প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

জগদ্বিখ্যাত বাঙ্গালী সন্তরণ-বীর

[ লেখক পরিচিতি : প্রখ্যাত ব্যাযামবীর ও যোগশিক্ষক বিষ্ণুচরণ ঘোষ ১৯০৩ খ্রীষ্টাব্দের ২৪শে জুন পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোরে (বর্তমানে পাকিস্থানে) জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ভগবতীচরণ ছিলেন ভারতীয় রেলওয়েতে কর্মরত এবং মাতা চব্বিশ পরগণা জেলার বারাসতের নিকটবর্তী রাজীবপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের তৃতীয় কন্যা জ্ঞানপ্রভা। চাকুরী সূত্রে ভগবতীচরণকে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে হয়েছে। মজঃফরপুর থেকে গোরক্ষপুর হয়ে ১৯০২ সালে লাহোরে বদলী হয়ে আসেন তিনি। সেখানেই জন্ম বিষ্ণুচরণের। বিষ্ণুচরণরা ছিলে চার ভাই চার বোন। এরা হলেন - অনন্তলাল (নান্টু), রমাশশি (টুনি), উমাশশি (মুনি), মুকুন্দলাল (মুকুন বা মুকো; পরবর্তী কালের পরমহংস যোগানন্দ), নলিনীসুন্দরী (নলি), সনন্দলাল (গোরা), পূর্ণময়ী (থামু) ও বিষ্ণুচরণ (বিষ্ণু)। বিষ্ণুচরণের মাত্র ১০ মাস বয়সে মা জ্ঞানপ্রভা ইহলোক ত্যাগ করেন। ছোটবেলায় বিষ্ণু ছিলেন খুবই রুগ্ন। দাদা পরমহংস যোগানন্দ ১৯১৮ সালে কাশিমবাজারের মহারাজা স্যার মনীদ্রচন্দ্র নন্দী মহাশয়ের বদান্যতায় বিহারের রাঁচীতে কাশিমবাজারের রাজপ্রাসাদে 'যোগদা সৎসঙ্গ ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে অন্যান্য শিক্ষণীয় বিষয়ের সঙ্গে যোগ, ধ্যানও অভ্যাস করানো হত। বিষ্ণুচরণ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার এই বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। এখানে 'যোগদা' পদ্ধতি অবলম্বন করে তার শরীরের চমকপ্রদ উন্নতি হয়।

      বিষ্ণুচরণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এসসি পাশ করে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কিছুদিন পড়াশোনা করেছিলেন। পরে ওকালতি পাশ করে কিছুদিন ওকালতি করেন। কিন্তু শরীর চর্চার দিকেই তিনি বিশেষ করে ঝুঁকেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যায়াম শিক্ষক রাজেন্দ্রনাথ গুহ ঠাকুরতার কাছেও তিনি তালিম নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। ক্রমে তিনি শরীর চর্চার সঙ্গে ভারোত্তলন ও যোগ ব্যায়ামও অভ্যাস করেন এবং ব্যায়ামাচার্য হিসাবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। পেশী সঞ্চালন ও নিয়ন্ত্রনে তার দক্ষতা ছিল উল্লেখযোগ্য। তিনি কলকাতায় নিজের বাড়িতে Ghosh College of Physical Education প্রতিষ্ঠা করেন। বহু শিক্ষার্থী এখানে শরীর চর্চার সুযোগ লাভ করেছেন। মেয়েদের মধ্যে এক সময়ে বুকে হাতি তুলে কিংবদন্তী হওয়া রেবা রক্ষিত দেশ বিভাগের পর কলকাতায় এসে বিষ্ণুচরণের আখরায় ভর্তি হয়েছিলেন।

