প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

ডালিম

চিত্তরঞ্জন দাস

   [ লেখক পরিচিতি : দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দের ৫ই নভেম্বর (২২শে কার্তিক, ১২৭৭ বঙ্গাব্দ) কলকাতার পটলডাঙ্গা স্ট্রীটে জন্মগ্রহণ করেন| বাবা ভূবনমোহন দাশ ও মা নিস্তারিণী দেবী| পৈতৃক নিবাস ছিল বিক্রমপুর (ঢাকা) তেলিরবাগ গ্রামে| গ্রামে দাশ পরিবার পরোপকার ও দানশীলতার জন্য খ্যাত ছিলেন|
   চিত্তরঞ্জন ১৬ বছর বয়সে ভবানীপুর লণ্ডন মিশনারী স্কুল থেকে ১৮৮৬ সালে এনট্রান্স পরীক্ষা এবং পরে ১৮৮৮-তে এফ.এ. ও ১৮৯০-এ বি.এ. পাশ করেন| সিভিল সার্ভিস পড়তে বাবা মা তাকে বিলেত পাঠান| ১৮৯২ সালে কিছু পরীক্ষা দিয়ে পরে আর পরীক্ষায় বসেন নি; কিন্তু ১৮৯২-তে আবার পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকেন| এই সময়ে ভারতবর্ষের নেতা দাদাভাই নৌরজী পার্লামেণ্টের সদস্য হবার চেষ্টা করলে লর্ড সেলিসব্যারী তাকে 'কালা আদমি' নামে অভিহিত করলে চিত্তরঞ্জন নৌরজীর সমর্থনে নানা স্থানে বক্তৃতা দিতে শুরু করেন| নৌরজী সেবার সেলিসব্যারীকে হারিয়ে জয়লাভ করেন| তবে চিত্তরঞ্জনকে এর ফল ভোগ করতে হয়েছিল| তিনি ১৮৯৩ সালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তের্ণ হলেও চাকরী পান নি| তার স্থান ছিল ৪৩ নম্বরে; ৪২ জন চাকরী পেলেও তিনি পান নি| ব্যারিস্টার হয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন|
     ১৮৯৭ সালে চিত্তরঞ্জন বাসন্তী দেবীকে বিয়ে করেন| বাসন্তী দেবী এক অসাধারণ মহিলা ছিলেন এবং সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছিলেন| নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তাকে মা-এর মত শ্রদ্ধা করতেন| পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় ছিলেন দেশবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা অপর্ণা দেবীর পুত্র| চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর মাত্র এক বছর পরেই তার একমাত্র পুত্র চিররঞ্জন দাশের মৃত্যু হয়|
     প্রেসিডেন্সি কলেজেই চিত্তরঞ্জন সুরেন্দ্রনাথের স্থাপিত স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন| ব্যারিস্টার হিসাবে তিনি বহু রাজনৈতিক মামলায় অংশ গ্রহণ করেছেন| 'বন্দেমাতরম' ও 'সন্ধ্যা' মোকদ্দমায় কৃতকার্য হয়ে তিনি আলিপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলায় বারীন ঘোষ ও অরবিন্দের পক্ষ সমর্থন করেন| একের পর এক মামলায় জয়লাভ করে তিনি প্রভূত যশ ও অর্থের অধিকারী হন| ১৯১৩ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে মা নিস্তারিণী দেবী ও ১৯১৪-এর জুন মাসে বাবা পরলোক গমন করলে চিত্তরঞ্জনের মনে ধর্মভাব প্রবল হয়ে ওঠে| ১৯১৪-এর নভেম্বর মাসেই তিনি 'নারায়ণ' মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং নিজের বিভিন্ন লেখা প্রকাশ করতে শুরু করেন| ইচ্ছা ছিল সাহিত্যসেবাতেই আত্মনিয়োগ করবেন কিন্তু সেটা হয়ে ওঠে নি তার গভীর দেশপ্রেমের জন্য| ১৯১৩ সালে শ্রীঅরবিন্দ পণ্ডিচেরীতে স্বেচ্ছায় নির্জনবাসে চলে যান এবং সাময়িক ভাবে আর্থিক দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন| দান গ্রহণ করবেন না জেনে, চিত্তরঞ্জন তার নিজের রচিত কবিতার বই 'সাগর সংগীত' অরবিন্দকে ইংরাজীতে অনুবাদ করার পরিবর্তে এক হাজার টাকা দিয়ে সাহায্য করেন|
     ১৯১৭ সালে চিত্তরঞ্জন প্রাদেশিক রাজনৈতিক সম্মেলনের সভাপতি হন, ১৯১৮-১৯ সালে তিনিই হন কংগ্রেসের প্রধান নেতা| জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পর তিনি একাদিক্রমে ৩/৪ মাস পাঞ্জাবে থেকে স্থানীয় লোকদের সহায়তা করেন| ১৯২০ সালে নাগপুর কংগ্রেসে মাসিক প্রায় ৬০ হাজার টাকার আইন ব্যবসা ত্যাগ করে দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন| ১৯২১ সালের ১৭ই নভেম্বর ইংল্যাণ্ডের যুবরাজের (প্রিন্স ওফ ওয়েলস) ভারতে আগমন উপলক্ষ্যে সমগ্র বাংলায় হরতাল পালিত হয়; সরকার আইন প্রবর্তন করে এই কার্যকলাপ বন্ধ করার প্রচেষ্টা করলে, চিত্তরঞ্জন সত্যাগ্রহ করেন এবং ১৬০০০ লোক সহ তিনি নিজেও কারাবরণ করেন| ছাত্রদের তিনি বিশ্ববিদ্যালয় নামক গোলামখানা ত্যাগের পরামর্শ দেন| শিক্ষা সম্বন্ধে তার বক্তব্য ছিল - "পরিপূর্ণ মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটানই শিক্ষার বিশিষ্ট কার্য্য|" ছাত্রদের তিনি বলতেন যে শিক্ষা মানুষের সেবাকে এবং দেশপ্রেমকে গুরুত্ব দেয় না, সে শিক্ষা শিক্ষাই নয়|
       আইন অমান্য আন্দোলনের সময় তিনি নিজ পত্নী বাসন্তী দেবী ও ভগ্নি ঊর্মিলা দেবীকে কারাবরণ করতে আদেশ দেন| সম্ভবতঃ সেটাই প্রথম মহিলাদের সত্যাগ্রহে অংশ নেওয়া| ১৯২১ সালে চিত্তরঞ্জন নিজেই আইন অমান্য করে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং আমেদাবাদ কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলেও সভায় অনুপস্থিত থাকেন| ১৯২০ সালে অনুষ্ঠিত লালা লাজপৎ রাই-এর সভাপতিত্বে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের একটি বিশেষ অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা করলে, চিত্তরঞ্জন কয়েকটি সংশোধনী প্রস্তাব দেন, কিন্তু সেগুলি মানা হয় নি| বিপিনচন্দ্র পাল, মদন মোহন মালব্য, জিন্না এবং মিসেস অ্যানি বেসান্ত চিত্তরঞ্জনের পক্ষেই ছিলেন| বিভিন্ন বিষয়ে গান্ধীজির সঙ্গে মতভেদ হওয়ায় তিনি কংগ্রেস ছেড়ে 'স্বরাজ্য দল' গঠন করেন এবং জনমত গঠন করতে সচেষ্ট হন| নেতৃত্বে ছিলেন মতিলাল নেহেরু ও চিত্তরঞ্জন| ভারতে এই দল একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে| ১৯২৪ সালে সরকার বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স জারি ক'রে সুভাষচন্দ্র, সুরেন্দ্রনাথ প্রমুখ নেতাদের গ্রেপ্তার করলে , গান্ধীজি বুঝতে পারেন যে সরকার স্বরাজ্য দলকে দমন করার মীতি গ্রহণ করেছে| এরপর গান্ধীজি স্বরাজ্য দলকে পূর্ণ সমর্থন যোগান| ১৯২৪ সালে চিত্তরঞ্জন কলকাতার প্রথম মেয়র হন| পরপর দু'বার তিনি এই পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন|
     মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রমে চিত্তরঞ্জনের শরীর ভেঙে পড়ে| কার্যোপলক্ষে ফরিদপুরে গিয়েছিলেন; সেখান থেকে ফিরেই তিনি দার্জিলিং-এ চলে যান| সেখানে মহাত্মা গান্ধী চিত্তরঞ্জনের আবাস 'স্টেপ অ্যাসাইডে' ৫ দিন ছিলেন এবং দেশের নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন| অসাধারণ ত্যাগ ও স্বদেশ প্রীতির জন্য তিনি দেশবাসীর কাছে 'দেশবন্ধু' নামে খ্যাত হন| দার্জিলিং থেকে দেশবন্ধু আর কলকাতায় ফেরেন নি| সেখানেই ১৯২৫ সালের ১৬ই জুন ৫৫ বছর বয়সে দেশবন্ধু পরলোক গমন করেন| মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার পৈতৃক বসত বাটি জনসাধারণকে দান করে যান| সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয় তারই নামে 'চিত্তরঞ্জন সেবাসদন'| তার মরদেহ ট্রেনে করে কলকাতায় আনা হলে দু঑মাইল দীর্ঘ শোকমিছিলে মহিলা সহ প্রায় তিন লক্ষ লোক যোগদান করেন এবং মহাত্মা গান্ধী ছিলেন মিছিলের পুরোভাগে| কলকাতার সেন্ট্রাল এভেনিউর নাম পরিবর্তন করে তারই নামে চিত্তরঞ্জন এভেনিউ রাখা হয়| দিল্লিতে চিত্তরঞ্জন পার্ক এবং তৎসন্নিহিত হাসপাতাল চিত্তরঞ্জন ভবন তারই নাম বহন করছে| ১৯৬৫ সালের ৫ই নভেম্বর দেশবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে ভারত সরকারের ডাক ও তার বিভাগ তার স্মরণে একটি স্মারক ডাক টিকিট চালু করে| ১৯৯৮ সালে তার নামাঙ্কিত একটি মুদ্রাও বাজারে ছাড়া হয়|
