পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
আমাদের
কথা
প্রফুল্লময়ী
দেবী
[ লেখক
পরিচিতি : প্রফুল্লময়ীর জন্ম ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে ; পিতা হাওড়ার
সাঁতরাগাছির অধিবাসী হরদেব চট্টোপাধ্যায় | প্রফুল্লময়ী ছিলেন
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ পুত্র বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের
( ১৮৪৫ - ১৯১৫ ) সহধর্মিণী | বোন নীপময়ীর সঙ্গে বিয়ে হয় মহর্ষির
তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথের | লেখা , গান গাওয়া ইত্যাদি ব্যাপারে
সুধীন্দ্রনাথের বড় মেয়ে রমার উৎসাহ ছিল খুব বেশী | মুলতঃ তারই
অনুপ্রেরণায় প্রফুল্লময়ী বর্তমান লেখাটি লিখেছেন | তার ছিল
'স্বর্ণচাঁপার পাপড়ির ফিকে সোনার মত চমৎকার গায়ের রঙ , পদ্মের
পাপড়ির মত টানা-টানা ডাগর দুটি ভ্রমরকৃষ্ণ চোখ , নিখুঁত মুখশ্রী
, চমৎকার গড়ন , মিষ্টি গলা' | সব থাকা সত্ত্বেও সুখ ছিল তার
কাছে আক্ষরিক অর্থেই অধরা | অনেকের ধারণা ঠাকুর বাড়ীর মেয়েরা
সবাই পোষাক-পরিচ্ছদে , ঘোড়ায় চরায় , মেলা মেশায় অত্যন্ত বহির্মুখী
মানসিকতা সম্পন্ন ছিলেন এবং অনেক ঐশ্বর্য্য নিয়ে ভোগ-সুখের
মধ্যে তাদের জীবন কেটেছে ; কিন্তু এরই মধ্যে ব্যক্তি জীবনে
তাদের অনেককেই সীমাহীন অন্তর্দ্বন্দ , শোক ও দুঃখের সম্মুখীন
হতে হয়েছে | অসাধারণ স্থৈর্য ও আত্মসংযমের সঙ্গে সেই প্রতিকূলতার
সঙ্গে সংগ্রাম করার ফলে শোক দুঃখহীন এক বিরাট সত্তার স্পর্শ
পেয়েছেন , অন্তর্জগতে এক গভীর অনুভূতি আস্বাদন করেছেন যেটা
বাইরে থেকে তাদের জীবনধারা থেকে বোঝা খুব শক্ত | প্রফুল্লময়ী
ছিলেন এ রকমই একজন মহিলা | ১৯৪০ খৃষ্টাব্দে তার মৃত্যু হয়
....
দীপক সেনগুপ্ত]
প্রথম অংশ
আমাদের ভারতবর্ষের মেয়েরা
যে-সকল ব্রত পালন করিয়া থাকেন, সেইগুলির মধ্য দিয়া অনেক দিক
হইতে তাঁহাদের চরিত্র-গঠনের সহায়তা হইয়া থাকে। পরিবারের সকলের
সহিত স্নেহ, মমতা, দয়া, সহিষ্ণুতা ক্ষমার দ্বারা আপনার মনের
দুর্ব্বলতাকে জয় করিয়া আপনাকে নতভাবে মিলাইয়া দিবার পথ নির্দ্দেশের
একটি পথ মাত্র, এই ব্রত। এখন ইহা ক্রমশঃ বিদেশীয় ভাবের ও শিক্ষার
প্রভাবে ধীরে ধীরে লুপ্ত হইয়া আসিতেছে। পারিবারিক সুখশান্তি
কল্যাণ সবই স্ত্রীলোকের উপর পুরুষের অপেক্ষা বেশী নির্ভর করিয়া
থাকে , সন্তান পালন, তাহাতেও স্ত্রীলোকের দায়িত্ব বেশী। মাতা
যদি সন্তানদিগকে উত্তমরূপে শিক্ষা দিতে সক্ষম না হইত তবে সে
সংসার সুখের হয় না। কত বড় দায়িত্ব ও সংসারের বন্ধনের দ্বারা