      রসিকলাল রায়ের কন্যা আশালতা রায়ের সঙ্গে বিষ্ণুর বিয়ে হয়। তাদের পুত্র বিশ্বনাথ এবং কন্যাদ্বয় আশা ও করুণা। বিশ্বনাথ ছিলেন তার বাবার একজন সেরা ছাত্র। একবার কিছু জাপানী টুরিস্ট বিষ্ণুর ব্যায়াম পদ্ধতি দেখে এতই মুগ্ধ হন যে দেশে ফিরে গিয়ে একটি হঠযোগের কেন্দ্র গড়ে তোলেন। ছোট মেয়ে করুণা যোগ্যতার সঙ্গে জাপানে কয়েকটি শরীর চর্চা কেন্দ্র চালিয়েছেন। বিদেশে আমেরিকা জাপান প্রভৃতি জায়গায় যোগব্যায়াম প্রদর্শন করে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন বিষ্ণুচরণ। বিধান চন্দ্র রায়ের আমলে তিনি কোন একটি কারণে বন্দী হন এবং তার যোগ প্রচারে বিঘ্ন ঘটে। আমেরিকা থাকার সময়ে তিনি সেখানকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এ ছাড়া লণ্ডনে অনুষ্ঠিত 'মিঃ ইউনিভার্স' প্রতিযোগিতায় অন্যতম বিচারক নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। এটি একটি দুর্লভ সম্মান যেটা সে সময়ে অন্য কেউ অর্জন করেন নি। তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে ধনকুবের যুগলকিশোর বিড়লাজী বালীগঞ্জে 'বজরংগ ব্যায়ামাগার' নামে একটি বৃহৎ ব্যামাগার তৈরী করে দেন ছোটদের ব্যায়ামাগার চর্চার সুবিধার জন্য।

      বিষ্ণুচরণের বহু ছাত্র 'ভারতশ্রী' সম্মান লাভ করেছেন। তার সুযোগ্য শিষ্য বিক্রম ঘোষ তার নির্দেশে কয়েকটি যোগের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিষ্ণুচরণ সেই অর্থে কিন্তু দীর্ঘজীবী হন নি। ১৯৭০ সালের ৯ই জুলাই মাত্র ৬৭ বছর বয়সে তিনি পরলোক গমন করেন। বিশ্বনাথ একবার জাপানে তার দল নিয়ে গিয়ে গোল্ড কাপ জিতে নেন; কিন্তু ফিরে এসে বাবাকে এই সুসংবাদটি দিতে পারেন নি। বিশ্বনাথের মেয়ে মুক্তামালা বর্তমানে বাবা ও দাদুর আরব্ধ কাজ এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। ]      দীপক সেনগুপ্ত।

      এইকিছুদিন হল জগদ্বিখ্যাত বাঙ্গালী সাঁতারু প্রফুল্ল ঘোষ কলকাতার হেদোয় যে অলৌকিক কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তা তোমাদের কারোই বোধ করি অজানা নেই। এক মুহূর্ত্ত বিশ্রাম না নিয়ে ক্রমাগত ৭২ ঘণ্টা ১৮ মিনিট ধরে সাঁতার কেটে তিনি পৃথিবীর সমস্ত সেরা সাঁতারুদের রেকর্ড ভেঙ্গেছেন - দেশমাতার কপালে জশের জয়টিকা পরিয়ে দিয়েছেন। সমগ্র ভারতের গৌরব এই বাঙ্গালী সন্তরণ-বীরের বিষয় ভাল করে জানবার আকাঙ্ক্ষা হওয়া বাংলার ছেলেমেয়েমাত্রেরই স্বাভাবিক, তাই বন্ধুবর রামধনু-সম্পাদকের অনুরোধে তাঁর সম্বন্ধে আজ গুটিকয়েক কথা বলব।
বাস্তবিক আজ পর্য্যন্ত প্রফুল্ল ঘোষের মত সব রকমের সাঁতারে সমান ভাবে পটু সন্তরণ-বীর কোন দেশে কোন জাতির মধ্যে জন্মগ্রহণ করেন নি। প্রবল বেগে সাঁতরে অল্প দূর অতিক্রম করা (Short distance) এবং মাইলের পর মাইল বহু দূর অবধি অত্যল্প সময়ে অতিক্রম করা (long distance) - দু'টোতেই তিনি সমান পারদর্শী। অনেক 'রেকর্ড টাইম' তিনি রেখেছেন। তা' ছাড়া উঁচু মঞ্চের ওপর থেকে নানাবিধ চমকপ্রদ এবং বিস্ময়কর ঝাঁপ - ইংরেজীতে যাকে বলে Fancy diving - তাতেও তিনি বাংলায় অদ্বিতীয়। প্রফুল্ল ঘোষের নৈপুণ্যের কথা ভাল করে বোঝাতে হলে একখানা বই লেখা দরকার - তা ছাড়া ও কাজ হয় না।

