পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
আমাদের
কথা
প্রফুল্লময়ী
দেবী
দ্বিতীয়
অংশ
তখনকার দিনে আমার শ্বশুরবাড়ীতে নিয়ম
ছিল যে , বিকাল হইলেই মালিনীরা ফুলের মালা গাঁথিয়া আনিবে এবং
সেই মালা বাড়ীর বৌঝিরা মাথায় গলায় দিয়া যাহার যেমন ইচ্ছা তেম্নি
করিয়া সাজিবে । আমি তখন নতুন বৌ আসিয়াছি , আমার বড় ননদ রোজ নানা
রকমের খোঁপা বাঁধিয়া সেই মালা উহাতে জড়াইয়া দিতেন । আমার বড়
জা সর্ব্বসুন্দরী দেবী নিজের টাকা-পয়সা খরচ করিয়া নানা রকম পাড়ের
শাড়ী কিনিয়া নানা রঙে ছুবাইয়া , আমাকে প্রত্যেকদিন পরাইয়া সাজাইতেন
। বড় জা আমাকে তাঁহার নিজের বোনের মত স্নেহ করিতেন । তখন আমার
ননদ , জায়েরা মিলিয়া সকলে একসঙ্গে খাইতে বসিতাম । নতুন বৌ আমি
, তার উপর পাড়াগেঁয়ে মেয়ে , কাজেই ঘোমটার বহরটা বেশী রকমই ছিল
, ঘোমটা ছাড়া এক মুহূর্ত্তও থাকিতাম না । খাইতে বসিবার সময় এক
হাত ঘোমটার ভিতরেই কোন রকমে খাইতাম । আমার দেওর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ
ঘোমটা দেওয়া পছন্দ করিতেন না । আমি যখন খাইতে বসিতাম তখন পর্দ্দার
আড়াল হইতে , আমি কি করিয়া খাই দেখিবার জন্য প্রায়ই উঁকিঝুকি
মারিতেন । খাওয়ার রকম দেখিয়া থাকিতে না পারিয়া , আমাকে নানারকম
ঠাট্টা করিতে ছাড়িতেন না । নতুন ঠাকুরপোর ( জ্যোতিরিন্দ্রনাথ
) গানে ঝোঁক খুব ছিল ও গান বড় পছন্দ করিতেন , একদিন আমার গান
তাঁর শুনিবার খুব ইচ্ছা হইল । স্বর্ণকুমারী - তাঁরও এ-সব বিষয়ে
খুব উৎসাহ ছিল , তিনি আমাকে সঙ্গে করিয়া তাঁর কাছে লইয়া গেলেন
। কি যে গাহিব কিছুই ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিতেছিলাম না , মনে
বড় ভয় ও লজ্জা করিতে লাগিল , শেষকালে যাহা একটু আধটু বাড়ীতে
শুনিয়া শিখিয়াছিলাম তাহাই তাঁর কাছে ভরসা করিয়া গাহিলাম । তিনি
গান শুনিয়া খুসী হইলেন বলিয়া মনে হইল , এবং যাহাতে আরও ভাল করিয়া
শিখিবার সুবিধা হয় তাহার বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন । তখন বাড়ীতে
বড় বড় ওস্তাদ গায়কেরা আসিয়া গান করিতেন , আমি মাঝে মাঝে সেই
সকল গান শুনিয়া শিখিবার চেষ্টা করিতাম । এমনি ভাবে চার বৎসর
বেশ সুখেই কাটিয়াছিল । বিবাহের চার বৎসর পরে আমার স্বামী মস্তিষ্ক
রোগে আক্রান্ত হইয়া সাড়ে তিন বৎসর ঐ ভাবে কষ্টে কাটান । আমার
বিবাহের পরই তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়া উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন
। এই রোগের পূর্বে তাঁর যথেষ্ট মেধাশক্তি ছিল বলিয়া আমার শ্বশুর
