প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

একটি রৌপ্যমুদ্রার জীবন-চরিত

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

        [ লেখক পরিচিতি : প্রভাতকুমারের জন্ম ১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দের ২৭শে (২৫শে?) জুলাই নদীয়ার রানাঘাটে| পিতা নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মাতা গিরিবালা দেবী| রানাঘাট পালচৌধুরী বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু| এরপর চলে যান উকিল পিতার কর্মক্ষেত্র বিহারের গিরিডিতে| সেখানে ১৯০৬ সালে তিনি গিরিডি ন্যাশনাল স্কুলে ভর্তি হন| ১৯০৭-এ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগ দেবার জন্য গিরিডি স্কুল থেকে বিতাড়িত হন| ১৯০৮ সালে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের (বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়) পরীক্ষায় পঞ্চম স্থান অধিকার করে দশ টাকা বৃত্তি পান| শিক্ষক হিমাংশুপ্রকাশ রায়ের সঙ্গে তিনি শান্তিনিকেতনে আসেন; হিমাংশুপ্রকাশ তাকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন| রবীন্দ্রনাথের স্নেহের স্পর্শ প্রভাতকুমারকে আপ্লুত করে| সেই থেকেই তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতনের স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে ওঠে| প্রভাতকুমারের ২২ বছরের জন্মদিনে কবি স্নেহাশীর্বাদ জানিয়ে এই কবিতাটি রচনা করেন -
         প্রভাতের পরে দক্ষিণ করে
         রবির আশীর্বাদ -
         নূতন জনমে নব নব দিন
         তোমার জীবন করুক নবীন
         অমল আলোকে দূর হোক লীন,
         রজনীর অবসাদ|

       বাবার মৃত্যু ও অন্যান্য কারণে প্রথাগত শিক্ষালাভ তার আর হয়ে ওঠে নি| ১৯০৯ সালে প্রভাতকুমার শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রমে যোগ দিয়ে সেখানেই থাকতে শুরু করেন| মাঝে বছর খানেক (১৯১৭-১৮) তিনি সিটি কলেজের গ্রন্থাগারিক হয়ে কাজ করলেও কবির আহ্বানে আবার শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেন এবং পঞ্চাশ টাকা বেতনে কাজে যোগ দেন| পাঠভবনের শিক্ষক ও গ্রন্থাগারিক পদেও তিনি কাজ করেছেন| ১৯২৬ সালে অধ্যাপক নিযুক্ত হন|
১৯১২ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় তার 'প্রাচীন ইতিহাসের গল্প'| ইতিহাস ছিল প্রভাতকুমারের খুব প্রিয়| এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি পুস্তক তিনি রচনা করেছেন| রবীন্দ্রনাথই সম্ভবত প্রথম চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা ও পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছেন| ১৯২১ সালে খ্যাতিসম্পন্ন ফরাসি পণ্ডিত সিলভা লেভি ভারতে এলে তার কাছে চীনা ও তিব্বতী ভাষা শিখে গবেষণা শুরু করেন প্রভাতকুমার| গবেষণার বিষয় ছিল - বৌদ্ধ ও হিন্দু দর্শনের সমগ্র চীনা ভাষা| ইতালীর প্রখ্যাত প্রাচ্য ভাষাবিদ জোশেফ তুচ্চির কাছে চীনের বিশিষ্ট দার্শনিক কনফুৎসুর রচনা পাঠ করে তা অনুবাদ করেন| এ সব বিষয় নিয়ে ১৯৩১ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত বই Indian Literature in China and Far East| ১৯৩৩ সালে প্রভাতকুমারের বর্মা পরিভ্রমণের সময় ইংরেজ প্রাচ্যবিদ ড: লুসো তাকে দেখে বলেছিলেন -"I know you. Your book is on my table." বিশ্বভারতীর ঐক্যের তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে ১৯৬৬ সালে তিনি রচনা করেন 'পৃথিবীর ইতিহাস'| তার আর একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল ১৯৭২ সালে প্রকাশিত 'রামমোহন ও তৎকালীন সমাজ ও সাহিত্য'|

        গ্রন্থাগারিক হিসাবেও প্রভাতকুমারের অবদান প্রশংসনীয়| বিশ্বভারতীর গ্রন্থাগার গঠন ও সম্প্রসারণে তার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে| ১৯৫৪ সালে সেখান থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন| 'বাংলা গ্রন্থ বর্গীকরণ' ও 'বাংলা দশমিক বর্গীকরণ' বই দুটি গ্রন্থাগার বিষয়ে তার উল্লেখযোগ্য সংযোজন| তিনি ভারতীয় গ্রন্থাগার পরিষদের সহ-সভাপতি এবং বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদের সভাপতিও ছিলেন| গ্রন্থাগারিক ছিলেন বলে কবিগুরু তাকে পরিহাস ছলে সম্বোধন করতেন বৈবাহিক (বই-বাহিক) বলে|

       প্রভাতকুমারের জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি চার খণ্ডে তার রবীন্দ্রজীবনী রচনা| তিনি লিখেছেন -"১৯০১ সালের শেষ দিকে আমি রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে আসি| তারপর দীর্ঘ ৩২ বছর রবীন্দ্রনাথকে দেখবার, জানবার, তার কথা শোনবার, অপার স্নেহ পাওয়ার, কবির সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক এমন কি সভা সমিতিতে তার বিরোধিতা করার সুযোগ পেয়েছিলাম| ....... লাইব্রেরিতে আমার ঘরে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে যে সব লেখা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হত তা রাখা থাকত| রবীন্দ্রনাথ সে সব লেখার ক্লিপিং আমার হেফাজতে রেখেছিলেন| আমি একজন সহকারীর সাহায্যে সেগুলো সাজানো গোছানো করতাম| তারপর খণ্ডে খণ্ডে তা বাঁধিয়ে রাখা হত| এইসব কার্তিকা খণ্ডগুলির দিকে তাকাতাম আর ভাবতাম এগুলিকে ব্যবহার করব না? সেগুলি হল আমার রবীন্দ্রজীবনী লেখার প্রেরণা|" চার খণ্ড শেষ করতে সময় লেগেছে পঁচিশ বছর (১৯২৯-৫৪)| প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯৩৩-এ এবং একমাত্র সেটিই রবীন্দ্রনাথ দেখে যেতে পেরেছেন| রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে তার অন্যান্য বই - 'রবীন্দ্র গ্রন্থপঞ্জী' (১৩৩৯), 'রবীন্দ্র জীবনকথা', 'রবীন্দ্রনাথের চেনাশোনা মানুষ', 'রবিকথা', 'শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতী', 'গীতবিতান-কালানুক্রমিক সূচী' (সুধাদেবীর সঙ্গে যুগ্মভাবে), 'রবীন্দ্র গ্রন্থ পরিচিতি', ইত্যাদি| 'রবীন্দ্র জীবনকথা' অনুবাদ করেছেন অধ্যাপক শিশির কুমার ঘোষ - 'Life of Tagore' নামে| এ ছাড়া তার রচিত অন্যান্য গ্রন্থ - 'ভারতের জাতীয়তা', 'ভারত পরিচয়' (১৩২৮), 'ভারতের জাতীয় আন্দোলন' (১৩৩১), 'প্রাচীন ইতিহাসের গল্প' (১৩১৯), 'বঙ্গ পরিচয়' ২খণ্ড (১৩৪২, ১৩৪৩), 'ভারত পরিচয়' (১৩২৮), 'চীনে বৌদ্ধ সাহিত্য', 'জাতীয় পরিষদের দিনগুলি', 'বাংলা ধর্মসাহিত্য', 'ফিরে ফিরে চাই' (আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ) ইত্যাদি| ১৯৬২ সালে সোভিয়েত বিজ্ঞান আকাদেমির আমন্ত্রণে তিনি রাশিয়া যান; ফিরে এসে লেখেন একটি বই 'সোভিয়েত সফর'|

