বকুল
দীনেশরঞ্জন দাশ
[
লেখক পরিচিতি : দীনেশরঞ্জন দাশের জন্ম চট্টগ্রামে ১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দের
২৯শে জুলাই| আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুর পরগণায় (ঢাকা) কুমোরপুর
গ্রামে| 'সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান' গ্রন্থে অবশ্য জন্মস্থান হিসাবে
কুঁয়রপুর-ফরিদপুরের উল্লেখ রয়েছে| পিতা ছিলেন কৈলাশচন্দ্র দাশ
বাহাদুর এবং মাতা ইচ্ছাময়ী দেবী| পিতা নববিধান ব্রাহ্ম সমাজের
উচ্চপদে অধিষ্ঠিত কর্মচারী ছিলেন| কৈলাশচন্দ্রের ছিল চার পুত্র
ও তিন কন্যা; মনোরঞ্জন, বিভুরঞ্জন, দীনেশরঞ্জন, প্রিয়রঞ্জন এবং
চারুবালা, তনুবালা ও নিরুবালা (বা নিরুপমা)| চট্টগ্রামে কৈলাশচন্দ্রের
বাসগৃহের নাম ছিল 'আশা কুটীর'| কৈলাশচন্দ্র, ইচ্ছাময়ী ও অন্যান্য
ভক্তেরা এখানে নিত্য উপাসনায় বসতেন| দীনেশরঞ্জনের অতি অল্প বয়সেই
তার পিতা পরলোক গমন করেন| ধর্মপ্রাণা, দৃঢ়চেতা মাতার কাছেই ছেলেমেয়েরা
মানুষ হয়| ইচ্ছাময়ীর শিক্ষাগত যোগ্যতা জানা না থাকলেও তিনি অল্প
বয়স থেকেই কবিতা লিখতেন| 'আশা কুসুম' নামে তার একটি কাব্য গ্রন্থও
প্রকাশিত হয়েছিল| দীনেশরঞ্জন চট্টগ্রাম স্কুল থেকে এনট্রেন্স
পাশ করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন, কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে
জড়িয়ে পড়ায় পড়াশোনা বেশিদূর এগোয় নি| পরে আর্ট স্কুলে ভর্তি
হয়েছিলেন কিন্তু সেখানেও পাঠক্রম শেষ করেন নি| কার্টুন ও ছবি
খুব ভাল আঁকতে পারতেন|
পিতার মৃত্যুর পরে পরিবারের সবাই কলকাতায় চলে আসেন| দীনেশরঞ্জন
ছিলেন চঞ্চল প্রকৃতির মানুষ| কোন একটি জায়গায় বেশিদিন কাজ করা
ছিল তার স্বভাব বিরুদ্ধ| তার প্রথম কর্মক্ষেত্র ক্লাইড ফ্যান
কোম্পানি; পরে যোগ দেন ১১/১ এসপ্ল্যানেড ইস্টে অবস্থিত সারদারঞ্জন
রায়ের ক্রীড়া সরঞ্জাম বিক্রির দোকানে সেলসম্যান হিসাবে| সারদারঞ্জন
ছিলেন মেট্রোপলিটন কলেজের ক্রীড়া শিক্ষক| সে কাজও বেশিদিন ভাল
লাগেনি| পরে চলে আসেন লিণ্ডসে ষ্ট্রীটের একটা ওষুধের দোকানে|
এখানে ভদ্র ও নম্র ব্যবহারের জন্য ক্রেতাদের সঙ্গে তার মধুর
সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল| কিন্তু এখানেও মন টেকেনি দীনেশরঞ্জনের|
সাহিত্য রচনা ও ছবি আঁকার দিকেই তার আগ্রহ ছিল বেশি| এই ইচ্ছা
ফলবতী হবার মত অনুকূল পরিবেশের অভাবেই হয়ত তার মন সদা চঞ্চল
ছিল|
দীনেশরঞ্জনের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না| এই অবস্থাতেই নতুন লেখকদের
নিয়ে ১৩৩০ বঙ্গাব্দে বন্ধু গোকুলচন্দ্র নাগের সঙ্গে সম্মিলিত
ভাবে প্রকাশ করেন 'কল্লোল' নামে একটি সাময়িক পত্রিকা| প্রচলিত
প্রথার বাইরে গিয়ে একটি নতুন ধারার সৃষ্টি করে এই পত্রিকাটি|
সাহিত্যিক মহলে ঝড় তোলা এই সাময়িক পত্রটিকে সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে
অনেকে একটি নতুন যুগের প্রবর্তক বলে মনে করেন| অচিন্ত্যকুমার
সেনগুপ্ত তার বিখ্যাত ‘কল্লোল যুগ’ নামক গ্রন্থে এই সময়টির উল্লেখ
করেছেন|
যক্ষারোগে গোকুলচন্দ্রের অকালমৃত্যু ঘটলে পত্রিকা প্রকাশের যাবতীয়
ভার দীনেশরঞ্জনের উপর এসে পড়ে| 'কল্লোলে'র মালিকানা থেকে যে
সামান্য আয় হত তা দিয়ে গ্রাসাচ্ছাদন করাই শক্ত ছিল| কিন্তু উৎসাহের
অন্ত ছিল না| এর মধ্যেই দীনেশরঞ্জন পটুয়াটোলা লেনে 'কল্লোল পাবলিশিং
হাউস' খুলে বসেন| বিভিন্ন লেখকের বেশ কিছু বই ছপানো হয় এই সংস্থা
থেকে| বইয়ের প্রচ্ছদ সজ্জা এবং কার্টুন আঁকা দু ধরণের কাজেই
দীনেশরঞ্জন ছিলেন যথেষ্ট পারদর্শী| তার অঙ্কিত কার্টুনের পাশে
D.R শব্দটি লেখা থাকতো| 'কল্লোলে'র মালিকানা থেকে আয় হত সামান্যই|
মেজদা বিভুরঞ্জন এক সময়ে কিছু অর্থ সাহায্য করলেও শেষের দিকে
পত্রিকা চালাতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন দীনেশরঞ্জন| অর্থোপার্জনের
জন্য তিনি চলচ্চিত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েন| চিত্র বিশেষজ্ঞ ধীরেন্দ্রনাথের
অধীনে কাজের সূত্রে ফটোগ্রাফি বিষয়েও তিনি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন|
চলচ্চিত্র সম্বন্ধে তার চিন্তা ও ধারণা তিনি ব্যক্ত করেছেন ১৩৩৬
বঙ্গাব্দের 'কল্লোলে' আষাঢ়, শ্রাবণ, অগ্রহায়ণ ও পৌষ সংখ্যায়
প্রকাশিত 'চলচ্চিত্র' নামক প্রবন্ধে|
'কল্লোল' পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বুদ্ধদেব বসু যথেষ্টই
দুঃখিত হয়েছিলেন| সেটাই স্বাভাবিক কারণ বুদ্ধদেব বসুর মত অনেক
সাহিত্যিককে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছে 'কল্লোল'| বুদ্ধদেব
বসু লিখেছেন -"যদি 'কল্লোল' আজ পর্যন্ত চলে আসতো এবং সাম্প্রতিক
নবীন লেখকদের গ্রহণ করতো তা হলে সেটি হত বাংলা দেশের একটি প্রধান
- এবং সাহিত্যের দিক থেকে প্রধানতম - মাসিকপত্র, আর দীনেশরঞ্জনের
নাম সম্পাদক হিসাবে হয়ত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের পরেই উল্লেখিত
হতে পারতো| এ কথা মনে না-করে পারিনা যে এ-গৌরব দীনেশরঞ্জন ইচ্ছে
করেই হারালেন - বাংলা সিনেমা বাংলা সাহিত্যের প্রথম ক্ষতি করলো|
