পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
পরকীয়া
বিপিনচন্দ্র পাল
[
লেখক পরিচিতি : বিপিনচন্দ্র ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দের ৭ই নভেম্বর শ্রীহট্টের
(অধুনা বাংলাদেশ) হবিগঞ্জ জেলার পৈল গ্রামে একটি হিন্দু বৈষ্ণব
পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন| পিতা রামচন্দ্র পাল জমিদার ছিলেন| বিপিনচন্দ্র
প্রথমে মৈলবীর কাছে ও পরে শ্রীহট্টের ইংরেজী বিদ্যালয়ে পড়াশোনা
করেন| ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দে তৃতীয় বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ
হন| পরে চার্চ মিশন সোসাইটি কলেজে (এখনকার সেণ্ট পল্স ক্যাথেড্রাল
মিশন কলেজ) এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে দু'বছর পড়ে গণিতের জন্য আই.এ.
পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারেন নি| বৈষ্ণব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও
ব্রাহ্ম পরিবারে তার যাতায়াত ছিল এবং ১৮৭৭ খ্রীষ্টাব্দে শিবনাথ
শাস্ত্রীর অনুপ্রেরণায় কেশবচন্দ্র সেনের কাছে ব্রাহ্ম ধর্মে
দীক্ষিত হন; কিন্তু পিতা এর ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং বিপিনচন্দ্র
ত্যাজ্যপুত্র হন| ১৮৭৯-তে কটকের একটি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের
পদ গ্রহণ করেন কিন্তু মতান্তর ঘটায় সে পদ ত্যাগ করেন| সাহিত্য
এবং ইংরেজী ভাষায় তার দখল ছিল অসাধারণ| বাঙ্গালোরেও তিনি শিক্ষকতা
করেছেন| তার নিজস্ব চিন্তা ও আদর্শে তিনি ছিলেন অবিচল| ব্যক্তি
জীবনেও এর প্রতিফলন ঘটেছে| ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে বোম্বাই-এর এক
বাল বিধবাকে তিনি ব্রাহ্মমতে বিবাহ করেন| স্ত্রীর মৃত্যুর পর
তিনি দ্বিতীয় বার দার পরিগ্রহ করেন|
কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরীতে গ্রন্থাগারিক হিসাবে কাজ করার সময়
বিপিনচন্দ্র বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসেন এবং শিক্ষকতা
ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে দেশের কাজ করতে মনস্থ করেন| ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দে
বৃত্তি নিয়ে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব পড়তে অক্সফোর্ডে ভর্তি হতে
বিলেত যাত্রা করেন| অক্সফোর্ডে এক বছর কাটিয়ে দেশে ফিরে ১৯০১
খ্রীষ্টাব্দের ১২ই আগস্ট 'নিউ ইণ্ডিয়া' নামে একটি সাপ্তাহিক
পত্রিকা প্রকাশ করেন| বাল গঙ্গাধর তিলক, লালা রাজপৎ রাই, অরবিন্দ,
সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রভৃতি মনীষীদের
সান্নিধ্যে এসে তিনি দেশপ্রেম ও আধ্যাত্মিকতায় উদ্বুদ্ধ হন|
বঙ্গভঙ্গ উপলক্ষ্যে সুরেন্দ্রনাথের অনুগামী হয়ে তিনি বিভিন্ন
সভায় উদ্দীপনাময় বক্তৃতা করেন| তার বাগ্মীতা ছিল অসাধারণ| ১৯০৬
খ্রীষ্টাব্দের ৬ই আগস্ট ইংরেজী দৈনিক পত্রিকা 'বন্দে মাতরম'
প্রকাশিত হলে তিনিই প্রথম সম্পাদক হন| পরে সম্পাদক হয়েছিলেন
অরবিন্দ ঘোষ| পত্রিকাটির শিরোনামে লেখা থাকত 'India for Indians'
অরবিন্দের সঙ্গে তার কিছুটা মতান্তর হলেও, রাজদ্রোহিতার অপরাধে
অরবিন্দ গ্রেপ্তার হলে মামলায় সাক্ষ্যদান করতে অস্বীকার করায়
বিপিনচন্দ্র কারারুদ্ধ হন| স্বরাজের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে ১৯০৭
খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণ ভারতে তার প্রদত্ত ভাষণের প্রভাবে সেখানকার
জনসাধারণ যথেষ্ট উদ্দীপ্ত হয়েছিল| ১৯০৮-এ তিনি দ্বিতীয়বার বিলেত
যান এবং 'Swaraaj' ও 'Indian Student' নামে দু'টি পত্রিকা প্রকাশ
করেন| কিন্তু সেখানে পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশের জন্য দেশে
ফিরেই গ্রেপ্তার বরণ করেন| বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় বহু লেখা প্রকাশ
করে তিনি মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করেছেন| তিনিই
প্রথম গান্ধিজীর বিরোধিতা করেন কিন্তু এতে তিনি যথেষ্ট সমালোচিত
হন এবং বিরোধিতার সম্মুখীন হয়ে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে যেতে
মনস্থ করেন| তিনি স্ত্রী শিক্ষা এবং স্ত্রী পুরুষের সমান অধিকারে
বিশ্বাসী ছিলেন| মতাদর্শের দিক থেকে তিনি ছিলেন চরমপন্থী 'লাল-বাল-পালে'র
(লালা লাজপৎ রাই, বালগঙ্গাধর তিলক ও বিপিনচন্দ্র পাল) অন্যতম|
ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হলেও পরে তিনি বৈষ্ণবমতের অনুরক্ত হন এবং
বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন| শেষ জীবনে বিপিনচন্দ্র
যথেষ্ট আর্থিক কষ্টের সম্মুখীন হন|
বিপিনচন্দ্রের প্রকাশিত গ্রন্থ : ‘শোভনা’ (উপন্যাস, ১৮৮৪) ;
‘ভারত সীমান্তে রুশ’ (১৮৮৫) ; ‘প্রমদাচরণ সেনের জীবনী’ (১৮৮৭)
; ‘মহারাণী ভিক্টোরিয়ার জীবন বৃত্তান্ত’ (১৮৮৯) ; ‘সুবোধিনী’
(১৮৯২) ; ‘ভক্তি সাধনা’ (১৮৯৪) ; ‘ব্রাহ্মধর্ম্ম জাতীয় ও সার্বভৌমিক’
(১৮৯৫) ; ‘জেলের খাতা’ (১৯০৮) ; ‘চরিতচিত্র’ (১৯১৬) ; ‘সত্য
ও মিথ্যা’ (১৯১৬) ; ‘প্রবর্ত্তক বিজয়কৃষ্ণ’ (১৩৪১) ; ‘নবযুগের
বাংলা’ (১৩৬২) ; ‘মার্কিনে চারি মাস’ (১৩৬২) ; ‘রাস্ট্রনীতি’
(১৩৬৩) ; ‘সাহিত্য ও সাধনা’ (১৯৫৯) ; ‘সত্তর বৎসর’ (আত্মজীবনী,
১৯৬২) ; ‘Indian Nationalism’ (লণ্ডন, ১৯০৯) ; ‘The New Spirit’
