প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

তারপর

দীনেশরঞ্জন দাশ

         [ লেখক পরিচিতি : দীনেশরঞ্জন দাশের জন্ম চট্টগ্রামে ১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দের ২৯শে জুলাই| আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুর পরগণায় (ঢাকা) কুমোরপুর গ্রামে| 'সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান' গ্রন্থে অবশ্য জন্মস্থান হিসাবে কুঁয়রপুর-ফরিদপুরের উল্লেখ রয়েছে| পিতা ছিলেন কৈলাশচন্দ্র দাশ বাহাদুর এবং মাতা ইচ্ছাময়ী দেবী| পিতা নববিধান ব্রাহ্ম সমাজের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত কর্মচারী ছিলেন| কৈলাশচন্দ্রের ছিল চার পুত্র ও তিন কন্যা; মনোরঞ্জন, বিভুরঞ্জন, দীনেশরঞ্জন, প্রিয়রঞ্জন এবং চারুবালা, তনুবালা ও নিরুবালা (বা নিরুপমা)| চট্টগ্রামে কৈলাশচন্দ্রের বাসগৃহের নাম ছিল 'আশা কুটীর'| কৈলাশচন্দ্র, ইচ্ছাময়ী ও অন্যান্য ভক্তেরা এখানে নিত্য উপাসনায় বসতেন| দীনেশরঞ্জনের অতি অল্প বয়সেই তার পিতা পরলোক গমন করেন| ধর্মপ্রাণা, দৃঢ়চেতা মাতার কাছেই ছেলেমেয়েরা মানুষ হয়| ইচ্ছাময়ীর শিক্ষাগত যোগ্যতা জানা না থাকলেও তিনি অল্প বয়স থেকেই কবিতা লিখতেন| 'আশা কুসুম' নামে তার একটি কাব্য গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছিল| দীনেশরঞ্জন চট্টগ্রাম স্কুল থেকে এনট্রেন্স পাশ করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন, কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় পড়াশোনা বেশিদূর এগোয় নি| পরে আর্ট স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন কিন্তু সেখানেও পাঠক্রম শেষ করেন নি| কার্টুন ও ছবি খুব ভাল আঁকতে পারতেন|

           পিতার মৃত্যুর পরে পরিবারের সবাই কলকাতায় চলে আসেন| দীনেশরঞ্জন ছিলেন চঞ্চল প্রকৃতির মানুষ| কোন একটি জায়গায় বেশিদিন কাজ করা ছিল তার স্বভাব বিরুদ্ধ| তার প্রথম কর্মক্ষেত্র ক্লাইড ফ্যান কোম্পানি; পরে যোগ দেন ১১/১ এসপ্ল্যানেড ইস্টে অবস্থিত সারদারঞ্জন রায়ের ক্রীড়া সরঞ্জাম বিক্রির দোকানে সেলসম্যান হিসাবে| সারদারঞ্জন ছিলেন মেট্রোপলিটন কলেজের ক্রীড়া শিক্ষক| সে কাজও বেশিদিন ভাল লাগেনি| পরে চলে আসেন লিণ্ডসে ষ্ট্রীটের একটা ওষুধের দোকানে| এখানে ভদ্র ও নম্র ব্যবহারের জন্য ক্রেতাদের সঙ্গে তার মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল| কিন্তু এখানেও মন টেকেনি দীনেশরঞ্জনের| সাহিত্য রচনা ও ছবি আঁকার দিকেই তার আগ্রহ ছিল বেশি| এই ইচ্ছা ফলবতী হবার মত অনুকূল পরিবেশের অভাবেই হয়ত তার মন সদা চঞ্চল ছিল|

          দীনেশরঞ্জনের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না| এই অবস্থাতেই নতুন লেখকদের নিয়ে ১৩৩০ বঙ্গাব্দে বন্ধু গোকুলচন্দ্র নাগের সঙ্গে সম্মিলিত ভাবে প্রকাশ করেন 'কল্লোল' নামে একটি সাময়িক পত্রিকা| প্রচলিত প্রথার বাইরে গিয়ে একটি নতুন ধারার সৃষ্টি করে এই পত্রিকাটি| সাহিত্যিক মহলে ঝড় তোলা এই সাময়িক পত্রটিকে সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে অনেকে একটি নতুন যুগের প্রবর্তক বলে মনে করেন| অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তার বিখ্যাত ‘কল্লোল যুগ’ নামক গ্রন্থে এই সময়টির উল্লেখ করেছেন|

