প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

নির্ম্মলের ডায়েরী

গোকূলচন্দ্র নাগ

        [ লেখক পরিচিতি : এক ধরণের মানুষ আছেন যারা অফুরন্ত প্রাণশক্তি ও কিছু ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করার স্বপ্ন নিয়ে পৃথিবীতে আসেন| কিন্তু প্রতি পদে প্রতিকূল পরিবেশ ও প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে সংগ্রাম করতে করতে অকালে ঝরে যান, গোকুলচন্দ্র ছিলেন এমনই একজন ভাগ্যহত ব্যক্তি|

        ১৮৯৪ খ্রীষ্টাব্দের (১৩১০) ২৮শে জুন কলকাতায় গোকুলচন্দ্রের জন্ম| পিতা মতিলাল নাগ ও মাতা কমলা নাগ উভযেই গোকুলচন্দ্রের অল্প বয়সেই লোকান্তরিত হন, গোকুল তখন স্কুলের ছাত্র| নাগদের পৈতৃক নিবাস ছিল অক্রুর দত্ত লেনে| মতিলালের ছিল তিন পুত্র ও দুই কন্যা - বিভাবতী (মিত্র), কালিদাস, গোকুলচন্দ্র, প্রভাবতী (মিত্র) ও রামচন্দ্র| পরবর্তী কালে অগ্রজ ডঃ কালিদাস নাগ রাজ্যসভায় রাস্ট্রপতি মনোনীত সদস্য ছিলেন এবং ঐতিহাসিক হিসাবেও নাম করেছিলেন| পিতৃমাতৃহীন গোকুলচন্দ্র মামা বিজয় বসুর কাছে মানুষ হতে থাকেন|

         গোকুলচন্দ্রের পড়াশোনা বেশীদূর এগোয় নি| ছোটবেলা থেকেই তার স্বাস্থ্য ভাল ছিল না| সাউথ সুবার্বন স্কুলে পড়েছেন, কিন্তু পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হওয়ায় প্রধান শিক্ষকের বকুনি খেয়ে পড়া ছেড়ে দেন| ঘাটশিলায় কিছুদিন পড়ার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু উল্লেখযোগ্য কিছু হয় নি| ছবি আঁকার দিকে গোকুলচন্দ্রের ঝোঁক ছিল ছোটবেলা থেকেই, তারই রেশ ধরে তিনি সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হন| তখন ছবি আঁকার পেশাকে খুব ভাল চোখে দেখা হত না, মামা বিজয় বসুও খুব সন্তুষ্ট ছিলেন না| আর্ট স্কুলেই গোকুলচন্দ্রের সঙ্গে শিল্পী অতুল বসু, যামিনী রায় ও ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়| পার্সি ব্রাউন ও যামিনীপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে তিনি ছবি আঁকা শিখেছিলেন| আর্ট স্কুলের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ছবি এঁকে কিছু কিছু রোজগার করতে থাকেন, তবে তা সামান্যই|

         ১৯১৮ খ্রীষ্টাব্দে প্রত্নতত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধীনে ভারতীয প্রত্নতত্ব বিভাগের ওয়েস্টার্ন সার্কেলে কাজে যোগ দেন গোকুলচন্দ্র, কিন্তু ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্য কাজ ছেড়ে দিতে হয়| গোকুলচন্দ্রের মামা বিজয় বসুর ভাই সুরেন বসুর নিউ মার্কেটে একটি ফুলের দোকান ছিল; সেখানে সকালে বসতেন সুরেন বাবু আর বিকালে ভার নিতেন গোকুলচন্দ্র| কেনা বেচার সময় যখন ফুল টানাটানি হত গোকুলচন্দ্র তখন বুকে ব্যাথা অনুভব করতেন| অচিন্ত্যকুমার লিখেছেন -"যে দোকান নিয়ে বসেছে সে ব্যবসা করতে বসে নি এমন কথা কে বিশ্বাস করতে পারত? কিন্তু সেদিন একান্তে তার কাছে এসে অনুভব করলাম, চার পাশের এই রাশিকৃত ফুলের মাঝখানে তার হৃদয়ও একটি ফুল| আর সে ফুলটি সে অকাতরে বিনামূল্যে যে কারুর হাতে দিয়ে দিতে প্রস্তুত|" এ থেকেই গোকুলচন্দ্রের মনের কিছুটা পরিচয় মেলে| ফুলের দোকানে কাজের মাঝেই চলতে থাকে ছবি আঁকার কাজ| তেল রঙের পোর্ট্রেট ছিল তার সবচেয়ে বেশি প্রিয়| সুদূর বম্বে ও পুণা থেকে অর্ডার পেতেন গোকুলচন্দ্র|

         সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ থাকলেও গোকুলচন্দ্র তখনও তাতে মন দিতে পারেন নি| ফুলের দোকানে ফুল কিনতে আসা দীনেশরঞ্জনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে| গোকুলচন্দ্র, দীনেশরঞ্জন দাশ, মণীন্দ্রলাল বসু ও সুনীতি দেবীকে নিয়ে তৈরী হয় 'ফোর আর্টস ক্লাব'| গোকুলচন্দ্রের মামাবাড়ি ছিল আলিপুর চিড়িয়াখানায়; তারাই প্রাঙ্গণে বসেছিল ক্লাবের প্রথম সমাবেশ| প্রত্যেকের একটি করে মোট চারটি গল্প নিয়ে বই প্রকাশিত হয়েছিল 'ঝড়ের দোলা'| এর মধ্যে গোকুলচন্দ্রের লিখিত গল্পের নাম ছিল 'মাধুরী'| চিত্র, সাহিত্য, সঙ্গীত ও অভিনয়-এই চারটি ক্ষেত্রেই গোকুলচন্দ্রের প্রবেশ ঘটেছে| তিনি বেহালা খুব খারাপ বাজাতেন না| দীনেশরঞ্জন দাশ বন্ধু গোকুলচন্দ্র সম্বন্ধে লিখেছেন -"কণ্ঠস্বর খুব সুন্দর না হইলেও তাহার গানে এমন একট গম্ভীর সুর ধ্বণিয়া উঠিত যে, তাহাতে শ্রোতার মনকে একান্ত আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিত| গোকুল যখন বেহালা বাজাইত তখন ও অত্যন্ত মনযোগের সহিত বাজাইত| বাজাইতে বাজাইতে গায়কের মুখের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকাইয়া থাকিত|"

       গোকুলচন্দ্র কিছুদিন অভিনয়ের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন| Photo Play Syndicate of India নামে একটি সিনেমা কোম্পানী গড়ে উঠেছিল; উদ্যোগক্তারা ছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী, প্রফুল্ল ঘোষ, কানাইলাল দাশ প্রমুখ ব্যক্তিরা| এই প্রতিষ্ঠানের একমাত্র নির্বাক চিত্র 'সোল অফ এ স্লেভ' বা 'বাঁদীর প্রাণ' খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের তক্ষশীলার প্রণয় কাহিনীকে উপজীব্য করে তৈরী হয়েছিল| নায়ক 'ধর্মপালে'র ভূমিকায় ছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী আর সহচর 'বাহুসেন' হয়েছিলেন গোকুলচন্দ্র| চলচ্চিত্রে তিনি সম্ভবতঃ আর অভিনয় করেন নি, তবে মাঝে মাঝে নাট্যাভিনয়ে অংশ গ্রহণ করেছেন|
চিত্র, সঙ্গীত বা অভিনয়ের জন্য নয় গোকুলচন্দ্র স্মরণীয় থাকবেন তার প্রকাশিত 'কল্লোল' পত্রিকার জন্য| চিরাচরিত গণ্ডী ও অনুশাসন উপেক্ষা করে বাংলা সাহিত্যে 'আধুনিকতা'র প্রবেশ ঘটে 'কল্লোলে'র হাত ধরেই| এ জন্য পত্রিকাটিকে কম সমালোচনা সহ্য করতে হয় নি| ১৩৩০ বঙ্গাব্দের বৈশাখে প্রকাশিত হয় পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা| তার নাম সহ-সম্পাদক হিসাবে থাকলেও সজনীকান্তের মতে গোকুলচন্দ্রই ছিলেন 'আসল কর্ণধার'| লেখা যোগাড় করা, প্রুফ দেখা, প্রচ্ছদ পরিকল্পনা, চিঠিপত্র লেখা ইত্যাদি কাজে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হত গোকুলচন্দ্রকে| তার স্বাস্থ্য কোনদিনই ভাল ছিল না| ১৯২৫-এর শুরু থেকেই অবিরাম জ্বরে ভুগতে থাকেন| যক্ষারোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি| রোগমুক্তির আশায় তাকে দার্জিলিং-এ নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ১৯২৫ খ্রীষ্টাব্দের ২৪শে সেপ্টেম্বর তিনি পরলোকে যাত্রা করেন|