      কলকাতা এবং কাশীর নানা প্রতিযোগিতায় তিনি ১১০ গজ, ২২০ গজ, ৪৪০ গজ, ৮৮০ গজ, এক মাইল, ১০ মাইল, ১৩ মাইল, এবং ২৩ মাইল সাঁতারে প্রথম হযেছেন। তা ছাড়া প্রবল স্রোতের টান অতিক্রম করে ঠিক সোজাসুজি ভাবে গঙ্গানদী তিনি যেটুকু সময়ে অতিক্রম করেছেন তার কাছাকাছি সময়ের ভেতরেও আজ পর্য্যন্ত অন্য কোন সাঁতারু সে কাজ করতে পারেন নি।

      এবার enduraance swimming অথবা দীর্ঘকালব্যাপী ক্রমাগত সাঁতার, যাতে তিনি ভুবনবিখ্যাত হয়েছেন, - তার কথা বলি। এই কলকাতাতেই প্রফুল্ল ঘোষ প্রথমে ২৮ ঘণ্টা এবং পরে ৫০ ঘণ্টা সাঁৎরে সবাইকে বিস্ময়াবিষ্ট করেছিলেন। নিজের শক্তিতে আস্থা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রফুল্ল বাবু সঙ্কল্প করলেন তিনি পৃথিবীর রেকর্ড ভাঙ্গবেন - সে রেকর্ড হচ্ছে ৭২ ঘণ্টা ২ মিনিট। বিপুল আশা নিয়ে তিনি জলে নামলেন কিন্তু ৬৮ ঘণ্টার পর অজ্ঞান অবস্থায় তাঁকে জল থেকে তুলে নিতে হল - মাত্র ৪ ঘণ্টা কয়েক মিনিটের জন্য তিনি সফলকাম হতে পারলেন না। কিছুদিন পরে তিনি আবার চেষ্টা করলেন। ব্যাপারটা ত বড় সোজা নয়, তিন দিন তিন রাত অবিশ্রান্ত সাঁতার কাটতে হবে এবং সাঁতার কাটতে কাটতেই যা হোক কিছু খেয়ে নিতে হবে। এবার একটা ভুল হ'ল, খাবারের পরিমাণ এত বেশী হয়ে গেল যে ৬৭ ঘণ্টার পর তিনি ফের অজ্ঞান হয়ে পড়লেন - তাঁকে জল থেকে তুলে নিতে হ'ল। দু঑-দু' বারের অকৃতকার্য্যতায় সাধারণ লোক হলে হতাশ হয়ে পড়ত, কিন্তু প্রফুল্ল ঘোষ দমবার পাত্র নন। বাংলাদেশের নানা জায়গায়, কোথাও ২৪ ঘণ্টা, কোথাও ৫০ ঘণ্টা - এমনি ভাবে মোট ১০০০ ঘণ্টা এই ধরণের সাঁতার অভ্যাস করে পুনরায় পৃথিবীর রেকর্ড ভাঙ্গবার জন্য তিনি প্রস্তুত হয়ে নিলেন। সাঁতার কাটবার সময় কি ধরণের খাদ্য খেলে শরীর সব চাইতে পটু থাকে তা পরীক্ষা করে দেখলেন এবং জলে শরীর সঞ্চালন করতে করতে দাস্ত করা অভ্যাস করলেন। অবশেষে বিজয়লক্ষীঁ তাঁর করতলগত হয়েছে - ৭২ ঘণ্টা ১৮ মিনিট সাঁতার কেটে তিনি পৃথিবীর রেকর্ড ভেঙ্গেছেন।

