প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

আমার বাল্যজীবন

সরলা দেবী চৌধুরানী

         [ লেখক পরিচিতি : মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের একাদশ সন্তান স্বর্ণকুমারী দেবীর দ্বিতীয় কন্যা সরলা দেবীর জন্ম ১৮৭২ খৃষ্টাব্দের ৯ই সেপ্টেম্বর। বাবা বাঙ্গলার কংগ্রেস সেক্রেটারি জানকিনাথ ঘোষাল। সরলা দেবীর শিক্ষারম্ভ বেথুন স্কুলে। বেথুন কলেজ থেকেই তিনি এফ.এ এবং পরে সেখান থেকেই ১৮৯০ সালে ইংরাজিতে অনার্স নিয়ে বি.এ পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে তিনি ‘পদ্মাবতী স্বর্ণপদক' লাভ করেন; তিনিই এই মেডেলের প্রথম প্রাপক। তিনি ফরাসি এবং পার্শি ভাষা নিয়েও পড়াশোনা করেছিলেন এবং পরে সংস্কৃত নিয়ে এম.এ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হলেও শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দেওয়া হয় নি। স্কুলে তার সহপাঠিনী ছিলেন কবি কামিনী রায় ( পূর্বে কামিনী সেন ) এবং লেডি অবলা বসু। বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান লাভের বাসনায় তিনি বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে মনস্থ করেন। স্কুলে বিজ্ঞান কিছুটা পড়েছিলেন কিন্তু সেকালে মেয়েদের বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ ছিল না। অবশেষে তিনি মহেন্দ্রলাল সরকারের প্রতিষ্ঠিত কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স অ্যাসোসিয়েসনে তার দুই দাদার সঙ্গে ( জ্যোৎস্নানাথ ও সুধীন্দ্রনাথ ) বিজ্ঞানের ক্লাসে বসে থাকতেন। তবে বিজ্ঞান শেষ পর্যন্ত তাকে টেনে রাখতে পারে নি। সঙ্গীতে তার ছিল সহজাত প্রতিভা। রবীন্দ্রনাথের কযেকটি গানের স্বরলিপিও তিনি তৈরী করেছেন। পাশ্চাত্য রীতির অনুসরণ করে ‘সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে’ গানটিকে পিয়ানোতে বাজানোর অনুকূল করে তোলেন। হাফেজের একটি কবিতায় সুর সংযোগ করে মহর্ষিকে শোনানোয় তিনি অত্যন্ত খুশি হয়ে সরলা দেবীকে এক হাজার টাকার হীরে বসান নেকলেস উপহার দেন। নানা জায়গা থেকে তিনি গানের সুর সংগ্রহ করতেন। তার সুরে কথা বসিয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে', ‘চিরবন্ধু চিরনির্ভর', ‘এ কি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ ' ইত্যাদি গানগুলি রচনা করেন। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে ‘বন্দেমাতরম' গানের সুর তিনিই প্রথমে দিয়েছিলেন। শোনা যায় ‘সপ্ত কোটির'বদলে ‘ত্রিংশ কোটি' বসিয়ে গানটিকে তিনি সর্ব ভারতীয় রূপ দেবার চেষ্টা করেন। তার বিখ্যাত দেশাত্মবোধক গান 'নমো হিন্দুস্থান' ১৯০১ সালে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে গাওয়া হয়। গানটি তিন চার দশক আগে রেডিওতে বাজান হত ;আধুনিক গান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ঢেউএ এ ধরণের গান এখন অনেকাংশে বিস্মৃতির অন্তরালে চলে গেছে। সরলা দেবী কিছুকাল মহীশূরে মহারাণী স্কুলে শিক্ষকতা করেন ,এমন কি মহারাণীর সেক্রেটারির কাজও করেছেন।

      ১৯০৪ সালে তিনি ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার'নামে একটি স্বদেশী দোকান খোলেন। মূলতঃ হাতে বোনা পোষাকের ব্যবহার জনপ্রিয় করতেই তার এই প্রয়াস। স্বদেশী জিনিস যোগাড় করে বম্বে কংগ্রেসে পাঠানোর উদ্যমকে স্বীকৃতি দিয়ে তকে একটি স্বর্ণপদক প্রদান করা হয।