       গোকুলচন্দ্র বেঁচেছিলেন মাত্র ৩১ বছর| তার মধ্যে কঠিন জীবন সংগ্রামে, জীবিকা অর্জনের চেষ্টায় তিনি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন| সাহিত্যানুরাগী হলেও খুব বেশী লেখা তিনি লিখে যেতে পারেন নি| 'প্রবাসী' পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছে; যেমন - 'শিশির' (আষাঢ়, ১৩২৬) ; 'বাতায়ন' (মাঘ, ১৩২৬) ; 'দুই সন্ধ্যা' (চৈত্র, ১৩২৬)| 'ভারতবর্ষ', 'ভারতী', 'নব্যভারত' পত্রিকাতেও তিনি লিখেছেন| তার রচিত গ্রন্থ -
(১) 'ঝড়ের দোলা' (১৯২২)| 'ফোর আর্টস ক্লাবে'র চারজনের চারটি গল্প নিযে বইটি রচিত হয়| গোকুলচন্দ্র লিখেছিলেন 'মাধুরী' গল্পটি|
(২) 'রাজকন্যা' (১৯২২)| টেনিসনের লেখা 'দি প্রিন্সেস' অবলম্বনে ছোটদের জন্য রচিত বই|
(৩) 'রূপরেখা' (১৯২২)| 'মালিনী', 'শিশির', 'বাতায়ন', 'জলছবি', 'মা', 'আলো', 'ছায়া', 'দুই সন্ধ্যা', 'পুজারিণী', 'অনন্ত' ও 'আশা' - এই দশটি রচনা গ্রন্থবদ্ধ হয়ে 'রূপরেখা' প্রকাশিত হয়| এই লেখাগুলি 'প্রবাসী', 'ভারতবর্ষ', 'নব্যভারত' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল|
(৪) 'সোনার ফুল' (১৯২২)| এটি 'বঙ্গবাণী' পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, শেষের কযেক অধ্যায় বাদ দিযে| কারণ হিসাবে লেখক নিজেই বলেছেন -"কারণ তাতে যা লেখা আছে তা মাসিক পত্রে ছাপবার উপযুক্ত নয়, এবং অনেকে বলেছেন যে ও ভাবে লেখা অন্যায়, ওতে "নীতির কোন আভাস নেই", এবং "কুরুচির" প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে| ওতে সমাজের বিশেষ ক্ষতি হতে পারে|" ... ইত্যাদি| এ থেকেই কিছুটা আঁচ করা যায় 'কল্লোল' তখন কেন এত কলরোল তুলেছিল|
(৫) 'পরীস্থান' (১৯২৪)| মেটারলিঙ্কের 'ব্লু বার্ড' নামক নাটকের কিছু নির্বাচিত অংশ নিয়ে ছোটদের জন্য রচিত হয়েছে এই গন্থটি|
(৬) 'পথিক' (১৯২৫)| এই উপন্যাসটি 'কল্লোল' পত্রিকায় ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা (১৩০০ বঙ্গাব্দ, বৈশাখ) ২য় বর্ষ ৭ম সংখ্যা পর্যন্ত (১৩৩১-এর জ্যৈষ্ঠ ও আশ্বিন বাদে) ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল| গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৫ খ্রীষ্টাব্দে|
(৭) 'মায়ামুকুল' (১৯২৭)| তিন খণ্ডে মোট ১৯টি গল্প নিয়ে এই গ্রন্থটি রচিত| লেখকের মৃত্যুর সময় এটি প্রকাশের কাজ চলছিল| সম্পূর্ণ গ্রন্থটি গোকুলচন্দ্র দেখে যেতে পারেন নি|

       অকালে বিদায় নেওয়া গোকুলচন্দ্রের সম্বন্ধে তার অভিন্নহৃদয় বন্ধু 'কল্লোল'-সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ লিখেছেন -"তাঁর চেহারায় অগ্রজ কালিদাসের মত জৌলুস ছিল না| তাঁর ছিল বেহালা-বাজিয়ের মত লম্বা চুল, চোখে সেকেলে চশমা, শরীর বেশ দুর্বল, স্বাস্থ্য বরাবর খারাপ| সব সময় মুখে থাকত সিগারেট, কথা বলতেন কম| দূর থেকে দেখলে কেমন যেন দাম্ভিক মনে হত| কিম্বা নিরাসক্ত উদাসীন| সেই উদাসীনতা কতকটা নিস্তেজ শরীর ও স্বপ্নাভিলাষের দান| কিন্তু কাছে গেলে পাওয়া যেত একটা উত্তপ্ত সান্নিধ্য, কণ্ঠস্বরে অন্তরঙ্গতা|"

         যে স্বপ্ন গোকুলচন্দ্র দেখেছিলেন, তা হয় ত পূরণ হয় নি; তবে যতদিন 'কল্লোল' পত্রিকা সাহিত্যের জগতে সজীব থাকবে ততদিন গোকুলচন্দ্রের মৃত্যু নেই|]