(১৯০৮) ; ‘Introduction to the Study of Hinduism’ (১৯০৮) ;
‘The Soul of India’ (১৯১২) ; ‘Nationality and the Empire’
(১৯১৬) ; ‘Annie Besant, a Psychological Study’ (১৯১৭) ; ‘Indian
Nationalism its Principles and Personalities’ (১৯১৮) ; ‘Sri
Asutosh Mukherjee’ (১৯১৯) ; ‘Srikrisna’ ; ‘The World Situation’
; ‘Non Co-operation’ ; ‘The Goal and the Way’ ; ‘Bengal Vaisnavism’
; ‘Responsible Government’ ; ‘The new Economic Menace to India’
; ‘The Basis of Social Reform’ ; ‘Swaraj the Present Situation’
; ‘Swaraj - what it is and How to obtain it’ ; ‘The people
of India’| ‘রাজা রামমোহন রায়ের ইংরেজি গ্রন্থাবলী’ নামে একটি
গ্রন্থও সম্পাদনা করেছেন বিপিনচন্দ্র| ‘বন্দে মাতরম’ (১৯০৬)
; ‘Swaraaj’ (লণ্ডন, ১৯০৯) ; ‘Independent’ (১৯২০) ; ‘Benagalee’
(দৈনিক) ; ‘paridarshak’ (শ্রীহট্ট, সাপ্তাহিক (১৮৮০) ; ‘সোনার
বাংলা’ (১৩৩২-৩৪) পত্রিকার সম্পাদক এবং ‘Bengal Public Opinion,
Calcutta’ (১৮৮৩-৮৪) ; ‘Tribune’ (লাহোর, ১৮৮৭-৮৮) পত্রিকার
সহ-সম্পাদক হিসাবেও কাজ করেছেন|
১৯৩২ খ্রীষ্টাব্দের
২০শে মে বিপিনচন্দ্রের মৃত্যু হয়|] দীপক
সেনগুপ্ত|
১
সেও
এই রকমই শরৎকাল| দেবী-পক্ষ আরম্ভ হইয়াছে| আমি প্রয়াগে গুরুদেবের
আশ্রমে তিন বৎসরান্তে তিন মাসের ছুটি লইয়া গিয়াছিলাম| আশ্রমটি
একেবারে গঙ্গার উপরে| বর্ষা সে বারে দেরিতে হয়| গঙ্গা কূলে ছাপাইয়া
উঠিয়াছে| আকাশ নির্ম্মল, জ্যোৎস্না না ফুটিলেও নক্ষত্রালোকে রাত্রি
উজ্জ্বল হইয়া আছে|
আমাদের নিয়ম ছিল, সন্ধ্যা আরতির পর, আহারান্তে সকলে দশটা না বাজিতেই
ঘুমাইয়া পড়িতাম| গুরুদেব জিতনিন্দ্র; শয্যা পাতিয়া ঘুমাইতেন না|
আসনে বসিয়াই সারারাত কাটাইতেন| তিনটা বাজিতে না বাজিতে আমরা সকলে
উঠিয়া, মুখ হাত ধুইয়া, তাঁর নিকটে যাইয়া বসিতাম| কখনও কথাবার্ত্তা
হইত, কখনও সঙ্গীত হইত, অধিকাংশ সময়ই নীরবে যে যার আসনে বসিয়া ইষ্টনাম
জপ করিতেন|
আমি ঘরে ঢুকিবার সময় দেখিলাম আমার গুরুভাই - শা সাহেব আনমনে বাহিরে
যাইতেছেন| ইঁহার প্রকৃত নাম কি জানিতাম না| ইনি জাতিতে মুসলমান|
গুরুদেবের কৃপা পাইয়া বহুদিন তাঁহারই নিকট ছিলেন| আমরা তাঁহাকে
শা সাহেব বলিয়া ডাকিতাম| কেহ কেহ বা হরিদাসও বলিতেন| গুরুভাইদের
মধ্যে গোঁড়া ব্রাহ্মনও দু'চার জন ছিলেন| তাঁরা শা সাহেবকে লইয়া
খাওয়াদাওয়া করিতে রাজি ছিলেন না| এই জন্য প্রথম হইতেই গুরুদেব
ইঁহাকে নিজের কাছে বসাইয়া খাওয়াইতেন| গুরুদেবের আসনের নিকটেই শা
সাহেব দিন রাত শুইয়া, বসিয়া কাটাইতেন| গুরুদেবের আশ্রমে ভোজনাগারে
যে যার জাত রাখিয়া চলিতেন; ভজনক্ষেত্রে কোনও জাতবর্ণের বিচার ছিল
না| গুরুদেব কহিতেন সাধন-ধর্ম্মে -
লোকের মধ্যে লোকাচার
সদ্গুরুর কাছে সদাচার -
ইহাই এই কথার সত্য অর্থ|
২
রাত্রি
পায় শেষ হইয়া আসিয়াছে, এমন সময় শা সাহেব ফিরিয়া আসিলেন| তাঁহাকে
দেখিয়াই গুরুদেব কহিলেন-"সে স্ত্রীলোকটিকে কোথায় রাখিয়া আসিলে?"
শা সাহেব চমকিয়া উঠিলেন| মুখে কথা সরিল না| আমরা সকলে আশ্চর্য্য
হইয়া গেলাম| শা সাহেবের ব্রত কি তবে ভঙ্গ হইয়াছে? আমাদের সাধনে
বেশি কিছু ধরা বাঁধা ছিল না| গুরুদেবের বিধি ছিল তিনটি-
১) নিত্য তিন বেলা নাম জপ করিবে|
২) প্রাতঃ-সন্ধ্যা অন্ততঃ পঁচিশ মিনিট
করিয়া প্রাণায়াম করিবে|
৩) সর্ব্বদা সাধু-সেবা করিবে|
সাধু কারা? এই প্রশ্ন তুলিয়া গুরুদেব কহিতেন যাদের দেখা মাত্র
অন্তরে ভগবদ্ভাব আপনা হইতে জাগিয়ে উঠে, তাঁরাই প্রকৃত সাধু| এখানে
আর কোনও ধর্ম্মাধর্ম্মের বিচার নাই|
গুরুদেবের-সাধনে নিষেধও ছিল তিনটি-
১) পরস্ত্রীর মুখ
দেখিবে না|
২) সুরাপান করিবে না|
৩) পরনিন্দা করিবে না|
এই নিষেধবাক্য মনে করিয়াই গুরুদেব
যখন এই গভীর রাত্রে শা সাহেবের নিকট অপরিচিতা স্ত্রীলোকের কথা
জিজ্ঞাসা করিলেন, তখন আমরা শিহরিয়া উঠিলাম| শা সাহেবের মতন নিষ্ঠাবান
সাধক আমাদের ভজনগোষ্ঠীতে আর কেউ ছিলেন না|
শা সাহেব কহিলেন-"প্রভু! আমি ব্রত ভঙ্গ করি নাই, তার মুখ
আমি দেখি নাই|"
গুরুদেব - "সে কথা জানি| তুমি
ত গুরুর কৃপায় জিতেন্দ্রিয় পুরুষ, ইহা কি আমার জানা নাই? কিন্তু
সে বেচারিকে কোথায় ফেলিয়া আসিলে?"
শা সাহেব-" সে আপনার পথে আপনি চলিয়া গিয়াছে|"
গুরুদেব - "সব ঘটনাটা খুলিয়া
বল| দেখছ না, এঁরা সকলে শুনবার জন্য উদগ্রীব হইয়া আছেন|"
শা সাহেব ধীরে ধীরে কহিতে লাগিলেন-
"প্রভো"! আপনি সর্ব্বজ্ঞ - আপনার অগোচর ত কিছুই নাই|
তবু আপনি যখন হুকুম কল্লেন, তখন সব খুলেই বলছি| আমি ত আপনার পায়ের
কাছেই বসেছিলাম| হঠাৎ প্রাণট বড় চঞ্চল হয়ে উঠল| মনে হলো কে যেন
ঘোর বিপদে পড়ে কাকে ডাকছে| আমি সে ডাকে অস্থির হয়ে উঠলাম| আমার
প্রাণের ভিতরেও কে যেন বার বার বলতে লাগল-জলদি যাও, জলদি যাও-নইলে
স্ত্রীহত্যার পাতকী হবে| তাই আমি দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে, যন্ত্রারূঢ়ের
মতন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম| সোজা একেবারে গঙ্গার ঘাটে গেলাম| গঙ্গা
প্রবলতরঙ্গে কূল ছাপাইয়া ছুটিয়াছে| ঘাট নির্জ্জন নিস্তব্ধ| কিন্তু
সামনে কে যেন ঝাঁপাইয়া পড়িবার উপক্রম করিতেছে| একটা কলসীতে জল
ভরিতেছে| দেখিয়া আমি লাফাইয়া পড়িয়া তাহার হাত ধরিলাম|" সে
বলিল-"তুমি কে?"