'কল্লোলে'র অপমৃত্যুর জন্য অন্তত আংশিকরূপে দায়ী হয়ে|"
কিন্তু দীনেশরঞ্জন চলচ্চিত্রে যোগদান করেছিলেন সম্ভবতঃ অর্থকষ্ট
থেকে মুক্তি পেতেই| 'কল্লোল' চালাতে গিয়ে ঋণের জালে জড়িয়ে না
পড়লে তিনি 'কল্লোল' বন্ধ করে দিতেন না|
যাই হোক দীনেশরঞ্জন আমৃত্যু চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন|
অভিনয়ও তিনি খারাপ করতেন না| কেশবচন্দ্র সেনের বাসভবন 'কমল কুটীরে'
কেশবেরই রচিত 'নব বৃন্দাবন' নাটকে অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেছেন|
১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দে তিনি নিউ থিয়েটার্সের অন্যতম ডিরেক্টর হিসাবে
পরিচালক মণ্ডলীতে যোগদান করেন| সিনারিও লেখক ও পরিচালক হিসাবেও
তিনি কাজ করেছেন| 'আলোছায়া' তার পরিচালিত একটি চলচ্চিত্র| ১৯৪০
খ্রীষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত হেমচন্দ্র চন্দ্র পরিচালিত
'প্রতিশ্রুতি' ছায়াছবিতে অভিনয়ের কাজ শেষ করে তিনি অসুস্থ হয়ে
পড়েন| ডিউডোনাল আলসারে আক্রান্ত হয়ে মাসখানেক রোগ ভোগের পর তার
ভাই, বোন ও ভাতৃবধূদের বহু চেষ্টা সত্বেও, বড়দিদি চারুবালা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
আলিপুরস্থিত বাসভবনে ১৯৪১ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই মে সোমবার বেলা
৩টা ৩৫ মিনিটে দীনেশরঞ্জন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন|
দীনেশরঞ্জন ছিলেন আজীবন অকৃতদার| তার বিয়ে না করার কারণ হিসাবে
যেটি শোনা যায় সেটি হল, দীনেশরঞ্জন প্রথম বয়সে একজন বিশিষ্ট
শিক্ষাবিদের বাড়িতে যাতায়াত করতেন এবং সেখানে একটি অল্প বয়সের
মেয়েকে দেখে তার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন| মেয়েটি তখন ফ্রক পড়তো|
কিন্তু দীনেশরঞ্জনের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না এবং সুপ্রতিষ্ঠিত
নয় বলে, মেয়েটির অভিভাভকেরা দীনেশরঞ্জনের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে
দিতে আপত্তি করেন| মেয়েটিকে পড়াশোনা করতে বিলাতে পাঠিয়ে দেওয়া
হয়| পরে দীনেশরঞ্জনেরই এক বন্ধুর সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে হয়| শোনা
যায় এই ঘটনার পরে দীনেশরঞ্জন অবিবাহিত থাকতে মনস্থ করেন |
দীনেশঞ্জনের কিছু গ্রন্থ ও বিবিধ রচনা এখানে উল্লেখ করা হল :
‘আতঙ্ক’ (রূপক নাট্য, ১৩২৭) ; ‘মাটির নেশা’ (গল্প সংগ্রহ, ১৩৩২)
; ‘ভুঁই-চাপা’ (গল্প সংগ্রহ, ১৩৩২) ; ‘কাজের মানুষ’ (ব্যঙ্গ
রচনা)| ‘দীপক’ ও ‘রাতের বাসা’ নামক তার দুটি উপন্যাস গ্রন্থায়িত
হয় নি| এ দুটি ধারাবাহিকরূপে প্রকাশিত হয়েছিল ‘কল্লোলে’| ১৩৩৪-এর
বৈশাখ সংখ্যা থেকে ১৩৩৫-এর চৈত্র সংখ্যা পর্যন্ত (কার্তিক ১৩৩৪
বাদ দিয়ে) বেরিয়েছিল ‘দীপক’ এবং ১৩৩৬-এর জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা থেকে
পৌষ পর্যন্ত (আশ্বিন বাদে) ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছিল ‘রাতের বাসা’|
১৩৩৬-এর পৌষ মাসে ‘কল্লোলে’র প্রকাশ আকস্মিক ভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায়
‘রাতের বাসা’ উপন্যাসটি অসম্পূর্ণ রয়ে যায়| এ ছাড়া ‘ভারতী’,
‘বঙ্গবাণী’, ‘চিত্রপল্লী’, ‘নাগরিক’ প্রভৃতি পত্রিকাতেও তার
লেখা প্রকাশিত হয়েছে|]
দীপক সেনগুপ্ত
শীতের
রাত্রি| পথের ধারে কেরোসিনের আলোগুলি কাঁচের উপর হিম পড়িয়া ধোঁয়াটে
হইয়া গিয়াছে| তাহারই উপর দিয়া দুএকটা শিশিরের ফোঁটা গড়াইয়া পড়িয়াছে|
তাহার জন্য কাঁচগুলি কাটা বলিয়া মনে হইতেছে| পথের পাশে একস্থানে
একটা আতা গাছের নীচে আবর্জ্জনার স্তূপ| তাহার ভিতর গর্ত্ত করিয়া
কুকুর-মাতা তাহার সদ্যপ্রসূত সন্তানগুলিকে লইয়া শুইয়া আছে| রাস্তা
জনশূন্য| শীতের সন্ধ্যা নামিয়া আসিলেই গৃহস্থ কেহ বড় আর বাহিরে
থাকে না| সন্ধ্যার পরে গ্রামে ঢুকিলে মনে হয় যেন রাজত্বের একটা
শূন্য পুরী মানব শিশুর আগমন প্রতীক্ষা করিতে করিতে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে|
সেই শব্দবিহীন, নিরালা পথে কাহার চলার পায়ের শব্দ উঠিল| কুকুরটা
একবার চোখ খুলিয়া চাহিল, দুএকবার ঘেউ ঘেউ করিয়া ডাকিয়া উঠিল,
আবার দুএকটা অস্পষ্ট শব্দ করিতে করিতে শুইয়া পড়িল| পায়ের শব্দ
একটি কুটীরের কাছাকাছি আসিতেই, প্রদীপ হাতে দরজা খুলিয়া একটি
মেয়ে বলিল, বাবা এলে?
একটি লোক ঘরের সম্মুখে বাঁশের বেড়া সরাইয়া
খুলিয়া বলিল, হ্যাঁ এসেছি মা|
লোকটি
মদের নেশায় টলিতেছিল| হাতে একটা পুঁটুলি| তাহা যেন সে কিছুতেই
সাম্লাইয়া রাখিতে পারিতেছে না| চঞ্চল শিশুর মত পুঁটুলিটা যেন
হাত পা ছুঁড়িয়া তাহার কোল হইতে নামিয়া যাইতে চায়| তাই সে দুই
হাতে পুঁটুলিটি বুকে চাপিয়া রাখিতেছে, পড়িয়া যাইবার উপক্রম হইলে
আবার তাহা আঁকড়াইয়া ধরিতেছে| পরণের ধুতির কোঁচা অর্দ্ধেক খুলিয়া
পড়িয়াছে, গায়ের কাপড়খানি রাজ পরিচ্ছদের পৃষ্ঠ-বস্ত্রের মত ধূলায়
পড়িয়া ঝুলিতেছে|
মেয়েটি
অঙ্গনে নামিয়া পুঁটুলিটা তাহার হাত হইতে ধরিয়া লইয়া বলল, দেখো
একটু আস্তে আস্তে উঠো| কাল্কের মত আবার পড়ে না যাও| পা'টা আজ
কেমন আছে বাবা?
