প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

জার্ম্মান্‌ বালিকাজীবন ও জার্ম্মান্‌ গৃহ

অজ্ঞাত

( লেখকের নাম জানা যায় নি। বর্তমান প্রবন্ধটি ‘আর্য্যদর্শন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সে সময়ে অনেক পত্রিকাতেই লেখার সঙ্গে লেখকের নাম থাকত না। কিন্ত ‘আর্য্যদর্শনে’ লেখার শেষে সাধারণতঃ লেখকের নাম ছাপা হত। তবে বর্তমান প্রবন্ধের শেষে কোন নাম ছিলা না। হতে পারে এটি সম্পাদক মহাশয়েরই লেখা। বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। )

   দীপক সেনগুপ্ত

         সমস্ত ইউরোপীয় জাতির মধ্যে জার্ম্মানদিগের সহিতই আমাদিগের ঘনিষ্ঠতর সম্বন্ধ| সুতরাং জার্ম্মানদিগের রীতিনীতি ও সামাজিক পদ্ধতি জানিতে আমাদিগের স্বভাবতঃ ঔৎসুক্য জন্মিয়া থাকে| সেই ঔৎসুক্য অংশংত চরিতার্থ করিবার জন্য অদ্য জার্ম্মান বালিকাজীবন ও জার্ম্মানগৃহ বিষয়ে আমরা কিঞ্চিৎ আলোচনা করিব|

        বালিকা বিধাতার সৃষ্টির একটী অপূর্ব্ব দৃশ্য| ইহার সরল স্বচ্ছ মুখকান্তিতে যেন স্বর্গীয় ভাব প্রতিবিম্বিত দেখা যায়| ইহাকে দেখিলে স্বর্গের পরী বলিয়া বধ হয়। ইহাকে দেখিলে দুর্ধ্বৃত্তেরও মনে ধর্ম্মভাবের উদয় হয়| পিতার শ্রান্তিহারিণী, মাতার আনন্দদায়িনী, সমাজের বন্ধন-স্বরূপিণী বালিকা-যে দেশেরই হউক সকলেরই স্নেহের সামগ্রী| ভারতীয় বালিকার অন্তর্জীবনের এখন ঘোর প্রলয়কাল উপস্থিত| এই সময়ে বৈদেশিক বালিকাগণের অন্তর্জীবনের চিত্র প্রচুর পরিমাণে আলোচনা করা ভারতীয় বালিকাগণের ও তদভিভাবকগণের বিশেষ কর্ত্তব্য|

        জার্ম্মাণীতে প্রথম হইতেই বালিকাগণের চরিত্র গঠিত করিতে চেষ্টা করা যায়| তিন চারি বৎসর বয়সের সময় সকালে বিকালে বালিকার "শিশু বিদ্যালয়ে" প্রেরিত হয় বটে, কিন্তু সে সকল বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য শুদ্ধ পুস্তক পাঠ করিতে শিখান নয়| এই সকল বিদ্যালয়ে এক এক জন শিক্ষয়িত্রী নিযুক্ত থাকেন| গ্রামের বা পল্লীর কোন সম্ভ্রান্তা প্রবীণা রমণী পতিবিয়োগে উপায়হীনা হইলে ভিক্ষাদ্বারা জীবিকা নির্ব্বাহ করার অপমান হইতে তাঁহাকে রক্ষা করিবার জন্য তাঁহাকেই এই পদ প্রদত্ত হইয়া থাকে| এই প্রবীণা রমণী সর্ব্বপ্রথমে নানাপ্রকারে বালিকাদিগের চিত্ত আকর্ষণ করিতে চেষ্টা করেন| তিনি তজ্জন্য বালিকাদিগের মনোরঞ্জনার্থ নানাবিধ খেলনা ও ক্রীড়া-পুত্তলী লইয়া তাহাদিগের সহিত খেলা করেন, ও তাহারা নির্ব্বিবাদে যাহাতে পরস্পরের সহিত খেলা করে কোমল শাসনে তাহার বন্দোবস্ত করেন| এইরূপে বালিকারা অল্পদিনের মধ্যেই বিদ্যালয়ের অবস্থাকে অতি সুখপ্রদ বলিয়া মনে করিতে থাকে| বাটী হইতে বিদ্যালয়ে গমন ও তথা হইতে বাটীতে প্রত্যাগমনও তাহাদিগের স্বাস্থ্যের পরিবর্দ্ধক| সুতরাং যাতায়াতেও তাহারা ক্রমে সুখানুভব করিতে থাকে| ক্রমে তাহাদিগের মন সম্পূর্ণ নিবিষ্ট হইলে ও স্মৃতি ধারণক্ষম হইলে তাহাদিগকে বর্ণমালা পড়িতে ও ঈশ্বরস্ত্রোত্র মুখস্থ করিতে শিখান হয়| ক্রমে তাহারা যেমন বড় হইতে থাকে, তাহারা পড়িতে, গান করিতে ও ছোট ছোট কবিতা আওড়াইতে, ও তাহাদিগের ক্রীড়া-পুত্তলীদিগকে পরিচ্ছদ পরাইতে শিখে|

