প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

বড়্ঠাকুর

[ লেখক পরিচিতি : পিতা যশোরের অভয়াচরণ মুখোপাধ্যায় ও মাতা নিস্তারিণী দেবীর কন্যা জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর জন্ম ১৮৫০ খৃষ্টাব্দের ২৬শে জুলাই । মাত্র ৭ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পুত্র , রবীন্দ্রনাথের মেজদা , সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে । সেকালে মেয়েদের বাড়ির বাইরে বেরনোর প্রথা ছিল না ; উচ্চ শিক্ষালাভ ত দূরের কথা । সংসারের কাজ করা এবং নিজের সব ইচ্ছা ত্যাগ করে সবার মন জুগিয়ে চলার জন্যই যেন তাদের জন্ম । সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন এই মানসিকতার সম্পূর্ণ বিরোধী । পড়াশোনার বিষযে জ্ঞানদানন্দিনীর প্রথম পাঠ শুরু হয় সেজ দেওর হেমেন্দ্রনাথের কাছে ; পরে মহর্ষি নিয়োজিত ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য্য অযোধ্যানাথ পাকড়াশী বাড়ির মেয়ে ও বৌদের স্কুলপাঠ্য বিষয়গুলি পড়ানোর ভার গ্রহন করেন ।
সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন প্রথম ভারতীয আই.সি.এস অফিসার (১৮৬৪) । তিনি বিলেতে গিয়ে দেখলেন সেখানে মেয়েরা পড়াশোনা করছে , ছেলেদের মতই বাড়ির বাইরে কাজ করছে , কিন্তু তাতে সমাজের ত কোন ভাঙন ধরে নি । তা হলে এটা কলকাতাতে হবে না কেন ! তার ইচ্ছে হল , তার স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী সর্ববিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে মহিলাদের দৃষ্টান্তস্বরূপ হয়ে উঠুক । ১৮৭৭ খৃষ্টাব্দের জ্ঞানদানন্দিনী তার তিন সন্তানকে নিয়ে ( সুরেন্দ্রনাথ , ইন্দিরা ও কবীন্দ্রনাথ ) বিলেতে যান এবং সেখানে সমাজে মেয়েদের ভূমিকা দেখে তার মন নারীর স্বাধীনতা ও শিক্ষা সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠে । দেশে ফিরে এ বিষয়ে সচেষ্ট হবেন বলে ঠিক করেন ; অবশ্যই সত্যেন্দ্রনাথের সমর্থন এ বিষয়ে তাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল । সত্যেন্দ্রনাথের কর্মক্ষেত্র ঠিক হল মহারাষ্ট্রে । তিনি চাইলেন তার স্ত্রীকে কর্মস্থলে নিযে যেতে ; মহর্ষির অনুমতি চাইলেন তিনি । সে যুগে বাড়ির বৌদের বাইরে যাবার রীতি ছিল না । কিন্তু এ ব্যাপারে মহর্ষির সমর্থন মিলল । স্বামীর সঙ্গে মহারাষ্ট্রে থাকার ফলে জ্ঞানদানন্দিনী গুজরাটি ও মারাঠি ভাষাতে যথেষ্ট পারদর্শিনী হয়ে উঠেছিলেন; এ ছাড়া ইংরাজী ও কিছুটা ফরাসী ভাষাতেও তার দখল ছিল ।

