মাতার
অনুরোধ-উপরোধে উপেক্ষা করিয়া, আত্মীয়-স্বজনের ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ
ও ভীতি-প্রদর্শনে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া, নবীন জমীদার রাজকুমার
যখন কলিকাতার কোন স্কুলের সামান্য বেতনের মাষ্টার অবনীনাথের
সুন্দরী এবং সুশিক্ষিতা কন্যাকে স্বয়ং মনোনীত করিয়া বিবাহ
করিয়াছিল, তখন তাহার মাতৃদ্রোহিতার ও অযোগ্য নির্ব্বাচনের
উল্লেখ করিয়া দেশের প্রবীণ ও প্রধানগণ তাহার সম্বন্ধে নানাপ্রকার
তীব্র মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছিলেন। কিন্তু দেশের নবীন-বয়ষ্ক
আত্মীয়-বন্ধু-বান্ধব এই পুত্র-কন্যা-ব্যবসায়ের যুগে, তাহার
এই প্রকার আত্মত্যাগ এবং কর্ত্তব্যকার্য্যে সৎসাহসের পরিচয়
পাইয়া, রাজকুমারকে প্রশংসার মাল্যচন্দনে চর্চ্চিত করিয়া দিয়াছিল।
তাহার যে প্রকৃত মনের তেজ আছে, সে যে দেশের মধ্যে যথার্থ আদর্শ
প্রতিষ্ঠা করিতে চেষ্টা করিতেছে, এ কথার উল্লেখ করিয়া সমাজের
উদীয়মান যুবকগণ তাহাকে সমাজ-সংস্কারকের উচ্চাসন দান করিয়াছিল।
বিবাহের পর পর দুই বৎসর পর্য্যন্ত
উভয় পরিবারের মধ্যে মনোমালিন্য যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান ছিল।
রাজকুমারের জননীর মনে বিশ্বাস ছিল,-অবনীনাথ সুন্দরী কন্যার
রূপের ফাঁদে ফেলিয়া, তাঁহার একমাত্র সন্তানকে অবৈধরূপে বশ
করিয়াছিলেন, তাহার ফলে অমন মাতৃভক্ত পুত্র বিগড়াইয়া গিয়াছে।
বেচারা অবনীনাথ বহুচেষ্টা করিয়াও বৈবাহিকার মত-পরিবর্ত্তন
ও ক্রোধ-শান্তি করিতে পারেন নাই। কিন্তু কালে মানুষ পুত্রশোকও
বিস্মৃত হয়। রাজকুমারের মাতা অবশেষে সকল কথা ভুলিয়া গেলেন।
লক্ষী রূপিণী বধূমাতাকে, দুই বৎসর পরে সস্নেহে ঘরে তুলিয়া
লইলেন। কারণ, তিনি বুঝিয়াছিলেন, পুত্রকে সন্তুষ্ট এবং আপন
বশে রাখিতে গেলে, পুত্রবধূকে সমাদরে গৃহে আনিতে হইবে, নচেৎ
পরিণামে পুত্র একেবারে হাতছাড়া হইয়া যাইতে পারে।
মাধুরীর রূপজোৎস্নায় রাজকুমার
যে ডুবিয়া গিয়াছিল, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই। পত্নী, গৃহে
অসিবার পর সে মাধুরীকে মনের মত করিয়া সাজাইয়া নিজের অতৃপ্ত
আকাঙ্ক্ষাকে চরিতার্থ করিতে লাগিল। বসনে ভূষণে সে পত্নীকে
এমনভাবে সাজাইয়া রাখিত যে, অল্পদিনেই রাজকুমারের স্ত্রৈণ আখ্যা
চারিদিকে রটিয়া গেল। সে স্বয়ং কাব্য ও উপন্যাসের ভক্ত ছিল।
পত্নীর মনোরঞ্জন এবং তাহার কল্পনা-বৃত্তির পূর্ণ-বিকাশের অভিপ্রায়ে,
রাজকুমার বাঙ্গলাদেশের প্রসিদ্ধ কবি ও ঔপন্যাসিকগণের যাবতীয়
গ্রন্থ নির্ব্বিচারে মাধুরীকে আনিয়া দিয়াছিল। বন্ধু বান্ধবগণের
কেহ তাহাকে এ সম্বন্ধে কোন কথা বলিলে সে হাসিয়া উড়াইয়া দিত।
লোকমতের অপেক্ষা রাখিয়া সে কোনও দিন কোনও কাজ করিত না। তাহার
অন্তরঙ্গ বন্ধুগণও জানিত, স্বভাবতঃ নিরীহ-প্রকৃতি রাজকুমার
যাহাতে জিদ করে, তাহা হইতে কেহই তাহাকে নিবৃত্ত করিতে পারে
না।
গৃহলক্ষ্মী ঘরে আসিবার এক বৎসর
পরে, নবীন বংশধরের আবির্ভাব জমীদারবাটীতে আনন্দের হিল্লোল
বহিয়া গেল। কিন্তু প্রসূতির শরীর ইহাতে ভাঙ্গিয়া পড়িল। ডাক্তারেরা
পরামর্শ করিয়া স্থির করিলেন যে, পশ্চিমের কোনও স্বাস্থ্যকর
স্থানে কিছুদিন বাস করিলে মাধুরীর শারীরিক দুর্ব্বলতা থাকিবে
না এবং তাহার পূর্ব্ব-স্বাস্থ্য ফিরিয়া আসিবে।
পরামর্শমত পশ্চিমযাত্রার
আয়োজন চলিতে লাগিল। টাইমটেবিল প্রভৃতি দেখিয়া, বন্ধুবর্গের
সহিত পরামর্শ করিয়া, রাজকুমার স্থির করিল, তাহারা তিন মাস
দেরাদুনে থাকিবে। কিন্তু প্রচণ্ড শীতের সময় দেরাদুন বাঙ্গালীর
বাসের পক্ষে সুবিধাজনক স্থান হইবে না জানিতে পারিয়া, সে আপাততঃ
কাশীধামে থকিবার সঙ্কল্প করিল। কাশীতে শীতকালে আহার্য্য দ্রব্যাদির
প্রাচুর্য্য তাহার লুব্ধ মনটিকে সেই দিকেই আকর্ষণ করিতে লাগিল।
ডাক্তারেরাও বলিলেন যে, বারাণসীধাম শীতকালে স্বাস্থ্যকর স্থানও
বটে।
কোনও কোনও আত্মীয় পরামর্শ দিলেন
যে, বিদেশে প্রবাস-যাপন কালে, অভিভাবিকাস্বরূপ কোনও বর্ষীয়সী
আত্মীয়ার সঙ্গে থাকা অবশ্যক। রাজকুমার অবশ্য ততটা প্রয়োজন
অনুভব করে নাই; কিন্তু সকলেই যখন এ বিষয়ে তাহাকে পুনঃ পুনঃ
স্মরণ করাইয়া দিলেন, তখন সে জননীকে সঙ্গে লইবার প্রস্তাব করিল,
কিন্তু তিনি সম্মত হইলেন না। বাড়ীতে পূজা আসন্ন, তার পর বারমাসে
তের পার্ব্বণ, অতিথি-অভ্যাগতের সেবা আছে। বিশেষতঃ তিনি চলিয়া
গেলে প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহের-কুলদেবতার পূজা ও অর্চ্চনার ব্যাঘাত