        অবসর গ্রহণের পর প্রভাতকুমার শান্তিনিকেতনের উপকণ্ঠে ভুবনডাঙায় নিজস্ব বাড়িতেই কাটিয়েছেন| তিনি পল্লী-সংগঠকের ভূমিকাও পালন করেছেন| এক সময়ে ভুবনডাঙার বিশাল জলাশয় পাঁক জমে অব্যবহার্য হয়ে যায়| গ্রামবাসী ও বিশ্বভারতীর কর্মীদের সহযোগিতায় পঁচিশ বিঘার সেই বিশাল জলাশয়টি পরিষ্কার করে পানীয় জলের সুবন্দোবস্ত করতে প্রভাতকুমার নেতৃত্ব দেন| প্রভাতকুমারের স্ত্রী সুধাময়ী দেবী ছিলেন পণ্ডিত সীতারাম তত্ত্বভুষণের কন্যা এবং শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্রী| স্থানীয় অঞ্চলে নারীশিক্ষা প্রসারে তাদের উভয়েরই উদ্যম প্রশংসনীয়|
স্মরণীয় অবদানের জন্য জীবনে বহু পুরস্কার ও সম্মান লাভ করেছেন প্রভাতকুমার| রবীন্দ্র জীবনী লিখে রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি| যাদবপুর, বিশ্বভারতী, বর্ধমান ও উত্তরবঙ্গ তাকে ডি.লিট দিয়ে সম্মানিত করেছে| ১৯৬৫ সালে বিশ্বভারতী থেকে পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সম্মান 'দেশিকোত্তম'| ১৯৮১ সালে ভারত সরকারের তাকে 'পদ্মভুষণ' প্রদান করে| এশিয়াটিক সোসাইটি তাকে 'রবীন্দ্র শতবার্ষিকী ফলক' দিয়ে সম্মান জানায়|
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কৃতবিদ্য প্রভাতকুমার ১৯৮৫ সালের ৭ই নভেম্বর ৯৩ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন|
     ( লেখক পরিচিতি প্রস্তুত করতে অন্যান্য সূত্র ছাড়াও স্বপনকুমার ঘোষের রচনার সাহায্য নেওয়া হয়েছে| মূল বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে )|

                                      দীপক সেনগুপ্ত|


       আমি একদিন রাত্রে আহারের পর রাস্তার ধারে বারান্দায় ঈজিচেয়ারে অর্দ্ধশয়ানাবস্থায় আল্বোলার নলটি মুখে দিয়া ঢুলিতেছিলাম| দারুণ গ্রীষ্মকাল, কিন্তু সে দিন সন্ধ্যা হইতে ঘণ্টা দুই বেশ এক পশলা বৃষ্টি হইয়া যাওয়াতে কিছু ঠাণ্ডা ছিল| পল্লীগ্রাম,-অধিকরাত্রি হইবার বহুপূর্ব্বেই পথে লোক-চলাচল বন্ধ হইয়াছে| হালদারদের বাগানের ভিতর একটা নারিকেল গাছে দুইটা পেচক বাস করিত, তাহারাই মধ্যে মধ্যে ঝঙ্কার দিতেছিল, আর সব নিস্তব্ধ| ঢুলিতে ঢুলিতে হ্ঠাৎ যেন মনে হইল, আমার মুখনলটা আস্তে আস্তে বলিতেছে-"বলি শুনিতেছ? এত ত লেখ, আমার জীবনের ইতিহাসটা লিখিয়া ছাপাইয়া দাও না; বেশ একটা গল্প হইবে|" আমি ঘুমের ঘোরে বলিলাম,-"তুমি এক স্থান হইতে অন্য স্থানে যাতায়াত করিতে পার না-অচেতন পদার্থ, তোমার আবার ইতিহাস কি?" সে বলিল,-"আমি এখনই অচল হইয়াছি, চিরদিনই কি এমন ছিলাম? যখন জীবিত ছিলাম, তখন আমি যেমন দ্রুত ও নিয়ত একস্থান হইতে অন্য স্থানে যাতায়াত করিতাম, তেমন তোমার জীবজগতের কেহ পারে না কি?" আমি বলিলাম, "ভাল, তুমি না হয় সচলই ছিলে, তা বলিয়া তোমার ইতিহাস আবার কি?" মুখনল এক মুখ হাসিয়া উত্তর করিল,-"বৃথা এতকাল তোমায় ধূমপান করাইয়াছি! মানুষেরই বুঝি সুখ দুঃখ, বিপদ্-সম্পদ্, সোণারূপার বুঝি সে সব কিছুই নাই? তবে আমার জীবনের কাহিনী শ্রবণ কর, তাহার পর বিচার করিয়ো|" বলিয়া আরম্ভ করিল:-

        আমার জন্মদিনটা ঠিক মনে নাই, বৎসরটা গায়ে লেখাছিল, দেখিয়াছিলে, কি? আশ্বিনমাস-শীঘ্রই পূজার বন্ধ হইবে বলিয়া টাঁকশালে কাযের ভারি ধূম পড়িয়া গিয়াছিল| দিবারাত্রি যন্ত্রের ঘটঘট শব্দে মনে হইত, চিরবধির হইয়া জন্মিতাম সেই ভাল ছিল| আমার জন্মের তিন চারি দিন পরেই বড়বাজারের এক মাড়য়ারি মহাজন বড় বড় থলি করিয়া দশ হাজার টাকার নোট ভাঙ্গাইয়া লইয়া গেল-আমাকেও সেই সঙ্গে যাইতে হইল| আমি তখন সংসারের ব্যাপার কিছুই জানি না; মনে করিলাম, ভারি মহাজনের দোকানে যাইতেছি, দোকানে বসিয়া কত কি দেখিতে পাইব, শুনিতে পাইব, কত আমোদ হইবে| ও মহাশয়, গাড়ি হইতে নামিয়া দুষ্ট-মহাজন দুইজন ভৃত্যের সাহায্যে থলিগুলা একটা অন্ধকূপের মত ঘরে লইয়া গিয়া মেঝেতে দমাদ্দম করিয়া ফেলিল, তাহার পর ক্যাঁচকড়াৎ করিয়া একটা শব্দ হইল, তাহার পর ঘটাং করিয়া আর একটা শব্দ হইল, তাহার পর বলিল, "লে আও|" তাহার পর এক এক করিয়া থলিগুলার নিম্নকর্ণ দুইটা ধরিয়া লোহার সিন্দুকে হড়্ হড়্ করিয়া ঢালিতে লাগিল| আমাদের শরীরটা শৈশব হইতেই কিছু কঠিন, নচেৎ সেই পতনেই, বিয়োগাঙ্ক নাটকের পঞ্চমাঙ্কে রাজা বা রাণীর ন্যায়, মৃত্যু অনিবার্য্য হইত|

