[
লেখক পরিচিতি : এক ধরণের মানুষ আছেন যারা অফুরন্ত প্রাণশক্তি
ও কিছু ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করার স্বপ্ন নিয়ে পৃথিবীতে আসেন।
কিন্তু প্রতি পদে প্রতিকূল পরিবেশ ও প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে সংগ্রাম
করতে করতে অকালে ঝরে যান, গোকুলচন্দ্র ছিলেন এমনই একজন ভাগ্যহত
ব্যক্তি।
১৮৯৪ খ্রীষ্টাব্দের (১৩১০) ২৮শে জুন কলকাতায় গোকুলচন্দ্রের জন্ম।
পিতা মতিলাল নাগ ও মাতা কমলা নাগ উভযেই গোকুলচন্দ্রের অল্প বয়সেই
লোকান্তরিত হন, গোকুল তখন স্কুলের ছাত্র। নাগদের পৈতৃক নিবাস
ছিল অক্রুর দত্ত লেনে। মতিলালের ছিল তিন পুত্র ও দুই কন্যা -
বিভাবতী (মিত্র), কালিদাস, গোকুলচন্দ্র, প্রভাবতী (মিত্র) ও
রামচন্দ্র। পরবর্তী কালে অগ্রজ ডঃ কালিদাস নাগ রাজ্যসভায় রাস্ট্রপতি
মনোনীত সদস্য ছিলেন এবং ঐতিহাসিক হিসাবেও নাম করেছিলেন। পিতৃমাতৃহীন
গোকুলচন্দ্র মামা বিজয় বসুর কাছে মানুষ হতে থাকেন।
গোকুলচন্দ্রের পড়াশোনা বেশীদূর এগোয় নি। ছোটবেলা থেকেই তার স্বাস্থ্য
ভাল ছিল না। সাউথ সুবার্বন স্কুলে পড়েছেন, কিন্তু পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ
হওয়ায় প্রধান শিক্ষকের বকুনি খেয়ে পড়া ছেড়ে দেন। ঘাটশিলায় কিছুদিন
পড়ার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু উল্লেখযোগ্য কিছু হয় নি। ছবি আঁকার
দিকে গোকুলচন্দ্রের ঝোঁক ছিল ছোটবেলা থেকেই, তারই রেশ ধরে তিনি
সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। তখন ছবি আঁকার পেশাকে খুব ভাল
চোখে দেখা হত না, মামা বিজয় বসুও খুব সন্তুষ্ট ছিলেন না। আর্ট
স্কুলেই গোকুলচন্দ্রের সঙ্গে শিল্পী অতুল বসু, যামিনী রায় ও
ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। পার্সি ব্রাউন
ও যামিনীপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে তিনি ছবি আঁকা শিখেছিলেন।
আর্ট স্কুলের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ছবি এঁকে কিছু কিছু রোজগার
করতে থাকেন, তবে তা সামান্যই।
১৯১৮ খ্রীষ্টাব্দে প্রত্নতত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের
অধীনে ভারতীয প্রত্নতত্ব বিভাগের ওয়েস্টার্ন সার্কেলে কাজে যোগ
দেন গোকুলচন্দ্র, কিন্তু ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্য কাজ ছেড়ে দিতে
হয়। গোকুলচন্দ্রের মামা বিজয় বসুর ভাই সুরেন বসুর নিউ মার্কেটে
একটি ফুলের দোকান ছিল; সেখানে সকালে বসতেন সুরেন বাবু আর বিকালে
ভার নিতেন গোকুলচন্দ্র। কেনা বেচার সময় যখন ফুল টানাটানি হত
গোকুলচন্দ্র তখন বুকে ব্যাথা অনুভব করতেন। অচিন্ত্যকুমার লিখেছেন
-"যে দোকান নিয়ে বসেছে সে ব্যবসা করতে বসে নি এমন কথা কে
বিশ্বাস করতে পারত? কিন্তু সেদিন একান্তে তার কাছে এসে অনুভব
করলাম, চার পাশের এই রাশিকৃত ফুলের মাঝখানে তার হৃদয়ও একটি ফুল।
আর সে ফুলটি সে অকাতরে বিনামূল্যে যে কারুর হাতে দিয়ে দিতে প্রস্তুত।"
এ থেকেই গোকুলচন্দ্রের মনের কিছুটা পরিচয় মেলে। ফুলের দোকানে
কাজের মাঝেই চলতে থাকে ছবি আঁকার কাজ। তেল রঙের পোর্ট্রেট ছিল
তার সবচেয়ে বেশি প্রিয়। সুদূর বম্বে ও পুণা থেকে অর্ডার পেতেন
গোকুলচন্দ্র।
সাহিত্যের
প্রতি অনুরাগ থাকলেও গোকুলচন্দ্র তখনও তাতে মন দিতে পারেন নি।
ফুলের দোকানে ফুল কিনতে আসা দীনেশরঞ্জনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব
গড়ে ওঠে। গোকুলচন্দ্র, দীনেশরঞ্জন দাশ, মণীন্দ্রলাল বসু ও সুনীতি
দেবীকে নিয়ে তৈরী হয় 'ফোর আর্টস ক্লাব'। গোকুলচন্দ্রের মামাবাড়ি
ছিল আলিপুর চিরিখানায়; তারাই প্রাঙ্গণে বসেছিল ক্লাবের প্রথম
সমাবেশ। প্রত্যেকের একটি করে মোট চারটি গল্প নিয়ে বই প্রকাশিত
হয়েছিল 'ঝড়ের দোলা'। এর মধ্যে গোকুলচন্দ্রের লিখিত গল্পের নাম
ছিল 'মাধুরী'। চিত্র, সাহিত্য, সঙ্গীত ও অভিনয়-এই চারটি ক্ষেত্রেই
গোকুলচন্দ্রের প্রবেশ ঘটেছে। তিনি বেহালা খুব খারাপ বাজাতেন
না। দীনেশরঞ্জন দাশ বন্ধু গোকুলচন্দ্র সম্বন্ধে লিখেছেন -"কণ্ঠস্বর
খুব সুন্দর না হইলেও তাহার গানে এমন একট গম্ভীর সুর ধ্বণিয়া
উঠিত যে, তাহাতে শ্রোতার মনকে একান্ত আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিত। গোকুল
যখন বেহালা বাজাইত তখন ও অত্যন্ত মনযোগের সহিত বাজাইত। বাজাইতে
বাজাইতে গায়কের মুখের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকাইয়া থাকিত।"
গোকুলচন্দ্র কিছুদিন অভিনয়ের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। Photo Play
Syndicate of India নামে একটি সিনেমা কোম্পানী গড়ে উঠেছিল; উদ্যোগক্তারা
ছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী, প্রফুল্ল ঘোষ, কানাইলাল দাশ প্রমুখ ব্যক্তিরা।
এই প্রতিষ্ঠানের একমাত্র নির্বাক চিত্র 'সোল অফ এ স্লেভ' বা
'বাঁদীর প্রাণ' খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের তক্ষশীলার প্রণয় কাহিনীকে
উপজীব্য করে তৈরী হয়েছিল। নায়ক 'ধর্মপালে'র ভূমিকায় ছিলেন অহীন্দ্র
চৌধুরী আর সহচর 'বাহুসেন' হয়েছিলেন গোকুলচন্দ্র। চলচ্চিত্রে
তিনি সম্ভবতঃ আর অভিনয় করেন নি, তবে মাঝে মাঝে নাট্যাভিনয়ে অংশ
গ্রহণ করেছেন।