লোকটি ঘরের দাবার উপর উঠিয়া চৌকাঠ ধরিয়া দাঁড়াইল| পিছনের দিকে
চাহিয়া অন্ধকারে সম্বোধন করিয়া ডাকিল, এস বাবা, হিমে দাঁড়িয়ে
থেকো না|
পিতার কথায় কন্যাও অন্ধকারের দিকে চাহিল | দেখিল
একটী ভদ্রবেশী যুবক উঠানের ছোট বাগানটুকু পার হইয়া দরজার কাছে
আসিয়া দাঁড়াইল|
কন্যাকে
সম্বোধন করিয়া বৃদ্ধ বলিল, আলোটা একটু দেখা না বকুল|
বকুল প্রদীপ ধরিবার পূর্ব্বেই যুবক ঘরে
উঠিয়া দাঁড়াইল| বৃদ্ধ প্রায় পড়িতে পড়িতে মাটির উপর বিছানায় বসিয়া
পড়িল| বকুল তাড়াতাড়ি বালিশটা সম্মুখের দিক হইতে পিছনে সরাইয়া
ছিল|
বৃদ্ধ বালিশে কাৎ হইয়া পড়িয়া আরাম করিতে
করিতে বলিল, দেখ্ বকুল, বাবুটিকে ত নিয়ে এলাম, এখন শুতে দিবি
কোথায় বল্ত? খেতেই বা দিবি কি?
যুবক এতক্ষণ মাথা নীচু করিয়া ভাবিতেছিল, আর আঙ্গুল দিয়া
বিছানায় উপর আঁচড় কাটিতে ছিল| বৃদ্ধের কথায় মুখ তুলিয়া বলিল,
খাবারের জন্য ব্যস্ত হবেন না| আমার তেমন ক্ষিদে নাই| আচ্ছা,
গ্রামে কোনও অতিথিশালা নেই? আমি ত সেখানে গিয়েই রাত্রিটা কাটিয়ে
দিতে পারি|
বৃদ্ধ এবারে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিয়া বসিল| বলিল, অতিথিশালা?
বড় বাবু থাক্তে খালের ধারে একটা অতিথিশালার মত মস্ত বড় আটচালা
তুলে রেখেছিলাম বটে| সে অনেকদিনের কথা| বড় বাবু দেহ রেখেছেন,
তাও প্রায় দশবছরের উপর হ'ল|
বিছানায়ই ত দুজনে শুতে পার্বে, কি বলিস্?
বকুল মাথা নাড়িয়া সম্মতি জানাইল| যুবক বলিল,
তবু এক ঘরে, ওঁর অসুবিধা হবে|
বৃদ্ধ যুবকের হাতে হাত দিয়া বলিয়া উঠিল,
উনি? উনি কে? বকুল? তাতে কি হয়েছে? ওর ভাই থাক্লে কি এক ঘরে
থাক্ত না? আমার ত আর দুটো ঘর নেই|
যুবক আবার মাথা নীচু করিল| বৃদ্ধ বলিল,
আন্ত পুঁটুলিটা বকুল|
বকুল উঠিয়া গিয়া গৃহকোণ হইতে পুঁটুলি আনিয়া পিতার সম্মুখে রাখিল|
বৃদ্ধের হাত কাঁপিতেছিল, অনেকক্ষণ চেষ্টা করিয়াও গিঁঠ্ খুলিতে
পারিল না| যুবক পুঁট্লিটা সরাইয়া লইয়া খুলিয়া দিল| বৃদ্ধ একটা
কাল বোতল বাহির করিয়া উঁচু করিয়া আলোর গায়ে ধরিল| বকুল উঠিয়া
যাইতেছিল, বৃদ্ধ বলিল, দে'ত মা ছোট গেলাসটা| যে শীত! হাড় শুদ্ধ
গুঁড়ো হ'য়ে যাচ্চে| তুমিও একটু খাবে ত বাবা? যুবক মাথা নাড়িয়া
মৃদু হাসিয়া বলিল, আমি খাই না|
বৃদ্ধ উত্তর শুনিয়া চোখ কপালে, তুলিয়া, ভ্রূ বাঁকাইয়া প্রশ্ন
করিল, সহরে থাক, বাবু মানুষ আর মদ খাও না? তবে হাঁ এ কথা বল্তে
পার, এ সব বাজে-মার্কা খাও না| কিন্তু কি জান, আমিও মদ খাওয়াটা
বড় পছন্দ করি না| আমাকে প্রথম মদ ধরিয়েছিল কে জান? আমাদের জমিদার,
আমাদের যে কর্ত্তা, যে রক্ষক! এই বলিয়া বৃদ্ধ আবার হো হো করিয়া
পাগলের মত হাসিয়া উঠিল|
সেই রাত্রির মত আহারাদি শেষ করিয়া সকলে শুইয়া পড়িল|
কিছুকাল হইতে যুবক বৃদ্ধের বাড়ীতেই
থাকে| যুবক বৃদ্ধের সঙ্গে ঘরে বসিয়া কাজ করিত| বৃদ্ধ ভাঙ্গা
ঢোল্ ছাউনি দিত, বাঁয়া তবলা সারিয়া দিত, সেতার এস্রাজ প্রভৃতি
মেরামত করিত| এই ছিল তাঁর উপজীবিকা|
দিনে দিনে যুবকেরও কাপড় চোপড় ময়লা হইয়া আসি| যাহা পরিয়া আসিয়াছিল,
তাহা স্থানে স্থানে ছিঁড়িতে আরম্ভ করিল| সুকোমল মুখে দাড়ি ও
গোঁফ বড় হইয়া উঠিল| জামার ছিদ্র দিয়া তাহার সুগঠিত দেহের লাবণ্য
ফুটিয়া বাহির হইত| যুবক যখন কাজ করিত, বকুল কাজের ফাঁকে দূরে
দাঁড়াইয়া তাহাকে দেখিত| মাঝে মাঝে বকুলও তাহাদের কাজে সাহায্য
করিত|
বৃদ্ধ একদিন বাহির হইতে ঘরে ফিরিয়া দেখিল, একটা ভাঙ্গা সেতারের
উপর দিয়া হাত বাড়াইয়া যুবক বকুলের হাত ধরিয়া রহিয়াছে, বকুলের
মুখ লাল হইয়া উঠিয়াছে| সে খুব ধীরে ধীরে মাথা নীচু করিয়া বলিতেছে,
না না, ছেড়ে দাও আমাকে| আমাকে বাঁচ্তে দাও| আমাকে পাগল ক'রে
দিও না|