        মহাজন যখন সিন্দুক বন্ধ করিয়া, চাবি দিয়া, চলিয়া গেল, তখন আমরা সকলে নিতান্ত ভীত হইয়া পড়িলাম| সকলেই ছেলেমানুষ, সংসারের কিছুই জানি না| বাঙ্গালীর ঘরের কচিমেয়ে শ্বশুরবাড়ী আসিলে তাহার যে কি মনে হয়, তাহা অন্তরে অন্তরে বেশ অনুভব করিতে পারিলাম| যাহা হউক, সকলে মিলিয়া নীরবে আপনাপন অদৃষ্টের নিন্দা করিতেছি, এমন সময় মহাজন আসিয়া সিন্দুক খুলিল| একমুঠা টাকা বাহির করিয়া গণিয়া দেখিল, আরও তিনটা লইল, লইয়া সিন্দুক বন্ধ করিয়া চলিয়া গেল| তখন পূজার বাজার, প্রাতঃকাল হইতে রাত্রি দশটা বারোটা অবধি দোকানে ক্রেতাগণের অবিশ্রাম কোলাহল শুনিতে পাইতাম| অধিকাংশ লোকই নোট্ লইয়া আসিত, তাহাদের বাকী টাকা ফিরাইয়া দিবার সময় সিন্দুক খোলা হইতে লাগিল, এবং মুঠা মুঠা টাকা বাহির হইয়া যাইতে লাগিল| দেখিয়া শুনিয়া আমাদের আশা হইল, এ অন্ধ কারাগার হইতে মুক্তিলাভ হইবে,-শীঘ্রই হউক আর বিলম্বেই হউক| দুই দিন পরে আমি বাহির হইলাম| পল্লীবাসী এক বৃদ্ধ তাঁহার পুত্রবধূর জন্য একখানি বোম্বাই শাড়ী ও অন্যান্য বস্ত্রাদি ক্রয় করিলেন, পঞ্চাশ টাকার একখানি নোট ছিল, ফেরৎ টাকার সঙ্গে আমি তাঁহার হাতে গিয়া পড়িলাম|

        কিন্তু বৃদ্ধের নিকট আমাকে অধিক্ষণ থাকিতে হইল না| বড়বাজার ছাড়াইবার পূর্ব্বেই এক ব্যক্তি কাঁচি দিয়া তাঁহার পিরাণের পকেট ছিন্ন করিল এবং সেই সুদ্ধ আমাদের লইয়া সরিয়া পড়িল| বোধ করি, বাসায় ফিরিয়া তিনি আমাদের বিরহে অনেক অশ্রুপাত হা হতাশ করিয়াছিলেন, আমরা তাহার কোনই সংবাদ পাই নাই| আমরা দুর্গন্ধময় গলির ভিতর দিয়া আঁকিয়া বাঁকিয়া একটি গোলার চালের ঘরে নীত হইলাম এবং সেখানে কিছুদিন রহিলাম| সমস্ত দিন ঘরে কেহ থাকিত না; সন্ধ্যা ৮টার পরে সহসা বহুলোকের সমাগম হইত, বোতল বোতল মদ আসিত, গান বাজনা হইত, অদ্ভুত গল্প চলিত - তাহারা সমস্ত দিন কেমন করিয়া কৌশলে লোককে ঠকাইয়া অর্থ উপার্জ্জন করিয়াছে, তাহারই কাহিনী তাহারা একভাগ সত্যের সহিত তিনভাগ মিথ্যা মিলাইয়া বলিত, শুনিয়া বিস্ময়ে আমি স্তম্ভিত হইয়া থাকিতাম| একদিন টাকা ভাগ হইল, আমি যাহার ভাগে পড়িলাম সে আমাকে লইয়া যাইতে যাইতে পথে এক দোকানে আমাকে দিয়া এক যোড়া জুতা কিনিয়া লইয়া গেল| পরদিন প্রভাতে ভাড়ার টাকার মধ্যে আমি জুতা বিক্রেতার বাড়ীওয়ালার হাতে গিয়া পড়িলাম|
যাঁহার বাড়ী, তিনি মধ্যবিত্ত গৃহস্থ, নিজে চাকরি করেন, দুইটি পুত্র চাকরি করে, আর দুইটি বিবাহিতা কন্যা, তাহার মধ্যে ছোটটি পিত্রালয়ে ছিল, সেই আমাকে অধিকার করিল| বাড়ীভাড়া আদায় করিয়া আসিয়া বাবুটি টাকাগুলি বাক্সে রাখিবার সময় দেখিলেন, আমিই সর্ব্বাপেক্ষা নূতন ও উজ্জল| মেয়েকে ডাকিয়া বলিলেন,-"চারু, একটা জিনিষ নিবি?"

       "কি বাবা!"

       "এই দেখ," বলিয়া বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জ্জনীর মধ্যে আমাকে ধরিয়া হাসিতে হাসিতে ঘুরাইতে লাগিলেন| মেয়ে বলিল,-"দাও বাবা, দাও বাবা, দাও!"

       "রোজ কিন্তু আমার পাকা চুল তুলে দিতে হবে|"
     "তা দোব|"
     "তবে এই নে"-মেয়েটি আমাকে পাইয়া ভারি খুসী-বারবার উল্টিয়া পাল্টিয়া দেখিতে লাগিল, দেখা শেষ হইলে সিন্দুরের কৌটার ভিতর আমাকে রাখিয়া দিল|

        তাহার সিন্দুরের কৌটার ভিতর আমাকে অনেক মাস থাকিতে হইয়া ছিল| মধ্যে মধ্যে সেই নোলকপরা ছোট মেয়েটি আমাকে বাহির করিয়া দেখিত, আমি কি নাই| আমি কি পালাই? পা ত নাই, সুতরাং একথা বলা আমার সাজে না; কিন্তু যদি থাকিত, তবে শপথ করিয়া বলিতে পারি, আমি পালাইতাম না| তত সুখ, তত যত্ন আর কোথায় পাইতাম? আমি তখন দেখিতে কি সুন্দরই হইয়াছিলাম; যন্ত্র হইতে সদ্য বাহির হইয়াছি; ঝকমক করিতেছি; দেহে স্থানে স্থানে সিন্দুর মাখা; এমন অতি অল্প টাকারই ভাগ্যে ঘটিয়া থাকে|

