প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

ঔপন্যাসিক

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

        [ লেখক পরিচিতি : প্রভাতকুমারের জন্ম ১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দের ২৭শে (২৫শে?) জুলাই নদীয়ার রানাঘাটে| পিতা নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মাতা গিরিবালা দেবী| রানাঘাট পালচৌধুরী বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু| এরপর চলে যান উকিল পিতার কর্মক্ষেত্র বিহারের গিরিডিতে| সেখানে ১৯০৬ সালে তিনি গিরিডি ন্যাশনাল স্কুলে ভর্তি হন| ১৯০৭-এ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগ দেবার জন্য গিরিডি স্কুল থেকে বিতাড়িত হন| ১৯০৮ সালে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের (বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়) পরীক্ষায় পঞ্চম স্থান অধিকার করে দশ টাকা বৃত্তি পান| শিক্ষক হিমাংশুপ্রকাশ রায়ের সঙ্গে তিনি শান্তিনিকেতনে আসেন; হিমাংশুপ্রকাশ তাকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন| রবীন্দ্রনাথের স্নেহের স্পর্শ প্রভাতকুমারকে আপ্লুত করে| সেই থেকেই তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতনের স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে ওঠে| প্রভাতকুমারের ২২ বছরের জন্মদিনে কবি স্নেহাশীর্বাদ জানিয়ে এই কবিতাটি রচনা করেন -
         প্রভাতের পরে দক্ষিণ করে
         রবির আশীর্বাদ -
         নূতন জনমে নব নব দিন
         তোমার জীবন করুক নবীন
         অমল আলোকে দূর হোক লীন,
         রজনীর অবসাদ|

       বাবার মৃত্যু ও অন্যান্য কারণে প্রথাগত শিক্ষালাভ তার আর হয়ে ওঠে নি| ১৯০৯ সালে প্রভাতকুমার শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রমে যোগ দিয়ে সেখানেই থাকতে শুরু করেন| মাঝে বছর খানেক (১৯১৭-১৮) তিনি সিটি কলেজের গ্রন্থাগারিক হয়ে কাজ করলেও কবির আহ্বানে আবার শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেন এবং পঞ্চাশ টাকা বেতনে কাজে যোগ দেন| পাঠভবনের শিক্ষক ও গ্রন্থাগারিক পদেও তিনি কাজ করেছেন| ১৯২৬ সালে অধ্যাপক নিযুক্ত হন|
১৯১২ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় তার 'প্রাচীন ইতিহাসের গল্প'| ইতিহাস ছিল প্রভাতকুমারের খুব প্রিয়| এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি পুস্তক তিনি রচনা করেছেন| রবীন্দ্রনাথই সম্ভবত প্রথম চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা ও পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছেন| ১৯২১ সালে খ্যাতিসম্পন্ন ফরাসি পণ্ডিত সিলভা লেভি ভারতে এলে তার কাছে চীনা ও তিব্বতী ভাষা শিখে গবেষণা শুরু করেন প্রভাতকুমার| গবেষণার বিষয় ছিল - বৌদ্ধ ও হিন্দু দর্শনের সমগ্র চীনা ভাষা| ইতালীর প্রখ্যাত প্রাচ্য ভাষাবিদ জোশেফ তুচ্চির কাছে চীনের বিশিষ্ট দার্শনিক কনফুৎসুর রচনা পাঠ করে তা অনুবাদ করেন| এ সব বিষয় নিয়ে ১৯৩১ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত বই Indian Literature in China and Far East| ১৯৩৩ সালে প্রভাতকুমারের বর্মা পরিভ্রমণের সময় ইংরেজ প্রাচ্যবিদ ড: লুসো তাকে দেখে বলেছিলেন -"I know you. Your book is on my table." বিশ্বভারতীর ঐক্যের তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে ১৯৬৬ সালে তিনি রচনা করেন 'পৃথিবীর ইতিহাস'| তার আর একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল ১৯৭২ সালে প্রকাশিত 'রামমোহন ও তৎকালীন সমাজ ও সাহিত্য'|

        গ্রন্থাগারিক হিসাবেও প্রভাতকুমারের অবদান প্রশংসনীয়| বিশ্বভারতীর গ্রন্থাগার গঠন ও সম্প্রসারণে তার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে| ১৯৫৪ সালে সেখান থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন| 'বাংলা গ্রন্থ বর্গীকরণ' ও 'বাংলা দশমিক বর্গীকরণ' বই দুটি গ্রন্থাগার বিষয়ে তার উল্লেখযোগ্য সংযোজন| তিনি ভারতীয় গ্রন্থাগার পরিষদের সহ-সভাপতি এবং বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদের সভাপতিও ছিলেন| গ্রন্থাগারিক ছিলেন বলে কবিগুরু তাকে পরিহাস ছলে সম্বোধন করতেন বৈবাহিক (বই-বাহিক) বলে|

       প্রভাতকুমারের জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি চার খণ্ডে তার রবীন্দ্রজীবনী রচনা| তিনি লিখেছেন -"১৯০১ সালের শেষ দিকে আমি রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে আসি| তারপর দীর্ঘ ৩২ বছর রবীন্দ্রনাথকে দেখবার, জানবার, তার কথা শোনবার, অপার স্নেহ পাওয়ার, কবির সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক এমন কি সভা সমিতিতে তার বিরোধিতা করার সুযোগ পেয়েছিলাম| ....... লাইব্রেরিতে আমার ঘরে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে যে সব লেখা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হত তা রাখা থাকত| রবীন্দ্রনাথ সে সব লেখার ক্লিপিং আমার হেফাজতে রেখেছিলেন| আমি একজন সহকারীর সাহায্যে সেগুলো সাজানো গোছানো করতাম| তারপর খণ্ডে খণ্ডে তা বাঁধিয়ে রাখা হত| এইসব কার্তিকা খণ্ডগুলির দিকে তাকাতাম আর ভাবতাম এগুলিকে ব্যবহার করব না? সেগুলি হল আমার রবীন্দ্রজীবনী লেখার প্রেরণা|" চার খণ্ড শেষ করতে সময় লেগেছে পঁচিশ বছর (১৯২৯-৫৪)| প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯৩৩-এ এবং একমাত্র সেটিই রবীন্দ্রনাথ দেখে যেতে পেরেছেন| রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে তার অন্যান্য বই - 'রবীন্দ্র গ্রন্থপঞ্জী' (১৩৩৯), 'রবীন্দ্র জীবনকথা', 'রবীন্দ্রনাথের চেনাশোনা মানুষ', 'রবিকথা', 'শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতী', 'গীতবিতান-কালানুক্রমিক সূচী' (সুধাদেবীর সঙ্গে যুগ্মভাবে), 'রবীন্দ্র গ্রন্থ পরিচিতি', ইত্যাদি| 'রবীন্দ্র জীবনকথা' অনুবাদ করেছেন অধ্যাপক শিশির কুমার ঘোষ - 'Life of Tagore' নামে| এ ছাড়া তার রচিত অন্যান্য গ্রন্থ - 'ভারতের জাতীয়তা', 'ভারত পরিচয়' (১৩২৮), 'ভারতের জাতীয় আন্দোলন' (১৩৩১), 'প্রাচীন ইতিহাসের গল্প' (১৩১৯), 'বঙ্গ পরিচয়' ২খণ্ড (১৩৪২, ১৩৪৩), 'ভারত পরিচয়' (১৩২৮), 'চীনে বৌদ্ধ সাহিত্য', 'জাতীয় পরিষদের দিনগুলি', 'বাংলা ধর্মসাহিত্য', 'ফিরে ফিরে চাই' (আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ) ইত্যাদি| ১৯৬২ সালে সোভিয়েত বিজ্ঞান আকাদেমির আমন্ত্রণে তিনি রাশিয়া যান; ফিরে এসে লেখেন একটি বই 'সোভিয়েত সফর'|

