পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
ইংলণ্ডীয়
সভ্যতা।
শ্রীপূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়
( লেখকের
পরিচয় জানা যায় নি । লেখকের পরিচয় পাঠকদের কেউ জানালে সেটা প্রকাশিত
হবে।) দীপক সেনগুপ্ত।
ইংলণ্ড
সভ্য দেশ, ইহা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু কি কি উপকরণে ইংলণ্ডের
সভ্যতা গঠিত, তাহা কি আমরা চিন্তা করিয়া থাকি? এই বিষয়টী আমাদের
চিন্তা করা উচিত; কেননা, আমরা সর্ব্বদাই ইংলণ্ডের সভ্যতার অনুকরণে
ব্যস্ত, সভ্যতা ভ্রমে যদি অসভ্যতার অনুকরণ করিয়া ফেলি, তবে বড়ই
বিপদের সম্ভাবনা। এই প্রবন্ধে ইংলণ্ডের সভ্যতার কয়েকটী উপকরণ প্রদর্শিত
হইতেছে।
প্রথম। ইংরেজজাতি অত্যন্ত বিনীত ও শিষ্টাচারী; এইটী তাহাদের সভ্যতার
একটী প্রধান অঙ্গ। আমরা যে সকল ইংরাজ এদেশে দেখিতে পাই, তাহাদের
ব্যবহার দেখিয়া ইহা ধারণা করা কঠিন; কিন্তু যাঁহারা বিলাতে গিয়াছেন
তাঁহারা ইংরেজ জাতির শিষ্টাচার দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছেন। শৈশবকাল
হইতেই বাপ মায়ের নিকট হইতে ইংরাজেরা শিষ্টাচারের নিয়ম সকল শিক্ষা
করিয়া থাকে। বিলাতে একটি বালকের মধ্যে যে প্রকার শিষ্টভাব দেখিতে
পাওয়া যায়, আমাদের দেশের অনেক বয়ঃপ্রাপ্ত যুবকের মধ্যেও তাহা নাই।
কি প্রকারে একজন ভদ্রলোকের সহিত কথা কহিতে হয়, কি বলিয়া একজনকে
অভ্যর্থনা করিতে হয়, এই সকল ইংরেজ বালক বালিকারা অতি সুন্দররূপে
শিক্ষা করে। কথাবার্তার মধ্যে বিনীতভাব, কাহারও কথার কর্কশভাবে
প্রতিবাদ না করা, প্রতিবাদ করিতে হইলে ক্ষমা প্রার্থনা করা, এই
সকল ইংরেজ জাতির চরিত্রগত সদ্গুণ। এমন কি ইংলণ্ডে চাকর চাকরাণীকে
পর্য্যন্ত কোন প্রকারে অবজ্ঞা করা নিন্দনীয়। তাহাদিগের নিকটেও
বিনীতভাবে কথা কহিতে হয়। কোন একটী আদেশ প্রতিপালন করিলে ধন্যবাদ
দিতে হয়, এটী বড়ই সুন্দর ভাব। আমরা চাকর চাকরাণীকে কতই মনঃপীড়া
দেই, তাহারা গরিব বলিয়া অন্নের দায়ে আমাদের অধীনে কাজ করিতে আসে;
আর তাহারা যে মানুষ, আমাদের মত তাহাদেরও সুখ দুঃখ বোধ আছে, ইহা
আমাদের যেন জ্ঞানই থাকে না। ভারতবর্ষীয় ইংরাজদেরত কথাই নাই, তাঁহারা
চাকরদিগকে নৃশংস ভাবে কতই না পাদুকা প্রহার ও বেত্রাঘাত করিয়া
থাকেন। ইংলণ্ডে আর একটী ভাব দেখিয়া চমৎকৃত হইয়াছি, সেখানে বৃদ্ধ
ও যুবকের সম্বন্ধ আমাদের দেশ হইতে অনেকটা স্বতন্ত্র। আমরা মনে
করি বৃদ্ধের নিকটে মন খুলিয়া গল্প করা কি আমোদ করা বেয়াদবী; কিন্তু
বিলাতে তাহা দেখা যায় না; বৃদ্ধ ও যুবকের মধ্যে বেশ সখ্যভাব। যুবকেই
যে কেবল বৃদ্ধের নিকট বিনীত আর বৃদ্ধ যুবকদের নিকটে উদ্ধত হইবেন,