        একদিন বাড়ীতে কোলাহল শুনিতে পাইলাম-"জামাই এসেছে, জামাই এসেছে|" দুদিন খুব লোকজন, হাস্যপরিহাসে বাড়ী গুলজার্ রহিল; তাহার পর দিন ক্রন্দন; মেয়েটিও ফুঁপিয়া ফুঁপিয়া কাঁদিতে লাগিল| জামাইটার উপর ভারি রাগ হইল; মনে হইতে লাগিল, যদি আমি উহার হইতাম, তবে এই দণ্ডেই হারাইয়া যাইতাম| যেন হারাইয়া যাওয়াটা সম্পূর্ণ আমার আয়ত্তাধীন! তোমার পাঠকেরা বোধ হয় এ কথার কেহ আপত্তি করিবেন না; তাঁহারা কি শতবার সহস্রবার এমন ইচ্ছা করেন নাই যাহা তাঁহাদের পক্ষে এমনই অসম্ভব? সে কথা যাক্| ঘোড়ার গাড়ী, তাহার পর রেলের গাড়ী, তাহার পর ষ্টীমারে চড়িয়া আমি অনেকদূর গেলাম; ক্রমে মেয়েটির শ্বশুরবাড়ী পৌঁছিলাম| বিবাহের পর বধূ এই প্রথম "ঘরবসত" করিতে আসিল| দেখিলাম, তাহার শ্বশুর শ্বাশুড়ী দরিদ্র; ছেলেটি গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করে, গুটিকত টাকা বেতন পায় তাহাতেই কষ্টে-সৃষ্টে সংসারটি চলিয়া যায়| ছেলের মা-টি রুগ্না, মাসের মধ্যে পনেরো দিন তাঁহাকে শয্যাশায়ী থাকিতে হয়| চারু আসিয়া, রন্ধনশালায় তাঁহার "প্রবেশ নিষেধ" করিল| যে চারু কলিকাতায় অট্টালিকায় বাস করিত, মায়ের "কোলপোঁছা" মেয়েটি, কত আদরের, তিনি কখনও তাহাকে একটি কাজ করিতে দেন নাই, সেই চারু সকালে উঠিয়াই চৌকঠে জল দিতে লাগিল, ঘর বারান্দা অঙ্গন পরিষ্কার করিতে লাগিল, দেখিয়া আমার যেমন দুঃখ হইত, তেমনই আহ্লাদও হইত| একটি ঠিকা ঝি ছিল, সেই বাসন মাজিয়া কাপড় কাচিয়া দিয়া যাইত; চারু ধুচুনি করিয়া পুকুরের ঘাট হইতে চা'ল ধুইয়া আনিয়া, তরকারি কুটিয়া, মসলা বাঁটিয়া, দশটার সময় স্বামীর "স্কুলের ভাত" প্রস্তুত করিয়া দিত| চারু তাহাদের পরিবারে আসিয়া যত শোভা করিল, তত কাজ করিল, তত সহ্যও করিল| তাহার স্বামীটিও দেখিলাম বেশ মানুষ, অর্দ্ধরাত্রি অবধি তাহাদের কত গল্প হইত, কত হাসিখুসি হইত, কোনও কোনও দিন প্রদীপ লইয়া দুজনে তাস খেলিতে বসিত| কিন্তু তাহাদের এ সুখ অধিক দিন রহিল না| তাহার স্বামী জ্বরে পড়িল, তিন মাস মাহিনা পাইল না; সংসারে দীনদশা ঘিরিয়া আসিল| পিতার নিকট চারু সাহায্য প্রার্থনা করে নাই-নিজের যতগুলি টাকা ছিল, সব খরচ করিয়া ফেলিয়াছে; শেষে একদিন বাক্স খুলিয়া আমার থাকিবার কৌটাটি বাহির করিল| আমাকে লইয়া আমার গায়ের সিন্দুর বস্ত্রে ঘষিয়া ঘষিয়া মুছিয়া ফেলিল, তার পর জলে ধুইয়া ফেলিল, যখন দেখিল কোথাও সিন্দুরের আর চিহ্নমাত্রও নাই, তখন দাসীহস্তে দিয়া চাউল কিনিতে পাঠাইল| একটু দুঃখ করিল না, একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল না, অকাতরচিত্তে আমাকে বিদায় দিল| তাহা দেখিয়া প্রথমটা আমি অত্যন্ত মনঃকষ্ট পাইয়াছিলাম, পরে ভাবিয়া দেখিলাম, আমাদের জাতিটাই বড় খারাপ; আমাদের যে অধিক ভালবাসে, সেই নিন্দার পাত্র নয়| চারু যদি আমায় বিদার দিবার সময় অশ্রুপাত করিত, তবে সে কার্য্যটা নিতান্ত অচারু হইত সন্দেহ নাই| যাহা হউক, আমি সে রাত্রি মুদির তহবিল বাক্সে যাপন করিলাম|

          পরদিন প্রভাতে বাক্সে বসিয়া বেচাকেনা, দরদস্তুর, তাগাদা স্তোকবাক্যের বিচিত্র কোলাহল শুনিতে লাগিলাম| যত বেলা হইতে লাগিল, ততই খরিদ্দার বাড়িতে লাগিল| বেলা ৯টার পর ক্রমে কমিয়া আসিল, ঘণ্টা দুই পরে দোকান একেবারে নিস্তব্ধ| কেবল মধ্যে মধ্যে পথে দুই একখানা গোরুর গাড়ীর চাকার ক্যাঁচকোচ এবং চালকের জিহ্বা ও তালুর সাহায্যে অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ কর্ণগোচর হইতে লাগিল| বেলা যখন দ্বিপ্রহর, তখন মাথায় গামছা বাঁধিয়া পান চিবাইতে চিবাইতে মুদির ছেলে আসিয়া বলিল, "বাবা, খেয়ে আসগে, আমি দোকান আগলুই|" মুদি তহবিল বাক্সে চাবি বন্ধ করিয়া চাবির গোচ্ছা ঘুন্সিতে বাঁধিয়া লইল; ছেলেকে বলিল, "দেখিস যেন খদ্দের ঠকিয়ে না যায়-আর বেশী টাকার জিনিস চায় ত বলিস, বসো, তামুক খাও, বাবা এল বলে|" মুদি চলিয়া গেল; অল্পক্ষণ পরে গুন্ গুন্ করিয়া মুদিপুত্র গান ধরিল-
                 প্রাণপতি করি এই মিনতি,
                 আমার জীবন রামকে বনে দি-ই-ই-ওনা|

           একবার পথে নমিয়া দেখিয়া আসিল, বাবা অনেক দূর চলিয়া গিয়াছে| তখন সে আপনার ঘুন্সি হইতে একটি চাবি বাহির করিয়া তহবিল বাক্সটি খুলিয়া ফেলিল| তৈলোজ্জল কৃষ্ণমুখমণ্ডলে শুভ্রদন্তপংক্তির শোভা বিস্তার করিয়া বলিল - "এঃ, আজ আর মেলা নেই; বেশী নিলে বাবা শালা টপ্ করে ধরে ফেল্বে"-বলিয়া আমাকে তুলিয়া লইল, আর একটা আধুলি লইল, লইয়া কোঁচার খুঁটে বাঁধিল, বাঁধিয়া সমস্তটা পেট কাপড়ে গুঁজিয়া রাখিল| বাক্স বন্ধ করিয়া, তখন আবার পূর্ব্বমত ঘাড় কাঁপাইয়া তাহার সঙ্গীতচর্চ্চা চলিতে লাগিল-

                   জীবন রামকে সঙ্গে করে, না হয় খাব ভিক্ষা করে,
                   অযোধ্যা পুরে|
                   জীবন রামকে বনে দিলে,
                   জীবনে জীবন রবে না-আ-আ-আ| ইত্যাদি|

           তাহার আচরণ দেখিয়া আমি মনে মনে হাসিতে লাগিলাম; ভাবিলাম, দেখ একবার, কলিকালে বাপ বেটার বিশ্বাস নাই, অন্য লোকের মধ্যে থাকিবে কি করিয়া? সেই দিন বৈকালে তাহার পেটকাপড় হইতে একটি ময়লা ছিটের থলির মধ্যে আশ্রয় প্রাপ্ত হইয়া একটি ভাঙ্গা টিনের পেটরায় বন্ধ হইলাম| এ অবস্থায় আমার মাস দুই থাকিতে হইয়াছিল|