        অবসর গ্রহণের পর প্রভাতকুমার শান্তিনিকেতনের উপকণ্ঠে ভুবনডাঙায় নিজস্ব বাড়িতেই কাটিয়েছেন| তিনি পল্লী-সংগঠকের ভূমিকাও পালন করেছেন| এক সময়ে ভুবনডাঙার বিশাল জলাশয় পাঁক জমে অব্যবহার্য হয়ে যায়| গ্রামবাসী ও বিশ্বভারতীর কর্মীদের সহযোগিতায় পঁচিশ বিঘার সেই বিশাল জলাশয়টি পরিষ্কার করে পানীয় জলের সুবন্দোবস্ত করতে প্রভাতকুমার নেতৃত্ব দেন| প্রভাতকুমারের স্ত্রী সুধাময়ী দেবী ছিলেন পণ্ডিত সীতারাম তত্ত্বভুষণের কন্যা এবং শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্রী| স্থানীয় অঞ্চলে নারীশিক্ষা প্রসারে তাদের উভয়েরই উদ্যম প্রশংসনীয়|
স্মরণীয় অবদানের জন্য জীবনে বহু পুরস্কার ও সম্মান লাভ করেছেন প্রভাতকুমার| রবীন্দ্র জীবনী লিখে রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি| যাদবপুর, বিশ্বভারতী, বর্ধমান ও উত্তরবঙ্গ তাকে ডি.লিট দিয়ে সম্মানিত করেছে| ১৯৬৫ সালে বিশ্বভারতী থেকে পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সম্মান 'দেশিকোত্তম'| ১৯৮১ সালে ভারত সরকারের তাকে 'পদ্মভুষণ' প্রদান করে| এশিয়াটিক সোসাইটি তাকে 'রবীন্দ্র শতবার্ষিকী ফলক' দিয়ে সম্মান জানায়|
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কৃতবিদ্য প্রভাতকুমার ১৯৮৫ সালের ৭ই নভেম্বর ৯৩ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন|
     ( লেখক পরিচিতি প্রস্তুত করতে অন্যান্য সূত্র ছাড়াও স্বপনকুমার ঘোষের রচনার সাহায্য নেওয়া হয়েছে| মূল বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে )|

                                      দীপক সেনগুপ্ত|


       কলিকাতার কোনও একটি মেসের বাসায়, নবীন ঔপন্যাসিক নগেনন্দ্রবাবু বসিয়া তাঁহার নূতন উপন্যাসের শেষ সংশোধন করিতেছিলেন| ভাদ্রমাস, বরিবার, বেলা নয়টা, আকাশে মেঘ থমথম করিতেছে| একটুও বাতাস নাই, মাঝে মাঝে তাঁহার ললাট হইতে ঘর্মবিন্দু ঝরিয়া প্রুফশীটের উপর পড়িতেছে| মাঝে মাঝে প্রুফগুলার উপর দোয়াত চাপা দিয়া, পার্শ্বস্থ পাখা খানা উঠাইয়া লইয়া নগেন্দ্র বাবু নিজেকে বাতাস করিতেছেন; আবার সংশোধন কার্য্যে মনোনিবেশ করিতেছেন| সম্মুখে পূজা, বহিখানি এই সপ্তাহেই বাহির করা প্রয়োজন|

        এই নগেন্দ্র বাবুর বয়স ২৬ বৎসর মাত্র| নিবাস, পাবনা জেলার কোনও এক দূরে পল্লীগ্রামে| আই-এ পরীক্ষায় একবার ফেল করিয়া, আর পড়িবার সঙ্গতি হয় নাই-বাড়ীর অবস্থা ভাল ছিল না - অনেক চেষ্টা চরিত্র ও সহি-সুপারিসের বসে গ্রিন্লে ফিওর কোম্পানির আপিসে চারি বৎসর হইল সামান্য বেতনে কেরাণীগিরি কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন; এখন বেতন ও পদবৃদ্ধি হইয়াছে| অস্বচ্ছল অবস্থায় বিবাহ করা অনুচিত বলিয়া দেশস্থ আত্মীয়গণের প্রবল অনুরোধ সত্ত্বেও আজও বিবাহ করেন নাই|

        বাল্যকাল হইতেই নগেন্দ্র বাবুর মনে ঔপন্যাসিক হইবার প্রবল আকাঙ্খা ছিল| চাকরিতে ভর্ত্তি হইয়া প্রথম বৎসরে তিনি একখানি উপন্যাস রচনা করিয়া, মাসিকপত্রে প্রকাশিত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন; কিন্তু কোনও সম্পাদকই তাহা গ্রহণ করিতে সম্মত হন নাই| এই কারণে বৎসর খানেক ধরিয়া তিনি ভগ্নোদ্যম হইয়া বসিয়াছিলেন| তার পর বঙ্গসাহিত্য উপন্যাসের "আর্ট"-এর যুগ আরম্ভ হইল| এবং যাঁহারা "আর্ট" মূলক উপন্যাস লিখিতে লাগিলেন, তাঁহাদের পুস্তক (বিশেষ করিয়া বিদ্যালয়গামী বালক ও তরুণ যুবকগণের মধ্যে) হু হু করিয়া বিকাইতে লাগিল| এই উপন্যাসগুলি নানা কাগজে যতই "অশ্লীল" বলিয়া গালি খাইতে লাগিল, ততই ইহাদের কাট্তি বাড়িতে লাগিল|