ইহা সেখানে দেখা যায় না। বিলাতে শিক্ষক ও ছাত্রের পরস্পর ব্যবহার
চিন্তা করিলে এই ভাবটী আরও পরিষ্কাররূপে বুঝা যায়। শিক্ষক সর্বদাই
রুদ্রমূর্ত্তি আর ছাত্র ভয়ে বিকম্পিত, এটী বিলাতে খুবই কম। ইহাঁদের
পরস্পরের মধ্যে সম্পূর্ণ সখ্যভাব দেখিতে পাওয়া যায়। শিক্ষক যেমন
ক্লাসের বাহিরে আসিলেন, অমনই ছাত্র ও শিক্ষক পরস্পরের বন্ধু, উভয়ে
সমভাবে কথা কহিবার অধিকারী। ছাত্রদের প্রতি শিক্ষক মহাশয়দিগের
শিষ্ট ও বিনীতভাব দেখিযা অবাক্ হইয়াছি। একজন শিক্ষকের বাড়ীতে যদি
যাওয়া যায়, তবে তিনি অন্য দশজন ভদ্রলোককে যে প্রকার সম্মানের সহিত
অভ্যর্থনা করেন, ছাত্রকেও ঠিক্ সেইরূপ করিয়া থাকেন, এমন কি বসিবার
জন্য ভাল আসন খানা ছাড়িয়া দেন্। আমি সর্ব্বপ্রথমে যেদিন প্রফেসার
কলডারউডের সঙ্গে তাঁহার বাড়ীতে দেখা করিতে গেলাম, তিনি যে প্রকারে
আমাকে অভ্যর্থনা করিলেন, আমি দেখিয়া চমৎকৃত হইলাম। একখানা ভাল
আসনে বসাইয়া অত্যন্ত বিনয় ও সদ্ভাবের সহিত আলাপ ত করিলেনই; তারপর
আমি যখন উঠিয়া আসি তিনি সঙ্গে সঙ্গে সদর দুয়ার পর্য্যন্ত আসিলেন
এবং আমার বড় কোট্টা গায়ে পরাইয়া দিলেন। তিনি যে আমাকে নূতন লোক
পাইয়া এইরূপ করিয়াছিলেন, তাহা নহে; আমি তারপর যতদিন তাঁহার বাড়ী
গিয়াছি, প্রতিদিনই তিনি ঐরূপ করিয়াছেন। যাঁহারা শিক্ষিত লোক, কেবল
তাঁহাদের মধ্যেই এই বিনয় ও শিষ্টাচার দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা নহে;-ইতর
ও সাধারণ লোকের মধ্যেও ইহা বেশ পরিলক্ষিত হয়। সাধারণ লোকেরা রাজপথে
দাঁড়াইয়া অসভ্য ভাষায় পরস্পরের সহিত গালাগালি করিতেছে, ইহা বিলাতে
খুবই কম দেখিতে পাওয়া যায়। মদ খাইয়া যখন মাতাল হয়, তখনই ঐরূপ করে।
অনেকে মনে করেন যে ইংরাজের যে শিষ্টাচার, এটা কেবল বাহ্যিক এবং
অনেক পরিমাণে কপটাচার। আমি এই মতে সম্পূর্ণ সারা দিতে প্রস্তুত
নই। শিষ্টাচার যাহাদের মজ্জাগত হইয়াছে, তাহাদের নিকটে উহা আর বাহ্যিক
কি করিয়া হইতে পারে? অবশ্য ভদ্রতার খাতিরে অনিচ্ছা সত্বেও অনেক
সময় অনেকে শিষ্টাচার প্রদর্শন করিয়া থাকে, কিন্তু সাধারণতঃ উহাকে
কপটাচার অথবা Artificial বলিয়া নিন্দা করা অন্যায়। আমরা যখন বিলাতে
যাই এবং যাইয়া যখন ইংরাজী সভ্যতা নকল করিতে থাকি, তখন তাহা কপটতা
ও Artificial; কেন না আমরা ত আর শৈশবকাল হইতে ঐভাবে পরিবর্দ্ধিত
হইয়া আসি নাই। আমরা অনেক সময়েই আমাদের নিজের মনের অবস্থা দ্বারা
বিচার করি বলিয়াই ঐরূপ নিন্দা করিয়া থাকি। ইংলণ্ডে একজন লোককে
ভদ্র হইতে হইলে, M.A., B.A. পাশ ও কতকগুলি অর্থোপার্জ্জন ব্যতীত
আরও কিছু করিতে হয়। তাহাদের শিষ্টাচারী হওয়া দরকার। আমরা ত অনেকেই
M.A., B.A. পাশ করিয়া থাকি কিন্তু কয়জন শিষ্টাচার শিক্ষা করি?