 দীপক সেনগুপ্ত|

        বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষাটির পাশের সংবাদ পেয়ে সেদিন সন্ধ্যাবেলা বাসার ছাদে একখানা কার্পেটের ওপর শুয়ে পড়লাম, আমার সমস্ত দেহমন ক্লান্তি এবং মুক্তির দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে স্তব্ধ হয়ে রইল| সে কি অবসাদ! আমার মনে হচ্ছিল নিঃশ্বাসটাও যদি আর না ফেলতে হয়, তাহলে একবার প্রাণ ভরে জিরিয়ে নিই| আমার জীবনের ছয় বছর বয়স হ'তে আরম্ভ করে আজ বাইশ বছর পর্য্যন্ত কেবলই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হ'য়েই কাটিয়েছি|

        ষোল বছর পূর্বে, দুই হাত দিয়ে মার গলা জড়িয়ে, তাঁর বুকে মুখ লুকিয়ে থাকা সত্ত্বেও যেদিন সকলে আমার বিদ্যামন্দির দ্বারে উৎসর্গের জন্য নিয়ে এল, সেদিন আমারই মত উৎসর্গকরা নৈবেদ্যগুলি আমার উৎকণ্ঠিত মুখের দিকে চেয়ে হেসে লুটিয়ে পড়ছে দেখে দ্বিগুন ভয়ে আমার বুক কেঁপে উঠেছিল| তারপর বুঝতেই পারি নি কখন আমিও ওদের মত হয়ে গিয়েছি| নূতন কেহ এলে ওদেরই মত তার দিকে চেয়ে হেসেছি| মাষ্টার মশাইকে জব্দ করবার নিত্যনূতন উপায় ওদেরই সঙ্গে বার করেছি|

        একটি বিষয় আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারতাম না| আমার সমস্ত মন যখন ঘোষেদের আমবাগানে ছুরি নুন নিয়ে যাবার জন্য ব্যস্ত, তখন ঘাড় হেঁট করে নু-ঔ-জস করতে হবে, সেটা বড়ই খারাপ লাগত| তখন যা কিছু করবার ইচ্ছা হত সে সকলের ওপরেই দেখতাম জ্বলন্ত অক্ষর দিয়ে লেখা আছে - নিষেধ| তারপর সেই সমস্ত নিষেধের কাছে মাথা নীচু করে এতকাল চলে এসেছি কলের মত| খুব সুনাম পেয়েছি - আমি একটি ভাল কল তৈরি হয়েছি বলে| যেদিন মুক্তি পেলাম, সেদিন একটা কিছু করতে ইচ্ছা করতে না দেখে কিছুই আশ্চর্য্য হ'লাম না| কেন না আমার ইচ্ছার ওপর যে ষোল বছরের পাথর চাপা রয়েছে| সে যে পঙ্গু! আজ তাকে ছুটি দিলে কি হবে?

        ষোল বছর পূর্বেকার সেই সমস্ত ছোট খাট ঘটনাগুলি একটি একটি করে আমার চোখের সামনে ফুটে উঠে, আমি জেগে আছি কি স্ব্প্ন দেখছি তা ভুলিয়ে দিয়েছিল| মৃদু বাতাস মালতীর গন্ধ নিয়ে, আমার ক্লান্ত দেহে মধুর পরশখানি বুলিয়ে দিচ্ছিল| হঠাৎ কেন জানি না আমার কান দুটি যেন কিছু শোনবার জন্য সজাগ হয়ে উঠল|
আমাদের বাসার পাশের বাড়ির কে গান গাইছে! ছুটে এসে পাঁচিলের কাছে দাঁড়ালাম| ও কি গান?

               'আমি যে আর
           সইতে পারিনে|"
     কি করুণ সুর!
           "হৃদয় লতা নুয়ে পড়ে
           ব্যাথাভরা ফুলের ভারে গো
           আমি যে আর বইতে পারিনে|"

      একি হয়ে গেল আমার! আমার সমস্ত প্রাণ যেন কেঁদে বলছে - আমিও যে আর সইতে পারিনে!
কি সইতে পারে না সে? আমার হৃদয়লতার ব্যাথার কুসুম, সে ত বহুপূর্বে তপ্তধূলায় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে| আজ তার জন্য এমন করে মন আকুল হ'য়ে উঠল কেন?

       ষোলবছরের রুদ্ধব্যাথার ভার এমন করে এক মুহূর্ত্তে একটি গান দিয়ে কে নামিয়ে নিল গো! ওগো অপরিচিতা, এ তুমি আমায় কি শুনালে!

       কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না| চোখ মেলে দেখি সূর্য্যোদয় হচ্ছে! নিজের অবস্থা দেখে অবাক হয়ে গেলাম| ছাদের পাঁচিলের কাছে সারারাত ঘুমিয়ে কাটিয়েছি| তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম| তখনও বাসার আর কেউ জাগেনি| আমি ঘরে এসে বসলাম| আর বুকের ভিতর তেমন ভার বোধ হচ্ছে না, বড় আরাম পেলাম| সারাদিন সকলের সঙ্গে গল্প করে কাটালাম| আমার মুখে হাসি দেখে বন্ধুরা একটু অবাক হয়ে পড়েছিল| সন্ধ্যাবেলা ছাদে এসে বসলাম| আবার সেই গান| আমার ইচ্ছা করছিল ছুটে গিয়ে তার পায়ের কাছে বসে পড়ি|

       মাকে চিঠি পাঠালাম - এবার ছুটিতে বাড়ি যাব না, বাসাতেই থাকবো মনে করছি, আর এখান থেকেই কোনরকম কাজের চেষ্টা দেখব - ইত্যাদি| চিঠি ডাকে দিয়ে সারাদিন পথে পথে ঘুরে কাটিয়ে দিলাম| আমার তখনকার মনের অবস্থার ঠিক বর্ণনা করতে পারব না| আমার মন পূর্বে কখনও এমন অশান্ত হয়নি, এত বেশী ব্যাকুলতা কখনও আমার বুকে জাগেনি|

       সন্ধ্যাবেলা যেন কিসের আকর্ষণে আবার ছাদে এসে বসলাম| রাত ক্রমেই গভীর হয়ে এল, কিন্তু আজ আর গান হল না| ক্ষুন্ন মনে বিছানায় শুয়ে পড়লাম, কিন্তু অনেকক্ষণ ঘুমাতে পারলাম না| কেবলই মনে হতে লাগল হয়ত এইবার গাইবে| সকালে জেগে উঠে নিজের ওপর বড় রাগ হতে লাগল| কেন ঘুমালাম, হয়ত সে গেয়েছিল|

       সেদিন সন্ধ্যায়ও গান হ'ল না| বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠল| বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম| তাদের বাড়ির সামনে এসে দেখি তালাবন্ধ ! বাসায় ফিরলাম| সে রাত্রি শুতে পারলাম না| এমন করে আমায় গলায় ব্যাথার মালাটি পরিয়ে দিয়ে সে কোথায় লুকাল!

       তারপর একমাস কেটে গেছে, আর একদিনও গান হয়নি| তবু প্রত্যেক দিন সন্ধ্যায় ছাদে বসবার প্রলোভন দমন করতে পারতাম না|

       সেদিন খুব বৃষ্টি নেবেছে| বাদলার হাওয়া চারিদিকে কাঁপিয়ে হা হা করে ছুটে চলেছে| জানালার ধারে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে, বাইরের দিকে চেয়ে বসে আছি, কৃষ্ণচূড়ার ফুলে ভরা ডালগুলি অবিশ্রান্ত বৃষ্টির আঘাতে আনন্দে মাতাল হয়ে দুলে দুলে উঠছে| আমার চোখ দুটি কেন যে জলে ভরে উঠছিল তা জানি না! কি আমার ব্যথা! কি চাই আমি?
চাকর আমার হাতে একখানা টেলিগ্রাম দিয়ে গেল| খুলে দেখি বাবা টেলিগ্রাম করেছেন|

        এতদিন আমার ইচ্ছা বলে কিছুই ছিল না| যা কিছু আদেশ হয়েছে তা সমস্তই মেনে চলেছি| আজ কেন জানি না বিদ্রোহের আগুন দারুণ তেজে আমার মনের মধ্যে জ্বলে উঠল|

          বাড়িতে ঢুকে আমি অবাক হয়ে গেলাম| সবাই ব্যস্ত| কাজের লোকের হাঁক ডাকে, ছেলেমেয়েদের আনন্দের কোলাহলে, একটা কোন বড় রকম ব্যাপারের আভাস দিচ্ছে| বিস্তর লোক-সমাগম হয়েছে| চেনা অচেনা সকলেই আমার মুখের দিকে চেয়ে, একটু বিশেষ করে যেন কোন বিষয়ের আলোচনা করতে লাগল| অন্দরে পা দিতেই নবাগতা মেয়েদের মধ্যে বেশ একটু চাঞ্চল্য, একটু কৌতুক-মেশান কানাকানি আমার বুকটাকে কাঁপিয়ে দিল|

