প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

উপহাস
হেমচন্দ্র বাগচী

       [ লেখক পরিচিতি : কবি ও শিশু সাহিত্যিক হেমচন্দ্র ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে (১৩১১ বঃ) নদীয়া জেলার গোকুলনগরের বেগে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২১ সালে কৃষ্ণনগরে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কৃষ্ণনগর কলেজ থেকেই আই.এস.সি পাশ করে কিছুদিন বি.এস.সি পড়েছিলেন। পরে বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বি.এ পাশ করে সংস্কৃত ও ইংরেজিতে এম.এ এবং বি.টি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ভবানীপুর পদ্মপুকুর ইন্সটিটিউশনে ১৯৩১ থেকে ১৯৪১ সাল অবধি অধ্যাপনা করেছেন। রাজশাহী কলেজেও অধ্যাপনা করেছেন কিছুদিন। পরে মানসিক রোগগ্রস্ত হয়ে কৃষ্ণনগরেই ফিরে আসেন। হেমচন্দ্র ছিলেন ‘বাগচি এণ্ড সন্স’ নামক প্রকাশনা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা।
     রচিত গ্রন্থ : কাব্য – দীপান্বিতা, তীর্থপথে, মানস বিরহ; উপন্যাস – অনির্বাণ; শিশু সাহিত্য – তপনকুমারের অভিযান, কবিকিশোর, মায়া প্রদীপ। সম্পাদিত গ্রন্থ : শতনরী। ‘বৈশ্বানর’ (জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৮) পত্রিকারও সম্পাদক ছিলেন তিনি।]

দীপক সেনগুপ্ত।

      কলকাতা সহরের শীতের কুয়াশা - কুয়াশা তাকে বলা চলে না, কয়লার ধোঁয়ার সঙ্গে শীতের বাতাস মিশে গিয়ে একটা জমাট বাষ্পস্তর। সেই বাষ্পস্তর ভেদ করে এসেছে সকালের রৌদ্র, কলতলা এবং চৌবাচ্চার পাশে এসে পড়েছে কোনো রকমে - একটা চতুষ্কোণ পরিমাণ স্থানকে একটু চিত্রিত করে তুলেছে পিঙ্গল শোকাচ্ছন্ন হাসিতে। সেই স্থান টুকুতে বসে তোলা উনুন পরিষ্কার করতে করতে প্রসন্নময়ী তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে ডাকছিলেন, "নিরঞ্জন, এখনো উঠলি নে রে, বাজার যাবার জন্যে এত খোসামুদী, আপিসের বেলা হলে ত তোর কিছু আসবে যাবে না-তুই ত খেয়ে দেয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোবি, না হয়, একখানা কেতাব নিয়ে বসবি - বলি ও নিরঞ্জন আটটা বেজে গেল যে, উঠবি কখন আর ?"
শেষ দিকটায় প্রসন্নময়ীর কণ্ঠস্বর সানুনাসিক, নিরঞ্জন যে উঠবে না এই নিশ্চিত নৈরাশ্যে তিনি অধীর হয়ে উঠেছেন।
যাকে লক্ষ্য করে কথাগুলো তীরের মত নিক্ষেপ করা হচ্ছিল, সেই নিরঞ্জন তখনো একখানা চাদর আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোচ্ছে। তখনো হয় ত আটটা বাজে নি, কিন্তু প্রসন্নময়ীর এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে। যাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে হবে, একটু আগে থেকে তাকে তাগিদ দেওয়া দরকার - এই জ্ঞান এবং আরও অনেক জ্ঞান প্রসন্নময়ীর আছে বলেই সংসার এখনো তাঁকে খাতির করে চলে।

        উনুন পরিষ্কার করা শেষ করে প্রসন্নময়ী একবার উপরের বারান্দার দিকে তাকিয়ে বললেন - 'তাই ত বলি, এমন না হলে আর বৌ বলেছে কেন? আজকাল ত সব বিবি বৌ? তাই ত বলি, ছোট বৌ আমাদের লক্ষী মেয়ে।'
'কি বললেন দিদি, আমাকে বলছেন ত, না, আর কাউকে?' -একটা মধুর তীব্র কণ্ঠস্বর বারান্দার পাশ দিয়ে যেন এক ঝলক রৌদ্ররশ্মির মতই এসে কলতলায় পড়ল।

       'হ্যাঁ, তোমাকেই বলছি ভাই, বলছি লক্ষী মেয়ে তুমি - সেই কোন ভোরে উঠেছ, আমারও আগে - এমন না হলে আর বৌ!'
      'আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক দিদি, সকালে উঠেই শুনলাম নিজের প্রশংসা - আমার আজ সৌভাগ্যের সীমা নেই দেখছি।"

      'সৌভাগ্য এখন থাক ভাই - তোমার আদরের দেওরটিকে যদি উঠিয়ে দিতে পার, তবেই বাজার হবে, নৈলে কর্ত্তাদের আজ আপিস যাওয়া বন্ধ।'

      'ওমা, সে কি? নিরঞ্জন এখনো ওঠে নি?' - বলে ছোট-বৌ বোধ হয বারান্দা দিয়ে পাশের ছোট একটি ঘরের দিকে চলে গেলেন। নিরঞ্জন তখন চাদর জড়িয়ে চৌকীর উপর উঠে বসেছে। ঘুম যে তার ভাল হয় নি এ কথা তার মুখ দেখলেই বোঝা যায়।

      'এই যে উঠে বসেছ দেখছি, এত ডাকাডাকি’ - বলে ছোট-বৌ ঘরের এসে দাঁড়ালেন। 'সুপ্রভাত বৌদি ঠাকুরাণী, দেরী করে উঠেছি বলেই না সকালেই দর্শন পেলাম। এই অকর্ম্মা লোকটাকে দেখছি আপনারা কিছুতেই রেহাই দেবেন না!'
‘আচ্ছা, রাখ ভাই তোমার বক্তৃতা - এখন বাজারে যাবে এস ত।’

      হাস্যমুখে নিরঞ্জন বলল, "তাই বলুন, আমি বলি ছোট-বৌদির অবির্ভাব - একি বৃথা হয়? একটা না একটা কাজ আমাকে করতেই হবে, কি বলেন?"

      কৃত্রিম দৃঢ় কণ্ঠে ছোট-বৌদি বললেন – ‘একশ বার। কাজ না করলে চলে? এই যে এত বড় জগৎ-এ ত কাজ নিয়েই।’

      হাত জোড় করে নিরঞ্জন বলল, 'দোহাই বৌদি, আপনার দর্শন রাখুন। আমি বাজারে যাচ্ছি এখুনি - কি কি আনতে হবে বলুন।'

      একরাশ আপিসের কাগজ-পত্র নিয়ে ছোট বধূর স্বামী মহিমারঞ্জন টেবিলের উপরে ঝুঁকে পড়ছেন। ছোট-বৌ ঘরে আসতেই কাগজ-পত্র থেকে মুখ তুলে তিনি বললেন, 'কি গো, ছোট বাবু গেলেন বাজারে? কাব্য করেই ছোক্‌রা মাটি হয়ে গেল-'
     'হ্যাঁ, গিয়েছে! হাঁগো, কাব্য করে কি কেউ মাটি হয়?' - ছোট-বৌ সকরুণ প্রশ্ন করলেন স্বামীকে।

       'মাটি হয় না? দিনরাত পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে - মাটি হতে আর বাকি কি?'
     'তা ঘুমোক, বয়স আর কতই বা? তোমরা কি সবাই ও-বয়সে চাকরী করতে না কি?'

      না করি, চাকরীর চেষ্টাও ত ছিল, - ওর ত তাও নেই। তোমার আবার বাড়াবাড়ি আছে কি না। তুমি ওকে প্রশ্রয় দিচ্ছ মনে হচ্ছে ছোট-বৌ। কেবল ঘরে বসে বসে কবিতা আওড়ালেই কি চলবে? যা দিনকাল পড়েছে-'
জানালাটা খুলে দিয়ে ছোট-বৌ বিছানা তুলতে তুলতে বললেন, 'এই রে এইবার আসল কথা আরম্ভ করলে দেখছি - এক্ষুনি হয়ত টাকার কথা তুলবে, - যা বোঝে করুক বাপু, সময় যখন আসবে, আপনিই টাকার দিকে ওর মন যাবে।'
-তারপর যেন আপন মনেই তিনি বলতে লাগলেন, যেন সম্মুখে কেউ নেই, 'টাকার দিকে মন গেলে মানুষ কি আর মানুষ থাকে? সে অমানুষ হয়ে যায়।'

      মহিমারঞ্জন স্ত্রীর অন্যমনষ্ক কথার সুর ধরতে পেরে বললেন, 'তাই বটে গো, তাই বটে - আমরা সবাই অমানুষ, কি বল?'

      তোষকটা উলটে ফেলে বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে ছোট-বৌ বললেন, ‘না আমি সে কথা বলছি নে, কেমন যেন একটা পরিবর্ত্তন হয়। কাব্য ত তুমিও করতে একদিন, মনে পড়ে না কি?' - জীবনের সেই বাসন্তী দিনগুলো ছোটবধূর মনের মধ্যে ছবির মত ভেসে উঠল।

     একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে মহিমারঞ্জন বললেন, 'আর কাব্য ছোট-বৌ, জগৎটা যে কত কঠিন, তা তুমি ঘরের কোণে থেকে বুঝতে পারছ না।'

     প্রভাতের আলোর মতই একটা স্নিগ্ধ স্বচ্ছ হাসি ছোট-বৌ-এর মুখের উপর উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। বললেন, 'বুঝতে চাইনে আমি, এই বেশ আছি।'

     মহিমারঞ্জন আপিসের কাজগগুলো লাল ফিতে দিয়ে বাঁধতে বাঁধতে বললেন, "তুমি ত বুঝতে চাও না, বুঝছে বড় বৌ, যেদিন থেকে সে বুঝেছে, সেদিন থেকে তার মুখে কথা নেই - দেখেছ কি?'
'কেন, বড়দির মুখে ত বেশ কথা আছে, মাঝে মাঝে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে হয় কথার চোটে, তুমি বলছ কথা নেই - এ আবার কি?'

