প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

পুঁটেরাম
নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত

[ লেখক পরিচিতি : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক নগেন্দ্রনাথ মোতিহারিতে (বিহার) ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন| পিতা মথুরানাথ গুপ্ত ছিলেন বিহারের সাব-জজ| আদি নিবাস ছিল উত্তর ২৪ পরগণার হালিশহরে| নগেন্দ্রনাথ ১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দে জেনারেল অ্যাসেম্ব্লিজ ইনস্টিটিউশন থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং লাহোরে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন| সংবাদিকতার সূত্রে তাকে বিভিন্ন স্থান ঘুরতে হয়| টাটা কোম্পানীর সেক্রেটারী হিসাবেও কিছুদিন কাজ করতে হয়েছিল তাকে| তার রচিত গ্রন্থ ও অন্যান্য রচনার সংখ্যা খুব কম নয়| একাধিক পত্রিকার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন| তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ : 'স্বপ্ম-সঙ্গীত' (কবিতা সংগ্রহ, ১৮৮২) ; 'অমরসিংহ' (উপন্যাস, করাচী, ১৮৮৯) ; 'পর্বতবাসিনী'(১২৯০) ; 'লীলা' (লাহোর, ১৮৯২) ; 'তস্বিনী' (উপন্যাস, ১৯০৯) ; 'জয়ন্তী' (১৯২৯) ; 'আরাতামা' (১৯৩০) ; 'ব্রজনাথের বিবাহ' (১৯৩১) ; 'উপন্যাস সংগ্রহ ও রহস্য' (১৮৯৯) ; 'জীবন ও মৃত্যু' (১৯০১) ; 'জাল কুঞ্জলাল' ; 'কাঠুরিয়া' ; 'বন্ধু' ; 'কাহার ভ্রম' ; 'ছায়া' ; 'টিকিয়াশাহ' ; 'চন্দ্রপীড়ের ঐশ্বর্য্য' ; 'ফুটবল ফাইনাল' ; 'মায়াবিনী' ; 'জামাল জমিল' ; 'প্রতিশোধ' ; 'ছোট বৌ' ; 'সুরজকওর' ; 'দেবরাত প্রসেন' ; 'নবনগর' ; 'শ্যামার কাহিনী' ; 'খেলাঘর' ; 'নিস্তারিণীর রাজনীতি' ; 'গল্প ও অল্প' ; 'চুলের কলপ' ; 'কেঁচোর কথা' ; 'বিভ্রাট' ; 'লক্ষ হীরা' ; 'প্রজার পোষাক' ; 'মিলন' ; 'বোম্বেটে' ; 'মেহেরজান' ; 'মানবিকা' ; 'পুঁটেরাম' ; 'দুইবার' ; 'চুরি না বাহাদুরী' ; 'মিরিয়ম ও সোরাব' ; 'ঘরের অলক্ষী' ; 'ইংরেজ পাঠান' ; 'ভৈরবী' ; 'নূতন বাড়ি' ; 'মুক্তি' ; 'হীরার মূল্য' ; 'নির্ম্মলা' ; 'ভৈরব মন্দির' ; 'বন্দী' ; 'অলকা' ; 'রিসিনারা' ; 'শাহনওয়াজ' ; 'বাংলার কৃষি'| ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দে বন্ধু রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি কবিতার রচনা সম্বলিত The Poems and Songs of Rabindranaath Tagore নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন| তার সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে দ্বারভাঙ্গা মহারাজের অর্থানুকূল্যে রচিত 'বিদ্যাপতির পদাবলী' ও ঐগোবিন্দদাস ঝা'র পদাবলী'| অপর একটি সম্পাদিত গ্রন্থ 'সত্যপীরের কথা' (১৯৩০)| তার সম্পাদনায় যে সব পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে তার কয়েকটি হল : Phoenix (সাপ্তাহিক, ১৮৮৪-৯০) ; Indian People (সাপ্তাহিক, এলাহাবাদ, ১৯০৫)| Indian People দৈনিক Leader-এর সঙ্গে যুক্ত হলে তিনি তার যুগ্ম সম্পাদক হয়েছিলেন| ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দে নগেন্দ্রনাথ ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের সঙ্গে The Twentieth Century নামে একটি ইংরাজি মাসিকপত্র প্রকাশ করেন| তিনি Sind Times-এর (১৮৮৪) সহ-সম্পাদকও ছিলেন| তিনি ১৩০৬ বঙ্গাব্দে কয়েকমাস মাসিক 'প্রদীপ' পত্রিকা ও ১৩০৭ বঙ্গাব্দে সাপ্তাহিক 'প্রভাত' পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন| কিছু সময় তিনি মহারাজা মণীন্দ্র চন্দ্র নন্দীর ব্যক্তিগত সচিব হিসাবেও কাজ করেছেন| ১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দের ২৮শে ডিসেম্বর বোম্বাইতে নগেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়| ]
                                                                                                          দীপক সেনগুপ্ত|

বাঁধানো অশথ-তলায় ব'সে বোসজা তামাক টানছিলেন| পাশে পাড়ার আর দু-জন বিজ্ঞ লোক| বোসজা নাকে মুখে ধোঁয়া বা'র ক'রে বল্লেন, তাইত, হ্যা, চৌধুরী পাড়ার পুঁটে নাকি যাত্রার দলে ঢুকবে?
হরে রাম দত্ত বল্লেন, না, না, এখনো তাদের সঙ্গে জোটেনি, তবে আসা যাওয়া করে বটে|
প্রসন্ন বাগ্চীর হাতে নস্যের শ্যামুক ছিল| এক টিপ নাকে গুঁজে বল্লেন, সেটাই কি ভাল কথা? ভদ্রলোকের ছেলে, বাপের জমিজমা আছে, দু দশ ঘর প্রজা আছে, গুরু মশায়ের কাছে লেখা পড়া শিখেছে, ডবকা বয়স, যাত্রার দলে মিশ্লে বাপের মুখ হেঁট হবে না? আর সেখানে ক'রবে কি, জুড়ী গাইবে না কেলুয়া সাজ্বে?
হরে রাম বল্লেন, কেন অধিকারী হ'তে পারে? এই মনে কর দাশরথী রায়ের মত-
বোসজা বল্লেন, রাখ, রাখ, গাছে না উঠ্তে এক কাঁদি!
এমন সময় এলেন বিনয় মল্লিক| বোসজা বল্লেন, আসুন মল্লিক মশায়, তামাক খান|
-শুক টান টানতে হবে না কি? তামাক থাক্তে কি তুমি হুঁকো ছাড়বার পাত্তর?
বোসজা কাষ্ঠ হাসি হেসে বল্লেন, আপনার কাছে কারুর তো এড়ান নেই!
হুঁকায় এক টান দিয়ে মল্লিক মশায় বল্লেন, কার কথা হচ্ছিল?