ঘটিবে। মাতা অসম্মত হইলেন দেখিয়া রাজকুমারও হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল।
কর্ত্তব্যের অনুরোধে সে প্রস্তাব করিয়াছিল মাত্র। মাতাই যখন
নিজে সে প্রস্তাবে রাজি হইলেন না, তখন সে অন্য কোন আত্মীয়ার
অপ্রীতিকর সঙ্গ-গ্রহণের চেষ্টা করিল না। সঙ্গে প্রাচীনা দাসী
থাকিবে, তাহাতেই চলিবে। পাচক ও ভৃত্য ব্যতীত তাহার অন্তরঙ্গ
বন্ধু সুস্থির ও মহাদেব তাহাদের সহযাত্রী হইবে স্থির হইয়া
গিয়াছিল।
[
২ ]
বাঙ্গালীটোলার
কোন দ্বিতল অট্টালিকায় একদিন বাস করিবার পরই রাজকুমার বুঝিল,
যে উদ্দেশ্যে সে কাশীধামে আসিয়াছে, এ অঞ্চলে থাকিলে তাহার
সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হওয়া অসম্ভব। পতিতোদ্ধারিণী জাহ্নবীর স্নিগ্ধ
পবিত্র সলিলে প্রত্যহ অবগাহন করিয়া, বিশ্বেশ্বর-অন্নপূর্ণার
মন্দিরে পূজা দিয়া, আরতিদর্শনের সুবিধা হইলেও, স্বাস্থ্যলাভের
আশা এখানে অল্প। অপ্রশস্ত, দুর্গন্ধময় গলির উপর অসংখ্য গগনস্পর্শী
অট্টালিকা; বায়ু ও সূর্য্যালোক এখানে পাষাণপ্রাচীরে প্রতিহত
হইয়া শুধু আকাশপথেই চলাফেরা করে। মানুষের সহিত তাহাদের সংস্রব
কতটুকু। সুতরাং, সর্ব্বদা দেবদর্শন জনিত পুণ্য ও অবগাহন-স্নানের
আরাম ত্যাগ করিয়া তাহাকে অন্যত্র স্থান করিয়া লইতেই হইবে।
বন্ধু যুগলের সহিত পরামর্শ করিয়া রাজকুমার শিক্রোলে একটা পছন্দমত
বাড়ী ভাড়া করিল। এখানে আসিয়া সকলেই একটা স্বস্তির নিশ্বাস
ত্যাগ করিল; মুক্তির পরমানন্দ সহজেই অনুভব করিতে লাগিল। বায়ু
এখানে অব্যাহত। সূর্য্যালোক উদয়াস্ত পর্য্যন্ত তাহাদিগের সঙ্গ
পরিত্যাগ করে না। প্রভাত ও সন্ধ্যায় ভ্রমণের কোনও অসুবিধা
নাই। পর্দ্দার অনুশাসন এখানে নিষ্ফল। তীর্থক্ষেত্রের সর্ব্বত্রই
এরূপ সুবিধা আছে বটে; কিন্তু উন্মুক্ত ক্ষেত্র, প্রশস্ত রাজপথে
মহিলাগণের ভ্রমণ করিবার সুযোগ ও সুবিধা সর্ব্বত্র পাওয়া যায়
কি।
দুই তিন সপ্তাহের মধ্যে
মাধুরীর স্বাস্থ্যের উন্নতি দেখা গেল। ক্রমে সে সবন্ধু স্বামীর
সহিত রাজপথে প্রভাত ও সান্ধ্যবায়ু সেবনের যোগ্যতা লাভ করিল।
প্রকাশ্য দিবালোকে স্বামী ও তাঁহার বন্ধুদ্বয়ের সহিত রাজপথে
ভ্রমণে মাধুরী প্রথমতঃ ঘোরতর আপত্তি করিয়াছিল; কিন্তু রাজকুমার
যুক্তিতর্কের বলে এবং প্রমাণ প্রয়োগ করিয়া তাহার সকল প্রকার
ওজর ও আপত্তি উড়াইয়া দিয়াছিল। প্রচলিত অবরোধ-প্রথার পক্ষপাতি
সে ছিল না। উহা যে সকল সময়েই একান্ত অবশ্যক, তাহাও সে মানিত
না, অন্ততঃ কলেজে পড়িবার সময় এই মতটি তাহার অন্তরে বদ্ধমূল
হইয়া গিয়াছিল। ঘরে ও বাহিরে নীতি প্রচলিত রাখিবার প্রয়োজন
সে ইদনীং স্বীকার করিত না। বাহিরের আলোক ঘরের অন্ধকার দূরীভূত
করে। বাহিরের নির্ম্মল বাতাস অবরুদ্ধ গৃহের দূষিত বায়ুকে পবিত্র
না করিয়া দিলে সেই ঘর বাসের অযোগ্য হয়, অন্ততঃ স্বাস্থ্যনীতির
কথা মানিয়া চলিতে গেলে, এ সত্যকে অস্বীকার করিবার কোনও উপায়
নাই। মানুষের পক্ষেও এই নীতি অবলম্বনীয়। বর্ত্তমান কালের দেশী
ও বিদেশী গ্রন্থরাজি পাঠে সে এই তত্ত্বটি আরও পরিষ্কারভাবে
বুঝিতে পারিয়াছিল। সুতরাং মাধুরী তাহার স্বামীর অন্তরঙ্গ বন্ধুবর্গের
সম্মুখে বাহির হইলেও ও তাহাদের সহিত আলাপ-পরিচয় করিলে, মহাভারত
অশুদ্ধ হইবার কোনই সম্ভাবনা সে দেখিতে পাইত না। বরং তাহাতে
উভয় পক্ষেরই অন্ধ কুসষ্কারের জড়তা দূরীভূত হইয়া সেই স্থলে
সত্যের আলোক সমুজ্জল হইয়া উঠিবে। মাধুরী আজন্মের সংস্কার বশতঃ
প্রথমতঃ সে কথা বুঝিতে চাহিত না; কিন্তু স্বামীর যুক্তি, তর্ক
ও দৃষ্টান্তে উপেক্ষা প্রকাশ করিলেও তাহার অনুরোধ-উপরোধ এড়াইতে
পারিল না। কাজেই ক্রমশঃ বাধ্য হইয়া সে সুস্থির ও মহাদেবের
সম্মুখে বাহির হইতে বা তাহাদের সহিত কোনও বিষয়ে আলোচনা করিতে
সঙ্কোচ বোধ করিল না। এরূপ অবসর এবং সুযোগ দিনের মধ্যে নানা
প্রকারে দেখা দিত।
বিদেশে বায়ুপরিবর্ত্তন করিতে আসিয়া সংসারের
খুঁটিনাটি কাজে ব্যস্ত থাকিবার কোন প্রয়োজনই ছিল না। সকালে
বৈকালে ভ্রমণ, নির্দ্দিষ্ট সময়ে পাচক-প্রস্তুত আহার্য্য ভোজন,
অবকাশ-সময়ে উপন্যাস ও কাব্য-গ্রন্থপাঠ, রাত্রে নিদ্রা। কিন্তু
দীর্ঘ অবকাশ শুধু বই পড়িয়া কাটান যায় না, ভালও লাগে না। কাজেই
প্রতিদিন মধ্যাহ্ণে তাসের আড্ডা বসিত। রাজকুমার, মাধুরী, মহাদেব
ও সুস্থির, চারিজনে তাসের যুদ্ধে যোগদান করিত। খেলামাত্রেরই
একটা প্রচণ্ড নেশা আছে-বিশেষতঃ তাসখেলায়-একবার আরম্ভ হইলে
সহজে উহা ত্যাগ করা যায় না। বিশেষতঃ যে পক্ষ হারিয়া যায়, তাহারা
প্রতিপক্ষকে হারাইবার জন্য মাতিয়া উঠে। কাজেই রাজকুমারের তাসের