আমি - তুমি কে? আত্মহত্যা কচ্ছ কেন? জাননা এ বড় পাপ?
সে - পাপের জ্বালা জুড়াইতে
মরতে এসেছি| আমায় আটকাইও না|
আমি - পাপের জ্বালাটা কোথায়?
শরীরে না মনে?
সে - শরীর মন দুইই জ্বলে যাচ্ছে|
আমি - ঐ জ্বালাই পাপের প্রায়শ্চিত্ত|
মরতে গিয়ে প্রায়শ্চিত্তের ব্যাঘাত দিচ্ছ-দেখ|
সে - অত শত বুঝি না| আমায় মরতে
দাও| মরা ভিন্ন আমার গত্যন্তর নাই|
আমি - মরলেই কি জ্বালা যাবে?
পাপের জ্বালা ত স্মৃতির জ্বালা| মরলে কি পাপ ভুলে যাবে? একথা তোমায়
কে বল্লে?
সে - সে কি কথা? সব ভুলব, সংসার
আঁধার হবে, কাউকে দেখব না, করো কথা শুনব না-আর কেবল পাপের কথাই
মনে থাকবে? এই কি সম্ভব?
আমি - সাধু-শাস্ত্রে ত তাই
বলেন| মরণে সব নষ্ট হয়, কিন্তু স্মৃতি নষ্ট হয় না| ঐ পাপের স্মৃতিই
মরণের পরেও মানুষকে পুড়াইয়া প্রায়শ্চিত্ত মারে| এখানে তবু পাপের
প্রায়শ্চিত্ত আছে| যে আত্মহত্যা করে, তার ঐ মহাপাতকের প্রায়শ্চিত্ত
নাই|
সে - তবে আমি যাই কোথায়?
আমি - ঘরে ফিরে যাও|
সে - ঘর নাই|
আমি - আপনার জন যেখানে আছে,
সেখানে ফিরিয়া যাও|
সে - আমার কেউ নাই| যারা আছে
তারা মুখ দেখবে না| তাদের মুখ দেখাতে পারব না| কোথা যাব? কোথা
গেলে সব ভুলব?
আমি - চল, আমি তোমাকে এমন জায়গায়
রেখে আসি-যেখানে কেউ তোমাকে চিনে না, যাদের কাছে থাকলে, কেউ তোমার
খোঁজখবর পাবে না| সে'ও মরার মতনই হবে| চল, আমি তোমাকে তাদের কাছে
রেখে আসি|
এই কথা শুনে আমার সঙ্গে জল হতে উঠে চলল| আমি নিকটের মসজিদের মৌলবীর
কাছে তাহাকে লইয়া গেলাম| মৌলবী আমার বাল্যবন্ধু| তাঁহাকে সকল ঘটনা
বললাম| তিনি বললেন-বেশ| আমার এখানে আশ্রয় পাবে| তখন আমি সেই স্ত্রীলোকটিকে
ডেকে বল্লাম - মা তুমি এঁর কাছে থাক| ইনি তোমাকে নিজের মেয়ের মতন
রাখবেন|
অতক্ষণ তার বাহ্যজ্ঞান ছিল না বল্লেই হয়| পুতুলের মতন আমার পেছনে
পেছনে এসে, মসজিদের দাবায় মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়েছিল| আমার কথায়
যেন তার বাহ্যজ্ঞান ফিরে এল| খানিকটা এদিক ওদিক চেয়ে, আমার বন্ধুটিকে
দেখে-চমকে উঠে বল্লে-"এ যে মুসলমান|"
আমি - ইনি আমার বন্ধু-তুমি নিরাপদে, আদরে মেয়ের মতন ইঁহার কাছে
থাকবে|
সে - আমি যে বামুনের মেয়ে|
মুসলমানের ঘরে থাকব কি করে?
আমি - জলে ডুবে মরতে গিয়েছিলে,
সে স্থান কি এর চাইতে ভাল?
সে - সে-যে গঙ্গা-পতিতপাবনী|
গঙ্গায় ডুবলে পাপ ধুয়ে যে'ত| আমার সাহসে কুলাইল না| ভেবনা বুড়া,
তোমায় কথায় ফিরে এসেছি, প্রাণের মায়া ছাড়তে পারলাম না| - আর......|
না আমি চল্লাম| জাত ধর্ম্ম খুয়াতে পারব না|
এই বলিয়া সে ফিরিয়া চলিল|
আমার বন্ধুটি সহজেই চটিয়া যান| ইহার কথায় ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন
-"রোখ-হারামজাদি| ইঁহাসে জানে নেই সেকেগী| এই বলিয়া গেট বন্ধ
করিয়া, পথ আটকাইয়া দাঁড়াইলেন|
সে বলিল - যে মরতে যাচ্ছে, তুমি তাকে কি ভয় দেখাও?
মৌলবী - মরতে পারবে না| ভাল ভাবে থাকতে চাও - অন্দরে যাও| নইলে
বান্দি কুত্তির মতন বেঁধে রাখব|
সে তার কথায় ভ্রূক্ষেপ না করে দেউড়ীর দরজার দিকে চলল| মৌলবী তখন
তার হাত ধরতে গেলেন|
সে - খবরদার সাহেব| আমায় ছুঁইও না|
মৌলবী - খবরদার কাকে বলছ জান না-এই বলিয়া তাহাকে ধরিতে হাত বাড়াইলেন|
চক্ষের পলকে সে নারী তখন তীক্ষ্ণ ছুরি বাহির করিয়া বলিল-"সাহেব,
স্ত্রীলোক যখন গভীর নিশাকালে জলে ডুবতে যায়-তখন সে আত্মরক্ষার
ব্যবস্থা করেই বাহির হয়| তোমার মতন দস্যু পথে ঘাটে থাকতে পারে
সে জানে| সাবধান-আর এক পা এগোবে তো এই ছুরিতে প্রাণ হারাবে|"
মৌলবী থমকিয়া দাঁড়াইলেন| আমি এগিয়ে বলিলাম-ছেড়ে দিন| জোর জবরদস্তি
করে রাখা যাবে না| তখন তিনি-"কাফের, বান্দি, কুত্তি-জাহান্নামে
যাবি-যা", এই বলিয়া দরজা খুলিয়া, তাহাকে লাথি মারিয়া বাহির
করিয়া দিলেন|
গুরুদেব - তার পর?
শা সাহেব - তার পর তার
কি হ'ল জানি না| হয়ত সে আবার গঙ্গায় ডুবতে গেছে|
গুরুদেব - শা সাহেব
এখনও চিত্ত নির্ম্মল হয় নি যে| এখনও বুঝলে না আমরা যেখানের যাত্রী
সেখানে-
টুটে যায় সব ধন্ধা|
যহা রাম রহিম এক বান্দা
কাফেরে মুসলমানা|
আমাদের দিকে লক্ষ্য করে বল্লেন-এদের কেউ যদি কোনও মুসলমান স্ত্রীলোককে
এ অবস্থায় পেত, হিন্দুর ঠাকুর বাড়ীতে নিয়ে যেত না-মুসলমানের আশ্রয়েই
রেখে আসত| শা সাহেব, এখনও তুমি হিন্দু-মুসলমানে ভেদ কর?