     একটা কাংস্যকণ্ঠের ঝঙ্কার শোনা গেল বাইরে, "ঠাকুরপো, নীচে দুজন ভদ্রলোক এসে বসে রয়েছেন, কতক্ষণ থেকে ডাকাডাকি করছি, তা তোমাদের গল্প চলেছে ত চলেইছে-"
     'এই যে, যাই বৌদি' - বলে মহিমারঞ্জন তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে দিয়ে স্ত্রীর দিকে একটা সকোপ কটাক্ষ ছেনে নীচে চলে গেলেন।

       'কি বাজার করে এনেছ, ছাই বাজার-' বলে তরকারি আনবার থলিটা টান মেরে কলতলার দিকে ফেলে দিয়ে বড় বৌ দুম দুম করে রান্নাঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। ছড়ানো তরকারিগুলো কুড়িয়ে নিয়ে প্রসন্নময়ী আষাঢ়ের মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মত মুখ করে বলতে লাগলেন, 'রাগটা তোমাদের বড় সহজেই হয় বড়-বৌ - কেন, বাজার কি এত খারাপ হয়েছে বাপু যে, টান মেরে ফেলে দিতে হবে আঁস্তাকুড়ের দিকে, অনাছিষ্টি কাণ্ড বাপু তোমাদের।' আরও কত কথা তিনি বলে যেতে লাগলেন। তাঁর সুদীর্ঘ বৈধব্যজীবন পিত্রালয়ে কাটিয়ে দিতে দিতে এমন কত দৃশ্য তিনি দেখেছেন, কত দারিদ্র্য, কত শোক - তারই একটা সবিস্তার বর্ণনা দিয়ে যেতে লাগলেন। অবশেষে স্নিগ্ধ কণ্ঠে তিনি ডাকলেন, "ছোট বৌ, তরকারিগুলো কুটে ফেল ত ভাই, বাবুদের আপিস যে আছে, একথা কত সহজে বড়-বৌ ভুলে গেল।"
নিঃশব্দ পদে ছোট-বৌ এসে তরকারি কুটতে আরম্ভ করলেন।

       বড়-বৌ কিন্তু থেমে থাকবার পাত্র নন; সমান সুরে রান্নাঘরের মধ্য থেকে বলে যেতে লাগলেন, 'ভুলে আমি যাই, সহজেই ভুলি, বুঝলে ঠাকুরঝি, না ভুললে যেমন চলছে, তেমন চলত না, বুঝলে?'

      শেষদিককার কথাগুলোর মধ্যে ঝাঁঝ কিছু বেশী। তারই উত্তাপ এসে লাগল প্রসন্নময়ীর মনে; তুবড়িতে আগুন দিলে যেমন হয়, তাই হল - বাক্যের অগ্নিস্রোত বেরিয়ে আসতে লাগল তাঁর মুখ দিয়ে, থামায় কার সাধ্য।
মহিমারঞ্জন এলেন, বড় ভাই মনোরঞ্জন এলেন। আপিসের দোহাই দিয়ে, বাইরের দুজন ভদ্রলোকের দোহাই দিয়ে কোনরকমে সে বেলার মত বিসম্বাদের অন্ত হল।

      কিন্তু বাজার যে করেছে, তার দেখা নেই। সে বাজরটি নামিয়ে দিয়েই ঘরের মধ্যে গিয়ে দরোজায় খিল দিয়ে আত্মস্থ হবার চেষ্টা করছে। জানালার কাছে বসে প্রকাণ্ড একখানা বই নিয়ে সে অতি দ্রুত তার পাতা উল্‌টে যাচ্ছে, বাইরের কলরব যেন কানে না আসে হে ভগবান - এই ধরণের প্রার্থনা তার মনের মধ্যে। কিন্তু দরোজারও ছিদ্রপথ আছে, তা ছাড়া, প্রসন্নময়ী এবং বড়-বৌ - দুজনের কণ্ঠস্বর-ই সমান মাত্রায় প্রতিযোগিতা করে। অতএব ঘরে খিল বন্ধ করেও নিরঞ্জনের উদ্ধার নেই।

     বাড়ীতে কোন একটা গোলমাল হলেই তার সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে। তার দেহের সমস্ত শিরা-উপশিরা দ্রুততালে স্পন্দিত হতে থাকে - স্নায়ুমণ্ডলীর মধ্যে একটা ভায়ার্ত্ত কম্পন সুরু হয়। এত দুর্ব্বল নিরঞ্জন। আজ তার মনে হচ্ছে; সে সংসারের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। এত দুর্ব্বল ও ভীরু মন নিয়ে এই নিত্য কোলাহলময়ী ধরণীর বুকের উপরে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাই শক্ত। ঘুর্ণ্যমান এই পৃথিবী, কুটিল তার গতিবিধি - সরীসৃপ আর মানুষে যেখানে তফাৎ বেশী কিছু নেই, সেখানে সে কি করে সহজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে?

      ধীরে ধীরে গোলমাল যখন থামল, তখন বই-এর পাতায় মন বসাবার দুঃসাধ্য চেষ্টা করছে নিরঞ্জন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে দেখল, বারোটা বেজে গেছে। এমন সময়ে দরোজার বাইরে মৃদু করাঘাত হতেই সে উৎকর্ণ হয়ে রইল। স্নিগ্ধ কণ্ঠে কে ডাকছে, "ঠাকুরপো, বেলা হয়ে গেছে, স্নান করে নাও।'"

     'এই যে যাই বৌদিদি ঠাক্‌রুণ’, - বলে নিরঞ্জন দরোজা খুলে দিল। এই একটি স্থানেই তার আশ্রয়, তার নির্ভরতা।
'কি করছিলে ঘরের মধ্যে খিল দিয়ে?' - বলে ছোটবধূ হাসতে লাগলেন।

      নিরঞ্জন অতি সপ্রতিভ ভবে বলল, 'এই যে বইখানা পড়ছিলাম। যা গোলমাল আপনাদের বাড়ীতে -!'
     'নাও এখন বই থাক, এস স্নান করবে।'
     'আর একটু বেলা হলে স্নান করা যাবে। আমার ত আপিস নেই বৌদি!'

      ছোটবধূ কৃত্রিম ভ্রূভঙ্গী করে বললেন, 'আপিস নেই বলে এই যে বেলা করে খাওয়া-দাওয়া - এতে শরীর খারাপ হয় না ভাবছ?' - তারপর একটু হেসে বললেন, 'আপিস ত একদিন হবে, তার জন্যে তৈরী হয়ে নাও এখন থেকে।'
নিরঞ্জন নিরুপায় হয়ে বই রেখে স্নানের জন্যে উঠে পড়ল। ছোট-বৌদির কথা এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য তার নেই। বই রাখতে রাখতে সে বলল, 'আপনার কথা, কথা নয় ত আদেশ - না শুনলে রক্ষে নেই।'

      সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে হঠাৎ বড় বধূর সঙ্গে দেখা। মুখের সেই কুটিল চক্ররেখা, সর্ব্বদা তাতে যেন একটা অসন্তোষের ভাব আঁকা রয়েছে। এই সংসরের কিছুই যেন তাঁর ভাল লাগে না - এই রকম একটা ভাব। নিরঞ্জনের সঙ্গে বড় একটা কথাবর্ত্তা বলেন না, আজ হঠৎ মুখোমুখি দেখা হতেই বললেন, 'কি গো, ছোটবাবু যে, এতক্ষণে নাইবার সময হল?'-'কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে এমন একটা ঘৃণা আর তাচ্ছিল্যের রেখা ফুটে উঠল মুখে যে, তা নিরঞ্জনের মত উদাসীনের দৃষ্টিও এড়িয়ে গেল না। তাই, যথাসম্ভব সহজে উত্তর দেবার চেষ্টা করে নিরঞ্জন বলল, 'হ্যাঁ হল বৌদি! না হলে কি ছোট-বৌদি ছাড়তেন সহজে?'

      মুখখানি অকস্মাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল। ভ্রূকুঞ্চিত করে সংক্ষেপে, 'হ্যাঁ', তা ত হবেই বলে বড় বধূ আর অপেক্ষা মাত্র না করে তর-তর করে উপরে উঠে গেলেন।

      নীচে রান্নাঘরে প্রসন্নময়ীর ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে, 'এদিকে এঁদের ত হল, ছোটবাবুর দেখা নেই এখনো। আমার কপালে ভাল কাজ কিছু কি আর আছে যা হবে? ভেবেছিলাম, আজ একবার কালীঘাট যাব রান্নাবান্না খাওয়া- দাওয়ার পাট শেষ হলে - তা ঐ হতভাগা কুড়ের বেহদ্দ, ওর জন্যে আমার আর কিছু হবার জো নেই।'

     নিরঞ্জন হাসিমুখে রান্নাঘরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলল, 'এই যে এসেছি দিদি - একটু তেলটেল যা হয় কিছু দাও।'
প্রসন্নময়ীর কণ্ঠস্বর আরও তীব্র হয়ে উঠল, 'হতভাগা বাঁদর, তোর কি লজ্জা হবে না কোনকালে!'
   'কিসের লজ্জা দিদি?'- নিরঞ্জন হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল।

   'হাসছিস কি দাঁত বের করে? শেষকালে বিপদে যখন পড়বি, তখন আমার কথা মনে করিস।'
   'কিসের বিপদ দিদি?' নিরঞ্জনের তখনো হাসিমুখ। প্রসন্নময়ীর কি যেন মনে হল-