জ্ঞানদানন্দিনী মহিলাদের পোষাক নিয়েও অনেক চিন্তা ভাবনা করেছেন । এতদিন মহিলাদের স্থান ছিল অন্তঃপুরে , তখন একটা শাড়ি জড়িয়ে নিলেই যথেষ্ট হত ; কিন্তু বাইরে বের হতে গেলে ত পোষাকের পরিবর্তন দরকার । বোম্বাই থেকে ফিরে এসে তিনি মহিলাদের বাইরে যাবার পোষাকের রূপ ও প্রকার নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করেন । শাড়ির সঙ্গে সায়া, সেমিজ ও ব্লাউজের প্রচলন করলেন তিনি ; সঙ্গে জুতো ও মোজা জুড়ে দিয়ে তিনি ‘ব্রাহ্মিকা শাড়ি’-র প্রচলন করেন । ১৮৭১ সালে তিনি ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’-য় তার পরিকল্পিত পোষাকের কথা নিয়ে লেখা প্রকাশ করেন । চারিদিকে বিতর্ক ও ধিক্কার উঠলেও জ্ঞানদানন্দিনী স্ত্রী-স্বাধীনতার চিন্তা থেকে সরে আসেন নি । তিনি যে শুধু বড়দের এবং মূলতঃ মহিলাদের নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন তা নয় , ছোটদের জন্যও তিনি চিন্তা করেছেন । ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে তিনি 'বালক' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন । ঠাকুর বাড়ির অনেকেই সাহিত্য চর্চা শুরু করেন এই পত্রিকায় লেখা প্রকাশের মাধ্যমে । ছবি আঁকায় উৎসাহ জোগাতে তিনি একটি লিথো প্রেসও চালু করেন । মূলতঃ নাতি সুবীরেন্দ্রকে উপহার দেবার জন তিনি 'সাত ভাই চম্পা' এবং 'টাক্ ডুমাডুমডুম' নামক দুটি রূপকথার নাট্যরূপ দান করেন । সাহিত্য চর্চায় তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । রবীন্দ্রনাথ 'রাজা ও রাণী' নাটক রচনা করলে রাজা বিক্রম ও রাণী সুমিত্রার ভূমিকায় অভিনয় করেন যথাক্রমে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এবং জ্ঞানদানন্দিনী দেবী । তবে জ্ঞানদানন্দিনীর প্রতিভা স্ফূরনের জন্য সত্যেন্দ্রনাথের উৎসাহ ও প্রেরণা অনস্বীকার্য । তার বহু কাজের সঙ্গে স্বর্ণকুমারী দেবীও যুক্ত ছিলেন । স্বর্ণকুমারীর ‘সখি সমিতি’-র সঙ্গেও তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন । চিত্রা দেবের লেখা থেকে জানা যায় , জ্ঞানদানন্দিনী আর দুটি জিনিস বিলেত থেকে শিখে এসে ঠাকুর বাড়িতে চালু করেছিলেন ; সে দুটি হল সান্ধ্যভ্রমণ ও জন্মদিন-পালন । তবে পরের দিকে জন্মদিন পালন করা হত তারিখ দেখে নয় , তিথি মেনে । বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মহিলার জীবনের অবসান ঘটে ১৯৪১ খৃষ্টাব্দের ১লা অক্টোবর । বর্তমান রচনাটিতে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে লিখেছেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী।     দীপক সেনগুপ্ত ]

আমি আটবছর বয়স থেকে এ বাড়িতে এসেছি তখন থেকে আমার স্বামীর মুখে বড় ভাইয়ের কবিতা-আবৃত্তি শুনতুম । বড় হয়ে বুঝতে পারলুম এ কবিটি অন্য কবিদের মতো লোকের কাছে যশের আকাঙ্খী নন , তিনি নিজের ভাবেই ভোর । কবিতা লিখে ভাইদের শুনিয়ে ফেলে দিতেন , ছেঁড়া কাগজ বাতাসে উড়ে যেত । ভাইদের কবিতা শুনিয়ে তাঁদের সঙ্গে তাই নিয়ে হাসাহাসি আমোদ করেই তাঁর পূর্ণ তৃপ্তি হত , বাইরে প্রকাশের কথা মনেই আসত না । এই রকম বড়্ঠাকুরের কত কবিতা ছেলেবেলা থেকে মুখে মুখে শুনে এসেছি । আমাদেরও শুনে আমোদ হত , বেশ লাগত । আমার পূজনীয় শ্বশুর মহাশয় তাঁর বয়ঃপ্রাপ্ত ছেলেদের জমিদারী দেখার কাজে নিযুক্ত করতে ইচ্ছা করতেন । প্রথমে বড় ছেলেকেই সেই কাজের ভার দেন । তাঁরই মুখে সেকালের কথা শুনেছি , তিনি কিছুতেই জমিদারী কাজে মন সংযোগ করতে পারতেন না । আমাকে বলেছিলেন - "আমার মনে তখন সর্বদাই এত কবিতা উথলে উঠছে যে আমি থামাতে পারতুম না - জমিদারীর দলিল দস্তাবেজের উপরেই অনেক সময় কবিতা লিখে ফেলতুম । আমার এই অমনোযোগের কথা বাবামহাশয়ের কানে গেল । তিনি আমার মন বাঁধার জন্যে আমাকে পঁচিশ টাকা মাসকাবারীর লোভ দেখালেন - যাতে আমি ভালো করে জমিদারীর কাজ করি । তাতেও কোনো ফল হল না । আমার মন কিছুতেই ওদিকে দিতে পারলুম না । পিতাকে সন্তুষ্ট করতে , তাঁর আজ্ঞা পালন করতে , সম্পূর্ণ ইচ্ছা সত্ত্বেও আমি পারলুম না ।"