       রাজনীতির মত সাহিত্য ক্ষেত্রেও চিত্তরঞ্জনের উৎসাহ ও অনুরাগ ছিল প্রবল| তিনি বলেছেন "আমি আজীবন সাহিত্য-সেবার চেষ্টা করিয়াছি|" তবে সমাজ সেবা ও দেশের অন্যান্য কাজে যথেষ্ট সময় ও শক্তি ব্যয় করেছেন বলে সাহিত্যের ক্ষেত্রে সে ভাবে মনোনিবেশ করতে পারেন নি| তিনি সব কাজকেই অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত মনে করতেন, বিচ্ছিন্ন ভাবে ভাবতেন না| তিনি বলতেন- "জীবনের প্রত্যেক অংশ তো কবুতরের খোপের মত পৃথক করিয়া ভাগ কর যায় না, সবই যে একই ভাবের ভিন্ন ভিন্ন ধারা|" মৃত্যুর দেড় মাস আগে স্বর্গীয় মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর তৈলচিত্র আবরণ ইন্মোচন সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন| সেখানে উপস্থিত সাহিত্যিকগণকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন- "আপনারা রাজনীতি ক্ষেত্রে আসিতে পারেন নাই বলিয়া দুঃখ প্রকাশ করিয়াছেন| কিন্তু ক্ষোভের কোন কারণ নাই| আমিও সাহিত্য সেবায় জীবনাতিবাহিত করিব বলিয়া ঠিক করিয়াছিলাম, ঘটনাচক্রে এক্ষেত্রে আসিয়া পড়িয়াছি| নতুবা সেই পথই অবলম্বিত হইত| কিন্তু অনুশোচনা তজ্জন্য নয়, অনুশোচনা যদি ষোল আনা ভাবে আত্মনিয়োগ না করা যায়| আমি যখনই যাহা করিয়াছি, ষোল আনা ভাবেই করিয়াছি| আপনারাও সাহিত্য-সেবা ষোল আনা ভাবেই করুন, আপনারাও নিশ্চিত ফল লাভ করিবেন|"
     চিত্তরঞ্জনের সব চেয়ে প্রিয় লেখক ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র| 'কমলাকান্ত' ছিল তার সম্পূর্ণ মুখস্থ| ইংরাজি সাহিত্যে ব্রাউনিংকে তিনি খুবই পছন্দ করতেন| এছাড়া সুইনবার্ণ, এমার্সন ও ওয়ার্ডসওয়ার্থের রচনাও তার খুব ভাল লাগত|
       চিত্তরঞ্জন ব্রাহ্ম পরিবারের ছেলে হলেও একান্নবর্তী পরিবারে বাস করার ফলে হিন্দু আচার আচরণের সঙ্গেও গভীর ভাবে পরিচিত ছিলেন| তিনি খোলাখুলিভাবে ব্রাহ্ম সমাজের দোষত্রুটির সমালোচনা করতেন| তিনি মনে করতেন ব্রাহ্ম প্রচারকগণ মনে মুখে এক নহেন| এতে ব্রাহ্মগণ তার প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠেন| চিত্তরঞ্জনের রচিত কবিতাও কুরুচিপূর্ণ বলে ব্রাহ্মরা মনে করতেন| বিশেষত তার 'বারবিলাসিনী' কবিতা অত্যন্ত কুৎসিত বলে সমালোচিত হয়| কবিতাটির কিছু অংশ-
         রঞ্জিয়াছি অধর আমার
         কোমল বিচিত্র রাগে
         আমার অধরে জাগে
         রক্ত আভা; কেশে পুষ্পসার -
         চঞ্চল কুন্তলে - মধু পুষ্পসার
         রমণীর অধর আমার!
         এসো পান্থ! ভ্রমিয়া ধরণী
         হেথা আজ আঁধিরা রজনী
         অবগাহ প্রেমে মোর আজি এ রজনী
         এলে পান্থ ভ্রমিয়া ধরণী! ... ইত্যাদি|
       ব্রাউনিং-এর One word more কবিতাটিকে তিনি অত্যন্ত প্রশংসা করতেন| তার মতে এ রকম প্রেমের কবিতা জগতে বিরল| টমাস হুডের Bridge of sighs, চার্লস ডিকেন্সের Threatening letter to a young man ইত্যাদি রচনা তার অত্যন্ত প্রিয় ছিল|
       দেশবন্ধুর ধর্মমত ছিল অতি বিচিত্র| ব্রাহ্ম থেকে শাক্ত, বৈদান্তিক, বৈষ্ণব সব ধর্মমতের দ্বারাই তিনি কোন না কোন সময়ে আকৃষ্ট হযেছেন| কিন্তু শেষে তিনি বৈষ্ণব মতেরই অনুবর্তী হন| চিত্তরঞ্জন বলেছেন -"বৈষ্ণব ধর্ম খুব ভাল লাগে, কেন না এই ধর্ম্মে ভাবে ধ্যানে ও কার্য্যে অনেক স্বাধীনতা আছে| অন্যান্য ধর্ম্ম নিজ নিজ মুক্তির জন্য ব্যস্ত, কিন্তু এখানে সকলে একসঙ্গে কাজ করে, কেহই নিজের মুক্তির জন্য ব্যস্ত নয়|" কীর্তন ছিল তার অতি প্রিয়| বৈষ্ণব পদাবলী বিশেষজ্ঞ গণেশ কীর্তনীয়া এবং ভক্ত রামদাস যখন তার বাড়ীতে এসে কীর্তন গাইতেন তখন তিনি প্রায় অর্ধবাহ্য অবস্থায় তা শ্রবণ করতেন| তিনি বলতেন -"কেহ অপরাধ নিবেন না; আমি কীর্ত্তনের পর কথা বলতে কষ্ট বোধ করি|"
     দুঃখের এবং আশ্চর্যের বিষয় রবীন্দ্রনাথের কবিতা চিত্তরঞ্জনের ভাল লাগে নি| ভাষা ও ভাবের কাব্যিক সংমিশ্রণ এবং বিষয়বস্তুর অন্তর্নিহিত অর্থের অব্যক্ত প্রকাশ হয় ত চিত্তরঞ্জনের কাছে স্পষ্টতার অভাব বলে মনে হয়েছে| তিনি রবীন্দ্রনাথকে ইঙ্গিত করে বলেছেন -"আজকালকার কবিতা পড়লে মনে হয় যেন আমাদের ভাব, ভাষা, অন্য প্রকারের| আমরা প্রত্যেক কথাই এমন ঘুরাইয়া বলি যে সাধাসিধে লোক বুঝিতে পারে না| আমাদের ছন্দের এখন সাপের মতন বক্রগতি| তার ঝঙ্কারে এত প্রকার রাগ-রাগিণী আলাপ থাকে যে, যাহার যথেষ্ট সুরবোধ আছে সে ভাব বেচারাকে একেবারেই আমল দেয় না, আর যে হতভাগ্যের একেবারেই সুরবোধ নাই সে অনেক চেষ্টা করিয়াও পড়িতে পারে না|" তবে এই মনোভাব কখনও রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে চিত্তরঞ্জনের মনে শ্রদ্ধার অভাব ঘটায় নি| ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দের আমেদাবাদ কংগ্রেসের সভাপতির অভিভাষণে তিনি কবিগুরুর প্রতি সশ্রদ্ধ মনোভাব প্রকাশ করেছেন| আর চিত্তরঞ্জনের প্রয়াণে রবীন্দ্রনাথ সেই বিখ্যাত দুই ছত্রে -
         'এনেছিলে সাথে করি মৃত্যুহীন প্রাণ,
         মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান|'
     দেশবন্ধুর ত্যাগ ও দেশপ্রেমের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করেছেন|
চিত্তরঞ্জন যথেষ্ট সাহিত্যানুরাগী হলেও নিরবচ্ছিন্ন ভাবে সাহিত্যকর্মে মন দিতে পারেন নি| দেশের কাজে তিনি নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন| এ কারণে তার প্রকাশিত রচনার সংখ্যা খুব বেশী নয়|
       চিত্তরঞ্জনের রচনা : কাব্য - 'মালঞ্চ' (১৮৯৬) ; 'মালা' (১৯০২ থেকে ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে রচিত) ; 'সাগর সঙ্গীত' (১৯১০-এ রচিত এবং ১৯১৩-তে প্রকাশিত) ; 'অন্তর্য্যামী (১৯১৪-তে ঐনারায়ণ' পত্রিকায় প্রকাশিত) ; 'কিশোর কিশোরী' (১৯১৫-তে 'নারায়ণে' প্রকাশিত)| শেষ দুটি রচনা পরে গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হয়| গল্প - "ডালিম' (১৯১৪-তে 'নারায়ণে' প্রকাশিত) ; 'প্রাণপ্রতিষ্ঠা' (১৯১৫-তে 'নারায়ণে' প্রকাশিত)| প্রবন্ধ - 'কবিতার কথা' (১৩২১ 'নারায়ণে'র ফাল্গুন সংখ্যা) ; 'বাংলার গীতি কবিতা' (১৩২৩ 'নারায়নে'র পৌষ সংখ্যা) ; 'বিক্রমপুরের কথা' (১৯১৬, বিক্রমপুর সম্মিলনীর সভাপতির ভাষণে পঠিত) ; 'বাঙ্গলার কথা' (১৯১৭ মে, প্রাদেশিক সম্মিলনীর সভাপতির অভিভাষণ) ; 'বাঙ্গলার গীতি কবিতা' (২য় ভাগ) (১৩২৪, অগ্রহায়ণ) ; 'বৈষ্ণব কবিতা' (১৯১৭, উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের ১০ম অধিবেশনে পঠিত, ১৩২৪ পৌষে মুদ্রিত) ; 'স্বাগত' (১৯১৮, ঢাকার বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির অভিভাষণ; ১৩২৫ বৈশাখে মুদ্রিত) 'বাঙ্গলার গীতি কবিতা' (৩য় ভাগ) (১৯১৮, গিরিজাশঙ্কর রায় কর্তৃক ১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত| প্রবন্ধটির বিশেষ নাম 'শক্তি-সাহিত্য ধারায রামপ্রসাদ') ; 'বঙ্কিম সাহিত্য' (১৯২৪, কাঁঠালপাড়ার সাহিত্য-সভায় সভাপতির অভিভাষণ)|