আড্ডা প্রতিদিনই অপ্রতিহত-তেজে চলিতে লাগিল। স্বামীর বন্ধুবর্গের
সহিত ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হইবার পক্ষে মাধুরীর তরফ হইতে যে সঙ্কোচটুকু
অবশিষ্ট ছিল, তাস-ক্রীড়ার রঙ্গভূমিতে তাহা অন্তর্হিত হইয়া
গেল। সঙ্গে সঙ্গে নানারূপ হাস্য-পরিহাস, ব্যঙ্গ-বিদ্রপও চলিত।
ক্রমে ক্রমে মাধুরীকে তাহাতেও যোগ দিতে হইত বই কি! রাজকুমার
ও সুস্থির পাকা খেলোয়াড় ছিল। কাজেই উহারা দুই জন দুই পক্ষ
অবলম্বন করিত। মাধুরী ও মহাদেব এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর সহকারিতা
করিত। রাজকুমারের প্রস্তাবে, মাধুরী সুস্থিরের দলেই পড়িয়াছিল।
রাজকুমার খেলায় জিতিবার আশায় মহাদেবকেই নিজের পক্ষে টানিয়া
লইয়াছিল।
মহাদেব স্বভাবতঃ একটি নিরীহ-প্রকৃতির ছিল। কিন্তু সুস্থির
ঠিক তাহার বিপরীত। নামের সহিত তাহার প্রকৃতির কোনই সামঞ্জস্য
ছিল না। স্বভাবতই সে চঞ্চল। সর্ব্বদা হাস্য-পরিহাস, গল্প-গুজব,
আলাপ-পরিচয়ে সে সকলকে ছাড়াইয়া চলিত। তাহার প্রকৃতির মধ্যে
একটা প্রচণ্ডতা ছিল। কোনও বিষয়ে সে সহজে নিজের পরাজয় স্বীকার
করিতে চাহিত না। কোনও বিষয়ে তর্ক আরম্ভ হইলে, সে নিজের মতটি
বজায় রাখিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিত। যুক্তির দোহাই দিতে
না পারিলেও অনেক সময় গলাবাজি করিয়া সে নিজের মত অব্যাহত রাখিতে
চেষ্টা করিত। রাজকুমার ও মহাদেব তর্কে তাহাকে আঁটিয়া উঠিতে
পারিত না। মাধুরী অনেক সময় নির্ব্বাক্ বিস্ময়ে বন্ধুত্রয়ের
তর্ক যুদ্ধ দেখিত। তাহাদের এই বাগ্যুদ্ধে বাহুবিক্ষোভ ও অঙ্গসঞ্চালনের
বাহুল্য দেখিয়া মাধুরীর হৃদয়ে কি ভাবের স্রোত বহিত, তাহা কাহারও
জানা নাই বটে; কিন্তু সময়ে সময়ে তাহার বিশাল নয়ন যুগলে বিস্ময়
ও কৌতুকের আলোক-রেখা যে উজ্জ্বল হইয়া উঠিত, তাহা কাহারও দৃষ্টি
একেবারে এড়াইত না।
[
৩ ]
মহাদেব
বলিল, "না না! আমার কিন্তু তা মনে হয় না। তবে-"
সহসা সে থামিয়া গেল। নিজের মনের সন্দেহ
প্রকাশ করিবার অধিকার তাহার আছে কি না, বোধ হয়, একবার সে তাহা
ভাবিয়া থামিয়া গেল।
সুস্থির উত্তেজিত-ভাবে বলিল, "আমারও
আগে সেই দ্গারণা ছিল। কিন্তু গত রাত্রের ব্যবহারে আমার সন্দেহ
আরও দৃঢ় হইয়াছে।"
"এ যদি সত্য, তাহা হইলে সংসারে আর
কাহাকেও বিশ্বাস করা চলে না ভাই! মাধুরীর মত অমন চমৎকার স্বভাবের
মেয়ে আমাদের দেশে অতি কমই আছে বলিয়া আমার বিশ্বাস ছিল। আমি
ছেলেবেলা হইতে উহাকে দেখিয়া আসিতেছি, বড় মিষ্ট, বড় ধীর স্বভাব।
সেই মাধুরীর মনের অবস্থা যদি এমন হয়, তাহা হইলে দুনিয়াতে আর
স্ত্রীজাতিকে বিশ্বাস করা চলে না। বিশেষতঃ রাজকুমার উহাকে
প্রাণ দিয়া ভালবাসে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, উহাদের স্বামি-স্ত্রীর
মধ্যে প্রণয় অকৃত্রিম, প্রগাঢ় ও দৃঢ়।"
সুস্থির বলিল, "সে বিশ্বাস তো আমার
কম ছিল না। আমিও ছেলেবেলা উহাকে দেখিয়াছি বটে, তবে তখনকার
কথা আমার বড় মনে নাই। কিন্তু বিবাহের পর বধূবেশে যখন তাহাকে
দেখিয়াছিলাম, তখন হইতেই উহার প্রতি আমার শ্রদ্ধা জন্মিয়াছিল।
মাধুরীর মধুর ও নম্র ব্যবহার এবং মিষ্ট স্বভাবটি আমার বড় ভাল
লাগিয়াছিল। বাস্তবিক এ বয়সে নানাদেশে নানাপ্রকার রমণী দেখিয়াছি।
কিন্তু উহার সমকক্ষ আমি আর একটিও দেখি নাই। সেইজন্য এই আবিষ্কারে
আমি বিষম আঘাত পাইয়াছি, ভাই! এখন আমার এই সন্দেহ ভিত্তিহীন
কি না, তাহা একবার পরীক্ষা করিয়া দেখিতে হইবে।"
মহাদেব সবিস্ময়ে বলিল, "পরীক্ষা।
সে আবার কি রকমে হইবে।"
"তাই তো ভাবিতেছি। একটা কিছু আবিষ্কার
কর না।"
কিন্তু তখন কোনও উপায়ই আবিষ্কৃত হইল না।
মধ্যাহ্ণে আহারের পর বন্ধুযুগল একত্র মিলিত হইল। গতকল্য রজনীতে
তাস-ক্রীড়া অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত চলিয়াছিল। বাজি রাখিয়া খেলা
আরম্ভ হইয়াছিল। সুতরাং রাত্রি তৃতীয় প্রহর পর্য্যন্ত খেলার
বৈঠক অপ্রতিহতভাবে চলিয়াছিল। কাজেই আজ মধ্যাহ্ণে তাসখেলা বন্ধ
ছিল। শরীরের ক্লান্তিবশতঃ রাজকুমার ও মাধুরী মধ্যাহ্ণে শয়নকক্ষ
ত্যাগ করিল না। মহাদেব ও সুস্থির তাহাদের নবাবিষ্কৃত সমস্যার
ও মীমাংসা করিতে বিব্রত হইয়া পড়িল।
অনেক চিন্তা, আলোচনা ও বাদানুবাদের পর
সুস্থির যে প্রস্তাব করিল, তাহা মহাদেবের মনঃপুত না হইলেও
সে অগত্যা তাহাতে সায় দিল। তখন সুস্থির কাগজ-কলম লইয়া লিখিতে
বসিল। অনেকবার কাটাকুটি করিয়া শেষে লেখা যাহা দাঁড়াইল, তাহা
সে অনুচ্চ কণ্ঠে মহাদেবকে পড়িয়া শুনাইল।
"মাধুরী!