            এক দিন শুনিলাম, মুদিপুত্র মামার বাড়ী যাইতেছে| যাহা আশা করিয়াছিলাম, তাহাই ঘটিল; যাত্রা করিবার সময় আমার থলিটি চুপে চুপে বাহির করিয়া লইয়া গেল| পথে যাইতে যাইতে পিতৃদত্ত সদুপায়ে অর্জ্জিত আরও কয়েকটি টাকা থলির ভিতর রাখিয়া দিল| গরুর গাড়ীর গাড়োয়ান, কৃষাণ, রাস্তামেরামতকারী কনট্র্যাক্টর মিস্ত্রী প্রভৃতি বহুলোকের নিকট হইতে কলিকা লইয়া তামাক খাইতে খাইতে, কখনও উচ্চৈঃস্বরে কখন গুণ গুণ করিয়া গান গাহিতে গাহিতে, সহচারী লোকদিগের নাম ধাম, গন্তব্যস্থান, পিতৃপুরুষের পরিচয় সম্বন্ধে সহস্র অনর্থক প্রশ্ন করিতে করিতে, বগলে ছাতা, বামহস্তে জুতা ও দক্ষিণে পুঁটুলি লইয়া অবশেষে ষ্টেশনে উত্তীর্ণ হইল| টিকিট কিনিবার সময় আমাকে ছাড়িয়া দিল, আমি সেই দুর্গন্ধময় বস্ত্রকারাগার হইতে মুক্তিলাভ করিয়া বাঁচিলাম|

           টিকিট বাবু আমাকে পাইবামাত্র একবার ঠং করিয়া টেবিলে আছাড় দিলেন-আমি ভাবিলাম, "বাবা, বহুনি হইল মন্দ নয়, এইরূপে বারকতক সদ্ভাবিত হইলেই ত গিয়াছি|" যতক্ষণ টিকিট বিক্রয় চলিতে লাগিল, ততক্ষণ আমি চিৎ হইয়া টেবিলের উপরই পড়িয়া রহিলাম| আমার উপরে, পার্শ্বে, ঝনঝন করিয়া আরও টাকা, আধুলি, সিকি, দুয়ানি, পয়সা আসিয়া পড়িতে লাগিল| বিক্রয় শেষ হইলে, বাবু ভিন্ন মূল্যের মুদ্রা আলাদা করিয়া গণিয়া সাজাইয়া ক্যাশ মিলাইতে লাগিলেন| শেষ আলমারি বন্ধ করিয়া তিনি চলিয়া গেলেন| অনেকক্ষণ পরে পুনরায় টিকিটের ঘণ্টা বাজিল| আবার আলমারি খুলিল| কিয়ৎক্ষণ পরে টিকিটবাবুর একটি কার্য্য দেখিয়া আমি অত্যন্ত বিস্মিত হইলাম| আলমারির একটি কোণে একটি টাকা একাকী পড়িয়া ছিল; বেশ করিয়া চাহিয়া চাহিয়া দেখিলাম, বুঝিতে পারিলাম সেটি অতিজাত বংশীয় নহে,-অর্থাৎ তোমরা যাহাকে বল মেকি টাকা| টিকিট বাবু এক ব্যক্তির নিকট টাকা লইয়া, সাঁ করিয়া সেই মেকি টাকা বাহির করিয়া তাহাকে ফিরিয়া দিলেন, বলিলেন, বদ্লাইয়া দাও, এটা চলিবে না| সে বেচারী তাঁহার জুয়াচুরি ধরিতে পারিল না; বলিল, "দোহাই হুজুর, আর আমার একটিও টাকা নাই, এই দ্যাখেন আমার কাপড় চোপড়| যেমন করে হোক্, দ্যান আমায় নিব্বাহ করে কত্তা|" বাবু রূঢ়স্বরে বলিলেন-"একি কত্তার বাবার ঘরের কথা? কি ক'রে তোমার নিব্বাহ ক'রে দোব? যখন আমার মাইনে থেকে কেটে নেবে তখন কোন বেটাকে ধর্বো?" লোকটা যত কাকুতি মিনতি করিতে লাগিল, বাবু মহাশয় ততই সপ্তমে চড়িতে লাগিলেন| তিনি অনায়াসেই সেই টাকা পরে অন্য কাহারও স্কন্ধে চালাইতে পারিতেন, কিন্তু কি জানি কেন তিনি রণে ভঙ্গ দিতে চাহিলেন না| বাবু অবশেষে অগ্নিশর্ম্মা হইয়া তাহার বাকী টাকা পয়সা গুলি মুঠা করিয়া হুহুঙ্কারের সহিত সেই গরীবের গায়ে ছড়াইয়া ফেলিয়া দিলেন; সে ব্যক্তির আর যাওয়া হইল না| আহা, আবার বোধ হয় তাহাকে পাঁচ সাত ক্রোশ হাঁটিয়া বাড়ী ফিরিয়া একটি ভাল টাকা সংগ্রহ করিয়া আনিতে হইয়াছিল|

         সেই দিন রাত্রে ডাকগাড়ীর পূর্ব্বে এক সাহেব আসিয়া বোম্বাইর টিকিট চাহিলেন| নোট দিয়া তাঁহার যে টাকা ফিরিল, তাহার সহিত আমাকেও যাইতে হইল| আমি সুকোমল মনিব্যাগে বন্ধ হইয়া সাহেবের পকেটে বাসা করিলাম| পথে যাইতে যাইতে কথায় বার্তায় জানিতে পারিলাম, তিনি নূতন ম্যাজিষ্ট্রেট হইয়া ইংলণ্ড হইতে আসিয়াছিলেন, সম্প্রতি ছুটি লইয়া পরিবার আনিতে যাইতেছেন| আমি মনে করিলাম, এই সুযোগে একবার বিলাতটা বেড়াইয়া আসা হইবে; আশায় উৎফুল্ল হইয়া কালাতিপাত করিতে লাগিলাম| কিন্তু আমার মনোরথ পূর্ণ হইল না; সাহেব জলরথে আরোহণ করিবার পূর্ব্বে যে হোটেলে পানাহার করিলেন, তথায় আমায় পরিত্যাগ করিয়া গেলেন| আমি হোটেলের ক্যাশবাক্সে হইতে আয়রণচেষ্টে স্থান প্রাপ্ত হইলাম|

        আমি এই সময়ে তাহাকে বাধা দিয়া বলিলাম,-"ওহে তোমার গল্প যে ক্রমশ "ডল" হইয়া পড়িতেছে; আমার পাঠকেরা যে বিরক্ত হইয়া উঠিবেন; তাহা ছাড়া তোমার জীবনের প্রতি ঘটনা এরূপ পূঙ্খানুপূঙ্খরূপে লিখিতে গেলে প্রবন্ধের কলেবর যে নিতান্ত দীর্ঘ হইয়া পড়িবে-সম্পাদক মহাশয় আমাকে লাঠি নিয়া তাড়া করিয়া আসিবেন| তুমি বরং তোমার জীবনের প্রধান প্রধান ঘটনাগুলি সংক্ষেপে বলিয়া যাও|" মুখনল বলিল,-"বটে? আচ্ছা তাহাই হইবে| আর আমার জীবনের বেশী বাকীও নাই, কিন্তু আসল ঘটনাগুলিই বাকী রহিয়াছে| উঃ-আমি এত সহ্য করিয়াছি, এত সুখভোগ করিয়াছি যে তোমরা হইলে আতিশয্যে দম ফাটিয়া মরিয়া যাইতে| মন দিয়া শুন|"

