প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)


মৃণালের কথা

বিপিনচন্দ্র পাল

         [ লেখক পরিচিতি : বিপিনচন্দ্র ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দের ৭ই নভেম্বর শ্রীহট্টের (অধুনা বাংলাদেশ) হবিগঞ্জ জেলার পৈল গ্রামে একটি হিন্দু বৈষ্ণব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন| পিতা রামচন্দ্র পাল জমিদার ছিলেন| বিপিনচন্দ্র প্রথমে মৈলবীর কাছে ও পরে শ্রীহট্টের ইংরেজী বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন| ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দে তৃতীয় বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন| পরে চার্চ মিশন সোসাইটি কলেজে (এখনকার সেণ্ট পল্‌স ক্যাথেড্রাল মিশন কলেজ) এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে দু'বছর পড়ে গণিতের জন্য আই.এ. পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারেন নি| বৈষ্ণব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও ব্রাহ্ম পরিবারে তার যাতায়াত ছিল এবং ১৮৭৭ খ্রীষ্টাব্দে শিবনাথ শাস্ত্রীর অনুপ্রেরণায় কেশবচন্দ্র সেনের কাছে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হন; কিন্তু পিতা এর ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং বিপিনচন্দ্র ত্যাজ্যপুত্র হন| ১৮৭৯-তে কটকের একটি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ গ্রহণ করেন কিন্তু মতান্তর ঘটায় সে পদ ত্যাগ করেন| সাহিত্য এবং ইংরেজী ভাষায় তার দখল ছিল অসাধারণ| বাঙ্গালোরেও তিনি শিক্ষকতা করেছেন| তার নিজস্ব চিন্তা ও আদর্শে তিনি ছিলেন অবিচল| ব্যক্তি জীবনেও এর প্রতিফলন ঘটেছে| ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে বোম্বাই-এর এক বাল বিধবাকে তিনি ব্রাহ্মমতে বিবাহ করেন| স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় বার দার পরিগ্রহ করেন|

           কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরীতে গ্রন্থাগারিক হিসাবে কাজ করার সময় বিপিনচন্দ্র বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসেন এবং শিক্ষকতা ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে দেশের কাজ করতে মনস্থ করেন| ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দে বৃত্তি নিয়ে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব পড়তে অক্সফোর্ডে ভর্তি হতে বিলেত যাত্রা করেন| অক্সফোর্ডে এক বছর কাটিয়ে দেশে ফিরে ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই আগস্ট 'নিউ ইণ্ডিয়া' নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন| বাল গঙ্গাধর তিলক, লালা রাজপৎ রাই, অরবিন্দ, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রভৃতি মনীষীদের সান্নিধ্যে এসে তিনি দেশপ্রেম ও আধ্যাত্মিকতায় উদ্বুদ্ধ হন| বঙ্গভঙ্গ উপলক্ষ্যে সুরেন্দ্রনাথের অনুগামী হয়ে তিনি বিভিন্ন সভায় উদ্দীপনাময় বক্তৃতা করেন| তার বাগ্মীতা ছিল অসাধারণ| ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দের ৬ই আগস্ট ইংরেজী দৈনিক পত্রিকা 'বন্দে মাতরম' প্রকাশিত হলে তিনিই প্রথম সম্পাদক হন| পরে সম্পাদক হয়েছিলেন অরবিন্দ ঘোষ| পত্রিকাটির শিরোনামে লেখা থাকত 'India for Indians' অরবিন্দের সঙ্গে তার কিছুটা মতান্তর হলেও, রাজদ্রোহিতার অপরাধে অরবিন্দ গ্রেপ্তার হলে মামলায় সাক্ষ্যদান করতে অস্বীকার করায় বিপিনচন্দ্র কারারুদ্ধ হন| স্বরাজের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে ১৯০৭ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণ ভারতে তার প্রদত্ত ভাষণের প্রভাবে সেখানকার জনসাধারণ যথেষ্ট উদ্দীপ্ত হয়েছিল| ১৯০৮-এ তিনি দ্বিতীয়বার বিলেত যান এবং 'Swaraaj' ও 'Indian Student' নামে দু'টি পত্রিকা প্রকাশ করেন| কিন্তু সেখানে পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশের জন্য দেশে ফিরেই গ্রেপ্তার বরণ করেন| বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় বহু লেখা প্রকাশ করে তিনি মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করেছেন| তিনিই প্রথম গান্ধিজীর বিরোধিতা করেন কিন্তু এতে তিনি যথেষ্ট সমালোচিত হন এবং বিরোধিতার সম্মুখীন হয়ে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে যেতে মনস্থ করেন| তিনি স্ত্রী শিক্ষা এবং স্ত্রী পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাসী ছিলেন| মতাদর্শের দিক থেকে তিনি ছিলেন চরমপন্থী 'লাল-বাল-পালে'র (লালা লাজপৎ রাই, বালগঙ্গাধর তিলক ও বিপিনচন্দ্র পাল) অন্যতম|

              ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হলেও পরে তিনি বৈষ্ণবমতের অনুরক্ত হন এবং বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন| শেষ জীবনে বিপিনচন্দ্র যথেষ্ট আর্থিক কষ্টের সম্মুখীন হন|
বিপিনচন্দ্রের প্রকাশিত গ্রন্থ : ‘শোভনা’ (উপন্যাস, ১৮৮৪) ; ‘ভারত সীমান্তে রুশ’ (১৮৮৫) ; ‘প্রমদাচরণ সেনের জীবনী’ (১৮৮৭) ; ‘মহারাণী ভিক্টোরিয়ার জীবন বৃত্তান্ত’ (১৮৮৯) ; ‘সুবোধিনী’ (১৮৯২) ; ‘ভক্তি সাধনা’ (১৮৯৪) ; ‘ব্রাহ্মধর্ম্ম জাতীয় ও সার্বভৌমিক’ (১৮৯৫) ; ‘জেলের খাতা’ (১৯০৮) ; ‘চরিতচিত্র’ (১৯১৬) ; ‘সত্য ও মিথ্যা’ (১৯১৬) ; ‘প্রবর্ত্তক বিজয়কৃষ্ণ’ (১৩৪১) ; ‘নবযুগের বাংলা’ (১৩৬২) ; ‘মার্কিনে চারি মাস’ (১৩৬২) ; ‘রাস্ট্রনীতি’ (১৩৬৩) ; ‘সাহিত্য ও সাধনা’ (১৯৫৯) ; ‘সত্তর বৎসর’ (আত্মজীবনী, ১৯৬২) ; ‘Indian Nationalism’ (লণ্ডন, ১৯০৯) ; ‘The New Spirit’ (১৯০৮) ; ‘Introduction to the Study of Hinduism’ (১৯০৮) ; ‘The Soul of India’ (১৯১২) ; ‘Nationality and the Empire’ (১৯১৬) ; ‘Annie Besant, a Psychological Study’ (১৯১৭) ; ‘Indian Nationalism its Principles and Personalities’ (১৯১৮) ; ‘Sri Asutosh Mukherjee’ (১৯১৯) ; ‘Srikrisna’ ; ‘The World Situation’ ; ‘Non Co-operation’ ; ‘The Goal and the Way’ ; ‘Bengal Vaisnavism’ ; ‘Responsible Government’ ; ‘The new Economic Menace to India’ ; ‘The Basis of Social Reform’ ; ‘Swaraj the Present Situation’ ; ‘Swaraj - what it is and How to obtain it’ ; ‘The people of India’| ‘রাজা রামমোহন রায়ের ইংরেজি গ্রন্থাবলী’ নামে একটি গ্রন্থও সম্পাদনা করেছেন বিপিনচন্দ্র| ‘বন্দে মাতরম’ (১৯০৬) ; ‘Swaraaj’ (লণ্ডন, ১৯০৯) ; ‘Independent’ (১৯২০) ; ‘Benagalee’ (দৈনিক) ; ‘paridarshak’ (শ্রীহট্ট, সাপ্তাহিক (১৮৮০) ; ‘সোনার বাংলা’ (১৩৩২-৩৪) পত্রিকার সম্পাদক এবং ‘Bengal Public Opinion, Calcutta’ (১৮৮৩-৮৪) ; ‘Tribune’ (লাহোর, ১৮৮৭-৮৮) পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসাবেও কাজ করেছেন|
             ১৯৩২ খ্রীষ্টাব্দের ২০শে মে বিপিনচন্দ্রের মৃত্যু হয়|]    

                                                                                                দীপক সেনগুপ্ত|

 

     ভগিনীর পত্র
   মেজ দাদা,

     তোমার চিঠি পাইলাম| মৃণালের পত্রখানাও পড়িলাম তুমি ভাবিও না| আমি তারে বেশীই চিনি, তোমার চাইতে বোধ হয় বেশীই চিনি| দিন কতক যদি তারে না ঘাঁটাও, সে আপনি ফিরে আসবে|
লেখার ঢংটা দেখেও কি বুঝনি ও চিঠি তার নিজের নয়| তুমি রাগ ক'রো না, তার বিদ্যা কত, আমরা তো জানি| দেখ্‌ছো না কি, যে সব বইএর কথা গেঁথে গেঁথে মেজ'বউ এই চিঠিটা সাজিয়েছে| আমি ভাব্‌ছি সে অমন চিঠিটা তোমায় পাঠালে কেন? তা না করে', কোন ভাল মাসিক কাগজে পাঠিয়ে দিলে তার লেখার তারিফ বেরোত', কালে জানি কি একজন বড় লিখিয়ে বলে লোকে তাকে জান্‌ত| আমার দুঃখ হয়, আমরা দুই ভাই-বোন আর উনি ছাড়া অমন একটা বড় লেখা বাংলার সমজদার পাঠকের কেউ পড়্‌লে না|
আমার সন্দেহ হয়, এ চিঠিটা সত্যি সত্যি মেজ্‌বউর লেখা কি না| তার যে ভাইটার কথা লিখেছে, তাকে তো তুমি বেশ জান| শুন্‌ছি সে নাকি একজন ভারি লিখিয়ে হয়ে উঠ্‌ছে| শুঁড়ওয়ালা নাগরা জুতা পায় দেয়, চুড়িদার জামা পরে, আর কবিদের মতন বাব্‌রী চুল রেখেছে| শুনেছি রবিঠাকুরের সঙ্গেও নাকি খুবই জানাশুনা আছে| তার নামসহি ছবি পর্য্যন্ত বাক্সে আছে, বন্ধু বান্ধবদের দেখিয়ে বেড়ায়| সে'ই হয়তো এ চিঠিটা লিখে দিয়েছে| লেখার খুব বাহাদুরি আছে, উনি পড়ে বল্লেন যে ঠিক রবি ঠাকুরের মতন| তুমি জান কি? মেজ' বউই আমায় লিখেছিল যে "সঞ্জীবনীতে" স্নেহলতা ছুঁড়িটার যে চিঠি বেরিয়েছিল, সেটা নাকি এই ছোঁড়াটারই লেখা, স্নেহলতার নাম জাল করে ছাপিয়েছে| আমাদেরো পড়েই তাই মনে হয়েছিল| হিন্দুঘরের মেয়ে, যতই জ্যাঠা হোক না কেন, অমন চিঠি লিখ্‌তে পারে না|