       সেকালের প্রচলিত রীতি ভেঙে সরলা দেবী প্রায় তেত্রিশ বছর বয়স অবধি অবিবাহিত ছিলেন। এক সময়ে মা স্বর্ণকুমারী চেয়েছিলেন মেয়ে আজীবন অবিবাহিত থেকে দেশের কাজ করুক। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি ১৯০৫ (?) সালে পাঞ্জাবের বিপ্লবী নেতা রামভজ দত্ত চৌধুরীকে বিয়ে করেন। স্বামী রামভজ অত্যন্ত তেজস্বী ছিলেন এবং ‘হিন্দুস্থান' নামে একটি উর্দু পত্রিকা প্রকাশ করতেন। নানা জ্বালাময়ী রচনা প্রকাশ করে তিনি শাসকদের রোষে পড়ে গ্রেপ্তার বরণ করেন। তবে এ নিয়ে দ্বিমত আছে ; অনেকের মতে তিনি শেষ অবধি গ্রেপ্তার এড়াতে পেরেছিলেন। সরলা দেবী এই সময়ে পত্রিকাটি প্রকাশনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং এর ইংরাজি অনুবাদও প্রকাশ করেন। ১৯২৩ খৃষ্টাব্দের ৬ই আগষ্ট মুসৌরীতে স্বামী রামভজের মৃত্যুতে সরলা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন এবং পাঞ্জাব থেকে ফিরে এসে ‘ভারতী’ সম্পাদনা ও অন্যান্য কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করেন। ১৯৩০ সালে তিনি কলকাতায় ‘ভারত স্ত্রী শিক্ষা সদন'নামে মেয়েদের একটি স্কুল খোলেন। কিছুদিন তিনি দিদি হিরণ্ময়ী দেবীর সঙ্গে ‘ভারতী'পত্রিকা সম্পাদনাও করেছেন। তার একমাত্র পুত্র দীপক দত্তর বিয়ে হয় মহাত্মা গান্ধির এক নাতনি রাধার সঙ্গে। প্রথমে বিপ্লবী চিন্তা দ্বারা চালিত হলেও পরে তিনি মহাত্মা গান্ধির অহিংসা নীতি ও অসহযোগ আন্দোলনের দ্বারা আকৃষ্ট হন। ভারতী সম্পাদনার সূত্রে তিনি স্বামী বিবেকানদ ও ভগিনী নিবেদিতার সংস্পর্শে আসেন। স্বামীজী সরলার গুণের অত্যন্ত প্রশংসা করতেন এবং বলতেন তিনি ‘নারীকুলের রত্ন'। নিবেদিতা তাকে বিদেশে গিয়ে প্রাচ্যের আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা প্রচার করতে বলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা আর হয়ে ওঠে নি। সরলার মূলমন্ত্র ছিল দেশপ্রেম। সমস্ত জীবন তিনি কঠোর পরিশ্রম করেছেন এবং অল্প বয়সের অনেক ছেলেমেয়েকে দেশাত্মবোধে অনুপ্রাণিত করেছেন। সাহিত্য রচনাতেও তিনি যথেষ্ট প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। মাত্র বার বছর বয়সে একটা কবিতা লিখে ‘সখা’ পত্রিকা থেকে একটি পুরস্কার পেযেছিলেন। পরে ‘সখা’ ,‘বালক’ ,‘ভারতী’ প্রভৃতি পত্রিকায় তার অনেক লেখা প্রকাশিত হযেছে। সরলা দেবী রচিত ‘জীবনের ঝরাপাতা’ একটি অত্যন্ত সুখপাঠ্য গ্রন্থ।

       শেষ জীবনে সরলা দেবী বিজয়কৃষ্ণ দেবশর্ম্মা নামে হাওড়া নিবাসী এক সাধককে গুরুপদে বরণ করেছিলেন। তিনি নিয়মিত সেখানে যাতায়াত করতেন এবং আশ্রমে অনুষ্ঠিত আধ্যাত্মিক ক্রিয়াকর্মে অংশ গ্রহণ করতেন। তার মৃত্যুর কিছু পরেই গুরুদেবও দেহরক্ষা করেন। ১৯৪৫ খৃষ্টাব্দের ১৮ই আগষ্ট ৭২ বছর বয়সে অসাধারণ তেজস্বী দেশপ্রেমিক ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মহিলা লোকান্তরিত হন।]

দীপক সেনগুপ্ত

 

        আমার সব প্রথম যে নিজেকে মনে পড়ে সে তিনবছরের আমি। সে সময়কার দুইটি ঘটনা মনে মুদ্রিত আছে। দাসীরা একটি দুরন্ত শিশুকে ঘরের মধ্যে স্নান করাইতেছে। বালিকার সাবানপিচ্ছিল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যত তাহারা মর্দ্দন বা ঘর্ষণের দ্বারা ধরিয়া রাখিতে চেষ্টা করিতেছে, তত সেই অধরা বালিকা তাহাদের হাত ছাড়াইয়া পালাইয়া, - তাহার অঙ্গধৌত সফেন জলের গতি আনুসরণ করিবার জন্য গৃহের নর্দ্দমার দিকে ছুটিতেছে। ফেণিল জল গড়াইয়া গড়াইয়া পড়িতেছে কেমন এক কৌতুকরাজ্যে। নর্দ্দমার সামনেটিতে মেঝের উপর উপুর হইয়া শুইয়া, তাহার বৃহৎ ছিদ্রের ভিতর দিয়া দেখিলে কেমন মজা দেখা যায়। রুদ্ধ দ্বারের অন্ধকারের পর সেখানে হঠাৎ কত আলো। আরও একটি কেমন আশ্চর্য্য জিনিষ সেখান হইতে দেখিবার রহিয়াছে। ঠিক সেই সময় তারই মত আর একটি শিশুর স্নানক্রিয়া চলিতেছে। একটা মেম তার বাড়ীর উঠানে একটা মোড়ার উপর বসিয়া একটা সাদা ধবধবে ছেলেকে টবের জলে চুবাইয়া চটকাইতেছে, - ছেলেটা তারস্বরে চেঁচাইতেছে। পয়ঃপ্রণালীর অন্তরালবর্ত্তিনী দর্শক্স্থানীয় অতি ক্ষুদ্র মানবিকাটির ঐ দিব্যি সাদা ছেলেটার আপত্তিসূচক ক্রন্দন ও চীৎকারই সবচেয়ে আমোদজনক লাগিত। তার তিন বছরের সুদীর্ঘ জীবনের বিজ্ঞতায় বুঝি মনে হইত – “কি ছেলেমানুষ! আমি ত কাঁদি না !”

