এইরূপে সন্ধ্যার অন্ধকারে ক্রমে গাঢ় হইল।
বিধুকর বিধৌত নির্ম্মল গগনে অযুত নক্ষত্র হাসিল। অদূরে দেবালয়
হইতে আরতির শঙ্খঘণ্টাধ্বনি শ্রুত হইল। বালিকা বলিল, "চল
রাত হয়ে এলো, বাড়ী যাই।" উভয়ে গৃহাভিমুখে চলিল। একটি
চৌমাথার উপরে যাইয়া বালক বলিল, "আমি তবে চল্লাম।"
বালিকা -- "এসো না, আমাদের বাড়ী হয়ে যেও।"
বালক -- "না তাহ'লে মাষ্টার মহাশয় এসে বসে থাকবেন। কাল
সকালবেলা আবার যাব।"
এই বলিয়া বালক বিদায় লইল। বালিকাও চৌমাথার অনতিদূরে একটি দ্বিতল
বাড়ীতে প্রবিষ্ট হইল।
২
যোগেন্দ্র বাবু পাটনার একজন ধনী জমিদার। পল্লীগ্রাম
অস্বাস্থ্যকর বলিয়া তিনি বৎসরে অধিকাংশ সময়ই পাটনা শহরের বাড়ীতে
বাস করেন। প্রথমা স্ত্রীর পরলোক গমনের পর ইনি পুনরায় দার পরিগ্রহ
করিয়াছেন। ইহার পূর্ব পক্ষের একমাত্র বালিকা কন্যা প্রভাময়ীর
সহিত, পূর্ব্বে আমাদের সাক্ষাৎ লাভ হইয়াছে। প্রভার সহিত আমাদের
যখন প্রথম দেখা হয় তখন প্রভার বয়স মাত্র ৮ বৎসর।
প্রভার সঙ্গী সেই বালকের নাম বিমল। ভাগীরথীর
তীরে যখন বিমলের সহিত পাঠক-পাঠিকার সাক্ষাৎ হয়, তখন তাহার
ত্রয়োদশ বৎসর বয়ঃক্রম। বিমলের পিতা পরলোকগত দীনেশবাবু, ডেপুটী
ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ভূসম্পত্তিতে প্রায় হাজার বারশ টাকা
বাৎসরিক আয় ছিল। বিমল পাঁচ বৎসর বয়সে পিতৃহীন হয়। অদৃষ্ট চক্রের
আবর্তনে তাহার লক্ষ্মীরূপা মাতৃদেবীও ইহলোক ত্যাগ করেন। বিমল
এই শৈশবেই পিতৃমাতৃহীন হইল।
দীনেশবাবু যখন পাটনায় বদলি হইয়াছিলেন, সেই
সময় শহরের উপর একটা পাকা বাটী ক্রয় করেন। পিতৃস্বসা ও একজন
বৃদ্ধ কর্মচারীর তত্ত্বাবধানে থাকিয়া বিমল পাটনা স্কুলে অধ্যয়ন
করে।
৩
খেলাধূলায় তিন বৎসর কাটিয়া গেল। প্রভার বয়স
এখন একাদশ বৎসর। বিমলের ষোড়শ বৎসর উত্তীর্ণ হইতে চলিল। বয়োবৃদ্ধির
সহিত উভয়ের বালোচিত সরল ভালবাসা ক্রমে গভীর হইতে গভীরতর হইতে
চলিল। সুতরাং ক্রমে উভয়ের দেখাশুনা একপ্রকার বন্ধ হইয়া অসিল।
উভয়ের মনে এখন পরস্পরের জন্য কেমন একরকমের ব্যাকুলতা আসিয়া
উপস্থিত হইল। প্রভার এখন আর সে সরল, মধুর হাসি নাই। সে এখন
মনের ভাব গোপন করিতে শিখিয়াছে। বিমলের এখন আর সে সদানন্দ ভাব
নাই।
প্রভার অদৃষ্ট যোগ বিমাতা তাহার প্রতি বড়
ভাল ব্যবহার করিতেন না। প্রভা যদি এখনও বিমলদের বাড়ী যাইত,
তাহা হইলে বিমাতার অম্ল মধুর বাণীর ভাণ্ডার প্রভার কল্যাণে
কিছু শূন্য হইত। প্রভা সহাস্য মুখে যাইয়া বিমাতার আঁচল ধরিত,
কিন্তু প্রভার দুর্ভাগ্যবশতঃই, বিমাতা ঠাকুরাণীর সেই চির অসন্তুষ্টমুখে