তোমার মধুর, স্নিগ্ধ ব্যবহার আমাকে যে
মুগ্ধ করিয়াছে, তাহা বলা বাহুল্যমাত্র। বাল্যকালাবধি তোমাকে
জানি। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তোমার কমনীয় দেহে লাবণ্যের জোয়ার
যেমন উচ্ছ্বলিত হইয়া উঠিতেছে, মনের সৌন্দর্য্যও সেই পরিমাণে
বাড়িতেছে; তাহা যাহার চক্ষু আছে, সেই দেখিতে পাইবে; যাহার
হৃদয় আছে, সেই বুঝিতে পারিবে। তোমাকে যে ভালবাসে না, সে মানুষ
নহে। সুতরাং তোমাকে স্নেহ করি, ভালবাসি এ কথা বলিলে কিছুই
বলা হইল না। ইদানীং তোমার নয়নে, আননে যে ভাষা একবার শব্দময়ী
হইয়া ক্রমশঃ উঠিতেছে, তাহা অন্যের নিকট দুর্ব্বোধ হইলেও আমার
অন্তরে অতি স্পষ্টভাবে ধ্বনিত হইতেছে, তাহা অস্বীকার করিব
না। আমার এ ধারণা কি মিথ্যা। যদি মিথ্যা হয়, তবে তাহাকে সংশয়ের
অবরণে ঢাকিয়া রাখিয়া কোন লাভ নাই। যদি সত্য হয়, তবে তাহাকে
প্রশ্রয় দেওয়াও কর্ত্তব্য নহে। মনের গতি অপ্রতিহত, তাহা স্বীকার
করি। সে আপনার পথে আপনি চলে, কাহারও বাধা, কোনও নিষেধ মানিতে
চাহে না। কিন্তু তথাপি তাহাকে অপথে বিপথে চলিতে দেওয়া কখনই
উচিত নহে। সংযমের বাঁধনে তাহাকে ধরিয়া রাখিতে হইবে। তোমার
নয়নের ইঙ্গিত, আননের নীরব ভাষা যদি সত্যই হৃদয়ের যথার্থ ভাব
ব্যক্ত করিয়া থাকে, তাহা হইলে সত্যের অনুরোধে আমার সংশয় ভঞ্জন
করিও। সেরূপ ক্ষেত্রে বন্ধুর আশ্রয়ে থাকিয়া আমি নিজেকে মুহূর্ত্তের
জন্যও অপরাধী করিব না। ইতি
সুস্থির।"
মহাদেব বলিল, "যদি আমাদের অনুমান
মিথ্যা হয়, তাহা হইলে মাধুরী হয় তো ইহা রাজকুমারকে দেখাইতে
পারে। তখন কি করিবে।"
সুস্থির দৃঢ়স্বরে বলিল, "সে তো ভালই
হইবে। আমাদের সন্দেহ অমূলক হয়, তবে আর কথা কি। তখন কি বন্ধুর
কাছে সকল কথা খুলিয়া বলিয়া ক্ষমা চাহিতে পারিব না।"
অপরাহ্ণে যখন সকলে নিয়মিত ভ্রমণে বাহির
হইবার আয়োজন করিতেছে, সেই সময় মাধুরীকে একা পাইয়া সুস্থির
তাহার সম্মুখে পত্রখানি ফেলিয়া দিয়া চলিয়া গেল। বারান্দা পার
হইয়া বাহিরের ঘরে প্রবেশ করিবার সময় সে চকিতে একবার পশ্চাতে
চাহিয়া দেখিল, পত্রখানি কুড়াইয়া লইয়া মাধুরী উহা বস্ত্রাঞ্চলে
লুকাইয়া রাখিল। ঠিক সেই সময় কক্ষান্তর হইতে রাজকুমার বাহিরে
আসিয়া বলিল, "চল মাধুরি, আর দেরী করা হবে না। আজ অনেক
দূর বেড়াইতে যাইবার কথা। সুস্থির ও মহাদেব বাহিরে অপেক্ষা
করিতেছে।"
মাধুরী কি উত্তর দিল, তাহা শুনিবার অপেক্ষায়
সুস্থির আর সেখানে দাঁড়াইল না। রাজকুমার তাহাকে যাহাতে দেখিতে
না পায়, সেই উদ্দেশ্যে সে কি নিঃশব্দে বাহিরের ঘরে গিয়া বসিল।
[
৪ ]
আকাশে
মেঘ গম্-গম্ করিতেছিল। মাঝে মাঝে এক একটা দম্কা হাওয়া ঘরের
মধ্যে ঢুকিয়া সকলকে শীতে কাঁপাইয়া তুলিতেছিল। একে পৌষমাস,
তাহার উপর বাদ্লা হাওয়া, কাজেই আজ কেহই লেপের আশ্রয় ত্যাগ
করিয়া উঠিতে চাহিতেছিল না। মহাদেব একেই একটু জরদ্গবের মত,
তাহাতে পশ্চিমের প্রবল শীত। সে লেপের মধ্য হইতে কোন রকমে মুখ
বাহির করিয়া ডাকিল, "কি হে সুস্থির, বলি ব্যাপার কি।"
সুস্থির তখন ড্রয়ারের উপর প্যান্ট চড়াইয়া,
গায়ের মোটা কোটের বোতাম আঁটিয়া, একেবারে সাহেব সাজিয়া বারান্দায়
বসিয়াছিল। নিয়মের ব্যতিক্রম সে পারত-পক্ষে করিতে চাহিত না।
বাড়ীর কর্ত্তৃপক্ষ শয্যাগত থাকিলেও সে নির্দ্দিষ্ট সময়ে উঠিয়া
চাকরকে দিয়া চায়ের সরঞ্জাম ঠিক করিয়া রাখিয়াছিল। ষ্টোভ জ্বালিয়া
দিয়া সে কেট্লি চড়াইয়া গরমজলের প্রতীক্ষা করিতেছিল।
বন্ধুর প্রশ্নে সুস্থির গম্ভীরভাবে উত্তর
দিল, "তুমি তো কুড়ের সর্দ্দার। একটু বাদ্লা হাওয়া দিয়াছে,
আর বিছানা ছাড়িবার নাম নাই। কিন্তু প্রাতরাশ তো কাহারও জন্য
বসিয়া থাকিবে না। বেলা যে আটটা বাজিয়া গিয়াছে।"
মহাদেব বলিল, "তা বাজিতে দাও না, ভাই! নিয়মমাত্রেরই ব্যতিক্রম
আছে। একদিন না হয় প্রাতরাশ নাই হইল। রাজকুমারের খবর কি। সেও
তো উঠে নাই দেখিতেছি!"