     চিত্তরঞ্জনের সাহিত্য প্রীতি ও তার আর্থিক উদারতার একটি পরিচয় পাওয়া যায় কয়েকটি মাসিক পত্রিকার দুঃসময়ে তার সাহায্য দানে| তার নিজের সম্পাদিত 'নারায়ণ' পত্রিকার ব্যয়ভার বহন করা ছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকায় তার সাহায্য দান সম্বন্ধে জানা যায় অধ্যাপক কৃষ্ণবিহারী গুপ্তর লেখা থেকে| কৃষ্ণবিহারী লিখেছেন -"মানসী পত্রিকা বাঁচাইয়া রাখিবার জন্য তিনি নিয়মিত অর্থ সাহায্য করিতেন| যে কয়জন উদ্যমশীল সাহিত্য-রসিক যুবক নিজেদের মধ্যে চাঁদা করিয়া 'মানসী' পত্রিকার ব্যয়ভার বহন করিতেন তাহাদের কাহারই অর্থস্বচ্ছলতা বেশী ছিল না| অধুনালুপ্ত হপশিং কোম্পানীর দ্বিতলের একটি ঘরে ইহার কার্য্যালয় ছিল| চিত্তরঞ্জন মাসে মাসে ৫০ টাকা করিয়া 'মানসী'র জন্য দিতেন, তা ছাড়া এককালীন বেশী টাকাও দান করিয়াছেন| একবার ম্যানেজার যতীন্দ্রনাথ বসু মহাশয় 'মানসী'র জন্য দুই হাজার টাকা আনিয়াছেন, তখন ইহা ঋণ বলিয়াই লওয়া হইয়াছিল, কিন্তু এ ঋণ আর শোধ করা হয় নাই| এই 'মানসী' ও 'মর্ম্মবাণী' সম্মিলিত হইয়া নাটোরের মহারাজা স্বর্গীয় জগদীন্দ্রনাথ রায় কর্ত্তৃক সম্পাদিত হইত| অধুনা ইহা বিলুপ্ত|
'সাহিত্য' পত্রিকাকে ঋণ হইতে বাঁচাইবার জন্য তিনি যথেষ্ট সহায়তা করিয়াছিলেন| আর একখানি মাসিক পত্রিকা 'নির্ম্মাল্য' মনোহরপুকুর রোডস্থ একটি বাড়ী হইতে রাজেন্দ্রলাল বিদ্যাবিনোদ কর্ত্তৃক সম্পাদিত হইত| 'নির্ম্মাল্য'-এ চিত্তরঞ্জনের অনেক কবিতা বাহির হইয়াছিল| এই মাসিক পত্রিকা পরিচালনের আবশ্যিক খরচ চিত্তরঞ্জনই বহন করিতেন এবং সাহিত্যসেবী রাজেনবাবুকেও নানা ভাবে সাহায্য করিয়াছেন| .... " মৃত্যুর কিছু পূর্বে তিনি বলেছিলেন ক঒যদি পাঁচ বৎসর বাঁচি তা হলে দুবৎসর যা করচি তাই করব, বাকী তিন বৎসর গঙ্গাতীরে সাহিত্য সাধনায কাটাব|ও
সানগ্রিকভাবে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের জীবন ছিল অসাধারণ কর্মব্যস্ততা ও বৈচিত্র্যে ভরপুর| তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল তার যে বিষয় সম্বন্ধে যা মনে হয়েছে তিনি তা স্পষ্টভাবে বলতে কখনও কুণ্ঠিত হন নি| এ নিয়ে তাকে অনেক নিন্দাবাদের সম্মুখীন হতে হয়েছে| পরিশেষে সুভাষ চন্দ্র বসুর একটি মন্তব্য দিয়ে উপসংহার টানা যাক| সুভাষ চন্দ্র বলেছেন -"দেশবন্ধুর জীবনই একখানি মহাকাব্য|" ]
                                                                                 দীপক সেনগুপ্ত|