চিত্র, সঙ্গীত বা অভিনয়ের জন্য নয় গোকুলচন্দ্র স্মরণীয় থাকবেন
তার প্রকাশিত 'কল্লোল' পত্রিকার জন্য। চিরাচরিত গণ্ডী ও অনুশাসন
উপেক্ষা করে বাংলা সাহিত্যে 'আধুনিকতা'র প্রবেশ ঘটে 'কল্লোলে'র
হাত ধরেই। এ জন্য পত্রিকাটিকে কম সমালোচনা সহ্য করতে হয় নি।
১৩৩০ বঙ্গাব্দের বৈশাখে প্রকাশিত হয় পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা।
তার নাম সহ-সম্পাদক হিসাবে থাকলেও সজনীকান্তের মতে গোকুলচন্দ্রই
ছিলেন 'আসল কর্ণধার'। লেখা যোগাড় করা, প্রুফ দেখা, প্রচ্ছদ পরিকল্পনা,
চিঠিপত্র লেখা ইত্যাদি কাজে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হত গোকুলচন্দ্রকে।
তার স্বাস্থ্য কোনদিনই ভাল ছিল না। ১৯২৫-এর শুরু থেকেই অবিরাম
জ্বরে ভুগতে থাকেন। যক্ষারোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। রোগমুক্তির
আশায় তাকে দার্জিলিং-এ নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ
করে ১৯২৫ খ্রীষ্টাব্দের ২৪শে সেপ্টেম্বর তিনি পরলোকে যাত্রা
করেন।
গোকুলচন্দ্র বেঁচেছিলেন মাত্র ৩১ বছর। তার মধ্যে কঠিন জীবন সংগ্রামে,
জীবিকা অর্জনের চেষ্টায় তিনি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন। সাহিত্যানুরাগী
হলেও খুব বেশী লেখা তিনি লিখে যেতে পারেন নি। 'প্রবাসী' পত্রিকায়
তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছে; যেমন - 'শিশির' (আষাঢ়, ১৩২৬)
; 'বাতায়ন' (মাঘ, ১৩২৬) ; 'দুই সন্ধ্যা' (চৈত্র, ১৩২৬)। 'ভারতবর্ষ',
'ভারতী', 'নব্যভারত' পত্রিকাতেও তিনি লিখেছেন। তার রচিত গ্রন্থ
-
(১)
'ঝড়ের দোলা' (১৯২২)। 'ফোর আর্টস ক্লাবে'র চারজনের চারটি গল্প
নিযে বইটি রচিত হয়। গোকুলচন্দ্র লিখেছিলেন 'মাধুরী' গল্পটি।
(২) 'রাজকন্যা' (১৯২২)। টেনিসনের
লেখা 'দি প্রিন্সেস' অবলম্বনে ছোটদের জন্য রচিত বই।
(৩) 'রূপরেখা' (১৯২২)। 'মালিনী', 'শিশির',
'বাতায়ন', 'জলছবি', 'মা', 'আলো', 'ছায়া', 'দুই সন্ধ্যা', 'পুজারিণী',
'অনন্ত' ও 'আশা' - এই দশটি রচনা গ্রন্থবদ্ধ হয়ে 'রূপরেখা' প্রকাশিত
হয়। এই লেখাগুলি 'প্রবাসী', 'ভারতবর্ষ', 'নব্যভারত' পত্রিকায়
প্রকাশিত হয়েছিল।
(৪) 'সোনার ফুল' (১৯২২)। এটি 'বঙ্গবাণী'
পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, শেষের কযেক অধ্যায়
বাদ দিযে। কারণ হিসাবে লেখক নিজেই বলেছেন -"কারণ তাতে যা
লেখা আছে তা মাসিক পত্রে ছাপবার উপযুক্ত নয়, এবং অনেকে বলেছেন
যে ও ভাবে লেখা অন্যায়, ওতে "নীতির কোন আভাস নেই",
এবং "কুরুচির" প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ওতে সমাজের বিশেষ
ক্ষতি হতে পারে।" ... ইত্যাদি। এ থেকেই কিছুটা আঁচ করা
যায় 'কল্লোল' তখন কেন এত কলরোল তুলেছিল।
(৫) 'পরীস্থান' (১৯২৪)। মেটারলিঙ্কের 'ব্লু
বার্ড' নামক নাটকের কিছু নির্বাচিত অংশ নিয়ে ছোটদের জন্য রচিত
হয়েছে এই গন্থটি।
(৬) 'পথিক' (১৯২৫)। এই উপন্যাসটি 'কল্লোল'
পত্রিকায় ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা (১৩০০ বঙ্গাব্দ, বৈশাখ) ২য় বর্ষ
৭ম সংখ্যা পর্যন্ত (১৩৩১-এর জ্যৈষ্ঠ ও আশ্বিন বাদে) ধারাবাহিক
ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৫ খ্রীষ্টাব্দে।
(৭) 'মায়ামুকুল' (১৯২৭)। তিন খণ্ডে মোট
১৯টি গল্প নিয়ে এই গ্রন্থটি রচিত। লেখকের মৃত্যুর সময় এটি প্রকাশের
কাজ চলছিল। সম্পূর্ণ গ্রন্থটি গোকুলচন্দ্র দেখে যেতে পারেন নি।
অকালে বিদায় নেওয়া গোকুলচন্দ্রের সম্বন্ধে তার অভিন্নহৃদয় বন্ধু
'কল্লোল'-সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ লিখেছেন -"তাঁর চেহারায়
অগ্রজ কালিদাসের মত জৌলুস ছিল না। তাঁর ছিল বেহালা-বাজিয়ের মত
লম্বা চুল, চোখে সেকেলে চশমা, শরীর বেশ দুর্বল, স্বাস্থ্য বরাবর
খারাপ। সব সময় মুখে থাকত সিগারেট, কথা বলতেন কম। দূর থেকে দেখলে
কেমন যেন দাম্ভিক মনে হত। কিম্বা নিরাসক্ত উদাসীন। সেই উদাসীনতা
কতকটা নিস্তেজ শরীর ও স্বপ্নাভিলাষের দান। কিন্তু কাছে গেলে
পাওয়া যেত একটা উত্তপ্ত সান্নিধ্য, কণ্ঠস্বরে অন্তরঙ্গতা।"
যে স্বপ্ন গোকুলচন্দ্র দেখেছিলেন, তা হয় ত পূরণ হয় নি; তবে যতদিন
'কল্লোল' পত্রিকা সাহিত্যের জগতে সজীব থাকবে ততদিন গোকুলচন্দ্রের
মৃত্যু নেই।]
দীপক সেনগুপ্ত।
সমাজের
সমস্ত বিধি বিধান মেনে বামুন পুরুতে ডেকে, মন্ত্র পড়ে মনোহর
দাশের সঙ্গে রঙ্গন-এর বিয়ে হয় নি। উভয় পক্ষেরই আত্মীয় কুটুম্বের
বালাই ছিল না, এই শুভ কাজে প্রতিবেশীদের নিয়ে উৎসব ক'রে খাওয়ান
দাওয়ানর কথাও মনোহরের মনে হয় নি। যৌবন যখন কামনার প্রদীপ বুকের
ভিতর জ্বেলে দিয়েছিল, শরীর মন যখন মিলন তৃষ্ণায় পাগল এমন সময়
দুজনের দেখা হল দু'দিক হ'তে দু'খণ্ড মেঘ এসে ধীরে ধীরে যেমন
পরস্পরের মধ্যে বিলীন হ'য়ে যায় তেমনি ক'রে দু'টি মানুষ পরস্পরের
মধ্যে আপনাদের হারিয়ে ফেলেছিল; সাক্ষী ছিলেন ভগবান। এই জন্যে
এটাকে বিবাহ বা উদ্বাহ বন্ধন বলা যায় না-মিলন নামই ঠিক।
এই মিলনের মধ্যে কোন নূতনত্ব বা এ মিলন কবিত্বময় ছিল কিনা জানি
না কিন্তু এতে বড় একটা চমৎকারিত্ব ছিল।
মনোহর দাশ গঙ্গার ওপর এক জেটির ক্রেন্মিস্ত্রীর কাজ কর্ত। বড়
বড় বজ্রা, গাধা বোট্ বা জাহাজ থেকে বস্তা বা বাক্স-বোঝাই মাল