         আমরা যে বালিকাগণের জীবনচিত্র প্রদান করিতেছি তাহারা মধ্যবিত্ত লোকের কন্যা| ব্যবহারাজীব, চিকিৎসক, সৈনিক, বণিক ও রাজকর্ম্মচারী - ইহাঁরাই মধ্যশ্রেণী| বিশেষতঃ জার্ম্মাণীতে রাজকর্ম্মচারিগণের বেতন অতি অল্প| সেই আয়ে তাঁহাদিগের সুখসচ্ছন্দতা কথঞ্চিৎ চলে বটে, কিন্তু তাহাতে কোন প্রকার জাঁকজমক চলিতে পারে না| কন্যারা জাঁকজমক-প্রিয় হইলে, তাহাদিগের স্বামিগণ অসুখী হইবে বলিয়া তাহাদিগকে আশৈশব পরিমিতাচার শিক্ষা দেওয়া হয়| সুতরাং কন্যারা যতই কেন বিদ্যাবতী ও কলাবতী হউক না সামান্য গৃহকার্য্য পর্য্যবেক্ষণ করা অপমান বোধ করে না| জননীর দৃষ্টান্ত তাহাদিগের প্রধান শিক্ষাস্থল| জননীকে তাহারা প্রথম প্রথম নানাপ্রকার বেশভূষায় চাকচিক্যশালিনী ও বিবিধ কলায় অলঙ্কৃত দেখিয়াছিল, কিন্তু কালে তাঁহাকে পুরন্ধ্রী হইয়া-সকলের পরিচ্ছদ সীবন, রন্ধন, ও পরিচ্ছদ পাদুকাদির যথাস্থানে সন্নিবেশন প্রভৃতি - সমস্ত গৃহকার্য্যই করিতে হইয়াছে তাহাও তাহারা দেখিতে পায়| সুতরাং তাহারা সেই বালিকাবয়স হইতেই আপনাদিগের কর্ত্তব্যের জন্য প্রস্তুত হইতে থাকে|

