পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
নন্-কো-অপারেশন
প্রফুল্লময়ী
দেবী
[ লেখক পরিচিতি
: বর্তমান গল্পের লেখিকা প্রফুল্লময়ী দেবী মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের
পুত্র বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কিনা বলা শক্ত । কারণ একই
নামে অর একজন লেখিকা ছিলেন যিনি ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দে ফরিদপুরে
জন্মগ্রহণ করেছিলেন | যদি লেখিকা ঠাকুর পরিবারের প্রফুল্লময়ী
দেবী হন তবে তার পরিচিতি বর্তমান ধারাবাহিকের ‘আমাদের কথা’ নামক
রচনায় দেওয়া হয়েছে | ]
দীপক সেনগুপ্ত |
কর্ম্ম
ত্রস্ত, সদাব্যস্ত কলিকাতা সহরে বেলা প্রায় ১১টা বাজে। রাস্তায়
টাইমের ভাত খাইয়া, কেহ বা অভুক্ত অবস্থায় যে যার কাজে যাতায়াত
করিতেছে।
পুত্রের দ্বিতলস্থ প্রকোষ্ঠের পর্দ্দার বাহিরে দাঁড়াইয়া বর্ষীয়শী
মাতা মৃদুস্বরে পুত্রবধূকে ডাকিতেছিলেন "সুধা, অ-সুধা!"
ভিতর
হইতে বধূ সুধা কণ্ঠস্বরে অনেক খানি বিষ ঢালিয়া বলিয়া উঠিলেন, "বেলা
দুপুরে গিল্তে বসেও স্বস্তি আছে। দিনরাত "সুধা" আর "সুধা"।
বিনি মাইনের বাঁদী আর কি।"
বিধবা
সঙ্কোচে মরিয়া গেলেন। সাহসে ভর করিয়া আবার বলিলেন, "খোকা
ঘরে আছে কি!"
"কি
আক্কেল মার আমার ! বল না অমল, ওঁড় বুড়ো খোকা কি এখনও ঘরে বসে আছে!
কাছারী নেই নাকি আজ!"
১৪ বছরের পৌত্র অমল বাহিরে আসিয়া দেখিল মার সুধামাখা সম্ভাষণে
ঠাকুরমা ম্লান মুখে নীচে ফিরিয়া যাইতেছেন।মাঝে মাঝে প্রায়ই সে
এ দৃশ্য দেখিয়া থাকে।তথাপি আজ নূতন করিয়া ঠাকুরমা এই অপমানিত ব্যথিত
মুখভাব দেখিয়া বড় বেদনা বোধ করিল। চাপিয়া ঠাকুরমাকে জড়াইয়া ধরিয়া
বলিল, "বাবা তো বাড়ীতে নেই! কেন ডাকছিলে ঠাকুমা।"
ঠাকু'মা একটি নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, "পোড়া পেটের জ্বালায়
দাদু, ঘুঁটে নেই, ঝি বল্ল, পয়সা চেয়ে আন, তবে তোমার উননে আগুন
পড়্বে।' থাক আজ আর খেয়ে কাজ নেই।"
অমল আবার ঘরে ফিরিয়া গেল। স্কুলের বই গুলি লইয়া বাহিরে আসিয়া ঝিকে
ডাকিয়া পয়সা দিয়া গেল। ঠাকুরমাকে বলিয়া গেল, "রাঁধ ঠাকুমা,
আমি এসে তোমার পাতে খাব।"
[ ২ ]
বিকালে অমল মা'কে লুকাইয়া ঠাকুরমা পাতের প্রসাদ খাইত। মা'র কঠোর
শাসনে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা ঠাকুরমার সহিত ভাল করিয়া কথা কহিত না।
অমল বড় হইয়াছে, সে মা'কে অত ভয় করিত না। আজ পাতের ভাত খাইতে বসিয়া
দেখিল, শুধু ভাত।
সে সবিস্ময়ে বলিল, "তুমি আজ কি খেয়েছ ঠাকুমা।"
ঠাকুমা বলিলেন, "বিধবার খাওয়া, একটু সন্ধব আর এক পো আলো চালেই
হয় রে, অমু ! তুই যদি মার কাছ থেকে একটু দুধ মিষ্টি আন্তি, ভাত
কটি খেয়ে নিতি।"
বুদ্ধিমান পৌত্র বুঝিল, হতভাগিনী ঠাকুমা ঘুঁটের পয়সা চাহিতেই সাহস
পান নাই, তা'র ডাল তরকারীর পয়সা চাহিবেন কি! আজ তিনি নুন তেঁতুল
দিয়াই পেটের জ্বালা নিবাইয়াছেন। অমল বলিল, "কেন ঠাকু'মা ভাঁড়ারে
কত তরকারী থাকে, তোমাকে কেন দেয় না মা !"