ক্রেনে তুলে নিয়ে জেটির ওপর দিকে মাল গুদামে পৌঁছে দেওয়া এই
ছিল তার কাজ। সকাল ছ'টায় সে কাজে বেরুত, ভাত খাবার ছুটির সময়
ছিল তার বারোটা থেকে তিনটে, তারপর আবার তাকে সন্ধ্যা ছ'টা পর্য্যন্ত
ক্রেন্ চালাতে হ'ত। মাইনে পেতো গোট্টা চল্লিশ টাকা, রাতে ওভার
টাইম খেটেও বিশ পঁচিশ টাকা সে উপায় কর্ত। মদের বোতল আর কাজের
নেশা ছিল তার একমাত্র সংসারের বন্ধন, কাজেই অবস্থা বেশ সচ্ছল
হলেও এই টাকাগুলোর বেশীর ভাগ অংশ গিয়ে পড়ত গুরুচরণ সাহার তহবিলে
আর ভজহরির চাট্ওয়ালার দোকানে। -ভজহরির হাতের রান্না চাট্ অর্থাৎ
কাঁক্ড়া বা মেটুলি চচ্চড়ি, কি দারুণ ঝাল দেওয়া কোন অজ্ঞাত মাংস,
ডিমের ডাল্না বা চানাচুর না খেলে মনোহরের মতে মদ খেয়ে মজাই হয়
না। প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলা কাজ থেকে ফির্বার পথে একটা শিশিতে
ক'রে আউন্স্ ছয় আট মদ আর কিছু চাট্ কিনে সে ঘরে ফির্ত। রাতে
সে প্রায়ই রাঁধত না, দোকানের পরোটা ঐ চাট্ আর মদ খেয়েই তার রাতের
খাওয়া সারা হ'ত। মদের দোকানে বসে, বন্ধু নিয়ে হল্লা ক'রে মদ
খাওয়া ছিল তার রুচির বাইরে। সে নিজে মদ খায় কিন্তু মাতালদের
সহ্য করতে পারে না বেশী। লোকজনের সঙ্গে মেলা মেশাও ছিল তার ধাতের
বাইরে।
দিনের শেষে কাজ থেকে ফিরে শ্রান্ত শরীর মন একটু জুড়িয়ে নিয়ে
পিদিম জ্বেলে তার মার হাতে লাগান তুলসী তলায় রেখে ভক্তিভরে মাটিতে
মাথা রেখে প্রণাম করে তারপর পিল্সুজ্টি ঘরের দাওয়ায় রেখে তার
রাতের খাওয়া সেরে নিতে বসে। যখন বসে তখন বড় জোর সন্ধ্যা সাড়ে
সাতটা কি আট্টা হবে কিন্তু যখন ওঠে তখন প্রায় মাঝরাত! এতখানি
সময় শুধু খেয়েই চলে না, অদৃশ্য কোন্ মানুষের কাছে আপনার জীবনের
ব্যথা বেদনার সমস্ত ইতিহাসটুকু গভীর আবেগের সঙ্গে একটু একটু
ক'রে বলে যেতে থাকে! চোখ দিয়ে তখন তার অবিশ্রান্ত ধারায় জল ঝড়ে
পড়ে!
সেদিন
দুপুর বেলা ছুটির পর দারুণ রোদের মধ্যে দিয়ে কোন মতে ঘরের দিকে
চলেছে, চৌমাথার কাছে এসে হ্ঠাৎ একটা নতুন জিনিস তার চোখে পড়ল।
যে পথটি বরাবর চিন্তামণির ঘাটের দিকে গিয়েছে সেই পথ দিয়ে এসে
একটি মেয়ে তারই পিছন-পিছন, কখন আগে আগে কখন বা পাশে পাশে বস্তির
দিকে চল্তে লাগল।
স্বাস্থ্যপূর্ণ,
আঁট্-সাঁট্ শরীর, গায়ের রং কালো, রোদের তাপে ও পরিশ্রমে তামাটে
দেখাচ্ছে, গালে অতিরিক্ত লাল আভা; চোখ দুটি তার আরও কালো, তাতে
যেন বিদ্যুৎ ভরা। পরনের কাপড়খানি যেন ভিজে রোদে শুকিয়ে আস্ছে,
অত্যন্ত আঁট্-সাঁট্ ভাবে পরা, মাথায় একটা ভিজে গামছা জড়ান আছে,
মনে হয় সে এই মাত্র স্নান সেরে উঠে আস্ছে। চল্তে চল্তে তার কালো
চোখের দু একটি চাউনি সে মনোহরকে উপহারও দিল। তারপর খানিক পথ
এমনি দু'জনে বিনা বাক্যব্যয়ে পাশাপাশি এসে মেয়েটি ঢুক্ল জগৎ
বিখ্যাত অন্ধকার স্যাঁত্-স্যেঁতে আবর্জ্জনায় ভরা মাথা-ফাটার
গলির মধ্যে। মনোহর কিছুক্ষণ পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তার চলে যাওয়া
দেখ্ল, কি যেন ভাবল তারপর বাজার থেকে বাজার ক'রে নিয়ে সে এল
তার ঘরে।
একটু জিরিয়ে
নিয়ে, উনান্ ধরিয়ে ভাত চাপিয়ে সে কৈ-পুকুরে স্নান কর্তে গেল।
ফিরে এসে সে প্রতিদিনের মত তরকারী কুটে নিয়ে রাঁধতে বস্ল। রান্না
খাওয়া শেষ হলে, উঠানের কাঁঠাল গাছের ছায়ায় পাটি বিছিয়ে একখানি
বহু পুরানো সহস্র দাগে ভরা জীর্ণ কৃত্তিবাসী রামায়ণ খুলে সুর
ক'রে পড়তে পড়তে ঠাণ্ডা বাতাসের তার চোখের পাতা তন্দ্রায় বুজে
গেল। তার এই সুখ-সুপ্তির মধ্যে ধীরে ধীরে সেই মেয়েটির কালো চোখের
চাওয়া যেন অসীম কোন্ রহস্য পূর্ণ লোকে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
তারপর আবার যথাসময়ে সে কাজে বেরিয়েছে, সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে মদের
সরঞ্জাম নিয়ে বসেছে কিন্তু সব সময়ই সেই মেয়েটি যেন তার সাম্নে
দিয়ে চলে ফিরে বেড়াচ্ছিল-মনোহরের মনে বড় বিস্ময় লাগ্ল।
পরের দিনও
ঠিক ঐ সময় একই অবস্থায় আবার সে ঐ মেয়েটির দেখা পেল। এমনি ক'রে
প্রতিদিনই ঠিক ঐ চৌমাথাটির কাছে এসে দু'জনের দেখা পায়, এক সঙ্গে
খানিকটা পথ হাঁটে তারপর আবার দু'জনে দু'দিকে চলে যায়। ক্রমে
এই মেয়েটির দেখা পাওয়া মনোহরের কাছে এত স্বাভাবিক হ'য়ে এল যে,
সময় সময় তার ভয় হ'ত...আজ যদি তারে না দেকি-কাজের মধ্যেও মেয়েটির
কথা ভেবে সে আন্মনা হয়ে যায়।
সেদিন
মনোহরের মনে হ'ল মেয়েটি চল্তে চল্তে একবার তার দিকে আড়চোখে চেয়ে
একটু হাসল! সেও তাড়াতাড়ি হাসির ঋণ, হাসি দিয়ে শোধ কর্তে গিয়ে
দেখ্ল-ফল হল উল্টো! মেয়েটির মুখ কাঁপিয়ে ছিট্কে পথের ওপাশে গিয়ে
হন্-হন্ করে এগিয়ে চলে গেল! মনোহর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আজ যেন
ঐ মেয়েটিকে তার বড় ভাল লাগ্ল। এতদিন সে শুধু একটা বিস্ময়ের ওপরেই
যেন ভাস্ছিল। তার মনের কৌতুহল বেড়ে গেল। সেদিন সে প্রতিজ্ঞা
কর্ল-যেমন করেই হোক্ ওর সাতে ভাব কোত্তেই হবে।
পরের দিনও
যথারীতি, যথা সময় এবং যথা স্থানে দু'জনের দেখা। কয়েক পা এক সঙ্গে
চলেই মনোহর বিষম এক হোঁচট্ খেয়ে মুখ দিয়ে একটা বিকৃত শব্দ ক'রে
আহত পায়ের আঙুল হাতে চেপে মাটিতে বসে পড়্ল-বুড়ো আঙুলের নখের
পাশ দিয়ে রক্ত ঝড়ে পড়্ছে!