    তাঁর মনে হল, মার মৃত্যুর কথা, ছোট ছেলেটিকে এই বিধবা কন্যার হাতে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেইদিন থেকে আজ পর্য্যন্ত ওর ঐ একই ভাব, সত্যই ত, বিপদের আর ও কি জানে! এই কথা মনে হতেই তিনি বললেন, "না কিছু না, যা, স্নান সেরে আয় - তোকে খেতে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হব।'

     সন্ধ্যার একটু আগে মনোরঞ্জন বইরের ঘরে এসে বসলেন। মনটা তাঁর ভাল নেই। বড়-বৌকে তিনি ভালরকমই জানেন। একটি বিষাক্ত হাওয়ার ঘুর্ণী সৃষ্টি করবার ক্ষমতা তাঁর আছে। মনোরঞ্জন সহস্র চেষ্টাতেও তাকে আর প্রতিরোধ করতে পারেন না। মহিমা, নিরো - এদের ত তিনিও মানুষ করেছেন। সেদিনকার সেই সংসারের করুণ ছবিটি তাঁর মনে পড়ছে। শুধু বিধবা প্রসন্ন আর তিনি নিজে - কত দুঃখ, কত ঝড় - এই দুই ভাই বোনের মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে, সেই দিনগুলির একটা সংহত রূপ তাঁর মনের মধ্যে উদিত হয়ে চোখ দুটিকে অশ্রু-সজল করে তুলল। তারপরে এসেছে বড়-বৌ, সংসারের গতি ধীরে ধীরে অন্যদিকে ফিরছে, তারপরে পরিবর্ত্তনের পর পরিবর্ত্তন - বাইরের ঘরে বসে অস্পষ্ট সন্ধ্যালোকে মনোরঞ্জন স্থির হয়ে বসে বসে ভাবছেন।

      এমন সময় বাইরে জুতোর শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। মহিমারঞ্জন আপিস থেকে ফিরছেন। মনোরঞ্জন বাইরের ঘর থেকে বললেন, 'কে মহিমা? জামাজুতো ছেড়ে একবার বাইরের ঘরে আসবে?'

      মনোরঞ্জনের ভাবনা সূত্রকে ছিন্ন করে মহিমা এসে ঘরের মধ্যে দাঁড়ালেন। খুব সপ্তর্পণে চৌকীর একপ্রান্ত ঝেড়ে দিয়ে মনোরঞ্জন বললেন, 'বস এইখানে, কয়েকটা কথা আছে তোমার সঙ্গে।'
     মহিমা সেখানে বসে পড়ে বললেন, 'বলুন।'

     'বলছিলাম নিরোর কথা, ওত একেবারে অপদার্থ হয়ে গেল, ওর সম্বন্ধে কিছু ভাবছ-টাবছ কি? কেবল দিনরাত বই-এর মধ্যে ডুবে আছে, সেটা ত আমাদের দরিদ্র সংসারের পক্ষে মোটেই ভাল নয় - কি বল?'

     মহিমারঞ্জন একটু পরে উত্তর দিলেন, 'তাইত, আমিও ত ওকে সে কথা প্রায়ই বলে থাকি। বয়সও ত বেশ হয়েছে, চাকরী-বাকরীর চেষ্টা এখন থেকে না করলে আর কবেই বা করবে?'

     মনোরঞ্জন হাসতে হাসতে বললেন, 'দেখ মহিমা, চাকরী-বাকরীর প্রয়োজন যার হয় না, সে ওদিকে বড় একটা যেতে চায় না। আমি নিরোর বিয়ে দিতে চাই, তোমার এ সম্বন্ধে কি মতামত?'

    মহিমারঞ্জন গম্ভীর মুখে বললেন, "আরও কিছুদিন যাক, বিয়ের বয়েস হতে এখনো কিছু দেরী আছে বলে মনে হয় আমার।'

    মনোরঞ্জন বললেন, 'দেরী আর কি? এখন বিয়ে না দিলে, এর পরে আর ও বিয়ে করতে চাইবে মনে কর?'
'কেন চাইবে না?'

    'সে কথা তোমাকেও বুঝিয়ে দিতে হবে? কি দিনকাল পড়েছে বুঝতে পারছ না কি? যেদিন ও সংসারের আসল রূপটা বুঝতে পারবে, সেদিন ও বুঝবে যে দুনিয়াটা শুধু কাব্য নয়, দুনিয়া সোজাসুজি গোলকার না হয়ে উত্তর-দক্ষিণে কিঞ্চিৎ চাপা-সে দিন সংসার ওর কাছে মহা ভার বলে মনে হবে।' বলে মনোরঞ্জন হেসে উঠলেন। পরক্ষণেই তিনি একটু গম্ভীর ভাবে বললেন, তৎপূর্ব্বেই আমি ওর বিয়ে দিতে চাই, বুঝলে মহিমা?'

    'আপনি যদি নিতান্তই বিয়ে দেন, সে আলাদা কথা। কিন্তু নিরোকে একবার জিজ্ঞাসা করবেন। শিক্ষা যেমনই হোক, সে তা পেয়েছে; কাজেই তার নিজের জীবন সম্বন্ধে. সংসার সম্বন্ধে সে নিশ্চয়ই ভাবে, কিন্তু খোলাখুলি ভাবে আমরা কোনদিন তাকে ত এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করি নি। আমার মতে তাকে ডেকে একবার জিজ্ঞাসা করা দরকার।'

    'উত্তম কথা, তাকে এখনই ডেকে নিয়ে এস। আমি এ বিষয়ে একটা মীমাংসা করে ফেলতে চাই-' মনোরঞ্জন আর দেরী করবেন না। নিরঞ্জনের ক্রমবর্দ্ধমান আলস্য এবং ঔদাসীন্য যেন তাঁর সহ্যসীমার বাইরে চলে গেছে।

    যাকে প্রয়োজন, তাকে ডেকে আনার দরকার হল না। দেখা গেল, নিরঞ্জন সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছে। দেখতে পেয়েই মহিমা ডাকলেন, "নিরো, বড়দা ডাকছেন, তুমি একবার বাইরের ঘরে এস।'

    নিরঞ্জন সচকিত হয়ে বাইরের ঘরে এসে দাঁড়াল। মনোরঞ্জন বললেন, "বস নিরো।'
     ঘরের মধ্যে আলো নেই। চৌকীর উপরে দুজনে বসে আছেন। নিরঞ্জন সেই প্রতীক্ষমান স্তব্ধতার মধ্যে নিঃশব্দে চৌকীতে এসে বসল। তার মনে হতে লাগল বড়দা হঠাৎ তাকে এমন অসময়ে ডাকলেন কেন? কোন অবাঞ্ছনীয় ঘটনা ঘটবে না ত? সন্ধ্যার অস্পষ্ট অন্ধকারের মধ্যে নিরঞ্জনের প্রতীক্ষা ক্রমশ শ্বাসরোধকর হয়ে উঠতে লাগল।
     মনোরঞ্জন সেই স্তব্ধতা ভেঙে গম্ভীরভাবে বললেন, 'দেখ নিরো, তুমি যে ভাবে দিন কাটাচ্ছ, তা একেবারেই আমাদের অনভিপ্রেত। কবিদের কাব্য, তাদের সমালোচনা এবং বাংলাসাহিত্য দীর্ঘজীবী হোক, কিন্তু সেই সব সাহিত্যের ভূত যদি আমার ঘাড়ে চেপে বসে আমাকে আমার সহজ কর্ত্তব্যগুলো করতে না দেয়, তা হলে আমি তাঁদের দূর থেকে প্রণাম করে বিদায় দিই।'

      মহিমারঞ্জন বললেন, 'কথা খুবই সত্যি। কিন্তু এ-ক্ষেত্রে সাহিত্যের চেয়ে নিরঞ্জনের উদাসীনতাই বেশী দায়ী।'
নিরঞ্জন খুব ধীরভাবে বলল, 'বড়দা, আমি কিছুই বুঝতে পারছি নে, আপনি আমাকে কি করতে হবে স্পষ্ট করে বলুন।'
মনোরঞ্জন তীব্রকণ্ঠে বললেন, 'না বুঝবার মত কথা আমি বলিনি নিরো। শুধু এককথাই আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, তুমি এখন আর নাবালক নও, বয়সে তোমাকে সাবালক করে তুলছে, আরও স্পষ্ট কথা এই যে, স্বাবলম্বন কথাটি শুধু পুঁথির পাতায় আবদ্ধ না রেখে তাকে কর্ম্মক্ষেত্রে সফল করে তোলা তোমার মত শিক্ষিত লোকের খুবই উচিৎ।'
বড়দার কণ্ঠস্বরের তীব্রতায় নিরঞ্জনের হৃৎকম্পন যেন বেড়ে গেল। এমন স্পষ্ট করে কেউ কোনদিন তাকে এ-কথা বলেনি। তথাপি ক্ষীণকণ্ঠে নিরঞ্জন বলল, 'বড়দা, আমি তা জানি, কিন্তু দেশের বর্ত্তমান অবস্থায় কি করি বলতে পারেন? আমি যে মোটেই তা ভাবি না, এমন নয়। কিন্তু বিশেষ পথ ত আমার চোখে পড়ে না, সবই গতানুগতিক বলে মনে হয়।'
মনোরঞ্জন সমন ভাবে বলে চললেন, 'আমি তোমার সঙ্গে বেকার-সমস্যার আলোচনা করতে বসি নি। অতি সহজ কথা এই যে, আমার কষ্টে উপার্জ্জিত বহু অর্থ তোমাকে শিক্ষিত করবার জন্যে ব্যায় করেছি। সে দিক দিয়ে তুমি আমার কাছে ঋণী - এই কথা মনে করে তুমি তোমার কর্ত্তব্য পালন কর।'