          যক্ষারোগে গোকুলচন্দ্রের অকালমৃত্যু ঘটলে পত্রিকা প্রকাশের যাবতীয় ভার দীনেশরঞ্জনের উপর এসে পড়ে| 'কল্লোলে'র মালিকানা থেকে যে সামান্য আয় হত তা দিয়ে গ্রাসাচ্ছাদন করাই শক্ত ছিল| কিন্তু উৎসাহের অন্ত ছিল না| এর মধ্যেই দীনেশরঞ্জন পটুয়াটোলা লেনে 'কল্লোল পাবলিশিং হাউস' খুলে বসেন| বিভিন্ন লেখকের বেশ কিছু বই ছপানো হয় এই সংস্থা থেকে| বইয়ের প্রচ্ছদ সজ্জা এবং কার্টুন আঁকা দু ধরণের কাজেই দীনেশরঞ্জন ছিলেন যথেষ্ট পারদর্শী| তার অঙ্কিত কার্টুনের পাশে D.R শব্দটি লেখা থাকতো| 'কল্লোলে'র মালিকানা থেকে আয় হত সামান্যই| মেজদা বিভুরঞ্জন এক সময়ে কিছু অর্থ সাহায্য করলেও শেষের দিকে পত্রিকা চালাতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন দীনেশরঞ্জন| অর্থোপার্জনের জন্য তিনি চলচ্চিত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েন| চিত্র বিশেষজ্ঞ ধীরেন্দ্রনাথের অধীনে কাজের সূত্রে ফটোগ্রাফি বিষয়েও তিনি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন| চলচ্চিত্র সম্বন্ধে তার চিন্তা ও ধারণা তিনি ব্যক্ত করেছেন ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের 'কল্লোলে' আষাঢ়, শ্রাবণ, অগ্রহায়ণ ও পৌষ সংখ্যায় প্রকাশিত 'চলচ্চিত্র' নামক প্রবন্ধে|

          'কল্লোল' পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বুদ্ধদেব বসু যথেষ্টই দুঃখিত হয়েছিলেন| সেটাই স্বাভাবিক কারণ বুদ্ধদেব বসুর মত অনেক সাহিত্যিককে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছে 'কল্লোল'| বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন -"যদি 'কল্লোল' আজ পর্যন্ত চলে আসতো এবং সাম্প্রতিক নবীন লেখকদের গ্রহণ করতো তা হলে সেটি হত বাংলা দেশের একটি প্রধান - এবং সাহিত্যের দিক থেকে প্রধানতম - মাসিকপত্র, আর দীনেশরঞ্জনের নাম সম্পাদক হিসাবে হয়ত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের পরেই উল্লেখিত হতে পারতো| এ কথা মনে না-করে পারিনা যে এ-গৌরব দীনেশরঞ্জন ইচ্ছে করেই হারালেন - বাংলা সিনেমা বাংলা সাহিত্যের প্রথম ক্ষতি করলো| 'কল্লোলে'র অপমৃত্যুর জন্য অন্তত আংশিকরূপে দায়ী হয়ে|" কিন্তু দীনেশরঞ্জন চলচ্চিত্রে যোগদান করেছিলেন সম্ভবতঃ অর্থকষ্ট থেকে মুক্তি পেতেই| 'কল্লোল' চালাতে গিয়ে ঋণের জালে জড়িয়ে না পড়লে তিনি 'কল্লোল' বন্ধ করে দিতেন না|