          তখন আমার চল্লিশ পার হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু আমোদ-প্রমোদ ছাড়ি নাই| ছাড়িও নাই| ছাড়িতে চেষ্টাও করি নাই| আমি কোনো কালেই মানুষ বড় ভালো ছিলাম না| সংসারের আমোদ-আহ্লাদের সঙ্গে কেমন একটা প্রাণের যোগ ছিল; আমার মনে হইত, কখনও যোগভ্রষ্ট হইব না| সমস্ত যৌবনটা এক রজনীর উৎসবের মতো কাটাইয়া দিয়াছি| কখন আরম্ভ হইল, কখন শেষ হইল, বুঝিতেও পারিলাম না| কোনোও সুখ হইতে আপনাকে কখনও বঞ্চিত করি নাই, আর তার জন্য কোনোও আফশোষও হয় নাই| প্রাণের মাঝে যে একটা মুক্ত আকাশ, একটা গভীর পাতাল আছে, তাহা তখন বুঝিতাম না| জীবনটা সর্ব্বদাই এক বিশাল সমতল ভুমির মতো মনে হইত, জীবনের রাজপথে ফুল কুড়াইতে কুড়াইতে আর হাসি ছড়াইতে ছড়াইতে চলিয়া যাইতাম| কখনও পায়ে কাঁটার আঁচড় লাগে নাই| কখনও প্রাণে দাগ বসে নাই| সমস্ত আমোদ-প্রমোদের মধ্যে বিনা চেষ্টায় সহজেই প্রাণটাকে আস্ত রাখিয়াছিলাম| কিন্তু আজ প্রায় বুড়া হইতে চলিলাম, আজ তার জন্য ভাবিয়া ভাবিয়া জীবন অন্ধকার হইয়াছে| সে কতদিনকার কথা| তারপর কত বৎসর চলিয়া গিয়াছে, তাহাকে আর ভুলিতে পারিলাম না| কত খুঁজিয়াছি-কোথাও পাইলাম না| সে যে অদৃশ্যভাবে আমার আশে-পাশে ঘুরিয়া বেড়ায়-ধরা দেয় না| তাহার পদধ্বনি শুনিতে পাই তাহাকে দেখিতে পাই না| চোখ বুজিলে তাহাকে বুকের ভিতর পাই, চোখ মেলিলে কোথায় মিলাইয়া যায়| আজও তাহাকে খুঁজিতেছি, জীবনের অবশিষ্ট কাল বুঝি খুঁজিতে খুঁজিতেই কাটিয়া যাইবে| তাহাকে পাইব না? আমি যে তাহার জন্য অপেক্ষা করিয়া আছি|

            তাহার নাম জানি না| সকলে তাহাকে "ডালিম" বলিয়া ডাকিত| সে দেখিতে সুন্দর কি কুৎসিত, আমি এখনও বলিতে পারি না| কিন্তু তার মুখখানি এখন পর্য্যন্ত আমার প্রাণে প্রদীপের মতো জ্বলিতেছে| মাথায় অন্ধকারের মতো এক রাশ চুল, মুখে একটা গভীর পাগল করা ভাব, আর তার চোখ দুটি? -চাহিবামাত্র আমার চোখ ছলছল করিয়া উঠিয়াছিল| আজ পর্য্যন্ত অনেক রমণীর সঙ্গে মিশায়াছি, আমোদ-প্রমোদ করিয়াছি, কিন্তু এমন বিষাদের প্রতিমূর্তি, চোখে এমন গদ্গদ্ করুন ভাব আর কখনও দেখি নাই| বোধহয়, আর কখনও দেখিব না|

            সেদিন সন্ধ্যাকালে কয়জন বন্ধু লইয়া বাগানে আমোদ-প্রমোদ করিতে গিয়াছিলাম| পূর্ণবাবুর বাগান চাহিলেই পাওয়া যাইত, আমরা চাহিয়া লইয়াছিলাম| বাগানটি খুব বড়, কটক হইতে সরু একটা রাস্তা ধরিয়া অনেক দূর গেলে বাড়িটা পাওয়া যায়| বাড়ির সামনেই একটা ঘাট-বাঁধানো পুকুর| ঘাটের ঠিক উপরেই শান বাঁধানো লতামণ্ডপ| সেই সরু রাস্তা ধরিয়া, সেই লতামণ্ডপের ভিতর দিয়া, বাড়ির ভিতর যাইতে হয়| সে দিন বন্দোবস্তের কোনো অভাব ছিল না| নানারকমের প্রচুর সুরা, নানারকমের খাবার, আলোয় আলোয় প্রমোদ মন্দির দিনের মতো জ্বলিতেছিল|