শা-সাহেব - আপনি অন্তর্যামী| আমি যে মুসলমান একথা ভুলতে পাচ্ছি
না|
গুরুদেব - ভুলতে কে বলে? আমি যে হিন্দু, তাই কি ভুলেছি, না ভুলতে
পারি, না ভুলতে চাই? তবে শ্রীগুরুর এই শিক্ষা-হিন্দু বলে আমি মুসলমানের
চাইতে বড়-এ অভিমান করব না| যিনি জগতের মালিক, হিন্দু-মুসলমান সবাই
তাঁরই সৃষ্টি| সবারই ভিতরে তিনি আছেন| আর হিন্দু, হিন্দুর পথে,
মুসলমান মুসলমানের পথে তাঁরই কাছে যাবে| তাঁকেই পাবে| তাঁর চরণে
সকলেই দাস হয়ে থাকবে| এইটি মনে করে রাখবার জন্যই ত আমাদের ভজন
গোষ্টীতে আমরা হরি নামও করি, আল্লা নামও করি|
পাশের ঘরে এক সাধক তখন গান ধরিয়াছেন-
"হরিসে লাগি রহরে ভাই|"
এই গান শেষ হইলেই গুরুদেব গুণ
গুণ করিয়া গাইতে লাগিলেন:-
"হরদমে আল্লার নাম লইও|"
তখন শা সহেবও তাঁর সঙ্গে
গাহিতে লাগিলেন-
"দমে দমে লইওরে ভাই, দমে
দমে লইও|"
আমরা তখন সকলে মিলিয়া এই হিন্দু সাধুর আশ্রমকে, পবিত্র আল্লা-নামে
মুখরিত করিয়া তুলিলাম|
প্রভাতের আলো ফুটিতে আর সকলে উঠিয়া চলিয়া গেলেন| সকলে চলিয়া গেলে,
গুরুদবকে জিজ্ঞাসা করিলাম, "এই অভাগিনীর শেষ দশা কি হইল?"
গুরুদেব কহিলেন-"তাঁর জন্য কোনও ভাবনার কারণ নাই| অন্নপূর্ণা
ঠাকুরাণী তাঁহাকে গঙ্গার ঘাট হইতে আবার ফিরাইয়া আনিয়া নিজের কাছে
রাখিয়াছেন|"
অন্নপূর্ণা ঠাকুরাণী আমাদের সাধনেরই লোক| বয়স্থা ব্রাহ্মণ বিধবা|
তাঁর একটিমাত্র পুত্র ছিল| একই সঙ্গে ঠাকুর তাঁহার পতি পুত্র দুইকেই
কাড়িয়া লইয়া যান| সেই সময়েই এই পতিবিয়োগবিধুরা ও পুত্রশোককাতুরা
ব্রাহ্মণ কন্যা গুরুদেবের আশ্রয় লাভ করেন| সে আজ চল্লিশ বৎসরের
কথা| দশপনেরো বছর হইতে ইনি আশ্রমেই আসিয়া বাস করিতেছেন| আরও দুচারিজন
গুরুভগিনীও তাঁর সঙ্গে থাকেন| আশ্রমের আহারাদির ব্যবস্থা ইঁহাদের
উপরেই ন্যস্ত ছিল| এই অসহায়া রমণী অন্নপূর্ণা ঠাকুরাণীর আশ্রয়
পাইয়াছেন শুনিয়া আমার ভাবনা দূর হইল|
গুরুদেব কহিলেন-কথাটা যেন বাহির না হয়| মেয়েরা ইঁহার ইতিহাস কিছুই
জানেন না| যে স্ত্রীলোকটির কথা শা সাহেব কহিলেন, তিনি যে এই আশ্রমেই
আসিয়া উঠিয়াছেন, তুমি ছাড়া আর কেহই একথা জানে না| তোমাকে আর একটা
কথাও বলিয়া রাখি| ইঁহার পিতামাতা তোমাদের সাধনেরই লোক ছিলেন| সে
সম্পর্কে ইনি আমাদের পরিবারভুক্ত বটে|
৩
দিন
চার পাঁচ পরে আমি প্রথমে ইঁহাকে দেখিলাম| সেই দেন প্রাতঃকালে গুরুদেবের
নিকটে ইঁহার দীক্ষা হয়| সেই সঙ্গে আরও দুই তিনটি মহিলা দীক্ষিত
হইয়াছিলেন| গুরুদেবের আশ্রমে নিয়ম ছিল যে, কোনও নূতন লোক দীক্ষা
লইতে আসিলে, গুরুদেব তাঁহাদিগকে গ্রহণ করিলে, তাঁরাই আমাদের ভজন
গোষ্ঠীর একটা সঙ্গত হইত| গুরুদেব যাঁহাদিগকে বিশেষ ভাবে ডাকিতেন
তাঁরাই এই সঙ্গতে উপস্থিত থাকিতেন| এই দিনেও গুরুদেব আমাদের পাঁচ-সাত
জনকে দীক্ষাকালে উপস্থিত থাকিতে বলেন| দীক্ষার অনুষ্ঠানের মধ্যে
কোনও কিছুর বাহুল্য ছিল না| দীক্ষার্থীরা স্নানান্তে নিজেদের সন্ধ্যাআহ্ণিকাদি
করিয়া গুরুদেবের নিকটে উপস্থিত হইতেন| প্রথমে দু'চারিটি ভজন হইত|
তারপর গুরুদেব ইঁহাদিগকে ইষ্টনাম দান করিতেন এবং শক্তি সঞ্চার
করিয়া, কি করিয়া প্রাণায়াম করিতে হয়, তাহা দেখাইয়া দিতেন| সেই
সময়ে শিষ্যেরা সকলে প্রাণায়ামের সঙ্গে নিজ নিজ জপ করিত| এই দিনও
আমরা সকলে উপস্থিত হইলে এইরূপেই নতুন দীক্ষা প্রার্থিনীদের দীক্ষা
হইল|
নাম দিবার পূর্ব্বে গুরুদেব দীক্ষার্থিনীদের জনে জনের নাম করিয়া
ভজন গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁহাদের পরিচয় করাইয়া দিলেন| তখন শুনিলাম ইঁহার
নাম হৈমবতী|
নাম পাইয়াই হৈমবতী কাঁপিতে কাঁপিতে অজ্ঞান হইয়া গেলেন| একটি মহিলা
ইঁহার অবস্থা দেখিয়া সন্ত্রস্ত হইয়া তাঁহার মুখে জল ছিটাইতে গেলেন|
ইঙ্গিত করিলেন, ইঁহাকে কেহ যেন স্পর্শ না করে| কহিলেন, শ্রীগুরুর
নাম ইঁহার নাম ইঁহার ভিতরে যে কাজ করিতে চাহে করুক, তাহার ব্যাঘাত
জন্মাইও না| আমাদিগকে ভজন গাহিতে কহিলেন| আমরা দু'তিনটি ভজন গাহিলাম|
কিন্তু হৈমবতীর বাহ্য চৈতন্য ফিরিয়া আসিল না| তখন গুরুদেব নিজে
ভাবাবেশে গাহিতে লাগিলেন,
হরেকৃষ্ণ
হরেকৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম
হরে রাম রাম রাম হরে হরে|
আমরা সকলে মিলিয়া তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে এই নাম কীর্ত্তন করিতে
লাগিলাম| এইরূপে প্রায় তিনচার ঘন্টা কাটিয়া গেল| এদিন ভজনে যেমন
জমাট হইয়াছিল, বহুদিন এমন জমাট দেখি নাই| যেমন হৈমবতীর, সেইরূপ
গুরুদেবেরও বাহ্য লোপ পাইয়াছিল| গুরুদেব 'বোল, বোল' বলিয়া চারিদিকে
নৃত্য করিতে লাগিলেন| ভক্তেরা তাঁর সঙ্গে সঙ্গে
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ
কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে|
বলিয়া প্রাণমন ঢালিয়া নাম কীর্ত্তন
করিতে লাগিলেন| আর হৈমবতী নিশ্চল, নিস্পন্দ হইয়া প্রায় মৃতের মতন
সেখানে পড়িয়া রহিলেন| গুরুভাইদের দশা অনেক দেখিয়াছি| কিন্তু এমত
দশা আর কখনও দেখি নাই| আমাদের কারও প্রাণে ভয় হইল, বুঝি বা এই