মনোহরের
উদ্দেশ্য ছিল অভিনয় করা কিন্তু সেটা যে এমন দারুণ সত্যে এসে
দাঁড়াবে তা সে ভাবেনি।
মেয়েটি থম্কে দাঁড়িয়ে পড়্ল। তারপর কাছে এসে চাপা গলায় অবাক হয়ে
বলে উঠ্ল-ইঃ-ই যে দেখি এক্কেবারে রক্তো গঙ্গা! র-র-একটুক্র আমি
এস্তিচি।
অতি পরিচিতের মত স্নেহ সিক্ত সুরে কথাগুলি বল্তে সে ছুটে পথের
ধারের এক মুদীর দোকান থেকে খানিকটা রেড়ির তেল চেয়ে নিয়ে, পান
দোখ্তা বাঁধা কাপড়ের খানিকটা ছিঁড়ে তেলে ভিজিয়ে মনোহরের পায়ের
আঙুলটা অতি যত্নে বেঁধে দিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে
বল্ল, কেমন ইবার একটুক আরাম লাগ্চে না তুর্?
মনোহর
মেয়েটির মুখের দিকে তার কৃতজ্ঞ দৃষ্টি রাখ্ল। মেয়েটি লজ্জা পেয়ে
মুখ নীচু ক'রে বল্ল, এখন ত ঘরকে যেতে পার্বি না, একটুকু ঐ পাকুড়
গোচের ছাওয়ায় ব'স।
অনুগত
ভৃত্যের মত খোঁড়াতে খোঁড়াতে মনোহর গাছের ছায়ায় এসে বস্ল। মেয়েটিও
সঙ্গে সঙ্গে এসে তার পাশে বস্ল, তারপর মৌনতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে
মেয়েটি নিজেই মনোহরের আঘাত সম্বন্ধে প্রশ্ন ক'রে যেতে লাগল,
ব্যথা কম্ছে কি না তাও জিগ্গেস কর্ল, তারই মধ্যে পুরুষদের প্রকৃতি
নিয়ে তীব্র মন্তব্য প্রকাশ কর্তেও ছাড়ল না। মিন্ষেগুলান্ সব
উট্চোকো, রাস্তা দিয়ে যাবে কিন্তুক চোক দুটো যে কুতা থাকে তা
যমরা জানে-ইত্যাদি।
মনোহর গভীর আনন্দে এই মেয়েটির অনর্গল ব'কে যাওয়া শুন্ছিল আর
মাঝে মাঝে তার মুগ্ধ দৃষ্টি মেয়েটির মুখের ওপর রেখে তাকে রঙিয়ে
তুলছিল। এক সময় সে হঠাৎ জিগ্গেস ক'রে বস্ল, আচ্ছা তুই উ মাতা-ফাটার
গলিতে কার ঘর্কে থাকিস্?
উদাসীনভাবে
মেয়েটি বল্ল, নক্ষ্মী বাড়ীউলির একখান্ ঘর আমি নে আচি।
কেমন মনমরা
হয়ে মনোহর বল্ল-নক্ষ্মী বাড়ীউলি? উ যে-'
একটু ঝাঁজের
সঙ্গে মেয়েটি বল্ল-উয়ার কতা আমারে কিচু কোস্ না-সব জানি-কিন্তুক
কোন্ চুলায় আর যাই? পির্থিমিতে আমার আর কে আচে?
ঘৃণা ভরা
মনোহর বল্ল-যেতো শালার মাতাল-'
মুখখানাকে যথাসম্ভব বিকৃত ক'রে দারুণ বিরক্তি
ও ঘৃণার সঙ্গে মেয়েটি কতকটা আপনার মনেই বল্ল-পিত্যহ রেতে দোর
ঠেঙাঠেঙি ... গলা কাটা কাটা খুনা-খারাপি...ভগোমান জানে কি কোরে
আমার রাতটুকুন্ কাটে-নক্ষ্মী হারামজাদী কি কম শেয়ান্? বলে-অমোন
গতোর নে' দোর বন্দো কো'রে কি থাকতে হয়? খুলে দে না-শতেক খোয়ারী!
মনোহর বল্ল-আর কোথাও ভাল ঘর নে যতী তুই-
তার কথা
শেষ না হতেই ঝঙ্কার দিয়ে মেয়েটি বল্ল-অমন নম্বা নম্বা কথা সব্বাই
কইতে পারে-টেকা জোগাবে কুন্ যম?-
মনোহর কোন কথা
কইতে আর সাহস পেল না। কিছুক্ষণ পরে মেয়েটা নিজেই আবার আরম্ভ
করল-অওরৎদারদের মাল লৌকা থেকে ঝাঁকা বোঝা নে' দু'শো কদম এসে
আর একজনার মাতায় চালান্ দি-দিন্ভোর খেটে এককুড়ি টেকা বড় জোর
মাসে রোজকার হয়; তার পাঁচ্টেকা যায় ঘর ভাড়া, নিজে রেঁদে খাই,
ভালোটা মন্দোটার ওপর একটুকু নোলাও আচে, তাতেও পেরায় বারোটা টেকা
যায়-হাতে আর কি রইল? পান দোখ্তা খাবার পয়সাও জুটে না। এই যে
সে দিনকে হরিদাসীর ছেলেটা আমার চোকের সামনে সন্নিপাত হয়ে ধড়ফড়িয়ে
মোল, কিছু কি কোত্তে পান্ন? বাজার পেটে এক ফোঁটা ওষুদ পড়্ল নি...