       ইহা দেখিয়া, নগেন্দ্রবাবুও আবার খাতা বাঁধিলেন| ৩/৪ মাস পরিশ্রম করিয়া আর্টমূলক একখানি উপন্যাস লিখিলেন| ইহাতে তিনি দেখাইলেন স্ত্রীলোকের সতীত্ব এমন কোনই মূল্যবান জিনিষ নহে, যাহার জন্য প্রাণপাত করিতে হইবে| পুরুষেরা যে স্ত্রীলোকের সতীত্ব সতীত্ব বলিয়া চীৎকার করিয়া থাকে, তাহার মূলে ঘোর স্বার্থপরতা ছাড়া আর কিছুই নাই| শাস্ত্র ও সমাজ মিলিয়া ষড়যন্ত্র করিয়া এতকাল স্ত্রীজাতির প্রতি যে অত্যাচার করিয়া আসিয়াছে, এ নূতন আলোর যুগে আর তাহা চলিবে না| পুরুষেরা যেমন যা-খুশী করিবার অধিকার আছে, স্ত্রীলোকেরও সেইরূপ অধিকার থাকাই ন্যায়সঙ্গত-ইত্যাদি| লিখিলেন বটে, তাহাতে আর্টও কিছু রহিল বটে, কিন্তু আর্টের "নগ্নচিত্র" তাহাতে তেমন ভাল করিয়া ফুটিল না| হাজার হোক ভদ্রলোকের ছেলে, কতকটা লেখাপড়াও শিখিয়াছেন, তাই একটু সঙ্কোচের হাত এড়াইতে পারিলেন না| কিন্তু তৎসত্ত্বেও, একজন উদ্যমশীল প্রকাশক বহিখানি ছাপাইবার ভার লইলেন, পুস্তকের মধ্যে আর্টের যেটুকু অভাব ছিল, প্রকাশক তাহা বিজ্ঞাপনের দ্বারা পরিপূরণ করিয়া, বৎসর না ঘুরতেই প্রথম সংস্করণ কাটাইয়া দ্বিতীয় সংস্করণ বাহির করিলেন| কিছু টাকাও নগেন্দ্রবাবুর করতলগত হইল|

        এইরূপ উৎসাহ পাইয়া, নগেন্দ্রবাবু তাঁহার এই তৃতীয় উপন্যাস খানি রচনা করিয়াছেন| এবার, পূর্ব্ব সঙ্কোচ অনেকটা কাটাইয়া উঠিয়াছেন - বেশ "নির্ভীক" ভাবেই এবার আর্টের "নগ্নচিত্র" অঙ্কিত করিয়াছেন| এই উপন্যাসে তিনি দেখাইয়াছেন, আমাদের মূর্খ অন্ধ সমাজ যাহাদিগকে পতিতা বলিয়া দূরে ঠেলিয়া রাখিয়াছে, তাহারাই যথার্থ স্বর্গের দেবী - তাহাদের হৃদয়গুলি কুসুমের মত কোমল ও পবিত্র - দয়া, মায়া, স্নেহ, মমতা, পরদুঃখকাতরতা, আত্মমর্যাদাবোধ প্রভৃতি সদ্গুনাবলীতে তাহারা ভূষিত; অপর পক্ষে গৃহস্থ মেয়েদের মন অতি নীচ, সঙ্কীর্ণ; তাহারা নিতান্ত সার্থপর, ক্রোধী, কটুভাষিণী - এককথায়, তাহাদের হাড়ে-হাড়ে বজ্জাতী|

       নগেন্দ্রবাবু বসিয়া বসিয়া প্রুফ দেখিতে লাগিলেন, ক্রমে দশটা বাজিল, সাড়ে দশটা বাজিল| ঝি আসিয়া স্নানের জন্য তাগাদা জানাইল; নগেন্দ্রবাবু সে কথা কানে তুলিলেন না| ক্রমে সুধীর নামক একজন সুদর্শন যুবা আহারান্তে পান চিবাইতে চিবাইতে আসিয়া তাঁহার পাশে বসিল| বলিল, "দাদা, আর বাকী কত?" - সুধীরও এই বাসাতেই থাকে|

      নগেন্দ্রবাবু অসংশোধিত কাগজগুলি গুনিয়া বলিলেন, "আর চার শীট আছে|"
     সুধীর বিনীত মিনতির স্বরে বলিল, "স্নান আহার করে' ওগুলো দেখলে হত না?"

      নগেন্দ্র বলিল, "দেরী হয়ে যাবে যে ভাই| আজকেই তারা পেজ বেঁধে অর্ডার প্রুফ দেবে বলেছে, সেইজন্যেই আজ রবিবার হলেও ছাপাখানায় লোক বের করেছে| কালই তারা ছাপা শেষ করতে চায়| বইখানা যাতে এই হপ্তার মধ্যে বেরিয়ে যায়, তার জন্য প্রকাশক তাদের কড়া তাগাদা দিচ্ছেন|"

      সুধীর বলিল, "আচ্ছা দাদা, এক কাজ করুন না| আপনি স্নানাহার করতে যান, প্রুফ যতগুলো দেখা হয়েছে, আমি এখনই গিয়ে ছাপাখানায় দিয়ে আসছি| ততক্ষণ তাদের কাজ চলুক| বলে' আসবো আর ঘন্টা দুইয়ের মধ্যে বাকীটুকু দিয়ে যাব|"

      নগেন্দ্র বলিল, "এই রোদ্দুরে, দু'দুবার তুমি সেই দর্জ্জিপাড়া হাঁটাহাঁটি করবে? তার চেয়ে বরঞ্চ, আধঘন্টা খানিক বস, শেষই করে দিই-একেবারে নিয়ে যেও|"

      সুধীর বলিল, "না দাদা দু'বার প্রেসে যেতে আমার কোন কষ্টই হবে না| আপনি উঠুন, 'স্নান করে' ভাত খান| কলের জল ত বহুক্ষণ চ'লে গেছে, চৌবাচ্চার জলও তলানি পড়ে গেছে| ভাতও প্রায় শুকিয়ে উঠলো|"
এই সুধীর, কলেজের একজন ছাত্র এবং নগেন্দ্র বাবুর একজন পরম ভক্ত| কেহ নগেন্দ্রনাথের লেখা নীতিবিগহিত বলিয়া নিন্দা করিলে সুধীর তাহার সহিত কোমর বাঁধিয়া লাগিয়া যায়; - বলে "তোমরা সব পেঁচার জাত, এতকাল অন্ধকারেই অভ্যস্থ ছিলে; এখন সাহিত্যের এই নবযুগের আলো দেখে কিচির মিচির আরম্ভ করেছে|" আরও কত কি বলে|

       ভক্তের সনির্ব্ব্ন্ধ অনুরোধ উপেক্ষা করিতে না পারিয়া, নগেন্দ্র উঠিল| সংশোধিত শীটগুলির পত্রাঙ্ক মিলাইয়া, পিনে গাঁথিয়া, সুধীরের হস্তে দিয়া, স্নানার্থ প্রস্তুত হইতে লাগিল| সুধীর প্রুফগুলি লইয়া প্রেসে দিতে গেল|

        নগেন্দ্রনাথের নূতন উপন্যাস "সমাজদ্রোহী" প্রকাশিত হইয়াছে| সপ্তাহ খানেক পরে, আপিসের ফেরৎ একদিন বিকালে নগেন্দ্র তাহার প্রকাশকের দোকানে আসিয়া দর্শন দিল| প্রকাশক মহাশয় তখন তাঁহার খাস কামরায় বসিয়া চা পান করিতেছিলেন, সংবাদ পইয়া নিজে আসিয়া নগেন্দ্রনাথকে অভর্থনা করিয়া লইয়া গিয়া, চেয়ারে বসাইয়া বলিলেন, "এক পেয়ালা চা দিক?" নগেন্দ্র সম্মতি জানাইলে প্রকাশক মহাশয় হাঁকিলেন, "ওরে নগেন বাবুকে এক পেয়ালা চা দে; আর আমার জন্যেও আর এক পেয়ালা আনিস|"

       নগেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, "সমাজদ্রোহী কিরকম বিক্রী হচ্চে?"