একজন লোকের সঙ্গে ভাল ভাবে কিরূপে কথা কহিতে হয়, তাহা আমরা অনেকে
জানি না। এই শিক্ষা স্কুল কলেজে হওয়া অসম্ভব। ইহ গৃহের শিক্ষা,
বাপ্ মায়ের কাছে এ শিক্ষা পাইতে হয়। আমরা বিশ্ব-বিদ্যালয়ের উপাধি
পাইয়াও যে সভ্য হইতে পারি নাই, তাহা ধরা পড়ে। যখন আমরা একজন ইংরাজের
সংসর্গে যাই, তখনই বুঝিতে পারি, আমাদের কত অভাব রহিয়াছে।
দ্বিতীয়। আমরা যদি এই শিষ্টাচারের গূঢ় কারণ জিজ্ঞাসা করি, তবে
বলিতে হইবে, ইংরাজের স্বভাবজাত স্বাধীনতাপ্রিয়তাই ইহার মূল কারণ।
স্বাধীনতা কাহাকে বলে? নিজের ব্যক্তিত্বের প্রতি সম্মান। সেই সম্মানই
অন্যের ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করিতে শিক্ষা দেয়। আমি যে
একটা মানুষ এবং আমার জীবনের যে একটা মূল্য আছে, এই বোধ যদি না
থাকে, তবে অন্যকে প্রকৃত ভাবে সম্মান করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
প্রত্যেক ইংরাজই অল্পাধিক পরিমাণে আপনার জীবনের মূল্য বুঝেন এবং
তদ্বারাই আপনার প্রতিবাসীকে ও সম্মান ও শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিতে
পারেন। ইংরাজ জাতি যে স্বাধীনতাপ্রিয় তাহা বলা বাহুল্য মাত্র।
স্বাধীনতা ইংরাজসমাজে সভ্যতার আরেকটী উপকরণ। বাঙ্গালীরা বিলাতে
যাইয়া যে এত সুখ অনুভব করেন, তাহার প্রধান কারণ আমার মনে হয় এই
যে তাঁহারা সেখানে স্বাধীনতার বায়ু সেবন করিয়া বিমলানন্দ অনুভব
করেন। সেখানে বাঙ্গালী ও ইংরাজে পার্থক্য নাই। আমি ও আমার ইংরাজ
বন্ধু দুই সমান; আমাকে কোন ইংরাজের হস্তে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হইতে
হয় না। আমার সঙ্গে সকলেই ভদ্র ও শিষ্টভাবে কথা কহেন, আমিও তখন
আমার জীবনের মূল্য কতক পরিমাণে অনুভব করি। ভারতবাসীদের বিলাতে
যাওয়া যে কর্ত্তব্য, তাহার প্রধান কারণ এই যে সেখানে তাঁহারা আত্মমর্য্যাদা
শিক্ষা করিতে পারেন। দেখিয়া অবাক্ হইতে হয় যে ব্যক্তিত্বের প্রতি
সম্মানের ভাব ইংলণ্ডে এতই প্রবল যে, তদ্ধেতু জাতিগত বিদ্বেষ ও
অসদ্ভাব অনেক পরিমাণে তিরোহিত হইয়াছে। কোন অসভ্য বিদেশীয় লোক ইংলণ্ডে
যাইয়া যেন ইংরাজ জাতির সঙ্গে এক হইয়া পড়ে। দেখিয়াছি যে আফ্রিকা
ও আমেরিকা হইতে কাফ্রিগণও ইংলণ্ডে যাইয়া ইংরাজের সঙ্গে এক হইয়া
যায়। ইংরাজ রমণীগণ তাহাদিগকে আপনাদের গৃহে স্থানদান করিতে কিছুমাত্র
কুণ্ঠিত হন্ না। এই উদার ভাব এতই প্রবল যে অনেক ইংরাজ মহিলা কৃষ্ণকায়
কাফ্রীদের পাণিগ্রহণেও কিছুমাত্র অপমান বোধ করেন না। আমাদের দেশে