দরজার ভিতর দিয়া মানুষের ছায়া দেখিয়া বকুল চাহিয়া দেখিল তাহার
বাবা দাঁড়াইয়া হাসিতেছে| বৃদ্ধের মুখে সুখের ও স্বস্তির চিহ্ন
ফুটিয়া উঠিয়াছে|
বৃদ্ধ বকুলের দিকে চোখ্ টিপিয়া হঠাৎ
গম্ভীর স্বরে ডাকিল-রাজীব|
যুবক কোনও সাড়া দিল না| বকুলের হাত
হইতে তাহার হাতখানি সেতারের উপর পড়িয়া গেল|
বৃদ্ধ পিছন হইতে রাজীবের পিঠে হাত রাখিয়া বলিল, কি রাজীব? ঘর
শূন্য পেয়ে আমার মেয়েকে তালিম্ দিচ্ছিলে? ভাল, ভাল| তোমাদেরই
দিন এখন| আমাদের দিন ত ফুরিয়ে গেছে|
বকুল দাঁড়াইয়া উঠিয়া একবার ডাকিল, বাবা! তাহার পরই তাহার দুই
চোখ ভরিয়া জল আসিল| চোখের পাতার উপর আসিয়া ফোঁটা দুইটি টল্টল্
করিতে লাগিল| বকুল যেন কি মন্ত্র বলে তাহাদিগকে ঝরিতে দিল না|
বৃদ্ধ একটা তবলা সরাইয়া রাজীবের কাছে ঘেঁষিয়া বসিল| তাহার পর
তাহার মুখ হাঁ করিয়া রাজীবের মুখের কাছে লইয়া গিয়া বলিল, দেখ
গন্ধ পাচ্ছ? আমি আজ মদ খাইনি| হাতের মুঠার ভিতর পয়সা দেখাইয়া
বলিল, এই দেখ পয়সা ছিল| কিন্তু খেতে গিয়েও খেলাম না| সুঁড়ির
দোকানে ঢুকে শুন্লাম, আমারই মত একটা বুড়ো মাতাল হ'য়ে মাটীর উপর
বুকে ঘা মারতে মারতে চেঁচাচ্ছে, ঘর গেল, দোর গেল, একে একে সব
ক'টা গেল, তবু কেন আমি রইলাম বেঁচে| তার ঐ কান্না শুনে, জান
রাজীব, আমাকে কে যেন মাথাটা হাতে ক'রে ঘুরিয়ে দেখাল, ঐ দেখ্,
অত মদ খেয়েও কি ওর প্রাণের জ্বালা গিয়েছে? বুঝ্তে আমার এক মুহুর্ত্ত
দেরী হ'ল না| সেই বুড়োটাকে ধরে তুললাম| আমার খোঁড়া পা, তবু তার
ঐ জ্ঞানহীন সমস্ত দেহের ভারটা যে কি ক'রে টেনে বাইরে আন্লাম
তা জানি না| তাকে ঐ গাছতলায় শুইয়ে রেখে এসেছি| আর টেনে আন্তে
পারলাম না| তুমি যাও ত রাজীব, ওকে নিয়ে এসত ঘরে|
রাজীব বৃদ্ধের কথা শুনিতে শুনিতে তন্ময় হইয়া গিয়াছিল| সে তখনও
বৃদ্ধের মুখের দিকে চাহিয়াছিল| তাহার এই অবস্থা দেখিয়া বৃদ্ধ
তাহার চোখের কাছে নিজের হাতের আঙ্গুলগুলি নাড়িতে নাড়িতে হাসিয়া
বলিল, যাক্ বাবা, আমি ভেবেছিলাম, তোমার বুঝি হ'য়ে গেছে| ভাগ্গিস্
চোখের পাতা নড়্ল| আর ভাবুক হ'য়ে কাজ নেই, এই বেলা গিয়ে ঐ বুড়িটাকে
ধরে নিয়ে এস|
রাজীব উঠিয়া বাহিরে গেল| বকুল বাবার গলা জড়াইয়া ধরিয়া তাহার
গলার পাশে মুখ রাখিয়া ডাকিল, বাবা|
বৃদ্ধ আর চোখের জল রাখিতে পারিল না| সেও হাতের পিঠ চোখ মুছিতে
মুছিতে বলিল, কি হয়েছে মা? খুসী হয়েছিস্? আর তোর বাবা ও সব খাবে
না| যতদিন খেয়েছি, তোর কান্নাতে তা ছাড়িনি| আজ নিজেরই মনে বিভীষিকা
দেখেছি| এমন মাতাল তার সব জ্ঞান হারিয়ে গেছে, তবুও প্রাণের জ্বালাটা
তখনও তাকে বিঁধে বিঁধে মার্ছিল| আমিও ত দেখেছি মদ খেয়ে কিছুই
ত ভুলতে পারি না| যত মদ ঢালি, ঐ মদের ওপর সমস্ত দুঃখটা একটা
লাল জবার মতই ভেসে ভেসে বেড়ায়| আজ এত বছর মদ ঢেলেও ঐ ওটাকে ডোবাতে
পারিনি রে বকুল!
বকুল তাহার নিজের গাল দিয়া পিতার চোখ মুছাইয়া দিয়া জিজ্ঞাসা
করিল, আর খাবে না বাবা?
বৃদ্ধ কন্যার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া
হঠাৎ তাহাকে বুকের মধ্যে টানিয়া লইল| আস্তে আস্তে বকুলের চুলগুলি
নাড়িতে নাড়িতে বলিল, রাজীব বুঝি তোকে ভালবাসে? তুই কি বাসিস্
ওকে?
বকুল বৃদ্ধের চিবুকের তলায় গলার কাছে তাহার
মাথাটি ঘষিতে ঘষিতে উত্তর করিল, হাঁ বাবা|
বৃদ্ধ একটু ভাবিয়া বলিল, কিন্তু তোদের বিয়ে
হবে না তা ত জানিস? আজও ঐ শ্মশানের ছাই-ভস্ম ঘেঁটে দেখ্লে হয়ত
তোর ছেলের পোড়া অস্থি খুঁজে পাওয়া যায়| রাজীব ত জানে না বকুল,
সে কথা|
বকুল বৃদ্ধের বাহুবেষ্টন হইতে সরিয়া আসিয়া
বলিল, আমি বল্ব তাকে সব কথা| তাহ'লেই সে আর আমাকে চাইবে না|
বেশ হবে|
বৃদ্ধ দুঃখের ব্যথায় হাসিয়া বলিল, কিন্তু
তুই কি কর্বি?