হরিদাসীর হাতে এক কানা কড়ি ছ্যালো নি, আমার কাচ্কে চার্টেকা
ছ্যালো, সে ত সব শ্যাম ডাক্তারের গব্বে গেল। কি আর উপায়? হাত
জোর কোরে ভগোমানের কাচ্কে নিবেদন জানানু-ভগোমান তুমি এরে বাঁচাও-তা
ভগোমান কি গরীব নোকের কথা শুনে? তেনার ত যত বড়নোক নে' কার্বার-তারপর
যে কাগোজখানায় ওষুদের নাম নিকে দে' ছ্যালো ডাক্তার, আমরা দু'জনায়
সেটাকে ছেলেটার বুকে, ঘোষ্তে নাগ্নু, আর তার চোক্ উল্টে গেল!
টেকার গাঁদির ওপর বোসে আচে ঐ নচ্ছার মাগী নক্ষ্মী, কিন্তুক্
একটা আদ্লা কি বার্ কোল্লে?-পায়ে ধরে কেঁদে হরিদাসী বললে-যেত
দিন বাঁচ্ব তোর গোলামী কোর্ব মাসী, আমার ছেলেকে বাঁচা।-মাগী
বল্ল কি-হেঁ কার ছেলে তার ঠিক নেই, তার তরে এত! ওটা ত মর্বেই
নাবের মধ্যে আমার টেকাগুনো যাবে-' অতো গুলান্ মিন্ষে ত আমাদের
পাড়ায়, কেউ কি একবার উকি পাড়্লে?-রেতের বেলা এসে সোহাগ-পীরিত
ক'রে ভোর রেতে ঘট্টে বাট্নে নে' পালাতে মুক্পোড়ারা খুব দড়। কি
আর করি, শেষবেলা আমিই ছেলেটাকে কেঁতায় জইড়ে কোলে তুলে নিনু আর
হরিদাসী আমার সাতে সাতে কান্তে কান্তে চল্ল। ঘাটের 'মুড়ি-পোড়া
বামুন' বলে, তিন টেকা সাড়ে বারো আনা নাগ্বে, পুড়াবার খরচ!-টেকা
কুতায় পাবো! শেষটা আমার হাতের দুগাচা চুড়ি পোদ্দারের দুকানে
রেকে বারোটি টেকা পেনু। -পোড়ানি খরচ, পেরাচিত্তির করা, বামুন
মুদ্দোফরাসকে দিতে পেরায় ছ'টেকা বেইরে গেল! বাকী টেকা আমি হরিদাসীর
হাতে দিনু। -মাগো! হাউ হাউ করে বক্তেই নেগেচি! আচ্ছা, তুর মা
আচে? বুন, ভাই, বাপ, বৌ, ছেনা পোনা?-
মেয়েটির জীবনের কাহিনী শুন্তে শুন্তে মনোহর কেমন উনমনা হয়ে পড়েছিল,
তারী প্রশ্ন শুনেও তখুনি জবাব দিতে পার্ল না। কিছুক্ষণ পরে গভীর
নিশ্বাস ফেলে শুক্ন হাসি হেসে সে বল্ল-হেঁ-মূলে মাগ নেই, তার
ছেনা-পোনা! বাপ মা ভাই বুন ছ্যাল, তা সে বছর মায়ের অনুগ্রহ হল
আর আমাদের সংসার ধুয়ে নে গেল, বাকী রইনু আমি।
ব্যথিত
সুরে জলভরা চোখ মনোহরের চোখের ওপর তুলে মেয়েটি বল্ল-তুরও কেউ
নেই?-
উদাসীন
ভাবে মনোহর উত্তর দিল-না। হঠাৎ সে মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে
সময় অনুমান করে নিয়ে বল্ল-ইঃ! বেলা পেরায় আড়াই পহর! আজ আর ঘরকে
যাওয়া হবে নি-কজে যাই।
মেয়েটি
অনুতপ্ত হয়ে বল্ল-আমারই দোষ, বসে বসে গল্প ক'রে বেলা গেল, তুর
যে খাওয়া হ'ল নি?
মনোহর বল্ল-ঐ ভুঞ্জাওয়ালার দোকান থেকে কিছু খেয়ে নি গে।
সে
যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াল। মেয়েটিও উঠ্ল সঙ্গে সঙ্গে। মনোহর চোখ
ভ'রে মেয়েটিকে শেষ করে দেখ্বার জন্যে তাকাতেই কুণ্ঠিত ভাবে সে
বল্ল-তুর ঘর কুতা?
মনোহর
বল্ল-ঐ মদন ঠাকুরের গলি। বাজার ছাইড়ে একটুক্ এগিয়ে গে বাঁ হাতি
যে গলি তারই ডান দিকে পের্থম ঘরখানায় আমি থাকি।-কিন্তুক তুর
নামটি ত আমায় বল্লি না?
মুখ নীচু
করে একটু হেসে মেয়েটি বল্ল-রঙ্গন।
মনোহর বল্ল-তুরও আজ যে বেলা হয়ে গেল-
রঙ্গন বল্ল-সে তুই ভাবিস্ না, ই পোড়া পেট
কামাই যাবে নি। উয়ার তরেই ত এত খোয়ার-যাই।
মনোহর
একটু ম্লান হেসে আবার তার জেটির দিকে চল্তে চল্তে একবার পিছন
ফিরে তাকাল, রঙ্গনও ঠিক সেই সময় তার দিকে ফিরে দেখ্ছিল! হেসে
মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সে আবার বস্তির দিকে চল্তে লাগল।
পথের ধারের
এক খোঁট্টা ভুঞ্জাওলার দোকান থেকে কিছু চাল্ কড়াই ভাজা, গোটাকতক
পেঁয়াজের বড়া আর কাঁচা লঙ্কা নিয়ে খেতে খেতে সে চলেছে-বুক তার
আজ কানায় কানায় ভরা।
২
সন্ধ্যার
পর নিয়ম মত সে পকেটে মদের শিশি, আর হাতে চাটের ঠোঙা নিয়ে ঘরে
ফির্ল। স্নান ইত্যাদি সেরে, ঠাকুর প্রণাম ক'রে, খাবারগুলি নিয়ে
বসেছে এমন সময় উঠানে একটি মেয়ে এসে দাঁড়াল।
আলোটা ছিল ঠিক
মনোহরের চোখের সাম্নে তাই বাইরের অন্ধকারে তার ভাল নজর চলছিল
না। একহাতে আলোটা আড়াল ক'রে সে বল্ল-কে গা?
মেয়েটি
এগিয়ে এসে দাওয়ার নীচে দাঁড়িয়ে বল্ল-আমি রঙ্গন-তুর পায়ের ব্যথাটা
কেমন আচে তাই জান্তে এনু।
কথা বল্তে বল্তে একটা খাবারের ঠোঙা সে মনোহরের সাম্নে রাখ্ল।
মনোহর
জিগ্গেস কর্ল-উতে কি আচে?
রঙ্গন অত্যন্ত কুণ্ঠিত ভাবে বল্ল-একটুক্
মিষ্টি-তুর্ তরে আজ কিচু তরকারী রেঁদেছিনু, তারপর ভাব্নু আমার
হাতের রান্না কি তুই খাবি?-
মনোহর
মন খুলে হেসে উঠ্ল, তারপর তার ডানপাশে অন্ধকার যে শিশি আর ওষুধ
খাবার মত ছোট একটা গেলাস ছিল সে দুটো সাম্নে এনে শিশি খুলে গেলাসে
মদ ঢেলে খাবার জন্যে মুখের কাছে হাত উঠিয়েছে এমন সময় একটা অস্ফুট
আর্ত্তনাদ শুনে তার হাত নেমে এল। রঙ্গনের দিকে তাকাতেই সে বলে
উঠল-তুইও উ খাস্?