জাতিভেদরূপ ভয়ানক অনুদারতা যে বিদ্যমান, তাহার কারণ এই যে জাতিগত
বিভিন্নতা সত্ত্বেও মানুষের মনুষ্যত্ত্বকে আমরা সম্মান করিতে পারি
না।
তৃতীয়। ইংলণ্ডের সভ্যতার তৃতীয় উপকরণ স্ত্রীজাতির প্রতি সম্মান
ও তাহাদের শিক্ষা। যে জাতিতে স্ত্রী জাতির প্রতি সম্মান নাই এবং
তাহাদিগকে যথোপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া হইতেছে না, সে জাতিকে ইংরাজেরা
সভ্য বলিতে একেবারেই প্রস্তুত নয়। যদি কেহ জিজ্ঞাসা করেন যে ইংরাজেরা
ভারতবাসীদিগকে সাধারণতঃ এত ঘৃনার চক্ষে কেন দেখেন? তাহার উত্তর
এই যে, ভারতবর্ষে স্ত্রীজাতির প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন
করা হয় না। ভারতবাসীদের প্রতি ইংরাজের যে এই ভাব, তাহা ইংলণ্ডে
না গেলে সম্যকরূপ অনুভব করা যায় না। ইংলণ্ডবাসীরা ভারতবাসীদের
সম্বন্ধে যদি কিছু জানে, তাহা স্ত্রীজাতির দুর্দ্দশা। সেখানে আবাল
বৃদ্ধ বনিতা সকলের মনেই এই সংস্কার দৃঢ়বদ্ধ। সেখানে যদি কোন অশিক্ষিত
কৃষককেও জিজ্ঞাসা করা যায়,-"তুমি ভারতবর্ষ সম্বন্ধে কি জান?"
সে নিশ্চয়ই বলিবে, "ভারতবর্ষ এমন এক দেশ যেখানে স্ত্রীলোকের
প্রতি মহা উৎপীড়ন হইয়া থাকে।" দিবাবসানে কোন গৃহস্থ ইংরাজ
দিবসের কার্য্য শেষ করিয়া যখন গৃহে প্রত্যাগমন করে এবং আপনার স্ত্রী
পুত্র লইয়া অগ্নিকুণ্ডের সমক্ষে বসিয়া নানারূপ উপাখ্যান দ্বারা
শ্রম নিবারণ করিতে প্রবৃত্ত হয়, তখন যদি কোন এক ভারতবাসী লুক্কায়িত
ভাবে থাকিয়া তাহাদের কথোপকথন শ্রবণ করেন, তবে হয় ত শুনিবেন, কোন
ভারতবর্ষীরা দুঃখিনী বিধবার দুঃখ কাহিনী বর্ণিত হইতেছে-কি প্রকারে
সে অনাথা হইয়া আত্মীয়গণের অশেষ উৎপীড়ন সহ্য করিয়া থাকে, অথবা কি
প্রকার স্বামীর মৃত দেহের সহিত আপনার জীবন্তদেহ ভস্মসাৎ করে। ইংলণ্ডে
অনেকে মনে করেন যে এখনও ভারতবর্ষে সতীদাহ প্রথা প্রচলিত আছে। ইংলণ্ডে
যে স্ত্রীজাতির প্রতি বহুল সম্মান প্রদর্শিত হইয়া থাকে, সে বিষয়ের
অধিক বর্ণনা বাহুল্য মাত্র। আমাদের দেশে এমন শুভদিন কবে আসিবে,
যে আমরা স্ত্রী জাতির যথার্থ সম্মান রক্ষা করিতে শিক্ষা করিব!
কবে তাহাদিগকে জ্ঞান ধর্ম্মে বিভূষিত করিয়া আমাদের দেশের মুখোজ্জল
করিব! ঈশ্বর করুন আমাদের দেশে ত্বরায় সেই শুভদিন আগমন করুক; এবং
আমরা জগতের সমক্ষে সুসভ্যজাতি বলিয়া পরিচিত হই।
(
‘দাসী’ পত্রিকা, ৪র্থ ভাগ ৪র্থ সংখ্যা, এপ্রিল ১৮৯৫ )
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।