বকুল তাহার আঁচলটা টানিয়া আনিতে গিয়া হাতের বালা লাগিয়া ভাঙ্গা
তবলার উপর ঢং করিয়া বেসুরা শব্ধ হইল| বৃদ্ধ হঠাৎ চমকাইয়া উঠিল|
দুই হাতে বুক চাপিয়া ধরিল? বুকের ভিতরে যাহা আছে তাহা যেন মাথা
নাড়িয়া দিয়া উঠিতেছে| বৃদ্ধের মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল| মুখের কথা
বলিতে বলিতে বৃদ্ধের কপালে অসহ্য একটা যাতনার চিহ্ণ রেখায় রেখায়
ভাসিয়া উঠিল| কপালটা ঘামিয়া উঠিল| একটা বিকৃত শব্দ করিয়া ভাঙ্গা
যন্ত্রের মত মাটিতে গড়াইয়া পড়িল| দেহটা কয়েকবার কাঁপিয়া কাঁপিয়া
উঠিল, তাহার পর বকুলের মুখের দিকে পলকহীন দৃষ্টি রাখিয়া বৃদ্ধের
দুই চোখ যেন অনন্ত কালের জন্য চাহিয়া রহিল|
বকুল কাঁদিল না, নড়িল না| বৃদ্ধের দৃঢ় মুষ্টি ধীরে ধীরে খুলিয়া
দিয়া হাত দুইখানি জোড় করিয়া বুকের উপর রাখিয়া দিল| মাথার নীচে
একটা বালিশ পাড়িয়া গুঁজিয়া দিল| একখানি কাপড় দিয়া সমস্ত দেহটি
ঢাকিয়া দিল| দেয়ালের গা হইতে একটী বহু পুরাতন সেতার আনিয়া বৃদ্ধের
বুকের পাশে রাখিয়া দিল| যন্ত্র ও বাজনাগুলি খুব সন্তর্পণে ঘরের
এক কোণে জমা করিল| তাহার পর সব কাজ সারিয়া দরজার গায়ে হেলান
দিয়া বসিয়া ভাঙ্গা পথের ধূলার পানে চাহিয়া রহিল|
রাজীব তখন অন্য বৃদ্ধটিকে ধরিয়া আনিতেছিল| বৃদ্ধ তখনও ঘোর মাতাল|
তখনও মাঝে মাঝে গভীর শোকে ও দুঃখে কাঁদিয়া উঠিতেছে|
কান্নার শব্দে বকুলের চমক ভাঙ্গিল| সে ঐ দৃশ্য দেখিয়া, ধীরে
ধীরে নামিয়া গেল| রাজীবের কাণে কাণে বলিল, এখন ওকে ঘরে নিয়ে
কাজ নেই| বাবা একটু শুয়েছেন| চল ওকে দুজনে ধরে ঘাটের চালাটাতে
এখন শুইয়ে রেখে আসি|
একদিকে রাজীব ও অন্য পাশে বকুল বৃদ্ধটিকে ধরিয়া প্রায় শূন্যে
তুলিয়া চালায় আনিয়া শোয়াইয়া দিল| রাজীব একটা নিশ্বাস ফেলিয়া
সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া বকুলের দিকে তাকাইল| বকুলও শ্রান্ত বক্ষের
নিশ্বাস ফেলিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, তারপর?
দুইজনে দুইজনেই দিকে কিছুকাল তাকাইয়া রহিল| বকুল আর যেন দাঁড়াইতে
পারিল না| খড়ের গাদার উপর বসিয়া পড়িল| রাজীব বলিল, বকুল তুমি
ঘরে যাও, আমি এখানে থাক্ছি|
বকুল একটু ম্লান হাসিয়া বলিল, আমি ঘরে গিয়ে কি কর্ব? তুমিই বা
এখানে থেকে কি করবে? কারুর কিছু কর্বার নাই|
রাজীব বলিল, তোমার বাবা আবার জেগে উঠে তোমাকে
খুঁজবেন ত? তাঁর যে ঘুম!
বকুল একটা বড় করিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া একখানি
খড় টানিয়া লইয়া ভাঙ্গিতে ভাঙ্গিতে বলিল, না, খুঁজ্বেন না| তাহার
পর সে চালা হইতে বাহির হইয়া পিছনের উঠানে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল|
রাজীবের ভয় হইল বুঝি বৃদ্ধ বকুলকে তিরস্কার করিয়াছেন| বুঝি বকুল
কিছু কঠিন কথা বলিয়াছে| বুঝি বা বৃদ্ধ রাগ করিয়া বকুলকে ঘর হইতে
চলিয়া যাইতে বলিয়াছেন| এই সকলের জন্য সে নিজেই যে দায়ী তাহাই
সে অনুভব করিতে লাগিল| যতই ভাবিতে লাগিল, ততই তাহার মন ব্যাকুল
হইয়া উঠিল| সে ছুটিয়া বকুলের কাছে যাইয়া দাঁড়াইল| দেখিল বকুলের
চোখে আর লজ্জার জড়িত ভাব নাই, মুখে একটা অস্ফুট হাসির রেখা তাহার
যৌবনের সুষমাকে কঠিন করিয়া তুলিয়াছে| রাজীব বলিতে যাইয়া কিছু
বলিল না| বকুলের পাশে যাইয়া তাহার হাতখানি নিজের হাতে তুলিয়া
লইল|
বকুল কিছুই বলিল না| রাজীব মমতা ও স্নেহের সুরে ডাকিল, বকুল|
বকুল এইবার চোখ ফিরাইল| রাজীবের
চোখের দিকে তাকাইয়া বলিল, থাক্ ছেড়ে দিও না| আমি রাগ কর্ব না|
তুমি আমার হাত তোমার হাতে তুলে নিয়েছ, এখন সত্যি ক'রে বল্তে
পার, তুমি কি আমাকে ভালবাস?
রাজীব উদ্গ্রীব হইয়া উত্তর করিল,
বাসি, কিন্তু তুমি?
আমি? আমিও তোমাকে বাসি| কতখানি জান,
আমাকে আমি যতখানি ভালবাসি তার চাইতে একটুও কম না| কিন্তু আর
একটা কথা| আচ্ছা, তুমি কি আর বাড়ীতে ফিরে যাবে না?
রাজীব বলিল, না| তোমাকে পাই না পাই, তোমার কাছেই থাক্ব| সেখানে
আর যাব না| সেখানে যা আছে, তা দিয়ে আমার প্রাণ ভরেনি| তুমি ত
জান, আমার দেশে আমি দু একজনকে ভালবাস্তাম| তাদের কাছ থেকে যা
পেয়েছিলাম, সেটা হচ্ছে ভালবাসার অপমান| তারা চাইল বিলাসিতা ও
ঐশ্বর্য্যের অবসরে সখ ক'রে প্রেমের অভিনয় কর্তে| তাও করিনি তা
নয়| ক'রে দেখেছি, প্রাণ ভরে না, প্রেম নির্ব্বাক হ'য়ে আপন শান্তিতে
ঘুমিয়ে পড়ে না| তেম্নি থাকে সব| আরও বাড়ে তৃষ্ণা| কেবলই ছুট্,
ছুট্-ছোটার আর অন্ত নাই| জীবনের একটা ফাঁকে কোথাও বিশ্রামের
সময় নাই| তাদের ফেলে এসেছিলাম| এখানে এসে মনে হয়েছিল, সব ফেলে
এসেছি, কিন্তু আজ দেখ্ছি আমার এই স্নেহকাতর প্রাণটাকে ফেলে আস্তে
পারিনি| তাই বলছিলাম, যাব না ফিরে| বকুল চোখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা
করিল, যদি কিছুদিন পরে ভাল না লাগে তখনও যাবে না?
-না|
বকুল এবার হাসিল| বলিল, দেখ, তোমার
প্রাণটা এত কোমল যে তুমি যে কি কথা বল্ছ, আর সে কথার ঋণ শুধ্তে
যে জীবনের কতখানি তিল তিল ক'রে, ফোঁটায় ফোঁটায় খসে পড়বে, তার
কথা একবারও ভাব্তে পার্ছ না| আমি বল্ছি, যখন ইচ্ছে হবে তখুনি
ফিরে যেও| কিন্তু একটা কথা বল্ছি, কিছুক্ষণ আগে বাবার সব শেষ
হ'য়ে গেছে| তুমি বাইরে চলে যেতেই কথা বল্তে বল্তে হঠাৎ ঢলে পড়্লেন,
তারপরই শেষ নিশ্বাস বেরিয়ে পড়্ল|
রাজীব চম্কিয়া উঠিল| জোরে বলিয়া উঠিল, তোমার বাবা?
রাজীব ঘরের দিকে ছুটিতে গেল, বকুল
তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল, থাক্| কি হবে গিয়ে? শেষকালে তাঁর
যেটা ভাব্না ছিল, সেইটেতেই তাঁর সব শেষ হ'ল| আমিই তাঁর শেষ ভাবনার
শেষ| তাই ভাব্ছিলাম-
রাজীব জিজ্ঞাসা করিল, কি ভাব্ছিলে?