, সমস্ত সংসারের তহবিলের আয়ব্যয় দেখিবার ভার তাঁহার উপর দিয়াছিলেন
। ইহার পূর্ব্বে আমার মামাশ্বশুর হিসাবপত্র দেখিতেন , কিন্তু
তাঁরও মাথায় দোষ থাকায় শ্বশুর তাঁহাকে ছাড়াইয়া দিতে বাধ্য হন
। তাঁহার যখন এইরূপ অবস্থা হইল এবং দিন দিনই রোগের বৃদ্ধি হইতে
লাগিল তখন আমার মনের অবস্থা বড়ই খারাপ হইয়া গেল , কি যে করিব
কিছুই ভাবিতে পারিতাম না , বাড়ীর সকলে এবং আমার শ্বশুর-শাশুড়ী
সকলেই তাঁর জন্য চিন্তিত হইয়া পড়িলেন । আমার স্বামী স্নান আহার
পর্যন্ত সব ছাড়িয়া দিলেন , ও সকলের উপর একটা তাঁর সন্দেহের ভাব
বাড়িতে লাগিল । এই সন্দেহ বাতিকের জন্য প্রায়ই আমাকে নানা রকম
ভুগিতে হইত । যখন নানা রকম দুশ্চিন্তায় আমার মনকে অস্থির করিয়া
তুলিত তখন আমি একটি ঘরে বসিয়া একলা একলা কাঁদিতে থাকিতাম । সে
সময়ে আমার সেজ 'জা' জ্ঞনদানন্দিনী তেতলার ঘরে থাকিতেন ; তিনি
আমার এই দুঃখ সহিতে না পারিয়া আমাকে তাঁর কাছে ডাকিয়া মায়ের
মতন নানা রকম সাক্ত্বনা দ্বারা আমার মনে শান্তি দিবার চেষ্টা
করিতেন । তাঁর স্নেহ আদর যত্নে তখন আমার মনের ভিতর কত যে বল
ভরসা আনিয়া দিয়াছিল এ সামান্য লেখার ভিতর দিয়া প্রকাশ করিতেম
পারিলাম না । আজও সেই কথা যখন মনে করি তখন ভক্তি শ্রদ্ধায় আমার
মন তাঁর প্রতি ভরিয়া উঠে ; তিনি যদি তখন উপস্থিত না থাকিতেন
, তবে কি যে করিতাম বলিতে পারি না । জানকীনাথ , তিনিও সেই সময়
ভাইয়ের ন্যায় আমার অনেক উপকার করেন ।
আমার স্বামী খাওয়া-দাওয়া এক রকম
ছাড়িয়াই দিলেন । তার উপর তাঁর কাসি ও হাঁপানী অল্প অল্প দেখা
দিল , এই সব কারণে তাঁকে লইয়া আমি আমার বড় জা , নতুন বৌ , আমার
দিদি সকলে মিলিয়া বোলপুরে যাই । সেখানে গিয়াও খাওয়ার কোনো পরিবর্ত্তন
হইল না । চায়ের চামচের এক চামচ ভাত বা কোনও দিন একটি পটল-পোড়া
খাইয়া থাকিতেন । এমনি ভাবে সেখানে তিন দিন কাটিল , খাওয়ার বা
শরীরের কোনই বদল না হওয়াতে তিন দিন পর আবার আমরা কলিকাতায় ফিরিয়া
আসি । দিন দিন শরীরের অবস্থা খারাপ হইতে থাকায় আনার শ্বশুর কিছুদিনের
জন্য তাহাকে আলিপুর পাগ্লাগারদে পাঠাইয়া দেন । সেখানে ছয়মাস
থাকিয়া অনেকটা সুস্থ হইয়া ফিরিয়া আসেন । সেই সময় আমার শরীর নানা
চিন্তার মধ্যে বড়ই খারাপ হইয়াছিল , তাঁর কথা ভাবিতে ভাবিতে আমার
অধিকাংশ সময় কাটিয়া যাইত , মনে কিছুতেই আনন্দ পাইতাম না । পাগলাগারদ
হইতে ফিরিয়া আসিবার কিছুদিন পরে বুলুর ( বলেন্দ্রনাথের ) জন্ম
হয় । তার জন্মের পূর্ব্বে একদিন স্বপ্ন দেখিলাম যে , একটি মেয়ে
লাল শাড়ী পরিয়া একমাথা সিঁদুর মাখিয়া একটি সরাতে রক্তমাখা ছাগমুণ্ড