       দেখ্‌ছো না, মেজ'বউএর চিঠিও এই ছাঁচেই ঢালা| আমরাও তো তোমাদের কল্যাণে একটু আধটু বাংলা শিখেছি, কিন্তু অত বড় বড় কথা তো কৈ জুটাতে পারি না! আর অত পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে লেখা! উনি বল্লেন আগা গোড়া যেন ইংরেজির তর্জ্জমা| মৃণাল কবিতাই লিখুক আর যাই করুক, ইংরেজিও পড়েনি, বিলেত টিলেতও যায় নি| সে অমন ইংরেজি ঝাঁঝের বাংলা লিখ্‌তে শিখ্‌লে কেমন করে, উনি কিছুতেই ঠাওর কর্ত্তে পাল্লেন না| আমি মুখ্‌খু মানুষ, কি আর ব'ল্‌ব?
        তুমি বল্‌'বে ইংরেজি হো'ক, বাংলা হো'ক, লেখাটা তো মৃণালের; ভাষাটা যারই হো'ক না কেন, মনের ভাবটা তো তার নিজের! আমি বলি, তাও নয়| ভাষা, ভাব, সব ধার করা, নাটুকে জিনিষ| দেখ্‌ছ না, ও কোথায়, কোন্‌ নাটকে, কি কোন্‌ গানে, মীরাবাই' এর কথা পড়েছে, আর অম্‌নি ভাব্‌ছে যে, সে মীরাবাই হয়েছে| উনি বল্লেন, ভক্তমালের যখন আবার নতুন সংস্করণ হবে, তখন মেজ'বউ-এর কোনও কবি-ভক্ত নিশ্চয়ই, মীরাবাই-এর কথার পরে, তার কথাটাও বসিয়ে দেবে| এ চিঠিটা তারই আয়োজন হচ্ছে| তামাসা কচ্ছেন না, সত্যি হতে পারে| তবে তুমি মাঝখানে পড়ে বাগড়া দেবে, ওঁর ঐ যা ভয়|
        উনি বল্লেন, এ চিঠিটা আর কিছু নয়, কেবল হিষ্টিরিয়া| ওঁদের ডাক্তারী কেতাবে না কি লেখে হিষ্টিরিয়াতে এ সব হয়| এমন কি, অমন যে রক্তমাংসের মান্‌ষের পীঠটা, তাও নাকি একেবারে কাচের হয়ে যায়| উনি বলেছিলেন যে ডাক্তারী বইএতে নাকি এ ধরনের একটা মেয়ের কথা আছে; তার বিশ্বাস হয়েছিল যে, তার পীঠটা কাচের হয়ে গেছে| তামাসা করে একজন তার পীঠে চাপড় মারাতে, "পীঠ গুঁড়ো হয়ে গেল" বলে চীৎকার করে সে মেয়েটা তখনি মারা যায়| হিস্টিরিয়াতে এতটা নাকি হয়| মেজ'বউএর এও এক রকমের হিস্টিরিয়া| তার খেয়াল হয়েছে যে, সে কারার বন্দিনী, আমাদের বাড়ীটা একটা জঘন্য জেলখানা, তোমরা সবাই কারারক্ষক| আমাদের বাড়ীর উঠানটা তো নেহাৎ ছোট নয়,-আমার শ্বাশুড়ী তোমার বে'র সময় গিয়ে ঐ উঠান দেখে আশ্চর্য্য হয়ে গেছলেন,-পাড়াগাঁয়েও অমন দৌড়দার উঠান কম, কলকাতার তো কথাই নাই| কিন্তু এত বড় উঠানটা মেজ'বউএর চোখে কত ছোট ঠেক্‌ছে! আমাদের ঘরগুলো কেমন বড় বড়, উত্তর দক্ষিণ খোলা, সাহেবদের ঘরের মতন অমন সাজান না হলেও কেমন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, মেজে গুলো আয়নার মতন চক্‌ চক্‌ ক'চ্ছে| আর বড় বৌএর যে শুচিবাই, রাতদিনই তো কেবল জল ঢাল্‌ছেন, আর দুটো ঝির পেছনে পেছনে ঘুরে ঘষাচ্ছেন ও মাজাচ্ছেন, এমন সাফশুফু ঘরদোর সকলের বাড়ীতে দেখা যায় না| কিন্তু অমন ঘরেও মেজ'বউএর মন উঠে না| কিন্তু মেজ'বউএর কোনও দোষ নাই| মেজ'বউ তো আর চোখ দিয়ে কোনও জিনিষ দেখে না| তার খেয়ালে যখন যেটা যেমন ঠেকে সেটাকে তেম্নি দেখে| উনি বলেছিলেন যে, সব কবি আর ঋষিদেরও নাকি ঐ রকম স্বভাব|
        একদিনের কথা তোমায় বলি; এ কথাটা নিয়ে আমরা কত দিন হেসে হেসে গড়াগড়ি দিয়েছি| সে বারে আমি পূজার সময় তোমাদের ওখানে ছিলাম| তুমি ছুটিতে কোথায় বেড়াতে গিয়েছিলে| তখন বছর পাঁচ ছয় বোধ হয় মেজ'বউএর বে' হয়েছে| আমি মেজ'বউএর ঘরেই শুতাম| একদিন, ঘোর আঁধার রাত, আকাশে ঘন মেঘ, বাহিরে গিয়ে হাত বাড়ালে হাত দেখা যায় না| অনেক রাত অবধি আমি বড়'বউএর কাছে বসে গল্পগাছা কচ্ছিলাম| শু'তে গিয়ে দেখি, মেজ'বউ জানালার পাশে বসে ঐ অন্ধকার পানে তাকিয়ে আছে| বল্লাম "রাত অনেক হয়েছে, মেজ'বউ শু'তে এসো|" মেজ'বউ আমায় বল্লে কি জান?-"ঠাকুর ঝি, দেখ এসে কেমন সুন্দর চাঁদ উঠেছে| ঐ আমবাগানে যেন রূপো গালিয়ে ঢেলে দিয়েছে, আকাশে যেন রূপালী রং মাখিয়ে তাল নীলবরণকে একেবারে ঢেকে ফেলেছে| মরি, মরি, কি সুন্দর!"
        আমি চম্‌কে উঠ্‌লাম, বল্লাম "বলিস্‌ কি মেজ'বউ? এ যে ঘোর আঁধার রাত| কাল বাদে পরশু কালীপূজা| চাঁদ পেলি কোথায়? তোর অত রসের ঢেউ আজ উঠ্‌ল কিসে?"
        মেজ'বউ একেবারে চটে উঠে বল্লে, "ঠাকুর ঝি, তোমার আক্কেল কেমন? অমন ত্রিদিববন্দ্য চন্দ্রমাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাসা কচ্ছো? না তোমার চোখের মাথা খেয়েছ?"
       আলোটা একটু উষ্কিয়ে দিয়ে কাছে গিয়ে দেখ্‌লাম মেজ'বউএর চোখের ভাবটা সহজ মানুষের মতন নয়| প্রাণ শুকিয়ে গেল| তবে কি শেষে পাগল হ'লো! হঠাৎ তার বিছানায় দিকে চেয়ে দেখি, মেজ'বউ এক নতুন কবিতা লিখেছে-
               চাঁদনি রজনী,                আও-লো সজনি,
                           চাহলো নয়ান মেলি|
               আম্র কানন,                  মর্ম্ম মন্থন
                           নর্ম্ম পরাণ কেলি|
               শুভ্র উজল,                   অভ্র কাজল
                           উছল ভুবন ভরি|
               মঞ্জীর মুকুরে,                শিঞ্চিত নূপুরে
                       রঞ্জল কিবা মরি!
          তখন আমার ঐ ডাক্তরী বইএর কথা মনে পড়লো| ভাব্‌লাম এ খেয়ালটা তার যেমন আছে থা'ক| জোর করে ভাঙাতে গেলে হয় তো উল্টা উৎপত্তি হবে| তাই ভেবে বল্লাম
       "তাই তো মেজ'বউ, আমার কি ভ্রমই হয়েছিল? সত্যই তো বড় সুন্দর চাঁদনি রাত| তবে জানই তো, উনি কালীপূজার সময় আমায় নিয়ে যেতে আস্‌বেন, তাই ভেবে ভেবে কালই বুঝি অমাবস্যা তাই মনে হচ্ছিল| আমি বিরহে অন্ধ হয়ে গেছিলুম, তাই অমন জোছনা রাতও চোখে আঁধার ঠেক্‌ছিল|"
         মেজ্‌বউএর মুখখানি অমনি প্রফুল্ল হয়ে উঠলো| জানালা থেকে লাফিয়ে উঠে এসে, আমায় একেবারে জড়িয়ে ধরে বল্লে,-
"ঠাকুর-ঝি, তুমি তবে প্রেম তা' কি জান? আমি ভাবতাম তুমি কেবল রান্নাবান্নাই কর, আর স্বামিপুত্রকে খাইয়ে দাইয়ে এ দাসীত্বেই অমন নারীজন্মটা খোয়াচ্ছো| বাঙ্গালীর মেয়ে খাঁচার পাখী, তারা কি বনের পাখীর সুর কখনও ভাঁজতে পারে? কেবল বাঁধাবুলিই তো কপ্‌চায়, দেখি! বনের গান একেবারে ভুলে গেছে| হায় বনের পাখী হলাম না কেন?"
         আমি কি আর বলব? তামাসা করে বল্লাম-
       "তোর চকা তো এখন আকাশে উড়ছে; বাসায় ফিরে এলে বলিস্‌, তোরে উড়িয়ে নিয়ে বনে যাবে|"
এই চিঠি পড়ে আমার সেই কথা মনে পড়্‌ল| এও তার খেয়াল| কবিতাগুলো কি সে সঙ্গে নিয়ে গেছে, না সত্যিই পুড়িয়ে ফেলেছে? ও জিনিষ পুড়ান যায় না| দেখ দেখি, কোথাও রেখে গেছে কি না? যদি রেখে গিয়ে থাকে, তবে খুঁজে দেখ, ঐ কৃষ্ণপক্ষের জোছনার বর্ণনার মতন বিন্দির সম্বন্ধেও অবশ্য দু-দশটা পাবে|
          তুমি তো তাকে জান| পনর বছর তাকে নিয়ে ঘর কর্‌ছ| সে যে তোমায় ছেড়ে বেশি দিন ঐ নীল-সমুদ্র আর আষাঢ়ের মেঘপুঞ্জ নিয়ে থা্‌কতে পারবে তা ভেব'না| সত্যি জিনিষে তার মন উঠে না| ছেলেবেলা থেকে সে তাই ছোট যা তাকেই বড় আর বড় যা তাকেই ছোট করে ভেবেছে| তোমার বাড়ী থেকে তোমার শ্বশুরবাড়ী কত দূর তুমি জান| শ্যামপুকুর আর টালা দু-দশ দিনের পথ নয়| সেকেন-ক্লাস গাড়ীতে আধ ঘন্টা লাগে| কিন্তু বাপের বাড়ী ও শ্বশুরবাড়ী অত কাছাকাছি এটা ভাব্‌তে মেজ'বউএর ভাল লাগ্‌ত না| তোমারই মুখে শুনেছি, তাই সে কোনও দিন সোজা সুজি বাপের বাড়ী যাতায়াত করে নি| শিয়ালদ'এ রেলে চেপে দমদম গিয়ে নেমেছে; সেখান হ'তে ছ্যাকড়া গাড়ীতে টালায় গিয়েছে| একবার-তোমার মনে আছে কি?-সেবারে বর্ষাকালে আমি তোমাদের দেখ্‌তে যাই| মে'জবউএর ভাইপোর ভাত| কিন্তু সে কিছুতেই গাড়ীতে বাপের বাড়ী যাবে না| শিয়ালদ'এ রেলে চেপেও যাবে না| বলে-বর্ষাকালে বধূরা নৌকায় বাপের বাড়ী যায়, সব কেতাবে লেখে| গাড়ীতে বরষার অভিসার কোন, কালে কেউ লেখে নাই| যদি যাই, তো নৌকায় যাব| এক রাত নৌকায় শোব| চড়ায় নৌকা লাগিয়ে ভাত রেঁধে খাব| মাঝিগুলো ক্যাঁৎ ক্যাঁৎ করে দাঁড় টানবে আর ভাটিয়াল গাইবে| কোট করে বস্‌ল| কি কর, তুমিও তা'তেই রাজী হলে| শোভাবাজারে গিয়ে সন্ধ্যা বেলা নৌকায় উঠলে, বাগবাজারে এসে রাত্রে রান্নাবান্না কল্লে, পরের দিন প্রাতে শ্যামবাজারের পোলের কাছে নৌকা লাগিয়ে, পাল্‌কী করে তাকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ী গেলে! এ সকল জেনে শুনেও তুমি অমন অস্থির হয়েছ কেন?