      এবারকার সাঁতারে তাঁকে কত রকমের অসুবিধা ভোগ করতে হয়েছে এবং কী ভাবে তিনি সে সবের সঙ্গে সংগ্রাম করেছেন শুনলে অবাক হবে। কখনো তাঁর হাত, কখনো তাঁর পা অবশ হয়ে গেছে - তখন সেই হাতটা বা সেই পাটিকে চার-পাঁচ ঘণ্টা বিশ্রাম দিয়ে অপর হাত-পায়ে সমানে সাঁতার কেটে গেছেন। প্রথম দিন প্রচুর বৃষ্টি পড়ায় জল হিমের মত এমনই ঠাণ্ডা হয়ে গেল যে তাঁর একদিককার পাঁজর ব্যাথায় বিষিয়ে উঠল - মনে হল যেন পেকে পূয হয়েছে। রোদ ওঠবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সেই পাঁজরগুলি সূর্য্যের পানে ফিরিয়ে শুধু এক হাতে পাঁচ-ছ ঘণ্টা সাঁতার কেটে চল্লেন - সাঁতারও চল্ল, সঙ্গে সঙ্গে পাঁজরে রোদের সেঁকও হতে লাগল। ৭২ ঘণ্টা ১৮ মিনিট সাঁতারের পর তাঁর শরীর এতটা সবল ছিল যে আমাদের ধারণা হয়েছিল আরও ঘণ্টা বারো তিনি জলে কাটাতে পারতেন। কিন্তু তাঁর মাথা গরম হয়ে উঠছিল এবং তিনি ভুল বকতে সুরু করেছিলেন। রেকর্ড ভাঙ্গা হয়ে গেছে দেখে আমরা তাঁকে ডাঙ্গায় তুলে আনলাম। একটা মজার কথা, এই তিন দিনের একদিনও তিনি প্রাতে দাঁতন করাটি বাদ দেন নি।

Vআগেই বলেছি পৃথিবীর রেকর্ড ৭২ ঘণ্টা ২ মিনিট। প্রফুল্ল ঘোষের সাঁতারের সঙ্গে কিন্তু সে সাঁতারের তুলনা চলে না, কেন না সে সাঁতার কাটা হয়েছিল swimming basin এ - তার জল ইচ্ছামত ঠাণ্ডা গরম করা যায়, তার ওপরটা ঢাকা। প্রফুল্লবাবুকে সাৎরাতে হয়েছে খোলা পুকুরে - তার জল কখনও হিমের মত ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, কখনও গরম হচ্ছে। মাথার ওপর কখনো অবিরাম বৃষ্টির ধারা পড়ছে, কখনো বা প্রচণ্ড সূর্য্য গা ঝলসে দিচ্ছে। এ অবস্থায় সাঁতার কাটা ঢের কঠিন। প্রফুল্ল বাবুর মত খোলা পুকুরে কেউ ৫৫ ঘণ্টাও সাঁৎরাতে পারে নি।
প্রফুল্ল বাবুকে নিয়ে আমরা সদলবলে রেঙ্গুন রওনা হচ্ছি। সেখানে ৫০ ঘণ্টা সাঁতার কাটার ঠিক অব্যবহিত পরে তিনি এক মাইল লম্বা রেঙ্গুন লেক অতি দ্রুত সাঁতারে পার হবেন। ৫০ ঘণ্টা সাঁতারের পর তিনি যে কোন লোককে চ্যালেঞ্জ করবেন।

      আগামী ফেব্রুয়ারী মাসে প্রফুল্ল বাবুকে নিয়ে আমরা আমেরিকা যাব মনে করছি। প্রফুল্ল বাবুর সঙ্কল্প সেখানে swimming baathএ তিনি জগৎকে ১০০ ঘণ্টা ব্যাপী সন্তরণ দেখাবেন।

শ্রীবিষ্ণুচরণ ঘোষ, বি-এস-সি, বি-এল

( 'রামধনু' পত্রিকা, কার্ত্তিক ১৩৪০ )।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।