স্ত্রীলোকেরা জড়িত রহিয়াছেন , তাহা বোধ করিবার প্রয়োজন ও শক্তি
আমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা তাঁহাদের সৎকর্ম্মের অনুষ্ঠানের দ্বারা
দেখাইয়া গিয়াছেন।
শিশুকাল হইতে এই ব্রত পালনের
ফলে দেখিতে পাওয়া যায় , যে কোনো একটা সামাজিক বা সংসারের নিজেদের
কার্য্যের ত্রুটি বা বিশৃঙ্খলতা আনয়ন করিতে তাঁহারা সহজে সাহস
পান না , অকল্যাণের, অমর্য্যাদার ভয় তাঁহাদের মনে প্রথমেই ঘা
দেয়, এই কারণে ইহাকে আমরা যতই হীনচক্ষে দেখি না কেন, এখন সমাজের
যেরূপ অবস্থা দাঁড়াইয়াছে তাহার সহিত তুলনা করিয়া দেখা যায় যে,
বাল্যকালে এই ব্রতের ভিতর দিয়া তাঁহারা যে শ্রদ্ধা, ভক্তি, প্রীতি
অর্জ্জন করিতেন এখনকার ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ভিতর সেটারই বড় অভাব।
যে শিক্ষা আমাদের দেশের উপযোগী ও সংসারের কল্যাণ এবং শ্রীবৃদ্ধি
করিবে, সেই শিক্ষা সন্তানদিগকে দেওয়া কর্ত্তব্য, কারণ ভবিষ্যতের
চিরমঙ্গল তাহাদেরই উপর নির্ভর করিতেছে। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন
ঐরূপ অনেক ব্রত করিয়াছি , একটি ব্রত উহার মধ্যে আমার মনে পড়ে
তাহাকে " পুণ্যিপুকুর ব্রত " বলা হইত। ইহার মধ্যে
দশটি শ্লোক আছে , যথা - সীতার মত সতী হবে , দশরথের মত শ্বশুর
হবে , কৌশল্যার মত শ্বাশুড়ী হবে , রামের মত পতি হবে , লক্ষণের
মত দেওর হবে , কুন্তীর মত পুত্রবতী হবে , দুর্গার মত সৌভাগ্যবতী
হবে , দ্রৌপদীর মত রাঁধুনী হবে , গঙ্গার মত শীতল হবে , পৃথিবীর
মত ধৈর্য্য হবে। এই সব গুণ যদি প্রত্যেকের মধ্যে বর্ত্তমান থাকিত
তবে সুখের সীমাই থাকিত না , কিন্তু সে যদি কিছু পরিমাণেও এগুলি
পাইয়া থাকে তবে তাহাও তাহার পক্ষে কম গৌরবের কথা নহে। আমার ভাগ্যে
দুই একটি ছাড়া সব ইচ্ছাই পূর্ণ হইয়া ছিল। ধনে, মানে, যশে, ঐশ্বর্যের,
চরিত্রে, রূপে, গুণে সর্ব্ববিষয়ে শ্রেষ্ঠতম বংশের মধ্যে আমি
আসিয়া পড়িয়াছিলাম। কুন্তীর মত বহু পুত্রের জননী হই নাই বটে ,
কিন্তু যে পুত্রকে গর্ভে ধারণ করিয়াছিলাম তাহা শত পুত্রের অপেক্ষাও
কিছু কম বলিয়া মনে করি নাই। এ শুধু জননীর নিকট পুত্রের প্রশংসা
নহে , পরিবারের সকলে এবং বাহিরে লোকেরা যাঁহারা তাহার সংস্পর্শে
আসিয়াছিলেন তাঁহারা বুঝিতে পারিবেন কোন পুত্রের জননী হইবার সৌভাগ্য
আমার ঘটিয়াছিল। পঞ্জাবের অধিবাসীরা , যাঁহারা তাহাকে প্রাণের
মত ভাল বাসিয়াছিলেন তাঁহারা বলিতে পারেন যে, অল্পদিনের মধ্যে
কি বস্তুকে তাঁহারা হারাইয়াছিলেন।
অল্পদিনের জন্য তাহাকে
পাইয়াছিলাম, কিন্তু তাহারই ভিতর তাহার ভালবাসার গুণে সে সকলকে