মনোহর কোন কথা না ব'লে মুখ নীচু ক'রে বসে রইল, কিছুক্ষণ, তারপর
মদের শিশি গেলাস রঙ্গনের পায়ের কাছে রেখে বল্ল-তুর দিব্যি উ
আর খাব নি।
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। যেন বল্বার মত কোন কথাই তারা
আর খোঁজে পাচ্ছিল না! দুজন এত কাছাকাছি এসে, পরস্পরের মন সম্পূর্ণরূপে
জেনেও আর একটু এগিয়ে আসবার সাহস যেন কারো হচ্ছিল না। মৌনতা যখন
অসহ্য হয়ে উঠেছে, এমন সময় রঙ্গন বল্ল-আজ ইবেলা তুই রাঁধিস্ নাই?
মনোহর হেসে বল্লে-হেঁ, একবেলা রাঁধ্তেই উনানে ফু পেড়ে পেড়ে চোক
কানা হয়ে যায়, আবার দু'বেলা।
রঙ্গন মুখ নীচু ক'রে বল্ল-আমি তুর রেঁদে দুবো?
মনোহর
কোন কথা না বলে তিন্টে চাবী একটা রিং রঙ্গনের হাতে দিয়ে বল্ল-এই
বড় চাবীটা বাইরের দোরের, মাঝারিটা ভাঁড়ার ঘরের আর আর ছোটটা রান্না
ঘরের।
তুর খাওয়া
হয়েছে?
রঙ্গন বল্ল-না, গে' খাব।
আমি দিলে খাবি না?
রঙ্গন শুধু হাস্ল।
মনোহর স্নিগ্ধসুরে ডাক্ল-রঙ্গন।
রঙ্গন কোন উত্তর দিল না, তার চোখ দিয়ে জল
পড়ছে।
মনোহর এবার কতকটা কর্ত্তৃত্বের সুরে বল্ল-তুকে
আমি আর উনানে যেতে দু'বো নি।
রঙ্গনের চোখে রইল জল কিন্তু আবার হাসি দেখা
দিল।
মনোহর বল্ল-ঘর দোর সব তুর্!
রঙ্গন হেসে বল্ল-ঘর দোর আমার আর তুই কার?
মনোহর বল্ল-তুই বল্।
রঙ্গন দ্বিধা লজ্জা ত্যাগ ক'রে মনোহরের
চোকের দিকে তাকাল।
মনোহর দাঁড়িয়ে উঠে রঙ্গনের হাত ধ'রে বল্ল-আমার
সাতে একবার আর-
রঙ্গনকে নিয়ে তুলসী তলায় এসে মনোহর বল্ল-ইটা
আমার মা'র তুলসী বেদী, আয় পের্ণাম করি-
মনোহর নিজে ভূমিষ্ট হয়ে প্রণাম কর্ল, রঙ্গনও তার পাশে মাটিতে
মাথা ঠেকাল। তারপর উঠে এসে দু'জনে খেতে বস্ল।
রঙ্গন বল্ল-কিন্তুক উখানে যে আমার পুরান
কাসুন্দির হাঁড়িটে পড়ে রইল!
চীৎকার ক'রে হেসে মনোহর বল্ল-হা তুর্ মেয়েমানুষের
নোলা রে-'
মুখ একটু ঘুরিয়ে রঙ্গন বল্ল-তা আর নয়! আজ
চার বচ্ছর উয়াস বয়েস হল-এক টুক্রা দে এক কুন্কে চালের ভাত খাওয়া
যায়।
মনোহর হেসে বল্ল-আচ্ছা তুর্ কাসুন্দির হাঁড়ি
আর সব জিনিষ-পত্তর কাল আমি এনে দুবো-নক্ষ্মী কিচু পাবে?
হুঁ, ইমাসের পনেরো দিনের ভাড়া আড়াই টেকা।
৩
বছর
প্রায় ঘুরে আস্তে চলেছে, মনোহর তৃপ্ত। গুরুচরণ সাহার দোকানে
প্রতিমাসে তার যে টাকা ঢাল্তে হত এখন তার চেয়ে কিছু বেশী। মধ্যে
মধ্যে গিয়ে পড়ছে 'লক্ষ্মী বাবুকা আস্লি, খাঁটি সোনে-চান্দিকা
দুকান-এ।' এবং সঙ্গে সঙ্গে দু'একখানা ক'রে ভারি ভারি রূপার গহনাও
রঙ্গনের অঙ্গে এসে উঠ্ছে। যে মাথা গোঁজবার ঠাঁইটুকু তার কাছে
মরুভূমি বলে কিছুদিন আগে মনে হ'ত, এখন সেখানেই সে শান্তি খুঁজে
পেয়েছে তাই তার আনন্দের সীমা নেই। সে এখন পরিশ্রম করে বেশী,
খায় প্রচুর উপার্জ্জন করে অনেকগুলি টাকা, তার বিশ্রাম এবং নিদ্রার
অবসরটুকু অনাবিল শান্তিপূর্ণ, কোন দুশ্চিন্তা, দুঃস্বপ্ন সেখানে
ঠাঁই পায় না।
কিন্তু রঙ্গনের মনে তৃপ্তি নেই, যৌবনের ক্ষুধা তৃষ্ণা, ক্রমেই
তার অসহ্য হয়ে উঠ্ছে। অতৃপ্ত কামনা সর্ব্বদাই তাকে যেন কেমন
আচ্ছান্ন ক'রে রাখে। মনোহরের ইচ্ছা এবং সময় হলে তবে সে একটু
সোহাগ একটু ভালবাসা একটু তৃপ্তি পাবে। সে নিজে গায়ে পড়ে কোন
দিন সোহাগ জানাতে গেলে শ্রান্ত মনোহর হয় ত বলে, একটুক্ বাতাস
কর্ না রঙ্গন, আজ ভারি খাটুনি গেছে।
রঙ্গন মনকে সংযত করে নিয়ে মনোহরকে বাতাস কর্তে বসে। এই কথা ভেবে,
মনে তার যত রাগ হয়, তার চেয়ে বেশী হয় লজ্জা। এই সুখের খাঁচা
তার অসহ্য লাগে। চিরমুক্ত সে। বাইরের হাজার ঝড়-ঝঞ্ঝা মাথায় ক'রে
চল্ত। সেই দারুণ দুঃখের মধ্যেও স্বাধীনতার একটা তীব্র নেশা তার
মনকে ঘিরে রাখ্ত। এখানে সবই সংযত, নিয়মিত পরিমিত, সীমাবদ্ধ!