"সেও তো তোমারই দলের। যাক্, তোমাদের
তো কাহারও ক্ষুধা নাই। আমি কিন্তু না খাইয়া পারিব না।"
গরম জলের কেট্লি নামাইয়া সুস্থির তাহাতে চা ঢালিয়া দিল। এ
কার্য্যটি ইদানীং মাধুরীই করিত। কিন্তু আজ শীতের প্রকোপে সেও
বোধ হয়, অন্যের ন্যায় কর্ত্তব্য ভুলিয়া, বিশ্রাম-সুখ ভোগ করিতেছে।
ভোরবেলা গোয়ালা যোগান দুগ্ধ দিয়া গিয়াছিল। যাহারা খাটিয়া খায়,
কর্ত্তব্যের ত্রুটি তাহাদের বড় একটা দেখা যায় না। চায়ের সঙ্গে
পাউরুটির টোস্ট প্রত্যহ বরাদ্দ ছিল; কিন্তু আজ বাড়ীর গৃহিণী
অনুপস্থিত, টোস্ট তৈয়ার করে কে। কাজেই সুস্থির বিনাটোস্টে
চা পান করিবার অভিপ্রায়ে ভৃত্যকে পেয়ালা সাজাইতে বলিল। সে
বেচারা, তুলার কোর্ত্তা গায় থাকা সত্ত্বেও শীতে থর্-থর্ করিয়া
কাঁপিতেছিল। বারান্দার তিন দিকে কোন আবরণই ছিল না। পশ্চমদিক্
হইতে বাতাস হু হু করিয়া ছুটিয়া আসিতেছিল।
সহসা পশ্চাতে পদশব্দ শুনিয়া সুস্থির মুখ
ফিরাইল। অকস্মাৎ তাহার কেশলেশহীন সুন্দর গণ্ডদেশ আরক্ত হইয়া
উঠিল। শালাখানা উত্তমরূপে গায়ে জড়াইয়া মাধুরী ধীর-পদক্ষেপে
সেখানে উপস্থিত হইল। পৌষের বারিসিক্ত বাতাস তাহার মুক্ত অলকগুচ্ছ
দোলাইয়া দিয়া গেল। ঈষৎ হাসিয়া সে বলিল, "সুস্থির বাবুর
দেখ্ছি নিয়মের ব্যতিক্রম হইবার যো নাই। সময় যায় দেখে, শেষে
নিজেই চা তৈয়ার ক'রে ফেলেছেন দেখ্ছি!" বলিয়াই সে একখানা
বাঁধান বহি শালের অন্তরাল হইতে বাহির করিয়া সুস্থিরের সম্মুখে
রাখিল। সুস্থির প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিবামাত্র
মধুর হাসিয়া সে বলিল, "আপনি সে দিন এই বইখানি পড়বার জন্য
চেয়েছিলেন, আজ হঠাৎ মনে পড়ায় নিয়ে এলাম।"
বইখানি কোটের পকেটের মধ্যে রাখিয়া সুস্থির
গম্ভীরভাবে বলিল, "চা খাবেন না। এক পেয়ালা নিন ও।
"একটু অপেক্ষা করুন। আমি কয়েক মিনিটের মধ্যে টোষ্ট কয়খানা
তৈয়ার করিয়া আনিতেছি।"
মহাদেব র্যা পার মুড়ি দিয়া বাহিরে অসিয়া
বলিল, "বলিহারি যা হোক্, আজ এই ঠাণ্ডায় বারান্দায় না
বসিলে কি চা পান হইত না।"
"ওটা যে প্রাত্যহিক অনুষ্ঠান। রোজ
যেখানে বসিয়া প্রাতরাশ করা যায়, আজ সেখানে বসিয়া সে কাজ না
করায় বিশেষ কোন বাধা ঘটে নাই। তুমি পেঁচার মত ঘরের মধ্যে দরজা
বন্ধ করিয়া বসিয়া থাক গে যাও।"
সর্ব্বাঙ্গ আলষ্টারে ঢাকিয়া, গলায় মফলার আঁটিয়া, রাজকুমার
সেখানে আসিয়া বলিল, "ব্যাপার কি। - সুস্থিরের প্রাতরাশ
বুঝি অপেক্ষা করিতে জানে না।"
"সে তো জানই ভাই, আমি ঘোর ঔদরিক।
নিয়মিত সময়ে আমার কিছু খাওয়া চাই। শীত, বৃষ্টি-ও সব আমি কিছুই
বুঝি না।"
তখন হাসিতে হাসিতে বন্ধুত্রয় চায়ের টেবিলের
পার্শ্বে আসন গ্রহণ করিল। মাধুরী পাঁউরুটি ভাজিয়া আনিয়া তাহাদের
প্লেটে সাজাইয়া দিল। তার পর এক পেয়ালা চা লইয়া সে চলিয়া গেল।
একত্র বসিয়া পান-ভোজনটা সে এখনও অভ্যাস করিয়া উঠিতে পারে নাই।
আজ আর প্রাতভ্রমণের সুবিধা ছিল না। তখন
বেশ বৃষ্টি পড়িতেছিল। কাজেই প্রাতরাশ শেষে বন্ধুত্রয় বৈঠকখানায়
আশ্রয় লইল।
মহাদেব ও রাজকুমার যখন একটা সাহিত্যিক
প্রসঙ্গ লইয়া তর্ক করিতে লাগিল, সুস্থির তখন মাধুরীর প্রদত্ত
বইখানি কোটের পকেট হইতে বাহির করিয়া পড়িবার চেষ্টা করিল। আজ
তাহার স্বাভাবিক তর্ক-প্রবৃত্তি যেন শীতের আর্দ্র হাওয়ায় জড়সড়
হইয়া গিয়াছিল। বেশী কথা কহিবার ইচ্ছা তাহার হইতেছিল না।
বইখানি খুলিবামাত্র বিস্ময়ে তাহার নয়ন-যুগল
উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। সে দেখিল, পুস্তকের মধ্যে খামে আঁটা একখানি
পত্র রহিয়াছে, শিরোনামা তাহারই নামে। হস্তাক্ষর দেখিয়া, পত্রখানি
কাহার লেখা, তাহা অনুমান করিতে সুস্থিরের মুহূর্ত্তমাত্র বিলম্ব
হইল না। পত্রে কি লেখা আছে, তাহা জানিবার জন্য সুস্থিরের ইচ্ছা
দুর্দ্দমনীয় হইয়া উঠিল। কিন্তু পাছে কোনরূপে রাজকুমারের দৃষ্টি
আকৃষ্ট হয়, এই আশঙ্কায় সে অতিকষ্টে কৌতূহল দমন করিয়া অন্যের
অলক্ষ্যে পত্রখানি কোটের পকেটে রাখিয়া দিল। তার পর অতি কষ্টে
মানসিক চাঞ্চল্য দমন করিয়া পুস্তক-পাঠে মনোনিবেশের চেষ্টা
করিল। দুই চারি ছত্র পড়িবার পর সে মনে ভাবিল, এখন যদি সে তাহাদের
সহিত চিরাচরিত আলোচনায় যোগদান না করে, তাহা হইলে তাহার এই
ভাবান্তর সমালোচনার বিষয়ীভূত হইবার সম্ভাবনা। সুতরাং বইখানি
একপার্শ্বে রাখিয়া সে বন্ধুদ্বয়ের কাছে আসিয়া বসিল।
কিন্তু যে কারণেই হউক, আজ আলোচনা তেমন
জমাট, ঘোরালো হইয়া উঠিতেছিল না, তর্কে তেমন জোর, যুক্তিতে
সেরূপ আন্তরিকতা দেখা যাইতেছিল না। আলোচনা যেন চলিতে চলিতে
হঠাৎ মাঝখানে আসিয়া হোঁচট খাইয়া পড়িয়া যাইতেছিল। প্রকৃতির
বিপর্য্যয়ই কি তাহার হেতু।
অন্যদিন মাধুরী তাহাদের তর্কযুদ্ধ দেখিবার
জন্য, সভাস্থলের এককোণে আসন গ্রহন করিত, কিন্তু আজ তাহার খোকার
সর্দ্দি হইয়াছে বলিয়া সে সেখানে অনুপস্থিত, কিয়ৎকাল পরে রাজকুমার,
খানকয়েক জরুরী পত্র লিখিবার অভিপ্রায়ে নিজের ঘরে চলিয়া গেল।
মহাদেব, বন্ধুর মুখমণ্ডল গম্ভীর দেখিয়া
বলিল, "কি হে, আজ প্রকৃতির সঙ্গে তুমি সমান সুরে তান
বাঁধিয়াছ নাকি।"
সুস্থির কোটের পকেট হইতে পত্রখানি বাহির
করিয়া বলিল, "উত্তর আসিয়াছে।"
ব্যগ্রকণ্ঠে মহাদেব বলিল, " কি লিখিয়াছে।"
"এখনও পড়ি নাই। এস পড়া যাক্।"
পত্রে লেখা ছিল,-
"এক সুরে যখন দুইটি বীণা বাঁধা থাকে,
তখন একটিতে আঘাত করিলে অপরের তন্ত্রীও ঠিক সমান সুরে ঝঙ্কৃত
হইয়া উঠে, ইহা তো সর্ব্ববাদিসম্মত সত্য। কেন এমন হয়, জানি
না। কিন্তু ইহা যে ঘটিয়া থাকে, তাহা তো অস্বীকার করা যায় না!