        নিজের সম্বন্ধে সব প্রথম স্মৃতি আমার ঐ কৌতুকময়ী। তিন বৎসর বয়সের আর একটি মাত্র ঘটনা মনে আছে। শেয়ালদহ স্টেসনের লাইনে কখানা খালি রেলগাড়ী পড়িয়া থাকিত। বিকাল বেলা হাওয়া খাওয়াইবার জন্য লইয়া গিয়া কোন এক দিন চাকররা আমাদের কয় ভাই বোনকে সেই গাড়ীতে চড়াইয়া দিত। একদিন তাহাতে বসাইয়া হঠাৎ তাহারা গাড়ী টানিতে লাগিল – সেদিন অকস্মাৎ চলন্ত রেলগাড়ীর গতিতে বিস্ময় আনন্দ ভয় ও আগ্রহমিশ্রিত একটা তীব্রভাবের প্রথম নবীন তরঙ্গ শিশুবক্ষে রেখা খেলিয়া গেল।

         যখন আমার বয়স পাঁচ ছয় বৎসর, আমার পিতার বিলাতগমন উপলক্ষ্যে, আমরা মাতুলালয়ে ছয় নম্বর যোড়াসাঁকোর বাটীতে দীর্ঘকালের জন্য বাস করি। আমার মামা ও মাসিদের ছেলেপিলে গণিয়া আমরা অনেক ভাই বোন। বয়সের ভিন্নতা অনুসারে আমাদের আমাদের বয়স্যদলের ভিন্ন ভিন্ন থাক ছিল। খুব উঁচু থাকগুলির সবিশেষ খবর রাখি না, কিন্তু আমার দিদি শ্রীমতী হিরণ্ময়ীর বয়স্যদলটি ঠিক আমারই উপরের থাকে ছিল। আর আমার দাদা – শ্রীয়ুক্ত জোৎস্নানাথের দলটি যদিও ছেলের দল, কিন্তু আমাদের সঙ্গেই তাদের সখ্য বেশী, তাহা প্রায় আমাদেরই দলের আর একটি শাখা ছিল। দিদিদের দল আমাদের উপর মুরুব্বিয়ানা করিতেন, কিন্তু দাদাদের দলের সঙ্গে আমাদের চুলোচুলি কিলোকিলির অদলবদল প্রায়ই হইত।

       দলগুলি প্রায়ই তিন তিনজনে গঠিত ছিল। আমার দলের আমি সবচেয়ে কণিষ্ঠা, সুতরাং অন্দভাবে পরিছালিত ছিলাম। আমাদের দলের যিনি মেজো ছিলেন তাঁকে আমি বড় ভালবাসিতাম, আর যিনি বড় ছিলেন তাঁকে ভয় করিতাম। তিনিই আমাদের পাণ্ডা। তাঁর দাসীদের মহলে ভারি গতিবিধি ছিল, সেই জন্য অনেক বিষয়ে পণ্ডিতা ছিলেন। প্রতিদিন অনেকটা সময় দাসীদের সঙ্গে যাপন করিয়া আসিয়া, নবনব জ্ঞানে পুরিত হইয়া তিনি আমাদের মধ্যে তাহা বিতরণ করিতেন। আর শুধু দাসীদের কাছে কেন? খুব বড় ভাইদের দল খুব বড় বোনদের দল – কথায় কথায় যে তিনি না ঘুরিতেন জানি না, সর্ব্বত্রই তাঁর অবারিত গতি ছিল, সুতরাং তাহার জ্ঞানসঞ্চয়ের আকার বহু ছিল। অশেষ বিষয়ে তিনি আমাদের নেত্রী ও শিক্ষাদাত্রী ছিলেন।