        হোটেলের আয়রণচেষ্টে প্রতিদিন টাকা যাহা জমা হয়, পর দিন সমস্ত ব্যাঙ্কে গিয়া পৌঁছে-কিন্তু আমাকে ব্যাঙ্ক যাইতে হইল না| হোটেল-সাহেবের কনিষ্ঠ পুত্রটি অত্যন্ত শিকারপ্রিয়| সে সেইদিন বহু বন্ধু সমতিব্যাহারে দূরদেশে শিকার করিতে চলিল| পথখরচের জন্য একখানা নোট ভাঙ্গাইয়া টাকা লইল, তাহার মধ্যে আমি পড়িয়া গেলাম| সাহেবতনয়গণ বোম্বাই ষ্টেশনে গাড়ী চড়িয়া পাঁচ ছয় ঘণ্টার পর এক স্থানে অবতরণ করিল; ষ্টেশনের কিছু দূরে তাম্বু ফেলিল; তাহার পর হিপ হিপ হুররে নাদে দিগন্ত প্রকম্পিত করিয়া জঙ্গলে প্রবেশ করিল| দুমদাম বন্দুকের আওয়াজ, বিজাতীয় চীৎকার, কখনও ধীরপদে গমন, কখনও ধাবন, কখনও লম্ফন, এইরূপ করিয়া সন্ধ্যা হইয়া আসিল, সকলে তাম্বুতে ফিরিল| এই রূপ সাহেবের পকেটে থাকিয়া প্রতিদিন শিকারে যাইতে লাগিলাম| একদিন একটা কৃষ্ণসারজাতীয় হরিণ সাহেবদের লক্ষ্য ব্যর্থ করিয়া একটা গভীর জঙ্গলে লুক্কায়িত হইল| সে জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করিতে সাহেবরা অনেক চেষ্টা করিল, কিন্তু পথ খুঁজিয়া পাইল না| সেই স্থানে একটি কাঠুরিয়াদের ছোট মেয়ে কাঁসার মল পরিয়া দাঁড়াইয়া তামাসা দেখিতেছিল, সে বলিল,-"সাহেব লোক, আমি প্রবেশের পথ দেখাইয়া দিতে পারি, আমায় কি দিবে আগে বল|" আমার সাহেব, মনিব্যাগটি খুলিয়া আমাকে বাহির করিয়া মেয়েটিকে দেখাইলেন; দেখাইয়া মনিব্যাগটি, তৎপশ্চাৎ আমাকে খোলা অবস্থায় পকেটে ফেলিয়া দিলেন| মেয়েটি আগে আগে চলিল, সাহেবরা তাহার অনুগমন করিল; শেষে মেয়েটির দর্শিত পথে এক স্থানে খুব ঝুঁকিয়া দুই হাতে ডালপালা ঠেলিয়া জঙ্গলে প্রবেশ করিল| মেয়েটি তখন প্রতিশ্রুত পুরস্কার চাহিল; সাহেব বন্দুক উঁচাইয়া বিকৃত মোটাগলায় বলিলেন, "ব্যা - গো"| সে বেচারী সুবিধা নয় দেখিয়া সরিয়া পড়িল| সাহেবের এই আচরণ দেখিয়া আমার বড় লজ্জা হইতে লাগিল| ইচ্ছা করিতে লাগিল, এই দুরাচারের কাছ হইতে হারাইয়া যাই; এবার আমার অভীষ্ট সফলও হইল, এবং আমার জীবনের সর্ব্বাপেক্ষা সুখের কাল আরম্ভ হইল| সাহেবগণ হরিণের জন্য অনেক ব্যর্থ চেষ্টা করিয়া জঙ্গল হইতে বাহিরে আসিল| যখন সন্ধ্যা হয় হয়, মোটা ঘাসগুলি বেশ দেখা যাইতেছে না, তখন সাহেবরা এক অনতিউচ্চ প্রস্তরবেদীর উপর উঠিল, সেখানে খালের ধারে বন্যহংস চরিতেছিল| সাহেবরা তাহাদের প্রতি লক্ষ্য করিবার চেষ্টা করিল| একটা বৃক্ষের স্থূলবক্রশাখার উপর ভর দিয়া ঝুঁকিয়া পড়িয়া আমার সাহেব যখন নিশানা করিতেছিলেন, তখন আমি তাঁহার বুকপকেট হইতে ঠুন্ করিয়া পড়িয়া গেলাম| সাহেব আমার পতনশব্দ বোধ হয় শুনিতে পাইলেন, কারণ তাঁহার মুখে একটা "ইণ্টর্জেক্সনে"র অস্ফুটধ্বনি শুনিয়াছিলাম, কিন্তু তিনি যেমন নিশানা করিতেছিলেন, তেমনি করিতে রহিলেন| আমি এই অবসরে পাথরের উপর দিয়া, ঘাসের উপর দিয়া, বালির উপর দিয়া, গড়াইয়া ঠিকরাইয়া একটা গাবভেরাণ্ডার ঝোপের পাশে গিয়া পড়িলাম| সাহেবের বন্দুক সে বার বিশ্বাস রাখিল, পাখীর ঝাঁক উড়িয়া গেল কিন্তু দুইটা পড়িয়া মৃত্যুযন্ত্রণায় ছট্ফট্ করিতে লাগিল| সাহেব মত্ত হইয়া সেইদিকে ছুটিলেন, আমার কথা আর খেয়াল হইল না|

         সাহেবেরা চলিয়া গেল, আমি মুক্ত আকাশের তলে, মুক্ত বাতাসে পড়িয়া রহিলাম| আজ আমার জীবনের বড় শুভরাত্রি| এমন আরাম, এমন স্বাধীনতা জন্মের পর এই আমার প্রথম ঘটিল| সে রাত্রি অতি আহ্লাদে আমি নিদ্রা যাইতে পারিলাম না| সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনাইয়া আসিল, মৃদুমন্দ বাতাস বহিতে লাগিল, দূরে কাছে ঝোপে ঝাপে বনপুষ্প ফুটিয়া উঠিতে লাগিল, তাহার গন্ধ একপ্রকার নূতনতর, আমি বাক্সে বাক্সে আতর গোলাপ বিলাতী এসেন্স, বাগানে বাগানে গোলাপ, বেলা, রজনীগন্ধা, কত পুষ্পের আঘ্রাণ পাইয়াছি, কিন্তু এমনটি আর কোথাও পাই নাই-সে অতি অপূর্ব্ব|

        আমি বলিলাম,-"ভুল; তোমার ওটি ভুল| সৃষ্টির আদিকালে বাগানের ফুলও বনে ফুটিত, কিন্তু যে সকল ফুলকে শোভায় সৌরভে শ্রেষ্ঠ বলিয়া মানুষ বিবেচনা করিল, তাহাদিগকেই তুলিয়া আনিয়া বাগান সাজাইল| বাগানের ফুল অপেক্ষা বনফুলকে শ্রেষ্ঠ আসন দেওয়া আধুনিক কবিদিগের একটা ফ্যাসান হইয়াছে বটে, কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ অবিচার|"

        মুখনল বলিল,-"আমি ত আর কবি নহি, কোনও আধুনিক কাব্য ও পাঠ করি নাই, তবে আমার সে গন্ধ এত ভাল লাগিয়াছিল কেন?"