-এই চৌধুরী পাড়ার পুঁটেরামের| ছোঁড়া গোল্লায় যাচ্ছে| যাত্রাওয়ালাদের দলে মিশলে ওর পরকাল ঝরঝরে হ'য়ে যাবে|
মল্লিক মশায় মুখখানা গম্ভীর ক'রে বল্লেন, ওর বাপ কিশোরী চৌধুরীর সঙ্গে সেই কথা হচ্ছিল| ছেলে বড় হয়েছে কি না, বেশী রাগারাগি করলে এমন কি বাড়ী ছেড়ে যেতে পারে| আমি অধিকারীর সঙ্গে দেখা করব আর পুঁটেরামের গর্ভধারিণী তাকে বুঝিয়ে বলবেন| সে তেমন অবুঝ ছেলে নয়, তবে যা একটু একবগ্গা, একটু রগচটা, ঐ যা একটা দোষ|
হরে রাম বল্লেন, যখন মল্লিক মশায় মাঝে আছেন তখন একটা পথ হবেই, গ্রামের নাম খারাপ হবে না| আমার এই নরহট্ট গ্রাম থেকে ভদ্রলোকের ছেলে কেউ যাত্রার দলে ঢোকে নি|
দূরে অপরাহ্ণের সূর্য্যের আলো গঙ্গার জলে ঝিকমিক কর্ছে, নারিকেল গাছের পাতা বাতাসে নড়ছে, একটা খেজুর গাছে গোটা পাঁচ ছয় বাবুইয়ের বাসা ঝুলছে এক পাশে দু-তিনটে তেঁতুলগাছ, তেঁতুল গাছ ভ'রে রয়েছে, একটা কয়েথ বেলের গাছ, সেটাও ফলে ভরা| সব গাছের দিকে চেয়ে মল্লিক মশায় বল্লেন, বোসজা, এ বছর তোমার গাছে খুব ফল ধরেছে, আমরা দু'চারটে পাইনে?
-সে কি কথা! আপনাদেরই তো গাছ, কালই আমি এক ঝুড়ি পাড়িয়ে পাঠিয়ে দেব|
-চল না সবাই গিয়ে একটু গঙ্গার ধারে বসিগে|
-আপনারা এগুন, আমি হুঁকোটা রেখে আসছি|
দু চার পা এগিয়ে হরে রাম বল্লেন, আমিও একবার বাড়ী যাই, পুকুরটা জমা দেব, পারের এক জন মেছোর আসবার কথা আছে|
আর একটু এগিয়ে গিয়ে মল্লিক মশায় প্রসন্ন বাগ্চীকে বললেন, কি হে, তোমারও বাড়ীতেও কিছু বরাত আছে না কি?
-আজ্ঞে না, এমন কিছু নয়, চলুন আপনার সঙ্গে যাই|
-বাঁধা অশথ তলায় ব'সে গুড়ুক টান্বার বেলা সবাই আছেন, গঙ্গাতীরস্থ হবার বেলা কেউ নেই| তবুও এখনও কাঁধ দেবার দেরী আছে| শ্মশানে যস্তিষ্ঠতি স বান্ধবঃ|
মল্লিক মশায়ের রসিকতা যে রকম হোক তাতে যোগ দিতে হয়| প্রসন্ন বাগ্চী ফোক্লা দাঁত বা'র ক'রে বল্লেন, যা বলেছেন|

গঙ্গাতীরে দক্ষিণে বাতাস দিচ্চে| দু'চার জন প্রৌঢ় ও বৃদ্ধ ব্যক্তি বসেছিলেন| খানিক দূরে জন কয়েক যুবক বসে গল্প কচ্ছিল| আরও খানিক দূরে স্ত্রীলোকেরা গা ধুচ্ছিল| কেউ গা ধুয়ে ভিজে কাপড়ে জলভরা কলসী কাঁখে ঘরে ফিরে যাচ্ছে, কেউ এক গলা জলে দাঁড়িয়ে গা ধুচ্ছে| বুড়ীরা ভিজে কাপড়ে ঘাটে ব'সে মালা জপ্ছে, যুবতীরা জলের ভিতর দাঁড়িয়ে গল্প করছে, আবার কেউ কেউ দাঁড়া সাঁতার দিচ্ছে, শুধু মাথা দেখা যাচ্ছে|
যুবাদের মধ্যে ব'সে পুঁটেরাম| পুঁটেরামের ভাল নাম দামোদর কিন্তু ডাকনামটাই সকলে জান্ত| পুঁটেরামের বয়স তেইশ বছর হবে, বেশ জোয়ান, মুখ সুশ্রী, গোঁফ এরই মধ্যে বড় বড় হয়েছে| গায়ে হাতকাটা, পাশের দিকে ফাঁস-বন্ধক-দেওয়া পিরাণ, পরণে গাঁয়ের তাঁতির বোনা কালাপেড়ে ধুতি| খুব হেসে হেসে গল্প করছে| মল্লিক মশায় তাকে দেখে সেই খানে দাঁড়ালেন| বল্লেন, এই যে পুঁটেরাম যে আজ বড় এখানে|
পুঁটেরাম সমীহা ক'রে উঠে দাঁড়াল| বল্লে, আজ্ঞে, মাঝে মাঝে আমি ত বিকেল বেলা এখানে আসি|
-তা বেশ, বেশ| গঙ্গার বাতাস ভাল, বিকেল বেলা বেড়াতে এলে ত এখানেই আসতে হয়|
গঙ্গার জলে শুশুক উল্টোবাজি খাচ্ছে, মাছরাঙা ডেকে ডেকে জলের উপর বাতাসে থত্থর ক'রে কাঁপছে, থেকে থেকে জলে ছোঁ মারছে, এক এক বার বড় বড় রুই কাৎলা মাছ ঘাই করছে| জেলে পাড়ার নীচে কতকগুলো ডিঙ্গী বাঁধা, বালিতে পোঁতা বড় বড় বাঁশে জাল শুকুচ্ছে| ও পারে কোথাও বন, কোথাও প'ড়ো বাড়ীর ভাঙ্গা দেয়াল| সূর্য্য অস্ত গেছে, পশ্চিম দিকের আকাশে লালী রয়েছে, এক খানা সিঁদুরে মেঘে সেই লাল আভা আটকা পড়েছে|
দু চার জন কিশোরী আর যুবতী সাঁতার দিচ্ছে দেখে প্রসন্ন বাগ্চী বল্লেন, মেয়েরা যে সাঁতার দিচ্ছে, এখনি বান ডাকবে যে!