            আমার পৌঁছতে একটু দেরী হইয়াছিল| কটকে নামিয়াই সেই সরু রাস্তা| চাঁদের আলো খুব ক্ষীণ হইয়া ছায়ার মতো সব ঢাকিয়াছিল| নানা ফুলের গন্ধে, সেই ম্লানছায়ালোকে, লতাপল্লবের মর্মরধ্বনিতে সেই সরু রাস্তাটিকে যেন জীবন্ত করিয়া রাখিয়াছিল| আমার মনে কি হইতেছিল, আমি ঠিক বলিতে পারি না| কিন্তু প্রত্যেক পদধ্বনিতে কে যেন আমাকে সাবধান করিয়া দিতেছিল, সে রাস্তায় অনেকবার গিয়াছি, সেই বাগানে অনেক প্রমোদ-রাত্রি কাটাইয়াছি, কিন্তু সর্ব্বদাই হালকা মনে ফুরতি করিতে গিয়াছি| সেদিন আমার প্রাণে কোথা হইতে একটা ভার চাপিয়াছিল| সে যে কেমন ভার, আমি কিছুতেই বুঝাইয়া বলিতে পারি না|

            আমি আস্তে আস্তে সেই বাড়িতে ঢুকিলাম| সিঁড়ি দিয়া উঠিতে উঠিতে, গান হইতেছে, শুনিলাম| পরিচিত গায়িকা গাহিতেছে-"চমকি চমকি যাও|" ঘুঙুরের শব্দ শুনিলাম| নৃত্যগীতে আমার মন নাচিয়া উঠিত| কিন্তু সেদিন কি জানি কিসের ভারে আমাকে চাপিয়া রাখিয়াছিল| আমি স্বপ্নাবিষ্টের মতো আস্তে আস্তে উঠিয়া সেই ঘরে প্রবেশ করিলাম|

             তখনও নাচ হইতেছে| সেই গায়িকা হাত ঘুরাইয়া নাচিয়া নাচিয়া গাহিতেছে-"চমকি চমকি যাও|" আমাকে দেখিয়াই আমার বন্ধুরা সব চেঁচাইয়া উঠিল-"কেয়া বাৎ, কেয়া বাৎ, দাদা আ-গিয়া|" একজন বলিল, "দাদা, এই লাও এক পাত্র চড়াও, আনন্দ কর|" আর একজন গান ধরিল, "এত গুণের বঁধু হে|" আমার এক বন্ধু উঠিয়া নাচিয়া নাচিয়া গাহিতে লাগিল - "কাঁটা বনে তুলতে গিয়ে কলঙ্কেরি কুল! ওগো সই কলঙ্কেরি কুল!" আর একজন উঠিয়া আমার মুখের কাছে হাত নাড়িয়া গাহিল, "দেখ্লে তারে আপনহারা হই|" আমার আর একজন বন্ধু একটা গেলাসে মদ ঢালিয়া আমার হাতে দিয়া গাহিলেন, "দাদা, হেসে নাও দু'দিন বই তো নয়, ঠিক জানি কখন্ সন্ধ্যা হয়|" সবার হাতে মদের গেলাস, মদের গন্ধ, ফুলের সৌরভ, সিগারেটের ধুঁয়া, গানের ধ্বনি, সারেঙ্গের সুর, ঘুঙুরের শব্দ তবলার চাঁটি| কিন্তু আমি যেন একটা অপরিচিত লোকে আসিয়া পৌঁছিলাম, অনেকবার এই প্রমোদে মন ভাসাইয়া আনন্দ করিয়াছি| সে দিন কে যেন আমার মনের ভিতর থেকে আমায় ধরিয়া রাখিয়াছিল| মনে হইতেছিল, এ সবই আমার নূতন, অপরিচিত| আমাকে জোর করিয়া এই নূতন অপরিচিত লোকে টানিয়া আনিয়াছে| সেখানে আমার অনেক পরিচিত লোক ছিল-বিডন ষ্ট্রীটের সুশীলা, হাতিবাগানের নুরী, পুতুল, কিরণ, বেড়াল হরি, এই রকম অনেক; কিন্তু সে দিন হঠাৎ মনে হইতে লাগিল, ইহাদের কাহাকেও আমি চিনি না|

               ইহাদের একটু তফাতে, এক কোণে বসিয়াছিল, "ডালিম"| একজন বন্ধুকে জিঙ্গাসা করিলাম, "ও মেয়েটিকে আগে কখনও দেখি নাই|" সে বলিল, "বাস্ ওকে জান না? ও যে ডালিম, শহর মাত করেছে, অনেক কাপ্তেন ভাসিয়েছে|" আমি বলিলাম, "কাপ্তেন ভাসানোর মতো চেহারা তো ওর নয়| ও যে এক কোণে ঘ'রে বসে আছে|" বন্ধু বলিল, "ঐ তো ওর ঢং, ও অমনি করে লোক ধরে|" আমার মন তাহা জানিতে চাহিল না| আমি কিছু না বলিয়া একদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলাম| সে-ও আমায় দেখিতেছিল| বহুবার চোখে চোখে মিলিয়া গেল| আমি কি দেখিলাম-তাহার চাহনিতে কি ছিল-আমি কেমন করিয়া বলিব-আমি যে নিজেই ভালো করিয়া বুঝিতে পারিতেছিলাম না| আমার মনে হইল, সেই আমোদ-প্রমোদের সঙ্গে তাহার প্রাণের যোগ নাই| তার চোখ দুটি যেন আর কিসের খোঁজ করিতেছে| আমার প্রাণে কি হইতেছিল, তাহা বুঝাইয়া বলিতে পারি না| আমার ভিতর থেকে কে যেন কাঁদিয়া কাঁদিয়া উঠিতে লাগিল, ইচ্ছা হইল উহাকে বুকের ভিতর টানিয়া লই|

          এমন সময় কে বলিল, "ডালিম একটা গাও|" আর একজন বলিল, " ডালিম ভালো গাইতে পারে না|" আমি তাহার দিকে চাহিলাম| সে বুঝিল, বলিল,-"আমি ভালো গাইতে পারি না|" আমি বলিলাম, "গাও না?" সে একটু সরিয়া আমার সামনে বসিয়া গান ধরিল| আমি সে রকম গান কখনও শুনি নাই| সে গানে সুরের কেরামতি ছিল না, তালের বাহাদুরী ছিল না; কিন্তু সে গানে যাহা ছিল, তাহা আর কখনও কোনো গানে পাই নাই| মনে হইল, ওই গানের জন্য আমার সমস্ত মনটা অপেক্ষা করিয়াছিল| চোখের জলে ভেজা সেই সুরে, সুরের মধ্যে গানের কথাগুলি যেন নয়নপল্লবে অশ্রুবিন্দুর মতো জ্বলিতেছিল, সেই সুরের প্রত্যেক স্বর, সেই গানের প্রত্যেক কথা আজও আমার প্রাণপল্লবে বিন্দু বিন্দু অশ্রুর মতোই জ্বলিতেছে, ডালিম গাহিতেছিল-
                 "কেমন ক'রে মনের কথা কইব কানে কানে|
                 প্রাণ যে আমার ছি'ড়ে গেছে কাহার কঠিন টানে||
                 আজি আমি ঝরা ফুল, পড়ি তোমার পায়,
                 গন্ধটুকু রেখো বঁধু হিয়ায় হিয়ায়|
                 প্রাণের পাতে ফুলের মতো|
                 রাখব তোমায় অবিরত|
                  তফাত্ থেকে দেখব শুধু, রাখ্ব প্রাণে প্রাণে;
                 প্রাণ যে আমার ছিঁড়ে গেছে কাহার কঠিন টানে||"