তিনি আশুরোষ আশুতোষ ছিলেন । চাকরের উপর বা কোনো স্বজনের উপর রাগ হলে খানিকটা চেঁচামেচি করতেন , ধমকাতেন , কিন্তু দু এক মিনিট পরেই তাঁর রাগের দরুন পাছে তার মনোব্যাথা হয়ে থাকে সেটা মুছে দেবার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তেন । খাবার ভাল হয়নি বলে চাকরকে হয় ত ধম্কেছেন বা একটা চড় দিয়েছেন , তখুনি একটা কাগজ আনিয়ে সরকারদের হুকুম লিখিয়ে দিতেন , "একে পাঁচ টাকা পুরস্কার দেবে ।" আত্মীয়দের সঙ্গেও সেই রকম ব্যবহার । যদি দৈবাৎ কোনো কঠোর কথা বলে ফেলে থাকেন , তার ব্যাথাটা মন থেকে দূর করে দেবার জন্যে চেষ্টার আর শেষ থাকত না ।
সকলের সঙ্গেই তাঁর হাসি আমোদের সম্পর্ক ছিল । স্নেহের পাত্রদের সকলেরই নতুন কিছু নামকরণ করতেন , আর দেখা হতেই পিঠ চাপড়িয়ে সেই নাম ধরে আদর করতেন । সে নামগুলি প্রায়ই হাস্যজনক হত - যেমন 'বাল্মীকিপ্রতিভা'তে সরস্বতীর ভূমিকা যে-কোন মেয়ে গ্রহণ করত তার নাম হত "সরস্বতী সাহেব"। নামকরণে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রত্যয়ের প্রতি ঝোঁক পড়ে যেত - কখনো সাহেবের জয়গায় 'রাম' শব্দ প্রত্যেকের নামের সঙ্গে জুড়ে দিতেন - সে বালকই হোক্ কি বালিকাই হোক্ প্রৌঢ়ই হোক্ আর বুড়িই হোক্ ।
তাঁর নিজের রচনা আত্মীয়দের শোনাতে তো ভালোবাসতেনই - কিন্তু পুরোনো দাসী চাকরদেরও কখনো কখনো শোনাতেন , বলতেন -"সকলেরই মত নেওয়া ভাল , ওদেরই বা কেমন লাগে দেখা যাক্"। আমার স্বামীর পুরোনো দাইকে 'স্বপ্নপ্রয়াণ'টা আগাগোড়া শোনালেন । সে মহাভারত রামায়ণ শোনার মত ধৈর্য ধরে শুনে গেল । শেষকালটা গড় হয়ে প্রণাম করলে । বড়ঠাকুর ভারি খুশি ।
তিনি যখন একবার রাঁচিতে আসেন তাঁর এক বাল্যবন্ধুর সঙ্গে অনেক বৎসর পরে দেখা হয় । বাল্যকালের পর আর কখন দেখা হয়নি । ভাইদের প্রতি যে এত ভালবাসা , বাল্যবন্ধু প্রীতি কিন্তু তার চেয়ে কিছু কম নয় দেখা গেল । প্রতিদিন তিন ভাই একত্রে খেতেন , কিন্তু যেদিন বন্ধুটি আসতেন , সেদিন নিজের শোবার ঘরে দরজা বন্ধ করে শুধু তাঁর সঙ্গে খেতে বসতেন । সেই অবসরে বন্ধুর কাছে তাঁর দারিদ্র্য ও ঋণগ্রস্ত অবস্থার কথা শোনেন । বন্ধুর ঘরবাড়ি দেনায় বিক্রি হয়ে যাচ্ছিল । বড়ঠাকুর একথা শুনে ব্যাকুল হয়ে তাঁর ঋণ পরিশোধ করে দিয়ে আসেন । কবিতায় মজা করে চিঠি লেখা তাঁর একটা স্বাভাবিক কাজ ছিল । দুই ভাইয়ের কাছে - সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ - হপ্তায় দুই একখানা তো আসতই । আমরা তিনজনে মিলে সেগুলি উপভোগ করতুম । শেষটা তাঁর মৃত্যুর দিনপনেরো পূর্বে পর্যন্ত আমি একলাই তাঁর কবিতায় চিঠি পেয়েছি । এ সমস্ত কবিতা যুবার স্ফূর্তি ও শিশুর সরলতায় পূর্ণ , বার্ধক্যের কোনো চিহ্ণই তাতে থাকত না ।
একবার জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে লিখলেন , "ভাই জ্যোতি আমার সরস্বতী গাউন পরেছেন ।" - তার পরেই অনেকগুলি ইংরেজি কবিতা ; দুঃখের বিষয় তার একটিও আমার কাছে নেই । জরার অক্ষমতা সত্ত্বেও এবং নড়াচড়া তাঁর পক্ষে কষ্টকর হলেও ভ্রাতৃস্নেহের আকর্ষণ তাঁকে তিন চারবার রাঁচিতে নিয়ে এসেছিল । তিন ভাইয়ের মিলন-সুখ দেখাটা আমার একটি উপভোগ্য জিনিষ ছিল । আশা করি আজ ত্রিদিবে তিনভাই সেই বিশুদ্ধ মিলনানন্দ লাভ করেছেন ।

জ্ঞানদানন্দিনী দেবী

( ১৩৩২ বঙ্গাব্দের 'ভারতী' পত্রিকার মাঘ সংখ্যায় প্রকাশিত । )

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।