সত্যকে কেহ কোনদিন কোনরূপ অবরণেই ঢাকিয়া রাখিতে পারে নাই।
দুর্ব্বলা নারী যে আজ তাহা পারিবে, ইহা কি সম্ভবপর। এই সত্য
জানিবার পর যদি আপনি স্থান ত্যাগ করেন, তবে তাহা আর একজনকে
কিরূপ গভীরতর আঘাত করিবে, মর্ম্মপীড়া ও বেদনা দেবে, তাহা একবার
ভাবিয়া দেখিবেন। শুধু দর্শনেও যে তৃপ্তি, যে সুখ, তাহা হইতে
কাহাকেও বঞ্চিত রাখা কি ধর্ম্ম-সঙ্গত। হৃদয় কি সে কার্য্যের
অনুমোদন করিতে পারিবে। শাসন, শৃঙ্খলা, নিয়ম, সংযম, এ সকল কি
শুধু কথার সমষ্টি নহে। সকলের উপর সনাতন সত্য-হৃদয়। তাহার বাণী,
তাহার আদেশ লঙ্ঘন করিবার সামর্থ্য যাহার থাকে থাকুক, কিন্তু
অভাগিনীর যে নাই, তাহা গোপন করিব না।"
মহাদেব পাংশুমুখে, উত্তেজিত কণ্ঠে বলিল,
"কি কঠোর ভীষণ সত্য!"
দৃঢ়কণ্ঠে সুস্থির বলিল, "আমার অনুমান
অযথার্থ নহে, এখন বুঝিলে।"
"কিন্তু ইহা মিথ্যা, জানিতে পারিলে-অত্যন্ত
সুখী হইতাম।"
"আমিও হইতাম; কিন্তু সত্য চিরকাল
স্বপ্রকাশ ।"
"এখন কি করিবে, কি করা উঠিত।"
"তাহাই ভাবিতেছি।"
[ ৫ ]
বায়ু, অগ্নি ও জল সংযত অবস্থায় থাকিলে যেমন বিশ্বের
উপকারে লাগে, উদ্দাম ও উচ্ছৃঙ্খল হইলে তেমনই সৃষ্টি সংহার
করিয়া থাকে। মানবের হৃদয়, প্রবৃত্তিও ঠিক সেইরূপ। যদি শাসন
ও শৃঙ্খলার বন্ধনে হৃদয় সংযত না থাকে, তাহা হইলেও দুর্ব্বার
প্রবৃত্তি মানব-সমাজের কল্যাণের কারণ না হইয়া ধ্বংস-সাধনের
হেতু হইয়া উঠে। এই চিরন্তন সত্য সুস্থিরের অগোচর ছিল না। কিন্তু
সে চেষ্টা করিয়াও আত্ম-সংবরণ করিবার উপায় খুঁজিয়া পাইতেছিল
না। মাদক দ্রব্যের এমনই প্রভাব যে, একবার উহার স্বাদ পাইলে
সহসা পরিত্যাগ করা কঠিন। নেশা জমিয়া উঠিতে আরম্ভ করিলে পরিণামের
কথা মনে ভাবিয়া কেহ মাদক দ্রব্য সেবন বিরত থাকে না।
নেশার ঘোরে সুস্থিরের অবস্থাও
অনেকটা সেইরূপ হইয়া উঠিয়ছিল। মাধুরীর প্রথম পত্রে মধ্যে যে
মাদকতা ছিল, তাহা তাহার মস্তিষ্কে প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল।
সে সেই পত্রের উত্তর দিবার প্রলোভনও সংবরণ করিতে পারে নাই।
সুর একটু চড়াইয়া সে উত্তর দিয়াছিল। প্রত্যুত্তরে সে এমন অনেক
কথা জানিল যে, তখন মস্তিষ্ক ও হৃদয় শাসন ও সংযমের বাঁধন মানিয়া
কাজ করিতে চাহিল না। সে আরও একটু উঁচু পর্দ্দায় সুর চড়াইয়া
'উতোর' গাহিল।
এইরূপ উভয়ের মধ্যে পত্র-দূতী প্রত্যহই আনাগোনা করিয়া এমন একটা
অবস্থায় সৃষ্টি করিয়া তুলিল যে, তাহাকে অমান্য করিয়া চলা সুস্থিরের
পক্ষে একান্তই কঠিন হইয়া উঠিল। এতদিন তাহার হৃদয়ের অন্তঃপুরে
যে সুর প্রচ্ছন্নভাবে থাকিয়া অতি মৃদু, অতি অস্ফুট স্পন্দন
তুলিতেছিল, এখন তাহা ভৈরব রাগে ঝঙ্কৃত হইয়া সমগ্র বিশ্বে আত্মপ্রকাশ
করিতে চাহিতেছে।
বেদনার ও আনন্দের আতিশয্যে সুস্থির অধীর
হইয়া উঠিল। এ কি নিদারুণ ব্যাথাভরা চেতনা! বহুদিন হইতে কী
সে ইহাই চাহিয়াছিল। নিশ্চয়! নহিলে এমন ভাবে সত্যের উপলব্ধি
তাহার হইবে কেন। ইহা কি সত্য। আত্মপ্রবঞ্চনা নহে তো। নিশ্চয়ই
নয়! হইতে পারে, সমাজ বিধির ইহা অনুকূল নহে; কিন্তু মনের অবস্থা
যে সত্য, তাহা সে সর্ব্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করে। তাহা যেন হইল;
কিন্তু এখন কর্ত্তব্যই বা কি। - স্রোতে ভাসিয়া যাওয়া ছাড়া
সে তো অন্য কোন পথ দেখিতে পাইতেছে না। তার পর। হাঁ, সেও তাহাই
ভাবিতেছে, - কোথায় ইহার সমাপ্তি, পরিণামই বাকি।
নূতন ভাবের প্রবাহে ভাসাইয়া, নূতন আশার
সম্ভাবনা দেখাইয়া দিনের পর দিন চলিয়া যাইতে লাগিল। প্রথমে
শুধু খেলা ভাবিয়া যাহা আরম্ভ করা গিয়াছিল, তাহা যে শুধু এখন
অর্থহীন খেলা নহে, উহা যে প্রকৃত সত্য, ইহা তো এখন অস্বীকার
করাই চলে না।
গল্প ও উপন্যাস সুস্থির যথেষ্টই পড়িয়াছিল।
কিন্তু মানুষের সত্যকার জীবনে যে গল্প ও উপন্যাসের অপেক্ষাও
বিচিত্র, ঘটনা-বহুল এবং বিস্ময়জনক, ইহা সে আগে বিশ্বাস করিত
না। কিন্তু এখন সে বেশ বুঝিতে পারিতেছে যে, গল্প অপেক্ষা সত্য
অধিক বিস্ময়কর ও বিচিত্র। কিন্তু এই সত্য, ইহাকে অস্বীকার
করাও যেমন কঠিন, আবার বরণ করিয়া লওয়াও সেই অনুপাতে দুরূহ।
নিশীত রাত্রিতে শয্যায় শয়ন করিয়া দারুণ শীতেও সুস্থির ঘামিয়া
উঠিতে লাগিল। পথের ভিতর দিয়া যে ভাব ক্রমেই স্পষ্টতর হইয়া
উঠিতেছে, তাহা যেমনই মধুর, তেমনই তীব্র।
না-আর সে পারিয়া উঠিতেছে না। আত্মসংবরণ
করিয়া থাকা ক্রমেই তাহার পক্ষে দুঃসাধ্য হইয়া উঠিতে লাগিল।
নেশার ঘোরে সে পত্রের মধ্যে তাহার হৃদয়ের ভাবরাশি ক্রমেই খুলিয়া
লিখিতে আরম্ভ করিল। মাধুরীর পত্রেও ইঙ্গিতগুলি ক্রমেই সুস্পষ্ট
হইয়া উঠিতেছে দেখিয়া তাহার হৃদয়ও বিদ্রোহের জয়ধ্বজা তুলিয়া
দিতে আর কুণ্ঠিত নহে!