        আমি জিজ্ঞাসা করিলাম-"তুমি কখনও গান শিখেছিলে?" সে বলিল, "না ওস্তাদের কাছে কখনও শিখি নাই|" আমি বলিলাম-"আমি এমন গান কখনও শুনি নাই| তুমি কোথায় থাক?" সে কোনো কথা বলিল না| আমি আবার জিজ্ঞাসা করিলাম-"এই গানটি আমাকে একলা একদিন শুনাইবে?" সে কোনো উত্তর দিল না| আমি বলিলাম-"এ সব তোমার ভালো লাগে?" তাহার চোখ ছলছল করিয়া উঠিল সে কোনো কথা বলিল না|

        আমার বন্ধুদের সকলেরই তখন প্রায় মত্ত অবস্থা| একজন উঠিয়া টলিতে টলিতে ইলেকট্রিক বাতিগুলি সব নিবাইয়া দিলো| আমি সেই অন্ধকারে ডালিমকে বুকে টানিয়া লইলাম| সে কিছু বলিল না| তারপর,-তার হাত ধরিয়া উঠাইলাম| আমিও দাঁড়াইলাম| তাহাকে আস্তে আস্তে বলিলাম-"আমার সঙ্গে চল|" সে আমার হাত ধরিল, আমার সঙ্গে চলিল|

        কোথায় যাইব, মনে মনে কিছুই ঠিক করি নাই| সিঁড়ি দিয়া নামিলাম, তারপর একটা ঘরের ভিতর দিয়া সেই লতা-মণ্ডপ গেলাম| তখন চাঁদের আলো আরও ম্লান মনে হইতেছিল| পুকুরের উপর একটু উজ্জ্বল ছায়ামাত্র পড়িয়াছে| বাতাস বন্ধ| ফুলের গন্ধ থামিয়া গিয়াছে| মনে হইল, আকাশে যেন একটু মেঘ উঠিয়াছে| সেই উজ্জ্ব্ল অন্ধকারে একখানা বেঞ্চির উপর তাহাকে বসাইলাম| আমার সর্ব্বশরীর তখন অবশ হইয়া আসিতেছিল| বুকের ভিতর ধপ্ধপ করিতেছিল| আমিও তাহার পাশে বসিলাম| আমি তাহার হাত দুটি ধরিয়া বলিলাম-"ডালিম আমার তোমাকে বড় ভালো লাগে, আমার তো অমন কখনও হয় নাই|" সে বলিল-"ও কথা তো সবাই বলে, মনে করিয়াছিলাম তুমি ও কথা বলিবে না|" আমি বলিলাম-"তুমি তো আমাকে চেনো না|" তাহার একখানি হাত আমার বুকের উপর দিলাম| সে বলিল-"তোমার কি হইয়াছে?" আমি বলিলাম-"জানি না| ইচ্ছা হয়, তোমাকে লইয়া কোথাও পলাইয়া যাই| এত দিনের জীবন যাপন সবই মিথ্যা মনে হইতেছে|" সে আরও একটু আমার কাছে সরিয়া আসিল| আমার বুকের উপর মাথা রাখিয়া কাঁদিল| অনেকক্ষণ কাঁদিল| আমারও চোখে জল আসিয়াছিল, কোনো কথা বলিতে পারি নাই| সে য্তই কাঁদিতে লাগিল ততই তাহাকে বুকে চাপিতে লাগিলাম| মনে হইল ইহাকে কোথায় রাখি, কেমন করিয়া শান্ত করি| এক নিমেষে আমার সংসারে সকল সম্বন্ধ ঘুচিয়া গেল| নিশীথের স্বপ্ন যেমন প্রভাতে এক নিমেষে মিলাইয়া যায়| আমার জীবনের সকল স্মৃতি, সংসারের সকল বন্ধন, সকল ঘটনা এক মুহূর্ত্তে কোথায় মিলাইয়া গেল? একি সেই আমি! আমার মনে হইতে লাগিল, আমি যেন কোনো অপরিচিত ব্যক্তি, এইমাত্র এক নূতন জগতে আসিয়া দাঁড়াইয়াছি| সে অবস্থা সুখের কি দুঃখের, আমি আজ পর্যন্ত বুঝিতে পারিতেছি না| তাহাকে কেবল বুকে চাপিতে লাগিলাম| কথা বলিবার শক্তি ছিল না| মনে মনে বলিতে লাগিলাম-"হে আমার ব্যথিত, পীড়িত! এস, তোমার চোখের জল মুছাইয়া দি, তোমাকে বুকের ভিতর রাখিয়া দি, তুমি আর বাহিরে থাকিও না-আমার বুকের ভিতর ফুটিয়া ওঠ| আমিও তোমাকে বুকে করিয়া জীবন সর্থক করি|" কতক্ষণ পরে সে একটু শান্ত হইয়া উঠিয়া বসিল| বলিল-"আমি মনে করিয়াছিলাম তোমার সঙ্গে আসিব না| কে যেন আমার বুকের ভিতর থেকে বলিল যাও, তাই আসিলাম| তুমি আমার কথা শুনিতে চাও? আমি মনে করিয়াছিলাম বলিব না, কিন্তু কে যেন আমার প্রাণের ভিতর থেকে বলাইতেছে| শুনিবে?" আমি বলিলাম-"শুনিব; শুনিবার জন্যই তোমাকে এখানে আড়াল করিয়া আনিয়াছি|" সে তাহার জীবন-কাহিনী বলিতে লাগিল| আমি শুনিতে লাগিলাম, সেই কণ্ঠস্বর আজও আমার প্রাণে জাগিয়া আছে, তাহর প্রত্যেক কথা আমার প্রাণে ব্যথার মতো বাজিতে লাগিল,-আজও বাজিতেছে|