বল্তে বল্তে কল কল ক'রে বান ডাকল| জোয়ারের মুখে আগে ছোট ছোট ঢেউ, তার পিছনে বড় বড় ঢেউ| ঢেউয়ের উপরে সাদা ফেনা| ফেনাসুদ্ধ ঢেউ তীরে আছ্ড়ে পড়তে লাগল|
জল খেয়ে স্ত্রীলোকেরা তাড়াতাড়ি উঠে এল| কেবল এক জন সাঁতার দিয়ে দূরে গিয়েছিল সে বানের মুখে প'ড়ে অদৃশ্য হ'য়ে গেল| তীরে স্ত্রীলোকেরা চেঁচিয়ে উঠল, ওই যা! থাকি বুঝি ডুবে গেল! কি হ'ল গো!
মল্লিক মশায় চেঁচিয়ে বল্লেন, ডাক্ ডাক্ জেলেদের ডাক্, ডিঙ্গী নিয়ে ওঁকে তুলে আনুক্|
যুবকেরা সব উঠে দাঁড়াল| তারা যেখানে বসেছিল তার দক্ষিণ দিকে মেয়েরা গা ধুচ্ছিল| গঙ্গা সেখানে দক্ষিণবাহিনী, বান ঠেলে দক্ষিণ দিক থেকে উত্তরে আসছে|
যুবকেরা যেখানে দাঁড়িয়ে তার একটু দক্ষিণে জলমগ্ন স্ত্রীলোকটী একবার ভেসে উঠ্ল| দু' একবার হাত নেড়ে আবার ডুবে গেল| পুঁটেরাম তৎক্ষণাৎ জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল|
প্রবীণদের মধ্যে একজন বল্লেন, দেখ্লে গোঁয়ারতামি! মেয়েটাকে ত তুল্তে পার্বেই না, শেষে নিজেও ডুববে|
পুঁটেরাম সাঁতার দিতে দিতে বাঁ হাত দিয়ে গায়ের পিরাণ ছিঁড়ে ফেল্লে| তাতে দুই হাত আর কোমর পর্য্যন্ত শরীর মুক্ত হ'ল, হাতে পায়ে জল ঠেলে বেগে সাঁতার দিয়ে চল্ল| যেখানে স্ত্রীলোকটি ভেসে উঠেছিল তার খানিকটে উত্তর দিকে লক্ষ্য ক'রে সাঁতার দিতে লাগল| জলের বড় টান, সামলে যখন একটা বড় ঢেউ ফেনা মাথায় ক'রে আসে তখন পুঁটেরাম ডুব দেয়, আবার ঢেউ কাটিয়ে ভেসে ওঠে| খানিক দূর এই রকম ক'রে গিয়ে ঢেউয়ের জোর কম দেখে পুঁটেরাম ডুব দিলে| অনেকক্ষণ পরে একটু উত্তর দিকে ভেসে উঠ্ল| দু'তিনবার এই রকম ক'রে আবার উঠতে স্ত্রীলোকটি আবার ভেসে উঠল| সে ডোববার আগেই পুঁটেরাম তার পাশে দিয়ে তার হাত ধরল| প্রাণের ভয়ে স্ত্রীলোকটি দুই হাতে তাকে জাপ্টে ধরলে| দু'জনেই ডুবে যায়, পুঁটেরাম জোর ক'রে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলে| এবারে স্ত্রীলোকটি যখন আবার ডোবে তখন পুঁটেরাম তার হাত ধরবার চেষ্টা করলে না| যখন তার মাথা ডুবে বড় বড় চুল ভেসে উঠ্ল তখন তার চুল ধ'রে তাকে ভাসিয়ে টেনে নিয়ে ডাঙ্গার দিকে ফিরল| এবার এক হাতে সাঁতার, জোয়ার যেমন টেনে নিয়ে চল্ল পুঁটেরাম সেই সঙ্গে তীরের দিকে গেল| জলের টানে তাকে অনেকটা উত্তরে নিয়ে গেল| পায়ে মাটী ঠেক্তে পুঁটেরাম মেয়েটির মাথা জলের উপর তুলে ধরলে| কোমর জলে আস্তে দু চার জন যুবক নেমে গিয়ে তাদের দুই জনকে ধরধরি ক'রে ডাঙ্গায় নিয়ে এল|
স্ত্রীলোকটি মূর্চ্ছিত কিন্তু বেশী জল খায় নি| পুঁটেরাম অবসন্ন হয়েছে, বালিতে ব'সে হাঁপাতে লাগল|
তীরে বিস্তর লোক জড় হয়েছে| যে মেয়েটিকে পুঁটেরাম জল থেকে তুল্লে তার নাম থাকমণি, জেতে হাড়ি| তাকে উপুড় ক'রে শুইয়ে তার পেট থেকে জল বা'র ক'রে দিলে পর তার জ্ঞান হ'ল| বয়স বছর আঠারো হবে, দেখ্তে খ্যাঁদা-খোঁদা কালো-কোলো| খানিক পরে তার বাপ-মা তার হাত ধ'রে তুলে তাকে বাড়ী নিয়ে গেল| যাবার আগে তারা বলে গেল, যাই পুঁটেরামবাবু ঘাটে ছিল তাই আজ আমাদের মেয়ে রক্ষে পেলে!
তারা চলে গেলে পর প্রসন্ন বাগচী এক টিপ নস্য নিয়ে বললেন, তা কল্লে হয় কি, পুঁটেরামের সামর্থ্য আছে! এত লোক ছিল, কই আর ত কেউ জলে পা দিলে না| তবে কি জান, থাকি হাড়ির মেয়ে, পুঁটেরাম ওকে ছুঁলে!
পুঁটেরামের ঠোঁট দু একবার কেঁপে উঠ্লে, তার নত চক্ষু একবার জ্বলে উঠল| বল্লে,-হাড়ীর কি প্রাণ নেই? চোখের সামনে ডুবে মরে আর আমি দাঁড়িয়ে দেখব? ধিক্ আমার পুরুষ জন্মে!
-তা বটে, তা বটে! আর গঙ্গাজলে ছুঁতে দোষ কি! তবে কি জান, একবার ভটচাজ্জি মশায়কে জিগ্গেস করলে-
-ভটচাজ্জি মশায়ের গুষ্টির মাথা!
পুঁটেরামের গলার সে বিকট আওয়াজ শুনে প্রসন্ন বাগচী এমন চমকে উঠলেন যে তাঁর হাত থেকে নস্যের শামুক প'ড়ে গেল| সেটা তুলে নিয়ে তিনি আর মল্লিক মশায় সেখান থেকে সুড় সুড় ক'রে স'রে পড়লেন|

কিশোরী চৌধুরী আর তাঁর পরিবার পুঁটেরামের সাহসের কথা শুনে কিছু বল্লেন না| প্রসন্ন বাগচী ভট্টাচার্য্য গোষ্ঠীর প্রসঙ্গ চাপা দিলেন| অমন উঠতি বয়সে ছেলেরা একটু দুর্মুখ হ'য়ে থাকে| সকাল বেলা চৌধুরী বাড়ীতে থাকমণি, তার মা আর বাপ এসে উপস্থিত, সঙ্গে এক জন মেছুনী| থাকির বাপ কিশোরী চৌধুরীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম ক'রে বাহির বাড়ীতে দাঁড়িয়ে রইল, থাকি আর তার মা মেছুনীকে সঙ্গে ক'রে বাড়ীর ভিতরে গেল| মেছুনী উঠানের মাঝখানে একটা মস্ত কালো মাছ ধপাস্ ক'রে ফেললে| বাড়ীর গিন্নী বল্লেন, এই যে থাকি আর থাকির মা! তা আবার মাছ এনেছিস কেন?
