পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
আমাদের
কথা
প্রফুল্লময়ী
দেবী
তৃতীয় অংশ
আমাদের এই সব সুখ-দুঃখের
ভিতর দিয়া বলু বড় হইতেছিল ।
বাপের ঐ রকম অবস্থা হওয়াতে
তার মনে তখন হইতেই একটা বড় হইবার প্রবল আকাঙ্খা হইয়াছিল । যখন
আট নয় বছরের , সেই সময় আমাকে প্রায় বলিত যে , সে লেখাপড়া শিখিয়া
ইঞ্জিনিয়ার হইবে । লেখা-পড়া তার নিকট একটা প্রিয় বস্তু ছিল ,
কোনও দিন তাহাতে অবহেলা করে নাই । যখন ওর তের বছর বয়স সেই সময়
আমরা একবার শ্রীরামপুরে যাই । সেখানে থাকিবার সময় একদিন একটা
মাঝি নৌকায় চড়িয়া গান গাহিতে গাহিতে যাইতেছিল " আমার খুড়োখুড়ী
পায় না মুড়ী " ইত্যাদি । এই গান শুনিবার পর হইতেই ওর মনে
কি এক রকম ভাব উপস্থিত হয় । সে প্রায়ই এক একটা প্রবন্ধ লিখিয়া
আমাকে শোনাইত । বুঝিবার মত লেখাপড়া যদিও আমার তেমন জানা ছিল
না, কিন্তু তবু শুনিয়া ভালই লাগিত । তখন হইতেই সাহিত্যের প্রতি
তাহার দিন দিন অনুরাগ বৃদ্ধি পাইতে লাগিল ।
বলুর যখন ছাব্বিশ বছর বয়স
সেই সময় ডাক্তার ফকিরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা সাহানা দেবীর
সঙ্গে বিবাহ হয় । বিবাহে খুবই ঘটা হইয়াছিল । বিবাহের যত রকম
আয়োজন করিবার সবই আমার মেজ জা করিয়াছিলেন । আমার ছোট জা ( রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের স্ত্রী ) মৃনালিনী দেবীও সঙ্গে সঙ্গে যোগ দিয়া নানা
রকম ভাবে সাহায্য করেন । তিনি আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে লইয়া ,
নানা রকম আমোদ-আহ্লাদ করিতে ভালবাসিতেন । মনটি খুব সরল ছিল ,
সেইজন্য বাড়ীর সকলেই তাঁকে খুব ভালবাসিতেন । আমার সব জায়েরাই
আমাকে নিজের বোনের মতন মনে করিয়া স্নেহ ভক্তি করিতেন । মৃনালিনী
, যশোহর জেলার বেণীমাধব রায়ের কন্যা ।
বলুর বিবাহ ১৩০২ সালের
২২শে মাঘ হয় । বউ যখন ঘরে আসিল তখন এত কষ্টভোগের পর মনে বড় আহ্লাদ
হইল , ভাবিলাম এইবার ঈশ্বর আমাকে একটু বুঝি সুখের মুখ দেখাইলেন
। সাহানার যখন বিবাহ হয় তখন তাহার বয়স বার পূর্ণ হইয়া তের বছর
। দেহের রং যদিও শ্যামবর্ণ ; কিন্তু চেহারা খুবই সুশ্রী ছিল
। স্বভাবটি সরল শিশুর মত , যে যাহা বলিত বা ঠাট্টা করিত , সে
তাহাই সত্য বলিয়া ধারণা করিয়া লইত । আমার কন্যা হয় নাই , সে
আমার কন্যার স্থান অধিকার করিয়া লইয়াছিল । আমি যখন খাইতে বসিতাম
সেই সময় সেও আহ্লাদ করিয়া আসিয়া আমার সঙ্গে খাইতে বসিত । তাহার
যখন বিবাহ হয় , তখন বাড়ীতে অনেকগুলি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ছিল ।
তাহাদের সঙ্গে সেও ছোটাছুটি-খেলাধূলা করিত । বলুও অনেক সময় তাহার
