[ লেখক পরিচিতি : কান্তিচন্দ্রের জন্ম ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে
কলকাতায় শ্যামবাজারে| বিদ্যালয় বা কলেজ শিক্ষা সম্বন্ধে
কিছু জানা যায় নি| তবে পরবর্তী কালে লেখক ও সাংবাদিক হিসাবে
তিনি যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন| তিনি বিশেষ খ্যাত হয়েছেন
'রুবাইয়াৎ-ই-ওমর-খৈয়াম'-এর অনুবাদ করে| ওমর খৈয়াম ( ১০৪৮-১১৩১
খ্রী: ) ছিলেন পারস্য দেশের কবি, গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী|
তার রচিত চৌপদি ছন্দের কবিতা ইংরাজীতে অনুবাদ করেছেন ইংরেজ
কবি এড্ওয়ার্ড ফিট্জেরাল্ড ( ১৮০৯-১৮৮৩ খ্রী: )| সেই ইংরাজী
রচনার অনুবাদ করেছেন কান্তিচন্দ্র| কবিপ্রশস্তি অংশে তার
বঙ্গানুবাদের দুটি পংক্তি :
'হাজার বছর ধরে সে এক
বাংলা দেশের কবি
নিজের মাঝে দেখেছে তোমার
দুঃখ সুখের ছবি|'
মূল কাব্যের সুর ও ছন্দ অবিকৃত রেখে
তার অনুবাদ উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে| রবীন্দ্রনাথ অনুবাদকের
'বিশেষ ক্ষমতা'র স্বীকৃতি দিয়েছেন| সাহিত্য রচনা ছাড়াও কান্তিচন্দ্র
বিভিন্ন সংবাদ পত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং তিনি ছিলেন
বঙ্গীয় আইনসভার একজন সংবাদদাতা| 'বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ'-এর
গ্রন্থাগারিক পদেও তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করেছেন| তার
রচিত গ্রন্থ : 'রুবাইয়াৎ-ই-ওমর-খৈয়াম' (অনুবাদ ) ; 'রুবাইয়াৎ-ই-হাফেজ'
( অনুবাদ ) ; 'সেবিকা' ( গদ্য কবিতা ) ; 'ধূমকেতু' ( গল্প
) ; 'মোগল বধূ' ( আকবর ও যোধাবাই-এর প্রণয় কাহিনী নিয়ে রচিত
ঐতিহাসিক নাটক ) ; 'কবীর বাণী' ( কবীরের দোঁহার ছন্দানুবাদ
)| কান্তিচন্দ্রের গল্প রচনার প্রতিভাকে আবিষ্কার করেন প্রমথ
চৌধুরী| ১৯৪৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত 'ধূমকেতু' গ্রন্থটিতে
ন'টি গল্প এবং আটটি কথিকা সংযোজিত হয়েছে| গ্রন্থ ছাড়াও 'সবুজপত্র',
'প্রবাসী', 'ভারতবর্ষ', 'কল্লোল' পত্রিকাতেও তার অনেক রচনা
প্রকাশিত হয়েছে|
১৯৪৯ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ই মে কালিম্পঙে তার
দেহাবসান ঘটে| ]
দীপক সেনগুপ্ত|
শিল্পী ছবি
আঁকত।
রাজার সেগুলো পছন্দ হত না; সভাসদগণের
মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠত; নাগরিকেরা মুখ ফিরিয়ে চলে
যেত।
শিল্পীর তবুও ছবি আঁকার বিরাম ছিল না।
* * *
কিন্তু এমন একদিন এল যখন শিল্পীর অনশন-ক্লিষ্ট
হাত হতে তুলিকা আপনিই খ'সে প'ড়ল।
গৃহলক্ষ্মী বললেন-রাজার কাছে যাও; তাঁর কৃপাকটাক্ষে তোমার
সকল অভাব দূর হ'য়ে যাবে।
মানস-প্রিয়ার আধ-আঁকা ছবিখানি তুলে
রেখে শিল্পী রাজসভায় এসে দাঁড়াল।
রাজা বল'লেন-উদ্যানবাটিকার ভিত্তিগাত্রে
আমার পূর্বপুরুষগণের কীর্তিকাহিনী তোমার তুলির মুখে ফুটিয়ে
তুলতে হবে।
সভাসদেরা আশ্বাস দিলে-আশাতীত পুরষ্কার
পাবে।
নাগরিকদের আশা হ'ল-দেয়ালজোড়া ছবি দেখে
চক্ষু সার্থক করবে।
রাজপ্রসাদতুষ্ট হাতে শিল্পী আবার তুলিকা
তুলে নিলে।
* * *
শতেক রাজার মুখচ্ছবি ভিত্তিগাত্রে ফুটে
উঠ্ল; অমাত্যদের ভাবহীন মুখের ছায়া অলিন্দের ফাঁকে ফাঁকে
দেখা যেতে লাগল; নাগরিকদের প্রাণহীন মুখের রেখা শোভাযাত্রার
মধ্যে ছড়িয়ে রইল।
শিল্পীর কাজ সাঙ্গ হবার পর-
রাজা তাকে শিরোপা দিলেন; সভাসদেরা দিলে-বাহবা;
নাগরিকেরা দিলে-অভিনন্দন।
শিল্পীর মুখে গর্বে, আনন্দে উৎফুল্ল
হ'য়ে উঠল।
* * *
শিল্পীর বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই তার
মানস-প্রিয়ার অর্ধসমাপ্ত মুখখানি রেখায় সমাপ্ত হ'য়ে উঠল।
কিন্তু তার প্রাণপ্রতিষ্ঠা হ'ল না-শিল্পীর শত চেষ্টা সত্ত্বেও।
রং-এর সঙ্গে রং মিশল, রং-এর 'পরে রং
পড়ল; কিন্তু মুখের সে মৃত্যু-বিবর্ণ ভাব কিছুতেই ঘুচল না।
শিল্পী আহার নিদ্রা ত্যাগ করলে, বিত্ত সম্পদ দূরে ফেললে,
সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিলে; কিন্তু সে মুখে প্রাণের আভাষ
ফুটে উঠ্ল না।
* * *
শিল্পী তখন কলাদেবীর দ্বারস্থ হ'ল।
দেবী বললেন-শিল্পীর বুকের রক্ত দিয়েই
আমি তার মানসপ্রিয়ার মুখে জীবনের আভা ফুটিয়ে তুলি; শিল্পীর
মৃত্যুর ভিতর দিয়েই তার মানস-প্রতিমার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করি।
শিল্পী বললে-আমার সেই শ্রেষ্ঠ বলি আজ
গ্রহণ করুন।
দেবী উত্তর করলেন-তা' তো পারি না। স্বর্ণমুদ্রার
রঙে যে দিন তুলি রাঙিয়ে ছিলে, সে দিন হ'তে তুমি মৃত। তোমার
আত্ববলিদানে অধিকার নাই, ফলও নাই।
শিল্পীর সংজ্ঞাহত হাত থেকে তুলিকা খসে
পড়ল। আর মানস প্রিয়ার প্রাণহীন মুখ শূন্যে চেয়ে রইল।
('সবুজপত্র'
পত্রিকা পৌষ সংখ্যা, ১৩২৬)।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।