হাতে লইয়া আমার কাছে দাঁড়াইয়া আছে । আমি স্বপ্নের কথা আমার দিদিশাশুড়ীর
কাছে সব খুলিয়া বলিলাম । তিনি বলিলেন যে , ' এ স্বপ্ন শুভ হইবে
।" তারপরই বুলুর জন্ম হয় ।
১২৭৭ সালের ২১শে কার্ত্তিক রবিবার
বিকাল ৫টায় তার জন্ম হইয়াছিল । সে ভুমিষ্ঠ হইবার পর কিছুক্ষণ
পর্যন্ত একেবারেই কোনও কান্নার শব্দ পাওয়া যায় নাই , নিস্তেজ
অবস্থায় পড়িয়াছিল । তাহার পর ডাক্তারেরা নানা উপায়ে তাহাকে কাঁদাইতে
সক্ষম হন । আমারও সেই সময় খুবই অসুখ । নাড়ী ছাড়িয়া কয়েকদিন অজ্ঞান
অবস্থায় পড়িয়াছিলাম । আমার নানারকম মনের অশান্তির মধ্যে ওর জন্ম
হইয়াছিল বলিয়া তাহারও শরীর তেমন সুস্থ ছিল না , দুটি পা-ও একটু
বাঁকা মতন হইয়াছিল । তাহার দরুণ অনেকদিন পর্যন্ত পা ঘসিয়া ঘসিয়া
চলিত । সে যখন ছয় দিনের , তখন আমার বড় ভাসুর ( দ্বিজেন্দ্রনাথ
ঠাকুর ) উপাসনা করিয়া বলুকে একটি গিনি দিয়া আশীর্ব্বাদ করেন
।
আট দিনের পর , আমার শাশুড়ী , ছেলের
পরমায়ু বৃদ্ধির জন্য বাড়ির যত দাসদাসী ছিল সকলকেই তেল দিয়া এক
একটি কাঁসার বাটি দান করেন । শাশুড়ী বলুকে বড় ভালবাসিতেন । বলু
যখন ছোট ছিল তখন আমার শ্বশুরের চলার নকল করিত , আমার শাশুড়ী
তাই দেখিতে খুব ভালবাসিতেন এবং তাহাকে ডাকিয়া আনিয়া দেখিতেন
।
বলু যখন সাড়ে চার বছরের , তখন আমার
কাছেই তাহার হাতে খড়ি হয় । তখন হইতে পাঁচ বছর পর্যন্ত আমি নিজেই
তাহাকে অল্প অল্প পড়াইতাম । ছয় বছরের সময় তাহাকে সংস্কৃত কলেজে
ভর্ত্তি করিয়া দিয়াছিলাম । সে তার মামাতো ও জ্যেঠতুতো ভাইদের
সঙ্গে আমাদের সরকারী গাড়ীতে করিয়া পড়িতে যাইত , কিন্তু তাহার
পায়ের দোষ থাকায় অন্য ভাইরা ঠাট্টা করিত । এই কথা শুনিতে পাইয়া
আমি প্রিয়নাথ ডাক্তারের গাড়ী কিছুদিনের জন্য ভাড়া করিয়া পাঠাইতে
লাগিলাম । তাহার পার তার জন্য ঘোড়াগাড়ী কিনিয়া দিয়াছিলাম , সে
তাহাতে করিয়া যাইত । বার বছর বয়সের সময় সে হেয়ার স্কুলে ভর্ত্তি
হয় ও পনের বছর বয়সে এন্ট্রেন্স পরীক্ষা দেয় । যে বছর বলু বিদ্যালয়ে
যায় সেই বছরে আমার শাশুড়ীর মৃত্যু হইয়াছিল । বলুর বিদ্যালয়ে
যাইবার সংবাদ আমার কাছে পাইয়া , তিনি খুবই খুসী হইয়াছিলেন ।
আমার শাশুড়ীর মৃত্যুতে আমি চারিদিক অন্ধকার দেখিতে লাগিলাম ।
শাশুড়ীর মত শাশুড়ী পাইযাছিলাম । তাঁর মতন সৌভাগ্যবতী , পতিভক্তিপরায়ণা
স্ত্রীলোক এখনকার দিনে খুব কমই দেখিতে পাওয়া যায় । তাঁহার সৌভাগ্যের
জোরে দ্বারকানাথ ঠাকুরের ব্যবসা-বাণিজ্যে যথেষ্ট শ্রীবৃদ্ধি
লাভ হইয়াছিল । শাশুড়ীর কাছ শুনিয়াছিলাম যে, তাহারই জন্য তাঁহার