          আমাকে পুরী যেতে বল্‌ছ, আমি এক্ষণি যেতাম| কটক থেকে পুরী তেমন দূরেও নয়; কিন্তু গেলে উল্টা ফল হবে| আমি আমার ঠাকুরপোকে পাঠাচ্ছি, সে মেজ'বউকে চোখে চোখে রাখ্‌বে আর প্রতিদিন আমাকে খবর দিবে| উনি তা'কে একটা খাতা করে দিয়েছেন| বল্লেন, "তুই সর্ব্বদা সঙ্গে থাক্‌বি আর এই খাতায় ডায়রী রাখ্‌বি| আর রাত্রে ডায়রীটার নকল পাঠাবি|
মেজদাদা তুমি নিশ্চিন্ত থাক, আমরা থাক্‌তে মেজ'বউএর কোনও বিপদ ঘট্‌বে না|

 

দ্বিতীয় অধ্যায়


ঠাকুর পো'র পত্র

[১]

       বউ দিদি,
     এই তিন দিন তোমাকে কোনও খবর দেই নাই; খবর দিবার কিছু ছিল না| তোমার মেজ'বউ যে বাড়ীতে ছিলেন, আমি এসে দেখ'লাম সেখানে নাই| সে এক পাণ্ডার বাড়ী| কোথায় যে উঠে গেছেন, তাও সে কথা বল্‌তে পারলে না|
      তোমায় যে খুড়িমার সঙ্গে তোমার মেজ'বউ পুরী এসেছিলেন, এখন তিনি দেশে ফিরে গেছেন| তোমার মেজ'বউকে যাবার জন্য শুন্‌লাম অনেক পীড়াপীড়ি করেন, কিন্তু তিনি কিছুতেই যেতে রাজি হন নি| ওদিকে তাঁর পৌত্রটীর বড় অসুখ, খবর পেয়ে বেচারী আর থাক্‌তে পাল্লেন না| তোমার মেজবউ তাঁর ভাইকে নিয়ে সেই পাণ্ডার বাড়ীতেই রয়ে গেলেন, বল্লেন যখন জগন্নাথ এনেছেন, তখন রথযাত্রা না দেখে যাব না| তোমার খুড়িমা চলে গেলে, পরের দিনই তোমার মেজ'বউ সে পাণ্ডার বাড়ী থেকে কোথায় উঠে গেছেন, তারা কেউ জানে না| তবে বল্লে, স্বর্গদ্বারে নাকি একটা বাড়ী ভাড়া করেছেন|
       তোমার মেজ'বউকে যদি আমি জান্‌তাম বা তার ভাইএর নামটাও যদি বলে দিতে, তা হলে স্বর্গদ্বারে গিয়ে খুঁজে বের করা কিছুতেই কঠিন হ'ত না| কিন্তু আমি তো তাঁকেও দেখিনি, তাঁর ভাইএর নামও তুমি বল নাই| তোমার দাদার নাম করে খোঁজ কর্‌তে পারতাম| কিন্তু তাতে পুলিশের গোয়েন্দাগিরি হত, তোমরা আমাকে যে গোয়েন্দাগিরি কত্তে পাঠিয়েছ তাহা হ'ত না| কাজেই সেটা করি নাই| ঘটনাক্রমে কোনও সন্ধান কর্‌তে পারি কি না, তাই দেখে দেখে কেবল স্বর্গদ্বারের পথে ঘাটে এই কটা দিন ঘুরে বেড়িয়েছি| তোমার আশীর্ব্বাদে সন্ধান পেয়েছি| আমার বাহাদুরী কিছুই নাই| কেবল ঘটনাচক্রেই এটী ঘটেছে|
আজ সন্ধ্যাবেলা সমুদ্রের ধারে বেড়াতে বেড়াতে একটী পরিচিত ছেলের সঙ্গে দেখা হলো| কলকাতায় যখন আমি Y,M,C,A. এর বোর্ডিংএ ছিলাম, তখন আমরা দুজনে একই ঘরে থাক্‌তাম| সে আজ তিন চার বছরের কথা| হঠাৎ আজ তাকে এখানে দেখ্‌তে পেলাম| বল্লে সে তার দিদির সঙ্গে স্বর্গদ্বারে আছে| সে আমায় কিছুতেই ছাড়্‌লে না-তাদের বাড়ী নিয়ে গেল| তার ঘরে ঢুকে দেখি একটা বিলাতী ট্রাঙ্কের উপরে তোমার দাদার নাম লেখা| বুঝলাম বিধি আজ সুপ্রসন্ন হয়েছেন| যা খুঁজছিলাম, তাই আপনি মিলিয়ে দিয়েছেন| সে আমায় কিছুতেই রাত্রে না খাইয়ে ছাড়লে না| তোমার মেজ'বউএর সঙ্গেও দেখা হল, সে'ই আলাপ করিয়ে দিয়েছে| তুমি যে আমার বউদিদি এরা কেউ জানে না|

        আজ এই পর্য্যন্ত| ক্রমে ক্রমে সব খবর পাবে এখন| তবে তোমরা যে প্রতিদিন একটা ডায়রী পাঠাতে বলেছ, তা কি দরকার? যে দিন কিছু বিশেষ বলবার থাকে সে দিনই চিঠি লিখ্‌ব| আর পুরীতে যারা হাওয়া খেতে আসে, তাদের ডায়েরী কিরূপ হবে, তা তুমিই জান| প্রাতে চা' পান| তারপর সমুদ্রের ধারে ভ্রমণ| তারপর গৃহে প্রত্যাগমন| নয়টার সময় নুনিয়ার আগমন| সাড়ে ৯টা হইতে ১১ টা সমুদ্রে স্নান ও নুনিয়ার হাত ধরিয়া ঢেউ খাওয়া ও সাঁতার কাটবার ভান করা| ১১টায় আহার| ৩টা পর্য্যন্ত নিদ্রা| ৪টায় চা পান বা জলখাবার| ৫টা হইতে ৮টা পর্য্যন্ত আবার সমুদ্রের ধারে বেড়ান| রাত্রে আহার ও তারপর শয়ন| তোমার মেজ'বউএর ডায়রীও ঠিক এই| এটা আমি তাঁর ভাইএর কাছ থেকে ইতিমধ্যেই বে'র করে নিয়েছি| সুতরাং প্রতিদিন এইরূপেই কাট্‌ছে, জানিয়া রাখিও| প্রতি রাত্রে পুরাতন কথা লিখে বেহুদা কাগজ ও কালি খরচ করার কোনও প্রয়োজন আছে কি? যদি থাকে, লিখিও, হুকুম তামিল কর্‌ব| এখন ধর্ম্মাবতারকে সেলাম করিয়া এ অধীনের তবে শয্যাশায়ী হইতে আজ্ঞা হয়|

[২]

     বউ দিদি,
     আজ একটা নূতন খবর আছে| শুনে তুমি খুশী হবে| তোমাদের খরচ বাঁচ্‌ল| আমি ভিক্টোরিয়া হোটেল ছেড়ে চলে এসেছি| শরৎ (তোমার মেজ'বউএর ভাইএর নাম শরৎ) ক'দিনই আমাকে তাদের সঙ্গে এসে থাকতে পীড়াপীড়ি কচ্ছিল| আমি রাজি হই নি| ইচ্ছা যে ছিল না তা নয়, কিন্তু নিজেকে অত সস্তা করাটা কিছু নয়. তুমি দাদাকে সর্ব্বদা এই কথা বল| তাই আমিও নিজেকে সস্তা কর্‌তে চাই নি| যা হউক কাল রাত্রে, তোমার মেজবউও বড় ধরে বস্‌লেন| তিনি আমাকে নরেন বলেই ডাকেন, আর আমিও তাঁকে দিদি বল্‌তে আরম্ভ করেছি| তাঁর অনুরোধ আর এড়াতে পারলাম না| তোমাদের কাজের অনুরোধেও এ আতিথ্যগ্রহণ করাই ভাল মনে কল্লাম| তোমার মেজ'দাদাকে লিখ, আমি তাঁর গিন্নিকে পাহারা দিচ্ছি| গোয়েন্দাগিরিটা জমছে ভাল|
       আচ্ছা, বউ দিদি, তোমরা তোমাদের মেজ'বউএর উপরে অমন নারাজ কেন? আমার তো তাঁকে বেশ ভালই লাগে| ভাল'র চাইতেও ভাল লাগে,-সত্যি বড় মিষ্টি লাগে| মুখে হাসি যেন লেগেই আছে| চালচলন অতি শোভন, চোখ দুটো ভাবে ঢল ঢল, নিজেকে সাজাবার কোনও চেষ্টা নাই, অথচ সাজা জিনিষটা যেন আপনি জোর করে এসে তাঁর অঙ্গে অঙ্গে বসে যায়| কথা অতি মিষ্টি| সমুদ্রের ধারে বেড়াতে গিয়ে এক এক বার কেমন উদাস পারা হয়ে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন,-দেখে আমার সেই কীর্ত্তনের পদ মনে পড়ে-
যোগী যেন সদাই ধেয়ায়!
        তোমাদের কত ভাগ্যি, অমন বউ পেয়েছ| দিন রাত কেবলই লিখ্‌ছেন আর পড়ছেন| আর তাঁর পড়বার ধরণটা বড় সুন্দর| সর্ব্বদাই পেন্‌সিল ও খাতা নিয়ে পড়তে বসেন; আর য্খন যেখানে মিষ্টি কথা পান, তাই টুকে রাখেন| আমায় বলেছিলেন এতে কবিতা লেখার নাকি খুব সুবিধা হয়| আমি জিজ্ঞাসা কল্লাম্‌, "কি করে সুবিধা হয়, দিদি?" বল্লেন্‌ "জান কি, বড় বড় কবিরা যেন এক এক জন ভারি রাজমিস্ত্রি| আর এই যে সুন্দর কথাগুলি এগুলি তাদের পঙ্খিরকাজের মালমসলা| ঐ মিষ্টি মিষ্টি কথা গুলো চুনে চুনে, "মোর," "হায়," "সখী," "সখা," "বঁধূ" প্রভৃতি মিষ্টি কথার বুক্‌নী দিয়া সাজা'লেই অতি সুন্দর কবিতা হয়|"

        আমিও এখন থেকে খাতা হাতে করে সব বই পড়ি| দেখ কি, তোমার মেজ'বউয়ের কল্যাণে হয় তো তোমার এই ঠাকুরপোও ক্রমে একটা কবি হয়ে উঠ্‌বে| বাঙ্গালা মাসিকে ছাপাবার মতন ভারি ভারি দু-দশটা এরি মধ্যে পকেটে জড় হয়েছে| গোয়েন্দাগিরি কর্‌তে এসে একেবারে একটা ডাকসই কবি হওয়া সকলের ভাগ্যে ঘটে না| তবে ভাগ্যি জিনিষটাই নাকি অন্ধ, তার গমনে নাইক কোন ছন্দ, আমার কপাল নহে নেহাৎ মন্দ; কর কি এখনও তুমি সন্ধ; তবে তোমার সঙ্গে আমার দ্বন্দ্ব; করিলাম এখানেই চিঠি বন্ধ|

[৩]

         বউ দিদি!
       তোমার শ্রীপাদপদ্মে কোটী কোটী প্রণাম করি| তুমি যদি মেম সাহেব হ'তে, তা হ'লে লক্ষ লক্ষ ধন্যবাদ তোমায় দিতাম| তোমার কল্যাণে এই গোয়ান্দাগিরি কর্‌তে এসে কি সুখেই দিন কেটে যাচ্ছে| তোমার ফরমায়েস খাট্‌তে হয় না, ছেলেদের পড়া বল্‌তে হয় না, আপিসে কলম পিসতে হয় না, ঘরে গিন্নির মুখ ঝামটা খেতে হয় না; দিনে শুতে পাই, ঝিমুতে হয় না; রাতে ঘুমুতে পাই, ছেলে বইতে হয় না; আর দিন রাত কবিতা শুন্‌তে পাই, দুনিয়াশুদ্ধ লোকের সঙ্গে বকাবকি কর্‌তে হয় না| আমার মনে হয়, স্বর্গে যারা যায়, তারা বুঝি এই ভাবেই দিন কাটায়| বস্তু যত সব ছায়া হয়ে গেছে, ছায়া যত সবই কেবল কায়া নয়, প্রাণী হয়ে উঠে, চারিদিকে ছুটাছুটি কচ্ছে| বিজ্ঞান পড়ে যা ভুল বুঝেছিলাম, সব এখন শুধ্‌রে যাচ্ছে| চোখ কাণ গুলোকে ফাঁকি দিয়ে এখন কেবল মন দিয়ে সব জ্ঞান আহরণ কর্‌তে শিখ্‌ছি| এ শিক্ষায় তোমার মেজ'বউ আমার গুরু হয়েছেন| সত্যি বল্‌ছি বউ দিদি, মানুষের মনটা যে কত বড় জিনিষ, এতদিন বুঝি নি| এই মনই ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর, সৃষ্টি ও প্রলয় কর্ত্তা| তোমার মেজ'বউএর মন ঠিক তাই|
      সে দিন আমরা নরেন্দ্রসরোবরের ধারে বেড়াতে গিয়েছিলাম| সেখানে একটি অতি সুন্দর মন্দির হয়েছে| তোমরা দেখ নি| মন্দিরের বাগানে বিস্তর আমগাছ আছে| একটা আমগাছে এই অকালেও নতুন লালপাতা গজিয়েছে| তোমার মেজ'বউ আমায় গাছটা দেখিয়ে বল্লে, "দেখেছ নরেন, ঐ গাবগাছে কেমন লাল পাতা বেরিয়েছে|"
      আমি বল্লাম-"গাবগাছ কৈ দিদি, ওটা যে আম গাছ!"
     দিদি বল্লেন-"আমগাছ, কখনই নয়; তুমিও এত বড় একটা মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত কচ্ছো?
আমাদের বাড়ীর দেয়ালের আড়ালে এরই মতন একটা গাবগাছ আছে, তার এই যৌবনের সাজ দেখে আমি বসন্তের সংবাদ পেতাম| আর তাকেই কি না তুমি বল্‌তে চাও, আমগাছ?"
       আমি তো একেবারে অবাক্‌ হয়ে গেলাম| ধীরে ধীরে বল্লাম, "একটু কাছে গিয়ে দেখুন, ওটা যে আমগাছ তা বুঝতে পার্‌বেন|"
      তোমার মেজ'বউ আরো গরম হয়ে উঠে বল্লেন-"কাছে গেলেই কি সত্য দেখা যায়? অন্ধেরা তো হাতিটাকে গিয়ে হাতড়িয়েছিল, কিন্তু তাকে সত্যিই দেখ্‌তে পেয়েছিল কি? দেখে চোখ নয়-মন, আর মনের নিকটে আবার কাছে আর দূরে কি? তুমি কি দেখে ওটাকে আমগাছ ভাব্‌লে, আমি বুঝতেই পাচ্ছি না| ওটা যদি আমগাছ হবে তবে তার ডালে ডালে কোকিল কৈ? ডগায় ডগায় ভৃঙ্গ কৈ? আকাশে আকাশে কুহু কুহু কৈ? ঘরে ঘরে উহু উহু কৈ? কেবল লাল পাতা দেখে ওটাকে আমগাছ ভাব্‌ছ, লালপাতা যে গাবগাছেও হয়|"
      বেগতিক দেখে বল্লাম "তুমি যখন বল্‌ছ, তখন গাবই হবে|"