         জার্ম্মান জননীরা পরিচ্ছদ-গর্ব্বকে এত ঘৃণা করেন, যে পাছে কন্যাগণের অন্তরে সেই অশুভ ভাব বদ্ধমূল হয় এই ভয়ে তাঁহারা তাহাদিগকে যথোচিত পরিচ্ছদে ভূষিত করেন না| ব্রিটন বালিকার তরঙ্গায়িত কেশপাশ, স্ফীত কারুকর্ম্ম সস্মুচ্ছ্বাসিত পরিচ্ছদ - জার্ম্মাণীতে দেখিতে পাওয়া যায় না| জার্ম্মান্‌ বালিকাদিগের পরিচ্ছদ সাদাসিধা, কেশ পেটীকরা, এবং একটী রঞ্জিত ফিতায় আবদ্ধ দুইটী বেণী পৃষ্ঠদেশে লম্বমান| ছোট ছোট বালিকাগণের পরিচ্ছদ আগুলফ লম্বিত; শীতকালে তাহাদিগের পাদদ্বয় কৃষ্ণ বস্ত্রের পাজামায় আবৃত| জার্ম্মান জননীরা, বালিকাগণের মুখকান্তি পরিপুষ্ট করিবার জন্য কোনও চেষ্টা করেন না; কেবল সূর্য্যালোকে যাহাতে সেই মুখ-কুমুদিনী ম্লান না হয় এই জন্য ইহাকে মুখাবরণ দ্বারা আবৃত করিয়া রাখেন| কেশের প্রতি তাঁহাদিগের বিশেষ যত্ন| সবিশেষ পরিমার্জ্জনায় কেশ এরূপ চাকচিক্যশালী হয় যে সময়ে সময়ে ইহাকে রেশম বলিয়া ভ্রম জন্মে, এবং এরূপ পরিপুষ্ট হয় যে অনেক স্থলে ইহাকে আগুলফ-বিলম্বী দেখিতে পাওয়া যায়|

        প্রাথমিক জ্ঞানোপার্জ্জন ও ধর্ম্মোপদেশ সমাপ্ত হইলে দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ বৎসর বয়ক্রম কালে ইহাকে "নাসচুল" বা সীবন-শিক্ষামন্দিরে প্রেরণ করা হয়| তথায় সে বিবিধ সূচীকার্য্য, মোজাবুনন, কার্পেট বুনন প্রভৃতি কার্য্য সমাপ্ত করিয়া, তাহারা "হোহীয়ার টচটারসুল" অর্থাৎ শিক্ষা সমাপ্তি কারী বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে| এখানে সে ফরাশি ভাষা, উদ্ভিজ্জ বিদ্যা এবং এবং নৃত্য গীত চিত্র কর্ম্ম প্রভৃতি বিবিধ কলা শিক্ষা করে|

         জার্ম্মাণীর ন্যায় আর কোন দেশেই যান্ত্রিক সঙ্গীতের এত চর্চ্চা দেখা যায় না| কি যুবা, কি বৃদ্ধ, কি ধনী কি নির্ধন- সঙ্গীতের চর্চ্চা সকলেই দুর্দ্দমনীয় ব্যসন ও বৃত্তি| ইহা ধনীর আমোদ প্রমোদের মূল, এবং দরিদ্রের জীবিকা; কারণ সঙ্গীত ব্যবসায়ীর জার্ম্মাণীতে বিশেষ আদর| ইংলণ্ডে প্রত্যেক শুভকার্য্যে সঙ্গীতোৎসব| জার্ম্মাণীতে রাজনীতির আলোচনা অপেক্ষা, সঙ্গীতের চর্চ্চাই অধিকতর বলবতী| জার্ম্মাণীতে স্বজাতিপ্রেম ও স্বদেশহিতৈষণা বক্তৃতায় বা তর্ক বিতর্কে পরিণত না হইয়া সঙ্গীতের সাহায্যে অভিগীত হইয়া লোকের চিত্ত হরণ করে|

         জার্ম্মাণ মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকে শিকাব করা, পাখী মারা, বা মাছ ধরা ভাল বাসেন না| তাঁহারা মাছধরাকে অতিশয় নীচ কর্ম্ম বলিয়া মনে করেন|