আপনার করিয়া চলিয়া গিয়াছে। সমস্ত সুখ ঈশ্বর আমাকে দিয়াছিলেন
কিন্তু আবার তিনিই ধীরে ধীরে সবই কাড়িয়া লইয়াছেন। সুখ-দুঃখের
ভিতরই মানুষের জন্ম এবং মৃত্যুর লীলাখেলা চলিতেছে , আমার এই
লেখার ভিতর সুখ হইতে দুঃখের অংশ বেশি। যাঁহারা আমার মতনই ভাগ্যের
সহিত জড়িত , তাহারাই আমার এই ক্ষুদ্র লেখার ভিতর তাঁহাদের অবস্থাকে
মিলাইয়া আমার সুখ-দুঃখের ভাগী হইয়া তৃপ্তি বোধ করিবেন। জীবনের
শেষ প্রান্তে আসিয়া পৌঁছিয়াছি , যিনি এত বড় দুঃখ কষ্টকে সহ্য
করিবার শক্তি আমার ভিতরে দিয়াছিলেন তাঁহারই চরণে আশ্রয় পাইবার
জন্য অপেক্ষায় আছি , জানি না কবে তিনি আমার শেষ আশা পূর্ণ করিবেন।
এই লেখার মধ্য দিয়া যদি কাহারও মনে অতটুকুও শান্তি বা সান্ত্বনা
আনিয়া দেয় তবেই এই লেখা সার্থক।
হুগলি জেলার অন্তর্গত বাঁশবেড়িয়া
গ্রামে প্রাণকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র আমার পিতা ছিলেন। পিতারা
দুই ভাই, হরদেব ও কালিপদ। আমার পিতার নাম হরদেব চট্টোপাধ্যায়
ও মাতার নাম বামাসুন্দরী। আমার পিতা প্রথমে সনাতন ধর্ম্ম প্রচার
করেন। তাঁর এই ধর্ম্মনুরাগ থাকার দরুন আমার শ্বশুর দেবেন্দ্রনাথ
ঠাকুরের সহিত পিতার বন্ধুত্ব হইয়াছিল। আমার পিতাকে তিনি খুবই
ভালবাসিতেন। আমার পিতামহের শ্রাদ্ধের পূর্ব্বে শ্বশুর একবার
বাঁশবেড়িয়ায় বেড়াইতে গিয়াছিলেন, সেখানে যাইয়া তাঁহার কর্ম্মচারী
কিশোরী চট্টোপাধ্যায়, কৈলাস মুখোপাধ্যায় ও দেওয়ান চন্দ্রনাথ
রায়ের নিকট পিতার অবস্থার কথা শুনিলেন, তারপর পিতাকে ডাকাইয়া
তাঁহার বেশ-পরিবর্ত্তনের চিহ্ন দেখিয়া, নানারূপ সৎ বাক্যদ্বারা
তাঁহাকে সান্ত্বনা দিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসেন। বাড়ি আসিয়া পিতামহের
যাহাতে শ্রাদ্ধাদি কার্য্য সকল ভালরূপে সম্পন্ন হয় তাহারই জন্য
পিতার নিকট অর্থ পাঠাইয়া দিলেন , পিতা সেই অর্থের সাহায্যে তাঁহার
পিতার শ্রাদ্ধাদি সম্পন্ন করেন। পিতার সহিত তাঁহার এতদূর সৌহার্দ্য
জন্মাইয়াছিল যে, দুইজনের মধ্যে স্থির ছিল যে, যাঁহার আগে মৃত্যু
হইবে, তাঁহার বিধিমত সৎকার যিনি জীবিত থাকিবেন তিনিই করিবেন।
পিতার মৃত্যু পূর্ব্বেই হওয়াতে, আমার শ্বশুর স্বয়ং উপস্থিত থাকিয়া
চন্দনকাষ্ঠে তাঁহার চিতাশয্যা প্রস্তুত করিয়া সুচারুরূপে সৎকারকার্য্য
সম্পন্ন করেন। ইহাদের দুই জনের পরস্পরের মধ্যে এত ভালবাসা থাকার
জন্য তাঁহার ইচ্ছা ছিল এই ঠাকুর পরিবারের সহিত বিবাহ দ্বারা
আরও নিকটতর সম্বন্ধ স্থাপন করা। তাঁহার এই ইচ্ছা পূর্ণ হইয়াছিল।
পিতা দয়াবান ও ধার্ম্মিক পুরুষ ছিলেন , গ্রামের গরীব দুঃখীদের