থাকির মা বল্লে, মা ঠাকরুণ, কাল দাদাবাবু না থাকলে কি আমার থাকি রক্ষী পেত? তা মা, মেছুনীকে সঙ্গে ক'রে দাদা বাবুর জন্য এই মাছটা-
এমন সময় পুঁটেরাম হাসতে হাসতে সেখানে এল| দেখে বল্লে, থাকির মা, না? সঙ্গে বুঝে থাকি? মাছ কার জন্য?
থাকির মা বল্লে, দাদা বাবু, তোমার জন্য| কাল তুমি থাকিকে বানের মুখ থেকে-
-থাক্ থাক্, সে কথায় কাজ নেই| তাই বুঝি আমার জন্য মাছের মুড়ো এনেছিস্?
থাকির পরণে খাট মোটা কাপড়, আঁচল টেনে মাথায় দিয়ে সে মাথা হেঁট ক'রে দাঁড়িয়ে রইল|
গিন্নী বললেন, তা বেশ, বেশ| মেছুনী মেয়ে মাছটা কুটে দে ত বাছা|
মেছুনী মাছ কুটতে বস্ল| পুঁটেরাম বাইরে গেল| কিশোরী চৌধুরী বল্লেন, পুঁটেরাম থাকির বাপ এসেছে|
পুঁটেরাম বল্লে, হ্যাঁ, থাকি আর তার মা বাড়ীর ভিতরে| আমার জন্য মস্ত একটা মাছ এনেছে|
কর্ত্তা হেসে বল্লেন, সত্যি না কি? হ্যাঁ রে ভীম, ও আবার কি?
ভীম হাড়ী বল্লে, কর্ত্তা মশায়, আপনাদেরই ত খাই| ছোট বাবু আমাদের মেয়ের প্রাণ রক্ষে কর্লেন তা যদি একটা মাছ-
পুঁটেরাম বল্লে, বেশ করেছিস, মাছ কোটা হচ্ছে, আজ আমাদের বাড়ী যগ্গি হবে|
ও দিকে মাছ কোটা হ'লে গৃহিণী মেছুনীকে চারটে পয়সা আর এক কুন্কে চাল দিলেন| থাকির মাকে বল্লেন, একটু দাঁড়া| ঘরের ভিতর থেকে একখানি নিজের পরণের সাড়ী আর পাতার ঠোঙ্গায় ক'রে এক ঠোঙ্গা খইয়ের চাঁপা এনে উঠানে রাখ্লেন| বল্লেন, এই কাপড়খানা থাকি পর্বে আর তার জন্য এই খাবার|
গিন্নীর দান মায়ে ঝিয়ে তুলে নিয়ে খুসী হ'য়ে ঘরে গেল|
* * *
যাত্রার অধিকারী হিমু রায়ের কাছে গিয়ে মল্লিক মশায় দেখ্লেন অধিকারী একখানি কোঠা ঘরের দাওয়ায় ব'সে হৃষ্টপুষ্ট বপুতে আভাঙ্ ক'রে সরিষার তেল মাখ্ছে| তেল মাখা হ'লে গঙ্গাস্নান কর্তে যাবেন| একখানা কোঠা ঘর আর এক খানা খড়ো ঘর, এই দুটী ঘরে যাত্রার দলের আড্ডা, দু দশ দিন পরে তারা আর এক গ্রামে চলে যাবে|
মল্লিক মশায়কে দেখে অধিকারী তেলমাখা হাতে নমস্কার ক'রে বল্লেন, আসতে আজ্ঞে হয়| বসুন, বসুন! ওরে নিমে, মল্লিক মশায়কে তামাক দে!
মল্লিক মশায় মাদুরে বসে বল্লেন, না, এখন আর তামাক খাব না, আপনাকে একটা কথা বলতে এসেছি|
-কি বলুন|
-এই কিশোরী চৌধুরীর ছেলে পুঁটেরাম আপনাদের এখানে যাওয়া আসা করে তার কথা| যাত্রার দলে ঢুকে সে কি করবে? বাপের এক ছেলে, পৈতৃক জোত জমা আছে, দশ ঘর প্রজা আছে, তা দেখবে না যাত্রার দলে মিশবে? আর সে একটা চোয়াড় ছোঁড়া বই ত নয়|
-সে কথা আমিও জানি| পুঁটেরামের একটা খেয়াল চেপেছে, না পারে গাইতে, না পারে সাজতে আমার দলে এসে ওর কি হবে?
-আমিও তাই বলি যে অধিকারী মশায় এমন বুদ্ধিমান লোক, পুঁটেরামকে নিয়ে ওঁর কি হবে? সেইটে যদি আপনি তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে থামাতে পারেন ত বড় ভাল হয়|
-তা আমি ঠিক বুঝিয়ে দেব, আপনারা কিছু ভাববেন না|
-তবে আমি গিয়ে তার বাপকে বলিগে| আপনার উপর তাঁর খুব আস্থা আছে| তবে আমি যে তাঁর কাছ থেকে এসেছি, কি আপনাকে কেউ কোন রকম উপরোধ-অনুরোধ করেছে, পুঁটেরাম যেন তা টের না পায়, বুঝলেন কি না?
-সে কথা আমাকে আর বল্তে হবে না| অমনতর ছেলে ছোকরা আমাদের কাছে কত আসে, সবাইকে কি আমরা দলে নি?
মল্লিক মশায় উঠে গেলে খানিক্ষণ পরে পুঁটেরাম এল| অধিকারী মশায়ের তেল মাখা তখন প্রায় শেষ হয়েছে, গামছা কাঁধে ক'রে উঠ্বার উদ্যোগ করছেন| পুঁটেরামকে দেখে হেসে বল্লেন, এই এখখুনি তোমার নাম হচ্ছিল, তুমি অনেক দিন বাঁচবে| তুমি যে মেয়েটাকে রক্ষে করলে সে কি কম বাহাদুরী?
-কে বলছিল আমার নাম?
-কে না বলছে? যার তার মুখে তোমার নাম| আমি তোমায় দেখে পর্য্যন্ত ঠিক করেছি যে তুমি মানুষের মত মানুষ হবে| তোমার মত লোক যাত্রার দলে আসা মিছে|
-কেন?