শ্বশুর খুসী হইয়া , তাঁহাকে একলক্ষ টাকার হীরা, পান্না, মোতি
বসানো খেলনা কিনিয়া দিয়াছিলেন । ধর্ম্মে মতি তাঁর যথেষ্ট ছিল
। কেহ যদি তাঁহার সাক্ষাতে পুত্রকন্যাদের প্রশংসা করিত , তখনই
তিনি মাথা নত করিয়া থাকিতেন , পাছে তাঁর মনে অহঙ্কার আসে । সেই
সময়ে আমাদের বাড়ীতে পূজা বন্ধ হইয়া গিয়াছিল । আমার শ্বশুর যখন
পূজার দালানে বসিয়া উপাসনা করিতেন , তখন তিনিও অধিকাংশ সময় তাঁর
পাশে বসিয়া উপাসনায় যোগ দিতেন । তাহা ছাড়াও জপ করিতেন , দেখিয়াছি
। অত বড় বৃহৎ পরিবারের সমস্ত সংসারের ভার তাঁহারই উপর ছিল ,
তিনি প্রত্যেককে সমানভাবে আদর যত্নে , অতি নিপুনভাবে সকলের অভাব
, দুঃখ , দূর করিয়া চলিয়া গিয়াছেন । কাহাকেও কোনো বিষয় হইতে
বঞ্চিত করিয়া মনে ব্যথা দিবার কখনও চেষ্টা করিতেন না । তাঁর
মনটি শিশুর মত কোমল ছিল । এত বড় লোকের পুত্রবধূ এবং গৃহিণী হওয়া
সত্ত্বেও তাঁর মনে কোনরকম জাঁক বা বিলাসিতার ছায়া স্পর্শ করিতে
পারে নাই । যতদূর সম্ভব সাদাসিধে ধরণের সাজপোষাক করিতেন , কিন্তু
তাহাতেই তাঁহার দেহের সৌন্দর্য্যকে আরও বাড়াইয়া তুলিত । হাতের
উপর একবার একটি লোহার সিন্দুকের ডালা পড়িয়া যাওয়াতে সেই অবধি
হাতের ব্যথায় প্রায়ই কষ্ট পাইতে থাকেন । পাঁচছয় জন বড় বড় ডাক্তার
দেখানর পরও ভাল না হওয়াতে পুনরায় অস্ত্রপ্রচার করিতে হইয়াছিল
। ক্ষতটি যখন শুকাইতেছিল সেই সময় একজন আচার্য্যানীর পরামর্শে
তেঁতুলপোড়া বাটিয়া ক্ষতের চারিদিকে লাগাইবার পর বিষাক্ত হইয়া
আবার পাকিয়া উঠে । সেইটাই ক্রমশঃ দূষিত হইয়া তাঁহার মৃত্যু ঘটে
।
আমার বড় জা , তাঁরও সৌভাগ্য কিছু কম হয় নাই । যাঁর দ্বিজেন্দ্রনাথ
ঠাকুরের মত পতিলাভ ভাগ্যে ঘটিয়ছিল , তাঁরও ভাগ্যের কম জোর নয়
। আমার বড় জা একত্রিশ বছর বয়সে পাঁচটি পুত্র ও দুটি কন্যা রাখিয়া
মারা যান । আটমাসের একটি সন্তান ভূমিষ্ঠ হইয়া মারা যাইবার পর
হইতে তাঁহার শরীর অসুস্থ হইয়া পড়ে । নানা চিকিৎসার দ্বারা কোনও
ফল না হওয়াতে শেষকালে মৃত্যু হয় ।
দ্বিপেন্দ্র, অরুণেন্দ্র, নীতেন্দ্র,
সুধীন্দ্র, কৃতীন্দ্র - এই পাঁচ পুত্র এবং সরোজ, ঊষা (**) দুই
কন্যা । ইহারা সব খুবই অল্প-বয়সে মাতৃহারা হইয়াছিল । জ্যেষ্ঠপুত্র
দ্বিপেন্দ্রনাথের তখন ষোল বছর বয়স মাত্র ।
আমার বড় জা আমাকে ঠিক নিজের ছোট
বোনের মতন ভালবাসিলে আমিও তাঁকে সেইরূপ ভালবাসিতাম ও ভক্তি করিতাম
। তাঁহার মৃত্যুর তিন মাস পূর্ব্ব হইতে কেন জানি না আমার মন
বড়ই চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল , কিছুতেই বাড়ীতে থাকিতে পারিতাম না