        তাঁদের মহলে একটি ছোট কুঠুরি ছিল। কোন কোন দিন আমরা তিনটিতে সেইখানে মধ্যাহ্ণ যাপন করিতে যাইতাম। সেই কুঠুরীর তিন দিককার জানলা অর্গলবদ্ধ থাকিত, একদিকে শুধু একটি ক্ষুদ্র গবাক্ষ খুলিয়া রাখা হইত। সেদিকটা গোলাবাড়ীর দিক; গবাক্ষের নীচে অনেকখানি খোলা জমি, উপরে খোলা আকাশ।

         তিন সখিতে এক দৌড়ে সেই ঘরে আসিয়া, তাড়াতাড়ি কবাট বন্ধ করিয়া – কবাট বন্ধ করার কারণ, পাছে দিদিদের দল বা দাদাদের দল আমাদের বেদখল করিতে আসে – মেঝেয় পাতা ছোট বিছানার উপর যে-যার নিরূপিত স্থানে ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া শুইয়া পড়িয়া একটু হাঁফ ছাড়িয়া আসিলে, পণ্ডিতা-দিদি তাঁহার জ্ঞানের ভাণ্ডার উন্মুক্ত করিতেন। সে কতদিন কত অমুল্য তত্ত্ব ! আমরা ছোট দুজনে ভক্তিভরে সবিস্ময়ে তাঁর সব কথা উৎকর্ণে শুনিতাম।
একদিন তিনি বলিলেন – “মরবার আগে কি হয় জানিস?” আমরা বলিলাম – “ না ভাই ”।

         তখন মরণ কি তাই জানিতাম না। আমাদের জ্ঞাতসারে কারও মৃত্যু কখনও সে বাড়ীতে হয় নাই।
       তিনি বলিলেন –“মরবার একটু আগে আকাশ থেকে দুজন যমদুত নেবে আসে। তারা দেখতে ভয়ঙ্কর, শরীর প্রকাণ্ড, রঙ ঘর কালো, গালপাট্টা দাড়ী। তারা জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকে যে মরবে তাকে উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়”।
আমাদের গা ছম ছম করিতে লাগিল। আমরা শ্রোত্রী দুটিতে সভয়ে আমাদের ছোট ঘরের একটিমাত্র খোলা জানালার দিকে তাকালাম। দেখিলাম জানালা অতি ক্ষুদ্র, তার ভিতর দিয়া প্রকাণ্ড শরীর যমদূতের ঢুকিবার সম্ভাবনা নাই। কিছু আশ্বস্ত, তবুও অনেকটা ভীতভাবে আমার পাশের দিদির অনেকটা গা ঘেঁষিয়া সরিয়া আমি বলিলাম –“এ রকম ছোট জানালা দিয়ে ত যমদূত ঢুকতে পারবে না ?”

         আমাদের তত্ত্ববিদ্যাদায়িনী বলিলেন –“তা কেন পারবে না ? যমদূতেরা ইচ্ছে করলেই বড় শরীরকে ছোট ক’রে যেখান সেখান দিয়ে যে সে ঘরে ঢুকতে পারে। যখন ইচ্ছে যাকে তাকে নিয়ে যেতে পারে ”।

         একটা নিরূপায় অসহয়তার ভাবে আচ্ছন্ন রইলাম। সেদিন যে তারপর ঠিক কি করিয়া সেই ঘর ছাড়িয়া উঠিয়া গিয়াছিলাম বলিতে পারি না। নড়িতে চড়িতে ভয়, উঠিতে পড়িতে ভয় – জানালার দিকে কেবলই সচকিত চোরা দৃষ্টি – যদি দেখি জানালার ধারে যমদূত আসিয়া পৌঁছিয়াছে! যদি আমরা এ ঘর হইতে বাহির হইতে না হইতে আমাদের চুলের মুঠি ধরিয়া ফেলে!

         একদিন বিকালে আমরা বাড়ীর ভিতরের বাগানে খেলা করিতেছিলাম। হঠাৎ খুব হাওয়া উঠিল। আমাদের আজ্ঞাকারিণী নেত্রী – ইনি এখন ডেপুটিগৃহিণী – আজ্ঞা করিলেন – “গুড়ি গুড়ি চল! গুড়ি গুড়ি চল! এখনই হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে ”।

