তার সঙ্গে প্রথম দেখার দিনটা মনে
না থাকলেও ক্ষণটা এখনও মনে আছে। তখন প্রায় সন্ধ্যা-অস্তগামী
সূর্যের সোনালি আভা জনবিরল পার্বত্য পথে সেদিন একটা কুহক রচনা
ক'রেছিল।
* * * * *
তারপর সে যখন আমাদের বাড়িতে এল-চিরদিনের
সুখদুঃখের ভাগী হ'য়ে-সে দিন আমাদের কি আনন্দ আর অতগুলো অপরিচিত
মুখের কৌতুহল দৃষ্টির সামনে তার যে কি সঙ্কোচ! সে তখন দেখতেও
ছিল ছোট্টটি আর তার বয়সটাও ছিল তরুণ। তার উপর সে যে গরীবের
ঘরে প্রতিপালিত - জন্মটা বড় ঘরে হ'লেও - এ কথাটা বোধ হয় সে
তখনও ভুলতে পারেনি।
বাড়ির সকলে তার পূর্বেকার নামটা ব'দলে
নূতন নামকরণ কর'লে পুতলি বা ডলি-তার পুতুলের মত স্বচ্ছ আর
হরিণীর মত সরল বিশ্বস্ত চোখ দুটি দেখে। সে-ও তাই বিনা আপত্তিতে
মেনে নিলে।
* * * * *
তারপর কতদিন কেটে গেল। ভালবাসার মৃদু
উত্তাপে ডলির সঙ্কোচ তুষারের মত যেন গ'লে গিয়ে কেমন ক'রে স্রোতস্বিনীর
মুখরতায় পরিণত হ'য়েছিল তা' সে নিজেও টের পায়নি বোধ হয়। কেমন
ধীরে ধীরে সে আমার হৃদয়ে নিজের স্থানটি অধিকার ক'রে নিয়েছিল!
বাড়ীর কোথাও আদর ভালবাসার ত্রুটি ছিল না এবং সে-ও তার স্নেহ-বন্ধুত্বের
বন্ধনে আত্মীয়-অভ্যাগত সকলকেই বেঁধে ফেলেছিল। তবু সে এটা ভোলেনি
যে তার সমস্ত সুখ দুঃখ আমাকেই কেন্দ্র ক'রে ঘিরে র'য়েছে আর
আমিও জানতুম যে তার ক্ষুদ্র হৃদয়ের সমস্ত ভালবাসাটুকু আমাতেই
এসে বিরাম পেয়েছে। নিদাঘ দিনে তার ক্লান্ত চোখের নির্ভর দৃষ্টি
আর শীতের রাতে লেপের ভিতর তার সুনিবিড় স্পর্শ আমাকে ওই কথাটাই
বিশেষ ক'রে জানিয়ে দিত।
* * * * *
তারপরে আরও কতদিন কেটে গেল। সমস্ত নেশার
মত নূতনত্বের নেশাও আমার মন থেকে ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগল।
নিজেকে ফিরে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিনকার খুঁটিনাটি কর্তব্যের
দাবীও মাথা পেতে স্বীকার করে নিতে হল। কোথায় গেল ছুটীর সেই
দীর্ঘ দিনগুলি আর কোথায় পড়ে রইল আমার অবসরের জীবন্ত সাথী আর
খেলার ঘুমন্ত স্মৃতি!
কিন্তু ডলি সেটা ঠিক এভাবে স্বীকার ক'রে
নিতে পারলে না। এবং এইখানেই আরম্ভ হ;ল সেই নীরব ট্র্যাজেডি
যার কথাগুলি কোন নাট্যকরের লেখনী মুখে কোন দিন ফুটে ওঠেনি
কিন্তু জীবন রঙ্গমঞ্চে যার অভিনয় প্রতিদিনই চ'লে আসছে।
সকালবেলার কাজের মধ্যে আমার আপিস-কেদারার
ফাঁকটুকু সে অধিকার করে ব'সত। আমি ব্যস্ত হ'য়ে বলতুম-ডলি এখন
নয়; কাজ আছে।
সে চ'লে যেত। তার অভিমান দৃষ্টিটুকু আমার
কাজের মধ্যে যে কোথায় মিলিয়ে যেত তার কিছুই খবর থাকত না।
ক্লান্ত সন্ধ্যার বিরল অবসরে আরাম-কেদারার
মধ্যে আমার বুকের কাছে তার মুখের সঙ্কোচ স্পর্শ অনুভব কর'তুম।
তার সেই রেশমের মত চুলগুলির ভিতর আঙুল রেখে বল'তুম-ডলি, এখন
যাও; বড়ই ক্লান্ত।
রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখতুম-বিছানার
আমার ছেড়ে দিয়ে সে যে কখন নীচের গালচেতে শুয়ে ঘুমিয়ে প'ড়েছে
কিছুই টের পাইনি।
তাকে কর্ম আর অবসর কিছুরই সাথী ক'রে নিইনি।
কয়েকটা অলস দিনে তাকে একটু আমোদ যোগাতে দিয়েছিলুম মাত্র।
* * * * *
তাই সে যে আমাকে একেবারে ছেড়ে চ'লে যাবে-এতে
আশ্চর্য হবারই বা কি আছে। তবে এ-কথাটা ঠিক সে সময় বুঝে উঠতে
পারিনি।
সেদিনের কথা সংক্ষেপেই বলব। সেদিন বিলাতী
স্যাকরার দোকান থেকে তারই জন্যে আনা নূতন কণ্ঠহারটা একেবারেই
কাছে রাখতে পারলুম না, দূরে ফেলে দিলুম। সেটা যে আমার কতকটা
অনুতাপ এবং অনেকটা অনুগ্রহ দিয়ে গড়া-তাতে স্নেহ ভালবাসার নাম
গন্ধও ছিল না।
সেদিন বিনিদ্র রজনীর নিস্তব্ধতার মধ্যে
ডলিকে যেন আবার নূতন ক'রে পেলুম। মনে মনে ব'ললুম-বন্ধু, তুমি
যে নূতন আশ্রয়ে গেছ, সেখানে তোমার ভালবাসা যেন কখন ক্ষুণ্ণ
না হয়। নীরব অবহেলার অপমান বিষে তোমায় যেন জর্জরিত হতে না
হয়। তুমি ভালই ক'রেছ। তুমি সুখী হও।
* * * *
* * * * *
তার হৃদয়ের সমস্ত অভিমানটুকু নিয়ে ডলি
চ'লে গেছে;-আমার হৃদয়ে একটা অনুতাপের ক্ষত রেখে গেছে মাত্র।
ডলিও চ'লে গেছে-আমিও সেই থেকে কুকুর পোষা ছেড়ে দিয়েছি।
('সবুজ
পত্র', শ্রাবণ সংখ্যা, ১৩২৭)