সঙ্গে খেলা করিত । সে বাড়ীর বউ হওয়ার জন্য , তাহাকে সেইভাবে
বদ্ধ অবস্থায় বা কোনও রকম নিয়মের বাঁধনে রাখি নাই ।
একবার আমাকে বলুকে সঙ্গে
লইয়া কোন একটি আত্মীয়ের দুটি কন্যার বিবাহ স্থির করিবার জন্য
তাঁহাদের বাড়ীতে যাইতে হইয়াছিল । যখন বাড়ীতে ফিরিলাম তখন রাত্রি
হইয়া গিয়াছে । পথের মধ্যে হঠাৎ শুনিলাম যে , মুসলমান এবং ইংরাজদের
ভিতর ভীষণ রকম মারামারি আরম্ভ হইয়াছে । মুসলমানেরা ইংরাজি দেখিলেই
তাহাকে অতি ভয়ানক রকমে মারিতেছে । রাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের
জমির উপর একটা মস্জিদ্ ছিল , সেই মস্জিদ্টি ইংরাজের সাহায্যে
তিনি ভাঙিয়া ফেলেন । তারই জন্য ইহাদের আক্রোশ । আগে জানিতাম
না , রাস্তার মাঝে আসিয়া এই ব্যাপার দেখিলাম - আমাদের ঘরের গাড়ী
ছিল , আমাদেরই এক ডাক্তার নন্দাইয়ের গাড়ীতে সেদিন গিয়াছিলাম
। তাহারা কোচম্যানকে প্রথমে কার গাড়ী জিজ্ঞাসা করাতে সে অত বিবেচনা
না করিয়া বলে যে ' সাহেবের ।' এই কথা বলিবামাত্র অজস্রধারায়
ইট লাঠি সমানে গাড়ীর উপর পড়িতে লাগিল । গাড়ীর কাঁচ ভাঙিয়া চারিদিকে
ছিটকাইয়া পড়িল । আমি বলুর মাথাটা আমার বুকের কাছে টানিয়া আনিয়া
তাহাকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম । আমার পিঠের উপর অনেক
ইট আসিয়া পড়িয়াছিল । আমাদের যখন এই অবস্থা , তখন কোচয়ান্ চীৎকার
করিয়া বলিতে লাগিল, " এ গাড়ী বাঙ্গালীবাবুর - সাহেবের নয়
।" তাহারা গাড়ীর নিকটে যখন আসিয়া দেখিল সত্য সত্যই ইহা
বাঙ্গালীর গাড়ী তখন নিরস্ত হইল । আমরাও কোনরকমে প্রাণটুকু হাতে
লইয়া বাড়ী ফিরিলাম । বাড়ী আসিয়া তিন চার দিন প্রায় অজ্ঞান অবস্থায়
দুজনে পড়িয়া ছিলাম । সারা দেহে অসহ্য রকম বেদনা এবং তার দরুণ
যন্ত্রণায় আমার সর্ব্বশরীর নীলবর্ণ হইয়া গিয়াছিলাম । ডাক্তার
আসিয়া ওষুধ-পত্তর ব্যবস্থা করিবার পর ক্রমশঃ আরাম পাই । বলুর
কপালের ভিতর একটি ছোট কাঠের টুক্রা বিঁধিয়া অনেক দিন পর্যন্ত
ছিল , তারপর আপনা হইতেই সেটা বাহির হইয়া যায় ।
পঞ্জাবে আর্য্যসমাজের সহিত
আমাদের ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে যাহাতে মিলন স্থাপন হয় সেইজন্য তাহার
প্রাণের প্রবল ইচ্ছা ছিল এবং তাহারই জন্য বলু , আর্য্যসমাজে
যাতায়াত করিতে থাকে , তাঁহারাও তাকে প্রাণের সহিত ভালবাসিতেন
। তাঁহাদের মধ্যে যদি কখনও বিবাদ উপস্থিত হইত , তাহা হইলে বলুকে
মীমংসা করিয়া দিবার জন্য আহ্বান করিতেন , এবং সে গিয়া তাহাদের
মধ্যে বিবাদ মিটাইয়া মিলন স্থাপন করিয়া আসিত । তাহার এই ইচ্ছা
পূর্ণ করিবার সুযোগ আর জীবনে ঘটিয়া উঠিল না । দ্বিতীয়বার যখন
সে তাঁহাদের টেলিগ্রাম পাইয়া চলিয়া যায় , সেইদিন আমার মেজ জায়ের