বিপদ-আপদে নিজের শরীর ও অর্থ দ্বারা নানারূপে তাহাদিগকে সাহায্য
করিতেন। ইহা ছাড়া গ্রামে দাতব্য চিকিৎসাও তিনি করিতেন।
আমার পিতা তিনবার বিবাহ
করেন। তিনি কুলীন ব্রাহ্মণ ছিলেন। প্রথম স্ত্রীর দুই কন্যা,
দ্বিতীয়ার সন্তানাদি হয় নাই। শেষে আমার মাকে বিবাহ করেন। মায়ের
আট কন্যা এবং তিন পুত্র হয়। আমি ভাইবোনদের মধ্যে সর্ব্বকণিষ্ঠা।
বোনদের নাম ছিল সারদা, সুখদা, জ্ঞানদা, নিস্তারিণী, লক্ষ্মী,
নৃপময়ী ও প্রফুল্লদেবী। ভাই তিনটির নাম তারাপ্রসন্ন, শ্যামাপ্রসন্ন,
দুর্গপ্রসন্ন। আমার সৎবোন দুটির নাম অন্নদা ও সৌদামিনী। সর্ব্বপ্রথম
মায়ের যে কন্যা হইয়াছিল সে খুবই অল্পদিনের মধ্যে মারা যায়, সেইজন্য
তাহার নাম রাখা হয় নাই।
জ্ঞানদাকে আমার মনে পড়ে
না, কারণ সেও পাঁচ বৎসর বয়সের সময় মারা হায়। অন্নদা ও সৌদামিনী
দুইজনই বেথুন স্কুলে পড়িয়াছিলেন।
পিতার প্রথম পক্ষের স্ত্রী
যিনি ছিলেন, তাঁহার স্বভাব বড়ই কর্কশ ও ব্যবহার অত্যন্ত খারাপ
ছিল। আমার ঠাকুরমা, তাঁহার নানা রকম দুর্ব্যবহারে অত্যন্ত জ্বালাতন
হইয়া আমার পিতার পুনরায় বিবাহ দেন। এই বৌ-এর কোনো সন্তানাদি
হয় নাই। ইনি বাপ মায়ের খুবই আদরের একমাত্র কন্যা ছিলেন বলিয়া,
তাঁহার বাপ মা তাঁহাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাইতেন না, শুনিতে পাই সেই
সব নানা কারণে পিতা আমার মাকে বিবাহ করেন এবং, ঠাকুরমাও এই বিবাহ
দিতে বাধ্য হন। আমার মেজমার ( পিতার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী )
স্বভাব বড়মার মত রুক্ষ ছিল না, তিনি পতিব্রতা সরল প্রকৃতির স্ত্রীলোক
ছিলেন। আমার মা মাকুরদা গ্রামে বাসাণ্ডা নিবাসী গোরাচাঁদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের
কন্যা। মায়ের যখন দুই তিনটি সন্তান হয় তখন বড়মার দৌরাত্ম্যে
পিতামাতা সকলে বাঁশবেড়ে ছাড়িয়া কলিকাতায় আসিয়া বাস করিতেন থাকেন।
প্রথমে কলিকাতায় আসিয়া আমার পিতা শাঁখারিটোলা, নেবুতলায় কিছুকাল
বাড়ী ভাড়া করিয়া থাকেন। তারপর বৌবাজারে একটি বাড়ী ভাড়া করিয়া
সেখানে কিছুদিন ছিলেন , সেই বাড়ীতেই আমার জন্ম হয়। মায়ের কাছে
শুনিয়াছি , যখন সিপাহীবিদ্রোহ হয় তখন আমি সূতিকাগৃহে। আমার যখন
বয়স পাঁচ ছয় বৎসর তখন আমার দুই বোন নিস্তারিণী ও লক্ষ্মীর পনের
দিনের মধ্যে মৃত্যু হয়। আমরা সে সময়ে শিয়ালদহে একটি বাড়ীতে বাস
করি। নিস্তারিণীর সিমলাপাড়ায় বিবাহ হইয়াছিল। শ্বশুরবাড়ির নানা
রকম যন্ত্রণা ভোগ করায় তাহার শরীর মন ক্রমশঃ খারাপ হইতে থাকে,
তাহা হইতেই কঠিন রোগের সূত্রপাত, তারপরই তাঁহার মৃত্যু ঘটে।