      প্রকাশক বলিলেন, "বেশ টানছে|" এই এক সপ্তাহ ত বই বেরিয়েছে? এরই মধ্যে প্রায় ২৫০ গেছে| পূজোর মধ্যে ৪/৫ শো কেটে যাবে বোধ হয়|"
     শুনিয়া নগেন্দ্রর মনটি পুলকিত হইয়া উঠিল| জিজ্ঞাসা করিল, লোকে কেমন বলেছে?"
     প্রকাশক বলিলেন, "তা-ভালই বলেছে| কিন্তু কেউ কেউ আবার বলছে, অন্য সব জায়গা ভাল হয়েছে, কিন্তু গণিকা-চরিত্রগুলো ভাল হয়নি|"

      নগেন্দ্র একটু শ্লেষের হাসি হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, "রুচিবাগীশ মহাশয়েরা বুঝি?"

      প্রকাশক ধীরে ধীরে উত্তর করিলেন, "না, তারা রুচিবাগীশ দলের লোক নয়| বরং একটু-অর্থাৎ-ইয়ে দলের| তারাই ত বেশীভাগ খদ্দের কিনা| তারা বলেছে, "মশায় নগেন বাবু ঐ যে গণিকা চরিত্রগুলি এঁকেছেন, ও সাফ কল্পনা| তাদের চাল চলন কি ঐরকম, না তাদের কথাবার্ত্তা ঐরকম রবিঠাকুরী ধাঁজের ? নগেন্দ্র বাবু বোধ হয় জ্যান্ত গণিকার সঙ্গে কখনও কারবার করেন নি; তাই তাদিকে, এমন অদ্ভুত করে এঁকেছেন| চিত্রগুলি যদি বাস্তব হত, তা'হলে বইখানি আরও বেশী হৃদয়-গ্রাহী হতে পারতো| এ কথা তো তারা বলে|" বলিয়া প্রকাশক মহাশয় অবনত মুখে চা পান করিতে লাগিলেন|

        নগেন্দ্র এই সমালোচনা খণ্ডন করিতে পারিল না|
       বাস্তবিকই ত, গণিকা চরিত্র অঙ্কিত করিতে সে নিজ অভিজ্ঞতা কিছুমাত্র সাহায্য পায় নাই| নাটকে উপন্যাসে গণিকাদের বর্ণনা, এবং লোক মুখে কিছু কিছু শুনা কথা মাত্রই তা তাহার অবলম্বন! এই সকল কথা ভাবিতে ভাবিতে নগেন্দ্র চা পান শেষ করিল|

        নগেন্দ্র নীরব দেখিয়া প্রকাশক বলিলেন, "আপনি যদি ঐ সব দলে মাঝে মাঝে একটু আধটু মেশেন, তাতে তার ক্ষতিটা কি? বিলাতী ঔপন্যাসিকেরা, যাঁরা দরিদ্রপল্লীর গল্প লিখবেন, তাঁরা রীতিমত দরিদ্র সেজে তাদের পল্লীতে গিয়ে বাস করে', তাদের সঙ্গে মেলামেশা করে', নিজস্ব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে' এনে নভেল লেখেন শুনেছি|"
আর কিছুক্ষণ কথাবার্ত্তার পর নগেন্দ্র উঠিল| প্রকাশক বলিলেন, "আমার কথাটা ভেবে দেখবেন তা হলে?"
"হাঁ-ভেবে দেখব বৈ কি|" বলিয়া নগেন্দ্র বিদায় গ্রহণ করিল|

         সেই দিন রাত্রে আহারের পর, বাসায় নির্জ্জন ছাদে বসিয়া, নগেন্দ্র সুধীরকে তাহার প্রকাশকের মন্তব্য ও প্রস্তাবটা জানাইল| শুনিয়া, সুধীর প্রথমটা শিহরিয়া উঠিল; বলিল, ছি ছি, তাও কি হয়?"

        নগেন্দ্র সুধীরকে বুঝাইল, উদ্দেশ্য যখন মন্দ নহে, উদ্দেশ্য যখন কেবলমাত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয়-জ্ঞান আহরণ, তখন আর ইহাতে দোষটা কি? কিছুক্ষণ তর্ক বিতর্কের পর সুধীর স্বীকার করিল যে, বর্ত্তমান ক্ষেত্রে ওরূপ কার্য্য দোষাবহ হইবে না বটে| জিজ্ঞাসা করিল, "তা, আপনি তাদের সঙ্গে কি করে মিশবেন? কাউকে ত আপনি জানেন না?"

        নগেন্দ্র হাসিয়া বলিল, "তাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ের জন্যে কোনও সুপারিশ বা পরিচয় পত্র আবশ্যক হয় না হে| কিঞ্চিত অর্থ থাকলেই হয়| কিন্তু, আমি যে মৎলবটি ঠিক করেছি, তাতে বোধ হয় টাকারও কোনও আবশ্যক হবে না|"
সুধীর কৌতূহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, " কি রকম?"

        নগেন্দ্র বলিল, "আমাদের ব্রজনাথ মল্লিক-আমাদের চা বাগানগুলিকে যিনি কোদাল আর কম্বল সরবরাহ করেন, তিনি বছর দুই আগে আমাকে একবার তাঁর বাগান পার্টিতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন| সেখানে, ঐ দলের একটি স্ত্রীলোকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল| এমন তার স্বভাব, এমন কথাবর্ত্তা যে, সে আর তোমায় কি বলব| সে আমায় তার ঠিকানা দিয়েছিল; তার সঙ্গে গিয়ে দেখা সাক্ষাৎ করবার জন্যে বিশেষ করে' অনুরোধ করেছিল| ভাবছি, তাকেই চিঠি লিখে তার সঙ্গে গিয়ে দেখা করি| তার মন যে রকম উঁচু, কখনই সে আমার কাছে টাকা চাইবে না| কিছুদিন মাঝে মাঝে সেখানে যাতায়াত করলে, তাকেও বেশ চিনতে পারবো, ঐ দলের আরও কত স্ত্রীলোক ত সেখানে যাওয়া আসা করে, তাদেরও চাল চলন, কথাবার্ত্তা, জীবন যাত্রা প্রণালী ষ্টাডি' করবার বেশ সুযোগ পাব|"