রমণী মহাপ্রয়াণ করিয়াছে| অন্নপূর্ণা ঠাকুরাণী একটু তুলা আনিয়া
তাঁর নাসিকাগ্রে ধরিয়া শ্বাস বহিতেছে কি না দেখিতে লাগিলেন| হঠাৎ
গুরুদেব বাহ্য লাভ করিয়া আমাদের আশ্বস্ত করিয়া কহিলেন,-তোমরা ভয়
পেয়েছ কেন? সাধকের সমাধি কি কখনও দেখ নাই? নাম কর, উচ্চৈঃস্বরে
নাম কর| সমাধি ভাঙ্গিবে, বাহ্যজ্ঞান আবার ফিরিয়া আসিবে| এই বলিয়া
তিনি হৈমবতীর কানের কাছে মুখ দিয়া, আবার ধ্যানস্থ হইয়া,- হরে কৃষ্ণ
হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে| হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে|
- কহিতে লাগিলেন|
ক্রমে তাঁহার বাহ্য চৈতন্য ফিরিয়া আসিল| হৈমবতী চোখ খুলিয়া চাহিলেন
কিন্তু সে দৃষ্টি আমাদের কাছে অর্থহীন বোধ হইতে লাগিল| ক্রমে ক্রমে
যখন পূর্ণ বাহ্য হইল, তখন অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া অবগুণ্ঠন টানিয়া
সসঙ্কোচে উঠিয়া বসিলেন| তখনও দেহ ঈষৎ কম্পিত হইতেছে; স্বেদ জলে
কাপড় ভিজিয়া অঙ্গে লাগিয়া গিয়াছে| গুরুদেব তখন কহিলেন, যাও মা,
একটু সুস্থ হইয়া আহারাদি করগে|
৪
দীক্ষা
শেষ হইয়া গেলে গুরুভাইরা এসে পরস্পরের মুখ চাওয়া চাও ই করিতে লাগিলেন|
এই আগন্তুক রমণী কে, কোথা হইতে আসিয়াছেন, জানিবার জন্য উৎসুক হইয়া
উঠিলেন| আমি শা সাহেবের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, শা সাহেব ইঁহাকে
চিনিতে পারেন নাই, দেখিয়া গুরুদেবকে মনে মনে প্রণাম করিলাম| আমাদের
কৌতূহল দেখিয়া গুরুদেব কহিলেন, - তোমাদের নিকট অপরিচিত হইলেও,
বহুদিন হইতেই আমি ইঁহাকে জানি| ইঁহার পিতামাতা উভয়েই তোমাদের সাধনের
লোক ছিলেন| সে বহুদিনের কথা| শৈশবেই ইনি পিতৃমাতৃহীন হন| তার পর
মাতুলালয়ে চলিয়া যান| সেখান হইতেই তাঁহার বিবাহ হয়| তখন ইঁহার
বয়স আট বৎসর মাত্র| দুই বৎসরের মধ্যে বৈধব্য ঘটে; এবং এতাবৎ কাল
নিষ্ঠা সহকারে ব্রহ্মচর্য্য পালন করিয়া আসিয়াছেন| আজ তোমরা যা
দেখিলে তাহা এই দীর্ঘকাল ব্রহ্মচর্য্যেরই ফল| অমন উপ্যুক্ত ক্ষেত্র
না পাইলে নামের বীজ পড়িবামাত্রই অঙ্কুরিত হইয়া উঠে না|
গুরুদেবের কথা শুনিয়া আমরা বুঝিলাম, শুদ্ধ দেহ না হইলে অমন স্নিগ্ধ
উজ্জ্বল রূপ ফুটিয়া উঠে না| আকুল তরঙ্গায়িত যৌবনের অমন শান্ত মুর্ত্তি,
জন্মে কখনও দেখি নাই| শ্রী আছে অথচ সঙ্কোচ নাই, কমনীয়তা আছে অথচ
সে কমনীয়তার ভিতরেই যেন অলোকসামান্য শক্তির প্রভাব ফুটিয়া উঠিতেছে|
এরূপ দেখিয়া মানুষের মন চঞ্চল হইয়া উঠে না, কিন্তু শ্রদ্ধাভরে
যেন নুয়াইয়া পড়ে| এ রূপ ভোগ করিবার জন্য আকাঙ্খা হয় না, কেবল পূজা
করিতেই সাধ যায়| অমন রূপ জন্মে কখনও দেখি নাই|
৫
আমাদের
ভজন গোষ্ঠীতে সেবারে সেখানে একটি নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী ছিলেন| তাঁহাকে
আমরা 'ব্রহ্মচারী' বলিয়াই ডাকিতাম| গুরুদেব কহিতেন, ব্রহ্মচর্য্যের
ভিত্তি দুই, সত্য রক্ষা ও বীর্য্য ধারণ| এই ব্রহ্মচারীও অত্যন্ত
সত্যবাদী এবং জিতেন্দ্রিয় ছিলেন| মনের কথা বা ভাব কখনও গোপন করিতেন
না| এ বিষয়ে তিনি বালকের মতন ছিলেন| যখন যে খেয়াল মনে আসিত, তখনই
মুখ ফুটিয়া কহিতেন, এবং কাজেও পরিণত করিতে চেষ্টা করিতেন| হৈমবতীর
দীক্ষার পরে আমাদের ব্রহ্মচারীর মধ্যে এক আশ্চর্য্য পরিবর্তন দেখিলাম|
তাঁর নিত্যসিদ্ধ প্রসন্নতা যেন হঠাৎ কে চাপিয়া মারিয়া দিল| বালকের
মত সরল প্রকৃতি যেন হঠাৎ বদলাইয়া গেল! ব্রহ্মচারীকে দেখিলাম আর
কারও সঙ্গে বেশি কথাবার্ত্তা কহেন না, গুরুভাইদের সঙ্গে মিলিয়া
আমোদ আহ্লাদ আর করেন না, অধিকাংশ সময় একেলা গঙ্গাতীরে ভ্রমণ করেন,
আশ্রমেও একেলা চুপটি করিয়া বসিয়া থাকেন| দিন দুই তিন পরে একদিন
প্রত্যুষে গুরুভাইরা সকলে স্নানাদি করিতে উঠিয়া গেলে, ব্রহ্মচারী
গুরুদেবের নিকট আসিয়া বসিলেন| আমি তখনও এক কোণে বসিয়া ছিলাম| বোধ
হয় আমাকে দেখিতে পান নাই| গুরুদেবকে সাষ্টাঙ্গে প্রাণিপাত করিয়া
উঠিয়া কহিলেন,-আমায় আদেশ করুন, আমি বিবাহ করিব|
গুরুদেব কহিলেন, -তা বেশ| ব্রহ্মচর্য্যাশ্রমের পরেই ত গার্হস্থ্যাশ্রমের
প্রতিষ্ঠা হয়|
ব্রহ্মচারী - আমি ভাবিয়াছিলাম, আমরণ ব্রহ্মচর্য্যই পালন করিব,
কিন্তু সে শক্তি আমার নাই| আমার ব্রত ভঙ্গ হইয়াছে|
গুরুদেব হাসিয়া কহিলেন, - সে কি কথা? স্বভাবের বশে থাকাই যে ধর্ম্ম|
যাহা অস্বাভাবিক তাহা ত ধর্ম্ম নয়| লোকে ব্রহ্মচর্য্য সত্য অর্থ
বোঝে না| ব্রহ্মভর্য্য উপায় মাত্র, লক্ষ্য নহে| ব্রহ্মচর্য্যের
উদ্দেশ্য শরীর মন্কে বিশুদ্ধ করিয়া নিষ্কাম সংসার ধর্ম্ম প্রতিপালনে
সাধককে সক্ষম করা| তোমার ব্রত ভঙ্গ হয় নাই| ব্রতের সফলতা লাভ করিবার
জন্যই তোমার প্রাণ আকুল হইয়া উঠিয়াছে| যতদিন ব্রহ্মচর্য্য অনুষ্ঠান
করিতেছিলে, ততদিন তাই তোমার শ্রেষ্ট ধর্ম্ম ছিল| এখন তোমার অন্য
অবস্থা উপস্থিত| স্কুলের শিক্ষা শেষ করিয়া তুমি এখন সাধন রাজ্যে
কালেজে প্রবেশ কর, এজন্য সঙ্কুচিত হইতেছ কেন? এ ত আনন্দের বিষয়|
ব্রহ্মচারী - তবে আপনি আমাকে বিবাহ করতে আদেশ করছেন?