          সে বলিল-আমি শৈশবেই পিতৃমাতৃহীন| কুলীন ব্রাহ্মণের মেয়ে মামার বাড়িতে প্রতিপালিত| মামা নেশা করিতেন| দিবানিশি সুরামত্ত, তাহার কাছ থেকে কখনও ভালো ব্যবহার পাই নাই| মামী আমাকে একটা বোঝা মনে করিত, তার মুখে কটুক্তি ছাড়া মিষ্টি কথা কখনও শুনি নাই| আমার মামার মামাতো ভাই আমাকে ভালোবাসিতেন| তাঁহার কাছে লেখাপড়া শিখিয়াছিলাম| কিন্তু আমার যখন বারো বৎসর বয়স তখন তিনি মারা যান| তারপর চারি বৎসর পর্য্যন্ত সে বাড়িতে যে কি যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছি, তাহা তোমার না শুনাই ভালো| আমার ষোল বৎসর বয়সে বিবাহ হইল| আমার স্বামীর বয়স তখন পঞ্চাশ বৎসরের উপর| তারপর চার বৎসর শ্বশুরবাড়িতে ছিলাম| এই চার বৎসরের মধ্যে আমার স্বামীর সঙ্গে বোধহয় ছয়-সাত দিনের বেশী দেখা হয় নাই| তিনি বিদেশে চাকুরী করিতেন| কখন কখন দু'এক দিনের জন্য বাড়ি আসিতেন| বাড়িতে আসিলেও বাহির বাড়িতেই থাকিতেন| আমার সঙ্গে দুই একবার দেখা হইয়াছিল| কখনও কথাবার্তা হয় নাই| তাহার আগে দুইবার বিবাহ হইয়াছিল, চার পাঁচটি ছেলেমেয়ে ছিল| আমার শাশুড়ী তাঁহার বিমাতা| আমার কথা কহিবার কেহ ছিল না| ছেলেপিলেগুলিকে দেখিতে হইত| কাঁদিলেই শাশুড়ীর কাছ থেকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি শুনিতাম| কখন কখন মারও খাইয়াছি| বাড়িতে ঝি ছিল না, সমস্ত কাজই আমাকে করিতে হইত| ঘরের মেঝে পরিষ্কার করা থেকে আরম্ভ করিয়া-রাঁধাবাড়া, ছেলেপিলেদের দেখা ও দুইবার খাওয়ার পর বাসনগুলি-বাড়ির কাছে নদী, সেই নদীতে-মাজিয়া আনিতে হইত| আমার মনে হয় না যে, এই চার বৎসরের মধ্যে কখনও চোখের জল না ফেলিয়া ভাত খাইতে পারিয়াছি| যতই দিন যাইতে লাগিল, আমার যন্ত্রণা অসহ্য হইয়া উঠিল| আমি পাগলের মতো হইয়া গেলাম| আমার কাছে কয়েকখানি বাঙ্গলা বই ছিল| মাঝে মাঝে রাত্রে সবাই ঘুমাইলে একটি প্রদীপ জ্বলিয়া পড়িতাম| আমার শাশুড়ীর তাহা সহিল না| একদিন সেই বইগুলি পোড়াইয়া ফেলিলেন| আমারও আর সহ্য হইল| সেইদিন মনে মনে স্থির করিলাম এ বাড়িতে আর থাকিব না| পাড়ার একটি ছেলে-আমি যখন ঘাটে বাসন মাজিতাম, আমার কাছে দাঁড়াইয়া থাকিত, আর আমার দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া থাকিত, কিছু বলিত না, আমিও কিছু বলিতাম না| সেদিন সন্ধ্যার সময় বাসন মাজিতে ঘাটে গেলাম| চাঁদের আলো ছিল বাতি লইয়া যাই নাই| দেখিলাম, সে ঠিক সেইখানে দাঁড়াইয়া আছে| তাহাকে দেখিয়াই বাসনগুলি নদীতে ফেলিয়া দিলাম| তাহাকে বলিলাম-"আমাকে মামার বাড়ি পৌঁছাইয়া দিতে পার?" সে বলিল- "কত দূর?" আমি গ্রামের নাম বলিলাম| সে বলিল-"নৌকায় যাইতে তিন-চার ঘণ্টা লাগিবে|" আমি বলিলাম-"যতক্ষণই লাগে, আমাকে লইয়া যাও|" এই বলিয়া তাহার পায়ে আছড়াইয়া পড়িলাম| সে বলিল, "আচ্ছা তুমি এইখানে বসো, আমি নৌকা ঠিক করিয়া আসি|" সে নৌকা লইয়া আসিল, আমি নৌকায় উঠিলাম| ভাবিলাম, এইবার যমের বাড়ি ছাড়িয়া মামার বাড়ি যাইতেছি| যতক্ষণ নৌকায় ছিলাম, সে ঠিক সেই রকম করিয়া আমার দিকে চাহিয়া ছিল, কোনো কথা বলে নাই; শুধু চাহিয়াছিল| আমার মনে হইতেছিল, তাহার চোখ দুটি যেন আমাকে গিলিয়া ফেলিবে| আমি ভয়ে ভয়ে চুপ করিয়া ছিলাম|

          যখন মামার বাড়ি গিয়া পৌঁছিলাম, তখন বেশ রাত্রি, মামা অজ্ঞান হইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন, আর সকলেই শুইয়াছে| অনেক ডাকাডাকির পর মামী উঠিয়া দরজা খুলিয়া দিলেন| আমাকে দেখিয়া যেন একটু শিহরিয়া উঠিলেন| আমি তাঁহার পায়ে পড়িয়া কাঁদিতে লাগিলাম| বলিলাম, 'আমি পলাইয়া আসিয়াছি, আমি সেখানে আর যাব না| আমি তোমার দাসী হইয়া থাকিব, আমাকে রক্ষা কর| তোমার বাড়িতে একুটু স্থান দাও|' মামী কর্কশস্বরে বলিলেন, 'পালিয়ে এসেছিস কার সঙ্গে?' আমি সে কথার অর্থ তখন ভালো করিয়া বুঝিতে পারি নাই| আমি সেই ছেলেটিকে দেখাইয়া বলিলাম, 'এর সঙ্গে|' মামী বলিলেন, 'এ কে?' আমি বলিলাম, "জানি না|" মামী বলিলেন, "আমার বাড়িতে তোমার স্থান হবে না|' 'আমি কোথায় যাব? মামী বলিলেন, 'গোল্লায়|' বলিয়াই দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন| আমি পাগলের মতো সেই দরজায় ধাক্কা মারিতে লাগিলাম| কেহ সাড়া দিলো না| ত্খন সে আমার পিছনে দাঁড়াইয়া ছিল, সরিয়া আসিয়া আমার হাত ধরিয়া আমাকে ফিরাইয়া লইয়া চলিল|

           আমি চক্ষে অন্ধকার দেখিতেছিলাম| কোথা যাব? কোথা যাব? এই কথাই বারে বারে মনে উঠিতেছিল, কিন্তু এই প্রশ্নের কোনো উত্তরই পাইলাম না| পুতুলের মতো সে যে দিকে লইয়া গেল, সেদিকেই গেলাম|

          আবার সেই নৌকা| আমি জিজ্ঞাসা করিলাম-'কোথা যাইবে?' সে বলিল-'কলকাতায়|' তখন সেই কথার অর্থ বুঝিতে পারিলাম| বিদ্যুতের মতো আমার মন চমকাইয়া গেল| আমি চীৎকার করিয়া তাহার পায় পড়িলাম| কাঁদিয়া বলিলাম-'আমাকে রক্ষা কর; আবার আমাকে শ্বশুরবাড়ি লইয়া চল|' সে কিছিক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, তারপর বলিল, 'আচ্ছা' কিন্তু ফের সেই চাহনি, আমি ভয়ে, অপমানে, দুঃখে, লজ্জায় একেবারে মরিয়া গেলাম| ভোর হইতে না হইতে নৌকা ঘাটে লাগিল| আমি দৌড়িয়া শ্বশুরবাড়ির দিকে চলিলাম| সে বাধা দিলো না, কিন্তু আমার পিছনে পিছনে আসিল| আমি কিছু না বলিয়া দরজায় আঘাত করিতে লাগিলাম| আমার শাশুড়ী উঠিয়া আসিয়া দরজা খুলিল, আমাকে দেখিয়াই সজোরে দরজা বন্ধ করিয়া দিলো| আমি চীৎকার করিয়া 'মা' 'মা' বলিয়া ডাকিলাম আর কোনো সাড়া শব্দ পাইলাম না|
তখন আর কাঁদিতে পারিলাম না, চোখে আর জল ছিল না| মামীর কথা মনে পড়িল-'গোল্লায় যাও|' আমি ফিরিলাম দেখিলাম সে দাঁড়াইয়া আছে আর ঠিক তেমনি করিয়া চাহিয়া আছে| আমি হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলাম, বলিলাম-'আমি গোল্লায় যাব, যেখানে ইচ্ছা, লইয়া যাও|'

            তখন নিশ্চয়ই সূর্য্য উঠিয়াছে কিন্তু আমার চোখে ঘোর অন্ধকার-মনে হইল যেন সেই ঘর অন্ধকারে এক ভীষণাকৃতি কাপালিক আমার হাত ধরিয়া কোনো অদৃশ্য-বলিদান-মন্দিরের দিকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে|
           তারপর?
           তারপর কলিকাতায় আসিলাম| ভাবিলাম সে কোনো জমিদারের ছেলে| কর্ণওয়ালিশ ষ্ট্রীটে একটা বাড়ি ভাড়া করিয়া দুজনে থাকিলাম| সাতদিন সে আমার গায় গায় লাগিয়া ছিল| তাহার সেই চাহনির অর্থ সেই কয়দিনে বেশ ভালো করিয়া বুঝিলাম| আট দিনের দিন আর তাহাকে দেখিতে পাইলাম না|'
তারপর?