[
৬ ]
সে
দিন শিবচতুর্দ্দশী। আজ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা বিশ্বেশ্বরের মাথায়
ফুল, জল ও দুগ্ধ চড়াইবে। সমগ্র কাশীধাম আজ 'হর হর ব্যোম' শব্দে
পরিপূর্ণ। সখ করিয়া রাজকুমার সস্ত্রীক শিবচতুর্দ্দশীর উপবাস
করিয়াছিল। সখের ন্যায় ধর্ম্মস্পৃহাও অনেক সময় সংক্রামক। তবে
উহা ব্যধি নহে। মহাদেব এ সকল বিষয়ে তেমন অগ্রণী ছিল না। কিন্তু
সকলের দেখাদেখি সেও আজ পুণ্যসঞ্চয়ের ইচ্ছা ত্যাগ করিতে পারে
নাই। আর সুস্থির। তাহার তো আজ উৎসাহের অন্তই ছিল না। অন্ততঃ
তাহার ব্যবহারে সকলে কতটা সেই রূপ অনুমান করিয়াছিল।
পূর্ব্বদিবস, সান্ধ্যভ্রমণের পর বাসায়
আসিয়া, সে আর একখানা পত্র পাইয়াছিল। ইদানীং দিনের মধ্যে পরস্পরের
মধ্যে তিন চারিবার পত্র-ব্যবহার চলিতেছিল। এই পত্রে সুস্থির
এমন কিছু সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাইয়াছিল, তাহা কোনও বিচার-বুদ্ধি-সম্পন্ন
ভদ্রসন্তানের লেখনী হইতে নিঃসৃত হইবার উপযুক্ত নহে, পত্র যথাস্থানে
পাঠাইবার পর-মুহূর্ত্তে ইহা একবার চকিতবৎ তাহার মনের মধ্যে
উদিত হইয়াছিল। কিন্তু তখন " পাশা হস্তচ্যুত" - কোনও
উপায় ছিল না। তার পর যখন সেই প্রশ্নের অনুকূল উত্তর সে পাইল,
তখন সমস্ত বিশ্বটা তাহার কাছে একেবারে যেন নূতন বলিয়া মনে
হইল। এই উত্তরটা যেমন উত্তেজনা-মূলক, তেমনই সাংঘাতিক। ইহা
কি সে কোনও দিন স্বপ্নেও প্রত্যাশা করিয়াছিল, সে যে মাধুরীর
কত প্রিয় তাহা এখন সে অনুমানবলে বুঝিয়া লইল। বিশ্বেশ্বরের
মন্দিরে গিয়াও মাধুরী শপথ করিতে সম্মত হইয়াছে! কোনও হিন্দুপত্নী
যে এমন করিয়া অনুকূল মত কাগজে কলমেও প্রকাশ করিতে পারে, ইহা
পূর্ব্বে সুস্থিরের স্বপ্নেও অগোচর ছিল। মাধুরী এবারের পত্রে
এমন ভাবে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল যে, তাহাতে সংশয়ের লেশমাত্র
কোথাও ছিল না।
হৃদয়কে পরীক্ষা না করিয়াই অপরিণত বুদ্ধিবশে
সে অন্যের পত্নী হইয়াছে, বন্ধনে আবদ্ধ হইয়াছে; কিন্তু এত দিন
পরে সে নিজের ভ্রম বুঝিতে পারিয়াছে। বুঝিতে পারিয়াছে বলিয়াই
তাহার চিত্ত এমন উদ্ভ্রান্ত হইয়া উঠিয়াছে। পরীক্ষায় না পড়িলে
হৃদয় কি চাহে, কাহাকে চাহে, তাহা কেহ বুঝিতে পারে না। কৈশোরের
চপলতায় সেও তাহা বুঝিতে পারে নাই। এখন জ্ঞানের প্রদীপ্ত আলোকে
তাঁহার হৃদয় সমুজ্জ্বল; সেই দীপ্ত রশ্মিরেখায় অন্তরের যেখানে
যাহা ছিল, সবই এখন স্বপ্রকাশ। সে এতদিনে নিজের ভ্রম বুঝিয়াছে,
আপনাকে যেখানে চিনিতে পারিয়াছে। আর সে আত্মপ্রবঞ্চনা করিবে
না। কিন্তু যে সমাজের বন্ধন, যে ধর্ম্মের অনুশাসন তাহাকে মানিয়া
চলিতে হইতেছে, তাহাকে পূরোবর্ত্তী করিয়া এই নব উপলব্ধিকে সে
কাজে লাগাইতে পারিবে না। ইহার উত্তরে সুস্থির যাহা লিখিয়াছিল,
তাহা উত্তেজনা ও উন্মাদনায় অধীর ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কেহ লিখিতে
সাহস করিত না। যদি হৃদয় কোন বন্ধনে আপনাকে একান্তভাবে ধরা
দিয়া রাখিতে না চাহে, যদি সত্যিই কাহারও চিত্ত সেই বন্ধনে
শুধু দাসত্বের নিগড় ব্যতীত আর কিছু মনে করিতে না পারে, প্রতিমুহূর্ত্তই
যদি আত্মা সেই বন্ধন ছিঁড়িবার জন্য অধীর হইয়া উঠে, তখন সেই
মিথ্যাবন্ধনে জড়াইয়া থাকিবার প্রয়োজন কি। সমাজবন্ধন লোকস্থিতির
জন্য, যদি স্থিতিই না হইল, তবে সে সংস্কারের বন্ধন ছিন্নভিন্ন
করিয়া মানুষকে এমন স্থলে যাইতে হয়, এমন অবস্থা গ্রহণ করিতে
হয়, যেখানে এ সকল ক্ষুদ্রতা, নীচতা ও বন্ধন নাই। যে আত্মপ্রবঞ্চনা
করিতে না চাহে, সে এই সত্যের সন্ধান পাইবামাত্র তখনই তাহাকে
বরণ করিয়া লয়।
এইরূপ পত্র আদান-প্রদানের পর একটা কিছু
সিদ্ধান্ত হইয়াছিল। সেই সিদ্ধান্তের ফলস্বরূপ সম্ভবতঃ উভয়ে