ভুলিয়াও হাসি ফুটত না। প্রভা কিন্তু সুযোগ পাইলেই বিমলদের
বাড়ী যাইয়া উপস্থিত হইত। বিমলও মধ্যে মধ্যে প্রভাদের বাড়ী
আসিত।
যোগেন্দ্রবাবু স্ত্রীশিক্ষার বিশেষ পক্ষপাতী
ছিলেন। আশৈশব কন্যাকে লেখাপড়া শিখাইয়াছেন। প্রভার বিমাতার
ইহাতে সনাতন অসন্তোষের মাত্রাটা কিছু বাড়িয়া গিয়াছিল। কারণ
তিনি সরস্বতীর কৃপায় 'ক' অক্ষর লিখিতে তিনটা কলম ভাঙ্গিতেন।
সুবিধামত তাঁর কল্পনাকুশল মনের সাহায্যে, প্রভাময়ীর নানারূপ
নিন্দার সৃষ্টি করিয়া ফেলিতেন। বিমাতার এরূপ আচরণেও, প্রভা
তাঁহার সহিত কোন দিন বড় করিয়া কথাটা কহে নাই।
যোগেন্দ্রবাবুর ইচ্ছা বিমলের সহিত কন্যার
বিবাহ দেন, কিন্তু প্রভার প্রতি স্নেহ প্রদর্শন করিয়া, বিমল
যোগেন্দ্রবাবুর অশেষ গুণবতী স্ত্রীর কুটিল কটাক্ষে পড়িয়াছিলেন।
ঐ নিমিত্ত যোগেন্দ্রবাবুর মানস সিদ্ধির পক্ষে একটা কঠিন রকমের
কন্টক সৃষ্টি হইল। যোগেন্দ্রবাবু স্ত্রীর নিকট এই অভিপ্রায়
ব্যক্ত করিলে, স্ত্রী বলিলেন, "ও ছেলের যে রকম সকম, তাহাতে
ও যে কালে ভাল হবে, বোধ হয় না, তবে তোমার মেয়েকে তুমি দুঃখী
করিবে, আমি বাধা দিই কেন! তবে যদি আমার মত চাও, আমি বলি এ
বিবাহে ভবিষ্যতে ভাল হইবে না। ঘরে শ্বশুর শাশুড়ী নাই, ইহাওত
দেখিতে হইবে?" স্ত্রীর শেষের যুক্তিটা যোগেন্দ্রবাবুর
মনে বড় ধরিল। তিনি বুঝিতে পারিলেন না, স্বামীর প্রাণভরা ভালবাসা
পাইয়া বা প্রভা সুখী হয়, এইজন্য হিতাকাঙ্ক্ষিনী বিমাতার এত
যুক্তিতর্ক। প্রভার অদৃষ্ট অলক্ষে নিষ্ঠুর হাসি হাসল।
৪
সন্ধ্যা হইয়াছে। পাটনার পার্শ্বদেশ ধৌত করিয়া
পুতসলিলা ভাগীরথী কল কল নাদে ছুটিয়াছে। ভাগীরথীর তীরে অগণিত
সৌধমালা, শহরের শোভা সম্বর্ধনা করিতেছে। ইহারই একটা দ্বিতল
গৃহে ফুল্লকুসুম সদৃশ একটা বালিকা, উন্মুক্ত বাতায়ন পথে, ক্ষুদ্র
তরঙ্গভঙ্গ শোভিত জাহ্নবী বক্ষের প্রতি নির্ণিমেষ নয়নে চাহিয়া
আছে। ঐ ভাগীরথীর শ্রুতি সুখকর। জলকল্লোল কি বালিকার শ্রবণে
প্রবেশ করিতেছিল? বালিকা জাহ্নবীর দিকে চাহিয়া আছে বটে, কিন্তু
সে স্থির ধীর উদাস নেত্রযুগল দেখিলে বোধ হয় না যে, বালিকার
দৃষ্টি কোন বিশেষ পদার্থের উপর পতিত হইয়াছে।
তবে কি বালিকা আকাশের দিকে চাহিয়া আছে। জড় জগৎ পরিত্যাগ করিয়া,
ঐ অপার্থিব দৃষ্টি কি অন্তরীক্ষে বিচরণ করিতেছে? সে দৃষ্টি
কালোচিত নহে, গভীর চিন্তাপূর্ণ।
সহসা প্রকোষ্ঠে কে প্রবেশ করিল। প্রভা দীর্ভনিঃশ্বাস
ত্যাগ করিয়া মুখ ফিরাইল। দেখিল, বিমল আসিয়াছে। সে গম্ভীর মুখখানিতে
একটু হাসি দেখা দিল। বিমল ঈষদ্ধাস্য করিয়া বলিল, "প্রভা
অমন এক মনে কার কথা ভাবছিলে! যার সঙ্গে বিয়ে হবে তার কথা কি?"