     "গাবই বা হবে কেন, গাবই নিশ্চয়ই| ওটা যদি গাব না হয় তবে কবির দৃষ্টি কি মিথ্যা হবে?"
     আমি বল্লাম-"কখনই হতে পারে না| বিধাতা যে কবির চোখেই তাঁর জগৎকে দেখেন| তিনি তো কবি|"
     এতগুলি ধর্ম্মকথা বলে তবে প্রাণে বাঁচলাম| এবার থেকে তোমার মেজ'বউ যখন যা বল্‌বে, তা'তেই হুঁ দিয়ে যাব|

[৪]

       বৌ দিদি,
     আমার ছুটি তো ফুরিয়ে আস্‌ছে, আর কত দিন তোমার মেজ'বউকে পাহারা দিতে হবে? তোমার মেজদাদাকেই না হয় পাঠিয়ে দাও, গতিক বড় ভাল বোধ হচ্ছে না| যে কবিতার ঢেউ উঠ্‌ছে, তাতে তোমার মেজবউকে কোথায় নিয়ে যাবে, বলা যায় না| আর আমাকে পরের স্ত্রীর পাহারা দিতে পাঠিয়ে তোমার ঘরেও যে খুব শান্তি পাচ্ছ, তাও তো সম্ভব নয়| তবে একবার নাকি আমি আগুনের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাবার ফন্দিটা শিখেছিলাম, ঐ যা তোমাদের ভরসা|
      সত্যি বল্‌ছি আমার ভাব্‌না হয়েছে| তোমার মেজ'বউকে এই একমাসকাল দিনরাত দেখে দেখে, এতটাই চিনেছি বলে মনে হয় যে, বাহিরে তাঁর যতই কবিতা গজা'ক না কেন, ভিতরটা ঠিক্‌ আছে| সে ভাবনা আমার হয় না| তবে জান কি, ভিতর শুদ্ধ থাক্‌লেই যে বাহিরে কালির ছিটা পড়ে না বা পড়তে পারে না, তা নয়| ঐ ভয়টাই আমার বড় বেশী হচ্ছে| অথচ কেমন করে যে বেচারীকে বাঁচাই, ভেবে পাচ্ছি না| তারই জন্যে তোমাকে লিখ্‌ছি| নহিলে তোমাকেও লিখতাম না;-এ হব কথা কাউকেই বলা ভাল নয়| বলাবলিতেই যত গোল বাধে|
      আমার আরো বেশী বিপদ হয়েছে এই জন্য যে, শরৎ হঠাৎ কল্‌কাতায় চলে গেছে| বাড়ীতে তোমার মেজ'বউ, একটী বুড়ী চাকরাণী আর আমি, আমরা তিন প্রাণী মাত্র আছি| তার জন্যও আমি ভাব্‌তাম না| কিন্তু শরৎটা নাকি নেহাৎ গাধা, যাবার সপ্তাহ খানেক আগে একটা সাহিত্যিক বন্ধুকে এনে জুটিয়ে দিয়ে গেছে| এ ব্যক্তি নিতান্ত ছোক্‌রা নয়, বয়স তোমার মেজদাদারই মতন| বল্‌ছে তো যে বিলেত টিলেত ঘুরে এসেছে, কিন্তু ইংরেজি শুনে কথাটা বিশ্বাস কর্‌তে মন উঠে না| তবে ইংরেজ কবিদের নাম হামেষাই মুখে লেগে আছে|

      ইনি তোমার মেজ'বউকে, ব্রাউনীং বলে একজন খুব বড় ইংরেজ কবি আছেন, তাঁর কবিতার তর্জ্জমা করে পড়াচ্ছেন| এখন প্রতি দিন বিকেল বেলা সমুদ্রের ধারে গিয়ে দুজনে কবিতা পড়েন, আর এ গরিব পাহারাওয়ালা দায়ে পড়ে কাজেই সেখানে গিয়ে বসে বসে ঝিমোয়| আমি মুখ্‌খু লোক,-কেরাণীগিরি করে খাই, তার উপরে কোনও দিন জাহাজে চড়ি নি| কাজেই এই সাহিত্যিকবরের চক্ষে যে অতি নগন্য হ'ব, ইহা আর আশ্চর্য্য কি? তবে তোমার মেজ'বউএর একটা বড় বাহাদুরী দেখতে পেলাম| আমি যে তাঁর সোদর ভাই নই, তিনি ঘুণাক্ষরেও একথাটা এ ব্যক্তিকে জান্‌তে বা বুঝ্‌তে দেন নি| একদিন ও জিঙ্গেস কচ্ছিল-" শরৎবাবু, আর নরেনবাবু এঁদের মধ্যে বড় কে?" তোমার মেজ'বউ বল্লেন-"নরেনই বড় বটে, তবে পিঠোপিঠি বলে শরৎ ছেলেবেলা থেকেই কোনও দিন একে দাদা বলে ডাকে নি|" কথাটা শুনে অবধি তোমার মেজ'বউএর উপরে আমার ভক্তি বেড়ে গেছে| যতটা বোকা মনে হচ্ছিল, ততটা বোকা নন| কবিতাই লিখুন আর যাই করুন, ভিতরে ভিতরে বিষয়বুদ্ধিটুকু বেশ আছে|

[৫]

         তুমি বউ দিদি,
       ও লোকটার পরিচয় জানতে চেয়েছ| এ সব লোকের পরিচয় পাওয়া বড় কঠিন| বাংলা সাহিত্যে আজকাল বড় সাহিত্যিক যে কি করে গজিয়ে উঠে, ভগবান্‌ও তার ঠিক কর্‌তে পারেন কি না সন্দেহ| কবিতা যেমন এদের আকাশ থেকে ঝুর ঝুর করে পড়ে, এদের জন্মকর্ম্মটাও তেম্নি দিব্য ব্যাপার বলে মনে হয়| এঁকে আমরা কেবল মিষ্টার মৈত্র বলেই জানি| শরৎকে জিজ্ঞেস করছিলাম এঁর বাড়ী কোথায়, আছে কে, করেন কি, সে ওসব কথার কোনই উত্তর দিতে পার্‌লে না! বল্লে-"ও সব খবর সংসারের লোকেই রাখে| সাহিত্যজগৎ মনোজগৎ, ভাবরাজ্য; এখানে জন্মকর্ম্মের পরিচয় কেউ নেয় না, রসসৃষ্টির শক্তির প্রমাণ পরিচয়ই যথেষ্ট| মিষ্টার মৈত্রের লেখাই তাঁর শ্রেষ্ঠ পরিচয়|" এর উপরে তো আর কোনও কথা চলে না| কাজেই ইঁহার কোনও পরিচয় এ পর্য্যন্ত পাই নাই, পাবার আশাও রাখি না|
        তবে নামগোত্রের পরিচয় না পেলেও, কাব্যরসপটুতার পরিচয় প্রতিদিনই পাচ্ছি| সে পরিচয়টা তোমাকে দিতে পারি| কাল বৈকালে বৃষ্টি হচ্ছিল| কাজেই সমুদ্রের ধারে আমরা বেড়াতে যেতে পারি নাই| মিষ্টার মৈত্র এখানে বসেই তোমার মেজ'বউএর সঙ্গে সাহিত্য-চর্চ্চা কচ্ছিলেন| ইনি ব্রাউনীংএর একটা বাংলা অনুবাদ কচ্ছেন, তোমার মেজ'বউকে তাই পড়িয়ে শুনাচ্ছিলেন| ভুলক্রমে এখানেই সে অনুবাদটা ফেলে গেছেন, তার খানিকটা তোমায় পাঠাচ্ছি|
           ওগো সুন্দর মোর!
     ও বয়ানে তব, এ নয়ান মম
           পিয়ে পিয়ে হলো ভোর|
               ওগো সুন্দর মোর
     চোরের মতন কতই চাতুরী,
     গুপ্ত প্রেমের কিবা এ লহরী,
     নাচত আঁখিতে উঠত শিহরী
               সুখের নাহিক ওর!
                 ওগো সুন্দর মোর!
     ঘরের ভিতরে বসে যারা ঐ,
     ভাবিছে কাতরে গেল ওরা কৈ,
     কৌতুকে কপোল করে থৈ থৈ,
             বাহিয়া বাহিছে লোর|
                 ওগো সুন্দর মোর!
     আমরা দুজনে, বিজনে বিপিনে,
     নীপ মূলে এই, কিবা নিশি দিনে,
     বাঁধা আছি, নতু আঁধোয়া তু বিনে
               কে ভাঙ্গে মোদের জোড়?
                     ওগো সুন্দর মোর!
     তিলে তিলে গড়ি কতেক ছলনা,
     পলে পলে পরি শতেক গহনা,
     গাহি মূলতান, পূরবী সাহানা,
               কাটিছে রজনী ঘোর,
                     ওগো সুন্দর মোর!
     এ সুখ তেয়াগি, কোন্‌ সুখ লাগি,
     কোন্‌ মন্ত্র পড়ি, কি সিন্দুর দাগি'
     কিইবা সোহাগে, মিলিবে কি ভাগি,
                 কলা, মোচা, কিবা, থোড়!
                     ওগো সুন্দর মোর!
     আষাঢ় মাসের গুপ্ত অভিসার,
     ভৈরব ঐ নৃত্য বরিষার,
     মর্ম্ম বিদারি এ ঘরের ধার,
                 চর্ম্মে ঝুরিছে ঝোর!
                       ওগো সুন্দর মোর!
     ছাড়িয়া এ সব বিভব ছন্দে,
     ঘুরিয়া ফিরিয়া ভবের ধন্দে,
     কোন্‌ রূপে রসে, গরাশে গন্ধে
                   আনিবে আনন্দে তোর?
                       ওগো সুন্দর মোর!
     থাক্‌ তারা নিজ জগৎ লইয়া
     রান্ধিয়া বাড়িয়া, খাইয়া, শুইয়া,
     জীবনে মরিয়া মরমে মারিয়া
                     কেবলি ঘাঁটিয়া হোড়!
                       ওগো সুন্দর মোর!
     জান নাকি তুমি উহাদের রীতি,
     যশমান দিয়া কষয়ে পিরিতি
     ঝগড়া-ঝাটি হয় নিতি নিতি
                     ভাঙ্গাতে ভামিনী ভোর
                       ওগো সুন্দর মোর!
     নাহি সুতা হাতে, হলো কিবা তায়
     ও রীতি দেখিলে পিরিতি পালায়?
     দীপ্ত হৃদের মুক্ত হাওয়ায়
                     যুক্ত পরাণ-ডোর|
                       ওগো সুন্দর মোর!
      দাদাকে বলো, এর মূলটা ব্রাউনীংএর In a Balconyতে কোথাও নাকি আছে| মূলের সঙ্গে মিলুক আর নাই মিলুক অনুবাদের বাহাদুরী আছে বটে| আর সব চাইতে এর বাহাদুরী এই যে তোমার মেজ'বউকে এ কবিতাটায় একেবারে ক্ষেপিয়ে তুলেছে| তিনি বারবার এসে আমায় বলছেন "দেখ নরেন্‌, দেখ, কি সুন্দর শুনাচ্ছে-
               দীপ্ত হৃদের মুক্ত হাওয়ায়
               যুক্ত পরাণ-ডোর-