কন্যা ইন্দিরার ফুলশয্যা । সেইজন্য সকলেই তাকে যাইতে বারণ করিলেন
, কিন্তু তাঁহাদের টেলিগ্রাম পাওয়াতে পাছে কর্ত্তব্যের অবহেলা
হয় বলিয়া নিষেধ সত্ত্বেও সে চলিয়া গেল । সেখান হইতে ফিরিয়া আসিবার
পথে মথুরা , বৃন্দাবন , এলাহাবাদ এবং কাছাকাছি অনেক তীর্থস্থান
দর্শন করিয়া আসিল । সীতাকুণ্ডতে স্নান করিবার পর তার কাণে খুব
যন্ত্রণা হয় এবং তাহা লইয়াই বাড়ীতে ফিরিয়া আসে । বাড়ী আসার পর
নানারকম সেবা-যত্নে কানের যন্ত্রণা অনেকটা কমিয়া আসিতেছিল ,
কিন্তু সেই সময় ঠাকুর কোম্পানীর হিসাবপত্র চুকাইবার জন্য তাহাকে
শিলাইদহে জমীদারিতে যাইতে হয় । সাহানা ওখানে আমার ছোট জায়ের
কাছে ছিল , তাহাকে সেই সময় ওখানে একজন ইংরাজ মাষ্টার পড়াইত ।
সারা দিনরাত হিসাবপত্র লইয়া বলু এত ব্যস্ত থাকিত যে , সময় মত
স্নানাহার তাহার হইত না , কখনও বা বেলা তিনটায় কখনও বা পাঁচটায়
খাইত , এইরূপ অনিয়ম হওয়াতে পুনরায় কানের যন্ত্রণা খুব বাড়িয়া
উঠে । সে যখন শিলাইদহে , তখন একদিন স্বপ্নে দেখিলাম , যে বলু
আমার কাছে দাঁড়াইয়া বলিতেছে , " মা, আমার শরীর ভাল নাই
।" ইহার পর আমার মন তাহার জন্য আরও অস্থির হইতে লাগিল ।
আমি সাহানাকে লিখিলাম যে , তাহাকে আমার কাছে শীঘ্র পাঠাইয়া দেও
, আমি এইরূপ স্বপ্ন দেখিয়াছি । সে যখন ফিরিয়া আসিল তখন তাহার
শরীরের অবস্থা দেখিয়া আমার চিন্তার অবধি রহিল না , কিসে সে আরাম
হইবে এই কেবল ভাবিতে লাগিলাম । অঘোর ডাক্তার , উমাদাস বাঁড়ুয্যে
, ডাক্তার সাল্জার্ এই তিনজনে দেখিতে লাগিলেন । তাঁরা আমাকে
বলিতেন , যে ভয়ের কোন কারণ নাই , ভাল হইয়া যাইবে , কিন্তু আমি
কিছুতেই সে ভরসা পাইলাম না । বাড়ীর সকলে আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন
যে , আমি কোনও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে দেখাইতে চাই কিনা , আমার তখন
ভাবনা-চিন্তায় মনের এমন অবস্থা হইয়াছিল যে হিতাহিত জ্ঞান একেবারেই
হারাইয়া ফেলিয়াছিলাম , কিছুই বলিতে পারিলাম না । তাঁহারাই তখন
সাহেব ডাক্তারকে আনিয়া দেখান । বলুর অবস্থা ক্রমশঃই খারাপের
দিকে যাইতে লাগিল । যেদিন সে জন্মের মত আমাকে তাহার বন্ধন হইতে
মুক্ত করিয়া চলিয়া গেল , সেই দিন রবি ( আমার ছোট দেওর ) আসিয়া
আমাকে বলিলেন যে , " তুমি একবার তার কাছে যাও , সে তোমাকে
মা, মা করিয়া ডাকিতেছে ।" আমি এক সময় তার যন্ত্রণা দেখিতে
না পারিয়া পাশের ঘরে গিয়া বসিয়া থাকিতাম । রবির কথা শুনিয়া যখন
তার কাছে গিয়া তার পাশে বসিলাম , তখন তাহার সব শেষ হইয়া আসিয়াছে
। মনে হইল , আমাকে দেখিয়া চিনিতে পারিল , তাহার পর একবার বমি