         মার কাছে এসে দাঁড়াতেই তিনি আমার অকল্যাণ অজস্র আশীর্ব্বাদ দিয়ে মুছে দিলেন| আমি একটু অভিমানের সঙ্গেই বলে ফেললাম, মা, এ সমস্ত কি? তিনি হেসে কেঁদে আমার মাথাটা বুকে চেপে বললেন - কি সমস্ত? আমি বললাম - এই যে এত আয়োজন? মা আমার কথা শেষ না হ'তে দিয়ে বলে উঠলেন - তোর বিয়ে, আয়োজন হবে না? বিয়ে কি অমনি হয় পাগলা? আমি বললাম-না, মা এ আমার ভাল লাগছে না| আমি কিছুতেই 'পারব না '| শোন একবার ছেলের কথা! আমি বললাম, - এর পূর্বে তোমরা ত আমার মত জিজ্ঞেস করনি| মা এবার ভয় পেয়ে বললেন, - তোর কথাটা কি শুনি? আমি বললাম, - এ বিয়েতে আমার মত নেই|

          মা যেন কিছুতেই আমার কথা বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলেন না| তাঁর নির্ম্মলের কোন স্বতন্ত্র মত যে থাকতে পারে, তা হয়ত তাঁর ধারণার বাইরে ছিল|

         আমার কথা মেয়ে মহলে যখন প্রচার হয়ে গেল, সকলেই একমত হয়ে বললেন, এমন সৃষ্টিছাড়া কথা তাঁরা কখনও শোনেন নি|

         সন্ধ্যার পর হরি এসে খবর দিল, বাবা আমায় ডেকেছেন| বাবা ডেকেছেন শুনেই আমার বুকের একদিক হতে আর একদিক পর্য্যন্ত শুকিয়ে গেল| আমি সেদিন যে রকম করে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালাম সেই অবস্থায় যদি কেউ আমায় দেখত, তাহলে নিশ্চয়ই আমার সেই ছয় বছর বয়সের সঙ্গে এই বাইশ বছর বয়সের কোন পার্থক্য দেখতে পেত না|

          বাবা জিজ্ঞেস করলেন, - কি হয়েছে রে নিল? তুই তোর মাকে কি বলেছিস?

          কথাটি অত্যন্ত শ্বেতবর্ণের হলেও ওরই ভিতর রক্তবর্ণটি বেশ সজাগ আছে বুঝতে আমার বাকি রইল না|
আমি মনকে বেশ শক্ত করেই এসেছিলাম| তাই একটুখানি এদিক ওদিক চেয়ে গলাটি পরিষ্কার করে বললাম, এবিয়েতে আমার.......|

          আমার মুখ দিয়ে কোন মতেই আর শেষ কথাটি বেরুল না| বাবা বললেন, -এ বিয়েতে তোর কি? তিনি এমনভাবে এবার কথাগুলি বললেন যে আর দ্বিতীয়বার চেষ্টা করবার কল্পনাও করতে পারলাম না| মাথা নীচু করে চলে এলাম|

          আজ আমার বিয়ে| সকাল থেকে এই দেহটির ওপর কত রকমে অত্যাচার অরম্ভ করে দিলে| ওগুলিকে অত্যাচার বলতে আমি পারি; কেন না আমার মন যে কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না| বাড়ির ভিতর থেকে ছাড়া পেয়ে বাইরে এসে দেখি, আমার জন্য সকলে অপেক্ষা করে আছেন| দু একজন বন্ধু আমার সঙ্গে কিছু রসিকতা করবার জন্য কাছে এসে দাঁড়াল, কিন্তু আমার মুখের দিকে চেয়ে কেউ সাহস করে কিছু বলতে পারল না| আমিও বাঁচলাম|

           তারপর সে কি শাস্তি শুরু হ'ল| ওরা যখন একখানা চাদর আমাদের মাথার ওপর ঢেকে দিয়ে পরস্পরের দিকে চাইতে বাধ্য করাল, কি ভীত চাহনি তার! সে ছবি আজও আমার বুকে আঁকা হয়ে রয়েছে| এই অজানা বাড়িতে এসে একঘর মেয়ের মধ্যে কি করে যে সে রাত কাটালাম তাই ভেবে আজও আশ্চর্য্য হয়ে যাই| মাঝে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম| জেগে উঠে দেখি লাল চেলীর ভিতর দিয়ে দুটি কাল চোখ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে| কিছু দূরে কতকগুলি ছোট ছেলে মেয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে| তখন আকাশ অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেছে| আমি ছাদে এসে দাঁড়ালাম|
ফুলশয্যার রাত্রে যখন ঘরে এলাম, দেখি আমার বিছানায় একরাশ ফুলের মতই সে তার দেহখানি মেলে দিয়েছে| মুখের ওপর কি আশ্চর্য্য নির্ভরতা| নূতন জায়গায় এসে, এমন নিশ্চিন্তভাবে কেউ ঘুমাতে পারে তা জানতাম না|

           তার মাথার কাছে এসে দাঁড়ালাম| নিজের প্রতি ঘৃণায় মন ভরে গেল| সমস্ত জেনে কেন এমন সর্ব্বনাশ করলাম? কাপুরুষের মন অন্যায়ের কাছে মাথা নীচু না করে, আমার ইচ্ছামত কাজ করা ত আমার ক্ষমতার মধ্যেই ছিল| ও আমার কি করেছিল? আমার বুকের আগুনে আমি পুড়ে ছাই হতাম, ওকে সেই সঙ্গে পুড়িয়ে আমার কি লাভ হল?