       লেখার কি ভঙ্গী, ভাবের কি গভীরতা| বাংলায় এক রবি ঠাকুর ছাড়া আর কেউ অমন লিখ্‌তে পারে না| তুমি তো ব্রাউনীং পড়েছ, ব্রাউনীং সত্যি কি এত মিষ্টি?" এর উত্তর আমি কি আর দিব| আমার কেবল ইচ্ছা হলো বউদিদি, ঐ মিষ্টার মৈত্রটাকে আমার এই জিমন্যাষ্টিকপটু মুষ্টিটা যে কত মিষ্টি তাই দেখিয়ে দি| সত্যি বল্‌ছি বউদিদি, এ লোকটা যদি শিগ্‌গির সরে না পড়ে, তবে কোন্‌ দিন যে আমার সঙ্গে একটা ফৌজদারী বেধে যাবে জানি না|

[৬]

         বউ দিদি!
       যা ভয় কচ্ছিলাম, তাই হয়েছে| আজ সন্ধ্যাবেলা জুতিয়ে ঐ লোকটার হাড় ভেঙ্গে দিয়েছি| বোধ হয় সে আর এখানে মুখ দেখাতে সাহস পাবে না| আজকের এই জুতাপেটাটা কেউ জানে না, কেবল আমার হাত জানে, আর জুতা জানে, আর ওর পীঠ জানে, আর কেউ জানে না; তোমার মেজ'বউও ভাল করে জানেন কিনা সন্দেহ| কিন্তু আমি তাকে বলে দিয়েছি, ফের যদি পুরীর সমুদ্রের ধারে দেখ্‌তে পাই, তবে সবার সাম্‌নে জুতাপেটা করে ছাড়্‌ব| সে পায়ে ধরে দিব্যি করে গেছে, আজ রাত্রেই পুরী থেকে চলে যাবে| আমার বিশ্বাস তাই করবে|
          কেন হলো, কিসে হলো, আমার নিজের মনে মনেও তার আলোচনা কর্‌তে ইচ্ছা হয় না; ভয় হয় বুঝিবা এ চিন্তাতেও তোমার মেজ'বউএর অকৈতব শুদ্ধ চরিত্রের মর্য্যাদা নষ্ট হয়| কিন্তু তোমাকে না বল্লে নয়| তোমার মেজ'বউ-এর প্রাণে যে আঘাত লেখেছে, তার ফল কি যে হবে, ভেবে পাচ্ছি না| এই আঁধার রাতে সমুদ্রে গিয়ে ঝাঁপ না দিলে বাঁচি| দিনরাত আমায় এখন তাঁকে খাড়া পাহারা দিতে হ'বে দেখ্‌ছি|
ঘটনাটা তোমায় লিখ্‌তেই হচ্ছে, কিন্তু আমার আদৌ ইচ্ছা নয় যে দাদাও এটা জানেন| আমরা পুরুষমানুষ, স্ত্রী-চরিত্র যে কিছুই বুঝি না, বউদিদি! তাই ভয় হয় দাদাও তোমার মেজ'বউ সম্বন্ধে সুবিচার কর্‌তে পারবেন না| যদি পার, তবে তাঁকে দেখিও না, তোমার মেজদাদার তো কথাই নাই| এই পত্রখানা পড়িয়াই পুড়াইয়া ফেলিবে|

         ঘটনাটা এই| কাল রাত্রে আমার একটু সামান্য জ্বর হয়েছিল; তাই আজ সন্ধ্যার সময় আর সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যাই নি| মিষ্টার মৈত্র অনেক অনুনয় বিনয় করাতে তোমার মেজ'বউ তাঁর সঙ্গেই সমুদ্রের ধাড়ে বেড়াতে গেলেন| আমায় বলে গেলেন যে বেশী দূরে যাবেন না, বাড়ীর সাম্‌নেই বেড়াবেন| তখন সবে রোদ পড়েছে| আমি দরজায় বসে দুজনায় বেড়াচ্ছেন দেখতে লাগলাম| ক্রমে অন্ধকার হয়ে এল| কাজেই আমি আর স্থির থাক্‌তে পারলাম না| তোমার মেজ'বউএর খোঁজে বেরুলাম| সমুদ্রতীরে গিয়া দেখ্‌লাম তিনি সেখানে নাই| ভারি মুষ্কিলে পড়লাম| কোন্‌দিকে গেলেন ঠাওর করতে পার্‌লাম না| কা'কেই বা জিজ্ঞাসা করি? এমন সময় একটী পরিচিত লোকের সঙ্গে দেখা হলো| তিনি বল্লেন-"আপনি যে আজ বড় পিছিয়ে পড়েছেন, আপনার ভগিনী চক্রতীর্থের দিকে যাচ্ছেন দেখলাম|" শুনে কি জানি কেন আমার বুকটা ধড়াশ করে উঠল| চক্রতীর্থ তো দোরের কাছে নয়| স্বর্গদ্বার চক্রতীর্থ দেড় ক্রোশের পথ| আর সন্ধ্যাবেলা সে অতি নিরালা স্থান| আমিও ঐ দিকেই বালি ভেঙ্গে ছুট্‌লাম| গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়্‌তে আরম্ভ করেছে| সমুদ্রতীর জনমানবশুন্য হয়ে পড়েছে| সারকিট্‌ হাউস ছড়িয়ে দেখ্‌লাম, আর কোথাও কেউ নাই| হঠাৎ যেন একটা অস্ফুট চীৎকার কাণে গেল| সেই শব্দ লক্ষ্য করে দৌড়ে গিয়া দেখলাম, ঐ লোকটা তোমার মেজ'বউকে অপমান কর্‌বার চেষ্টা কচ্ছে| আমি এক লাফে তার উপরে পড়ে তোমার মেজ'বউকে ছাড়িয়ে নিয়ে, তার গলায় চাদর কষে ধরে, পায়ের জুতা খুলে, গায়ে যত জোর ছিল তাই দিয়ে বেটাকে পিটুতে আরম্ভ কর্‌লাম| যখন ও একেবারে মাটিতে পড়ে গোঁগাতে লাগ্‌ল তখন ছাড়্‌লাম| তোমার মেজ'বউ একেবারে পাথরের মত নিশ্চল, অসাড় হয়ে এই ব্যাপার দেখ্‌ছিলেন| আমি কাছে যাবা মাত্র, মাটিতে পড়ে উপুড় হয়ে কাঁদতে লাগলেন| তোমার মেজ'বউ একটু সুস্থ হলে, তাঁকে নিয়ে বাড়ী এলাম| ক্রোধে, অপমানে, লজ্জায়, ভয়ে, অনুতাপে, তাঁর দশা যে কি হয়েছে বল্‌তে পারি না| এই আধ ঘন্টা কালের মধ্যে তাঁর মুখ একেবারে পাংশু হয়ে গেছে, চোখ বসে গেছে, মনে হয় যেন ছ মাসের রোগী| হঠাৎ মানুষের চেহারার অমন পরিবর্ত্তন হয়, ইহা জন্মে আর কখনও দেখি নাই| বাড়ী আসিয়া তোমার মেজ'বউ ঘরে যাইয়া দোরে খিল দিয়া শুয়ে পড়েছেন| আমি কি কর্‌ব, ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছি না| যে ঝিটী আছে, তাকে কোন কথা বল্‌তেও পারি না, নিজে যাইয়াও তাঁর সেবাশুশ্রূষা কর্‌তে পাচ্ছি না| হয়ত এই চিঠি পেতে না পেতেই তুমি এখানে আসবার জন্য আমার টেলিগ্রাম পাবে| কাল প্রাতঃকালের অপেক্ষায় বসিয়া রহিলাম|

[৭]

      বউ দিদি
     ভগবান্‌ বাঁচালেন| শরৎ আজ প্রাতে ফিরে এসেছে| তা'কে কালকার ব্যাপারের কথা কিছুই বলিনি| বলা যায় কি? সে ভাবছে তার দিদির অসুখ করেছে| অসুখও করেছে সত্যি| খুব জ্বর হয়েছে| মাথার খুব যাতনা| বিকার না হলে বাঁচি| দেখি ঠাকুর কি করেন| দাদাকে তোমার মেজ'বউএর অসুখের কথাটা বলে রেখো| বাড়াবাড়ি হলে আস্‌তেই হ'বে| তারে খবর দিব|

[৮]