         যাই হোক দীনেশরঞ্জন আমৃত্যু চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন| অভিনয়ও তিনি খারাপ করতেন না| কেশবচন্দ্র সেনের বাসভবন 'কমল কুটীরে' কেশবেরই রচিত 'নব বৃন্দাবন' নাটকে অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেছেন| ১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দে তিনি নিউ থিয়েটার্সের অন্যতম ডিরেক্টর হিসাবে পরিচালক মণ্ডলীতে যোগদান করেন| সিনারিও লেখক ও পরিচালক হিসাবেও তিনি কাজ করেছেন| 'আলোছায়া' তার পরিচালিত একটি চলচ্চিত্র| ১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত হেমচন্দ্র চন্দ্র পরিচালিত 'প্রতিশ্রুতি' ছায়াছবিতে অভিনয়ের কাজ শেষ করে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন| ডিউডোনাল আলসারে আক্রান্ত হয়ে মাসখানেক রোগ ভোগের পর তার ভাই, বোন ও ভাতৃবধূদের বহু চেষ্টা সত্বেও, বড়দিদি চারুবালা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলিপুরস্থিত বাসভবনে ১৯৪১ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই মে সোমবার বেলা ৩টা ৩৫ মিনিটে দীনেশরঞ্জন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন|

         দীনেশরঞ্জন ছিলেন আজীবন অকৃতদার| তার বিয়ে না করার কারণ হিসাবে যেটি শোনা যায় সেটি হল, দীনেশরঞ্জন প্রথম বয়সে একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদের বাড়িতে যাতায়াত করতেন এবং সেখানে একটি অল্প বয়সের মেয়েকে দেখে তার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন| মেয়েটি তখন ফ্রক পড়তো| কিন্তু দীনেশরঞ্জনের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না এবং সুপ্রতিষ্ঠিত নয় বলে, মেয়েটির অভিভাভকেরা দীনেশরঞ্জনের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে দিতে আপত্তি করেন| মেয়েটিকে পড়াশোনা করতে বিলাতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়| পরে দীনেশরঞ্জনেরই এক বন্ধুর সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে হয়| শোনা যায় এই ঘটনার পরে দীনেশরঞ্জন অবিবাহিত থাকতে মনস্থ করেন |

         দীনেশঞ্জনের কিছু গ্রন্থ ও বিবিধ রচনা এখানে উল্লেখ করা হল : ‘আতঙ্ক’ (রূপক নাট্য, ১৩২৭) ; ‘মাটির নেশা’ (গল্প সংগ্রহ, ১৩৩২) ; ‘ভুঁই-চাপা’ (গল্প সংগ্রহ, ১৩৩২) ; ‘কাজের মানুষ’ (ব্যঙ্গ রচনা)| ‘দীপক’ ও ‘রাতের বাসা’ নামক তার দুটি উপন্যাস গ্রন্থায়িত হয় নি| এ দুটি ধারাবাহিকরূপে প্রকাশিত হয়েছিল ‘কল্লোলে’| ১৩৩৪-এর বৈশাখ সংখ্যা থেকে ১৩৩৫-এর চৈত্র সংখ্যা পর্যন্ত (কার্তিক ১৩৩৪ বাদ দিয়ে) বেরিয়েছিল ‘দীপক’ এবং ১৩৩৬-এর জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা থেকে পৌষ পর্যন্ত (আশ্বিন বাদে) ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছিল ‘রাতের বাসা’| ১৩৩৬-এর পৌষ মাসে ‘কল্লোলে’র প্রকাশ আকস্মিক ভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ‘রাতের বাসা’ উপন্যাসটি অসম্পূর্ণ রয়ে যায়| এ ছাড়া ‘ভারতী’, ‘বঙ্গবাণী’, ‘চিত্রপল্লী’, ‘নাগরিক’ প্রভৃতি পত্রিকাতেও তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে|]

  দীপক সেনগুপ্ত

       অনেক মেয়েরা তাঁকে ভাল বাসত, আর অনেকে তাঁকে ভালবেসেই মরেছে| আমি জানি - তাঁর জীবনে অনেক নারীর জীবন-ধারা জড়িত| আমার এই কয়েক বছরের বিবাহিত জীবনে আমি তাঁতে যতটা জেনেছি সেইটুকুই লিখছি| তাঁর প্রথম যৌবন - যখন কৈশোরের সবুজ ঘাসের মাঠের উপর থেকে সবেমাত্র যৌবনের সোনালী ধূলায় বাঁকা পথে পা দিয়েছেন - তখন দেখা হোল তাঁর চাইতে অনেক বেশী বয়েসের এক নারীর সঙ্গে| সে তাঁকে জানাল বোঝাল অনেক কথা| বেচারা ডুব দিলেন সেই কথার তলে - যেদিন মাথা তুলে নীল আকাশের দিকে চেয়ে নিশ্বাস নিলেন - সেদিন দেখলেন - সারা অঙ্গে জড়তা - মনের কোণের সমস্ত ভবিষ্যৎটা শৈবালের সহস্র পাকে জড়িয়ে গেছে|