বকুল বলিল, না কিছু না| ভেবে পার
পাবার এ সমুদ্র নয়| ঢেউয়ের সঙ্গে তাল রেখে চল্তে পার্লেই যথেষ্ট|
২
বকুল বসিয়া ভাবিতেছিল, এ চমৎকার| আশ্চর্য্য একটা শান্তি| কোনও
সুখে প্রাণ লাফিয়ে ওঠে না, কোনও দুঃখেও মন ত আর কেঁদে মরে না|
এমন চমৎকার শান্তি কিসে ভাঙতে পারে? রাজীবের একটা স্পর্শে? না,
তাও আজ সম্ভব নয়| আজ যদি রাজীব এসে বলে তুমি এক্লা, তাহ'লে বুঝি
আমি এমনি শান্তিতে বিভোর হ'য়ে থাকি| সব আছে তবু চাইবার তাড়া
নাই| কিছুই কি আমার আর নাই? স্নেহ, ভালবাসা, স্বাস্থ্য, জীবন,
এ সব কিছুরই জন্য আমার আর কামনা নাই?
বকুল ভাবিতেছিল, রাজীব আসিয়া একখানি আসন পাতিয়া বসিয়া জিজ্ঞাসা
করিল, কি ভাব সারাক্ষণ বকুল?
বল্ব না| বকুল উত্তর করিল, বল্ব না|
রাজীবের প্রাণে বকুলের ঐ ছোট উত্তরটি বড় বিষম করিয়া লাগিল| তাহার
মনে হইল, সমস্ত ঘরটার ভিতর যেন তাহার নিশ্বাস লইবার মত একটু
বাতাস নেই| সে তবু ম্লান হাসিয়া বলিল, আমাকেও বল্বে না? আর কিছু
না দাও, তোমার ভাবনাটুকুও আমাকে দিতে পার না? আজ কতদিন পরে এসে
তোমার কাছে বসেছি বল ত? মনে পড়ে আজও, তোমাকে ছেড়ে, তোমাদের এই
ঘরখানি, এই উঠান, এই ঘাটের ধারের চালা, ছোট বাগানটুকু, এমন কি
ঐ আমগাছের তলায় ঐ শুক্নো কাঠের গুঁড়িটা পর্য্যন্ত ছেড়ে যে দিন
চলে যেতে হ'ল, সেদিন আমার শরীরে একফোঁটা শক্তি খুঁজে পেলাম না|
প্রথমটা সারারাত সারাদিন, মনে হ'ত, আমার এই শরীর আর মনটা যেন
দুজনে দুজনের দিকে নির্ব্বাক হ'য়ে চেয়ে থাক্ত| অনেক ভেবে তোমাকে
একলা থাক্তে দিয়েছিলাম| সাধুকাকার ওপর, তোমার নিজের ওপর সবটুকু
ভার দিয়ে, আমি ভাস্তে চেয়েছিলাম ছবির নৌকার মত, স্বচ্ছ জলের
ওপর কালো ছায়ার পাশে সাদা পালের নিস্পন্দতা নিয়ে| বহুদিন পর
আবার আজ মনে হ'ল, আমাকে না দেখেও তোমার শান্তি নাই| বকুল একটা
কাঠের খুঁটির ওপর মাথা রাখিয়া চুপ করিয়া রাজীবের কথাগুলি শুনিতেছিল,
আর মাঝে মাঝে চোখ বুঁজিয়া চোখের ভিতরের ঐ অন্ধকারটুকুর ভিতর
যেন কোন্ ছবিরই ছায়া দেখিতেছিল|
রাজীব একটু আসিতেই সে বলিল, বল, বল, আরও বল| কথা কয়টি বলিতে
বলিতেই যেন তাহার সর্ব্বদেহ জুড়াইয়া আসিল| সে আবার চোখ বুঁজিয়া
তেম্নি অসাড় হইয়া পড়িয়া রহিল|
রাজীবের চোখে তখন জল, গলা ভারী হইয়া গিয়াছে| সে বকুলের একটু
কাছে গিয়া বসিল| বকুল একটুও নড়িল না, একটিবার চাহিয়া দেখিল না|
রাজীব জিজ্ঞাসা করিল, শুন্ছ? বকুল
তেমনি অলসভাবে উত্তর করিল, হুঁ|
রাজীব আবার বলিয়া চলিল, যে দিন তুমি তোমার সেই সন্তানের কথা
বল্লে, সে দিন বল্লে, তোমার মা যেমন ক'রেই হোক, তাঁর নিজের চিতা
নিজে সাজিয়েছিলেন, সেদিন তোমারই সাম্নে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল,
এইখানেই শেষ হোক্| তারপরেই মনে হ'ল তুমি বলেছিলে, আমি দেবী নই,
আমি মানুষ, আমি নারী, আমার ইচ্ছে হয়েছিল, আমি দেখ্ব আমার সন্তান
কেমন হয়| তুমিই আবার বুঝিয়ে বলেছিলে, সে ত সন্তান নয়, সে ত আমার
আর তার যৌবনের তাগিদের রাহাজানি| তখন মনে হ'ল, তোমার আবার জীবন
আরম্ভ হয়েছিল, যেদিন তোমার সেই শিশু এসে বিদ্রোহ ক'রে তোমার
সমস্ত অতীতকে অস্বীকার ক'রে চলে গেল|
বকুল উঠিয়া বসিল| রাজীবের মুখের দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল,
তাহার পর হঠাৎ খুব চঞ্চল হইয়া উঠিল| বলিল, দেখি তোমার আঙ্গুলের
আংটিটা|
রাজীব হাত বাড়াইয়া দিল| বকুল তাহার
হাতের উপর রাজীবের হাত রাখিয়া আংটিটা দুই একবার ঘুরাইয়া দেখিয়া
বলিল, এটা সেই তোমার বাবার আংটি, না? রাজীব কিছু উত্তর দিবার
পূর্ব্বেই বকুল আবার রাজীবের হাত ছাড়িয়া দিল|
কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া থাকার পর বকুল বলিল, কিছু বল্ব না
বলেছিলাম, তুমি বড় কষ্ট পেয়েছিলে, না? মনে হয়েছিল, আমার দুঃখের
কথাও কাউকে বল্ব না, সুখের কথাও না| কেন জান? আমি এখন খুব শান্তিতে
আছি| এ যে কত স্নিগ্ধ, কত অনাকুল, তা আমি বোঝাতে পার্ব না| সারাদিন
মেরামতের কাজ করি, সাধুকাকা লোকেদের বাড়ী গিয়ে কাজ দিয়ে আসে,
নিয়ে আসে| ঠিক্ বাবার সময়ে যেমন চল্ত, এখনও সংসার তেম্নি চল্ছে|
অভাবও আছে, আর তার উপায়ও ক'রে নিতে হয়| কিন্তু তার মধ্যেও মনে
কোন হাহাকার নাই, তাও নয়| একটু আগে বল্ছিলে আজ এখানে আস্বার
আগে তোমার মনে হয়েছিল, তোমাকে না দেখেও আমার শান্তি নেই! ঠিক্
তাই, প্রতিদিন, প্রতি মুহুর্ত্তে ইচ্ছে করে, তোমাকে কাছে দেখি,