ঠাকু'মা মৃদু হাসিয়া বলিলেন, "সে সব যে তোমাদের মাছ মাংস
মাখা থাকে, অমু, আমাকে দে'বেনা কেন, আমিই তা চাই না।"
"তুমি কেন ভাঁড়ার দেখ না ঠাকুমা।"
"ভাঁড়ারের চাবি যে আমি তোমার জন্ম থেকেই তোমার মা'কে দিয়ে
দিয়েছি। এখন আমি তোমাদের শুধু ঠাকু'মা হয়ে থাক্ব গঙ্গাস্নান কর্ব,
আর শিব পূজো কর্ব দাদা, আমার গিন্নিপনার আর দরকার কি ! সুধা এখন
বুঝতে শিখেছে!"
ঠাকু'মা নীচেই থাকিতেন। উপরের ২ খানা ঘরের একখানাতে পুত্র নির্ম্মলচন্দ্র
বৈঠকখানা করিয়াছিলেন, অপর খানি শয়ন কক্ষ। বিলাসিনী বধূর পরামর্শে
মাতার উপরে স্থান হইত না। নির্ম্মলচন্দ্র কাছারী হইতে ফিরিয়াছিলেন।
একবার ভাবিলেন, "অমু মার কাছে বসে কথা কইছে, আমিও যাই।"
অমনি দেখিলেন বেথুন স্কুলের সুশিক্ষিতা পত্নী সুধা হাকিম গৃহিণীর
উপযুক্ত "পজিশন" বজায় রাখিয়া, খবরের কাগজ পড়িতেই নীচে
তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিতে আসিতেছে। আর মাতার সঙ্গে সাক্ষাৎরূপ দুরভিসন্ধি
কার্য্যে পরিণত হইল না, তিনি উপরে ধাবিত হইলেন।
অমু বলিল "আজ ভাত খেয়েই আমার পেট ভরেছে, ঠাকুমা আমার জল খাবারের
পয়সা দিয়ে তোমার খাবার আন্ব। কি আন্ব আমায় বলে দাও না, ঠাকুমা।"
ঠাকু'মা আজ অনেক সহিয়াছিলেন, কিন্তু এই মাত্র পুত্র অগ্রসর হইতে
হইতে যে ফিরিয়া গেল, সেই ক্ষতের উপর পৌত্রের স্নেহের প্রলেপটি
আর সহিতে পারিলেন না, অঝোরে চোখের জল ঝরিতে লাগিল; তিনি আবেগ ভরে
বলিয়া উঠিলেন, "দাদু, দাদু, আজ খোকা আমার পর হয়েছে, আজ সে
নির্ম্মল বাবু হয়েছে, একদিন সেও তোর মত আমার আঁচলধরা ছিল। পাঁচ
মাসের ছেলে কোলে নিয়ে একাদশীর উপোস করেছিলাম। আধ পেটা খেয়েও তাকে
তা'র বাপের ভিটেয় নিয়ে ছিলেম। শেষে তার কাকার চক্রান্তে তাকে নিয়ে
বাপের বাড়ী আসি। কত করে ভাই ভাজের মন জুগিয়ে তাকে "ডবল এমে"
পাশ করিয়েছিলুম, তা আমি জানি আর উপরওয়ালা জানে রে! বিধবার সম্বল
খোকা যখন এন্ট্রান্স পাশের জলপানির পয়সা দিয়ে আমার খাবার ছানা
চিনি আন্তো, সে যেন অমৃত খেতাম। আর আজ বড় লোকের শিক্ষিতা মেয়ে
বিয়ে করে হাকিম হয়ে নির্ম্মল আমার দিকে ফিরে চায় না। একটা পয়সার
আলু ভাতে দিয়ে খেতে চাইলে সুধা আমায় বলে, "বিধবার অত নোলা
কেন, তাতে আমার খেদ নেই ভাই! তোমরা ভাল খাচ্ছ, ভাল পরছ তো! অভাগীকে
যে আমার খোকা মা বলে ডেকে খোঁজ নেয় না, সেই খেদেই আমি মরে আছি!"
অমল ভাবিল "এই কি উচ্চ শিক্ষার পরিণাম !"