         বিবাহ বা খ্রীষ্টোৎসব ব্যাতীত অন্য সময়ে স্ত্রী-পুরুষ-সংমিশ্রণ প্রায় দেখিতে পাওয়া যায় না| এই সকল উৎসব কালে ভদ্রলোক ও ভদ্র মহিলারা একত্র মিশ্রিত হন বটে, কিন্তু সেও বিশেষ সংযমের সহিত| পুরুষেরা একদিকে বসিয়া পরস্পর কথোপকথন করেন, এবং স্ত্রীলোকেরা দল বাঁধিয়া অন্যদিকে পরস্পর আলাপ করেন| বলের(Ball) সময় স্ত্রী-পুরুষে একত্র নৃত্য করেন বটে, কিন্তু বল সমাপ্ত হইলেই যুবতী নৃত্য-সহচরের নিকট বিদায় লইয়া জননীর নিকট গমন করেন| নৃত্য-ভঙ্গের পর নৃত্য-সহচরের যুবতীর হস্তধারণে কোন অধিকার নাই| সেরূপ করিলে তাঁহাদিগের বিশেষ নিন্দা হইবে| নৃত্য-ভঙ্গের পর যুবতীর আঙ্গুলির অগ্রভাগ মাত্র স্পর্শকরণে পুরুষের অধিকার আছে| ইহার অতিরিক্ত করিলে তাঁহাদিগের সম্বন্ধ অতি ঘনিষ্ঠ বলিয়া বিবেচিত হইবে| নৃত্য-সহচর নৃত্য-ভঙ্গের পর এতদূর উদাসীন ভাব ধারণ করিলে কিন্তু ইংলণ্ডীয় রমণী আপনাকে বিশেষ অপমানিত মনে করেন|

         জার্ম্মাণীর লোকেরা অতি সামান্য ভাবে বাস করে| তাহাদিগের অধিকাংশরেই স্বতন্ত্র গৃহ নাই| একটী বাটীর চারি পাঁচতল | প্রত্যেক তলে একেকটী পরিবার বাস করে| বাটীগুলি প্রকাণ্ড, এবং বাহির হইতে দেখিতে সুন্দর; কিন্তু অভ্যন্তর ভাগ অতি সামান্য| কার্পেটের প্রচুর ব্যবহার নাই, এই জন্য মেঝে প্রায় বিবিধ বর্ণে রঞ্জিত| গৃহাভ্যন্তরে ইংলণ্ডের ন্যায় অতিরঞ্জিত ও স্থূল মশারি এখানে দেখা যায় না| এখানকার মশারি অতি পাতলা ও তরল বর্ণের, জার্ম্মাণ গৃহসামগ্রীর মধ্যে মেহাগনী কাষ্ঠের চেয়ার, টেবিল, খাট প্রভৃতিই বিশেষ দ্রষ্টব্য| জার্ম্মাণেরা কোন প্রকারে টেবিল সাজায় না| ইংরাজ-গৃহের আয়না, একটী প্রধান ভূষণ, কিন্তু জার্ম্মান্‌গৃহে আয়না এত উচ্চে টাঙ্গান থাকে, যে পদাগ্রে দাঁড়াইয়াও তাহাতে মুখ দেখা যায় না| আইভীলতা ও পিয়ানো এই দুইটীই জার্ম্মাণ্‌দিগের গৃহদেবতা| এই দুইয়ের নিকটেই সমস্ত জার্ম্মান্‌ পরিবার নত-শির| অতিশৈত্য নিবন্ধন আইভীলতা অতি কষ্টে জার্ম্মাণীতে পরিবর্দ্ধিত হয়| এত দুষ্প্রাপ্য বলিয়াই ইহার এত আদর| যদি জানালায় টবে করিয়া একটী আইভীলতা রাখিতে পারিলেন, তবেই একজন জার্ম্মান্‌ গর্ব্বেস্ফীত হইলেন|

        অনেক সময় এরূপ ঘটে যে অনেকগুলি সঙ্গীত-চর্চ্চা পরিবার একত্র এক বাটীতে বাস করেন, এবং তাঁহারা প্রত্যহ মিলিত হইয়া ঐকতানিক বাদ্যে নিমগ্ন হন| ইহার পরিণাম এই হয যে করলালিতা শিশুরাও সঙ্গীতে আনন্দানুভব করিতে শিখে| অতি শৈশবেই তাহাদিগের কণ্ঠ সঙ্গীতানুকূল হইয়া উঠে; তাহারা সঙ্গীতের মূল সূত্র শিখিবার জন্য আপনারাই আগ্রহ প্রকাশ করিয়া থাকে|