      কথাগুলি সংক্ষিপ্ত, সারবান এবং মর্ম্মস্পর্শী। কিন্তু কর্ত্তব্য-পালন যে কি ভাবে করতে পারা যায়, এ উপদেশ ত কেউ দেয় না - নিরঞ্জন ভাবতে লাগল, কিন্তু তার মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বার হল না। মনোরঞ্জন আর বেশী কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মহিমা নিরঞ্জনের স্তব্ধ মূর্ত্তির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তাকে বললেন, "যাও, যেখানে যাচ্ছিলে যাও, দাঁড়িয়ে থেকে কি হবে?'- বলে তিনিও ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

     সেই রাত্রে নিরঞ্জন বহুক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে বসে বসে ভাবতে লাগল। তার মনে হল সে অপরাধী। এতদিন সে যে ভাবে জগৎ-টাকে দেখত, তার সেই দেখার মধ্যে কোথায় যেন ফাঁকি ছিল। আজ তার সেই ফাঁকি ধরা পড়ে গেছে - তাই তার ভাবনার যেন আর অন্ত নেই। তার মনে হল, তার নিজের সমস্যা যেখানে, সেখানে সে বড় একা। দুর্ব্বল, ভীরুহৃদয় নিরঞ্জন রাত্রির দিক্‌চিহ্ণহীন অন্ধকারের মধ্যে ভাবতে লাগল, ছোট বয়স থেকে এ-পর্য্যন্ত আশ্রয়ের অভাব ত তার হয় নি, কিন্তু আজ সেই আশ্রয়ের ভিত্তি যেন টলে উঠছে, আর আশ্রয় তাকে যারা এতদিন দিয়েছে, তারা সেই নির্দ্দেশহীন পথপ্রান্তে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তারা প্রাণ গেলেও বলবে না যে, 'নিরঞ্জন, এই পথ তোমার পথ।'

     একাকীত্বের এই নিবিড় অনুভূতির অসহ্য ভার নিরঞ্জন যেন আর সহ্য করতে পারে না।

     নিজেকে এমন পৃথক করে স্বতন্ত্র করে নিরঞ্জন কোন দিন ভাবে নি। সে ভেবেছিল, তার দিন এমনি চলে যাবে - সংসারের একপাশে কাব্য আর সাহিত্যচর্চ্চা নিয়ে। গতানুগতিক জীবনকে নিরঞ্জন ঘৃণা করে, কিন্তু আজ বড়দার কথায় তার চৈতন্য ফিরে এল, গতানুগতিকতা যেমনই হোক, তার মধ্যে আত্মসম্মান আছে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ আছে; কিন্তু এই চলমান জগতের কোন্‌ প্রান্তে সেই স্বাতন্ত্র্যকে সে লাভ করবে, কি উপায়ে তা সম্ভব - নিরঞ্জন সহস্র চেষ্টাতেও সে পথ আবিষ্কার করতে পারল না।

      এই দিক দিয়ে ভাবতে ভাবতে নিরঞ্জন তার বড়দার সম্বন্ধে একটা গভীর শ্রদ্ধা অন্তরে পোষণ করতে লাগল। তিনি একাকী সংগ্রাম করেছেন, তাঁর সংগ্রাম যে দিন থেকে আরম্ভ হয়েছে, সে দিন তাদের সংসারের বড় দুর্দ্দিন। দুটি ছোট ছোট ভাই আর একটি বিধবা ভগ্নীর ভার নিয়ে তিনি তাঁর জীবন আরম্ভ করেছিলেন। সেই স্বাবলম্বী মানুষ কেমন করে তাঁর চোখের সম্মুখে দেখবেন যে, তাঁরই সহোদের নিশ্চিন্ত আলস্যে কাব্য আর সাহিত্য-চর্চ্চা নিয়ে দিন কাটাচ্ছে!

       রাত্রির অন্ধকার ক্রমশ বেড়ে চলেছে। জানালার বাইরে কলকাতা সহরের ধূমাচ্ছন্ন আকাশে নক্ষত্র দেখা যায় না। বাড়ীতে আর কেউ জেগে নেই। নিরজ্ঞন তার ছোটদার সম্বন্ধে ভাবতে লাগল। ছোটদাও বুঝেছেন জীবন-সংগ্রামের মর্য্যাদা। সংগ্রামই সত্য, তা সে যেমনই হোক। একটি ছোট কীট থেকে আরম্ভ করে জগতের প্রত্যেকটি প্রাণী আত্মপ্রাণরক্ষার জন্য সংগ্রাম করতে লাগল। আর তার নিজের কোন সংগ্রাম নেই, কোনো সমস্যা নেই, এমন কি চিন্তা পর্য্যন্ত নেই! বড়দার কাছে, সংসারের কাছে, অমন কি জগতের কাছে নিরঞ্জন নিজেকে অপরাধী বলে মনে করতে লাগল।
কত রাত হয়ে গেছে, নিরঞ্জনের সে খেয়ালই নেই। একটি বন্দী বিশালকায় অজগরের মত প্রকাণ্ড কলকাতার শহর তখনো গর্জ্জন করছে। এই রক্তচক্ষু দানবীয় শহরটার যেন চোখে ঘুম নেই। নিরঞ্জন আজ যেন দিব্যচক্ষু পেয়েছে, সে যেন স্পষ্টই দেখতে পেল কলকাতা শহরের রাস্তায় রাস্তায় অসংখ্য মানুষ ঘোরাঘুরি করেছে, অন্ধকার সুড়ঙ্গপথের মত রাস্তা - আলো আসে কি না এই রকম অবস্থা; আর সেই স্কল্পান্ধকার পথপ্রান্তে মানুষগুলোর মধ্যে বেধেছে হানাহানি, একে অপরকে হত্যা করতে উদ্যত। হিংসা তাদের ভ্রূকুটির মধ্যে জাজ্জ্বল্যমান - যেন পাতালপুরীর তোরণদ্বার উন্মুক্ত কতকগুলো নরপিশাচ সদ্য নর রক্ত পান করবার জন্যে পৃথিবীতে উঠে এসেছে!

      এই রকম নিদ্রাহীন অবস্থায় কতক্ষণ কাটিয়ে নিরঞ্জন ঘরের মধ্যে পায়চারি করে বেড়াতে লাগল। হঠাৎ জানালার বাইরে খুট করে একটা শব্দ হল - নিরঞ্জন চেয়ে দেখল ছোট-বৌদি দাঁড়িয়ে আছেন বাইরে। নিরঞ্জনের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ছোট বধূ বললেন, 'ঠাকুরপো তুমি এখনো ঘুমোওনি, ঘরে আলো জ্বলছে দেখে আমি ভাবলাম, দেখি গিয়ে ব্যাপারটা কি? তোমার হয়েছে কি বলতে পার ঠাকুরপো? এমনি করে কি শরীর খারাপ করবে নাকি?' ছোট বধূর কণ্ঠস্বরে ভর্ৎসনার সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে সস্নেহ আশঙ্কা।

      নিরঞ্জনের সমস্ত অভিমান যেন তার বুকের মধ্যে পুঞ্জিত হয়ে উঠল। সে শুধু বলল, 'আমায় একটু একা থাকতে দিন বৌদি - আজ আর নাই ঘুমোলাম।'

     'ঘুমোবে না, আচ্ছা। আমি তা হলে এখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকব বলে দিচ্ছি এই শীতে। যতক্ষণ না শোবে, ততক্ষণ এই দাঁড়িয়ে রইলাম।'

     'আচ্ছা, আমি শুচ্ছি বৌদি, আপনি যান-' বলে নিরঞ্জন তার বিছানায় এসে বসল।
     'শুধু শুধু রাত জেগে শরীর খারাপ কর না' - বলে ছোটবধূ জানালার পাশ থেকে সরে গেলেন।

      নিরঞ্জন আপন মনেই হেসে উঠল। তবু ত তায় একটু আশ্রয় আচ্ছে বলে মনে হয়। সেদিন সে কাগজে দেখছিল একটি ছেলে পটাসিয়াম্‌ সায়েনাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। হতভাগার জন্যে বোধ হয় তিলার্দ্ধ স্নেহও জোটে নি! তবু ত তার ছোট-বৌদি আছেন।

      অর্দ্ধতন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় নিরঞ্জন চিন্তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেল না। তার মনে হতে লাগল, তার ঔদাসীন্যের স্বপক্ষে কোন যুক্তি নেই। নিজের স্বাতন্ত্র্য অর্জ্জন করবার জন্যে যারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তার নাম তাদের দলে নেই। সংসারকে তার আজো জানা হয়নি - ছোট থেকে সে ত অভাব কাকে বলে জানে না। যদি সেই সংসারের জানতেই হয়, তাহলে এই অবস্থায় থাকলে চলবে না। সংসারের আসল রূপটা বুঝে নিয়ে যারা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, অজস্র অভাব পূরণ করে, নিত্য যারা সংগ্রামশীল, তাদের সেই বিপুল উদ্যমের প্রেরণা নিরঞ্জন নিজের মধ্যে অনুভব করতে লাগল।

     এইরকম ভাবতে ভাবতে কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছে, খেয়াল নেই। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্ন দেখছে; চারিদিকে রাশি রাশি গ্রন্থ-ভাবনা - কুঞ্চিতললাট পৃথিবীর অগণ্য মনস্বীদের ছবি - একটা সুগন্ধি ধূপের ধোঁয়া ঘুরে ঘুরে ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠছে, নিরঞ্জন সেই নীলাভ ধূপকুণ্ডলীর দিকে চেয়ে আছে। গ্রন্থের যেন জীবন আছে, ছবিরাও যেন সজীব - তারা যেন নিরঞ্জনকে বাক্যহীন সঙ্কেতে জানিয়ে দিচ্ছে, নিরঞ্জন, এই তোমার পথ, এই তোমার লক্ষ্য। বাইরের ঘন নীল রাত্রির আকাশে দপ-দপ করে একটা তারা জ্বল্‌ছে - তার সেই স্নিগ্ধোজ্জ্বল দীপ্তি নিরঞ্জনকে সংসার ভুলিয়ে দিচ্ছে, অন্তরের প্রদাহ দূর করছে। নিরঞ্জন সেই ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াত লাগল। জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়ে সে দেখল একটা সীমাহীন পথ-রেখা। রাত্রির অন্ধকারের মধ্যে সেই আঁকা-বাকা শুভ্র পথ-রেখা কত সুন্দর, কত সুস্পষ্ট!

      হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যেতেই নিরঞ্জনের মনটা ব্যথিত হয়ে উঠল। কোথায় সেই জগৎ - সেই ছায়ালোক, সেই শ্রেণীবদ্ধ স্তব্ধ ধ্যানমূর্ত্তি! বাইরের এই রৌদ্রদীপ্ত, কোলাহলময় অতি স্পষ্ট, অতি প্রত্যক্ষ সংসার তার কাছে কত শ্রীহীন!
সকালের নির্ম্মল আলোয় নিরঞ্জন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল - রাত্রির সেই স্বপ্নালোকের জগৎই তার জীবনের লক্ষ্য হবে। বাকি সমস্তই তার কাছে মিথ্যা, অর্থহীন। সংগ্রাম যদি করতে হয়, সেই জীবনকে লক্ষ্য করেই সে সংগ্রাম করবে। তাতে তার বা হবার হোক। সঙ্কল্পের শেষ অবধি নিরঞ্জন ভেবে নিল - কিন্তু উপায় নেই; যা সে সত্য বলে উপলব্ধি করছে, তার কাছে আত্মবিসর্জ্জন করতেই হবে। কর্ত্তব্যের ত্রুটি হয়ত হবে, কিন্তু উপায় নেই এমনি ভেবে নিয়ে নিরঞ্জন বাইরে চলে গেল।
বহুদিনের অনাদৃত বইগুলোর উপর ধূলো এসে জমেছে। নিরঞ্জন আজ কি মনে করে বইগুলো নামিয়ে ধূলো ঝেড়ে টেবিলের উপরে দিচ্ছে আর আপন মনেই গুঞ্জন করছে -

দক্ষিণ সমুদ্র-পারে তোমার প্রাসাদ-দ্বারে
হে জাগ্রত রাণী,
বাজে নাকি সন্ধ্যাকালে শান্ত সুরে ক্লান্ত তালে
বৈরাগ্যের বাণী?

      এমন সময় ছোট বধূ ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখে একটা পাণ্ডুর, বিষণ্ণ ছায়া। হঠাৎ তাঁর দিকে চোখ পড়তেই নিরঞ্জন বলে উঠল, 'কি হয়েছে বৌদি, অসুখ?'
     একটু হেসে ছোটবধূ বললেন, 'কৈ না, কিছুই হয়নি ত।'
     'অসুখের মতই ত মনে হয়, কি হয়েছে বলুন ত।'
     'না কিছুতেই হয় নি, তুমি কি কবিতা পড়ছ শুনতে এলাম, পড় শুনি।'
     'শুনবেন? আচ্ছা।' - বলে নিরঞ্জন পরম উৎসাহে কবিতা পড়তে লাগল-

      নিরঞ্জন স্পষ্ট সুন্দর উচ্চারণে কবিতা পড়ে যাচ্ছে - আর ছোটবধূ তন্ময় হয়ে শুনছেন। কবিতার সুরের সঙ্গে তাঁর যেন কোথায় যোগ আছে। তাঁর মনের মধ্যে নিরঞ্জনের কণ্ঠস্বর যেন ক্রমাগত ঝঙ্কার তুলছে, তিনি মুগ্ধ হয়ে নিরঞ্জনের আবৃত্তি শুনে যাচ্ছেন। কবিতায় এক-একটি শব্দের উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনের মধ্যে জেগে উঠছে এক একটি ছবি - দক্ষিণ সমুদ্রপারের অজ্ঞাত দেশের চিরজাগ্রত রাণী - আকাশ ভরা তারা - আর, গহন অরণ্যের নিশ্ছেদ শাখান্তরালে অসংখ্য পাখীর নিদ্রাহীন কলকণ্ঠ - এমনি কত স্পষ্ট, অস্পষ্ট চিত্রমালা! তার চোখের পল্লব গভীর সহানুভূতিতে আদ্র হয়ে আসছে।

       কি আশ্চর্য্য সুন্দর লেখা - এ যেন আকর্ষণ করে, একটি মোহিনীমায়ায় সমস্ত সত্তাকে ঘিরে রাখে। নিরঞ্জন যে কেন কথাবিমুখ, কেন সে যে আবিষ্ট হয়ে থাকে, তার অর্থ যেন তাঁর কাছে ক্রমশঃ স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল।

       পড়া শেষ করে নিরঞ্জন তার ছোট-বৌদির দিকে চেয়ে রইল। তিনি স্নিগ্ধহাস্যে বললেন, 'বেশ সুন্দর'। কবিতা পড়ার সময়ে নিরঞ্জনের উৎসাহ, আগ্রহ আর আনন্দ লক্ষ্য করে ছোটবধূ বিস্মিত হয়েছেন। কৈ, এমন উৎসাহ ত নিরঞ্জনের অন্য বিষয়ে নেই। সংসারের একপাশে অতি সংকীর্ণ স্থান নিয়ে এই প্রাপ্তবয়স্ক কিশোর যে উদাসীনভাবে কিসের ধ্যান করে, এতদিন পরে এই কবিতার আবৃত্তি শুনে ছোটবধূর মনে আর সে সম্বন্ধে সংশয় মাত্র রইল না। নিরঞ্জনের উজ্জ্বল মুখের দিকে চেয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, 'আচ্ছা ঠাকুরপো, এই সব নিয়েই তুমি বেশ খুশী থাক, না?'

      নিরঞ্জন কণ্ঠস্বরে নৈরাশ্য নিয়ে এসে বলল, "খুশী আর থাকতে দিচ্ছেন কৈ আপনারা? এই সব নিয়ে থাকতে পেলে ত বেঁচে যেতাম। আমি খুশী হলে আপনারা যদি খুশী হতেন, তাহলে ত কোন কথাই ছিল না।'
     'কেন তোমার খুশী থাকার বাধা কি?'
     নিরঞ্জন স্মিতহাস্যে বলল, 'এই জীবনটাই একটা বাধা। কাব্য ভাল লাগা, সাহিত্য ভাল লাগা, দরিদ্র সংসারে এ সব মনোবৃত্তি ত ব্যাধি বৌদি - আর, ব্যাধি মাত্রই বাধা।'

      'ভুল বলছ তুমি ঠাকুরপো, তোমার ভাল লাগাটাই ত সত্যি। সংসার দরিদ্র হোক আর ধনীই হোক তোমার যা ভাল লাগে, যাতে তুমি সত্যি সত্যি আনন্দ পাও, তা তুমি কেন করবে না?'

     'কথাটা ঠিক হল না বৌদি। আমার ত অনেক জিনিষ ভাল লাগতে পারে, কিন্তু তা বলে যা কিছু আমার ভাল লাগবে, তাতেই যে সংসারের মঙ্গল হবে - এর মধ্যে সত্য কোথায়?'
     'আমি ও-সব বুঝি নে। সংসারের মঙ্গল যে কোনদিক দিয়ে হয়, তার তুমি কি জান? যাতে নিন্দে নেই অথচ যা করলে তোমার আনন্দ হয়, যা তোমার নিজের উন্নতির জিনিষ, তা তুমি একশবার করবে। সেইখানেই ত তোমার পৌরুষ!'

      'কি জানি বৌদি - ঠিক বুঝতে পারি নে। মনে করুন, এখন টাকা আনতে পারলে সংসারের মঙ্গল হয়। আমার কি কর্ত্তব্য হবে টাকা আনবার চেষ্টা করা, না কবিতা আবৃত্তি?'

      'টাকার কথা আমার কাছে তুলো না ঠাকুরপো! ও সব তোমার দাদাদের সঙ্গে পরামর্শ করবার বিষয়। তবে এটুকু আমি জানি যে, সাহিত্যচর্চ্চা যাঁরা করেছেন, তাঁরা ত উপোস করেন নি। এক রকম করে চলে যায় দিন, কি বল?'
নিরঞ্জন কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। তারপর বলল - 'তা যেতে পারে। তবে, আমার নিজের দিক দিয়ে আমি মোটেই স্থিরনিশ্চয় নই।'

      'তা হলে তুমি কি করবে? একটা কিছু ত করতে হবে।'
     'তাই ত রাতদিন ভাবছে বৌদি। ওকালতির কথা ভাবলে গায়ে জ্বর আসে। কোনো আপিসের কেরাণীগিরি, না হয় ত নিদেনপক্ষে একটা স্কুলমাষ্টারি জোগাড় করে নিতে হবে। সাহিত্যের দিক দিয়ে কিছু করা যায় কি না তাই ভাবি মাঝে মাঝে-'
     'আচ্ছা, এক কাজ করলে ত পার’- খুব উৎসাহের সঙ্গে ছোটবধূ বললেন।
     'কি কাজ?'
     'কোনো মাসিক পত্রিকা বার করতে পার ত!'
     'মাসিক পত্রিকা? অত টাকা কোথায় পাব বৌদি? যদিও কাজটি আমার মনের মত, কিন্তু সাহায্য করবে কে?'
     ছোটবধূ এক মুহুর্ত্ত স্থির থেকে বললেন, 'আচ্ছা, আমি সাহায্য করব।'
     নির্ব্বাক বিস্ময়ে নিরঞ্জন তার ছোট-বৌদির স্নেহদীপ্ত মুখের দিকে চেয়ে রইল - ছোটবৌদি একি বলছেন। উপহাস নয় ত-!
     'তাই কি হয় বৌদি। আপনি? আপনি কি করে সাহায্য করবেন?'
     'যেমন করেই হোক, আমি যদি তোমাকে সাহায্য করি, তুমি পত্রিকা বার করতে পার কি?'
     'তা কেন পারব না? তবে আপনি কি করে আমাকে সাহায্য করবেন, আমি ত তা ভেবে পাই নে।'

      'যেমন করেই হোক, আমি তা পারব। তুমি এখন কি করে কাজ আরম্ভ করবে, আমাকে তার হিসেব দাও ত দেখি।'
নিরঞ্জনের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। সে বলল, 'আপনাকে প্রণাম বৌদি - আপনি আমাকে বড় স্নেহ করেন, কিন্তু আপনার কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে আপনাকে বিপদে ফেলতে চাই নে।'

      'না, তা হতেই পারে না ঠাকুরপো। তোমাকে যে এঁরা কেবল অপমান করবেন, তা আমার সহ্য হয় না। আমি নিজে থেকে তোমাকে সাহায্য করব। তুমি কাগজ বের কর - নিজের কাজ করে যাও তুমি। দরিদ্র-সংসারে জন্মেছ বলেই যে তুমি অপরাধ করেছ, এমন ত নয়!'