-এ ত কতকগুলো অকেজো ছোঁড়ার দল, কাজের বেলা কেউ নয়| আর দেখ, বল্লে তুমি রাগ কোরো না, তুমি তেমন ভাল সাজতে পারবে না, আর তোমার গলাও ত তেমন নেই|
পুঁটেরাম একটু রুক্ষ হেসে বল্লে, তা জানি, কোকিল পুড়িয়ে খেলেও আমার গলা হবে না|
-নাই বা হ'ল গলা! তুমি এক জন বীরপুরুষ হবে?
অধিকারী গঙ্গাস্নানে গেলেন| পুঁটেরাম বাড়ী গেল| পথে যেতে যেতে বল্লে, যাত্রাদলে আবার মানুষ যায়!

দিন দুই পরে যাত্রার দলের লোকেরা তল্লী-তল্লা বেঁধে আর এক গ্রামে গেল| সেখানে তারা বারোয়ারি পূজায় যাত্রার করবার বায়না পেয়েছিল| দলের দু চার জন যুবক আশা করেছিল যে তারা যাবার আগে পুঁটেরাম তাদের সঙ্গে দেখা করতে আসবে, কিন্তু তারা পুঁটেরামের টিকিও দেখতে পেলে না|
যাত্রার দল চলে গিয়েছে আর ছেলে তাদের নাম করে না দেখে পুঁটেরামের মা তাকে বল্লেন, বাবা, যাত্রাওয়ালাদের কাছে তুমি আর যাও না শুনলে ওঁর আহ্লাদ হবে|
পুঁটেরাম নাক সিঁটকে বা হাত নেড়ে বল্লে, রাম বল, ওদের দলে কে যায়? আমি অমনি দু চার বার দেখতে গিয়েছিলাম আর অমনি তোমরা সব ঠিক ক'রে বস্লে যে আমি যাত্রার দলে মিশব| খেয়ে দেয়ে আমার ত আর কাজ নেই!
ভরসা পেয়ে গিন্নী কর্ত্তাকে বল্লেন, ছেলের জন্য তুমি ভেব না, ও যাত্রার দলে মিশবে না, তাদের ঘেন্না করে|
কর্ত্তা বল্লেন, তারা গিয়েছে আপদ চুকেছে| মিছিমিছি সকলে হইচই করছিল; ছেলে ছোকরা অমন দশ জায়গায় গিয়ে থাকে, তা ব'লে কি যেখানে যাবে সেই দলে ভিড়তে হবে?
অন্নপূর্ণার গলিতে সর্ব্বমঙ্গলার মন্দির| পুঁটেরামের মা মানত রেখেছিলেন যে, ছেলে যদি যাত্রার দলে না মেশে, তা হ'লে তিনি সর্ব্বমঙ্গলার পূজা দেবেন| সেই দিন তিনি পূজা পাঠিয়ে দিলেন|
পঞ্চানন তলার যাদব রায় গ্রামের সব চেয়ে সঙ্গতিপন্ন লোক| বুনিয়াদী ঘর, জমিদারী, কাছারী বাড়ী, বাড়ীতে ঠাকুরবাড়ী, সদরে খিড়কীতে বড় বড় পুষ্করিণী, আম কাঁঠালের মস্ত বাগান| চকমিলান বাড়ী, দেউড়ীতে লোক জন দু চার জন লাঠিয়াল| বাড়ীতে দোল-দুর্গোৎসব হয়, সর্ব্বদা লোকের যাওয়া-আসা, সব সময় বাড়ী গম্গম্ করছে|
তাঁর ছেলে মাধব পুঁটেরামের সমবয়সী, ছেলেবেলা থেকে এক সঙ্গে খেলা ধূলা করত| বাড়ীতে মাধবের আলাদা মহল, সেখানে তার বয়স্যেরা জুটত, তাস, পাশা, দাবা খেলা হ'ত| যাদব রায় ছেলেকে কখন কিছু বলতেন না, কিন্তু তিনি রাশভারি মানুষ, বিনা ইঙ্গিতেই বাড়ীর সর্ব্বত্র তাঁর শাসন ছিল| মাধব কোন বিষয় বাড়াবাড়ি করতে সাহস করত না, আর সে স্বভাবতঃ একটু ভীতু, ছেলেবেলাও পুঁটেরামের মত ডানপিটে ছিল না|
একদিন সন্ধ্যার সময় পুঁটেরাম মাধবদের ওখানে যাচ্ছিল| পথে রায়েদের খিড়কীর পুকুর আগে পড়ে| তখন ঘোর ঘোর হয়েছে| এক সার নোনা গাছে এক ঝাঁক চড়াই পাখী ব'সে কিচ্ কিচ্ করছে, চালতা গাছের চ্যাটালো পাতায় আঁজি কাটা, আগডালে একটা হাড়ী-চাঁচা লাফাচ্চে| সাদা সাড়ীর চওড়া কালো পাড়ের মত পুকুর পাড়ে সাঁঝের আঁধার কালো বন, নারিকেল গাছের মাথায় অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে| সুপারি গাছের সারি যেন কোন দৈত্যের ঊর্ধ্বপুঙ্খ তীরের মত মাটীতে বিঁধে রয়েছে| একটা শিয়াল পুঁটেরামের দিকে চেয়ে দেখে আস্তে আস্তে বনে ঢুকল| পুরু ঘাসের মাঝে সরু পথ দিয়ে ঘুরে যেতে পুঁটেরাম দেখ্লে ঘাটে পইটের উপর ভিজে কাপড়ে একটা স্ত্রীলোক দাঁড়িয়ে রয়েছে| পুঁটেরাম যেমন হন্ হন্ ক'রে যাচ্ছিল সেই রকম চলে যেত কিন্তু সে দেখলে স্ত্রীলোকটি তার দিকে চেয়ে রয়েছে| মাথায় কাপড়ও টেনে দিলে না, পিছন ফিরেও দাঁড়াল না| পুঁটেরাম থমকে দাঁড়াল না বটে কিন্তু তার চলার তেজ কমে এল, চেয়ে চেয়ে দেখতে দেখতে চল্ল|
সন্ধ্যার কালো কোলে যেন অরুণবরণী ঊষাকন্যা দাঁড়িয়ে রয়েছে| গায়ে ভিজে কাপড় লেগে অঙ্গের গৌরবর্ণ ও উন্নত পূর্ণ গৌরব ফুটে ফেটে পড়ছে, একটু আড়ভাবে দাঁড়িয়ে গ্রীবা ঈষৎ বাঁকিয়ে নিঃশঙ্ক ফুল্ল নয়নে চেয়ে রয়েছে| কিছু মাত্র ত্বরা কিংবা সঙ্কোচ না ক'রে ধীরে ধীরে খিড়কীর দরজার দিকে গেল| এর আগে পুঁটেরাম সে যুবতীকে গ্রামে কখন দেখেনি?