       বালিকার বয়স যখন পঞ্চদশ বা ষোড়শ তখন তাহার বিদ্যালয়ের পাঠ সমাপ্ত হয়| তখন তাহাকে ধর্ম্মোপদেশ সকল যত্নপূর্ব্বক শিখিতে হইবে, ধর্ম্মগ্রন্থ সকল পাঠ করিতে হইবে, এবং সেই সকল স্বহস্তে নকল করিতে হইবে| এই সমস্ত বাধা বিঘ্নের মধ্যেও তাহাকে এখন হইতে সমস্ত পরিবারের জন্য রন্ধনাদি করিতে হইবে| এসকল সত্ত্বেও তাহাকে নিয়ত সঙ্গীত-শাস্ত্রের আলোচনা করিতে হইবে|

       জার্ম্মান বালিকারা রন্ধনবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শিনী| তাহারা উদ্ভিদ ও মৎস্য মাংসের নানাবিধ পাক ও বিবিধ মিষ্টান্ন প্রস্তুত করিতে পারে| গ্রীষ্মকাল অতীত হইলে তাহারা উদ্ভিদ হইতে নানাবিধ খাদ্য দ্রব্য প্রস্তুত করিয়া রাখে| কারণ শীতকালে জার্ম্মাণীতে প্রায় কোন-প্রকার উদ্ভিদ পাওয়া যায় না|

       জার্ম্মান্‌-গৃহিণী স্বামী ও পুত্রকন্যাদিগের জন্য আহার প্রস্তুত করিতে সবিশেষ ব্যগ্র| এতদ্ভিন্ন পরিচ্ছদাদির তত্ত্বাবধারণ করা ও বাহিরে কন্যাগণের সঙ্গে গমন করা তাঁহার আর দুই প্রধান কার্য্য| কারণ জার্ম্মাণীরা অবিবাহিতা কন্যাকে একাকী কোন স্থানে যাইতে দেন না| শরৎকালে যখন শীতকালের জন্য খাদ্যদ্রব্য সকল সংগ্রহ করিয়া রাখা হয, সে সময়ে কাজের এত ভীড় হয় যে কোন কুলকামিনী একাকী তাহা নির্ব্বাহ করিয়া উঠিতে পারেন না, সুতরাং তাঁহাকে প্রতিবেশিনীদিগের সাহায্য লইতে হয়| এইরূপে প্রত্যেক বাড়ীতে সকলে মিলিয়া কাজ করায়, তাদৃশ শঙ্কট সময়েও লোকাভাব হয় না|

       প্রতি বাড়ী বাড়ী যখন সকল প্রতিবেশিনীগণের সমাবেশ হয়, তখন কাফী দিয়া সকলের সম্মান বর্দ্ধন করা হয়| কাফী খাইতে খাইতে প্রতিবেশিনীগণের পরের কথা লইয়া অনেক অন্দোলন হয়| "অমুকের স্বামী এত অল্প বেতন পায়, তথাপি তাহার স্ত্রীর পরিচ্ছদের ছটা দেখ! শুনিতে পাই তাহার স্বামী নাকি ইংরেজের নিকট ঘুস খাইয়া তাহাদিগের নিকট আমাদের গৃহছিদ্র প্রকাশ করে| ইংলণ্ড হইতে মধ্যে মধ্যে প্রায়ই রেজিষ্টারি চিঠি তাহার নিকট আসে| তাহার মেয়েটী আবার অমুক সৈনিক পুরুষের দিকে কটাক্ষপাত করে| তাহার মাতাও শুনিতে পাই সে বিষয়ে সাহায্য করে| এ বড় লজ্জার কথা! কিন্তু তাকে কে বিবাহ করবে, কারণ সে রন্ধন কার্য্য কিছুই জানে না; কেবল পিয়ানো বাজাতে পারে, সহজ সহজ গান করতে পারে, এবং কদাকার প্রতিমূর্ত্তি আঁকতে পারে|" পুরন্ধ্রীগণ সমবেত হইলে এই সকল কথায় কথায় সময় কাটাইয়া থাকেন|