        সুধীর কিয়ৎক্ষণ বসিয়া ভাবিল| শেষে বলিল, "কিন্তু দাদা, মানুষের মন , শেষে হিতে বিপরীত ঘটিয়ে বসবেন না ত?"
       নগেন হাসিয়া বলিল, "সে ভয় নেই| আমি তার গোড়া মেরে রেখে তবে গিয়ে কার্য্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হব|"
       সুধীর কৌতুহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, "কি করে' দাদা?"
       নগেন কহিল, "সে তুমি কাল জানতে পারবে|"

          নগেন্দ্র রাত্রে শয়নঘরে খিল বন্ধ করিয়া এই পত্রখানি লিখিল:-
       স্নেহের ভগিনী,
       তোমার স্মরণ আছে কি না জানি না, প্রায় দুই বৎসর পূর্ব্বে কাশীপুরের এক বাগানে এক রাত্রে তুমি মুজরা করিতে গিয়াছিলে, সেইখানে তোমার সহিত আমার পরিচয় হইয়াছিল| রাত্রি একটু অধিক হইলেই, সমবেত স্ত্রীপুরুষ সুরাপানে হতজ্ঞান অবস্থায় ভূমিতে লুটাইতেছিল, কেবল তুমি এবং আমি স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলাম| তুমি স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া আমার সহিত আসিয়া আলাপ করিয়াছিলে এবং আমাকে ক্ষুধায় অত্যন্ত কাতর দেখিয়া, তুমি নিজে উদ্যোগিনী হইয়া পাকশালা হইতে খাবার আনাইয়া পরম যত্নে আমায় খাওয়াইয়াছিলে| আশা করি এখন তোমার সব কথা মনে পড়িবে|
সে রাত্রে তোমার ঠিকানাযুক্ত একখানি কাগজ তুমি আমায় দিয়াছিলে, এবং অনুরোধ করিয়াছিলে যে, আমি যেন একদিন তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি| আমি তখন তোমায় মৌখিক সম্মতি জানাইয়াছিলাম, যদিও মনে মনে স্থির জানিতাম যে, তোমার অনুরোধ আমি কখনও পালন করিব না| কারণ তখন ওরূপ কার্য্যকে আমি অত্যন্ত নীতি-বিগর্হিত বলিয়া মনে করিতাম| তাই আমার সে মৌখিক প্রতিশ্রুতি এতদিন রক্ষা করি নাই| কিন্তু এখন নবযুগের নূতন আলোকে আমার মতের পরিবর্ত্তন হইয়াছে| তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে এখন আমি অভিলাষী হইয়াছি| তোমার ব্যবহারে ও তোমার সঙ্গে সেই অল্পক্ষণ আলাপেই আমি বুঝিয়াছিলাম যে, জগতের চক্ষে তুমি একজন পতিতা নারী হইলেও, তোমার অন্তঃকরণ অতি কমনীয় সৌন্দর্যে মণ্ডিত| আজ স্বীকার করিতে বাধা নাই, আমি তোমাকে দেখিয়া অত্যন্ত মুগ্ধ হইয়াছিলাম| কিন্তু তাহা কোনও কুভাবের বশবর্ত্তী হইয়া নহে; -ফুলের সৌন্দর্যে, পাখির কলগানে মনুষ্য-হৃদয় যে কারণে মুগ্ধ হয়, আমিও সেই কারণেই মুগ্ধ হইয়াছিলাম| (আর এ পত্রখানি কোনও কুভাব প্রণোদিত হইয়া আমি যে লিখিতেছি না, উপরে যে শব্দে তোমায় সম্বোধন করিয়াছি তাহা হইতেই তুমি বুঝিতে পারিবে|) দুই বৎসর হইতে চলিল, কিন্তু আজিও তোমাকে আমি ভুলিতে পারি নাই| তোমার সেই হাসিত ঢল ঢল সুন্দর মুখখানি আমার মানসে পটে অঙ্কিত হইয়া আছে| তাই তোমার হৃদয়খানি আরও কাছাকাছি পাইবার জন্য- সেখানির পরিচয় আরও নিবিড়ভাবে করিবার জন্য, আমার মনে প্রবল বাসনা জন্মিয়াছে| আমি জানি, তোমাদের জীবন বড় নিঃসঙ্গ-বড় একা-কেহ তোমাদের আপনার হয় না-বা তোমাদিগকে যথার্থ আপনার কেহ করে না-হাটের বিকিকিনি মাত্র| আমার অভিলাষ, আমি তোমার বন্ধু হই, সখা হই, আত্মীয় হই, এই জন্যেই আমি তোমার দর্শন কামনা করিতেছি; অন্য কোনও অভিপ্রায়ে নহে| ইতি
পুন্শ্চ-খামে পত্র দিও|
                               আশীর্ব্বাদক
                             শ্রীনগেন্দ্রনাথ রায়
                             ঠিকানা-২৭ নং দুর্গাচরণ ঘোষের লেন,
                             বউবাজার, কলিকাতা|

        পরদিন প্রাতে এই পত্রখানি পড়িয়া সুধীর একেবারে মোহিত হইয়া গেল| বলিল, "দাদা, সামান্য একখানা চিঠি লিখেছেন, তাতে জিনিয়সের ছাপ! এই ঠিক হয়েছে| সকল কথা গোড়া থেকে স্পষ্ট করে বলা রইল, ভালই হ'ল|"

         দুইদিন ধরিয়া নগেন্দ্রনাথ পত্রোত্তরের জন্য ব্যাকুল প্রতীক্ষায় কালযাপন করিল| তৃতীয় দিনে পত্রোত্তোর আসিল| পত্রখানি সুলিখিত নহে, সুরচিত নহে, বানান ভুল অত্যন্ত বেশী| সংশোধনান্তে নিম্নে উহার প্রতিলিপি আমরা প্রকাশ করিলাম:-

        মহাত্মন্,
       আপনার সুধামাখা পত্রখানি পাইয়া আমি যে কি পর্য্যন্ত সুখিনী হইলাম তাহা এই সামান্য পত্রে লিখিয়া কি জানাইব| আপনি অধিনীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে ইচ্ছুক হইয়াছেন উহা আমার পরম সৌভাগ্য| আপনি যে কথা লিখিয়াছেন তাহা সমস্তই আমার স্মরণ আছে| সেই বাগানে আপনার সহিত সাক্ষাতের পর আপনার নাম আমি জপমালা করিয়াছি জানিবেন| আপনি দয়া করিয়া আগামী মঙ্গলবার দিবস সন্ধ্যার পরে আসিবেন, আমি তৃষিতা চাতকিনীর ন্যায় আপনার আশাপথ চাহিয়া থাকিব|
                         আপনার চিরাধিনী
                         শ্রমতী প্রভাবতী দাসী|

          এই পত্র যথাসময়ে নগেন্দ্রনাথ, সুধীরকে দেখাইল| সুধীর পত্র নাড়িয়া নাসিকা কুঞ্চিত করিল| বলিল, "আপনার কাছে তার কথাবার্ত্তা শুনে আমার মনে কেমন ধারণা হয়েছিল যে স্ত্রীলোকটি বেশ শিক্ষিতা| রাম, রাম, এত দেখছি নিতান্ত মূর্খ!"