ইচ্ছে করে একটা নিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকি, ইচ্ছে করে আমার একটি
পদ্মের মত শিশুকে কোলে ক'রে দেখি, আমাদের সমস্ত আকাঙ্ক্ষাকে
কেমন ক'রে তার পাপড়ি ভরে সে নিয়ে এসেছে| সবই ভাবি, কিন্তু অশান্ত
হই না| উদ্গ্রীব থাকি, ছট্ফট্ করি না| জানি, তোমারও দিনরাত এমনি
ভাবেই যায়| কিন্তু রাজীব, মনে ক'রে দেখ দেখি, যা হাত বাড়ালেই
পাই, অথচ জানি না তার শেষ কোথায়, তাকে তোমার আমার মধ্যে স্থান
না দিয়ে ভাল করেছি কিনা| আমাদের দুজনের বুকের মাঝখানে সে যত
বেড়ে উঠ্ত, আমরা তত দূরে চলে যেতাম| শেষকালে হয়ত জীবনের একপ্রান্তে
এসে পিছন ফিরে দেখ্তাম মরণ আর জীবনের মাঝখানে এক তিল স্থান নেই,
যেখানে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর বাতাসকে শেষ নিশ্বাসটিও ফিরিয়ে যেতে
পারি|
বকুলের কথা শেষ হইতেই সাধুকাকা, সেই বৃদ্ধ, আসিয়া বলিল, ওরে
ওরে বকুল, আজ ভারি মজা হয়েছে| আজ তাকে দেখ্লাম| আমার পেছনে পেছনে
এসে বাড়ী দেখে গেছে| আমি সব টের পাচ্ছিলাম, কিন্তু একটুও তাকে
জান্তে দিইনি| রাজীব কোনও কথা বলিল না| বকুল বলিল, তাহ'লে অনেকদিন
পরে গ্রামে এলেন| শুনেছিলাম আজকাল তাঁর অনেক কাজ| সহরেই নাকি
খুব কাজ করছেন| সভায় বক্তৃতা করেন, কাগজে লেখেন, সমাজে একজন
গণমান্য লোক|
বৃদ্ধের দুইটি চোখ হাসিতে ভরিয়া উঠিয়াছিল| শীর্ণ গালে রক্তের
আভা ফুটিয়া উঠিল| সে আরও চুপি চুপি বলিল, বোধ হয় টাকা ফুরিয়ে
গেছে তাই জমিদারীতে এসেছে| কালই সব খবর পাব| এইবার আমার হাতে
পড়েছ যাদু, এবার তোমার টুটি ছিঁড়ে নদীতে ফেলে দেব| নদী লাল হ'য়ে
উঠ্বে| বলিতে বলিতে বৃদ্ধের কপালের ও হাতের শিরাগুলি ফুলিয়া
উঠিল| প্রতিশোধের আশায় তাহার দুই চোখ জ্বলিতে লাগিল|
বকুল তাহা লক্ষ্য করিল| ধীরে ধীরে বৃদ্ধের কাছে যাইয়া বলিল সে
কে জান ত সাধুকাকা?
বৃদ্ধ রাগিয়া বলিল, জানি, জানি সে জমিদারের
ছেলে| তাতে আমি ভয় করি না| আমার আবার কিসের ভাবনা? দেব বেটাকে
শেষ ক'রে|
বকুল বৃদ্ধের মুখের উপর হাত চাপা দিয়া বলিল,
সে শুধু জমিদারের ছেলে নয়, আমারও কেউ|
বৃদ্ধ চাপা হাতের ভিতর দিয়াই রুখিয়া চীৎকার
করিল, কেউ না| ওটা রাক্ষস|
বকুল এবার হাত নামাইয়া লইল| তারপর মৃদু হাসিয়া বলিল, রাক্ষস
হ'তে পারে| আমি রক্ত দিয়েছিলাম তাইত সে ক্ষুধা মেটাতে পেরেছিল|
আমি নিজে যদি তা না দিতাম, সাধ্য ছিল তার?
বৃদ্ধ এবার বসিয়া পড়িল| ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়া ক্ষীণস্বরে বলিতে
লাগিল, তাই ত! কেবল ত তারই সব দোষ নয়| তাহার পরেই বড় ব্যাকুল
ভাবে বলিল কিন্তু কেন এমন করেছিলি বকুল| তুই ত যে-সে মেয়ে না|
তুই কি ক'রে ও কাজ কর্লি? তোরা বড় ঘরেরই মেয়ে, শিক্ষা পেয়েছিলি,
বাপ অমন বুদ্ধিমান্ লোক, তার মেয়ে তুই-
বকুল দেখিল বৃদ্ধের যেন প্রাণ ফাটিয়া বাহির হইতেছে| সে বৃদ্ধের
মুখের কথা কাড়িয়া লইয়া উত্তর করিল, কেন করেছিলাম? খুব সোজা কথা|
তাকে খুব ভাল লেগেছিল| আর ভাল লেগেছিল তাদের বাড়ীর প্রচুর স্বচ্ছন্দতা|
মা সে বাড়ীতে থাক্তেন, অনেক দিন আগে থেকে| বাবারা আর তারা এক
জাত, তবু বাবা তাদের উপকার, করা ছাড়া, একটি উপকার তাদের কাছ
থেকে ভিক্ষে ক'রে নেন্ নি| মাকেও থাক্তে দিয়েছিলেন ঐ ভাব থেকে|
এঁর বাবা বেঁচে থাক্তে মা তাঁদের বাড়ীতে গিয়েছিলেন| ইনি তখন
শিশু, মাতৃহীন, আর আমিও শিশু| ঐ মাতৃহীন শিশুর নাম ক'রে বৃদ্ধ
রামকমল মাকে বাবার কাছ থেকে ব'লে কয়ে তাঁর পরিবারে নিয়ে গিয়েছিলেন|
তারপর ত সবই জান| আমিও বড় হ'লাম, তিনিও বড় হ'লেন| সবাই দেখ্ত
আমরা খেলার সাথী| তারপরে যে কোন্ ফাঁকে সবাইকে ফাঁকি দিলাম তা
আমারও ভাল ক'রে মনে নেই| রাজীব বহুক্ষণ নীরব হইয়া বসিয়াছিল|
এবারে সে দৃঢ়মুষ্টিতে মাটীর উপর আঘাত করিয়া ঘৃণার সুরে বলিল,
কিন্তু সেই শিশুকে এমন ক'রে হত্যা কর্ল কেন?
বকুল রাজীবের মুখের দিকে চাহিয়া হাসিল| খুব স্পষ্ট করিয়া আস্তে
আস্তে বলিল, হত্যা কর্ল কেন? তার মান, তার সমাজ বড়, না, ঐ ক'টা
নিশ্বাস মাত্র যে নিয়েছে ঐ শিশুটা বড়| তাও, রাখ্বার কোনও বিধান
নাই, মেরে ফেল্লেও কোনও শান্তি নাই| তাকে হত্যা কর্তে হ'ল বলেই
কর্ল| সেইটেই সব চাইতে সুবিধের ছিল| মা সেই সুবিধাকে দুষ্কর
কর্তে গিয়েছিলেন, বিধিমত তাঁকে সরান হ'ল| সেই মৃতদেহের বুকের
উপর ঐ শিশুকে লুকিয়ে রেখে একসঙ্গে চিতার উপর ভস্ম করা হ'ল| আমি
ত এতকাল তা জান্তাম না|
রাজীব বলিয়া উঠিল, দস্যুর চাইতেও নৃশংস এরা!