      নিরঞ্জন আর বেশী ভাবল না। সরল বিশ্বাস, শ্রদ্ধা আর আনন্দে তার মন পূর্ণ হয়ে উঠেছে। সে তার ছোট-বৌদিকে প্রণাম করে বলল, 'তাই হবে বৌদি, আমি তা হলে প্রস্তুত হই!'

      পরদিন রাত্রে মহিমারঞ্জন আর ছোটবধূর চোখে ঘুম এল না। মহিমারঞ্জন কিছুতেই তাঁর স্ত্রীকে বোঝাতে পারেন না যে, নিরঞ্জনকে কয়েক হাজার টাকা দেওয়া আর টাকাগুলো নিয়ে জলে ফেলে দেওয়া একই কথা।
'তোমার নিজের টাকা আছে বলেই সেগুলো যে আমার চোখের সম্মুখে এমন করে অপব্যয় করবে, এ আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারি নে।'

      'সহ্য করতে না পার, তোমরা ওর দাদা, কি ও করতে চায় বা কি করবে এ সম্বন্ধে ওকে কখনো কি জিজ্ঞাসা করেছ? শুধু শুধু তোমরা ওকে নির্য্যাতন কর - সেটা কি ভল? 'নির্য্যাতন আর কিসের? ওর চেয়ে ঢের বেশী নির্য্যাতন আমি সহ্য করেছি। উপার্জ্জন করার কথাট একটু জোর দিয়ে বললেই বুঝি নির্য্যতন হল? এ বুদ্ধি তোমাকে কে দিল?'
'যেই দিক্‌, কাজ ভাল হচ্ছে না। ওর প্রকৃতি তোমাদের মত অত কঠিন নয়; কি ও করতে চায় বা কি করতে পারে, তাই ওকে করতে দাও না কেন?'

      'ও সব কিছু নয়, আমরা যে গরীব, আমাদের উঠতে বসতে পরের খোসামোদ করে চলতে হয়, কত ঝঞ্ঝাট, কত বিপদ-আপদ সহ্য করতে হয়, কত গ্লানি মাথা পেতে নিতে হয় - নিরঞ্জনকে এই কথাটা বুঝিয়ে দিতে পার না?       সাহিত্য, সাহিত্য! সাহিত্য নিয়ে কি ধুয়ে খাবে? কটি লোক সাহিত্য বোঝে বা পড়ে?'
   'তোমরা বা বোঝ কর গিয়ে! আমি যা বুঝি, তাই করব।'

    'উত্তম কথা। তাহলে আমাকে ও-কথা জিজ্ঞাসা না করলেও পারতে। আর বেশী বিরক্ত কর না আমাকে। তোমার দেবর লক্ষণটিকে আর বেশী প্রশ্রয় দিয়ো না - তার নিজের হাত-পা আছে, লেখাপড়া শিখেছে - যেমন করে পারে কিছু আনুক সংসারে। তোমার এত মাথাব্যাথা কেন?' ছোটবধূ দেখলেন মহিমারঞ্জন তাঁর নিজের মত থেকে তিলমাত্র বিচলিত হবার লোক নন। সুতরাং আর বেশী কথা না বলে তিনি চুপ করে রইলেন। তাঁর মনে হতে লাগল, ভাই-এর সঙ্গে ভাই-এর সম্বন্ধ শুধু নামে। লেখাপড়া শিখেছে অতএব সে যেমন করে পারুক, কিছু নিয়ে আসুক। তা সে চুরি করেই হোক আর ডাকাতি করেই হোক। সরিষাতৈলস্নিগ্ধ মসৃণ সংসারের বিপুলায়তন দেহের খোরাক জোটাতে হবে - হায় রে সংসার! নিরঞ্জন ঠিকই বুঝেছে। 'আপনাকে আমি বিপদে ফেলতে চাই নে বৌদি।' সে বলেছিল। কথা খুবই সত্যি। তাঁর নিজের যে স্বাতন্ত্র্য নেই, স্বাধীন মতামতের কোনো মূল্য নেই- নৈলে, নিরঞ্জন কি আর ঘরে বসে থাকবার ছেলে? এমনি কত কথা ছোটবধূ ভাবতে লাগলেন। অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত তাঁর আর ঘুম এল না।

      সকালে মনোরঞ্জন বাইরের ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। প্রসন্নময়ী নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে এসে চায়ের কাপটা টি-পটের উপর রেখে দিয়ে চলে যাবেন, এমন সময় মনোরঞ্জন খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে বললেন, 'প্রসন্ন, নিরো উঠেছে বলতে পার? যদি উঠে থাকে, তাকে শীগ্‌গির পাঠিয়ে দাও।'
     প্রসন্ন তীক্ষ্ণকণ্ঠে বললেন, 'নিরো? নিরো এত সকালে উঠবে?'

      'বড় খারাপ অভ্যেস প্রসন্ন। তোমার আমার ত দেরী হয় না উঠতে। তার মানে কি? মানে আর কিছুই নয় - আমরা দুই ভাইবোনে জানি, অভাব কাকে বলে। সকালে না উঠলে মনে হয়, দিনটা বুঝি ছোট হয়ে গেছে।'

       প্রসন্নময়ী আপন মনেই বকতে বকতে বাইরে চলে গেলেন। বাইরে থেকে নিরঞ্জনের নাম ধরে ক্রমাগত ডাকতে লাগলেন।

       কিছুক্ষণ পরে মহিমা চায়ের বাটি হাতে করে বাইরের ঘরের মধ্যে এসে বসলেন। তাঁর মুখ গম্ভীর, অসপ্রন্ন।
উভয় ভ্রাতা নিঃশব্দে চা পান করে যাচ্ছেন। যেন দুটি অগ্নিগিরি উৎপাতের পূর্ব্বমুহুর্ত্তের চরম প্রান্তে এসে স্তব্ধ হয়ে আছে।
স্তব্ধতা ভেঙে চায়ের বাটিটা নামিয়ে রেখে মহিমা বললেন, 'বিষম সমস্যা দাদা, ছোটবৌ নিরোকে টাকা দিতে চাইছেন।'
মনোরঞ্জনের মুখাকৃতির শান্তি মুহূর্ত্ত মধ্যে বিবিধ কুটিল রেখায় একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। উৎক্ষিপ্ত মনোরঞ্জন ব্যাকুল কণ্ঠে বললেন, 'বল কি?'

     ঘাড় নেড়ে মহিমা সংক্ষেপে বললেন, 'হ্যাঁ, তাই।'
    'আজ আর আমার আপিস যাওয়া হল না দেখতে পাচ্ছি। এ ত' বড় অন্যায় দেখতে পাচ্ছি। কৈ, প্রসন্ন, নিরো হতভাগা উঠেছে বিছানা ছেড়ে?'
     ভিতর থেকে প্রসন্ন চীৎকার করে বললেন, "হ্যাঁ, উঠেছে - যাচ্ছে বাইরে।'
     কিছুক্ষণ পরে ভীতচকিতদৃষ্টি পাংশুমুখ নিরঞ্জন বাইরের ঘরে এসে দাঁড়াল। তাঁকে দেখলে হঠাৎ সপ্তমে সুর চড়িয়ে কিছু বলা যায় না। মনোরঞ্জন অতি ধীর স্নিগ্ধ কণ্ঠে বললেন, 'হঠাৎ টাকার তোমার কিসের দরকার হল নিরো? আর, সে কথা আমাদের না বলে তুমি ছোট-বৌমার কাছে গিয়েছ টাকা চাইতে?'