       বউ দিদি,
     ঠাকুরের প্রসাদে আজ সাতদিন পরে তোমার মেজ'বউএর জ্বর ছেড়েছে| চেহারাটা একেবারে ভেঙ্গে গেছে, সে রং নাই, সে কোনও কিছুই নাই| চোখের ভিতরে কি যেন একটা কাতরতা জেগে উঠেছে| আজ বিকাল বেলা আমায় ডেকে জিঙ্গাসা করলেন-"শরৎ কোথায়?" আমি বল্লাম-"কিছু আঙ্গুর আর ডালিমের জন্য বাজারে গেছে; আর কলকাতা থেকে কিছু ফল আস্‌বার কথা, তাও এসেছে কিনা, দেখ্‌তে ষ্টেশনে যাবে|" তখন আমাকে কাছে ডেকে, বিছানায় বসিয়ে, আমার হাতখানা ধরে বল্লেন-"নরেন, তুমি আমার সত্য ভাইএর কাজ করেছে, তুমি না থাক্‌লে সেদিন আমার কি হ'তো জানি না| প্রথম দিন থেকেই আমি যে চোখে শরৎকে দেখ্‌তাম, সেই চক্ষে তোমায় দেখেছি| তাই শরৎ যখন কলকাতায় যেতে চাইলে, কোনও আপত্তি করি নাই| শরৎ আমার জন্য যা কর্‌তে পার্‌ত না, তুমি তাই করেছে, এ ঋণ জন্মে শোধ দিতে পারব না|" বলিতে বলিতে চক্ষু দুটা জলে ভরিয়া উঠিল| ক্রমে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বল্লেন-"শরৎ সব শুনেছে?"
      আমি বল্লাম "না| কিছুই শুনে নি| ওকি বলবার কথা? শরৎ কেবল জানে যে আপনার অসুখ করেছে|"
    "শরৎ তো আমায় 'আপনি' বলে না, তুমি বল কেন?"
     বউদিদি আমারও চক্ষে জল আসিল| একটু স্নেহের জন্য ঐ প্রাণটা যে কতই তৃষিত হয়ে আছে, দেখে আমার প্রাণটাও কেমন করে উঠল|
      বল্লাম "আচ্ছা আমি এখন থেকে তুমিই বল্‌ব| আর তুমিও শরৎকে যেমন কখন 'তুমি' কখন 'তুই' বল, আমাকেও তেমনি বল্‌বে?"
     "আমার অসুখ বাড়্‌লে তোমরা কি কর্‌তে বল তো?"
     "কর্‌ব আর কি, ভাল ডাক্তার ডেকে চিকিৎসা করাতাম|"
     "এখানে কি ভাল ডাক্তার আছে?"
     "এখানে নাই, কটকে আছে|"
     "সেখানে থেকে কি এখানে ডাক্তার আসে?"
     "আনালেই আসে|"
     "আমার তো অত টাকা নাই?"
     "যে ডাক্তার আস্‌ত সে টাকার জন্য আস্‌ত না|"
      "তবে কিসের জন্য?"
     "তুমি আমার দিদি, তারই জন্য আস্‌ত|"
     "সে ডাক্তার তোর কে হয় নরেন?"
     "তিনি আমার দাদা, কটকের সিভিল সার্জ্জন|"
     "তোমার দাদা কটকের সিভিল সার্জ্জন! তোমার দাদার নাম কি?"
      আমি দাদার নাম বল্লাম| তোমার মেজবউ অমনি চম্‌কে উঠে বল্লে, "উনি তোর দাদা!"
এই বলে চোখ দুটো আবার কাঁদ কাঁদ হয়ে উঠ্‌ল| এবার আমার পালা; বল্লাম-"আমার দাদাকে কি তবে তুমি চেন?"-একটু তামাসা করে বল্লাম-"তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে বুঝি বা কোনও দিন আমার দাদার সঙ্গে তোমার সম্বন্ধ হয়েছিল|" তোমার মেজ'বউ বড় বিষণ্ণ ভাবে বল্লে-"উনি আমার নন্দাই ছিলেন|"
     "ছিলেন মানে কি, দিদি? দাদার তো দুটো বিয়ে হয় নি, আর আমার বউ দিদি তো এখনও বেঁচে আছেন|"
     "তোর বউ-দিদিই আমার ননদ|"
     "তবে তুমি আমার দাদার শালাজ, আর এতদিন এই কথাটা লুকিয়ে রেখেছিলে!"
     "তুই যে ওঁর ভাই জান্‌ব কি করে?"
     "তা তো বটেই| যা হোক, এখন তো জানা শুনা হলো| আজই আমি বউদিদিকে আস্‌তে লিখব| কটক থেকে পুরী দু'তিন ঘণ্টার পথ বই তো নয়|"
     "না, না, তাকে লিখিস্‌ না| সে আস্‌বে না|"
     "আস্‌বে না? তাঁর ভা'জ এখানে বেয়ারাম হয়ে পড়ে আছেন, আর উনি আস্‌বেন না, অসম্ভব কথা| আমার বউদিদি তেমন লোক নন| আর বউদিদিকে লিখব্‌, তাঁর দাদাকেও যেন তারে খবর দিয়ে আনিয়ে নেন|"
      তোমার মেজ'বউ আর ধৈর্য্য রাখ্‌তে পাল্লেন না| একেবারে আমার দু হাত ধরে বল্লে-"না ভাই নরেন, তোর পায়ে পড়ি| অমন কর্ম্ম করিস্‌ না| আমি রাগ করে বাড়ী থকে বেরিয়ে এসেছি, তাদের আর এ মুখ দেখাতে পার্‌ব না|"
      শরৎ বলেছে তুমি তোমার খুড়শ্বাশুড়ীর সঙ্গে জগন্নাথ দেখতে এসেছিলে, রাগ করে এসেছ কে বল্লে?"
"কেউ বলে নি, আমি তো জানি|"
     "তোমার মনের কথা তো আর কেউ জানে না| লোকে জানে তুমি জগন্নাথ দেখ্‌তে এসেছিলে| এখন বাড়ী ফিরে যাবে| তাতে হলো কি?"
     "উনি জানেন|"
     "তা হলে উনি তোমায় নিতে আসেন নি, তার জন্য মিষ্টার মৈত্রের যে ব্যবস্থা করেছিলাম, তাঁরও সেই ব্যবস্থাই কর্‌ব|"
     নরেন, তুই আমায় ভালবাসিস্‌ বলে ওসব বল্‌ছিস| তুই জানিস্‌ না, আমি কি করেছি| আমি তাঁকে ত্যাগ করেছি|"
     আমি হোঃ হোঃ করে হেসে উঠ্‌লাম| "ত্যাগ করেছ কি করে? হিন্দুর শাস্ত্রে যে ডাইভোর্স নাই তা কি জান না?"
     "ডাইভোর্স কি রে?"
     "মুসলমানেরা যাকে তালাক বলে, ইংরেজেরা তাকেই ডাইভোর্স বলে| হিন্দুর স্ত্রী যে স্বামীকে তালাক দিতে পারে না|"
     কিন্তু আমি তো করেছি তাই|"
     "করেছ কি, খুলেই বল না, দেখি|"
     "ওঁকে লিখেছি, আমি আর ওঁর স্ত্রী নই|"
     "ঐ কথা! সব স্ত্রী তো রাগ করে ওকথা বলে|"
     "ঝগড়ায় মুখে ওকথা বলিনি, কোনও দিন ওঁর সঙ্গে আমার ঝগড়া হয় নি| তাই বুঝি ছিল ভাল|"
"তবে কি করেছ?"
     "আমি তাঁকে, শান্তভাবে ঠাণ্ডা হয়ে, চিঠি লিখেছি যে আমি তাঁর স্ত্রী নই|"
     "আবার একটা বে কর্‌তে বল নি তো?"
     "তা বল্‌তে যাব কেন| তাঁর ইচ্ছা হয় তিনি কর্‌বেন| সে দায় আমার নয়|"
     "ঐ দেখ, তুমি তাঁকে ছাড়নি; ছাড়্‌লে তাঁর বিয়ের কথায় অমন হয়ে ওঠ কেন?"
     "না নরেন, সত্যি আমি তাঁকে ছেড়েছি|"
     "তিনিও কি তোমায় ছেড়েছেন?"
       তাঁর ছাড়ার অপেক্ষা তো আমি রাখি নি|"
     "তবে তিনি যদি না ছাড়েন?"
     "তায় কি হয়, আমি যে তাঁকে ছেড়েছি|"
     "স্বামী স্ত্রীতে অত সহজে ছাড়াছাড়ি হয় না, দিদি| যে দেশে মাজিষ্টরের কাছে রেজিষ্টারী করে বিয়ে হয়, সে দেশে আবার মাজিষ্টরের কাছে গিয়ে রেজিষ্টারী থেকে নিজেদের নাম খারিজ কর্‌তেও বা পারে| হিন্দু তা পারে না| জান না দিদি, সাত পাক ঘুরে যে বে হয়, চৌদ্দ পাকেও তা খোলে না|"
"আমি যে তাঁকে ছাড়লাম বলে লিখেছি|"
     "লিখেছ তাতে হলো কি? ছেলেটা বেশী বিরক্ত কর্‌লে, মা যে কতবার বলে মর, মর; তাতে কি আবার সেই ছেলেকে বুকে টেনে রাখে না! আমাদের শাস্ত্রে বলে, রাগের মাথায় মানুষ যা বলে তাতে মিথ্যা বলার পাপ হয় না|"
     "আমি যে কি করেছি তুই জানিস্‌নে নরেন, নইলে অমন কথা ভাব্‌তে পার্‌তিস্‌ না|"
     "কি করেছ? ঝগড়াঝাটি করনি; মারধর করনি; একখানা চিঠি লিখেছ বই তো নয়?"
     "সে চিঠি দেখলেও কথা কইতিস্‌ না| চিঠিখানা দেখ্‌বি? ঐ বাক্সের ভিতরে তার নকল রেখেছি| বের করে নে|"
     চিঠিখানা পড়ে বল্লাম, "এই তো, অমন চিঠি আমরাও কত পাই| তাতে হয়েছে কি?"

     এমন সময় শরৎ এসে হাজির হলো|
     বিকাল বেলা তোমার মেজ'বউএর আর জ্বর আসে নি| এখানকার ডাক্তার বল্লেন, আর জ্বর হবে না| এখন ওঁকে বাড়ী পাঠাবার ব্যবস্থা কর্‌তে হবে|

[৯]

         বউদিদি,
       আজ একটা খুব নতুন খবর আছে| বিন্দু বলে যে মেয়েটা আত্বীয়স্বজনদের অত্যাচারে আত্মহত্যা করেছে শুনে তোমার মেজ'বউএর এই বিরাগ হয়েছিল, সে মরেনি| শরৎ কলকাতা থেকে সে খবর নিয়ে এসেছে| বিন্দু নিজেও তোমার মেজ'বউকে চিঠি দিয়েছে| কি সামান্য ভুল ভ্রান্তি ধরে বড় ট্র্যাজেডির (মাপ কর বউদিদি, ট্র্যাজেডির বাঙ্গ্‌লা আমি জানি না) সৃষ্টি হতে পারে, এই ঘটনায় তাই বুঝ্‌লাম| বিন্দু মরে নি| শরৎ বিন্দুর শ্বশুর বাড়ীর নম্বরটা ভুলে গিয়েছিল| তাই সেই গলিতেই আর একটা বাড়ীতে খোঁজ কর্‌তে গিয়ে জানে, সে বাড়ীর নতুন বউ কাপড়ে আগুন লাগিয়ে স্নেহলতার মতন আত্মহত্যা করেছে| ঐ খবর নিয়ে এসেই তো যত গোল বাধিয়েছে| বিন্দু কেবল মরে নি তা' নয়, এখন অতি সুখে আছে| তোমার মেজ'বউকে সে যে চিঠি লিখেছে, সেখানা নকল করে দিলাম, পড়ে দেখ| রাগ করো না, বউদিদি, বিন্দু যে প্রথমে অতটা গোল বাধিয়ে তুলেছিল, তা তোমার মেজ'বউএর শিক্ষারই গুনে, তাঁর নিজের স্বভাব-দোষে নয়| তোমার মেজ'বউ নিজে এখন এটা বুঝেছেন, নইলে আমি ওকথা কইতাম না| বিন্দু সর্ব্বদাই নিজেকে বড় নিষ্পীড়িত মনে কর্‌ত| তোমার মেজ"বউই এভাবটা তার প্রাণে বেশী করে জাগিয়ে দেন| আর যে আপনাকে সর্ব্বদাই নির্য্যাতিত ও নিষ্পীড়িত ভাবে, তার দ্রোহিতা অবশ্যম্ভাবী| সব বিদ্রোহীর ভিতরকার কথাই এই| বিন্দুর কথাও তাই| তোমার মেজ'বউএর কথাও তাই| বিন্দু এখন এরোগমুক্ত হয়েছে; তোমার মেজ'বউও ঠাকুরের কৃপায় আরোগ্যর পথে দাঁড়িয়েছেন|

 