। মৃত্যুর সময়ে আমি নিকটে ছিলাম , মৃত্যুর কিছু পূর্ব্বেই সঙ্কেতের
দ্বারা আমাকে জানাইলেন যে , তিনি তাঁহার স্বামীকে এবং ছেলেমেয়েদের
দেখিতে চান । আমি তৎক্ষণাৎ বড় ভাসুরকে তাঁর ইচ্ছার কথা জানাইলাম
। তিনি আসিবার অল্পক্ষণ আগেই তাঁর প্রাণ বাহির হইয়া গেল । বড়
জায়ের মৃত্যুর পর ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভার আমি প্রথমে বহন করিলাম
, স্নান আহার সবই তারা আমার নিকট করিত । বড় মেয়ে সরোজার তখন
বিবাহ হইয়াছিল , জামাই মেয়ের দেখাশুনা যাহা করিবার আমিই করিতে
লাগিলাম । শাশুড়ী এবং বড় জা , এই দুজনের মৃত্যুর পর আমার মনে
বড় আঘাত লাগিল । বিবাহ হইয়া শ্বশুর-ঘর যখন করিতে আসি তখন আমার
বড় জা , বড় ননদের আদরযত্নই বেশী পাইয়াছিলাম । অন্য ননদেরা তখন
ছোট ছোট , কাজেই ইহাদের যত্নটাই বেশী মনের মধ্যে গাঁথিয়া গিয়াছিল
। আমার মেজ জা বেশীর ভাগ সময় বিদেশে স্বামীর সহিত থাকিতেন ,
যখন তিনি বাড়ী আসিতেন তখন তাঁহার সকলের প্রতি আদরযত্নের কিছুমাত্র
ত্রুটি হইত না , সকলের খোঁজখবর লওয়া তাঁহার কার্য্যের মধ্যে
একটি প্রধান কাজ ছিল । তাঁহার আগমনে বাড়ীর সকলের আর আনন্দের
সীমা থাকিত না । আমাদের সেই সময় বেশ-ভূষার বড়-একটা কিছু আড়ম্বর
ছিল না । আমরা কেবলমাত্র একটি শাড়ী পরিয়া থাকিতাম , গায়ে জামা
দিবার চলন ছিল না । তিনি প্রথমে বম্বে হইতে আসিয়া শাড়ীর নীচে
পায়জামা পরা , সায়া পরা , জামা পরা ও বম্বে ধরণের শাড়ী পরা আমাদের
পরিবারের মধ্যে প্রচলন করিয়াছিলেন । তাই দেখিয়া বাহিরের অন্যান্য
লোকেরা তাহার অনুকরণ করিতে থাকেন । বাড়ীর দাসদাসী ভিন্ন বাহিরের
দর্জ্জি , স্যাঁকরা ইত্যাদি কাহারও অন্দরমহলে প্রবেশ করিবার
হুকুম ছিল না, আমার মেজ জা-ই সেই নিয়ম ধীরে ধীরে ভঙ্গ করেন এবং
ছায়াচিত্রকর (photographer) ডাকিয়া আমার বড় জার শ্বাশুড়ীর এবং
বাড়ীর সকলের ছবি তুলাইয়াছিলেন ।
বড় জায়ের মৃত্যুর দু-তিন বছর পরে
তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথের বরিশালের জমিদার রাখাল
রায়ের জ্যেষ্ঠ কন্যা সুশীলার সহিত বিবাহ হয় । তার বাপ-মায়ের
সুশীলা নাম সার্থক হইয়াছিল - ধর্ম্মে কর্ম্মে স্বভাবে মায়ায়
দয়ায় মনটি পূর্ণ ছিল । সে যখন যাহার নিকট আসিত সেই তাহার মিষ্ট
ব্যবহারে সুখী হইত । এত ভাল বউ পাওয়া সত্ত্বেও আমাদের ভাগ্যে
তাহাকে লইয়া ঘর করা বেশী দিন ঘটিল না । সে আমাকে বড়ই স্নেহ ভক্তি
করিত । তাহার একটি কন্যা এবং পুত্র হইবার কয়েক বছর পর হইতেই
শরীর অসুস্থ হইয়া পরায় শেষকালে ক্ষয়কাশ রোগে তাহার মৃত্যু ঘটে