         সেই থেকে আমার সঙ্গে বিবাহ হওয়া পর্য্যন্ত অনেক নারীকে তিনি ভালবেসেছিলেন - আর সত্যি করেই বেসেছিলেন| সেগুলি জানতে পেরেছিলাম তাঁর লেখা বই ও গল্পের ভিতর দিয়ে| আমাদের বাড়িতে তাঁর লেখা প্রায় সব বই গুলিই আসত - আমি খুব আগ্রহ করে সেগুলি পড়তাম| তাঁর লেখার প্রতি আমার এমন একটা অনুরাগ ছিল যে লেখকের কথা আমার কখনও মনে আসত না| কোনও দিন তাঁর ছবি মনে মনে আঁকতে চেষ্টাও করিনি| তা ছাড়া লোকের মুখেও তাঁর বিষয়ে অনেক কথা শুনতাম| শুদ্ধ সেগুলো শুনে সেই মানুষটীর প্রতি ঘৃণা হবারই কথা-কিন্তু আমার কেন এমন অবসর ছিলনা যে তাও ভাবি| সে মানুষটী যেন আমার কাছে কিছুই নয়|

        তাঁর প্রথম যৌবনের একটা লেখায় দেখেছিলাম - ভালবাসা একটা মানুষকে পাবার ফাঁদ মাত্র| শুধু ভালবাসি বলেই একটা মানুষকে বিবাহ করা ঠিক নয়, মনের কতকগুলি সুভাবের জন্য তাকে পাবার ইচ্ছা হতে পারে|

       এরকম করে খুব তীব্রভাবে ও ভাষায় তিনি তখন ভালবাসা সম্বন্ধে আলোচনা করতেন| শেষকালে এক ভাঙ্গা মন্দিরের চাতালে বসে আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হোল| মন্দিরের ভিতরের দেবতা অশ্বত্থ গাছের শিকড়ের জটায় ডাকা পড়ে গেছেন - দরজার উপর বনপক্ষীর হাড়ের স্তুপ জমে উঠেছে - পাহাড়ের গায়ের ফুলহীন গুল্ম লতা ঝরণার তোড়ের মুখে মাথা বাড়িয়ে বাড়িয়ে পাখীর মত স্নান করছে - তিনি বসেছিলেন আমাদেরও মাথার উপরে আরও উঁচু একটা পাথরের উপর একটা কুল গাছের গায়ে ঠেসান দিয়ে| বছরে বছরে সে মন্দিরে মেলা বসত-মেলায় কেনা বেচা যা' হোত তা কেবল কথা আর চীৎকার| তার সঙ্গে যোগ দিত যারা তখনও ভাল করে কথা বলতে শেখেনি সেই শিশুরা তাদের বাঁশী, ভেঁপু, কড়কড়ি বাজিয়ে|

        আমাদের বাড়ির লোকেরা উপরের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন - ঐ দেখ কে বসে আছে - তোমার প্রিয় বই গুলির উনিই লেখক| আমি একবার উপরের দিকে চাইলাম - মনে হোল যেন যে পাথরটার উপর উনি বসেছেন সেইটে শুদ্ধ এখুনি গড়িয়ে পড়বেন|

      আমরা যেখানটিতে বসেছিলাম তারই সামনে একজন যুবক সন্ন্যাসী একখানি আসনের উপর হাত পা মুড়ে নানা রকম ক্রিয়া দেখাচ্ছিল-তিনি নেমে এসে সেখানে দাঁড়ালেন| দেখে মনে হোল যেন সত্যি একখানা পাথর পাহাড়ের গায়ে গড়াতে গড়াতে ঘাত প্রতিঘাত, রাগ বিরাগ, সুখ দুঃখ, ভাল মন্দের গায়ে ঘা খেয়ে আমার নয়নপল্লবের আস্তরণের উপর এসে থেমেছে|