মাধবের ঘরে অন্য দিন যেমন খেলা গল্প গুজব হয় সেই রকম হ'ল, পুঁটেরাম যেমন জোরে জোরে কথা কইত সেই রকম কইতে লাগল, সেই রকম মুক্ত কণ্ঠে হাসতে লাগ্ল| কিন্তু বাড়ী যাবার সময় সমস্ত পথে তার চোখের সামনে সেই আর্দ্রবসনলগ্ন রূপের ছবি লেগে রইল|

তরুণীর নাম চাঁপা, সে গ্রামে থাকে না| রায়দের গিন্নীর মামার বাড়ীর কাছে বাড়ী, বুড়ী দিদিমার কাছে থাক্ত| দিদিমার সঙ্গে ত্রিবেণীতে একটা যোগে স্নান করতে গিয়েছিল, ফিরে যাবার পথে দিদিমা মাধবের মার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, তিনি দেশের লোক দেখে যত্ন ক'রে তাদের নিজের কাছে দিন কতক রেখেছিলেন| তাঁর আপ্যায়নে দিদিমা-নাতিনী বত্তে গেল| এই সবে তারা দিন দুই এসেছে| চাঁপার কুলীনে বিয়ে হয়েছিল, তার দিদিমা গরীব, নাতজামাইয়ের সম্মানী কিছু দিতে পারত না, নাতজামাইও তাদের বাড়ীমুখো হ'ত না| স্বামীর সোহাগ কি শ্বশুর-ঘর করা চাঁপার কপালে লেখেনি|
তা সে জন্য আর যে যাই বলুক চাঁপা নিজের কপালের নিন্দা করত না| সে দিবা হাসি মুখে কাল কাটাত| বেশী লজ্জা সরম ছিল না, একটু যেন কি রকম কি রকম, একটু বেহায়া বলে তার অখ্যাতি ছিল| যে দিন পুকুর পাড়ে পুঁটেরাম তাকে দেখতে পায় তার পরদিন বিকেল বেলা সে পাড়ার আর কয়জন মেয়ের সঙ্গে গঙ্গায় গা ধুতে গেল| চাঁপা খুব ভাল সাঁতার জানত, অনেকক্ষণ সাঁতার দিয়ে উঠলে পর তার সঙ্গিনীরা থাকির জলে ডুবে যেতে যেতে রক্ষে পাবার গল্প জুড়ে দিল| চাঁপা বল্লে, বানের মুখে আমি অনেক বার পড়েচি, আমার ভয় করে না|
পাশে একটি মেয়ে চাঁপার গা টিপে বল্লে, ঐ যে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখছিস, থাকিকে সে দিন ঐ জল থেকে তুলেছিল|
চাঁপা চেয়ে দেখ্লে একটু দূরে পথের ধারে দাঁড়িয়ে পুঁটেরাম| পুকুর পারে যাকে দেখেছিল সেই| দুজনে আবার চোকোচোকি হ'ল| মেয়ের দল যেমন এগিয়ে গেল চাঁপা দু তিন বার ফিরে দেখলে পুঁটেরাম তার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রয়েছে|
পুঁটেরামকে যে এর আগে দেখেছিল চাঁপা সে কথার উল্লেখ করলে না| জিজ্ঞাসা করলে, ওকে?
একটা মেয়ে বল্লে, ও পুঁটেরাম| ওর নাম দামোদর, পুঁটেরাম ব'লে সবাই ডাকে| চৌধুরী পাড়ার কিশোরী চৌধুরীর ছেলে| যাত্রার দলে ঢুকবে ব'লে দিন কতক খেপেছিল|
-সত্যি?
-সে বাতিক এখন আর নেই, যাত্রার দল এখান থেকে চলে গিয়েছে|
-ওর বউ কি রকম দেখতে?
মেয়েরা খিল খিল ক'রে হেসে উঠ্ল, শোন কথা! বিয়েই হয় নি তার আবার বউ কেমন দেখতে! কোথায় এক জায়গায় সম্বন্ধ হয়েছিল সে সম্বন্ধ ভেঙ্গে গিয়েছে| আর এক জায়গায় না কি কথা হচ্ছে|
চাঁপা আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করলে না|
দিন দুই চার এই রকম গেল| চাঁপা অন্য মেয়েদের সঙ্গে বিকেল বেলা গঙ্গায় গা ধুতে যায়, ফিরতে সন্ধে হয়, পথে কোথাও না কোথাও পুঁটেরাম দাঁড়িয়ে থাকে| এক দিন ঘাট থেকে ফিরতে কিছু দেরী হ'য়ে গেল| চাঁপা অনেক ক্ষণ জলে ছিল, ডাকাডাকি করলেও ওঠে না| যখন সে উঠে এল তখন ঘোর ঘোর হ'য়ে এসেছে, মাথার উপর দিয়ে বাদুড় উড়ে যাচ্ছে, কাল পেঁচা ডাকছে? সে দিন পথে যেতে মেয়েরা পুঁটেরামকে দেখতে পেলে না|
একটি মেয়ে বল্লে, বাড়ী যেতে রাত হবে, আমরা সব বকুনি খাব| চাঁপা তোর কেমন আক্কেল!
চাঁপা বল্লে তা না হয় একদিন খাব! রোজ তো আর দেরী হয় না| আর পথে ত আর ডাকাত নেই যে আমাদের লুটে পুটে নেবে!
এক জন বল্লে, ভর সন্ধে বেলা অন্য ভয় নেই?
-কিসের আবার ভয়? আমি কাউকে ভয় করি নে|
তারা যেখান দিয়ে যাচ্ছিল সেখানে জনমানুষ ছিল না| দু পাশে বাগান, বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা, মাঝ খান দিয়ে সরু পথ, পাশাপশি দু' তিন জন যেতে পারে না| মেয়েরা একের পর আর এক জন, এই রকম ক'রে যাচ্ছিল|
পথের পাশে এক জায়গায় একটা বাঁশঝাড়| ঝাড়-বেড়ার ভিতর, পথের দিকে গোটা কতক বাঁশ হেলে আছে| তখন বেশ অন্ধকার, আর ঠিক সেই খানে ঝোপ পানা ব'লে কিছু বেশী অন্ধকার| চারি দিকে ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে, পথের মাঝ খানে, গাছের ভিতর জোনাকি উড়ছে, মানুষের কোথাও সাড়া নেই, চারিদিকে আর কোন শব্দ নেই| মেয়েদের কারুর মুখে কথা নেই, ভয়ে ভয়ে সব তাড়াতাড়ি চলেছে| দু জন এগিয়ে গিয়েছে আর চার পাঁচ জন পিছনে আসছে এমন সময় একটা বাঁশ পথের দিকে নুয়ে প'ড়ে আবার উপরে উঠে গেল! আবার আস্তে আস্তে নুয়ে পড়তে আরম্ভ হ'ল| সর্ব্বনাশ! রাত্রে অন্ধকারে ভূত ছাড়া আর কিসে এমন ক'রে বাঁশ নোয়াবে? মা গো! ব'লে মেয়েরা ছুটল| কারুর মুখে 'রাম' নাম বেরুল, কারুর দাঁত কপাটী লাগবার মত হ'ল|
পালাল না একা চাঁপা| সে পথে দাঁড়িয়ে দেখলে আর সকলে পালিয়ে গেল| তখন বেশ সহজ গলা ক'রে বল্লে, কে গা তুমি, রাত্রি বেলা মেয়েদের এমন ক'রে ভয় দেখাচ্ছ?