            এখন আমি কলকাতায় ডালিম| আমার সুখের শেষ নাই| শহরের বড় বড় লোক আমার পায়ের তলায় গড়াগড়ি যায়| আমার বাড়িতে সাজ-সজ্জার অভাব নাই, সোনার খাট হীরার গহনা| বাড়িতে ইলেকট্রিক বাতি, ইলেকট্রিক পাখা, দাস-দাসীর অন্ত নাই, আলমারী ভরা কাপড়, বাক্স ভরা টাকা|
আমি কলকাতার ডালিম কিন্তু-কিন্তু বলিয়াই কিছুক্ষণ নীরব হইয়া রহিল| দুহাত দিয়া বুক চাপিয়া ধরিল| তখন জ্যোৎস্নার লেশমাত্র নাই| সেই লতামণ্ডপ গাঢ় অন্ধকার ভরা| তাহার বুক ধড়াস্ ধড়াস্ করিতেছিল, আমি সেই অন্ধকারে তাহার শব্দ শুনিতে পাইতেছিলাম, আর আমার অন্তরে এক অসীম বেদনা অনুভব করিতেছিলাম| কিছুক্ষণ পরে সে বলিল-"কিন্তু আমি যেন অঙ্গারের মতো জ্বলিতেছি| বুক যে জ্বলিয়া জ্বলিয়া পুড়িতেছে, তাহা কি কেহ দেখিতে পায়?"

          আবার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল| বোধহয় কাঁদিতেছিল| তারপর বলিল, "তোমার আমাকে ভালো লাগিয়াছে| তোমার মতো আর কারও সঙ্গে আমার এ জীবনে কখনও দেখা হয় নাই| কেন তোমাকে আগে দেখিলাম না? আমি যখন নরক-যন্ত্রণা ভোগ করিতেছিলাম তখন তুমি কোথায় ছিলে? এখন-তোমাকে তো দিবার কিছু নাই|"

           এই বলিয়া সে আমার বুকে ঢলিয়া পড়িল, শিশুর মতো কাঁদিতে লাগিল, আমি বলিলাম-"আমি আর কিছু চাহি না আমি তোমাকেই চাই|" এই বলিয়া দুজনেই কাঁদিতে লাগিলাম| পাগলের মতো জ্ঞানহারা হইয়া কাঁদিতেছিলাম| কতক্ষণ কাঁদিয়াছিলাম জানি না| আমি কি জাগিয়াছিলাম? মনে হইতেছিল, আমি ডালিমকে লইয়া এই সংসারের বাহিরে এক অপূর্ব্ব নন্দন-কাননে বাস করিতেছি| আমি আর ডালিম-সে জগতে আর কেহ নাই| চিরদিন তাহাকেই বুকে করিয়া রাখিয়াছি| প্রতি প্রভাতে তাহাকে নব নব ফুলে সাজাইয়াছি, প্রতি নিশাশেষে তাহাকে নব নব চুম্বনে জাগইয়া দিয়াছি| প্রাণের যে একটা মুক্ত আকাশ আছে, আর একটা অতি গভীর পাতাল আছে, সেদিন প্রথম অনুভব করিলাম| আমার হৃদয়ের সেই স্বর্গ ও সেই পাতাল পূর্ণ করিয়াছিল ডালিম-ডালিম|

            এমন সময় উপরে কোলাহল শুনিলাম, চমকিয়া দেখিলাম ডালিম আমার কাছে নাই| আমি অস্থির হইয়া গেলাম, পাগলের মতো ছুটাছুটি করিতে লাগিলাম| দৌঁড়িয়া উপরে গেলাম, দেখিলাম সেখানে ডালিম নাই| আমাকে দেখিয়া একজন বলিল-"কি বাবা, একেবারে উধাও|" আমি তাহাকে গালি দিলাম, আবার ছুটিয়া নীচে আসিলাম| সেই বাগানে সকল স্থানে খুঁজিলাম| ডালিম ডালিম বলিয়া চীৎকার করিয়া ডাকিলাম| কোনো সাড়া শব্দ পাইলাম না| ফটকে গেলাম জিজ্ঞাসা করিলাম, "কোই বিবি চলা গিয়া?" একজন গাড়োয়ান বলিল, "হাঁ বাবু, এক বিবি আভি চলা গিয়া|" আবার দৌড়িয়া উপরে গেলাম| জিজ্ঞাসা করিলাম, "ডালিম কোথায় থাকে?" এবার আর কেহ রসিকতা করিল না| ঠিকানা জানিয়া লইয়া আবার ফটকে দৌড়িয়া আসিলাম| একখানা মোটর-কার করিয়া তাহার বাড়ি গেলাম| শুনিলাম ডালিম আসে নাই| কতক্ষণ সেখানে ছিলাম জানি না ডালিমের দেখা পইলাম না| আবার বাগনে গেলাম, আবার খুঁজিলাম, কিন্তু তাহাকে আর পাইলাম না|

            সে রাত্রে ঘুমাই নাই| পাগলের মতো ছুটাছুটি করিলাম| পরদিন প্রভাতে আবার ডালিমের বাড়ি গেলাম, ঝি বলিল, সে শেষ রাত্রে এসেছিল, আবার ভোর না হ'তে হ'তেই চলে গেছে| একখানা চিঠি রেখে গেছে, তাহাকে বলে গেছে-সকালে একজন বাবু খোঁজ করতে আসবে তাকে এই চিঠিখানা দিস্| আমি সেই চিঠিখানা লইলাম| খুলেতে খুলিতে আমার হাত কাঁপিতে লাগিল, চিঠিখানা পড়িলাম-
"তুমি আমাকে খুঁজিতে আসিবে জানি, কিন্তু আমাকে আর খুঁজিও না| আমাকে আর কোথাও দেখিতে পাইবে না| মনে করিও আমি মরিয়া গিয়াছি| আমি মরি নাই- আমি মরিতে পারিব না| তুমি আমাকে যাহা দিয়াছ, আমি এ জীবনে কখনও পাই নাই| তাহারি গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখিতে চাই| অনেক দুঃখ সহিয়াছি, সংসারে যাকে বলে সুখ, তাহাও পাইয়াছি, কিন্তু কাল রাত্রে যে সত্য প্রাণের পরশ পাইয়াছে তাহা কখনও পাই নাই| তাহারি স্মৃতিটুকু প্রাণে প্রদীপের মতো জ্বালাইয়া রাখিতে চাই| যাহা পাইয়াছি তাহা আর হারাইতে চাই না|

            তুমি আমাকে খুঁজিও না, প্রাণসর্বস্ব! আমি বড় দুঃখী, তুমি কাঁদিয়া আমার দুঃখ বাড়াইও না, এ জন্মে হইল না, জন্মান্তরে যেন তোমার দেখা পাই!
                                             -ডালিম"

( ‘নারায়ণ’ পত্রিকা, পৌষ, ১৩২১ )

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।