         সুধীরের এ উক্তি শুনিয়া নগেন্দ্র মনে মনে একটু বিরক্ত হইল| বলিল, "লেখাপড়া শেখবার সুযোগ কখনও পায়নি, কাজেই এ রকম চিঠি সে লিখেছে| কিন্তু লেখাপড়া না জানলেই যে মানুষ একেবারে অপদার্থ হয়ে গেল তা মনে করা ভুল সুধীর।"

        সুধীর একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিল, "না, তা মনে করিনি দাদা| তবে শুধু এই বলছিলাম যে, ভাষাটা -"
নগেন্দ্র বাধা দিয়া বলিল, চিঠির ভাষার কথা ছেড়ে দাও| তার মুখের ভাষা শুনলে তাকে আর মূর্খ বলে মনে হবে না| এমন কি, তাকে সে যা, তাই বলেই মনে হবে না|"

        নগেন্দ্র মনে মনে স্থির করিল, মঙ্গলবার সন্ধ্যার সময় সে ত নিজে যাবেই, সুধীরকেও লইয়া গিয়া, উহার এই ভ্রান্ত ধারণা দূর করিয়া দিবে|

          ঠিক এক সপ্তাহ কলিকাতা হইতে অনুপস্থিতির পর, আজ মঙ্গলবার প্রাতে, তবলা বাঁয়া বেহালা হার্ম্মোনিয়ম বিছানা বাক্স ভৃত্য ওস্তাদজি ও কুকুর সহ নর্ত্তকী প্রভাবতী মফঃস্বল হইতে মুজরা করিয়া তাহার বাসায় ফিরিল| এ বাড়িখানি তাহার নিজের নহে, এগ্রিমেন্ট করিয়া লওয়া; ত্রিতলের সমস্ত কক্ষগুলিতে দুইজন ভাড়াটিয়া আছে-ইহারাও নর্ত্তকী, তবে তাহাদের তেমন পশার নাই| যে আসরে প্রভার ৫০ টাকায় বায়না হয়, সে আসরে ইহারা ১০ টাকার বেশী পায় না| এই কারণে ইহারা মনে মনে প্রভার বিলক্ষণ ঈর্ষা করে; কিন্তু প্রভা বাড়িওয়ালী, মুখে কিছু প্রকাশ করিতে সাহস করে না| একতলায় পাকাদি হয়, ভৃত্যেরা থাকে|

         প্রভাবতী দ্বিতলে উঠিয়া, সম্মুখে কুসুমকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, "কি ভাই, বাড়ির খবর সব ভাল ত?"
       কুসুম বলিল, "বাড়ির খবর ত এক রকম ভালই| কিন্তু পাড়ায় বড় ভয় হয়েছে দিদি!"
       প্রভা জিজ্ঞাসা করিল, "কেন, কি হয়েছে?"
       কুসুম বলিল, "বড় গুণ্ডার উপদ্রব হয়েছে| পর্শু রাত্রে একটা গুণ্ডা, বাবু সেজে যামিনীর ঘরে এসেছিল| ছুরি           দেখিয়ে তার গহনাগুলি সব কেড়ে নিয়ে, পালিয়ে গেছে|"
       "সে চেঁচামেচি করেনি?"
       "তার মুখ বেঁধে ফেলেছিল, চেঁচাবে কোত্থেকে? ভাগ্যিস একটু পরে একজন ভাড়াটে সে ঘরে গিয়ে পড়েছিল, সে তার মুখ থেকে কাপড়ের বাঁধন খুলে দিলে, নইলে হয়ত দম বন্ধ হয়েই মরে যেত|"
       "পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল?"
       "হাঁ হয়েছে বৈকি| তা, সে চোরকে পুলিশ আর কোথা খুঁজে পাবে?"
       প্রভা জিজ্ঞাসা করিল, "আমার চিঠিপত্র কিছু এসেছিল?"
       কুসুম বলিল, "হাঁ এসেছিল একখানা| তোমার ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে ভিতরে ফেলে দিয়েছি|"
       এমন সময় অপর ভাড়াটিয়া সারদাসুন্দরী হাঁপাইতে হাঁপাইতে সিঁড়ি উঠিয়া বলিল, "এই যে প্রভা দিদি, এই আসছ           বুঝি? দাঁড়াও, হাঁপ ছাড়ি| ছুটতে ছুটতে বাড়ি এসেছি|"
       প্রভা ও কুসুম যুগপৎ জিজ্ঞাসা করিল, "কেন? কেন? কি হয়েছে সারদা?"
       "ওগো ঐ গলিতে পুলিশে পুলিশে ছেয়ে গেছে| গলি দিয়ে যে যাচ্চে তাকে ধরছে| তাই দেখে আমি ভয়ে ছুটতে ছুটতে অন্য পথ দিয়ে পালিয়ে এসেছি|"
         প্রভা জিজ্ঞাসা করিল,"কেন, এত পুলিশ কেন?"
       "খুন হয়েছে যে গো!"
       "কে খুন হল?"
       "কামিনী|"
       "অ্যাঁ-কামিনী খুন হয়েছে? কি করে খুন হল? কে খুন করলে?"

       "শুনলাম, কাল রাত্রে একজন গুণ্ডা, বাবু সেজে কামিনীর ঘরে এসেছিল| তারপর অনেক রাত্রে, কামিনীকে খুন করে', তার গয়নাগাঁটি সব নিয়ে সরে পড়েছে| গায়ের গয়না তা নিয়েছেই, আঁচল থেকে লোহার সিন্ধুকের চাবি নিয়ে লোহার সিন্ধুক খুলে, বাকী গয়না, টাকা কড়ি সমস্ত নিয়ে গেছে|"

         শুনিয়া প্রভাবতী ও কুসুম উভয়েই হায় হায় করিতে লাগিল| আর দুই চারি কথার পর, প্রভা ত্রিতলে উঠিয়া নিজ শয়ন ঘরের চাবি খুলিল| খুলিয়া, ভিতরে প্রবেশ করিবামাত্র দেখিতে পাইল, কুসুম - কথিত ডাকের চিঠিখানা মেঝের উপর পড়িয়া রহিয়াছে|

         চিঠিখানি কুড়াইয়া প্রভা শিরোনামা দেখিল, হস্তাক্ষর অপরিচিত| চিঠিখানা টেবিলের উপর রাখিয়া, ভৃত্যকে চায়ের জল চড়াইতে আদেশ দিয়া, মুখ হাত ধুইয়া, বস্ত্রাদি পরিবর্তন করিল| বাজার আনিবার জন্য ঠাকুরকে টাকা দিয়া, চা পান করিতে করিতে চিঠিখানা খুলিল|

         চিঠি পড়িয়া, প্রভার মুখ শুকাইয়া গেল, তাহার হাত পা ঠক ঠক করিয়া কাঁপিতে লাগিল| ছুটিয়া বারান্দায় বাহির হইয়া, কম্পিতকণ্ঠে ডাকিল, "ও কুসুম, ও সারদা, তোরা শীগগির আয়|"

        কুসুম ও সারদা উভয়েই একত্র বসিয়াছিল| এই ডাক শুনিয়া তাহার পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করিয়া একটু হাসিল| পরে বাহির হইয়া বলিল, "কেন দিদি? ডাকছ?"