করিয়া সব শেষ হইয়া গেল । তখন ভোর হইয়াছে । সূর্য্যদেব ধীরে ধীরে
তাঁহার কিরণচ্ছটায় পৃথিবীকে সজীব করিয়া তুলিতেছিলেন , ঠিক সেই
সময় তাহার দীপ নিভিয়া গেল । অনেকক্ষণ তাহাকে লইয়া বসিয়া রহিলাম
। তারপর সকলে আমাকে অন্য ঘরে লইয়া গেল । যখন আবার ফিরিয়া আসিলাম
তখন সে নাই , ঘর শূণ্য পড়িয়া রহিয়াছে । বুকের মধ্যেও সবই তখন
শূণ্য হইয়া গিয়াছে । সেই শূণ্যতার কঠিন মর্ম্ম তারাই বুঝিতে
সক্ষম হইবে , যাহারা এই পুত্রশোকের তীব্র জ্বালা অনুভব করিয়াছে
। তাহার স্মৃতি চারিদিক হইতে প্রতিমুহূর্তে আমাকে দগ্ধ করিতে
লাগিল । তারই ঘর সাজাইবার জন্য নানারকম জিনিস কিনিয়া দিয়াছিলাম
, তখন মনে হইতে লাগিল , তাহারই চিতার সঙ্গে এইগুলিও সব জ্বালাইয়া
ছারখার করিয়া ফেলি । কিন্তু বউটির মুখের দিকে চাহিয়া তাহা হইতে
নিরস্ত হইলাম । যেদিন তার মৃত্যু হয় সেইদিন আমার স্বামী ক্রমাগত
ঘর আর বাহির করিয়াছিলেন । শুনিয়াছি চাকরদের নিকট বারবার জিজ্ঞাসা
করিয়াছেন , "বাড়ীতে সব তালাবন্ধ কেন ?" যদিও তখন তিনি
উন্মাদ অবস্থায় ছিলেন , কিন্তু ভগবান তাঁর ভিতরেও পুত্রশোকের
দারুণ যন্ত্রণার অনুভব-শক্তি দিয়াছিলেন ।
যাহাকে ছাড়িয়া কখনও থাকিতে
হইবে একথা মনেও আনিতে পারি নাই , তাহাকে ছাড়িয়া একত্রিশ বছর
কাটিয়া গেল । ঊনত্রিশ বছর বয়সে ১৩০৬ সালে, ৩রা ভাদ্র তাহার মৃত্যু
হয় ।
তাহার মৃত্যুর পর সেই ঘরেই
দরজা বন্ধ করিয়া অচেতন অবস্থায় পড়িয়া থাকিতাম । মনে হইত , সে
যেন পূর্ব্বেকার মত আমার কাছে দাঁড়াইয়া আছে । তাহারই ঘরের সামনের
বারান্দায় একটি মাদুরের উপর দিনরাত্রি শুইয়া কাটাইতাম । জল ঝড়
বৃষ্টি সবই আমার উপর দিয়া যাইত , কিন্তু আমার তখন কোনও দিকেই
হুঁস ছিল না , কেবল সর্ব্বদাই মনে হইত , আমি না থাকায় তাহার
আহারের না জানি কতই কষ্ট হইতেছে । সে যখন যাহা খাইত , আমি নিজের
হাতে তাহা খাইতে দিতাম । তাহার জন্য গরু কিনিয়াছিলাম এবং গরুটিকে
নানা রকম ভাল জিনিস খাইতে দিতাম , কেন না তাহার দুধ ভাল হইলে
শরীর সুস্থ হইবে । সেই দুধের সর তুলিয়া নিজের হাতে মাখন করিয়া
তাহারই ঘি হইতে সে যাহা খাইত সব রকম খাদ্য প্রস্তুত করিতাম ।
এইসব যখন মনে হইত ও খাবার সময় নিকটে আসিত তখন মন আরও অস্থির
হইয়া পড়িত । একদিন বৈকাল বেলা তাহার কথা চিন্তা করিতে করিতে
মনে হইল , কে যেন আমাকে বলিতেছে , " কে তোমাকে দুধের ঘটি
দিয়া তাহার সঙ্গে পাঠাইয়াছিল ?" যখন এই কথাটা মনের মধ্যে
জাগিয়া উঠিল তখন মনে অনেকটা শান্তি পাইলাম । মনে হইল , যিনি
তাহাকে দয়া করিয়া আমার কোলে আনিয়া দিয়াছিলেন তিনিই তাহার সমস্ত
অভাব মোচন করিয়া দিবেন । বিদ্যারত্ন মহাশয় সেই সময় আসিতেন .