গুরুদেব - আমি আশীর্ব্বাদ করি, তুমি
সংসার করিয়া কৃতার্থ হও| বিবাহের কোনও সম্বন্ধ আসিয়াছে?
ব্রহ্মচারী - সম্বন্ধ আর কে আনিবে?
আমার প্রাণই সে সম্বন্ধ করিতেছে| আমি হৈমবতীকে বিবাহ করিতে চাহি|
গুরুদেব - হৈমবতী বিধবা তুমি জান?
ব্রহ্মচারী - জানি| কিন্তু বিধবাবিবাহ
শাস্ত্র নিষিদ্ধ নহে| আর আপনার এখানে তো কোনও বাহিরের বন্ধন নাই|
যাদের সমাজে বিধবাবিবাহ প্রচলিত, তারাও ত আপনার আশ্রিত|
গুরুদেব - হৈববতী কি বিবাহ করিতে চান?
ব্রহ্মচারী - জানি না| কিন্তু আমার
প্রাণ যখন তাঁকে অমন করিয়া চাহিতেছে, তখন তাঁর প্রাণ আমায় টানিতেছে,
ইহাই বিশ্বাস করি|
গুরুদেব - সে তোমায় দেখেছে?
ব্রহ্মচারী - জানি না| না দেখে কি
অনুরাগ হয় না? নক্ষত্রে নক্ষত্রে আলোকের ভিতর দিয়া কথা হয়, প্রাণে
কি নীরব পরিচয় হয় না?
গুরুদেব - হয় না কে বল্লে? হয়েছে কি
না, তাই জানতে চাই|
ব্রহ্মচারী - তাকে আপনি ডেকে জিজ্ঞাসা
করুন, তাহলেই জানা যাবে|
গুরুদেব - নিজেই তাহা জানিয়া লও না
কেন?
৬
দিন
দুই পরে গুরুদেবের সঙ্গে বিন্ধ্যাচলে গেলাম| অন্নপূর্ণা ঠাকুরাণী,
হৈমবতী এবং ব্রহ্মচারীকেও গুরুদেব সঙ্গে লইলেন| আর সকলে প্রয়াগের
আশ্রমেই রহিলেন|
একদিন অপরাহ্ণে একলা বসিয়া আছেন, এমন সময় হৈমবতী আসিয়া তাঁহার
চরণে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিয়া কহিলেন - "আপনি অন্তর্য্যামী,
সকল কথাই ত জানেন| আমি যে মহাপাতকে পড়িয়া আত্মহত্যা করিতে গিয়াছিলাম,
এ আশ্রমের আর কেউ তাহা জানে না - কিন্তু আপনার অবদিত নাই, এ পাপের
প্রায়শ্চিত্ত কি, আমায় বলিয়া দিন|" গুরুদেব কহিলেন - তুমি
যাহাকে পাপ বলিতেছ, বস্তুতঃ তাহা ত পাপ নহে| অনাচার মাত্র| পাপ
ভিতরকার কথা| অজ্ঞানে মানুষ যে অনাচার করে, তাহাতে তার দেহাদি
দুষ্ট হইতে পারে, কিন্তু প্রাণ কলুষিত হয় না| তুমি লোভে পড়িয়া
কিছু কর নাই| সজ্ঞানে তোমাতে কোনও পাপ স্পর্শ করে নাই| জ্ঞান হওয়া
মাত্রই তোমার সমস্ত শরীর, সমস্ত প্রাণ এই অনাচারের স্মৃতিতে জ্বলিয়া
উঠিয়াছিল| সেই জ্বালাতেই তুমি আত্মহত্যা করিতে গিয়াছিলে| লোকের
চোক্ষে তুমি অপরাধী ভাবিয়াই অত অধীর হইয়া পড়িয়াছিলে| নইলে তোমার
প্রাণে কোনও পাপ স্পর্শ করে নাই| আমি তোমাকে প্রান খুলিয়া আশ্বস্ত
করিতেছি, তোমার ব্রত ভঙ্গ হয় নাই| নিষ্পাপ তুমি, তোমার দেহ, মন
প্রাণ সকলি শুদ্ধ রহিয়াছে| মিথ্যা পাপ কল্পনা করিয়া প্রাণের শান্তি
নষ্ট করিও না|
হৈমবতী - শান্তি ত পাই না|
গুরুদেব - সংস্কার সহজে যায় না| অহর্নিষ
নাম কর, আপনি শান্তি আসিবে|
হৈমবতী - ব্রহ্মচারী আমাকে বিবাহ করিতে
চাহেন|
গুরুদেব - তোমার যদি ইচ্ছা হয়, তাতে
আপত্তি কি?
হৈমবতী একথার কোন উত্তর দিলেন না| তখন গুরুদেব কহিলেন-তুমি
কোনও সংস্কারের দাস নও, আমি জানি| লোকভয়, সমাজভয়, তোমার নাই| তবে
শঙ্কিত হইতেছ কেন? আমার সাধনের এসকল বিষয়ে কোনও বাঁধাবাঁধি নাই|
নিজের কাছে খাঁটি থাকিয়া সকলেই যাতে তাঁদের চিত্তের প্রসন্নতা
নষ্ট না হয়, যাহাতে আত্মার প্রসাদ লাভ হয়, সেরূপ কাজ করিতে পারেন|
দীর্ঘকাল ব্রহ্মচর্য্যে তোমার দেহ মন বিশুদ্ধ হইয়াছে| এইরূপ শুদ্ধ
প্রাণে যে সংসারে প্রবেশ করে, তারই সংসার সার্থক হয়| তারই সংসার
পথে পরমপুরুষার্থ লাভ হইয়া থাকে| তুমি আত্মসুখেচ্ছায় কোনও কাজ
করিবে না জান বলিয়াই যদি ইচ্ছা হয়, বিবাহ করিয়া সংসারধর্ম্ম প্রতিপালন
করিতে পার, ইহা অসঙ্কোচে কহিতেছি|
হৈমবতী - আমার দেহ ত অপবিত্র হয়েছে| এ দেহ ত আমি কাহাকেও দান করিতে
পারি না|
গুরুদেব
- যাকে দান করিবে, সে যদি অপবিত্র মনে না করে, সে যদি তোমার অতীতকে
ধুইয়া মুছিয়া, তোমার বর্তমান শুদ্ধ দেহকেই অকৈতব প্রেমভরে বরণ
করিয়া লয়, তাহাতে আপত্তি কি?