        উপর হইতে পূর্ব্ববৎ আর্ত্তকণ্ঠে উত্তর আসিল - "শীগগির আয়-সর্ব্বনাশ হয়েছে|"

        কুসুম ও সারদা তখন মুখের হাস্যরেখা গোপন করিয়া, মুখে উদ্বেগ ও ভয়ের চিহ্ণ লইয়া, ছুটিতে ছুটিতে উপরে উঠিয়া গেল| গিয়া দেখিল, মেঝের উপর চা ঢেউ খেলিতেছে, পেয়ালা ও পিরিচ টেবিলের উপর হইতে পড়িয়া ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, প্রভা চক্ষু কপালে তুলিয়া, তাহার ফরাস বিছানায় বসিয়া হাঁপাইতেছে|
       কুসুম ও সারদা প্রবেশ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, "কি দিদি, কি হয়েছে?"
       প্রভা চিঠিখানা তাহাদিগকে ঠেলিয়া দিয়া বলিল, "পড়ে দেখ?"
       কুসুম তখন চিঠি লইয়া পড়িল|

         মেছুয়াবাজার
       শ্রীচরণকমলেষু-
       প্রিয়সি, একদিন কোনও স্থানে তোমার মুজরো শুনিয়া আমি প্রাণে এতই আনন্দ পাইয়াছিলাম, যদিও আমি একজন গুণ্ডা, সেই অবধি মনে মনে তোমায় অত্যন্ত ভালবাসি ও ভক্তি করি| তাই এ পত্র তোমায় লিখিতেছি| আমাদের দলের লোকেরা স্থির করিয়াছে যে, মঙ্গলবার রাত্রে তাহারা তোমার নিকট বাবু সাজিয়া যাইবে এবং তোমাকে হত্যা করিয়া তোমার অলঙ্কার ও টাকা কড়ি অপহরণ করিবে| তোমার গলায় ছুরী দিবে ইহা সহ্য না হওয়াতে, এই পত্র লিখিয়া তোমায় সাবধান করিয়া দিলাম| এ পত্র পড়িয়া তুমি পুড়াইয়া ফেলিবে, কারণ ইহা আমাদের দলের লোকের হস্তগত হইলে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য আমাকেই হত্যা করিবে সন্দেহ নাই| ইতি
       তোমার প্রেমাকাঙ্কী অধম ভৃত্য
       শ্রীগুণ্ডা|

       চিঠি পড়িয়া কপটী কুসুম দুই চক্ষু কপালে তুলিয়া বলিল, "তাই ত দিদি, কি হবে?"
     সারদা পেচকের মত গম্ভীর স্বরে বলিল, "এখন উপায়?"
     প্রভাবতী শুইয়া পড়িয়াছিল| তাহার মুদ্রিত চক্ষু হইতে অশ্রু গড়াইতে লাগিল|
     সারদা কাঁদ কাঁদ স্বরে বলিল, "হ্যাঁ ভাই কুসুম, যদি আমাদিগকেও খুন করে? এইবেলা কোথাও পালাই চ'|
     কুসুম বলিল, "পালিয়ে যাব কোথা? কোনও চুলো কি আছে? আর, আমাদের আছেই বা কি ভাই, যে নেবে? তবে        প্রভা দিদির বোধ হয় পালানোই উচিত| সাতদিনের বায়না নিয়ে মফঃস্বলে গেছে, অনেক টাকা কড়ি নিয়ে আজ তার ফিরে আসবার কথা, তা বোধ হয় কেমন করে' তারা টের পেয়েছে| দিদি, ও দিদি, ও রকম করে পড়ে' থাকলে কি হবে ভাই? ওঠ, একটা পরামর্শ যুক্তি করা যাক|" - বলিয়া সে সারদার পানে চাহিয়া, অলক্ষিতে একটু হাসিল|
প্রভা উঠিয়া বসিল| বলিল, "আমার চাকরকে ডাক ত|"

        ভৃত্য নিম্নতলে বসিয়া মশলা বাঁটিতেছিল, কুসুমের ডাক শুনিয়া, হাত ধুইয়া উপরে আসিল|
প্রভা বলিল, "লালবাজার| পুলিশ কমিশনার সাহেবকে গিয়ে চিঠিখানা দেখাই| তিনি আমার প্রাণরক্ষা করেন কিনা দেখি|"

        ট্যাক্সি আসিবার শব্দ শুনিয়া, প্রভা উঠিয়া তাহার কেশবেশ একটু পরিপাট্য সাধন করিয়া লইল| তাহার পর জুতা মোজা পরিয়া, সিঁড়ি দিয়া নীচে নামিয়া গেল|

       সারদা বলিল, "পুলিসে গেল, আমার কিন্তু ভয় করছে ভাই|"
     কুসুম বলিল, "একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল|"
     সারদা বলিল, "শেষে আমরাই জাল করার দায়ে পড়ে যাব না কি?"
     কুসুম বলিল, "ঈস্ আমাদের কে ধরে? কিছু প্রমাণ আছে? হাতের লেখা ত আর আমাদের কারু নয়|"
     "তুই তবে বসে 'চিন্দি' কর| আমি যাই, নেয়ে নিই গে, আবার কলের জল চলে' যাবে|"

        সন্ধ্যার পূর্ব্বেই নগেন্দ্র আপিস হইতে ফিরিয়া আসিল| আপিসের বস্ত্র পরিবর্ত্তন করিয়া বলিল, "ওঃ, আজ কি গরমটা'ই গেল! আপিসে ঘেমে একবারে নেয়ে উঠলাম| স্নান করে ফেলি|"

       সুধীর বলিল, "দাদা, এই অবেলায় স্নান করবেন? তার চেয়ে না হয় ভিজে গামছা দিয়ে-"

       নগেন্দ্র বলিল, "না না-কিছু হবে না!" - বলিয়া সে নিজ সাবানদামী ও তোয়ালে লইয়া নীচে নামিয়া গেল|
স্নান করিয়া আসিয়া, সাবধানে কেশ বিন্যাস করিয়া, নগেন্দ্র খাবর খাইয়া চা পান করিল| সুধীরকে বলিল, "ওহে তৈরী হয়ে নাও|"

       সুধীর বলিল, "আমি - আমার আর যাবার দরকার আছে কি? হয়ত একজন তৃতীয় ব্যক্তি উপস্থিত থাকলে সে নিজের জীবন কাহিনী-"
     নগেন্দ্র বলিল, "জীবন কাহিনী কি আজই সে বলেছে? আজ একটু আলাপ পরিচয় করে আসা মাত্র| চল চল| অন্ততঃ আজকের দিনটে ত চল| অন্যদিন না আমি একাই যাব|"

      সুধীর অগত্যা কাপড় বদলাইতে গেল| নগেন্দ্রর ঘরে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, ঘরখানি সৌগন্ধে ভুর ভুর করিতেছে| নগেন্দ্র, জামাই সাজিয়া বসিয়া বসিয়া সিগারেট ফুঁকিতেছে| প্রভাবতীকে উপহার দিবার জন্য হাতে একখানি "সমাজদ্রোহী" পুস্তক| উভয়ে তখন বাসা হইতে বাহির হইল| বড় রাস্তায় পৌঁছিয়া নগেন বলিল, "ওহে একখানা ট্যাক্সি, ধরা যাক|"
     সুধীর বলিল, "কত দূরই বা? মিছামিছি আর ট্যাক্সি কেন দাদা?"