        ষোড়শবর্ষীয়া বালিকা বিদ্যালয় পরিত্যাগ করিয়া শাস্ত্রের অনুশীলনে এতদূর তন্ময় হইয়া যায়, যে তাহার বেশভূষা বা অঙ্গসংস্কারে কোন প্রকার আস্থা থাকে না| জার্ম্মান বালিকারা অপরিচিত সমাজের সহিত তত মেশামিশি করে না, এই জন্য অঙ্গের অসংস্কারে বা বেশভূষার অভাবে তাহাদিগের ক্ষতি হয় না| কিন্তু তাহাদিগের জননী তাহাদিগকে সঙ্গে করিয়া মধ্যে মধ্যে অপরিচিত সমাজেও লইয়া যান| সেই সময় জননীই তাহাদিগের অঙ্গসংস্কার ও বেশভূষা করিয়া দেন| কিন্তু ইংলণ্ডের ন্যায় অবিবাহিতা কন্যাকে তরাইবার এখানে নানাপ্রকার উপায় উদ্ভাবিত হয় না|
জার্ম্মাণীতে পাণিগ্রহণার্থী ব্যক্তির প্রথমেই কন্যাকে সম্বোধন করিবার অধিকার নাই| তাঁহাকে সর্ব্বপ্রথমে কন্যার পিতার নিকট অনুমতি লইতে হইবে| এই অনুমতি না পাইলে তাঁহার কন্যার গৃহে প্রবেশ করিবার অধিকার নাই| অভদ্রলোকে সময়ে সময়ে গুপ্তভাবে অভিভাবকের বিনা অনুমতিতে কন্যা-গৃহে প্রবেশ করিয়া কন্যার হৃদয় হরণ করিতে চেষ্টা করে বটে, কিন্তু তাহা সাধারণ নিয়ম নহে, সাধারণ নিয়মের ব্যভিচার মাত্র| কন্যাপ্রার্থী কন্যার পিতার নিকট অনুমতি পান বটে, কিন্তু তিনি নির্জ্জনে তাহার সহিত কথা বার্ত্তা কহিতে পান না| অভিভাবকের নয়নসমক্ষে তাঁহাকে কন্যার সহির কথোপকথন করিতে হইবে| কন্যা - পিতা, ভ্রাতা, ভগিনীগণের সহিত কিরূপ ব্যবহার করেন তাহাও তিনি বসিয়া দেখিতে পারেন| পারিবারিক ব্যবহারে কন্যার স্বভাব চরিত্র যতদূর জানা যাইতে পারে তাহা জানিবার তাঁহার অধিকার আছে| জার্ম্মান বরেরা কন্যার বাহ্য আকৃতিতে সম্পূর্ণ মুগ্ধ হন না| তাঁহার কন্যার স্বভাব চরিত্র সবিশেষ বিদিত না হইয়া কখনই বৈবাহিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ হন না| যদি জার্ম্মান বর তাঁহার প্রণয়-পাত্রীকে অভীষ্ট গুণে বিভূষিত দেখেন, তবেই তাঁহাকে বিবাহ করিতে প্রতিশ্রুত হন| তখন তাঁহার পরস্পর অঙ্গুরীয়ক বিনিময় করেন, এবং তাঁহার যে পরস্পর প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হইয়াছেন আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবদিগের বিদিতার্থ তাহা সম্বাদপত্রে প্রচার করেন| যদি বর এই বিজ্ঞাপনের পরও সুক্ষ অনুসন্ধানে কন্যাকে দুর্ব্বিণীত বা বৃথা-গর্ব্বিত বলিয়া জানিতে পারেন, তাহা হইলে তিনি ভদ্রতার নিয়ম ভঙ্গ বা রাজ বিধি উল্লঙ্ঘন না করিয়াও এই বিবাহ হইতে অপসৃত হইতে পারেন| কিন্তু বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর বিবাহভঙ্গ অল্পই ঘটিয়া থাকে|