হৈমবতী - তিনি আমাকে শুদ্ধ বলে ভাবছেন
বলেই, তাতে আমার অপরাধ হবে না কি? এ প্রবঞ্চনা ত করিতে পারি না|
গুরুদেব - সকল কথা তাঁকে খুলিয়া না
বলিলে, প্রবঞ্চনা হবে বটে; কিন্তু বলিলে ত আর সে অপরাধ হবে না|
কিছুক্ষণ পরে গুরুদেব জিজ্ঞাসা করিলেন - সকলের গোড়ার কথা - তাঁহার
প্রতি তোমার সত্য অনুরাগ হয়েছে কি?
হৈমবতী উত্তর দিলেন না| গুরুদেব কহিলেন,-"সত্য অনুরাগের লক্ষণ
- প্রিয়জনের নাম শুনিবামাত্র দেহ মন প্রাণ পুলকিত হইয়া উঠে, তাঁহার
দর্শনে কেবল চক্ষু নহে, কিন্তু সর্ব্বেন্দ্রিয় অপূর্ব্ব উল্লাসে
ভরিয়া উঠে, তাঁহার প্রতি অঙ্গের জন্য, প্রেমিকের প্রতি অঙ্গ আকূল
হইয়া, সর্ব্বাঙ্গ দিয়া তাঁহাকে পাইতে চাহে| সত্য অনুরাগ দেহ এবং
মন সকলই অধিকার করে| এ অনুরাগ তোমার জন্মেছে কি? যদি এ শুদ্ধ অনুরাগ
জন্মিয়া থাকে, তবে বিবাহ কর, তাহাতে মঙ্গল হইবে"|
হৈমবতী কিছু কহিলেন না| কিন্তু তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ গুরুদেবের কথাতে
পুলকে পূরিয়া উঠিল| এমন সময় ব্রহ্মচারী সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন|
তাঁহাকে দেখিয়া গুরুদেব কহিলেন,-"ব্রহ্মচারী, হৈমবতী এবং
তুমি এখন হইতে একসঙ্গে বসিয়া সাধনভজন করিবে| তোমার ইষ্টনামের সঙ্গে
হৈমবতীর রূপ ধ্যান করবে, আর হৈমবতী, তুমিও তোমার ইষ্টনামের সঙ্গে
ব্রহ্মচারীর রূপ ধ্যান করিবে| এইরূপে দেখিবে তোমরা উভয়ে একে অন্যের
নিকটে ভগবদ্বিগ্রহরূপে ফুটিয়া উঠিবে| তোমরা এমন অবস্থা লাভ করিবে,
যখন পরস্পরকে নিজ নিজ ইষ্টমূর্ত্তিরূপে প্রত্যক্ষ করিতে পারিবে,
তখন একে অন্যের সেবাতে তোমাদের নিজ নিজ ইষ্টদেবতার সেবা হইবে|
ইহাই প্রেমের চরম অবস্থা, এইরূপেই নিষ্কাম কর্ম্মযোগ সাধন করিতে
হয়| এই কর্ম্মযোগের মধ্য দিয়াই তোমরা ব্রজের শুদ্ধপ্রেম লাভ করিতে
পারিবে|"
৭
আমার
ছুটি ফুরাইয়া আসিল| গুরুদেবকে বিন্ধ্যাচলে রাখিয়াই আমাকে আমার
কর্মস্থলে চলিয়া যাইতে হইল| ইহার অল্পদিন পরেই শুনিলাম হৈমবতীর
সঙ্গে ব্রহ্মচারীর বিবাহ হইয়াছে| গুরুদেবের উপদেশে ইঁহারা দু'জনে
নাসিকে যাইয়া নর্মদাতীরে একটি কুটির বাঁধিয়া ঘরকন্না করিতে আরম্ভ
করিয়াছেন| বুঝিলাম কি জানি অন্য গুরুভাইরা ইঁহাদের প্রতি কটাক্ষ
করেন, এই জন্যেই গুরুদেব তাঁহাদের এই অজ্ঞাত বাসের ব্যবস্থা করিয়া
দিয়াছেন| নাসিকে বাঙালী নাই| বিদেশীয়দের মাঝখানে এই নবদম্পতী নির্বিঘ্নে
আপনাদের ঘরকন্না ও সাধনভজন করিতে পারিবেন|
৮
তিন
বৎসর পরে আবার পূজার ছুটিতে গুরুদেবের পাদপ্রান্তে যাইয়া উপস্থিত
হইলাম| একদিন একলা পাইয়া ব্রহ্মচারী ও হৈমবতীর কথা জিজ্ঞাসা করিলাম|
গুরুদেব কহিলেন ব্রহ্মচারী আবার বিবাহ করিয়াছেন| শুনিয়া চমকিয়া
উঠিলাম| বলিলাম-"সে কি? ব্রহ্মচারীকে ত এমন নীচ প্রবৃত্তির
লোক বলিয়া মনে করি নাই|"
গুরুদেব কহিলেন - বিবাহ করিয়াছে বলিয়াই এরূপ ভাবিতেছ কেন?
আমি - এক স্ত্রী থাকতে কেবল
কামপরবশ হইয়াই লোকে আবার বিবাহ করিতে পারে|
গুরুদেব - বিবাহ ব্রহ্মচারী করে নাই|
হৈমবতীই তাহাকে আবার বিবাহ করাইয়াছেন|
আমি - এও ত অদ্ভুত কথা| হৈমবতীর কি
সন্তানাদি হয় নাই?
গুরুদেব - হৌমবতীর
একটি পুত্র সন্তান আছে|
আমি - তবে আবার বিবাহ কেন?
গুরুদেব অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন| আমিও ভাবিতে লাগিলাম - এ হল
কি? গুরুদেব ইঁহাদের যে রাগমার্গের সাধনা দিয়াছিলেন তার পরিণাম
কি এই? তিনিও কি ইঁহাদের ভিতরকার প্রকৃতিটা ধরিতে পারেন নাই? এই
সকল প্রশ্ন মনের ভিতরে তোলপাড় হইতে লাগিল|
দিন তিন চার আমি এই সন্দেহে পড়িয়া অস্থির হইয়া রহিলাম| গুরুদেবের
প্রতি পূর্ব্বেকার অবিচল শ্রদ্ধা যেন টলিয়া উঠিল| এই সন্দেহে মনটা
এতই খারাপ হইল যে আর সেখানে থাকা অসম্ভব হইল| একদিন প্রত্যুষে
আর সকলে স্নানাদি করিতে চলিয়া গেলে, গুরুদেবকে একেলা পাইয়া কহিলাম,-"আমি
আজই দেশে ফিরিয়া যাইব|"
গুরুদেব - তোমার মন যখন চঞ্চল হইয়াছে তখন যাওয়াই ভাল| তবে এখনও
ত ছুটী ফুরাইবার বিলম্ব আছে| একবার হৈমবতীর ও ব্রহ্মচারীকে যাইয়া
দেখিয়া আইস না কেন? তারাও আপ্যায়িত হইবে, তুমিও দেখিয়া সুখী হইবে|
আমি এ কথার হাঁ, না, কোনও উত্তর করিলাম না দেখিয়া গুরুদেব কহিলেন,-"দেখ,
আমরা ভগবান নই| অন্তর্য্যামী ভগবান কোন পথে লইয়া যান, তার মর্ম্ম
কিছুই বুঝি না| ব্রহ্মচারীর পক্ষে দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করা
ধর্ম্ম-রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যকীয় হইয়া পড়িয়াছিল, ইহা বুঝিয়াই আমি
তাঁহাকে অনুমতি দিয়াছি| লোকে যাতে বিবাহ বলে-হৈমবতীর সঙ্গে ব্রহ্মচারীর
সে বিবাহ হয় নাই| কখনও স্বামী-স্ত্রীরূপে পরস্পরের সঙ্গে বাস করে
নাই| হৈমবতী এই সর্ত্তেই ব্রহ্মচারীকে বিবাহ করেন| ব্রহ্মচারীও
এই সর্ত্তেই ধর্ম্মপত্নীরূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন|"
আমি - এও তো একরূপ প্রবঞ্চনা নয় কি?