বেড়া টপকে পুঁটেরাম তার পাশে এসে দাঁড়াল| বল্লে, এই রকম একটা কিছু ফন্দি না করলে ত তোমাকে একলা পাবার যো নেই| তোমার সঙ্গে গোটা দুই কথা আছে|
-ভূতের কথা শুনে বলল যে গাঁ-সুদ্ধ তোলপাড় হবে সে কথা ভেবেছ? আমার সঙ্গে আড়ালে তোমার কি কথা? যা বলবার থাকে দু কথায় বল, আমাকে এখ্খুনি ওদের সঙ্গে যেতে হবে|
মেয়েরা আগে দৌড়ে যাচ্ছিল, একটু পরেই পিছনে পায়ের শব্দ শুন্তে পেয়ে এক জন হাঁপাতে হাঁপাতে বল্লে, ঐরে, এইবার তেড়ে এসে ধরবে! রাম-রাম, রাম-রাম!
পিছনে থেকে শব্দ এল, ওলো ভয় নেই, আমি চাঁপা! তোরা একবার দাঁড়া| চাঁপা এলে এক জন বল্লে, কি ভাগ্যি তুই রক্ষে পেয়েছিস! আমরা ভাবলাম বুঝি তোর ঘাড় মটকে থুয়েছে!
-মাঙনা পেয়েচে কি না, ঘাড় মটকালেই হ'ল! তোরা আর অমন ক'রে ছুটিস্ নে| এমনি ক'রে হাঁপাতে হাঁপাতে কি বাড়ী যাবি? কথা বলি শোন্|
চাঁপা খল্ খল্ ক'রে হেসে উঠ্ল| তার হাসি শুনে অন্য মেয়েদের ধড়ে প্রাণ এল| চাঁপা বল্লে, তোরা ভেবেছিলি ভূত না?
মেয়েরা ভয়ে আড়ষ্ট হ'য়ে জড়াজড়ি ক'রে বল্লে, রাম রাম, নাম করতে নেই, রাম নাম কর্|
-তোরা ত ভয়ে পালিয়ে এলি| আমি অন্ধকারে উঁকি মেরে দেখি বাঁশগাছে একটা হনুমান বসে রয়েছে, থেকে থেকে বাঁশটা নোয়াচ্ছে|
রামচন্দ্রের পরম ভক্ত পবননন্দনের সঙ্গে নিজের অভিন্ন সাদৃশ্য জানতে পারলে পুঁটেরাম কি বল্ত তা অনুমান করা যায় কিন্তু ঠিক বলতে পারা যায় না|
চাঁপার সঙ্গিনীরাও তখন হাসতে লাগ্ল| চাঁপা বল্লে, বাড়ী গিয়ে কারুর কিছু বলবার আবশ্যক নেই| যেন কিছুই হয় নি|
এই পরামর্শ ঠিক হ'ল|

সেই রাত্রে যাদব রায়ের বাড়ী ডাকাত পড়ল| রাত্রি তখন দুটো, কৃষ্ণ পক্ষের ত্রয়োদশী| চারি দিকে নিশুতি, কেউ কোথাও জেগে নেই| বাড়ীর সাম্নে এসে মশাল জ্বেলে 'রে-রে' শব্দে ডাকাতেরা বাড়ী ঘেরাও করলে| সদর দরজায় যে কয়জন লাঠিয়াল পাহারায় ছিল লাঠি হাতে তারা বেরুতেই ডাকাতেরা তাদের মাথা ফাটিয়ে দিলে| ভিতর থেকে ফটক বন্ধ হ'য়ে গেল, ভিতরে যারা ছিল তারা কতক দরজা থেকে গজালের মাথা খুলে ছোট ছোট বর্শা চালাতে লাগ্লে, কতক ছাদের উপর উঠে বড় বড় থান ইট ডাকাতদের উপর ছুঁড়তে লাগল|
ডাকাতদের মালকোঁচা আঁটা, খোলা গা, গায় তেল চক্ চক্ করছে| দুজন দুইটা কুড়াল নিয়ে দরজা চিরে ফেলবার চেষ্টা করতে লাগ্লে, এক জনের বুকে দরজার ভিতর থেকে এমন সড়কি বিঁধে গেল যে সে আর্ত্তনাদ ক'রে প'ড়ে গেল, তৎক্ষণাৎ দুজন ডাকাত তাকে তুলে নিয়ে গেল, আর এক জন কুড়াল নিয়ে দরজা কাট্তে লাগল| বাইরে ডাকাতদের হৃৎকম্পকারী বিকট চীৎকার, ভিতরে গৃহস্থের ছেলে মেয়ে, স্ত্রীপুরুষ, লোকজনের ভীতিপূর্ণ চেঁচামেচি| বাতাসে মশালের আলো কাঁপছে, মাটীতে ভূতের মত ছায়া নৃত্য করছে, গাছের পাতায় আলো চিক্ চিক্ করছে, ভীষণ কোলাহলে কাকগুলো কা কা ক'রে অন্ধকারে উড়ে বেড়াচ্ছে|
বাড়ীর সামনে পাঁচ হাত রসি লম্বা জায়গা জুড়ে ঘাটির পাক ফিরছে| লম্বা দেড়হাড়া জোয়ান, লোহার মত আঁটালো শরীর, হাতে খোলা তলোয়ার, মণ্ডলাকারে বিদ্যুদ্বেগে মাথার উপর ঘুরছে| এক মোড় থেকে আর এক মোড় পর্য্যন্ত ঘুরতে ঘুরতে, তলোয়ার খেলাতে খেলাতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, আর সেই সঙ্গে তার ভীম গর্জ্জন ভীষণ উৎকট তালে উঠ্ছে নামছে| রে-রে রে-রে একটা রব তার কণ্ঠ থেকে অবিশ্রান্ত নিঃসৃত হচ্ছে, এক একবার সে শব্দ আকাশ ভেদ ক'রে ওঠে আবার স্বর কিছু নরম হয়| পাড়ার লোক দূরে জড় হ'তে আরম্ভ হ'ল কিন্তু কার সাধ্য পুঁটেরাম কারুর নিষেধ না শুনে তার সমবয়স্ক এক দল যুবক নিয়ে লাঠি হাতে এল, ডাকাতদের সঙ্গে তাদের লাঠালাঠি হবার উপক্রম হচ্ছে, এমন সময় সকলে সভয়ে দেখলে সমুদ্যত খড়গধারিণী করাল কালীরূপিণী রমণী-মূর্ত্তি বেগে সেই দিকে আসছে| নীলাম্বরী সাড়ী অন্ধকারে কৃষ্ণবর্ণ, মুক্ত, কুঞ্চিত কৃষ্ণ কেশ হাঁটুর উপর পড়েছে, কপাল-জোড়া সিঁদুর টক্ টক্ করছে, হাতে খাঁড়া মশালের আলোকে ঝক্ ঝক্ করছে! বিশাল নয়নে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, ক্রোধপ্রদীপ্ত রণরঙ্গিণী সংহার-মূর্ত্তি! সঙ্গে সঙ্গে আলোয় অন্ধকারে আন্দোলিত ছায়ায় যেন ভৈরবীর দল নৃত্য করতে করতে আসছে|
নৈশস্তব্ধতাবিদায়ী সেই ঘোর কোলাহল স্তব্ধ হ'য়ে গেল| ঘাটির পাকের তলোয়ার হাত থেকে নুয়ে পড়ল, সে পাষাণ মূর্ত্তির মত নিস্পন্দ হ'য়ে দাঁড়িয়ে রইল| ডাকাতদের সর্দ্দার ডেকে বল্লে, ও মূর্ত্তি দেখে এখানে আর থাকা নয়! মাছ পড়বে না রে, শুধু জাল গুটো!