        আমি অধ্যাপকোচিত গাম্ভীর্য্যের সহিত বলিলাম,-"উহার ভিতর একটু মনস্তত্ত্বঘটিত জটিলতা আছে| যখন তুমি আতর, এসেন্স, বেলা, গোলাপের গন্ধ ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে অনুভব করিয়াছিলে, তখন তুমি পরাধীন| এখন তুমি স্বাধীন; তখন ভালও মন্দ লাগিবার কথা, এখন মন্দও সুধাবৎ লাগিবে| সেই শ্লোকটা জান না?"

       মুখনল বলিল,-"থাম, থাম, অত বিদ্যা আমার নাই| আচ্ছা না হয় তোমার থিওরিই মানিয়া লইলাম| শুনিয়া যাও, বৃথা তর্ক করিয়া রসভঙ্গ করিও না| হাঁ, কি বলিতেছিলাম, চারিদিক্ হইতে ফুলের গন্ধ আসিতেছিল, আকাশে দুইটি একটি করিয়া শত সহস্র নক্ষত্র জ্বলিয়া উঠিল, জীবজন্তুর কোথাও আর কোনও চিহ্ণ দেখা গেল না, কেবল অনেক রাত্রে একটা নেকড়ে বাঘ জল খাইতে আসিয়াছিল, তাহার পা লাগিয়া একটা প্রস্তর গড়াইয়া আমার অতি নিকট দিয়া নীচে গড়াইয়া গেল| রাত্রি গভীর হইল, আকাশে কৃষ্ণপক্ষের চন্দ্রখণ্ড ভাসিয়া উঠিল, শিশির পড়িতে লাগিল,-সে কি স্নিগ্ধ! প্রাণমন শীতল হইল; ভাবিলাম, এই ভারতবর্ষের সাম্রাজ্ঞীর মুখমণ্ডল-চিহ্ণ বক্ষে ধারণ করিয়া, কত কোটি কোটি আমার স্বজাতীয়গণ বিচরণ করিতেছে, তাহাদের মধ্যে কয়জন এমন করিয়া শিশির জলে স্নান করিতে পাইতেছে? সকলে আয়রণ চেষ্টে, না হয় কাঠের বাক্সে,- না হয় চর্ম্মপেটকে বা রুমালে, নয় ত দেশী লোকের কাপড়ের কিম্বা চাদরের খুঁটে, ট্যাঁকে এবং অবস্থাবিশেষে কক্ষে, আবধ আছে, ভাল করিয়া নিশ্বাসও ফেলিতে পাইতেছে না| আমি নিশ্চয়ই পূর্ব্বজন্মে কোনও বৃহৎ পুণ্যকর্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়াছিলাম, সেই সুকৃতির বলে আমার এই সুখলাভ হইল| যদি কেহ লোকালয়ে পথে ঘাটে দৈবাৎ পড়িয়াও থাকে, তবে সেও আমার ন্যায় এমনি আরামে আছে বটে, কিন্তু সে তাহার কতক্ষণ? প্রভাত হইতে না হইতেই কোনও ঊষাচারী পথিক তাহাকে কবলিত করিয়া পকেটে ফেলিবে, আবার যে দুর্দ্দশা! আর আমি দিনের পরদিন, রাত্রির পর রাত্রি এই খানে পড়িয়া বিশুদ্ধতম বনবায়ু সেবন করিব, শিশিরে অঙ্গধাবন করিব, পাখীর গান শুনিয়া ঘুমাইয়া পড়িব, মুখে প্রভাতের রৌদ্রে আসিয়া লাগিলে জাগিয়া উঠিব| আহা, যদি চলিতে পারিতাম, তবে ঐ স্ফটিকস্বচ্ছ ঝরণার জল একটু পান করিয়া আসিতাম, আর গোটা কত ঐ ফুল তুলিয়া আনিয়া বিছাইয়া শয়ন করিতাম, আর ঐ কি একটা লাল টুকটুকে ফল পাকিয়া রহিয়াছে, উহার রস দিয়া মুখটি একটু রাঙইয়া লইতাম| বাসনার এইরূপ নিষ্ফল আবেগ প্রতিনিয়ত আমার বক্ষঃপঞ্জরে আঘাত করিত, তথাপি বড় সুখে ছিলাম| কিন্তু প্রতিদিন আমার উপরে ধুলিস্তর জমা হইতে লাগিল| দেখিলাম, ক্রমেই আচ্ছন্ন হইয়া পড়িতেছি| একটু দুঃখ হইল, কিন্তু কি করিব, উপায় নাই| মাসের পর মাস চলিয়া গেল, আমি সম্পূর্ণরূপে আবৃত হইয়া গেলাম| আর পাখীর গান শুনিতে পাই না, ফুলের গন্ধ পাই না, নবরৌদ্ররাগে রঞ্জিত প্রভাতগগনের শোভা দেখিতে পাই না, আমি যেন গভীর নিদ্রায় মগ্ন রহিলাম| কতকাল পরে বলিতে পারি না, একদিন কিঞ্চিত শীতলতা অনুভব করিলাম| দেখিলাম, আমার দেহের আবরণমৃত্তিকা সিক্ত হইতেছে; ক্রমে তাহা গলিয়া ধৌত হইয়া গেল; আমার যেন নিদ্রাভঙ্গ হইল; দেখিলাম, পাংশুবর্ণ মেঘে আকাশটা পূরিয়া গিয়াছে, মুষলধারায় বৃষ্টি পড়িতেছে, আমার এমন সুখবোধ হইল যে, সে আর তুমি কি বুঝিবে? তোমরা বৃষ্টির সময় ছাতা, ওয়াটারপ্রুফ্ ব্যবহার কর, প্রকৃতিদত্ত একটা মহাসুখ হইতে স্বেচ্ছায় বঞ্চিত হইয়া থাক, তোমাদের কথাই স্বতন্ত্র| আমি দেখিলাম, বনের সমস্ত গাছপালা উন্মুখ হইয়া দাঁড়াইয়া ভিজিতেছে, যেন কতদিনকার তৃষ্ণা আজ সাগ্রহে মিটাইতেছে| আকাশে বিদ্যুতের ঝিলিক দিতে লাগিল; সেই এক চমৎকার ব্যাপার, একবার করিয়া বিদ্যুৎ চমকে, আর আমি নিশ্বাস বন্দ করিয়া থাকি-যতক্ষণ মেঘ না ডাকিবে, ততক্ষণ নিশ্বাস ফেলিব না| সে একটা খেলামাত্র, তাহার কোনও বৈজ্ঞানিক বা আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য ছিল না| ক্রমে জল ছাড়িয়া গেল; পূর্ব্বদিকে রামধনু দেখা দিল; ক্রমে সন্ধ্যায় চারিদিক অন্ধকার হইয়া আসিল| বর্ষাকাল, প্রায়ই এইরূপ জল হইত; ক্রমে বর্ষা ছাড়িয়া শরৎ আসিল, হেমন্ত আসিল, আমি আবার ঢাকা পড়িয়া দুরন্ত শীত হইতে আত্মরক্ষা করিলাম| আবার বর্ষাকালে সহসা একদিন বাহির হইলাম| এইরূপ প্রতিবৎসর হইতে লাগিল; কবৎসর কাটিয়া গেল, তাহার কোনও হিসাব রাখিতে পারি নাই; একদিন আমার অবস্থায় আকস্মিক পরিবর্ত্তন ঘটিল|