প্রভা। "যাও তোমার ত কেবল ঐ কথা।"
বিমল। "তবে অমন করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললে যে?" বিমল
প্রভার বামকপোলে একটি মধুর করাঘাত করিলেন। পাঠক পাঠিকা, তোমরা
কি তাহাকে 'আঘাত' বলিতে চাও!
৫
দিনের পর দিন যাইতে লাগিল। সময় বড় নির্দয়।
এক দণ্ডও বসিয়া থাকিতে পারে না। তাহা যদি পারিত, তবে কত লোকের
সুখের স্বপ্ন এমন সহসা ভাঙ্গিয়া চুরিয়া তাহাদিগের জীবনকে এমন
চির অবসাদময় করিতে পারিত কি?
প্রভার বিবাহের সম্বন্ধ স্থির হইল। হরিদাসপুরের
জমিদার প্রতুল রায়ের পুত্র কিরণচন্দ্রের সহিত বিবাহ হইবে নির্ধারিত
হইল।
বিমল শুনিলেন, বরের নাকি অশেষ গুণ। বিদ্যায় দিগগজ। মদিরাদেবীর
প্রিয় শিষ্য। ভাবিলেন, "প্রভা আমার হইল না ইহাতেও তত
কষ্ট পাইতাম না, কিন্তু প্রভা এমন পশুর হাতে পড়িল, ইহা সহ্য
হয় না। বিধাতা প্রভার কপালে এত দুঃখ লিখিয়াছিলেন।"
প্রচুর সম্পত্তিলোভে যোগেন্দ্রবাবু প্রভাকে এমন অকূল পাথারে
ভাসাইবেন, তাহা বিমল কোন দিন স্বপ্নেও ভাবিয়াছিল না।
বিমল সমস্ত জগৎ অন্ধকার দেখিতে লাগিল।
৬
একদিন অপরাহ্নে প্রভা নিজের প্রকোষ্ঠে একাকী
পালঙ্কের উপর বসিয়া একখানি চিঠি লিখিতেছিলেন দুই তিনখানি ছিঁড়িয়া
অবশেষে একখানিতে লিখিল। "বিমল তুমি বলিয়া গিয়াছিলে আজ
আসিবে, কৈ কতক্ষণ যে গেল।" এমন সময় বিমল পা টিপিয়া টিপিয়া
সেই প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিয়া প্রভার পশ্চাতে আসিয়া দাঁড়াইল।
বোধ হয় সামান্য পদশব্দ হইয়াছিল। প্রভা পশ্চাদ্দিকে দৃষ্টিপাত
করিল। বিমলকে দেখিয়া অমনি লজ্জায় সঙ্কুচিত হইয়া চিঠির কাগজখানি
বস্ত্রান্তরালে লুকাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। সেই বিষাদ গম্ভীর মুখে
হাসি ফুটিল। কিন্তু উভয়েই নীরব। বিমল ভাবিলেন প্রভা এখনও তেমনই
হাসিতেছে। তবে কি অভাগিনী এখনও বিবাহের কথা জানিতে পারে নাই।
নীরবতা ভঙ্গ করিয়া বিমল বলিলেন, "প্রভা,
তুমি চিঠিতে যাহা লিখিতেছিলে তাহা কিন্তু আমি দেখিয়াছি। তুমি
কি এখনও কিছু শুনিতে পাও নাই?" প্রভা যেন আকাশ হইতে পড়িল।
সে হাসি অধরের প্রান্তে মিলাইয়া গেল। ভীত কম্পিত স্বরে প্রভা
বলিল, "কৈ শুনি নাই শীঘ্র খুলিয়া বল, আমার প্রাণ কেমন
করিতেছে।" বিমল তাহাকে সে বিষম সংবাদ দিলো। প্রভার সকল
শরীর কাঁপিতে লাগিল। চতুর্দিক যেন অন্ধকার হইয়া আসিল। কাষ্ঠ
পুত্তলিকার মত বিমলের দিকে চাহিয়া রহিল। বিমল অদৃষ্টের দোহাই