লক্ষ্মী বড় অভিমানিনী মেয়ে ছিল, সে কাহারও কর্কশ কথা সহ্য করিতে
পারিত না , একদিন আমার ভাইয়ের কাছে কোন কারণে মার খাইয়াছিল এবং
তারপর হইতে তাহার প্রায়ই জ্বর হইতে থাকে , সেই জ্বরই তাহার মৃত্যুর
এক রকম কারণ হয়।
দুজনেই খুব অল্প বয়সে মারা
যায়, নিস্তারিণী তের বছরে ও লক্ষ্মী দশ বছরে। তাহাদের দুজনের
মৃত্যুর পর আমার পিতা সাঁতরাগাছিতে একটি বাড়ি কিনিয়া বরাবরের
জন্য সেখানে বাস করিতে থাকেন। আমার বয়স যখন দশ বৎসর সেই সময়
আমার দিদি নৃপময়ী দেবীর সহিত মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয়
পুত্র হেমেন্দ্রনাথের বিবাহ হয়। ইহার পূর্ব্বে সারদাসুন্দরী
ও সুখদার বিবাহ হইয়া গিয়াছিল। সরদাসুন্দরীর উত্তরপাড়ায় যদুনাথ
বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহ হইয়াছিল।
নৃপময়ীর বিবাহের সময় আমাদের
দিকে মহাগণ্ডগোল উপস্থিত হয়। আমাদের জ্ঞাতি কুটুম্বেরা সকলেই
মনে করিলেন এই বিবাহ হইলে তাহাদের জাত নষ্ট হইবে , সেই আক্রোশে
একশত লাঠিয়াল ঠিক করিয়া রাখিলেন, যে, যেমনি বর সভায় আসিবে তৎক্ষণাৎ
তাহাকে লাঠির ঘায়ে শেষ করিয়া কনেকে তুলিয়া লইয়া যাইবেন। এই খবর
পাইবামাত্র আমার ভাই দুর্গাপ্রসন্ন , পুলিশের সাহায্য লইয়া যাহাতে
বিবাহে কোনও রূপ বাধাবিঘ্ন না ঘটে তাহার জন্য সার্জ্জেন কনেষ্টবল্
পুলিশের পাহারা বসাইয়া রাখিলেন। ভাগ্যক্রমে কোনো বিপদ ঘটে নাই।
বর যখন বিবাহের আসরে আসিয়া বসিলেন তখন মনে হইতেছিল সত্য সত্যই
যেন মহাদেব ধরাতলে অবতীর্ণ হইয়াছেন। যেমন রূপ, আবার তমনি সাজের
বাহার। বর দেখিয়া পাড়ার লোকেরা স্তম্ভিত হইয়া গেল , চারিদিক
হইতে লোকেরা বর দেখিবার জন্য উঁকিঝুঁকি মারিতে লাগিল। সে যে
তাহাকে কি সুন্দর দেখাইয়াছিল তাহা আজও ভুলিতে পারি নাই। অগ্রহায়ণ
মাসে গোধূলি লগ্নে বিবাহ হইয়াছিল। দিদির বিবাহের পর আমি প্রায়ই
মায়ের সঙ্গে জোড়াসাঁকোর বাড়ী আসা যাওয়া করিতাম , সেই সময় আমাকে
দেখিয়া আমার ননদ স্বর্ণকুমারী ও শরৎকুমারীর পছন্দ হওয়াতে আমার
স্বামীকে বিবাহ করিবার জন্য বারবার অনুরোধ করিতে থাকেন। আমার
স্বামী সেই কথায় তাহাদিগকে বলিয়াছিলেন যে , তিনি কলাবৌকে বিবাহ
করিবেন। এই কথা শুনিয়া তাঁহাদের মধ্যে খুব একটা হাসাহাসির রোল
পড়িয়া যায়। আমি আসিতেই আমাকে তাঁহারা দুজনে মিলিয়া সাজাইয়া আমার
স্বামীকে দেখাইবার জন্য বাহিরের বারাণ্ডায় লইয়া যাইবার জন্য
অনেক চেষ্টা করিতে লাগিলেন , কিন্তু আমি পাড়াগেঁয়ে মেয়ে , তখন
লজ্জাই বেশী ছিল , কাজেই আমি কিছুতে তাঁহার সামনে যাইতে রাজি