         আমার মনে মুহূর্ত্তের জন্য অবিশ্বাসের উদয় হইয়াছিল, প্রশ্ন করিবার ইচ্ছা হইয়াছিল কেমন করে জানলে ?” কিন্তু তখন প্রশ্নাত্মক বিদ্রোহের সময় নাই - কি জানি এখনই যদি হাওয়ায় উড়ে যাই! সুতরাং আমরা ছোটদুটি আজ্ঞামাত্র তৎক্ষণাৎ বসিয়া পড়িয়া সারা বাগানটা গুড়ি গুড়ি চলিলাম, খোলা বাগানের সীমা অতিক্রান্ত হইলে সেখানে আর বায়ু চলাচল নাই, সেখানে পৌঁছিয়া আবার খাঁড়া হইয়া দাঁড়াইলাম। তখন ভাবি হাকিমগৃহিণী তাঁর হুকুমের পোষকতায়, হাওয়ায় মানুষ উড়িয়া যাওয়া সম্বন্ধে দাসীদের কাছে শ্রুত নানা সত্যমূলক কাহিনী বলিয়া আমাদের চমৎকৃত করিলেন।
পাপপুণ্য ও তার দণ্ড পুরস্কার সম্বন্ধে তাঁর কাছে নানা তথ্য লাভ করিতাম। পুণ্যের কথা কিছু মনে পড়ে না, কিন্তু কথায় কথায় পাপ করিতাম বোধ হয়, কারণ পাপের দণ্ড-ভয়টা তিনি প্রায়ই দেখাইতেন। তিনি ঈশ্বর হইয়া কতকগুলি নিজস্ব দণ্ডবিধি আবিষ্কার করিয়াছিলেন, যার এক আধটির ভিতর বাস্তবিকই ভারি দক্ষতা ও ভয়ানকতা আছে। কিন্তু তাহা সম্পূর্ণই তাঁহার নিজের, মানবধর্ম্মশাস্ত্রে তাহা লেখে না, যদিও মানবধর্ম্মের প্রতি তাহা অতিশয় সূক্ষ্মদৃষ্টিসম্পন্ন।
তিনি বলিতেন, কোন পাপ – যেমন বড়দের কথা না শোনা, ঝগড়া করা বা মিথ্যা কথা বলা – একবার আচরিত হইলে তার জন্য ঈশ্বর ভবিষ্যজীবনে প্রথমে স্থূল রকম অল্প শাস্তিবিধান করিয়া রাখিয়াছেন। অল্প শাস্তি – যেমন কিনা, সাধারন শাস্ত্রে সচরাচর যাহা পাওয়া গিয়া থাকে, -নরকের আগুনে পোড়া, নরকের ভুতেদের দ্বারা প্রহারিত হওয়া ইত্যাদি। কিন্তু পাপ যত বেশী করিতে থাকিবে, শাস্তির মাত্রা তত বাড়িতে থাকিবে। পাপের চূড়ান্ত শাস্তির কথা তিনি আমাদের কাছে যা ব্যাখ্যা করিতেন সেইটিই তাঁর স্বকীয় বিশেষ শাস্ত্রের ব্যবস্থা। তিনি শাসাইয়া বলিতেন, -“খুব যদি পাপ করিস তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শাস্তি এই যে ব্রহ্মাণ্ডসুদ্ধু সবাই মরে যাবে, তুই একা বেঁচে থাকবি ”। এই কথা বলিয়া আমাদের সবে-মাত্র সংসারে আসা কচি মনে একটা ভয়ানক শূণ্যতাময় উদাস কল্পরাজ্যের সৃষ্টি করিয়া দিতেন।
আমি এক দিন, তাঁর কথা মনে করিয়া, তেতালার ছাদে উঠিয়া দিগন্তরেখার চারিদিকে চাহিয়া চাহিয়া সেই চরম শাস্তির দিন কল্পনায় দেখিতাম। যেন কেহ কোথাও নাই, আকাশে পাখী নাই, চিল নাই, বাহিরের তেতালায় বড়মামা নাই; বাড়ী-ভিতরের তেতালায় সেজ-মামীরা নাই, সেখানে আমার দিদি দাদা নাই, মঙ্গলা দাসী নাই, রাজি দাই নাই; - বাড়ীর কোথাও কেহ নাই – নীচের অন্ধকার ঘরগুলার কোনো কোণেও কেহ লুকাইয়া বাঁচিয়া নাই, ইঁদুরও নাই, একটা পিঁপড়াও নাই; সামনে যে খোট্টাদের বাড়ী দেখা যায় তাদের ওখানেও কেহ নাই; - ব্রহ্মাণ্ড শূন্য, আমি একা রহিয়াছি।
কি আশ্চর্য্য আমার একেবারে নিঃসঙ্গ মনে হইল না। আকাশ যেন সঙ্গী রহিয়াছে, আলো যেন সঙ্গী রহিয়াছে; আর থাকিয়া থাকিয়া মনে মনে একটা অনুভব হইতে লাগিল আমার যিনি শান্তি-বিধাতা ঈশ্বর তিনিও যে কন এক জায়গায় রহিয়াছেন, আকাশে সিঁড়ি লাগাইলেই যেন তাঁকাছে পৌঁছান যাইবে। কিন্তু সে জন্য কম আগ্রহ আনুভব করিলাম না, শাস্তি দাতার প্রতি কিছুই হৃদ্যতা বধ হয় নাই; তিনি আছেন ত আছেন! অথচ তন্মুহূর্ত্তের জন্য একটা এই উপলব্ধি হইয়াছিল তিনি আর আমি কি এক ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ। শুধু আমার সত্তা আছে। আর তাঁর সত্তা আছে, ব্রহ্মাণ্ডে আর কিছুই নাই। ইহাতে তাঁর উপর রাগও হইয়াছিল, কেমন একটা একাত্মবোধও হইয়াছিল।