। সেই দুরন্ত রোগের সময় তাহার চতুর্থ দেওর সুধীন্দ্রনাথ তাহার
পার্শ্বে বসিয়া পুত্রের ন্যায় সেবা করিয়াছিলেন । সে মৃত্যুর
সময় , একমাত্র কন্যা নলিনী ও পুত্র দিনেন্দ্রনাথকে রাখিয়া যায়
। তাহার মৃত্যুতে আমার মনে বড়ই ব্যাথা লাগিয়াছিল । তাহার কন্যা
নলিনী ঠিক তাহার মায়ের স্বভাবটিই পাইয়াছে । স্নেহ, মমতায়, দযা,
মায়ায় সেবাযত্নে তাহারও মনটি খুবই সুন্দরভাবে গঠিত হইয়াছে ।
পুত্র দিনেন্দ্রনাথ তাহার সুমধুর কণ্ঠস্বরে সকলকে মুগ্ধ করিয়া
রাখে । সুশীলার গলাও মিষ্টি ছিল । যে গানই সে করিত , তাহা এতই
ভাবের সহিত গাহিতে থাকিত যে তাহাতেই লোকের মনকে মুগ্ধ করিত ।
দিনেন্দ্রনাথের গানের মধ্যেও তাহার মাতার সঙ্গীতের সেই বিশেষত্বটুকু
রহিয়া গিয়াছে । তাহাদের মাতার আশীর্বাদের ফলে , তাহারা দুজনেই
উপযুক্ত মাতার উপযুক্ত সন্তান হইতে পারিয়াছে ।
সুশীলার মৃত্যুর পর দ্বিপেন্দ্রনাথ
পুনরায় ডেপুটী ম্যাজিষ্ট্রেট ললিতামোহন চট্টোপাধ্য্যায়ের দ্বিতীয়া
কন্যা হেমলতা দেবীকে বিবাহ করেন । হেমলতার পুত্রকন্যা হয় নাই
, তিনি তাঁহার সপত্নী সন্তানদিগকে ঠিক নিজের সন্তানের ন্যায়
স্নেহে, যত্নে প্রতিপালন করিয়াছেন । আমি যখন পুত্রশোকে কাতর
, সেই সময় তিনি যথেষ্ট যত্ন আদরে আমার সেবা ও তত্ত্বাবধান করিয়াছেন
। ইহারই দুই ভ্রাতা , মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায় এবং রজনীমোহন
চট্টোপাধ্যায়ের সহিত আমার বড় জায়ের দুই কন্যা , সরোজা ও ঊষার
দুইজনের বিবাহ হইয়াছিল । এখন তাঁহাদের দুই ভগ্নীর মধ্যে কেহই
জীবিত নাই । আমার বড় ননদ সৌদামিনী দেবীর , তাঁর পিতার ন্যায়
ধর্ম্মভাব প্রবল ছিল এবং স্বভাবও বড় মিষ্ট ছিল । ১১ই মাঘের উৎসবের
দিন সন্ধ্যার সময় , আমাদের বাড়ীর একটি ঘর ফুল দিয়া নিজের হাতে
সাজাইয়া তিনি আমাদিগকে সকলকে সঙ্গে করিয়া লইয়া সেই ঘরটিতে উপাসনা
করিতেন, আমার শাশুড়ীও যাইতেন । সেখানে উপাসনা করিবার পর বাহিরে
- যেখানে বিশেষভাবে উৎসবের জন্য আয়োজন করা হইত , সেই খানে যাইয়া
আমরা আড়াল হইতে শুনিতাম । শ্বশুড় মহাশয় যখন বাড়ীতে থাকিতেন তখন
তিনি নিজেই উপাসনা করিতেন , তাহা না হইলে তাঁহার অনুপস্থিতিতে
, বেদান্তবাগীশ আনন্দরাম, - পাকড়াশি, জ্ঞানেন্দ্র -, এই তিন
জনে ১১ই মাঘের উৎসবে বেদীতে বসিতেন । মাঝে মাঝে আমার বড় ভাসুর
দ্বিজেন্দ্রনাথও উপাসনা করিতেন ।
আমার শ্বশুর আমার বড় ননদকে বড় ভালবাসিতেন
। তাঁহার এই সকল সৎকার্য্যে খুসী হইয়া তাঁহাকে তিনি " গৃহরক্ষিতা
সৌদামিনী " নামকরণ করিয়াছিলেন । আমার শ্বশুর চার কন্যাকে