           একবার বৈবাহিক জীবনে আবদ্ধ হইলে, জার্ম্মান দম্পতী আমরণ অবিচ্ছন্ন থাকেন| ইহার প্রধান কারণ-জার্ম্মাণীতে জীবিকা নির্ব্বাহের কঠোরতা| অনেককেই অতি সামান্য অবস্থা হইতে ধীরে ধীরে ক্রমে ক্রমে উন্নতির উচ্চতম সোপানে উঠিতে হয়| অনেকে প্রথম অবস্থায় বেতনস্বরূপ এক কপর্দ্দকও প্রাপ্ত হন না| আবার যখন যুবক কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ পাইতে আরম্ভ করেন, তখন যুবতীর পিতা মাতা হয়ত সে সময় আর কন্যাকে কিছুই সাহায্য করিয়া উঠিতে পারেন না| জার্ম্মাণীতে বিবাহের পর কন্যা যখন প্রথমে স্বামিগৃহে গমন করেন, তখন পিতামাতা তাঁহাকে যে শুদ্ধ তাহার প্রয়োজনীয় পরিচ্ছদ প্রদান করিয়াই নিষ্কৃতি পান এরূপ নহে, তাঁহাদিগকে কন্যার সংসার-করণোপযোগী যাবতীয় দ্রব্য সামগ্রী প্রদান করিতে হয়, এতদ্ভিন্ন যতদিন জামাতা কিছু আনিতে না পারেন ততদিন তাঁহাদিগকে জামাতা ও কন্যার ভরণপোষণের জন্য নিয়মিত রূপে কিছু কিছু অর্থসাহায্য করিতে হয়| এইরূপে কন্যার সহিত বরের আর একটী গুরুতর দায়িত্বের জন্যই জার্ম্মাণ জননীরা কন্যর বিবাহ দিবার নিমিত্ত নিতান্ত ব্যস্ত হন না| এই জন্যই তাঁহারা ইংরাজ জননীগণের ন্যায় কন্যাগণকে বিবাহযোগ্য বসনভূষণে সাজাইয়া প্রকাশ্য জনসমাজে অবতারিত করিতে চাহেন না| কারণ অবস্থা ভাল না হইলে বিবাহে পিতামাতাকে সর্ব্বস্বান্ত হইতে হইবে| যতদিন কন্যার বিবাহ না হয়, ততদিন পিতা যে অল্প বেতন পান, তাহাতেও তাঁহার খরচপত্র একপ্রকার চলিয়া যায়| কিন্তু কন্যার বিবাহ হইলে তাহাকে সসজ্জ করিয়া পতিগৃহে পাঠাইতে তাঁহার পূর্ব্বসঞ্চিত সমস্ত বিনষ্ট হইয়া যায়|

            জার্ম্মান যুবতীরাও বিবাহ করিতে নিতান্ত ব্যগ্র নহেন, কারণ বৈবাহিক জীবনে তাঁহাদিগের সুখের বিশেষ আশা নাই| পিতার জীবদ্দশায় তাঁহারা পিতৃগৃহে যতদূর সুখিনী, পতিগৃহে পুত্রকন্যাবতী হইয়া অল্প আয়ে জীবন কাটাইতে তাঁহারা ততদূর সুখানুভব করেন না| পিতার মৃত্যু হইলেও জার্ম্মান্‌ বালিকারা আমাদের দেশের বালিকাগণের ন্যায় নিতান্ত নিরবলম্ব ও হতাশ হইয়া পড়েন না| তাঁহারা যেরূপ শিক্ষা প্রাপ্ত হয়েন তাহাতে পিতা ও স্বামী বিরহেও কথঞ্চিৎ স্বাধীন ভাবে জীবন কাটাইতে পারেন|