      আমার দিকে চোখ ফেরালেন - কালো তারার উপর একটা কিসের ছায়া পড়েছিল, সেটাকে দেখাচ্ছিল ছোট একটি প্রশ্নের চিহ্ণের মত - সমস্ত দৃষ্টিটি বলচে - 'তার পর?' এই 'তার-পরের' সঙ্গে আমারও মনের 'তার-পরের' জিজ্ঞাসা গাঁথা হয়ে গেল - তাই জুড়ে হোল আমাদের বিবাহিত জীবনের গল্প সুরু|

     প্রথম কথা তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন - কি নিয়ে তুমি আমাকে চিরকাল ভালবাসবে - আর আমিই বা কি দিয়ে তোমার প্রতি অনুরাগ চিরনূতন রাখব?

     আমি ভেবে দেখলাম ওটা ছোট কথা নয়| মানুষের মনের প্রথম টানটা সত্যি যেন শিশুর কোনও কোন খেলনার প্রতি লোভের মত| খেলায়, লালায়, সুরে, রাগে সে কিছুদিন অতি চট করে চলে যায়| মানুষ হাঁপিয়ে পড়ে ভাবে - 'তারপর!' আমিও ভাবলাম তার পর কি হবে|

     কিছু আর উত্তর দিলাম না| তিনি আমার চোখ দুটোকে বলতেন - 'কালো জাম'| এই কালজামের ভিতর ছায়া ও আলোকের খেলা দেখে তিনি যেন আমার সমস্ত সঙ্কল্প ও সুখের কথা বুঝে নিতেন|

     আমরা দুজন একই বই পড়তাম - একই কথা ভাবতাম| তাঁর সমস্ত লেখা আমি নকল করে দিতাম - তিনি আমার সকল প্রশ্ন, গল্প ও কাহিনীর ভিতর ফুটিয়ে তুলতেন| অভাব ও দারিদ্র্য যেদিন আমাদের অনাহারে রাখবার ব্যবস্থা করত - আমি সেদিন খুব আশা ও উৎসাহ দিয়ে তাঁকে বাইরে পাঠিয়ে দিতাম - নিজে বসে তাঁর অনেকখানি লেখা নকল করে ফেলতাম - আর নূতন গল্পের খোরাক তৌরী করে রাখতাম| হাসিমুখে ঘরে ফিরতেন - আমরা খেলা সুরু করে দিতাম| সে খেলায় বালিশ নিয়ে মারামারিও হোত - ধরাছাড়ায় মল্লযুদ্ধও হোত|

      তাঁর লেখা পড়ে লোকে মনে করত তিনি যেন মুক্ত তরবারি হস্তে শুধু রক্তের শোধ নিতেই বেরিয়েছেন, কিন্তু আমি জানি তাঁর প্রাণটা কতখানি মায়ায় ভরা ছিল - পৃথিবীর সকল নির্য্যাতিত যেন তাঁর হৃদয় কেড়ে নিয়েছিল - যে হাতে পরের ক্ষতমুখ থেকে রক্ত মুছিয়ে দিতেন - সেই হাতেই লিখতে বসতেন বলেই বোধ হয় দু এক ফোঁটা রক্ত ঐ লেখার উপর পড়ে যেত| লোকে মনে করত তাঁকে তিনি যেন বিধান, বিধি শাস্ত্র ভাঙ্গতেই উদ্যত হয়েছেন - কিন্তু তিনি চাইতেন আরও সহজ বিধান, আরও স্বাভাবিক বিধি, আরও সমীচীন শাস্ত্রের ব্যবস্থা| তাঁর জীবনে সত্যি যে জীবনলক্ষণ দেখেছি সে তাঁর চেতনাব্যাপী একটা সংঘর্ষ| সে বিদ্রোহে কোনও মানুষের বিরুদ্ধে নয় - সেটুকু কেবল অত্যাচারটুকু অধিকারটুকু বিপক্ষেই|

      এমন একটি সর্বহারা মানুষ কেমন করে এত আশার কথা ভাবতেন, বলতেন তাই আমি অবাক হয়ে বুঝতে চাইতাম|