            ঈশ্বর কিরাতবেশে অর্জ্জুনের পথরোধ করিয়াছিলেন। অর্জ্জুন তাঁর স্বরূপ না জানিয়া তাঁকে স্পর্দ্ধা করিয়া তাঁর উপর বিজয়ী হইয়াছিলেন। আমি ভাবি, অর্জ্জুন যদি প্রথমেই জানিতে পারিতেন তাঁর পথরোধক কে, তবে কি করিতেন ? কবি কি তাঁহার হস্তকে অপটু করিয়া ফেলিতেন, না তাঁহাকে বেশী বল দিতেন ?

            ছয় বৎসর আগে ব্রহ্মাণ্ডে একা অজ্ঞ আমি, শত্রুরূপী ব্রহ্মাণ্ড-পতির সম্মুখীন হইয়া তাঁহা হইতে ভীত হইলাম না, তাঁহার শরণাগতও হইলাম না। তাঁর তথাশ্রুত কঠোরতম বিধানকে ফাঁকি দিবার ফন্দীই আমার আনুদ্ভিন্ন মস্তিষ্কে ঘুরিতে লাগিল। তাঁর পয়গম্বরস্বরূপিনীকে আমি এক দিন বলিলাম –“আমি কেমন করে একা বাঁচব ? কি খেয়ে থাকব ? আর কেউ যদি না বেঁচে থাকে আমাকে খাওয়াবে কে ? তাহলে ত আমিও মরে যাব ”। - ভাবটা ঈশ্বর ত তবে নিজের ফাঁদে নিজে ধরা পড়িবেন! কিন্তু আমার সেই দিদিটির মুখে দ্যুলোক ভূলোকের অধিষ্ঠাতা, সর্ব্বজীবের আগোচর, আমার ন্যায় পাপীর প্রতি দয়ালেশহীন বিধাতা বলিলেন –“ তা হবে না। খাবার জিনিসপত্তর সব থাকবে। তোকে রোজ নিজে রেঁধে বেড়ে খেতেই হবে। বাঁচতেই হবে ”।

            কি নিষ্ঠুর বিধান !

            ভাবিতে ভাবিতে আর এক দিন আর একটা ফাঁকির পন্থা মনে মনে উদ্ভব করিলাম। স্বপ্রণীত উদ্ভিজ্জ শাস্ত্রে বিদুষী উক্ত দিদিরই কাছে শিক্ষালাভ করিয়াছিলাম গোলাপজামের বীচি বিষে ভরা, খাইতে নাই, খেলেই লোকে মরিয়া যায়। আমি তাঁর কাছে গিয়া বলিলাম –“ঈশ্বর যদি ব্রহ্মাণ্ডের সবাইকে মেরে ফেলে আমাকে একলা বাঁচিয়ে রেখে শাস্তি দেন, আমি সেদিন গোলাপজামের বীচি খাব, তা হলে ত আমিও মরে যাব ”। আমাদের ভয়ঙ্করী গুরু-ঠাকুরাণী ক্ষণমাত্র দ্বিধা না করয়াই উত্তর দিলেন –“সে দিন গোলাপজামের বীচিতে আর বিষ থাকবে না। তুই কিছুতেই মরতে পারবিনে ”।
আমার উপায়কুশলতা সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত মানিল। এমন অমোঘতার সঙ্গে কে লড়িতে পারে ?
বিবেকানন্দ স্বামী একবার বলিতেছিলেন – “আমাদের দেশে শৈশব হইতে শিশুকে ভয়ের দ্বারা ও ঈশ্বর নামক এক কল্পনার প্রতি নির্ভরপরায়ণতায় ঘিরিয়া দেওয়া হয়, তাহাতে ভারি ক্ষতি হয়। ইহার প্রতিবিধানেচ্ছু হইয়া বেদান্তবাদী একটি শ্বেতদম্পতি আলমোরায় বেদান্তাশ্রম খুলিয়া সেখানে হিন্দু শিশুদের বেদান্তসঙ্গত আত্মনির্ভরের ভাবে মানুষ করিতে চেষ্টা করিতেছিলেন ”।

            বিবেকানন্দের অভিযোগ শুনিয়া আমার নিজের শৈশবের ঘটনা মনে পাড়িয়াছিল, মানিয়াছিলাম সত্যই আমাদের কেবলই ভয়সমাকুল করিয়া রাখা হয়।

            কিন্তু সেই অতি শৈশবে যে দিন ছাদের উপর উঠিয়া প্রাণীশূন্য বিশ্বকে দেখিয়া আমি নির্ভীক ছিলাম, সেদিন আমার মন শিশুর কলকণ্ঠে গাহিয়া উঠিয়াছিল –
                   “ শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থুঃ
               বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তং
               দর্শম নু বিশ্বদর্শতম !”