           হঠাৎ চেয়ে দেখি ফুলগুলি দেহ ধরে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে| দুই হাত দিয়ে তাকে ঠেলে দিয়ে বললাম - সরে যাও| এই আমার প্রথম স্ত্রী সম্ভাষণ! তারপর ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম|

          সকালে বাবাকে বললাম, আমি কিছুদিন বাইরে বেড়িয়ে আসতে চাই| আশ্চর্য্য সেদিন তিনি কোন কারণ জানতে চাইলেন না| আমার হাতে একটা নোটের তাড়া দিয়ে বললেন, এতে সাতশ' কুড়ি আছে| যদি না কুলায় পরে জানিও| পাঠিয়ে দেবো|

         বাবার আজকের ব্যবহারটি আমার কাছে সম্পূর্ণ নূতন| আমি তাঁকে প্রণাম করে চলে আসছিলাম, তিনি ডেকে বললেন,- তুমি এখন বড় হয়েছ, অনেক লেখাপড়া শিখেছ, তোমাকে কোন উপদেশ দেব না, শুধু এই কথাটি মনে রেখো, - সমস্ত বোঝাবার পূর্বে যা তা একটা বিচার করে নিজেকে মাটি করো না|

         আজ প্রায় আটমাস বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি| ভারতের অনেক তীর্থে ঘুরে বেড়ালাম| তবু আমার মনের আগুন নিবল না যে! মাঝে একবার কলকাতায় ফিরেছিলাম, শুধু সেই গান শোনবার জন্য| দূর হতে জীবনে অন্ততঃ আর একবার ঐ গান শুনতে চাই, আমার সে আশা কি মিটবে না?

         তখন চিত্রকূটে আছি| বাবার চিঠি পেলাম| তিনি লিখেছেন, তাঁর শরীর অত্যন্ত খারাপ হয়েছে, দিনকতক তীর্থে বেড়াতে চান| কোন বিশেষ দরকারে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা করতে হবে|

        বাড়ি ফিরে মাকে কোনপ্রকার শান্ত করে বাবার কাছে এলাম| তাঁর দেহে কতই না পরিবর্ত্তন হয়ে গেছে| চোখ দুটির সে তীব্রতা কমে গিয়ে কি অপূর্ব্ব শান্তভাব ফুটে উঠেছে| সেই গর্বিত ঠোঁট দুটির ওপর কি মধুর হাসির রেখা ফুটে উঠেছে| আমি অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম|

        তিনি আমায় কাছে বসিয়ে শীর্ণ হাত দুটিতে আমার মাথা ধরে বললেন, তোর চেহারা এমন হয়ে গেছে কেন রে নিল? এত ঘুরে বেড়ালি তবুত কিছু সারতে পারিস নি!

        একটু থেমে আবার বললেন, - কারবারের যা কিছু, তোকে এবার সব বুঝে নিতে হবে| সমস্তই ঠিক করা আছে, এইগুলি পড়লেই বুঝতে পারবি| বেশী শক্ত যদি কিছু লাগে তাহলে আমার কাছে আসিস বুঝিয়ে দেব|
আমি ভাবলাম, এতদিন শূণ্য মনে ঘুরে বেড়িয়ে আমার শূণ্যতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছি, দেখি যদি এবার কাজের মধ্যে ডুবে মনটাকে হাল্কা করতে পারি|

         সেই সমস্ত লেখা পড়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম| অর্দ্ধেকের বেশি সম্পত্তি তিনি সাধারণের উপকারের জন্য ব্যয় করেছেন! বেশ মনে আছে এক সময় আমাদের গ্রামের লোকেরা কোন পূজা উপলক্ষে নাচ গানের খরচের জন্য তাঁর কাছে কিছু সাহায্য চাইতে আসে| তিনি তাদের ফিরিয়ে দিয়েছিলেন| সেই অবধি তাঁর ওপর কত নিন্দা বর্ষিত হয়ে এসেছে| সেই আবধি আমার মনের ভিতরেও তাঁর প্রতি কেমন একটা বিদ্বেষভাব ছিল| তিনি যে ভিতরে ভিতরে এমন সমস্ত কাজ করেছেন, তার কিছুই জানতাম না|