তিনি আমার মনে শান্তি আনিবার জন্য গীতা , উপনিষদ , ভগবদ্গীতা
পড়িয়া শুনাইতেন । আমার এক ভাইপো শিবপ্রসন্ন আমার কাছে থাকিত
, তারও খুব ধর্ম্মের ভাব ছিল , সেও শুনিত , এবং আমার সঙ্গে আহুতি
করিত , আমার বড় ভাসুরের পুত্রবধূ হেমলতা দেবীর কাছে পরমহংস শিবনারায়ণ
স্বামী আসিতেন , তাঁর নিকট হইতে অনেক সৎ উপদেশ পাইয়া মনে শান্তিলাভ
করি । তিনি আহুতি করিতে বলেন এবং বলুও বলিয়াছিল যে , "আহুতি
কর মনে শান্তি পাবে , ভগবানের দর্শন পাবে ।" ভগবানের দর্শন
পাইবার জন্য তখন মন বড়ই ব্যাকুল হইয়া উঠিল , আহুতি করিবার পর
হইতে মনে একটা বিশেষ আরাম অনুভব করিতে লাগিলাম । আমার শ্বশুর
ও রবি , দুইজনে মিলিয়া বিদ্যারত্ন মহাশয়কে বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছিলেন
, এক বৎসর তিনি প্রত্যহ আমাকে ধর্ম্মপুস্তক পড়িয়া শুনাইয়াছিলেন
। বলুর মৃত্যুর পর পনের-ষোল বছর আমার স্বামী উন্মাদ অবস্থাতেই
বাঁচিয়া ছিলেন , মাঝে মাঝে বলুর খোঁজ করিতেন । আমি সেই সময় হইতে
গেরুয়া কাপড় পরিতে আরম্ভ করি , হাতে দুগাছি শাঁখা রাখিয়াছিলাম
। আমার এই গেরুয়া বসনের জন্য তিনি প্রায় জিজ্ঞাসা করিতেন যে
কেন আমি এইরূপ বেশ পরিবর্ত্তন করিয়াছি । আমি তাঁহাকে বলিতাম
যে আমার পিতা পরিতেন তাই আমিও পরিতেছি , তাহার কাছে এই দুঃখের
সংবাদটা নিজ মুখে দিতে পারি নাই । সংসারে কর্ম্মের ভিতর , আমি
আমার মনকে আরও দৃঢ়ভাবে নিয়োগ করিতে লাগিলাম । মানুষের দুঃখের
লাঘব , একমাত্র কর্ম্মবন্ধু । কর্ম্মের ভিতর মানুষ নিজের অতি
প্রচণ্ড দুঃখকেও ভুলিয়া থাকিবার সুযোগ খুঁজিয়া পায় । আমার এত
বৃদ্ধ বয়সেও সেই কর্ম্মকে পরিত্যাগ করিতে পারিলাম না । স্বামী
যতদিন বাঁচিয়াছিলেন , তাঁহার সেবাশুশ্রূষা করা , পুত্রবধূকে
দেখা , এই সকল ভার আমার উপর পড়িল । তাহা ছাড়া আমার ভাই , ভাইপোরা
, প্রায়ই আমার কাছে আসিয়া থাকিতেন , তাহাদের তত্ত্বাবধান করা
- নেই সব কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রাখিতে লাগিলাম । শিবপ্রসন্নকে
ছোট হইতেই প্রতিপালন করিয়াছিলাম , সেও আমাকে খুব ভালবাসিত ,
তাহার বিবাহের কয়েক বছর পরেই সেও আমাকে ফাঁকি দিয়া চলিয়া গেল
। আমার পুত্রবধূ সাহানাকে ইংরাজী স্কুলে ভর্ত্তি করিয়া দিলাম
, ভাবিলাম লেখাপড়ার ভিতর নিজের মনকে নিয়োগ করিতে পারিলে মনে
অনেকটা শান্তি পাইবে শিক্ষার দ্বারা মনের উন্নতি লাভ করা সম্ভবপর
- অবশ্য যদি প্রকৃত শিক্ষা পায় । কিছুদিন পরে সে বিলাতে ট্রেনিং
পড়িবার জন্য গিয়াছিল , কিন্তু কিছুদিন থাকিবার পর শরীর অসুস্থ
হওয়া ফিরিয়া আসিতে বাধ্য হইল ।
( ক্রমশঃ )
(সম্পূর্ণ
রচনাটি ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের 'প্রবাসী'-র বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত)
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)