           সেদিন আমার মনের সেই স্বাবলম্বন কথা হইতে আসিল তাই ভাবি। বোধ হয় তাহা সহজাত হইবে, শিক্ষালব্ধ নয়।

          রামচন্দ্রের দৈবী প্সত্রের ন্যায়, এই সহজ স্বাবলম্বন প্রয়োজনের সময় স্মরণমাত্র আজীবন আমার সহায়তা করিয়াছে। ইহা মহদ্ভয়ে অভয়, শকে সান্ত্বনা, দৈন্যে অভ্যুদয়, তাপে তাপহরণরূপে আমার সেবা করিয়াছে। যখনি লতার মত লুটাইয়া পড়িয়াছি, দলিত ধ্বস্ত হইবার সম্ভাবনায় নিপতিত হইয়াছি, তখনি আবির্ভূত হইয়া আমায় তুলিয়াছে, জড়াইয়াছে, রক্ষা করিয়াছে। সংসারের ঘাতপ্রতিঘাতে চিত্ত যতই কেন বিক্ষুব্ধ হঊক না, কেমন করিয়া অচিরে ধ্যানস্থ যোগযুক্ত করিয়া সকল ক্ষোভের প্রশান্তি করিয়া দিয়াছে। আমার এই ঐশ্বরী দানের অংশ যদি আমার দেশের সকল বালকবালিকার মধ্যে বণ্টন করিতে পারিতাম, কৃতার্থ হইতাম।

         আমাদের পরিবারে শিশুরা সর্ব্বদাই ঈশ্বরের নাম লইয়া নাড়াচাড়া করিত। সর্ব্বদাই যে ভীতিজনকতায় তাঁর সঙ্গে আড়ি করিয়া থাকিতাম তাহা নয়। কখন তাঁহাকে রুদ্রমূর্ত্তিতে দেখিতাম, আবার কখন কখনও তাঁর সঙ্গে বেশ ভাব হইয়া যাইত, তাঁকে অন্তরঙ্গ সখাও মনে হইত।

        শৈশবে স্বকৃত দুটি লজ্জারাঙা আচরণ আমার মনে ছঁআকা দিয়া গিয়াছিল। স্মৃতির গায়ে এখনও তাদের দাগ খুঁজিয়া পাওয়া যায়। আমাদের দলটির মধ্যে যিনি মেজো, তাঁকে আমি ভারি ভালবাসিতাম বলিয়াছি। তিনি আমার প্রায় সমবয়সী ছিলেন – অর্থাৎ দুই এক বৎসরের মাত্র বড়, (দলপতি-দিদিটি বছর চারেকের বড় ছিলেন) এরই সঙ্গে বেশী মিল ছিল। বাহির বাড়ীতে আমাদের পড়ার ঘর ও তাঁদের পড়ার ঘর পাশাপাশি ছিল, বাড়ীর ভিতরেও আমাদের ও তাঁদের মহল কাছাকাছি হিল, তাঁর দাদারা ও আমার দাদা বয়স্য ছিলেন। আমরা অনেক সময় দাসীদের পাহারা এড়াইয়া এ-উহার ঘরে নিজেদের পাথরের রেকাবীভরা জলখাবার লইয়া গিয়া খাইতাম। আমাদের আলুভাজির সহিত উঁহাদের আখের গুড়ের সম্মিলন হইলেই তবে রসনা বেশী তৃপ্তিলাভ করিত।