         ডিটেকটিভ-পুলিশের এক দেশীয় কর্ম্মচারী অশ্বারোহণে সেই বনে প্রবেশ করিয়া, যেখানে আমি পড়িয়াছিলাম তাহার অতি নিকট দিয়াই যাইতেছিলেন| যাই আমাকে দেখিতে পাওয়া, অমনি অশ্ব হইতে লম্ফ দান, এবং বাক্যব্যয়মাত্র না করিয়া আমাকে পকেটে গ্রহণ|

         তুমি আমার জীবনচরিত সংক্ষেপে বলিতে বলিয়াছ; সুতরাং কেমন করিয়া আমি পুলিস্কর্ম্মচারীর হস্ত হইতে পোষ্ট আফিসে, এবং তৎপর দিন সেভিংস্ব্যাঙ্কের টাকার সহিত স্কুলের হেডমাষ্টারের নিকট ও ক্রমে ক্রমে ফল বিক্রেতা, সাহেবের খানসামা, মৎস্য-বিক্রেতা, বস্ত্র বিক্রেতা, আয়কর কর্ম্মচারী, গভর্ণমেণ্ট ট্রেঝরি, এবং তথা হইতে বহুলোকের হস্ত অতিক্রম করিয়া মিরজাপুরের এক শিবমন্দিরের পূজারীর হস্তে আসিয়া পড়িলাম, তাহার সবিস্তার বর্ণনার আর প্রয়োজন নাই| পূজারী মহাশয় আমাকে ট্যাঁকে গুঁজিয়া গঙ্গার ঘাটে স্নান করিতেছিলেন, কম্পিত স্বরে উচ্চারণদুষ্ট সংস্কৃত মন্ত্র পাঠ করিতেছিলেন এবং বিরলকেশ সুমসৃণ মস্তক খানিতে সঘন করসঞ্চালন করিতে করিতে ডুবের পর ডুব দিতিছিলেন, হেনকালে তাঁহার নীবিবন্ধ শিথিল হইল, আমি তাঁহার ট্যাঁকচ্যুত হইয়া অতি কোমল মৃত্তিকা শয়ন লাভ করিলাম| স্নানান্তে তীরে উঠিলে তিনি জানিতে পারিলেন আমি হারাইয়াছি| আবার জলে নামিয়া দুই দণ্ড ধরিয়া ডুব পাড়িয়া পাড়িয়া অনেক ব্যর্থ অন্বেষণ করিলেন; আমার আশে পাশে তাঁহার হস্ত আসিয়া পড়িতে লাগিল, কিন্তু আমি সেখানকার সেই খানেই রহিলাম| স্রোতে স্রোতে চুল পরিমান সরিয়া সরিয়া সমস্ত দিবা রাত্রে যেখানে পড়িয়াছিলাম সেখান হইতে দুই হস্ত পরিমিত দূরে গিয়া পড়িলাম| সেখানে মগ্ন জল, সুতরাং পরদিন স্নানের কেহই সেখানে আসিল না| আমি জলের ভিতর দিয়া জলতলবিহারী প্রাণীদের আহার ক্রীড়া যুদ্ধ প্রভৃতি সমস্ত উদ্যম দেখিতে লাগিলাম| সে রাজ্য সম্পূর্ণ অরাজক| সবল দুর্ব্বলের প্রতি অবাধে নির্ভয়ে অত্যাচার করে; কেহ তাহার প্রতিবাদ বা প্রতিবিধান করিতে অগ্রসর হয় না| কূম্ভীর, রাজার মত গভীর হইয়া বসিয়া থাকেন, কাহারও সহিত বাক্যালাপ করেন না; আর করিবেনই বা কাহার সঙ্গে? কেহ তাঁহার নিকট ঘেঁসিতেই সাহস করে না| মৎস্যগণ খুব আনন্দ করিয়া বেড়াইতেছে| চূনা পুঁটিরা কিছু চপল প্রকৃতির, প্রপিতামহ রোহিতের স্কন্ধে পুচ্ছে উঠিয়া নৃত্য করিতেছে| কর্ক্কটকুল আপন আপন বিবরে বসিয়া দাড়া নাড়িতেছে| এইরূপ জলবাসে আমার অনেক মাস অতিবাহিত হইল| জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড গ্রীষ্মে গঙ্গা আপনার জল সরাইয়া সরাইয়া এক দিন আমাকে স্বীয় কুক্ষি হইতে মুক্ত করিয়া দিলেন, কিন্তু আমার উপর কিয়দংশ কর্দ্দমের আচ্ছাদন রাখিয়া গেলেন, বোধ হয় আশা ছিল, আবার শ্রাবণ ভাদ্র মাসে সময় ভাল হইলে আমাকে অধিকার করিবেন| কিন্তু তাহা হইল না| একটী প্রৌঢ়াদাসী তীরে বসিয়া কটাহ মাজিতে মাজিতে অঙ্গুলি দিয়া মৃত্তিকা সংগ্রহ করিতেছিল, সে আমাকে দৈবধন বলিয়া ললাটে স্পর্শ করিয়া উত্তমরূপ ধৌত করণনান্তর অঞ্চলবদ্ধ করিল|

          অনেক রাত্রি হইয়াছে, তোমাকে আবার প্রভাতে গ্রামান্তরে রোগী দেখিতে যাইতে হইবে, সুতরাং গল্প শেষ করি| সেই দাসীর হস্ত হইতে ক্রমে আমি বহুলোকের হস্ত অতিক্রম করিয়া ভিজিট স্বরূপ কেমন করিয়া তোমার হাতে আসিয়া পড়িলাম, সে কথায় আর কায নাই; বিশেষতঃ, উল্লেখযোগ্য ঘটনা তেমন কিছুই ঘটে নাই| একবার কেবল এক দুই বৎসরের শিশু কর্ত্তৃক তাহার মাতার অজ্ঞাতে ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হইয়া বিলক্ষণ বিপদে পড়িয়াছিলাম; কিন্তু হায় হায়, তাহার পর যে বিপদ ঘটিয়াছে, তুলনা করিলে ভাতের হাঁড়ির সেই উত্তাপকে শীতলতাই বলিতে হয়| তুমি যখন গৃহিণীর সঙ্গে পরামর্শ করিয়া একটা নূতন মুখনল গাড়াইবার জন্য স্বর্ণকার ডাকিয়া খুকীর মলের ভগ্নাংশের সহিত আমাকে অর্পন করিলে, তখনই আমার আত্মাপুরুষ শুকাইয়া গেল| তাহার পর সেই সদ্যরচিত মৃৎপাত্র হাফরে রাখিয়া বাঁশের চোঙার ফুৎকার দিতে দিতে যখন আমার সাক্ষাৎ যমরূপী কৈলেস সেকরা আমাকে তাহাতে ফেলিল, তখন উঃ-

          আমি বলিলাম, ভাই আর কায নাই; কিন্তু আমাকে অপরাধী কর কেন? আমার দোষ কি?

          মুখনল বলিল, তোমার আর দোষ কি? অদৃষ্ট ভিন্ন পথ নাই| আমার অদৃষ্টে যাহা ছিল, তাহা ঘটিয়াছে| আমার জীবনী জনসমাজে প্রচার করিয়া তোমার এই অজ্ঞানকৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিয়ো|

( ‘দাসী’ পত্রিকা, ৫ম ভাগ ৯ম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দ )|

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।