      নিরঞ্জনের বুদ্ধি এই আকস্মিক প্রশ্নে একেবারে বিমূঢ় হয়ে গেল। তার মুখ দিয়ে শীঘ্র কথা বার হতে চায় না। কিছু ক্ষণ স্তব্ধ থেকে নিরঞ্জন বলল, টাকার আমার দরকার নেই, আমি ছোট-বৌদির কাছে টাকা চাই নি।'
     মহিমা রূঢ় কণ্ঠে বললেন, 'টাকা তুমি না চাইলে, ছোট-বৌ কি স্বেচ্ছায় টাকা দিতে চেয়েছে তোমাকে - আহাম্মক!'
মনোরঞ্জন শান্তকণ্ঠে বললেন, 'উঁহু, বিরক্ত হয়ো না মহিম! কি ব্যাপার ঠিক বুঝতে পারছি নে।'
     নিরঞ্জন বলল, 'ব্যাপার কিছুই নয়। এমন কথা হতে হতে ছোট বৌদি বললেন, চুপ করে বসে না থেকে একখানা মাসিকপত্র বার কর, টাকার জন্যে ভেব না, আমি তোমাকে টাকা দেব।'

     মনোরঞ্জন ঘাড় নেড়ে বললেন, 'হুঁ এতদূর? মহিম বড় বাড়াবাড়ি আরম্ভ হল সংসারে। এর প্রতিকার একটা কিছু হওয়া দরকার!' - বলেই মনোরঞ্জন তাঁর কণ্ঠস্বার সপ্তমে চড়িয়ে দিলেন, বললেন, 'আর তোমাকে বলি নিরঞ্জন, এখনো তোমার জ্ঞান হওয়া দরকার। ছোট-বৌমা তোমাকে অর্থ সাহায্য করবেন, আর তুমি সেই অর্থ দিয়ে মাসিকপত্র চালাবে - খুব গৌরবের কথা বটে। একটু লজ্জাও কি হয়না তোমার নিরো? এর পরে, এ বাড়ীতে তুমি থাকবে কি করে। আমি হলে ত, এতদিন বেরিয়ে পড়তাম যে দিকে দুচক্ষু যায়।' নিরঞ্জন মাথা নত করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
     মহিম কণ্ঠস্বরে চরম বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, 'একেবারে চরম হয়ে উঠল, আমারই ইচ্ছে করছে যে দিকে দুচক্ষু যায়, বেরিয়ে পড়তে।'
     মনোরঞ্জন পুনরায় শান্ত কণ্ঠে বললেন, 'না, তার দরকার নেই। ছোট-বৌমকে বুঝিয়ে দাও, নিরঞ্জনকে যেন তিনি আর এ ভাবে প্রশ্রয় না দেন। তর মাথার উপরে আমরা রয়েছি, তিনি কেন তাকে বিদ্রোহী করে তুলছেন? তার হিতাহিত মঙ্গলামঙ্গলের ভার আমাদের, তাঁর নয়।' - মহিম বললেন, 'আমি কোনো কথা বলতে বাকি রাখি নি। তবে আমাদের মনে হয় নিরোকে আর কালবিলম্ব না করে আপনি আপনার আপিসে নিয়ে যান। মঙ্গলামঙ্গলের ভার আমাদের, কিন্তু অমঙ্গলটাই যদি বেশী দেখা যায়, তাহলে কে স্থির থাকতে পারে - বলুন।'

      মনোরঞ্জন বললেন, 'সে ত সত্যি কথাই। দেখি কি কতদূর করতে পারি। কিন্তু আপিসে নিয়ে যাব কাকে? ও কি একটা মানুষ? সাত চড়ে যার মুখে রা নেই, সে কাজ করবে কি করে?'

      নিরঞ্জন আর স্থির থাকতে পারলে না, মাথা তুলে বলল, 'না, না-আপিসে যাওয়ার দরকার নেই, আমি শীগ্‌গির না হয় একটা কিছু করব, আপনারা আর বেশী ভাববেন না।'

     একটি অদ্ভুত বক্রহাসি হেসে মনোরঞ্জন বললেন, 'বেশ ত, বেশ ত, অতি উত্তম কথা, কিন্তু তুমি তা করবে কি? শেষ কালে ছোট-বৌমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে তুমি বড় হতে চাও। নিজেকে ধিক্কার দাও - ' বলে মুখের রেখাগুলোকে যতদূর সম্ভব কুটিল করে মনোরঞ্জন উঠে দাঁড়ালেন, 'আপিসের বেলা হল রে প্রসন্ন, দেখে শুনে হতজ্ঞান হলাম। এরই নাম শিক্ষা।' বলতে বলতে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

      মহিমাও আপিসের নাম শুনে ধীরে ধীরে বাইরের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। নিরঞ্জন স্তব্ধ হয়ে চৌকীর একপাশে বসে রইল। সে তার সরল সহজ বুদ্ধিতে ঘটনা যে এতদূর আসতে পারে, তা অনুমান করে নি। দুঃখে ক্ষোভে তার চোখ দিয়ে ঝর্‌-ঝর্‌ করে জল পড়তে লাগল। এই বাড়ীতে আর একমুহূর্ত্তও তার থাকবার ইচ্ছে নেই। চারিদিক থেকে শুধু বিষাক্ত তীর এসে তার বুকে বিদ্ধ করতে আরম্ভ করেছে। আজ যা হয় একটা তাকে করতেই হবে।

      গভীর রাত্রে বাড়ী যখন নিঃস্তব্ধ, তখন নিরঞ্জন একটা ছোট সুটকেসে খানকতক বই আর কিছু কাপড়-জামা বোঝাই করছে।
     হঠাৎ একটা আর্ত্ত তীব্র চীৎকারে তার মন সচকিত হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি দরোজা খুলে ফেলে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে মহিম একটা আলো নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুতপদে নীচে নেমে যাচ্ছেন। নিরঞ্জনকে দেখতে পেয়েই মহিম বললেন, 'নিরো, মহাবিপদ, তোমার ছোট-বৌদির ঘন ঘন ফিট হচ্ছে।'
     'আপনি কোথায় যাচ্ছেন।'
     'আমি যাচ্ছি ডাক্তার ডাকতে। তুমি যাবে? আচ্ছা, তুমিই যাও - আমি দেখি, এদিকে দাদাকে ডেকে তুলে নিয়ে আসি। তুমি যাও শীগ্‌গির-'
       নিরঞ্জন যখন ডাক্তার নিয়ে বাড়ী এল, তখন একটা মহা সোরগোল পড়ে গেছে। মনোরঞ্জন চীৎকার করছেন - 'নিরো এখনো এল না ডাক্তার নিয়ে?'

        প্রসন্নময়ী আলো নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন। নিরঞ্জনকে দেখে বললেন 'এই যে এসেছে!' ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে ঘরের মধ্যে এসে দেখে বড়-বৌদি ছোট-বৌদির মাথায় হাওয়া করছেন আর মহিমা তাঁর চোখেমুখে জলের ঝাপ্‌টা দিচ্ছেন। 

     ডাক্তার ঘরের মধ্যে আসতেই সকলে একটু সরে বসলেন। বাক্স থেকে ওষুধ বার করে খাওয়ানো এবং আর-ও অন্যান্য ব্যবস্থা শেষ করে ডাক্তার যাবার সময়ে বলে গেলেন, 'কোন মানসিক উত্তেজনায় আর উদ্বেগে এ-রকমটি হয়েছে, বিশেষ কোনো ভয়ের কারণ নেই, একটু পরেই জ্ঞান হবে।'

    নিরঞ্জন দেখল, তার ছোট-বৌদির দেহ স্থির হয়ে পড়ে আছে, হঠাৎ দেখলে মনটা ব্যাকূল হয়ে উঠে। আর, বাড়ীর সকলের মুখে একটা উদ্বেগ আর আশঙ্কার ছয়া। বড়-বৌদির মুখ থেকে উৎকট ঘৃণার রেখাটা দূর হয়ে গিয়েছে - দাদাদের উভয়েই নিস্পন্দ, স্থির, প্রসন্নময়ীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর হয়েছে নীরব। একটা আসন্ন বিপদের পরম মুহূর্ত্তে সকলের মন থেকে বিষাক্ত হাওয়াটা দূর হয়েছে। নিরঞ্জন ধীরে ধীরে তার ছোট-বৌদির মাথার কাছে গিয়ে বসল। মনোরঞ্জন হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, 'বড়-বৌ, দেখ ত, বৌমার দাঁতি-লাগাটা ছেড়েছে কি না?'

     বড় বধূ ঘাড় নেড়ে জানালেন, ছেড়েছে।
     মনোরঞ্জন বললেন, 'তবে আর ভয় নেই মহিম - এস আমরা যাই?'
     এই কথার কিছুক্ষণ পরেই ছোট বধূ চোখ মেলে চাইলেন। তাড়াতাড়ি উঠে বসবার চেষ্টা করতে লাগলেন। মনোরঞ্জন বললেন, 'ব্যস্ত হয়ো না বৌমা, যেমন শুয়ে আছ, অমনি থাক।'

     ছোটবধূ বালিশের উপরে মাথা রেখে আবার চোখ মুদ্রিত করলেন। প্রসন্নময়ী একবাটী গরম দুধ নিয়ে এলেন - তখন মনোরঞ্জন এবং মহিমা ঘর থেকে বেরিয়ে গেছেন।
     বড়-বৌ নিরঞ্জনকে বললেন, 'নিরো, তুমিও যাও ঘর থেকে, ওর কাপড়-জামা সব বদ্‌লাতে হবে। খানিকটা পরে আবার এস।'

     নিরঞ্জন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাইরে চলে গেল। তার মনে হতে লাগল, ছোট-বৌদির ফিট সংসারে আবার শান্তি নিয়ে এল। কিন্তু এ হয় ত সাময়িক, আবার রাত্রি শেষ হলেই দেখা যাবে সেই গোলমাল, সেই অশান্তি, সেই টাকা-টাকা রব! নিরঞ্জন তার নিজের ঘরের মধ্যে গিয়ে বিছানার আশ্রয় নিল, আজ আর তার সুটকেস গোছানো হল না।
পরদিন সন্ধ্যায় নিরঞ্জনের কি মনে হল, ছোট-বৌদির ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়াল। ছোট বধূর দুর্ব্বলতা এখনো যায় নি। খাটের বিছানার একপাশে তিনি শুয়ে আছেন। নিরঞ্জন ঘরের মধ্যে আসতেই তিনি বললেন, 'এসেছ ঠাকুরপো, বস। তোমাকে শুধু শুধু কষ্ট দিয়েছি। মাসিক-পত্রের কথাটি না তুললেই বোধ হয় ভাল হত।'

      নিরঞ্জন খাটের একপ্রান্তে চুপ করে বসে রইল।
     ছোটবধূ বলে যেতে লাগলেন - 'ছোট থেকে কারো কষ্ট আমি সহ্য করতে পারিনে মোটেই। তোমাকে ওঁরা বারে বারে অপমান করেন, সেই জন্যেই ও-কথা আমি বলেছিলাম। দেখলাম, বলা আমার ঠিক হয় নি - শেষ পর্য্যন্ত আমারই ফিট হল।