গত কয়
বৎসরের কর্ম্ম জীবনের কথা সে ভাবে, দুঃখ, দারিদ্র্য, অন্যায়
অত্যাচার অপমান-এ সবের ওপর নালিশ শোন্বার কেউ নেই সেখানে। যে
বয়স পর্য্যন্ত রঙ্গন কেবল সহ্যই করেছে, তারপর একদিন সে আপনার
রক্ষার ভার আপনার হাতেই তুলে নিল, অত্যাচারী বিস্মিত হয়ে দূরে
গিয়ে দাঁড়াল। সেই দিন থেকে সম্ভ্রম মেশান কৌতুকের সুরে সকলে
তার নাম উচ্চারণ কর্ত।
সে তখন চাট্নি কলে কাজ করে। কাজের মধ্যেই স্ত্রী-পুরুষের অজস্র
নোংরা হাস্য পরিহাস চল্তে থাকে। এই কলে যত ছেলে মেয়ে কাজ কর্ত
তার মধ্যে ভোলা চাঁড়ালের মত নোংরা প্রকৃতি কারো ছিল না। তার
ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে একদিন একটি মেয়ে বল্ল-আমাদরে কাচ্কে তুর্
যেত ফুটানি, যা দেখি একবার রঙ্গনের কাচ্কে-'
ভোলা হেসে বল্ল-ই কথা? ভাল তুই মনে ক'রে দিলি-ছুঁড়িটা বেশ ডব্কা
লয়?
তখন টিফিনের সময়। সবাই কোথাও না কোথায় বসে কিছু খেয়ে নিচ্ছে।
সবার থেকে কিছু দূরে একটু নিরিবিলি জায়গায় রঙ্গন আঁচলে কিছু
মুড়ি কড়াই সিদ্ধ লঙ্কা সহযোগে চিবাচ্ছিল, সামনে এক ঘটি জল ও
একটা শাল পাতায় ছোট ছোট দুটি শসা, নুন মরিচ মাখা পড়ে আছে। হঠাৎ
কোথা থেকে ভোলা এসে তার পাশে বসেই শসা দুটি হাতে নিয়ে চিবাতে
আরম্ভ কর্ল! তারপর তার আঁচল থেকে মুড়ি থাবা ভর্ত্তি ক'রে নিয়ে
খেতে লাগল। রঙ্গন আর খেল না, বাকী সমস্ত মুড়ি কড়াই সে ভোলার
কাপড়ে ঢেলে দিয়ে জলের ঘটিটা নিয়ে উঠ্তে যাবে এমন সময় টের পেল,
ভোলা বাঁ হাত দিয়ে তার কোমর জড়িয়ে ধরেছে!
বিশেষ কোন মেজাজে না দেখিয়ে রঙ্গন বল্ল-কি করিস্? ছাড়, কেউ দেক্বে-'
তচ্ছিল্যের সুরে মুখ বাঁকিয়ে ভোলা বল্ল-আরে দেখ্নে দেও-কুন্
শালা ভোলার উপর কতা কহেগা?
সে আপনার মনে খেয়ে চল্ল।
রঙ্গন হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে
নিয়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা কর্ল, তাতে ভোলার হাত ছেড়ে গেল বটে
কিন্তু সে কাপড়টাকে ধীরে অল্প অল্প টান দিতে লাগল।
রঙ্গন আর কোন কথা না বলে এমন প্রচণ্ড এক লাথি তার বুকে কসিয়ে
দিল যে, লঙ্কা-মুড়ি-শসা-পূর্ণ মুখে কাস্তে কাস্তে ভোলা মাটিতে
গড়িয়ে পড়ল। তারপর জলের ঘটিটা উঠিয়ে নিয়ে সে নিঃশব্দে তার কাজের
জায়গায় এসে বল্ল।
* * *
চটের কলে সে যখন ছিল তখন ভৈরব দুলের ছেলে
শ্রীদামকে তার কেমন অদ্ভুত লাগ্ত, ভালও লাগ্ত। ছেলেটার বযস প্রায়
তারই সমান, হৃষ্ট-পুষ্ট জোয়ান শরীর কিন্তু কেমন যেন হাঁদা হাঁদা
ভাব! কিছুই যেন সে বোঝে না। চট্কলে বিঁড়ি, সিগারেট বা তামাক
খাবার নিয়ম নেই, সবার মত দোখ্তার মিশি' ঠোঁটের কোলে রেখে আপনার
মনে কাজ ক'রে যায়-কোন দিকে তার নজর নেই। তার বয়সী বা তার চেয়ে
কত ছোট ছেলে মেয়েদের সঙ্গে কত 'রঙ্গ' কত 'ইয়ারকি' ক'রে, সে ওসব
বোঝে না।
রঙ্গন কিছুদিন তাকে দেখ্ল, তারপর একদিন নিরিবিলি একটা জায়গায়
তাকে একা পেয়ে তার পাশে এসে দাঁড়াল, আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছিয়ে
দিয়ে তারই মধ্যে গালটা একটু টিপে দিল।
শ্রীদাম রঙ্গনের মুখের দিকে তাকিয়ে হাস্ল-সেই বোকার হাসি, তাতে
চেতনার আভাস নেই।
রঙ্গন একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ তাকে বুকে চেপে তার মুখের
ওপর গভীর আবেগের সঙ্গে এক চুমা দিল।
শ্রীদাম বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে; তার ঠোঁটে যেন কিসের ছোঁয়া
সে অনুভব কর্ছে যার স্বপ্ন-স্পর্শে সর্ব্বশরীরে তার সুখের ঢেউ
খেলে যাচ্ছে! শরীর তার রোমাঞ্চিত হয়ে উঠ্ল। চোখ মেলে দেখে কেউ
নেই।
সেইদিন তার যৌবন-বনে ফুল ফুট্ল। ফুল তুলতে এল অনেক মেয়ে, এল
না শুধু যে ফোটাল সে।
* * *
এই
সেদিনের কথা, চিন্তামণির ঘাটে সে যখন মোট বইত, তখন তার মাথা
থেকে ঝাঁকাটি নেবার জন্যে মুটেরেদের মধ্যে কি ঝগ্ড়া। শেষে সাব্যস্ত
হল, পালা ক'রে সবাই ওর মাথা থেকে ঝাঁকা নেবে। এই দলের মধ্যে
পরান ছিল সবচেয়ে রসিক। তকে রঙ্গন কিছুতেই পেরে উঠ্ত না। ঝাঁকাটি
নেবার সময় কেমন অদ্ভুত উপায়ে যে সে রঙ্গনের গালে বা দাড়িতে ঠোঁটে
চুমা দিত যে রঙ্গনও কিছু ধর্তে পার্ত না-যেন ঠেকে গেল। রাগ কর্বার
উপায় নেই তার ওপর লোকটার হাসি, কথাবার্ত্তা এমন সুন্দর যে তাকে
ভালও লাগে। হাতের ছ'গাছা রূপার চুড়ি ত সে-ই দিয়েছিল-'
এমনি ক'রে
রঙ্গন-তার কাজের অবসরে সুখের খাঁচাটিতে ব'সে বাইরের স্বপ্ন দেখে।
শেষে একদিন সে মনোহরকে বল্ল-ঘর্কে বসে বসে বাত ধোত্বে নেগেচে,
আমি কাজকে যাবো।
মনোহর
হেসে বল্ল, তুই ত যাবি বাত সারাতে কিন্তুক লোকে বল্বে মনোহর
খেতে দেয় নি-'
রঙ্গন
বল্ল, উ পোড়া লোকের কতা কে শুনে? আমরা কুলি মজুর জাত-ছ' বচ্ছর
বয়েস ইস্তক ত মাটি থেকে খুঁটে খাচ্চি? আমাদের আবার বল্বে কি?