      নগেন্দ্র বলিল, "ওহে গরমটি কি রকম দেখছ? হেঁটে গেলে, ঘামে ভিজে, ভিজে বিড়ালটি হয়ে সেখানে পৌঁছে, ঘেমো গন্ধে কি তার মাথাটি ধরিয়ে দেবো?"

      রাস্তা হইতে একটি ট্যাক্সি ধরা হইল| দশমিনিটের মধ্যে ট্যাক্সি ঠিকানায় পৌঁছিল|
     নগেন্দ্র ট্যাক্সি হইতে নামিয়া, দরজার উপর বাড়ির নম্বর দেখিল| ঠিক হইয়াছে জানিয়া, তথাপি ভিতরে প্রবেশ করিতে একটু ইতস্ততঃ করিতে লাগিল| এমন সময় একজন ভৃত্যকে বাহির হইতে দেখিয়া নগেন জিজ্ঞাসা করিল, "এজি দেখো, প্রভাবতী বিবি হিঁয়া রহতা হায়?"
     ভৃত্য বলিল, "হ্যাঁ বাবু, তেতলায় আছেন|"

      দুইবন্ধু তখন অঙ্গনে প্রবেশ করিল| নির্জ্জন অঙ্গন পার হইয়া সিঁড়ি উঠিয়া, দ্বিতলে এবং ক্রমে ত্রিতলে উঠিল| দেখিল, একটি কক্ষে বিদ্যুৎ আলোক জ্বলিতেছে, পাখা চলিতেছে, ফরসা বিছানায় একজন স্ত্রীলোক বিমর্ষ বদনে বসিয়া আছে| দুইবৎসর পরে দেখিলেও, নগেন তাহাকে চিনিতে পারিল|

      অগ্রে অগ্রে নগেন্দ্র, পশ্চাতে সুধীর| দ্বারের নিকট উপস্থিত হইয়া নগেন বলিল, "প্রভাবতী-ভাল আছ ত?"
প্রভাবতী রুক্ষস্বরে বলিল, "কি রকম ভদ্রলোক মশাই আপনি? বলা নেই কওয়া নেই ঘরে ঢুকে পড়লেন যে?" - বলিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল-"পুলিস, পুলিস|"

      পর মুহুর্ত্তে, পাশের ঘরখানির বন্ধদ্বার খুলিয়া গেল| চারিজন কনষ্টেবল তন্মধ্য হইতে ছুটিয়া বাহিরে আসিয়া "শালা গুণ্ডা" - বলিয়া, এক এক জনকে উভয় হস্ত, দু'দজনে ধরিয়া ফেলিল|
     প্রভা বলিল,"এই লোক গুণ্ডা হায়| হামকো খুন করনে আয়া হায়|"
     নগেন্দ্র বলিল, "প্রভা, এ কি কাণ্ড? আমি নগেন্দ্র-নগেন্দ্র-এদের বল-"
     প্রভা বলিল, "নগেন্দ্র তোমার কুন্দনন্দিনীর কাছে যাও| এখানে কেন মরতে এসেছ?" পাহারাওয়ালা, এই দুনো আদমি গুণ্ডা হায়, হামকো খুন করনে আয়া হায়| পাকড়কে লে যাও|"

     "চল বে চল" - বলিয়া ধাক্কা দিতে দিতে কনষ্টেবল, ঔপন্যাসিক ও তাঁহার ভক্তকে থানায় লইয়া চলিল|
সেখানে হাজত ঘরে সারারাত্রি বন্ধ থাকিয়া, পরদিন প্রাতে থানার ইনস্পেক্টর বাবুর সম্মুখে তাহারা নীত হইল| নগেন্দ্র আমূল বৃত্তান্ত ইন্স্পেক্টার বাবুকে নিবেদন করিল| সৌভাগ্যবশতঃ প্রভাবতীর স্বাক্ষরিত পত্রখানি নগেন্দ্রর পকেটেই ছিল, সেখানি বাহির করিয়া ইন্স্পেক্টর বাবুকে সে দেখাইল| প্রভাকে উপহার দিবার জন্য যে বইখানি আনিয়াছিল তাহাও দেখাইল|

      ইন্স্পেক্টর বাবুটি শিক্ষিত লোক এবং ভদ্রলোক| নগেন্দ্রর কথার তাঁহার সম্পূর্ণ বিশ্বাস জন্মিল| উভয় আসামীকে মুক্তি প্রদান করিলেন|

      যাইবার সময় নগেন্দ্র ইন্স্পেক্টর বাবুর হাতটি ধরিয়া বলিল, "দোহাই মশাই, ব্যাপারটা যেন খবরের কাগজে না উঠে| তা'হলে মান ইজ্জৎ ত যাবেই, বই বিক্রিও বন্ধ হয়ে যাবে|"

      ইন্স্পেক্টর বাবু হাসিয়া বলিলেন, "আচ্ছা, খবরের কাগজে যাতে ব্যাপারটা না ওঠে, আমি তার ব্যবস্থা করব এখন| কিন্তু, সাবধান, আপনি আর ওসব পাড়ায় হাঁটবেন না|"

      নগেন্দ্র বাসায় ফিরিয়া আসিল| রাত্রে অনুপস্থিতির কৈফিয়ৎ স্বরূপ বাসার লোককে বলিল, " খিদিরপুরে নিমন্ত্রণ ছিল, আহার শেষ হইতে অধিক রাত্রি হইয়া গেল, ট্রাম পাওয়া গেল না, তাই উভয়ে সেইখানেই শয়ন করিয়া ছিল| তাড়াতাড়ি স্নানাহার শেষ করিয়া নগেন্দ্র আপিসে চলিয়া গেল| পরদিন নিজ গ্রন্থাবলী একসেট ইন্স্পেক্টর বাবুকে "ভক্তি উপহার" স্বরূপ পাঠাইয়া দিল|

( ‘বঙ্গবাণী’ মাসিক পত্রিকা, কার্তিক ১৩৩০)

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।