তৃতীয় অধ্যায়


বিন্দুর পত্র

       শ্রীশ্রীচরণেষু,
     দিদি আমি মরি নাই| তোমরা যে খবর পেয়েছিলে সেটা মিছে কথা| আমি যে দিন আবার আমার শ্বশুরবাড়ী ফিরে আসি, তার দুদিন পরে, আমাদের পাশের বাড়ীতে একটী বউ কাপড়ে কেরোসিন দিয়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করে| তারও নাম বিন্দু ছিল| ওরা আমাদেরই জ্ঞাতি| তারও এই দু'তিন মাস আগে বে হয়| এরই জন্য আমিই মরেছি বলে কথাটা রটে যায়| দিদি আমি মরি নি| আর এমন সুখে আছি যে মর্‌বার কোন সাধ আমার আর নাই|
       ঐ মেয়েটা যখন পুড়ে মরে, আমি দেখেছিলাম| আমার শোবার ঘরের পাশেই ছাদ, আর তার পরেই ওদের ছাদ| তখন রাত দুপোর হবে| আমরা তার চীৎকারে জেগে উঠে, দৌড়ে বাহিরে গিয়ে দেখি, মেয়েটার চারদিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠেছে, আর সে "বাবা গো, আমি মরবো না, আমি মরবো না"-বলে বিকট চীৎকার কচ্ছে| তার মুখের সে ছবি আমার প্রাণের ভিতরে কে যেন ঐ আগুন দিয়ে দেগে দিয়েছে| যখনই মনে হয়, সর্ব্বাঙ্গে ঘাম ছুটে, এত ভয় হয়| আমি ঐ দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ি| উনি আমাকে কোলে করে ঘরে এনে বিছানায় শুইয়ে, চোখে মুখে জল দিয়ে, সারা রাত বাতাস করে, কত রকমে ভুলিয়ে ভালিয়ে আমার ঐ ভয়টা তাড়াতে চেষ্টা করেন| আমি শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়্‌লাম; আর উনি, ছেলে ভয় পেলে মা যেমন তার গায়ে হাত দিয়ে তাকে ঘুমাতে দেয়, তেম্নি করে সারারাত জেগে আমার গায়ে হাত রেখে, আমার মাথায় বাতাস করে, পাহারা দেন| ভোর বেলা চোখ মেলে দেখি, এইভাবে বসে আছেন| দিদি, তোমার আশীর্ব্বাদে আমি বড় সুখে আছি|
       তুমি আমার দুঃখ অনেক দেখেছ, আমার সঙ্গে সঙ্গে অনেক কেঁদেছ, আমাকে মা'র পেটের বোনের মতন ভাল বেসেছ| জন্মে আমি তার আগে অমন আদর ও ভালবাসা পাই নাই| আর তুমি অমন করে ভালবাস্‌তে বলেই আমার বিয়ে করতে এত অনিচ্ছা ছিল| তোমার ঐ আদর ছেড়ে পরের বাড়ী যেতে একেবারেই মন চাইল না| তাই তোমার পায়ে ধরে কত কেঁদেছিলাম, বলেছিলাম আমার বিয়ে দিও না, দাসী করে নিজের কাছে রাখ| আমার রূপ নাই জান্‌তাম| সবাই বল্‌ত অমন কাল মেয়ের কি আবার ভাল বে হয়? আমার বাপ মা নাই| টাকা কড়ি নাই| শুন্‌তাম একরাশ টাকা নইলে কোনও বে হয় না| তাই আমার যখন বিয়ের সম্বন্ধ এল, তখন ভাব্‌লাম যে এর ভিতরে অবশ্য একটা কিছু ভারি গলদ আছে; নইলে অমন কাল মেয়েকে, অমন মাবাপখেগো গরিব মেয়েকে বিয়ে কর্‌তে চায় কে? তই ভয় হচ্ছিল, কোথায় যাচ্ছি| মনে মনে ভাব্‌লাম অমন কাল মেয়েকে যে বিয়ে কর্‌তে রাজি হয়, না জানি সে কত কুৎসিত| আমার মনের কথা কেউ জানে না, দিদি, কেবল এই আজ তোমায় বল্‌ছি| তোমায়ও এসব কথা কোনও দিন কইতাম না, যদি ঠাকুর আমার ভাগ্যে এত সুখ না লিখ্‌তেন| সুখ পেয়েছি বলেই আজ দুঃখের কথা কইতেও আমার সুখ হয়| কি বল্‌ছিলুম? হাঁ, ঐ আমার বের রাতের কথা| মনে মনে আমার স্বামী অতিশয় কুৎসিত হবে ভেবে রেখেছিলুম বলে, শুভদৃষ্টির সময় আমি জোর করে চোখ দুটাকে চেপে রেখেছিলুম| ছেলেবেলা আঁধার রাতে ঘরের বাহিরে গেলে ভূতের ভয়ে যেমন চোখবুজে থাকতাম, তেমনি করে চোখ বুজে রইলাম| তার পর বাসর ঘরে গিয়ে আমার ভয় আরও বেড়ে গেল| গল্প শুন্‌তাম বাসর ঘরে কত লোক থাকে, কত রং তামাসা হয়, আমার বাসরে সে রকম কিছুই হলো না| একজন বুড়ী আমার হাত ধরে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে চলে গেল| তার পরে উনি উঠে দরজা বন্ধ করে দিলেন| আমি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলাম| মুখে কাপড় মুড়ি দিয়ে বিছানার এক পাশে কাঠ হয়ে পড়ে রইলাম| একবার আমার হাত খানা এসে ধরলেন, তার পরেই ছুড়ে ফেলে গর্‌গর্‌ কর্‌তে কর্‌তে উঠে গেলেন, আর সারা রাত ঐরূপ গর্‌গর্‌ করে করে পাইচারি করে কাটালেন| মাঝে একবার মনে হল যেন, অনেকগুলি কাচের বাসন ছাতে ছুড়ে ফেলে চুরমার করে ফেল্লেন| আমি বুঝলাম এ ব্যক্তি পাগল| তার পর দিন যখন খেতে বসেছি, অমনি তেড়ে একেবারে সেখানে এসে উপস্থিত হলেন; আর ভাতের থালা ছুড়ে ফেলে, উনুনে জল ঢেলে, হেঁসেলের ভাতবেন্নুন সব জুতা শুদ্ধ পায় লাথি মেরে চারিদিকে ছড়িয়ে চলে গেলেন| আমি দেখে শুনে ভয়ে ভয়ে প্রাণের দায়ে তোমার কাছে পালিয়ে এলাম| তার পর কি হলো তুমি জান| তুমি আমার রাখ্‌তে চেয়েছিলে| কিন্তু আমার ভাশুর যখন নিতে এলেন, তখন দেখ্‌লাম তোমাদের বিপদ হ'তে পারে, তাই তাঁর সঙ্গে ফিরে গেলাম| এবারে গিয়ে ওঁর সঙ্গে আমার দেখাই হয় নি| আমি চলে এসেছি শুনে উনিও বাড়ী ছেড়ে চলে যান| তার পর যখন শুনলাম, আবার ফিরে এসেছেন, তখন আমার পিত্তি শুকিয়ে গেল| আই আবার পালিয়ে আমার খুড়ভাত ভাইদের ওখানে যাই| ওরা যখন কিছুতেই স্থান দিলে না, তখন কাজেই আবার ফিরে আস্‌তে হলো| আমার গাড়ী যখন দরজায় গিয়ে দাঁড়াল, তখন দেখ্‌লাম একটী নতুন লোক আমাকে গাড়ীর দরজা খুলে তুলে নিলেন| আমি ভাব্‌ছিলাম আমার শ্বাশুড়ী বা বাড়ীর ঝি-চাকরাণী বুঝি কেউ এসে দরজা খুল্‌ল; তাই নিঃসঙ্কোচে তার মুখের দিকে চেয়ে দেখ্‌লাম| দিদি, দেখলাম একজন অতি সুন্দর পুরুষ| যেমন মুখ, তেমনি রং, যেমন কোঁকড়া কাল চুল, তেমনি বড় বড় টানা চোখ, যেমন নাক তেমনি সব| পুরুষের অমন রূপ জন্মে দেখিনি| মিথ্যা বল্‌ব না, দিদি, দেখেই মনে হলো হা রে কপাল! অমন স্বামী যদি আমার হ'ত! আমি তাঁর পিছু পিছু অন্দর মহলে ঢুক্‌লাম| তখন ইনি ডেকে বল্লেন-"মা তোমার বউ এসেছে, আমার ঘরেই নিয়েই যাচ্ছি|" গলার স্বরে আমার সর্ব্বাঙ্গ কেমন করিয়া উঠিল| পা যেন আর চলে না| শরীরট যেন হঠাৎ ভারি হয়ে পড়্‌ল| মনে হলো যেন আমি ভেঙ্গে পড়্‌ছি| তখন তিনি আমার হাত ধরে একেবারে দুতালায় শোবার ঘরে নিয়ে গেলেন| যত্ন করে বিছানায় বসালেন| পাখা নিয়ে দাঁড়িয়ে বাতাস কর্‌তে লাগলেন| তার পর বল্লেন-অমন মিষ্টিভাবে জন্মে আমার সঙ্গে আর কেউ কথা কয়নি, দিদি, অভিমান করো না, তুমিও কইতে পারনি-"একবার এদিকে এস|" আমি যেন পুতুলবাজির পুতুল সেজেছি| অমনি ধীরে ধীরে উঠে তাঁর সঙ্গে গেলাম| বারান্দায় একখানা কাঠের চৌকি ছিল, আমায় সেখানে বসালেন| তার পর নিজে একঘড়া জল এনে আমায় পা ধু্‌তে দিলেন| আমি লজ্জায় মরে যেতে লাগ্‌লাম, কিন্তু বাধা দিবার শক্তি ছিল না| আমাকে হাতে মুখে জল দিতে বল্লেন, নিজে দাঁড়িয়ে সে জল ঢেলে দিলেন| তার পরে আবার ঘরে এসে, নতুন বাণারসী শাড়ী বের করে বল্লেন, "কাপড় ছাড়, তোমার ফুলশয্যার জন্য এখানি এনেছিলাম, আজই তোমার ফুলশয্যা|' এই বলে বারান্দায় গেলেন| আমি সেই শাড়ীখানি কোনও মতে পল্লাম| হাত পা কিছুই যেন আর আমার নিজের বশে নাই| আমার কাপড় ছাড়া হলে, এক বাক্স গহনা বের করে,-তোমার দেওয়া গহনাগুলি একে একে খুলে ফেলে, নিজের হাতে বালা, বাজু, অনন্ত, চিক, ইয়ারিং পর্য্যন্ত পরিয়ে দিলেন| কতক্ষণ যে এই গহনা পরাতে লাগল্‌, বল্‌তে পারি না| এক এক খানি গহনা পরাচ্ছেন, আর অনিমেষে খানিকক্ষণ সে অঙ্গটাকে দেখ্‌ছেন| এক এক বার মনে হতে লাগ্‌ল বুঝি এ ব্যক্তি সত্যি সত্যি পাগল| আবার মনে হতে লাগ্‌ল, দুনিয়ায় সব ভাল লোকের চাইতে আমার এ পাগলই ভাল, এ পাগলকে গলায় বেঁধেই আমি মর্‌ব| সব গহনা পরান শেষ হলে আমার মুখখানি তুলে ধল্লেন,-আমার তখন চোখ বুজে থাকাই উচিত ছিল, কিন্তু দিদি, পোড়া চোখ তা কল্লে না, চার চক্ষে মিলন হলো| এই আমাদের শুভদৃষ্টি| দিদি, আমার চোখ জলে ভরে আস্‌ছে, আমি যে কাল, আমি নাকি কুৎসিত, তবু ওঁর চক্ষে বুঝি বা আমিও বড় সুন্দর| নইলে ও চোখ আমায় দেখে অমন হয় কেন?
        দিদি, ইনি পাগল নন| ছেলে বয়সে একবার বড় মদ গাঁজা থেকে আরম্ভ করেন, তারই জন্য মাঝে ক'দিন একটু ক্ষেপে উঠেছিলেন সত্য| কিন্তু সে প্রায় দশ বার বছরের কথা| এখন তামাক পর্য্যন্ত ছোঁন না| তবে বড় বদ্‌রাগী লোক| রাগলে জ্ঞান থাকে না| আর, দিদি, যে রাগতে জানে না, সে তো পাথর, সে কি ভালবাসতে জানে? জান কি? আমায় বে কল্লেন কেন? স্নেহলতা মেয়েটা যখন আত্মহত্যা কল্লে, ঐ কথা শুনে তিনি প্রতিজ্ঞা কল্লেন যে, যার কোনও রকমে বরপণ দিবার সম্বল নাই, তেমন বাপের মেয়ে না পেলে বে করবেন না| তাই খুঁজে খুঁজে ঘটকী আমায় বের কল্লে| এ বিয়েতে তঁর বাপমায়ের আপত্তি ছিল| তাঁরা প্রথমে টাকা খুঁজছিলেন| যখন ছেলে পণ নিয়ে বে কর্‌বেই না কোট করে বস্‌লো, তখন আর কিছু না হউক যার দুপয়সা আছে, বারমাসে তের পার্ব্বণে তত্ত্ব পাঠাতে পার্‌বে, এমন ঘরের মেয়ে বে করুন, তাঁরা তাই চাচ্ছিলেন| কিন্তু উনি এতেও নারাজ হলেন| তাতেই বাপ বেটাতে ঝগড়া হয় ও বাপ ছেলের বিয়েতে থাকবেন না বলে কাশী চলে যান| আমার শ্বাশুড়ী বাড়ী ছেড়ে গেলেন না বটে, কিন্তু আমি যে কুলীনের মেয়ে এ অপরাধটা ভুল্‌তে পাল্লেন না| তারই জন্য আমাকে হাড়ীবাগ্দীর মেয়ের মতন পিতলের থালাতে ভাত দিয়েছিলেন| হয় তো ভেবেছিলেন, অতি গরীবের ঘরের মেয়ে, তাতে আবার বাপ মা নাই, এরূপেই বুঝি আমি লালিতপালিত হয়েছি; তারই জন্য উনি অমন রেগে উঠেছিলেন| মাকে তো আর কিছু মুখে বল্‌তে পারেন না, তাই কতকটা আমার উপর দিয়ে, আর কতকটা থালাবাসন ও হাঁড়ী-কুড়ির উপরে দিয়ে সে রাগটা চালিয়ে দিলেন| আর উনি যে সব গহনা দিয়েছিলেন, ওঁর মা আমায় সেগুলি পরিয়ে দেন নি বলে বিয়ের রাতে অমন করে রেগে গিয়েছিলেন|
        দিদি, আমি ভাবি, তোমরা যদি আমায় সত্যি সত্যি রাখ্‌তে, আমার খুড়তুত ভাইয়েরা যদি আমায় স্থান দিত, আর একমুঠা ভাত যেখানেই হউক আমার মিল্‌তই-তাতে আমার কি সর্ব্বনাশই হতো| অমন দেবতার মতন স্বামীকে পেতাম না| আর স্বামীকে পেয়েছি বলে, শ্বশুর, শ্বাশুরী সবাইকে পেয়েছি| ভাশুর, জা, ভাশুর-পো, ভাশুর-ঝী, সকলে আমার কতই আপনার হয়ে গেছে| দিদি, আমি নিজেকে ওদের সেবায় নিযুক্ত করে, ওদের মাঝে আপনাকে হারিয়ে ফেলেছি| এখন আর আমার নিজের কোনও দুঃখ নাই| সুখ আমার উপ্‌চে পড়্‌ছে| দিদি, অনেক দিন তোমার বুকে মাথা রেখে আমি আমার ছোট্ট দুঃখের কান্না কেঁদেছি, আজ বড় সাধ যায়, ঐ বুকে ছুটে গিয়ে এইবার আমার সুখের কান্না কাঁদি| আমার দুঃখে চিরদিন দুঃখ পেয়েছ, এবার আমার সুখ দেখে সুখী হও|