গুরুদেব - প্রবঞ্চনা কাকে?
আমি - সমাজকে|
গুরুদেব - বিধবা বিবাহ এখনও সমাজে
প্রচলিত হয় নাই| বিধবা-বিবাহ করিয়া ব্রহ্মচারী সমাজের বাহিরে গিয়াছেন|
সে সমাজে অপাঙতেয় হইয়াছে| সমাজের বিধিনিষেধের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক
নাই| সুতরাং তাঁরা সমাজকে প্রতারিত করিতে পারেন না|
আমি - তবুও হৈমবতীর পুত্রকে ত লোকে ব্রহ্মচারীর পুত্র বলিয়াই জানিবে|
এই কি প্রবঞ্চনা নহে?
গুরুদেব - লোকে দত্তক গ্রহণ করে ত| প্রাচীনেরা
ক্ষেত্রজ পুত্রের দায়াধিকার মানিয়াছেন| আর সকলের চাইতে বড় কথা
- এই গরিব বেচারা কি পাপ করেছে যে আমরণ পর্য্যন্ত সে সমাজে ঘৃণিত
হইয়া থাকিবে? হৈমবতীর দেহ যদি অপবিত্র হইত, হৈমবতী যদি কামাতুরা
হইয়া ব্রহ্মচর্য্য ভঙ্গ করিতেন, তাহা হইলে অন্য কথা ছিল| হৈমবতীকে
নিদ্রায় অচেতন পাইয়া এক ব্যক্তি তাঁহার ধর্ম্ম নষ্ট করে| সে ব্যক্তিও
ঠিক কামাতুর ছিল না| সেও ভাবাবেশে নিদ্রিত অবস্থাতেই তোমরা যাকে
ইংরাজিতে 'somnambulist' -এর অবস্থা বল, সেই অব্স্থায় নিদ্রাভিভূতা
স্বপ্নাবিষ্টা হৈমবতীর সঙ্গে যুক্ত হয়| সজ্ঞান হইবা মাত্র উভয়েই
অতিশয় অনুতপ্ত হইয়া পড়ে,-হৈমবতী আত্মহত্যা করিতে গিয়াছিল-ঠাকুরের
ইচ্ছায় করিতে পারে নাই| সে ব্যক্তি সেই দিন হইতেই নিরুদ্দেশ -
বাঁচিয়াছে কি মরিয়াছে কেউ জানে না| তার অগাধ বিষয়সম্পত্তি ফেলিয়া
সে নিরুদ্দেশ হইয়াছে| হৈমবতীর পুত্র যে পাপে জন্মে নাই, ইহা ত
মানতেই হবে| তথাপি সমাজ ত অত শত বুঝত না| অত জানবেই বা কি করিয়া?
অথচ হৈমবতী যদি বিবাহ না করিত, তাহা হইলে এই বেচারাকে কি দুর্ব্বিষহ
জীবনভার বহন করিতে হইত| এসকল ভাবিয়াই হৈমবতী রাজি হন| এসকল জানিয়াই
ব্রহ্মচারী তাঁহাকে ধর্ম্মপত্নীরূপে গ্রহণ করেন|
আমি - ব্রহ্মচারীর চরণে কোটি প্রণাম করি| পুরুষে এ মহত্ত্ব দেখি
নাই|
গুরুদেব - ভুল বুঝিওনা| ব্রহ্মচারী
পতিতোদ্ধারের জন্যে বিবাহ করেন নাই| যাঁহাকে আপনার ধর্ম্মপত্নীরূপে
গ্রহণ করিলেন, তাঁহার সকল কর্ম্মভার নিজে ভাগ করিয়া লইবার জন্যই
বিবাহ করিয়াছেন| হৈমবতীর প্রতি তাঁর শুদ্ধ প্রেম জন্মিয়াছিল বলিয়াই
তিনি হৈমবতীর সুখ ও শান্তি কামনায় তাঁহাকে বিবাহ করিয়াছেন|
আমি - হৈমবতীর কথা কি?
গুরুদেব - হৈমবতীও ব্রহ্মচারীর প্রতি
শুদ্ধ অনুরাগিনী হইয়া তাঁহাকে পতিরূপে গ্রহণ করেন| কিন্তু স্ত্রীলোকের
সংস্কার সহজে যায় না| হৈমবতী কিছুতেই তাঁর দেহ যে পরপুরুষ সংস্পর্শে
অপবিত্র হইয়াছে, ইহা ভুলিতে পারেন নাই, তারই জন্য এই অপবিত্র দেহকে
পবিত্র পতি-সেবায় অর্পণ করিতে পারিলেন না| পতিকে আপনার আর যা-কিছু
অর্পণ করিলেন-দেহটা অর্পণ করিলেন না| জন্মান্তরে শুদ্ধদেহে যাহাতে
পতিসেবা করিতে পারেন, অহর্নিশ হৈমবতী এই কামনাই করিতেছেন|
আমি - আবার বিবাহ করাইলেন কেন?
গুরুদেব - ব্রহ্মচারীকে আমরা ব্রহ্মচারী
বলিয়া ডাকি বটে, কিন্তু ব্রহ্মচারী একেবারে জিতেন্দ্রিয় পুরুষ
নহে| এ অবস্থায় তাঁর দারান্তর পরিগ্রহ করা নিজের ধর্ম্ম ও হৈমবতীর
ব্রত রক্ষা-উভয় কারণেই অতিশয় প্রয়োজনীয় হইয়া উঠিয়াছিল| হৈমবতীকে
দেখিয়াছ| তাঁর সপত্নী কোনও অংশে হৈমবতী অপেক্ষা খাটো নহেন| রূপে,
কূলে, গুণে, সকল বিষয়েই তিনি হৈমবতীর মতন| হৈমবতীই নিজে এই অলোকসামান্য
রূপগুণবতী রমণীকে খুঁজিয়া আনিয়া আপনার সপত্নী করিয়াছেন| হৈমবতী
নিজে প্রতিদিন সপত্নীকে সাজাইয়া, সপত্নীর পতিসেবার ভিতর দিয়া,
আপনার দেহমনপ্রাণ দিয়া পরিসেবার সাধ মিটাইয়া থাকেন| হৈমবতী এইরূপে
এখন "যুগল-সাধন" করিতেছেন| হৈমবতীর সাধনবলে তাঁহাদের
নাসিকের আশ্রমে নূতন বৃন্দাবন প্রতিষ্টিত হইয়াছে| এই নব বৃন্দাবনে,
নবযুগল উপাসনা দেখিয়া আইস; কৃতকৃতার্থ হইবে|
আমার নাসিকে যাইতে হইল না| এখান হইতেই
এই অপূর্ব্ব লীলা ধ্যান করিয়া কৃতার্থ হইতে লাগিলাম|
( 'বঙ্গবাণী' মাসিক পত্রিকা, কার্তিক ১৩৩০ )|
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।