হইলাম না, বাড়ীর ভিতরে চলিয়া আসিলাম। সেই বছর ফাল্গুন মাসের
৮ই তারিখে আমার বিবাহ হয়। দিদির বিবাহের দুই বৎসর পরেই ঐ বাড়ীতেই
মহর্ষির চতুর্থ পুত্র বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বিবাহ হইয়াছিল
, তখন আমার বয়স বার বৎসর ছয় মাস মাত্র। আশ্বিনের ঝড়ের বছরেই
আমার বিবাহ হয় , আমার বিবাহে কিছু গোলমাল হয় নাই , তবুও পাছে
হয় বলিয়া পুলিশের কিছু বন্দোবস্ত রাখা হইয়াছিল।
বিবাহের পরদিন আমার দেওর
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সরকারকে সঙ্গে করিয়া গয়নার বাক্স সঙ্গে
লইয়া আমাকে সেই সকল পরাইয়া আনিবার জন্য আমাদের বাড়িতে গিয়াছিলেন।
আমাকে সেই সব গহনা কাপড় পরাইয়া , মা আমার দুর্গা প্রতিমার স্তব
করিয়া আমাকে পাল্কীতে তুলিয়া দিয়া পা মুছাইয়া দিলেন। মা বাপকে
ছাড়িয়া আসিবার সময় খুবই কষ্ট হইল , সারারাস্তা তাঁহাদের জন্য
মন কেমন করিতে লাগিল , কাঁদিতে লাগিলাম। তখন এ রকম পাল্কী ছিল
না, পাল্কীর ধরণেরই ছোট এক রকম বস্বার যায়গা ছিল, তার উপর নানা
রকম কাজ করা কাপড় দিয়া উহা ঢাকা থাকিত , তাহাকে তখনকার দিনে
তাঞ্জাম বলিত। সেই তাঞ্জামসুদ্ধ আমাকে জাহাজে উঠান হইল, আমি
তাহার মধ্যে বসিয়া রহিলাম। আমার স্বামী, চার ঘোড়ার গাড়িতে চড়িয়া
বিবাহ করিতে গিয়াছিলেন। আমরা যখন বাড়িতে আসিয়া পৌঁছিলাম তখন
সন্ধ্যা হইয়াছে। বাড়ীর ফটকের সামনে গাড়ী যখন থামিল সেই সময় আমার
শাশুড়ী বড় ননদ সৌদামিনী দেবী ও বাড়ীর কয়েকজন স্ত্রীলোকেরা আমাকে
পাল্কী হইতে নামাইয়া লইলেন। আমার শ্বাশুড়ী জলের ঝারা দিয়া পানসন্দেশ
মুখের মধ্যে দিয়া সঙ্গে করিয়া লইয়া গেলেন। দোতলায় আনিয়া আমাদের
দুজনকে মসলন্দের উপর বসান হইল এবং সেখানেই বিবাহের নানারকম অনুষ্ঠানাদি
সম্পন্ন হইল। বিবাহের আটদিন পরে যেদিন বাপের বাড়ীতে যাই, সেই
দিন শাশুড়ী নিজে গহনা পরাইয়া আমাকে সাজাইয়া দিলেন, তাঁর নিজের
একটি চুনী-মুক্তার নথ ছিল, সেটি আমার নাকে পরাইয়া দিবার জন্য
চেষ্টা করিতে লাগিলেন। সেটা এত ভারী ছিল যে , পরিতে গিয়া আমার
চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। তাহা দেখিয়া আমার বড় ননদ আর পরিতে
দিলেন না , সে যাত্রা আমি রেহাই পাইলাম। চুনী এবং দুটি মুক্তোর
দাম দু হাজার টাকা। বিবাহের পর শ্বশুরবাড়ীতে আসিয়া এত আদর-যত্ন
পাই যে, তাহাতেই অনেকটা বাপ-মায়ের শোক ভুলিতে পারিয়াছিলাম। আমার
বিবাহের সাত মাসের মধ্যে আমার পিতার মৃত্যু হয়। তিনি অনেকদিন
হইতে অর্শ্বের রোগে ভুগিতেছিলেন।
( ক্রমশঃ )
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)