        ভোর হইতে না হইতে সব ভাইবোনেরা মিলিয়া ও-বাড়ীর বাগানে শিউলিফুল তুলিতে যাইতে হইবে। তাই যে যে-দিন আগে উঠিত সে অপরকে জাগাইয়া দিত। আমি একদিন আগে উঠিয়া উহাদের তুলিতে গেলাম। লম্বা দুই তক্তপষে উঁহারা ছারিটি ভাইবোনে শুইয়া আছেন, মধ্যে মধ্যে একজন দাসী আছে। তখনও ঘর অন্ধকার, সকলে নিদ্রিত। আমি মশারি খুলিয়া, বিছানায় ঢুকিয়া আন্দাজে আন্দাজে দিদির দিকটায় গেলাম। মনে মনে মৎলব করিয়া আসিয়াছিলাম, দিদি যদি ঘুমাইয়া থাকেন, তাঁর গালে চুপি চুপি একটি চুমু খাইয়া তাঁকে জাগাইয়া দিব। অন্ধকারে হাতড়াইয়া হাতড়াইয়া দিদিকে যখন পাইলাম, তাঁর গালে ধীরে ধীরে ভারি ভালবাসার সঙ্গে একটি চুমু খাইলাম। - “কে গা ! – কে গা ! ” – ক্যাঁক ক্যাঁক করিয়া একটি আওয়াজ হইল। ওমা ! আমি করিয়াছি কি ? দিদি ভাবিয়া বুড়ী তিনকড়ি দাসীর কুঞ্চিতচর্ম্ম, বলিত, অপরিস্কৃত গণ্ডে চুমু খাইয়াছি। সকলেই জাগিল, এবং সকলেই আমার এই কুকীর্ত্তি টের পাইয়া হাস্য করিয়া উঠিল। আমি যতটুকু ছিলাম লজ্জায় তার চেয়েও আরও ছোট হইয়া গেলাম। এমন গলদ ! তিনকড়ি দাসীকে চুমু খাওয়া ! সেই লোল শ্লথ মাংসপিণ্ডকে ভালবাসিয়া আদর করা ! বৃদ্ধা অতিশয় কর্কশ প্রকৃতির ছিল, তাকে আমরা শিশুরা কেহই ভালবাসিতাম না। কিন্তু সেদিন এক ক্ষুদ্র বালিকার ভুলকৃত স্নেহব্যবহা্রে তার প্রাণের কোন একটি তন্ত্রীতে বোধ হয় মুহূর্ত্তের জন্য ঘা পড়িল। সে আমাকে কোলে টানিয়া –“ কে ? তুমি ? এস মা এস ” – বলিয়া আদার করিতে গেল। আমি এই আদরের জ্বালায় সকলের বিদ্রূপ ভয়ে আরও অস্থির হইলাম। তার পর সকাল হইতে না হইতে সব দলের মধ্যে রটিয়া গেল আমি আজ ভোরে তিনকড়িকে চুমু খাইয়াছিলাম। দাদাদের দল আমার প্রতি অত্যন্ত ঘৃণা প্রকাশ করিতে লাগিলেন, দিদিদের দল সময় অসময়ে তিনকড়িকে দেখাইয়া আমাকে ঠাট্টা করিতে লাগিলেন। আমি যে অনবধানতাবশতঃ কতবড় দুঃষ্কর্ম্ম করিয়াছি হাড়ে হাড়ে বুঝিতে লাগিলাম। তার পর তিনকড়ি বুড়ীটার যাবজ্জীবন তাকে দেখিলেই আমার সর্ব্বাঙ্গ লজ্জায় ম্রিয়মান হইয়া যাইত।

           আএ একবার একটা গুরুতর অপরাধ করিয়াছিলাম। তখনও মৃত্যুতত্ত্ব ভাল বুঝিতাম না। এই পর্য্যন্ত বুঝিতাম যে কারও বাপ মা মরিয়া যাওয়ার মানে এই যে সে বাপ মার কাছে না থাকিয়া আর কাহারও কাছে থাকে। তাই আমি একদিন আমার প্রিয় সঙ্গিনীকে বলিলাম –“তোমার যদি ভাই বাপ মা মরে যান, আর তুমি আমাদের ঘরে সারাদিন থাক, সে বেশ হয়।

         আমাদের দলপতি-দিদির কর্ণকুহরে আমার এই নির্ব্বোধ মন্তব্যটি যেমন পহুঁছিল, তিনি হুঙ্কারিয়া উঠিলেন –“ কি বলছিস ? দাঁড়া, বলে দিচ্ছি সবাইকে ”।

         তিনি করিলেন কি, তৎক্ষণাৎ গিয়া ঘরে ঘরে সব অভিভাবকদের জানাইয়া আসিলেন। ঘরে ঘরে বড়দের বিচারাসনের তলে আমার তলব পড়িল। সকলে আমাকে গঞ্জনা দিলেন, লজ্জা দিলেন, ভর্ৎসনা করিলেন – এমন কথা মুখে আনে ! – এমন দুষ্টু মেয়ে ! আমি নিতান্ত লজ্জাপীড়িত ও মর্ম্মাহত হইলাম। শিশুর অস্ফুট মনের কাতরতা বড়রা বুঝিতে পারিলেন না। দিদিকে ভারি ভালবাসি, সেই কথাটি প্রকারান্তরে ব্যক্ত করয়াছি মাত্র, তাহাতে অন্যায়টা কোথায় হইয়াছে তাহা ঠিক তলাইতে না পারিলেও যখন ভর্ৎসিত হইতেছি তখন ভয়ানক একটা কিছু অন্যায় যে নিশ্চয়ই করিয়াছি, তাহা বুঝিলাম। সেই পর্য্যন্ত নিজের আসাধুতা ও দীনতা সম্বন্ধে একটা তপ্ত জ্ঞানের অঙ্কুর বালিকার মনে উপ্ত হইয়া রহিল।

[ লেখিকা জানিয়েছেন –“ইহা ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকার কর্ত্তৃপক্ষগণের অনুরোধে প্রথমে লিখিতে আরম্ভ করি। তাহাদের নিরূপিত সময়ের মধ্যে সমাপন করিয়া উঠিতে না পারায়, ‘ভারতী’তে পত্রস্থ করিতেছি ]

 

 (‘ভারতী’ মাসিক পত্রিকা, বৈশাখ ১৩১২ )

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।