দিয়া প্রভাকে অনেক বুঝাইলেন। সংসারে যে দুঃখ সহিতে পারে সেই
সুখী তাহাও বলিলেন। কিন্তু তাঁহারও গণ্ডদেশ হইতে একবিন্দু
অশ্রু গড়াইয়া পড়িল। প্রভা আর কি থাকিতে পারে? দুই হাতে মুখ
চাপিয়া অশ্রু বিসর্জন করিতে লাগিল। তাহার কোমল হৃদয়ে আজ যে
ক্ষত হইয়াছে তাহা আরোগ্য করিবার ক্ষমতা এ সংসারে কাহারও নাই।
সে ক্ষত তাহার জীবনের সঙ্গী।
ক্রমে সন্ধ্যা হইয়া আসিল। বিমল অনেক কষ্টে প্রভার নিকট বিদায়
লইয়া বাড়ী আসিলেন।
৭
ইহার পর কাল প্রবাহের অবিরাম গতিতে দুই বৎসর
অতীতের অতল সিন্ধুতে বিলীন হইয়া গিয়াছে। প্রভা আজ বিবাহিতা।
প্রভা সেই যে বিবাহের তিন মাস পরে শ্বশুরালয়ে গিয়াছে তাহার
পরে পিত্রালয় দর্শন তাহার ভাগ্যে ঘটিয়া উঠে নাই। কারণ শ্বশ্রুদেবী
ছাড়িয়া দিতে বড় নারাজ, কারণও আছে। পুত্রবধূ নিকটে না থাকিলে
তাঁহার গালিগালাজপ্রিয়তা অথবা প্রভুত্বপ্রিয়তা মাঠে মারা যায়।
যাহা হউক প্রভা প্রায় দুই বৎসর হইল পিত্রালয়ে
যায় নাই। পাঠিকা, প্রভা এখন আর সে প্রভা নেই। দিনরাত্রি ভাবিতে
ভাবিতে প্রভার সোনার শরীর কালি হইয়া গিয়াছে। সে ভাসা ভাসা
চোখ দুইটি কোটরগত হইয়াছে। তাহাতে আবার স্বামী উচ্ছৃঙ্খল চরিত্র,
কোন দিন মুখ তুলিয়া ভাল করিয়া কথাটিও বলেন না। শাশুড়ীও কটুভাষিণী।
প্রভার শরীর দিন দিন ক্ষীন হইতে ক্ষীণতর হইতে
লাগিল। প্রভা জ্বর রোগে আক্রান্ত হইল। অসুখের মধ্যেও প্রভা
শ্বাশুড়ীর ভয়ে শয্যা হইতে উঠিয়া কত কাজ করিত। সময় সময় এককাজ
করিতে অন্য কাজ করিয়া ফেলিত। শ্বাশুড়ির নিকট কত বকুনি খাইত।
এইরূপ অত্যাচার জ্বর ক্রমে কঠিন হইয়া দাঁড়াইল। শয্যা হইতে
গাত্রোত্থানের শক্তি আর প্রভার রহিল না। অবশেষে কিরণবাবুর
খেয়াল হইল বৌয়ের জ্বর হইয়াছে বটে। এরূপ নিষ্কর্মা একটা স্ত্রীলোককে
এখন ঔষধপত্র ও আহার যোগান কিরণবাবুর নিকট বিরক্তিকর ও অযৌক্তিক
বলিয়া বোধ হইল। যোগেন্দ্রবাবুর নিকট চিঠি লেখা হইল, তিনি যেন
অচিরে আসিয়া কন্যাকে লইয়া যান।
যোগেন্দ্রবাবু সহসা কন্যার এইরূপ পীড়ার সংবাদে
মহাচিন্তিত মনে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। অসিয়াই প্রভাময়ীর শরীরের
অবস্থা দেখিয়া প্রাণ উড়িয়া গেল। ডাক্তার ডাকাইলেন। ডাক্তারেরা
রকম সকম বুঝিয়া প্রভাকে নৌকাপথে পাটনা লইয়া যাইতে উপদেশ দিলেন।
যোগেন্দ্রবাবু একখানি নাতিবৃহৎ পান্সী ভাড়া কিয়া কন্যাকে লইয়া
একজন ডাক্তার
সমভিব্যহারে পাটনা যাত্রা করিলেন।
৮