[ ৩ ]
দুই
দিন পরে নির্ম্মল বাবু আহারান্তে ধড়া চূড়া পরিতে উপরে যাইতেছিলেন।
পথে পাইয়া মাতা একটা কথা কহিবার লোভ সাম্লাইতে পারিলেন না। বলিলেন,"নির্ম্মল,
রামদীনকে বলে যে'ও আমার আলোচাল ফুরিয়েছে, আধমণ চাল এনে দিতে।"
নির্ম্মল চন্দ্র মাতার প্রতি বধূর ব্যবহার অনেকটা জানিতেন, তথাপি
সুধা কি ভাবিবে, বলিয়া চাউল আনাইবার লুপ্ত কর্ত্তৃত্বটুকু হাতে
লইতে সাহস পাইলেন না। বলিলেন, "আজ আমার বড্ড তাড়াতাড়ি; সুধাকে
বলগে, সেই তো চাল ডালের খবর জানে।"
নির্ম্মল একটু ইতস্ততঃ করিয়া উপরে উঠিয়া গেলেন, দেখিলেন সেখানে
সুধা তাঁহার বেথুন স্কুলের "ক্লাস ফ্রেণ্ড" মিসেস্ অমিয়া
মিত্রের সহিত মিঃ গান্ধির বক্তৃতার অন্যায্যতা প্রমাণ করিতে মহা
তর্ক বাধাইয়া দিয়াছেন। নির্ম্মল স্মিত মুখে অমিয়া মিত্রকে নমস্কার
করিয়া পাশের ঘরে গিয়ে জামা কাপড় বদ্লাইতেছিলেন। সহসা নীচে যেন
কিছু পড়িয়া গেল। অজ্ঞাত আশঙ্কায় ছুটিয়া আসিতে দেখিলেন, চেতনহীনা
মাতা ধুলায় লুটাইতেছেন, অমল তাঁহার মাথাটী কোলে লইয়া অস্থির ভাবে
ডাকিতেছে "ঠাকুমা গো, ঠাকুমা!"
নির্ম্মল বলিলেন, "একি, মার কি হল, অমু !"
অমল
বলিল, "সইতে পারেনি, বাবা, ঠাকুমা অতটা সইতে পারে নি! আমি
নিজের চোখে দেখেছি, পরশু শুধু নুণ ভাত খেয়েছে, কাল একাদশী করেছে,
আজ চাল নেই বলে মাকে সকালে বলতে গিয়েছিলেন, মা এত শিগ্গির চাল
ফুরোল কেন বলে রাগ করতে লাগলেন। তোমাকে চালের কথা বলতে তুমি আবার
মাকে বলতে বললে! অত হেলা ফেলা বুড়ী আর সইতে পারেনি, মনের খেদে
অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে!"
ঠাকুরমা
চোখ মেলিয়া অমলকে দেখিয়া বলিলেন, "অমল, আমার খোকা কাছারি
চলে গেছে ?"
নির্ম্মল
হাঁটু পাতিয়া মার কাছে বসিয়া বলিলেন "মা, ওমা, এই যে আমি,
আমায় মাপ কর মা।"
মা
বলিলেন, "ডাক খোকা, আবার ডাক; আমি এখনও, তোকে খোকা ডাকা ভুলতে
পারিনি, তুই কি অপরাধে মা ডাক ভুলবি, খোকা! তুইত আমার সোহাগের
স্মৃতি নোস্, তুই যে দুঃখিনীর ধন বাবা।" উপরে নির্ম্মল চন্দ্রের
মেয়ে সুর করিয়া পড়িতেছিল।
"মা আমার কত ভালবাসেন আমায়
আছে কি তুলনা মোর মায়ের মায়ায়।"
* * * * * * * * *
* * * *
উপরে
গিয়া অমল ভগ্নী “বেবি” র চুলের ফিতা টানিয়া খুলিয়া ফেলিল,বলিল,"আর
তোমাকে বিবি সেজে স্কুলে যেতে হবে না।"
"আঃ! ছেড়ে দাও দাদা গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে,...।
না গেলে fine হবে যে" !
"
না বেবি, তুই আর আমি Non-co-operation করব।"
নির্ম্মল বিস্ময়ে বলিলেন,"সেকিরে অমু,তোর আবার হ’ল কি, Non-co-operation
আমার বাড়ী চলবে না।"
অমল গম্ভীরভাবে বেবির বইগুলি গুছাইতে গুছাইতে বলিল, "তোমার
বাড়ীতেই আগে আরম্ভ হ’বে, বাবা, নইলে এই শিক্ষা দীক্ষা শেষ হ’লে
১৫ বছর পরে আমিও যে তোমাদের খেতে দেব না, ঠাকুমার মত মা’কেও যে
আমার বউ-এর খোসামোদ করে খেতে হ’বে! বেবিটাকেও বাড়ীতে আমরা পড়াব,
নইলে পর শ্বশুর ঘরে গিয়ে এই রকম বিবিয়ানাই কর্বে,গেরস্তের সর্ব্বনাশ
করবে। কাঙ্গাল জাতের জন্যে তো এ শিক্ষা নয়,বাবা! আমি মুটে মুজুরি
করে খা’ব সেও ভাল; তবু অমনতর সভ্য হয়ে বাপ মা হারাতে চাই না। যদি
সুশিক্ষা দেশে আরম্ভ হয় তো আবার পড়ব; নইলে আমিও আজ থেকে মহাত্মা
গান্ধীর দলে যোগ দেব,হাকিমের ছেলে,‘Non-co-operation’ করব। নির্ম্মল
নির্ব্বাক !" অপর কক্ষে সুধা অর্দ্ধমুর্চ্ছিতা!
( ‘নারায়ণ’ পত্রিকা, বৈশাখ, ১৩২৮ )
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।