যাদের হাতে মশাল ছিল তারা মশাল ফেলে দিলে| মাটীতে প'ড়ে জ্বলে জ্বলে মশাল নিভে যেতে লাগ্ল| ডাকাতেরা নিঃশব্দে অন্ধকারে মিশিয়ে গেল|
মশালের আলোকে সেই মসিময় অঙ্গ ও উজ্জ্বলানন মূর্ত্তিতে পুঁটেরাম চিনেছিল-চাঁপা!
ডাকাতেরা শুধু হাতে চলে গেছে এ কথা বাড়ীর লোকে সহজে বিশ্বাস করে না, তার পর বাইরের লোকের কথা শুনে আশ্বস্ত হ'য়ে দরজা খুলে দিলে| কালীমূর্ত্তি দেখে ডাকাতেরা পালিয়েছে শুনে বাড়ীর মেয়েরা পর্য্যন্ত বেড়িয়ে এল| এ দিকে ডাকাতেরা চলে যেতেই চাঁপার খাঁড়া প'ড়ে গেল, সে ঠক্ ঠক্ ক'রে কাঁপতে কাঁপতে প'ড়ে যায় দেখে পুঁটেরাম ছুটে গিয়ে তাকে ধ'রে ধীরে ধীরে ঘাসের উপর শোয়ালে| চাঁপা মূর্চ্ছিত হ'য়ে পড়ল! একজন লোক তাড়াতাড়ি একটা মশাল তুলে ধরলে| মূর্চ্ছা বেশী-ক্ষণ রইল না| আবার যখন চাঁপা চোখ মেল্লে তখন পুঁটেরামের চোকে তার চোক মিলল| সে যেন কি কথা বলবার জন্য অল্প মুখ খুল্লে, ঠোঁটও নড়ল, কিন্তু কোন কথা বেরুল না| কিন্তু তার ঠোঁট নড়া দেখে পুঁটেরাম বেশ বুঝতে পারলে সে বল্লে, দামোদর-পুঁটেরামের ভাল নাম| মেয়েরা আসছে দেখে পুঁটেরাম স'রে গেল|
দেবীকে যেমন ঘরে নিয়ে যায় সেই রকম সকলে চাঁপাকে বাড়ীর ভিতর নিয়ে গেল| যাদব রায় এসে বললেন, তুমি আমার ঘরে রক্ষেকালী হ'য়ে এসেছিলে মা, আজ তুমি আমাদের রক্ষে করলে| এ উপকার আমি কেমন ক'রে শুধব?
পাশে একজন বুড়ী বললেন, আর কখন এ বাড়ীত কোন ভয় হবে না| কালীমূর্ত্তি দেখলে সে বাড়ীতে আর কখন উৎপাত হয় না|
কর্ত্তা চলে গেলে গিন্নী আর দুএক জন চাঁপাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কোন ভরসায় ওরকম ক'রে গেলে? তোমার কি প্রাণে ভয় হয় নি? চাঁপা তখন উঠে বসেছে| বল্লে, কি মনে হয়েছিল বল্তে পারিনে| আমি ছাদে দাঁড়িয়ে আছি আর কে যেন আমার কাণে কাণে বল্লে-'যা, মা-কালীর মত সেজে মায়ের খাঁড়া নিয়ে যা| ঠাকুর ঘরের পাশে ছোট ঘরে খাঁড়া ঝুলান আছে|' তার পর কখন যে কি করেছি আমার মনে নেই| যেমন স্বপন দেখে স্বপনের ঘোরে কিছু করে সেই রকম|
সেই দিন থেকে বাড়ী সুদ্ধ লোক চাঁপার জন্য ব্যস্ত হ'য়ে উঠল| গিন্নী তাকে নিজে বসিয়ে খাওয়াতেন, কর্ত্তা দিনে দশ বার খোঁজ নিতেন| চাঁপারও স্বভাব যেন বদলে গেল| সে আর গঙ্গার ঘাটে যেতনা, খিড়কীর পুকুরে গা ধুত, আগের মত হাসিখুসী, ঠাট্টাতামাসাও করত না| চাঁপার দিদিমা বাড়ী যাবার কথা বললে গিন্নী বল্তেন, এত তাড়াতাড়ি কিসের? দু'দিন আরও আমাদের কাছে থাক|
পাঁচ ছয় দিন এই রকম ক'রে কেটে গেল| আর তার পর এক দিন সকাল বেলা চাঁপাকে দেখতে পাওয়া গেল না! চার দিকে খোঁজ হ'ল কোথাও তার কোন সন্ধান পাওয়া গেল না| কেউ বললে তাকে, 'নিশি'তে ডেকে নিয়ে গিয়েছে, কেউ বল্লে মা-কালী তাকে নিয়েছেন|
সঙ্গে সঙ্গে পুঁটেরামও নিরুদ্দেশ হ'ল| কত খোঁজ হ'ল, কত জায়গায় লোক গেল, সে যে কোথায় চলে গেল, তা কিছুই জানা গেল না|

                                      ( 'কল্লোল' পত্রিকা, বৈশাখ, ১৩৩০ )

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)


Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।

সেকালের জনপ্রিয় লেখক ও তাঁদের লেখা

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