      আমাদের জীবনে একটা শোক এল - আমাদের একমাত্র শিশুকন্যা জন্মলাভের আটচল্লিশ ঘন্টা পরেই মারা যায়| তখন দেখেছিলাম তাঁকে আরেকরূপে| সমস্ত শোকের দুঃখটা দিয়ে সৃষ্টি করলেন আমাদের বাড়ির সঙ্গে আরেকটি ঘর| আমিও সারাদিন তাঁর সঙ্গে থাকতাম| রাত্রে বসে সে ঘর কেমন করে সাজান হবে তাই নিয়ে তর্ক করতাম|
তাঁর বন্ধুরা আসতেন-আমার বন্ধুরা আসতেন - সে ঘরে বসত মেঘের মেলা| নীল সাগরের গায়ে লাগা ধূসর মেঘের মত বন্ধুর মুখ পশ্চিমের সূর্য্যালোকে আভাময় হয়ে উঠত - কৌতুকী বন্ধুর হাস্যরসের কথায় ভাষায় দিগন্তের ঝড়োমেঘের মত সবার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠত| তাই থেকে সৃষ্টি হোত ছিটিয়ে দেওয়া অন্ধকারের ভিতর দিয়ে একটা মেঘলোকের ভৎর্সনা - একটা গল্প|

       তিনি ছিলেন কাজের সুরু - আমরা ছিলাম তার অন্ত| একলা তিনি কিছু করতে পারতেন না - আমরা না সঙ্গে দাঁড়ালে তাঁর কিছুই ফুটত না| তিনি ছিলেন যেন পৃথিবীর সাহস - আমরা ছিলাম তাঁর রণবাদ্য|

      সে ঘরে জমা হোত চিত্রকর, লেখক - আর বিদ্রোহী| তাঁরা জিজ্ঞাসা করত ক্ষণে ক্ষণে "তুমি কি করতে চাও? কিছুইত বোঝাতে পারনা|"

      তাঁর চোখের তারা স্থির হয়ে যেত -ঠোঁট দুটি ব্যাথায় ছিন্ন হয়ে উঠত - "আমি খুঁজি বহুদিনের বাঁচবার পথ! মানুষকে আমি অমর করব| এ স্পর্দ্ধা আমার নিজের নয় - পড়ন্ত রৌদ্রের আলোর ভিতর যেমন একটা পূর্ব্বেকার ইতিহাস প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে-আমারও জীবনে মানুষের ব্যাথার ভাণ্ডারের একটা নিমন্ত্রণ আছে - সে নিমন্ত্রণ কবে রাখতে পারব জানি না - কিন্তু তা যে রাখতে পারিনি তারই ভাষাহীন ব্যাকুলতা আমার না বোঝাতে পারার অক্ষমতা|"

      আমাদের দুটির ভিতরের সংসার তখন অনেকের পায়ের চলায় উৎকর্ণ হয়ে উঠেছে - তিনি যে প্রথম পৃথিবীতে আনন্দধ্বনি করে উঠেছিলেন তেমনি করে একদিন তৃতীয়ার চাঁদের জ্যোৎস্নার দিকে মুখ করে তিনি বললেন - "তোমরা থাক - আমি যাই|"

      তাঁর কথা আর কইব কি? তিনি নিজেই তাঁর জীবনের জটিলতায় পৃথিবীর ব্যাথার ভারের জঞ্জাল নিয়ে, রেখে গেলেন তাঁর প্রাণ| আমরা সেই প্রাণকে ধারণ করে রয়েছি - সবার মধ্যে|

      তাঁর প্রাণহীন দেহকে নিয়ে একদল লোকেরা ধর্ম্মবিধিতে সংস্কার করে এল| আমি যেতে পারলাম না|
আমি রইলম ধূসর - শ্যাম সমুদ্রের উপর তাঁর বাড়ির দিকে চেয়ে - অখ্যাত বীর যাত্রীর জীবনের ঐ সাদা পালখানির দিকে তাকিয়ে|

      আমি তাঁর ভালবাসায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছি - তাঁর শিক্ষা, তাঁর ব্যবহারের মাধুর্য্য - তাঁর অফুরন্ত দান - অনুভব আমাকে নিত্য মনে করিয়ে দেয় - "তারপর"|

                                         ( ‘বঙ্গবাণী’ মাসিক পত্রিকা, বৈশাখ ১৩৩০ )|

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।