ঘরজামাইরূপে বাড়ীতে রাখিয়াছিলেন , তাহা ছাড়াও প্রত্যেককে এক
একখানি বাড়ী দিয়াছিলেন । আর বড় ননদ ছাড়া অন্য ননদেরা সেই বাড়ীতে
উঠিয়া গেলেন । বড় ননদ মৃত্যুকাল পর্যন্ত তাঁহার বাপের বাড়ীতে
ছিলেন এবং মৃত্যুও তাঁহার এই বাড়ীতেই হইয়াছিল । পিতা যতদিন জীবিত
ছিলেন ততদিন পিতার খাওয়া-দাওয়া সর্ব্ববিষয় তত্ত্বাবধান তিনিই
সব করিতেন । আমার বড় ননদের দুটি কন্যা ও একটি পুত্র হইয়াছিল
। বড় মেয়ে ইরাবতীর , রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের ভাইপো
, নিত্যরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের সহিত বিবাহ হয় । ছোট মেয়ে ইন্দুমতীর
সহিত বর্দ্ধমান জেলায় একটি ব্রাহ্মণের পুত্র নিত্য চট্টোপাধ্যায়ের
সহিত বিবাহ হইয়াছিল । এই জামাতা পরে খুব বড় ডাক্তার হইয়াছিলেন
। পুত্র, সত্যপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায় , বিষয়কার্য্যে ও সাংসারিক
কার্য্যে তাঁহার মাতার ন্যায় সুদক্ষ ছিলেন । মাতার মৃত্যুর পর
তিনি এখন বরোদায় তাঁহার পুত্র ও পুত্রবধূর নিকট রহিয়াছেন ।
উৎসবের সময় আমাদিগকে নানারকম
গহনা পরিয়া সাজিতে হইত । এখনকার মত তখনকার দিনের গহনা অত হাল্কা
ছিল না । বাড়ীর যে বউ আসিত তাহাকে আরও বেশী রকম গহণার উৎপাত
সহ্য করিতে হইত । আমি তখন নতুন বউ , কাজেই আমারও অবস্থা নিতান্ত
মন্দ হয় নাই । গলায় - চিক ; ঝিলদানা ; হাতে - চুড়ী, বালা, বাজুবন্ধ
; কানে মুক্তার গোচ্ছা , বিরবৌলি , কানবালা ; মাথায় - জড়োয়া
সিঁথী ; পায়ে - গোড়ে, পায়জোড়, মল, ছান্লা চুট্কী । এই ছয়-সাত
সের ওজনের গহনা পরিয়া চলাফেরা করিতে হইত , না বলিবার উপায় ছিল
না । গয়নার ভারে কোনরকমে বাঁকিয়া চুরিয়া চলিতাম , তাহাতে বাহিরের
লোকেরা মনে করিত যে , আমি গহনার জাঁকে ও গুমরে ঐরূপ ভাবে চলিতেছি
, কিন্তু আমার যা অবস্থা হইত তাহা আমিই জানিতাম । ইহা ছাড়াও
দশ ভরির গোট কোমরে পরিবার নিয়ম ছিল ।
---------------------------------------------------------------------
(**) সরোজাসুন্দরী
এবং ঊষবতী দ্বিজেন্দ্রনাথের দুই মেয়ে ; এদের বিয়ে হযেছিল রাজা
রামমোহন রায়ের পুত্রের দৌহিত্র বংশে , মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়
এবং রমণীমোহন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
(সম্পূর্ণ
রচনাটি ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের 'প্রবাসী'-র বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত)
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)