           কন্যা -বিবাহরাত্রি উৎসবে কাটাইবার জন্য বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয় স্বজন সকলেই নিমন্ত্রিত করেন| কন্যালয়ে বিবাহরাত্রিতে নৃত্য, গীত, বাদ্য ও অন্যান্য নানাবিধ আমোদ প্রমোদ হইয়া থাকে| নিমন্ত্রিত ব্যক্তিমাত্রই সেই সময়ের উপযোগী বিবিধ যৌতুক লইয়া কন্যালয়ে আসেন ও কন্যাকে উপহার প্রদান করেন| পরদিন "কোড নেপোলিয়ন্‌" অনুসারে নির্দ্দিষ্ট রাজকর্ম্মচারী দ্বারা বর কন্যা বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েন, তাহার পর তাঁহারা আপন ইচ্ছানুসারে গির্জ্জায় গিয়া ধর্ম্মযাজকের সম্মুখে শপথ গ্রহণ পূর্ব্বক বিবাহের শেষ অঙ্গ পূর্ণ করেন| বিবাহের পর দম্পতী কিছু দিনের জন্য দেশভ্রমণে নির্গত হন, কিন্তু অর্থাভাবে সকলেরই অদৃষ্টে এ সুখ ঘটিয়া উঠে না| যাঁহারা দেশভ্রমণে নির্গত হইতে পারেন, তাঁহারা বিবাহের পরই একেবারে "ঘরকন্না" আরম্ভ করেন| আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি জার্ম্মাণীতে সকলেরই স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র বাটী নাই| সুতরাং নবদম্পতী বিবাহের পর কোন বাটীর দুই একটী কুঠারী ভাড়া লইয়া তাঁহাদিগের নূতন জীবন আরম্ভ করেন| ইহাতে তাঁহাদিগের কোন নিন্দা নাই, কারণ ইহা তথাকার প্রথা| এই জন্যই জার্ম্মান্‌ যুবকেরা অল্প আয়ে কথঞ্চিৎ জীবন যাপন করিতে পারেন| নবোঢ়া ইংরাজ যুবতীর ন্যায় জার্ম্মান যুবতীরা ততদূর ফুলবধূ নন, এই জন্যও তাঁহাদিগের স্বামীগণের বৈবাহিক জীবন তত ক্লেশকর বোধ হয় না| ইংরাজ রমণীরা বিবাহের পর বিলাস দ্রব্যের জন্য স্বামীকে নানামতে জ্বালাতন করিয়া থাকেন| এইজন্য ইংলণ্ডে অনেকেই বৈবাহিক জীবন অপেক্ষা অনূঢ়াবস্থাকে অধিক আদর করিয়া থাকেন| কিন্তু জার্ম্মান্‌যুবতীরা বৃথগার্ব্বজনিত সেই সকল বিলাসিতা হইতে সম্পূর্ণ নির্ম্মুক্ত| এই জন্যই জার্ম্মাণীতে অল্পবেতনের লোকে বিবাহ করিতে ততদূর ভীত হয়েন না| এই জন্যই জার্ম্মাণীতে ইংলণ্ডের ন্যায় অনূঢ় যুবকদলের সংখ্যা অধিক নহে|

       এই প্রস্তাবে জার্ম্মান্‌ জীবনের যে চিত্র প্রদান করা হইল, তাহা জার্ম্মান্‌ নগরসমূহের মধ্যশ্রেণীর লোকের| উচ্চ ও নিম্ন শ্রেণীতে স্থানে স্থানে এই চিত্রের বিপর্য্যয় দৃষ্ট হইতে পারে বটে, কিন্তু সাধারণতঃ ইহা জাতি সাধারণেরই প্রতিবিম্ব| জার্ম্মান্‌দিগের সামাজিক অবস্থার সহিত প্রাচীন ভারতীয় আর্য্যগণের সামাজিক অবস্থার অনেক সৌসাদৃশ্য আছে - এই প্রস্তাব পড়িলে সহজেই উপলব্ধি হইবে| জার্ম্মাণেরা যে দেব-সেনাপতি স্কন্দ কর্ত্তৃক তাড়িত দৈত্যগণ - এই সমাজসাম্য তাহার একটী আভ্যন্তরীণ প্রমাণ|

   ('আর্য্যদর্শন' পত্রিকা, চৈত্র ১২৮৫)

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।