সে আবার
চিন্তামণি ঘাটে তার পুরাতন ঠাঁইটুকু দখল করবার জন্যে দাঁড়াল,
পেতেও বিলম্ব হল না।
মাস তিন চার পর সে কাজ ছেড়ে আবার চুপ ক'রে ঘরে এসে বস্ল। শরীরটা
কেমন ভাল থাকে না, কিসের একটা অশান্তি তার মনকে সব সময় ঘিরে
থাকে, মাঝে মাঝে গভীর চিন্তায় ডুবে যায়। তার মনে অনবরত কে যেন
প্রশ্ন করে-কার ছেলে? পরান? শ্রীদাম? সাধু? দাসু? তিনকড়ি? না
মনোহর? কার?-
এই প্রশ্ন
তার শরীরে যেন জ্বর এনে দেয়। যখন অসহ্য লাগে ব'লে ওঠে-কার আবার,
আমার-'
উত্তরে
সে শুধু একটু বিদ্রূপ মেশান হাসি শুন্তে পায়। সে বিদ্রূপ, সে
হাসি তার কানে যেন লেগেই রইল!
দিন যায়। মনোহর রঙ্গনের এ পরিবর্ত্তন লক্ষ্য কর্ল কিন্তু বিশেষ
উদ্বেগ প্রকাশ কর্ল না, বরং যেন সে একটু বেশী খুশী হয়ে উঠ্ল।
তারপর একদিন সন্ধ্যা বেলা সে এক ছড়া 'বিছা গোট্' এনে রঙ্গনের
কোমরে পরিয়ে দিয়ে বল্ল-রঙ্গন, তুকে আর যেত গয়না দে'ছিনু, তা
সব ভালবেসেই দিচ্ছি, আজ ইটা দিনু তুই মা হয়েচিস্ বলে।
রঙ্গনের
মনের আগুন এবার দপ ক'রে জ্বলে উঠ্ল। ঝঙ্কার দিয়ে বল্ল-কে তুকে
বল্লে?
মনোহর
হেসে বল্ল-আমি জানি।
কি আশ্চর্য্য!
যে কথাটাকে প্রাণপণে সে অস্বীকার করতে চায়, দেবতার কাছেও যে
কথা সে স্বীকার করে নি-মানুষ ত দূরের কথা, সেই কথাটি কেমন ক'রে
বাইরে প্রকাশ পেল?
রঙ্গন
কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নীচু ক'রে বসে রইল।
মনোহর
বল্লে-এখন থেকে তুকে একটু সাম্লে চল্তে হবে। তুকে আর রান্না
বাড়া, হেঁসেলের কাজ কোত্তে দুবোনি, আগুনতাত্ তুর এখন সইবে নি।
নফ্রার মাকে চার্টেকা মাইনে দে রাঁধ্তে কবুল করেচি, সে কাল থেকে
আস্বে।
রঙ্গনের মনে যে আগুন জ্বলে উঠেছিল, মনোহরের কথায় তার তেজ একেবারে
কমে এল। অসহায় ভাবে মাথা নেড়ে সে জানাল, এতে তার আপত্তি কর্বার
কিছু নেই।
কিন্তু সেইদিন থেকে মনোহরকে সে যেন সহ্য কর্তে পার্ত না। তার
আদর সোগাহ তাকে যেন চাবুক মার্ত, তার চুম্বন, আলিঙ্গনে সে মরণ-যন্ত্রণা
বোধ কর্তে-অথচ এর কারণ সে বুঝতে পারে না; মনোহরকে তার ভয় ক'রে,
সময় সময় তার কাছে সব কথা স্বীকার করবার জন্যে তার মন অস্থির
হয়ে ওঠে কিন্তু পারে না। তবু দিন যায়, মাস যায় তারপর সময় হয়ে
এল-
* * *
বেলা
তখন প্রায় দেড়্টা হবে। পিঠের ওপর চুল এলিয়ে দিয়ে রঙ্গন দাওয়ায়
বসে তার খোঁকার কাঁথার ওপর নানা রং-এর পাড়ের সুতার ফুল তুলছিল।
ঘরের ভিতর খোঁকা বুকে উপুড় হয়ে শুয়ে তার সর্ব্ব শরীর 'নালে'
ভাসিয়ে বা-বাঃ মা-মাঃ প্রভৃতি নানা সম্বন্ধ বাচক শব্দ উচ্চারণ
ক'রে মনোহরকে চমৎকৃত ক'রে দিচ্ছিল। মনোহরও তাকে বুকে চেপে বাবা
আমার, মাণিক আমার আমার সোনা প্রভৃতি বলে শিশুকে বুঝাতে চেষ্টা
কর্ছিল যে সে তাকে খুব ভালবাসে।
রোজই এই দৃশ্য রঙ্গন দেখে, রোজই মনোহরের স্নেহের কথা শোনে কিন্তু
আজ তার অসহ্য লাগ্ল! কাঁথাটা এক পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছুটে ঘরে
এসে সে দাঁড়াল। তার সে চেহারা দেখে ভয় পেয়ে মনোহর খোঁকাকে বিছানায়
শুইয়ে উঠে বসে জিগ্গেস কর্ল-কি হয়েচেরে রঙ্গন? অমন কচ্চিস কেন?
আজ, আমার কাচ্কে একটুক্ বস।
রঙ্গন হাঁফাতে হাঁফাতে আগুনভরা চোখে তীব্র সুরে বল্লে-কে তুকে
বল্লে উ তুর্ ছেলে?
মনোহর
কিছুক্ষণ অবাক হয়ে বসে রইল তারপর হঠাৎ চীৎকার ক'রে হেসে বল্ল-কে
আবার বল্বে? ই কথা আবার কেউ বলে দেয় নাকি?
একথা কানে
না তুলে তেমনি সুরে রঙ্গন বল্ল-উ তুর্ লয়-তুর লয়-
কিছু বুঝ্তে না পেরে মনোহর বল্ল-তবে?
রঙ্গন কেঁদে উঠে বল্ল-আমি জানি না-
তার গলার
স্বর বন্ধ হয়ে এল, তারপর সে মনোহরের পায়ের ওপর পড়ে মাথা ঠুকে
ঠুকে বল্তে লাগল-আমাকে মেরে ফেল্, কেটে কুটে থেঁত ক'রে ফেল্।
আমি-'
মনোহরের মনের সংশয় কেটে গেল। সে রঙ্গনের মাথায় হাত বুলিয়ে বল্ল
ই কথা? তুই জানিস্ না। কিন্তুক আমি বল্চি উ আমার। আর তুকে মেরে
কেটে কি হবে রঙ্গন? ই কতা সত্যি যদি না-ও হয় তবু তুই যে আমাকে
ভাঁড়ালি সে-কতা কি কুন্দিন তুই ভুল্তে পারবি?-ই যে মারের বাড়া
মার রঙ্গন-লে ধর্ ছেলেটা কান্তে লেগেচে, আমি কাজে যাই-
* * *
মনোহরের
মনের কোন বিকার দেখা গেল না। সমস্ত জেনে এই দারুণ সংশয়ের মধ্যে
সে দিব্য আরামে দিন কাটায়। খোঁকাকে তেমনি করেই আদর করে, রঙ্গনকে
ভালবাসে।
কিন্তু
রঙ্গনের মনের আগুন নিব্লেও শান্তি সে পেল না। যখন সে একা থাকে
ছেলেটিকে কোলে নিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন কিছু আবিষ্কার
সে কর্তে চায় কিন্তু পারে না। ও যেন তার ব্যাথার প্রদীপ। চিরদিনের
জন্যে কে যেন তার বুকে জ্বেলে দিয়েছে-ও নিব্লেও বুঝি এ বেদনার
শান্তি হবে না।
(
‘কল্লোল’ পত্রিকা, আশ্বিন, ১৩৩২ )