        শুন্‌লাম আমি মরেছি শুনে তুমি বিরাগী হয়ে শ্রীক্ষেত্রে চলে গেছো| আমি যখন সত্যি সত্যি বেঁচে আছি, তখন তুমি আর ঘর বাড়ী ছেড়ে থাক্‌বে কেন? আর মরেই কি কখনও তোমার দুঃখে আমার সুখ হতো? স্বামীর কোলে মাথা রাখাতে যে কি সুখ, তা তো তুমি জান| তুমি আমার জন্য এই স্বর্গসুখও ছেড়েছ, শুনে অবধি আমার নিজের সুখ যেন আধখানা হয়ে গেছে| তুমি শিগ্‌গির ফিরে এস| তোমায় বড় দেখ্‌তে ইচ্ছে করে| লক্ষী দিদি আমার, শিগ্‌গির ফিরে এস| আমার কোটী কোটী প্রণাম জানিবে|
                                     তোমারই সেবিকা
                                             বিন্দু|

 

চতুর্থ অধ্যায়


মেজ'বউএর পত্র

       ঠাকুর-ঝি,
     তোমার চিঠি পেলাম| তোমার ঠাকুর-পোর কথা কি আর লিখ্‌ব, আমার জন্য সে যা করেছে, শরৎ তা কর্‌তে পার্‌ত না| ভগবান্‌ তাকে এনে জুটিয়েছিলেন বলেই তোমার মেজ'বউ এখনও বেঁচে আছে|
     আমাকে তোমার ওখানে যেতে বল্‌ছ| আমি কি করেছি তা জান্‌লে এ পোড়ারমুখীর মুখ আর দেখ্‌তে চাইতে না! অমন দেবতার মতন স্বামী, তাঁকে কতই না অনাদর, কতই না অপমান করেছি| শাস্ত্রমতে আমি পরিত্যক্তা| কারণ অপ্রিয়ভাষিণী স্ত্রীকে তৎক্ষ্ণাৎ পরিত্যাগ কর্‌বে, শাস্ত্রে এই কথাই বলে|
       আমি তোমার দাদাকে পরিত্যাগ করেছি| তিনি আমায় ছাড়েন নি, আমিই ছেড়ে এসেছি| আমি তীর্থ করতে আসি নি, ওটা একটা ছুতা মাত্র| আমি আর তোমাদের সম্পর্ক রাখ্‌ব না বলে এসেছি| স্ত্রীলোকের মনের যে অবস্থা হলে আজকাল তারা নিজের কাপড়ে আগুন লাগিয়ে পুড়ে মরে, আমি সেই মন নিয়ে বাড়ী ছেড়ে আসি| মর্‌তে সাহস হয় নি বলে মরি নি| সতী স্ত্রী আপনি মরে, আমি তা করি নি, স্বামীর ভালবাসাটাকে হত্যা কর্‌বার চেষ্টা করেছি|
       ঠাকুর-ঝি, তোমরা সতী সাধ্বী, আমি যে তোমাদের অস্পৃশ্যা| আমায় মাপ কর| আমি তোমাদের কাছে এ মুখ দেখাতে পার্‌ব না|
     স্বামীপুত্র নিয়ে সুখে থাক, এই প্রার্থনা করি|
পঞ্চম অধ্যায়
ঠাকুর-পোর পত্র
       বউ দিদি,
     আমি তো কিছুতেই তোমার মেজ'বউকে বাড়ী ফিরে যেতে রাজি করাতে পাল্লাম না| তোমাকেই আস্‌তে হবে| তোমার দাদা যদি আসেন, আরও ভাল হয়| তোমাদের প্রতীক্ষায় রইলাম|
ষষ্ঠ অধ্যায়
ঠাকুর-ঝীর পত্র
         মেজ'বউ,
       তুমি যখন এলে না, আমরাই তখন যাচ্ছি| মেজদাদাকেও লিখেছি, তিনি রবিবারে এখানে আসবেন| উনিও শালাজকে দেখ্‌তে যাবেন| তিন দিনের ছুটী নিয়েছেন| আমরা তিন জনে সোমবার প্রাতে তোমার দোরে গিয়ে অতিথি হবো| জ্ঞাতার্থে নিবেদনমিতি|
সপ্তম অধ্যায়
আবার স্ত্রীর পত্র
            শ্রীশ্রীচরণকমলেষু,
         ঠাকুর-ঝীর পত্রে জান্‌লাম, এই সোমবারে তুমি এখানে আস্‌বে| তোমার পায়ে পড়ি, এস না-আমিই যাচ্ছি-আমার জন্য এই কষ্ট স্বীকার করে, এ হতভাগিনীকে আর নতুন করে অপরাধিনী করো না|
তুমি এস না বল্‌ছি; কিন্তু তোমার কাছে কোনও কথা গোপন কর্‌ব না| তুমি আস্‌বে শুনে আমার প্রাণটা যে কি করে উঠ্‌ল, তোমায় বুঝাতে পার্‌ব না| তুমি আস্‌বে বলেই আমি ফিরে যেতে সাহস পাচ্ছি| নইলে বাকি জীবন হয় তো এমনি করে এই তুঁষের আগুনে পুড়ে মর্‌তে হতো| তুমি আস্‌ছ শুনে বুঝ্‌লাম তুমি তোমার এ কুলত্যাগিনী স্ত্রীকে পরিত্যাগ কর নি| আজ ঈশ্বরের দয়াতে আমার সত্য বিশ্বাস জন্মাল| লোকে যতই পাপ করুক না কেন, তিনি যে কাউকে ছাড়েন না, তোমার এ ক্ষমা দেখে তাই বুঝ্‌লাম|
          আর, সত্যি বল্‌ছি, ঈশ্বর কে, তা তো আমি জানি না| এক জন মনগড়া ঠাকুরের পায়ে এতকাল জীবনের সুখদুঃখের কথা বলেছি, কিন্তু এত দিন পরে আমার সত্য ঠাকুরকে আমি পেলাম|
         তোমায় যতদিন আমি কেবল আমারি মতন একজন মানুষ বলে ভাবতাম, ততদিন আমি আমার সত্য ঠাকুরকে পাই নাই| আর মানুষ ভেবেই তো তোমায় এত অযত্ন, এত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছি| পনর বছর কাল তোমার ঘর কল্লাম, কিন্তু একদিনও তোমার পানে তাকাই নাই, কেবল নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম| নিজের ক্ষুদ্র বুদ্ধির অহঙ্কারই করেছি, তোমার ঐ বিশাল জ্ঞানের দিকে তাকাই নাই; আপনার ভোগটাকেই বড় ভেবেছি, তোমার ত্যাগকে লক্ষ্য করি নাই; কেবল পাবার জন্যই ছটফট্‌ করেছি, কোনও দিন তোমায় সত্যভাবে কিছু দিই নাই| এবার এই কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে বুঝ্‌লাম, দিয়েই সুখ, পেয়ে নয়; ত্যাগেই শান্তি, ভোগে নয়| যে আপনাকে বড় করে, সেই ছোট হয়ে যায়, যে নিজেকে ছোট করে, সেই বড় হয়ে উঠে| আমি তোমার সঙ্গে টক্কর দিয়ে তোমার সমান হতে গিয়ে তোমাকেও ধর্‌তে পাল্লাম না, নিজেকেও রাখ্‌তে পাল্লাম না| আজ এই কলঙ্কের কালি মেখে, তোমার চরণের ধুলি হয়ে, তোমাকেও ধরেছি, নিজেকেও পেয়েছি| আমি বার বছরের ছোট্ট বালিকা তোমাদের এত বড় পরিবারের মধ্যে এসে পড়লাম| কিন্তু তোমাদের বিশালত্বের ভিতরে আপনার ক্ষুদ্রত্বকে হারাতে পাল্লাম না| লোকে বলত আমার রূপের কথা, অমন রূপ বাঙ্গালীর ঘরে হয় না-আমি তারই গর্ব্বে ফেঁপে উঠলাম| মা বাবা বলতেন আমার বুদ্ধির কথা, আমি সেই অহঙ্কারেই ঘট হয়ে বস্‌লাম| তুমি শিখালে আমায় লেখাপড়া, আমি তাই নিজেকে বিদ্বান্‌ ভেবে একেবারে টঙ্গে চড়িলাম| অন্য লোকে হলে কত ঝগড়াঝাটি হতো| কিন্তু তুমি একদিন একটা কড়া কথা পর্য্যন্ত বল নি| য্খন বড় অন্যায় করেছি, মুখখানা কেবল একটু ভারি হতো| এত করে তোমায় কষ্ট দিয়েও আমি যখন যা চেয়েছি তুমি তাই দিয়েছ| কোনও দিন কিছুতে 'না' করনি| 'না' কথাটা বিধাতা তোমায় শেখান নি| বাড়ীর যে যা ইচ্ছা তাই করে, তুমি কোনও দিন কারও ইচ্ছার প্রতিরোধ কর নি| আমি ভাবতাম তোমার পুরুষত্ব নাই| ভেবে দেখি নি যে, এই দুনিয়ার মালিক যিনি তিনিও তো অমনি ভাবেই চুপ করে বসে আছেন| তুমি ভাইদের মধ্যে সকলের চাইতে বেশী রোজগার কর; তুমি যদি কোনও বিষয়ে কথা কও, পরিবারে শান্তি থাক্‌বে না| যার যত শক্তি বেশী, যে যত কর্ম্মী বড়, সে তত চুপ করে থাকে| এই মোটা কথাটা আমি তখন বুঝি নি| আমি নিজেকে তোমা থেকে কেবলই আলাদা করে দেখ্‌তাম বলে, তোমার মহত্ব যে কত ও কোথায় তা বুঝ্‌তে পারি নি| তাই আমার এ দুর্গতি| আমি সব ছোট জিনিষকে বড় করে তুল্‌তাম. তাই তুমি যে অত বড় তা বুঝি নি, তোমাকেও ছোট বলে ভেবেছি| এই করে জীবনের এই পনর বছর খুইয়েছি| সব জীবনটাই খোয়াতে বসেছিলাম|
            আমার সকল অপরাধের কথা তো শুন নি| তোমাকে ছেড়ে এসে আমায় কি অপমান সহিতে হয়েছে, তুমি জান না| সে দিন যদি তোমার বোনের দেবর নরেন আমার খোঁজে এসে ঐ অপমান থেকে আমায় না বাঁচাত, তাহলে এই সমুদ্রেই চিরদিনের মতন মৃণাল ডুবে মরিত| অরক্ষিতা স্ত্রীর অঙ্গ পরপুরুষে স্পর্শ কল্লে অনেক স্বামী শুনেছি তাকে আর গ্রহণ করে না| অপরের কথা কি, স্বয়ং রামচন্দ্র পর্য্যন্ত কর্‌তে চান নি| আমায় কি তুমি গ্রহণ করবে? এই কথাটা তোমায় না বলে আমি তোমার কাছে যেতে পারি না|

           বড় সাধ হয়েছে এবার যদি তুমি এ কলঙ্কিনীকে আবার চরণাশ্রয় দাও তবে তোমার মধ্যে ও তোমার পরিবার পরিজনের মধ্যে একেবারে ডুবে গিয়ে এ নারী-জন্মটা সার্থক করি| বিন্দি আমাকে এই শিক্ষা দিয়েছে| সে নিজেকে নিঃশেষে বিলাইয়া দিয়া-সত্যকে পেয়েছে| আর আমি নিজেকে নষ্ট কর্‌তে বসে সত্যকে দেখেছি| তুমি আমায় রাখ বা ছাড়, যাই কর না কেন, আমি তোমারই চিরদিনের চরণাশ্রিতা|
                                                                       মৃণাল|

 

 ( ‘নারায়ণ’ পত্রিকা অগ্রহায়ণ সংখ্যা, ১৩২১| প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা )

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।