বকুল তেমনি স্থিরভাবে উত্তর করিল,
আমি ওদের হ'য়ে এটুকু বল্তে পারি, আর যদি কোনও পথ থাক্ত, তাহ'লে
ওরা এতখানি নিষ্ঠুর কাজ কর্ত না| তারাই বা কি কর্বে| তোমরা তাদের
থাক্বার স্থান রাখনি, যাবারও পথ রাখনি| যদি কোনও জবাবদিহি না
দিয়ে মানুষের সন্তান বলে ঐ শিশুকে তাদের বাড়ীতে রাখা চল্ত, আমি
জোর ক'রে বল্তে পারি, তিনি ওকে এমন ক'রে মানুষ করতেন, যাতে ওর
মন শান্তি পায়| তা ছাড়া পিতৃহীন যুবক, তাকে সাহস দেবার কেউ ছিল
না, দুঃসাহসে সবাই তাকে চোখ ঢেকে নিয়ে গিয়েছিল| আমার যদি জ্ঞান
থাক্ত, আমি তাঁকে বল্তাম, ঐ শিশুকে রাখ্তে, না হয় আমি নিজে নিতাম|
আমার এখন যে দশা, উপলক্ষ্যটুকু বেঁচে থাক্লে তার বাড়া কিছু কর্তে
পারত না কেউ|
বৃদ্ধ বলিল, ওরাই ত তোর বাবাকে মদ ধরালে!
বকুল বলিল, ধরাবে না? ঐ একটা মুখ ছিল, যে বিচার চাইতে পারে|
তর গলায় আকণ্ঠ বিষ ঢেলে দিয়ে সে শক্তিকে চূর্ণ কর্বে না তারা?
বাবাকে তারা বোঝাল, তুমি শোক ভুল্বে| সব ভাল মানুষ যা করে, বাবাও
তাই কর্লেন| সাধুকাকা, আজ মনে পড়ে, একদিন তোমার আর্ত্তনাদ শুনেই
বাবার মনে পড়্ল, এতদিনের বিষের স্রোত ঢেলেও একটা বোঝা তলিয়ে
দিতে পারে নি| আর সেই শেষ|
বকুলের কথা শেষ হইবার পরও বৃদ্ধ চুপ করিয়া বসিয়া কি ভাবিল| তাহার
পর ধরা গলায় প্রশ্ন করিল, কিন্তু তাকে ত দেখ্লাম না একদিন| সে
যেন তার শেষ ক'রে আমার আরম্ভ ক'রে দিয়ে গেল| আচ্ছা বল্ত, তার
পর কি হবে?
বকুল জিজ্ঞাসা করিল, কার পর? তুমিও যখন চলে যাবে?
হ্যাঁ তখন?
বকুল মুখ ফিরাইয়া রাজীবের দিকে চাহিতেই বৃদ্ধ বলিল, কিন্তু লোকে
আবার কথা তুল্বে| মানুষের বিশ্বাস একটু বয়েস বেশী হ'লে তাকে
দিয়ে কোনও ভয় থাকে না| রাজীবকেও তাই সন্দেহই কর্বে|
বকুল বলিল, সন্দেহ কর্বে? আজ যদি রাজীব
আমাকে বিয়ে করে?
বৃদ্ধ এবার হাসিয়া উঠিয়া বলিল, না তাহ'লে
আর কি বল্বে?
বকুল
হঠাৎ গম্ভীর হইয়া বলিল, দেখ রাজীব, প্রাণ গেলেও আমাকে বিয়ে কোরো
না| আমি যদি তোমাকে প্রলোভনে টানি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেও|
তার পূর্ব্বে যতদিন পার, আমাকে জান্তে দিও, তুমি আমার কাছে আছ|
দেখ্তে না পাই তোমাকে, যেন মনে কর্তে পারি এক মুহুর্ত্তে তোমাকে
কাছে পেতে পারি| তুমি কোথাও আমার পাশে পাশে আছ সেটা জীবনের বাইরেই
হোক্, আর ভিতরেই হোক্, কিছু আসে যায় না|
বৃদ্ধ বকুলের ছোট হাতখানি ধরিয়া নিজের চোখের উপর বুলাইতে বুলাইতে
বলিল, কিন্তু যদি-
রাজীব বাধা দিয়া বলিল, যদি আবার তেম্নি
হয়? আমাদের সমস্ত অক্ষমতাকে ঢাক্তে গিয়ে একটা বিপুল সম্ভাবনাকে
নষ্ট কর্ব না| আর সেই শিশু যাতে পরে আমাদের শত্রুর মত মনে না
করে, তার ব্যবস্থা তার শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গেই হবে|
বৃদ্ধ উঠিয়া মুখ হাত ধুইতে গেল| রাজীবও দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল,
আজ তবে যাই বকুল?
বকুল তাহার দিকে চাহিয়া বলিল, আর একটু বসো| আর একটা কথা আছে|
রাজীব জিজ্ঞাসা করিল, কি?
বকুল হাসিতে হাসিতে বলিল, এতক্ষণ যা বল্লাম
তা'ত সব কবিত্বের মতই শোনাল| তাই না? আচ্ছা, আমি যদি বলি তুমি
আবার এসে আমাদের সঙ্গে থাক্বে, পার্বে তা?
পার্ব মানে?
না, আমি নিজে জান্তে চাই, তোমাকে কাছে পেয়েও আমি যা বলি আর ভাবি
তা সম্ভব হয় কিনা| আর লোকেরাও জান্বে সেই আমি এই| এটা কি মন্দ
কথা?
রাজীব বলিল, এতক্ষণ আমারও ঠিক্ তাই মনে হচ্ছিল| নিজেকে শাসন
কর্তে হ'লে যে কতখানি খাঁটি আর কতখানি নিষ্ঠুর হ'তে হয়, তা যে
মা সন্তানকে শাসন কর্তে গিয়ে তাকে শাস্তি দেন্ তিনিও বোধ হয়
ধারণা কর্তে পারেন না| কিন্তু সব
সম্ভব হবে কি?
বকুল বিস্মিত হইয়া বলিল, কেন হবে না? সমস্ত
শূন্য ভরে বতাস নিরন্তর তার কাছে রয়েছে, কিন্তু শূন্যের গায়ে
কোথাও একটা আঁচড়ের দাগ দেখেছ?
রাজীব স্বীকার করিল, তবে তাই হবে| আমি হার মান্তে চাই, তুমি
বিজয়িনী হ'য়ে আমাকে আশ্রয় দিও, তুমি যদি নিজেকে ভোল, আমি আমার
শক্তি দিয়ে তোমাকে রক্ষে কর্ব|
রাজীব উঠিতেই চাহিয়া দেখিল, বৃদ্ধ সাধুকাকা ভিজা গামছা দিয়া
মুখ মুছিতেছে, আর তাহাদের দিকে চাহিয়া নীরবে হাসিতেছে|
বকুল উঠিয়া পড়িয়া সাধুকাকাকে এক ঝাঁকানি দিয়া বলিল, হাস্ছ যে?
ঠাট্টা মনে কর্ছ সব?
বৃদ্ধ উপহাস করিয়া বলিল, ধর যেন আমি পৃথিবীর হ'য়ে তোদের ঐ সব
কথা শুনে হাস্ছি| সর্ব্বদা মনে রাখিস্ পৃথিবী কেবলই তোদের দিকে
তাকিয়ে হাস্ছে| একটুও তোদের বিশ্বাস কর্ছে না|
বকুল বলিল, ইস্|
রাজীব বলিল, আচ্ছা! দেখা যাবে|
(
‘কল্লোল’ মাসিক পত্রিকা, ফাল্গুন, ১৩৩০ )|