       নিরঞ্জন অল্প একটু হেসে বলল, 'ভুলে যান, বৌদি, ভুলে থাকাই ভাল। আমি ত আর ভাবি নে কিছুর জন্যে। আপনি বেশী ভাবেন, তাই কষ্ট পান বেশী।'

     'তাই দেখছি ভাই, - ভুলে যাওয়া ভাল, না কষ্ট পাওয়া ভাল, কোন্‌টি ভাল ঠিক বুঝতে পারছি নে। যাই হোক, ফিটের ব্যাপারটা নিতান্ত মন্দ লাগল না, এইসব ব্যাপারে মানুষ চেনা যায়। যিনি ভুলেও আমার ঘরের দিকে আসেন নি কোনোদিন, সেই বড়দিই সকলের আগে এসে আমার মাথা কোলে তুলে নিলেন, আশ্চর্য্য!' ছোটবধূর বড় বড় চোখ দুটি অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠল।

      নিরঞ্জন কোনো কথা বলতে পারল না, জীবনের বিভিন্ন পথের বাঁকে দাঁড়িয়ে একই দৃশ্যকে হয় ত নানান আকারে দেখা যায়! তাতে আশ্চর্য্য হবার কি আছে? আবার হয়ত লক্ষ্য করলে এখুনি দেখা যাবে বড়-বৌদির মুখে সেই চিরপরিচিত ঘৃণা আর বিরক্তির রেখা ফুটে উঠেছে। এ বৈচিত্র্যকে কোন গণ্ডীর মধ্যে ফেলা যায় না ভাই, ছোট-বৌদি বড়বধূর যে টুকু ছবিতে আনন্দ পেয়েছেন, তাকে আর যুক্তির আঘাতে ভাঙবার ইচ্ছা নিরঞ্জনের হল না।
'শরীরটা কেমন বোধ হচ্ছে আপনার ছোট-বৌদি?'

      'খুব ভাল নয় ভাই, ভারি দুর্ব্বল মনে হচ্ছে। মাথার দিককার আকাশ যে এত স্বচ্ছ হতে পারে, নিরঞ্জন তা ধারণাতেও আনতে পারে না।

      জানালা খুলে দিয়ে নিরঞ্জন বলল, 'আমি তা হলে যাই ছোট-বৌদি! আপনার এখন বেশী কথা বলা ঠিক নয়।'
'যাই বলতে নেই ভাই, বল আসি।'

      'আচ্ছা আসি বৌদি' বলে নিরঞ্জন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
     আজকের সংসারটাকে নিরঞ্জনের কেমন যেন খাপছাড়া বলে মনে হতে লাগল। এত সহানুভূতি, এত দরদ - কৈ, নিরঞ্জন ত আগে লক্ষ্য করে নি। সংসারের কঠিন রুক্ষতার অন্তরালে যে গোপন ফল্গুধারা আছে, তার সঙ্গে তার পরিচয় হয় নি। তাই আজকের এই সংসারের নুতন রূপ তার চিরাভ্যস্ত চিন্তাধারায় এসে আঘাত করতে লাগল। খেতে বসে সে লক্ষ্য করে দেখল, বড়বধূ আজ তাকে আজ একটু যেন বিশেষ যত্ন করছেন - 'মাছের মুড়োটা খাও ভাই। শ্বশুরবাড়ী গেলে কত যত্ন করে খাওয়াবে তারা।'

       প্রসন্নময়ী যেন দূর থেকে বলছেন, 'ঐ টুকু ছেলে, ওর আবার বিয়ে!'
     নিরঞ্জনের কেমন যেন লাগল আজ। দিদি যে শুভসংবাদ দিলেন, সেইটাই সত্য নাকি? খাওয়ার পর মহিমা এবং মনোরঞ্জন উভয়ে কি সব কথাবার্ত্তা বলতে লাগলেন বাইরে - তার মধ্যে নিরঞ্জন তার নিজের নামটা উচ্চারিত হতে শুনল বারকতক। সেখানে আর না দাঁড়িয়ে সে সোজা তার নিজের ঘরে চলে এল।

      তার কেবলি মনে হতে লাগল আর দেরী করা নয়। সংসারের গতি যে দিকে ফিরছে, সেদিকটা মোটেই তার বাঞ্ছনীয় নয়। মনের নিভৃত কোণে এমন একটা রসের স্পর্শ সে পেয়েছে, যাকে কেন্দ্র করে তার একলার জীবন বেশ চলে যেতে পারে। সংসারের এই নিত্য ভাবান্তর, এই সচলতা - এ যেন তার মোটেই মানায় না। সে বেশ করে ভেবে দেখেছে, তার স্থান সংসারের বাইরে। শিল্পী, কবি, - মুক্তজ্ঞানের উপাসক সে। সেই নির্ম্মল আনন্দ, সেই নিভৃত নির্জ্জনবাস, হৃদয়ের সেই মুক্তস্বচ্ছ সরলতা - এর কাছে কামনার আর তার কিছু নেই। সংগ্রাম করতে হয় এগুলির জন্য সে সংগ্রাম করবে, আর অন্য কিছুর জন্য সংগ্রাম করতে সে প্রস্তুত নয়। সেই যে তার স্বপ্নে-দেখা সাধনার আসন - সেই সজীব গ্রন্থরাশি, মনস্বীদের ভাবনাকুঞ্চিত ললাট, চিত্তের গভীর অনুরাগের মত নীলাভ ধূপ-ধূম - এই ধ্যানসন-ই তার চিরকালের আকাঙ্খার বস্তু। সংসারের কোথাও আর তার কিছু বন্ধন নেই - রাত্রির অন্ধকারের মধ্যে দিগন্তবিসারী সেই বঙ্কিম শুভ্র পথ-রেখা, স্বপ্নের সেই পথ যেন তাকে অদৃশ্য আঙ্গুলি সঙ্কেতে আহ্বান করছে।

      নিরঞ্জন ভাবল; আর দেরী করার কোনো প্রয়োজন নেই। সংসারের প্রয়োজন তার নেই এবং তার প্রয়োজনও সংসারের নেই, অতএব এই সীমাহীন মুক্তির মধ্যে জগতের স্বরূপটি তার একবার দেখে আসা দরকার।

      খুব ভোরে নিরঞ্জন উঠল। সুটকেশটা হাতে করে নিয়ে ঘরের আলো নিবিয়ে দিয়ে খুব সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এল। একদিকে অজানা পথের আহ্বান, অপর দিকে আসন্ন বন্ধনছেদনের মুহূর্ত্তে প্রথমে ছোট-বৌদির বিমর্ষ পাণ্ডুর মুখ, তারপরে দিদির, তারপরে দাদাদের এবং সবশেষে বড়-বৌদির যত্ন করে খাওয়ানোর স্মৃতি তার মনের একদিকে ক্ষতস্থানের মত টন-টন করে উঠল। মনে মনে সে বলল, 'দাদা, আজ আপনাকে নিষ্কৃতি দিলাম। আমার ভবিষ্যতের ভাবনা আর আপনাকে ভাবতে হবে না।' সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো জ্বালা করে উঠল। বুকের ভেতর থেকে যেন একটা উত্তপ্ত অভিমান অশ্রু হয়ে ঝরে পড়তে চায়।

      সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমেই সে দেখল, প্রসন্নময়ী দালানটা ঝাঁট দিচ্ছেন। প্রতিদিন খুব ভোরে ওঠাটা তাঁর অভ্যস। আজও যথাসময়ে তিনি উঠেছেন - কিন্তু সে কথা নিরঞ্জনের জানা ছিল না। জুতোর শব্দ শুনেই তিনি মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখলেন - নিরঞ্জন সুটকেশ নিয়ে সদর দরোজার দিকে দ্রুত বেগে অগ্রসর হচ্ছে। তিনিও দ্রুতপদে তার অনুসরণ করে একেবারে দরোজার কাছে এসে স্বাভাবিক তীক্ষ্ণকণ্ঠে ডাকলেন, 'নিরো'!

      নিরঞ্জন ফিরে দাঁড়ল। দিদির চোখের দিকে চাওয়া যায় না। সুটকেশটি হাতে নিয়ে নিতান্ত নির্ব্বোধের মত নিরঞ্জন মাটির দিকে চেয়ে রইল।

      ‘কোথায় যাচ্ছিস এই ভোরে?’ – বলেই তিনি তার হাত থেকে সুটকেশটা কেরে নিলেন।
     'কোথায় যচ্ছিস্‌ হতভাগা এই সুটকেশ নিয়ে?'
     কোনো উত্তর নাই।

     'বাড়ী থেকে পালিয়ে যাচ্ছিস বুঝি! ভেবেছিস পালিয়ে গিয়ে নিস্তার পাবি? ওরে হতভাগা, যেখানে যাবি, সেখানেই যে টাকা চাই - এ কথাটা তুই এত বড় হয়েছিস, আজো বুঝলি নে? অভিমান কার উপর করবি, নিজেই ঠকবি যে! তোর জন্যে মাথা খুঁড়ে মরতে ইচ্ছে করছে নিরো! যা আর দাঁড়িয়ে থেকে কি হবে? বড়দা এখনো ওঠেনি, যা ঘরে চলে যা - এখনো রাত আছে।'

      ঘর এবং বাইরের মধ্যেপথে দাঁড়িয়ে নিরঞ্জন ভাবতে লাগল, তার ক্ষুদ্র জীবন নিয়ে সেই অদৃশ্য দেবতা একি নিষ্ঠুর উপহাস আরম্ভ করলেন!

 

('বঙ্গশ্রী' পত্রিকা, পৌষ ১৩৪১)

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।