         সন্ধ্যাবেলা যখন তাঁর পা দুটি মাথায় চেপে ছেলেমানুষের মত কেঁদে ফেললাম, তখন তাঁর চোখ দুটিও শুকনো ছিল না| আমায় বললেন, - নিল, তোমার ওপরই সব ভার রইল| নিজে যা ভাল বুঝবে তাই করো| লোকে কি বলবে তাই ভেবে নিজের ইচ্ছাকে কখনও কলুষিত হতে দিও না| তোমাকে সর্ব্বন্তঃকরণে আশীর্ব্বাদ করি, তোমার মনের সমস্ত গ্লানি মুছে যাক|

         মা আর বাবা চলে যাবার একমাস কেটে গিয়েছে| আমি তাঁর ব্যবসা সংক্রান্ত হিসাব ইত্যাদি দেখে দিনের বেলা যতটা পারি মনকে ভরিয়ে রাখি, কিন্তু সন্ধ্যা হলে আর কিছুতেই স্থির থাকতে পারি না, কি এক অসহ্য বেদনায় মন ভরে যায়|

        একমাস বাড়ি এসেছি, এর মধ্যে একবারও আমার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয় নি, দেখা করবার ইচ্ছাও করে নি| কাল খাবার সময় একবার পিছনের দিকে চোখ পড়ায় দেখতে পেলাম অতি সন্তর্পণে কে একজন দরজার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে| এই কি আমার স্ত্রী? কি আশ্চর্য্য পরিবর্তন! ফুলশয্যার রাত্রে ওকে একরাশ কুন্দ আর চামেলীর মতই দেখেছিলাম, তাকেই আজ দেখলাম যেন বৈশাখের রৌদ্রতাপে শুকান লতা! কি ব্যথাভরা করুনা তার চাহনি! অনুশোচনায় মন ভরে গেল| কিন্তু কোন উপায় যে খুঁজে পাচ্ছি না| আমার এই বিকিয়ে দেওয়া মন নিয়ে ওর কাছে দাঁড়াব কি করে?

        সমস্তদিন পাগলের মত ঘরের ভিতর ছুটাছুটি করেও মনকে শান্ত করতে পারলাম না| আর সহ্য করতে পারছি না| চাকরকে ডেকে তার হাতে একখানা নোট দিয়ে বললাম-নিয়ে আয়-|
       তখন গভীর রাত্রি| সামনের টেবিলের ওপর একটি বোতল রেখে বসে আছি, গ্লাসে খানিকটা ঢালা আছে, শ্যাম্পেনের ঈষৎ রং এর ওপর বাতির আলো পরে সমস্ত রাঙ্গিয়ে দিচ্ছে| এখনি যত বেদনা যত দুশ্চিন্ত মুছে গিয়ে রঙ্গিন স্ব্প্নে মন ভরপুর হয়ে যাবে|

        হাত বাড়িয়ে গ্লাস ধরলাম| একি হল? কিছুতেই যে ওটি মুখের কাছে আনতে পারছি না| এমন করে আমার সমস্ত দেহ কেঁপে উঠল কেন? ও কিসের শব্দ? এযে কান্না! একি আমার বুকের ভিতর হতে বেরিয়ে আসছে? মাথাটি নীচু বুকের কাছে নিয়ে এলাম, - কই না! জানালাটিকে ভাল করে খুলে দিলাম|

       একি শুনলাম! এ যে সেই সুর! একদিন যা আমার বুক ভরে দিয়েছিল! ছুটে উপরে উঠে এলাম| আমারই ঘরের ভিতর হ'তে যে ঐ সুর উঠছে!

       দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলাম| ভগবান আর কিছুক্ষণ আমায় শুনতে দাও| ঐ গান শোনবার জন্য আজ এক বছর পাগলের মত ঘুরে বেড়িয়েছি| আজ আমারই ঘরের মধ্যে তাকে পেলাম| আমার কান দুটিকে যে বিশ্বাস করতে পারছি না| আমি কি পাগল হলাম? দরজার চৌকাঠের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম|

      আমার বুকের ওপর মুখ রেখে আকুল কান্নায় কে আমার সব ভাসিয়ে দিল! তার মাথাটি তুলে ধরে বললাম, কে তুমি? সেই কান্নার সুরেই সে বলে উঠল - আমি মাধুরী| কেন তুমি নিজেকে এমন করে কষ্ট দিচ্ছ?

      আমার সারা দেহ মন গেয়ে উঠেছে-
         "আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
         দেখতে আমি পাই নি!
         আমি বাহির পানে চোখ মেলেছি
         হৃদয় পানে চাই নি|"

 

( ‘বঙ্গবাণী’ মাসিক পত্রিকা, বৈশাখ ১৩৩৩)

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।