কোন অভিনব অঙ্গীকারপাশে বদ্ধ হইবার কল্পনা করিয়া থাকিবে। বিশ্বেশ্বরের
মন্দিরে গিয়া, দেবতা স্পর্শ করিয়া সেই অঙ্গীকার স্বীকার করিবার
উল্লেখ শেষ পত্রে ছিল। তবে অঙ্গীকার গ্রহণ করিলেও তদনুসারে
কোন ব্যবস্থা সংপ্রতি সম্ভবপর হইতে পারে না, এ ইঙ্গিতও সুস্থির
যে না পাইয়াছিল, তাহা নহে। ইহাতে সুস্থিরের বিশেষ কোন আপত্তিও
ছিল না। কারণ, তাহাকেও তো সকল দিক্ বজায় রাখিয়া চলিতে হাইবে।
সারাদিন উপবাসের পর, রাজকুমার সস্ত্রীক
বিশ্বেশ্বরের মন্দিরে চলিল। যাইবার সময় সে সুস্থির ও মহাদেবকে
গাড়িতে উঠিবার জন্য অনুরোধ করিল। মহাদেব দ্বিরুক্তি করিল না,
কিন্তু সুস্থির কোনও মতে সঙ্গে গেল না। বিশেষ কোন প্রয়োজনের
উল্লেখ করিয়া সে তাহাদের সহযাত্রী হইবার প্রলোভন সংবরণ করিল!
আজ তাহার হৃদয় অসম্ভবরূপ চঞ্চল হইয়াছিল বলিয়াই কি সে রাজকুমারের
সঙ্গ এড়াইল।
সকলে চলিয়া গেলে সুস্থির অনেকক্ষণ চুপ
করিয়া কি ভাবিতে লাগিল। তার পর সহসা একখানা শাল গায় দিয়া পদব্রজে
মন্দিরের উদ্দেশে যাত্রা করিল। মন্দির তখন অসংখ্য পূজার্থী
নরনারীতে পরিপূর্ণ। কোনরূপে ভিড় ঠেলিয়া সুস্থির অগ্রসর হইল।
কিন্তু রাজকুমার প্রভৃতিকে প্রথমতঃ সে খুঁজিয়া বাহির করিতে
পারিল না। অবশেষে অনেক কষ্টে পাণ্ডার সাহায্যে মন্দিরের একাংশে
সে তাহাদিগকে দেখিতে পাইল। সুস্থিরকে দেখিয়া রাজকুমার প্রসন্নহাস্যে
বলিল, "এত দেরী ক'রে এলে। তোমার জন্যে বহুক্ষণ অপেক্ষা
করার পর এইমাত্র আমরা পূজা শেষ করেছি। যাও, এখন তুমিও কাজ
সারিয়া লও।"
সুস্থির একবার স্থির-দৃষ্টিতে মাধুরীর
দিকে চাহিল। উপবাসজনিত ক্লান্তির রেখা তাহার সুন্দর মুখখানিকে
একটু ম্লান করিলেও, তাহার ললাটের সিন্দুররাগ আজ যেন আরও সমুজ্জ্বল
দেখাইতেছিল। মাধুরীর পরিহিত রক্তাম্বরখানি স্থানে স্থানে দেবমন্দিরের
দুগ্ধ ও গঙ্গাজলধারায় সিক্ত হইয়া গিয়াছিল। তাহার গলদেশ বেষ্টন
করিয়া দেবতার পবিত্র নির্ম্মাল্য দুলিতেছিল। ঈষৎ হাসিয়া স্নিগ্ধস্বরে
মাধুরী বলিল, "যান্ সুস্থিরবাবু, শীঘ্র পূজা শেষ করুন।
আমাদের যাহা পূজা করিবার ছিল, শেষ করিয়াছি।"
সুস্থির কি শিহরিয়া উঠিল। ঠিক বুঝা গেল
না। কিন্তু সে দৃঢ়চরণেই মহাদেবের অর্চ্চনা করিতে অগ্রসর হইল,
ইহা সকলেই লক্ষ্য করিল।
বাড়ী ফিরিবার সময় রাজকুমার বন্ধুযুগলকে
সংক্ষেপে জানাইল যে, আর এক সপ্তাহমধ্যে তাহারা দেশে ফিরিবে।
মাধুরী শরীর এখন সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়াছে। দেরাদুনে যাইবার আর
প্রয়োজন নাই। বিশেষতঃ কয়েকটি জরুরী বৈষয়িক কার্য্যের ব্যবস্থার
জন্য তাহার আর এখানে বিলম্ব করা অসম্ভব।
সুস্থির নীরবে সমস্ত শুনিয়া গেল।
[
৭ ]
বারাণসীধাম
হইতে আসিয়া রাজকুমার তাহার ভবানীপুরের বাড়ীতে উঠিল। কলিকাতায়
কয়েকটা কাজ ছিল, তাহা সারিয়া তার পর দেশে যাইবে। মাতার নিকট
সেই মর্ম্মেই সে সংবাদ দিয়াছিল। কার্য্যানুরোধে মহাদেব আগেই
দেশে চলিয়া গেল। কিন্তু রাজকুমার সুস্থিরকে যাইতে দিল না।
কলিকাতার কাজ মিটাইয়া তাহারা একসঙ্গেই পল্লী-জননীর নিভৃত ক্রোড়ে
ফিরিয়া যাইবে, এইরূপ অভিপ্রায় প্রকাশ করিল। সুস্থির সে অনুরোধ
এড়াইতে পারিল না, ইচ্ছাও ছিল না। তাহার নিজেরও কোন বিশেষ প্রয়োজনবশতঃ
রাজকুমারের আতিথ্য উপস্থিত পরিত্যাগ করিবার বাসনা তাহার ছিল
না।
বাহিরের আলাপে ব্যবহারে তাহাদের হৃদয়ের ভাবোচ্ছ্বাস বিন্দুমাত্র
ব্যক্ত হয় নাই বটে, মুখের কথায়, অথবা ইঙ্গিতে কেহ কাহারও নিকট
ও পর্য্যন্ত ধরা দেয় নাই সত্য; কিন্তু কাগজ, কালি ও লেখনীর
সাহায্যে তাহাদের মধ্যে যে জিনিসটি ক্রমশঃ মূর্ত্তি পরিগ্রহ
করিয়াছে, তাহাকে পরিত্যাগ করিবার উপায় আছে কি। থাকিলেও হৃদয়
কি তাহার অনুমোদন করিতে পারে। ধূমায়মান বহ্ণিতে সুস্থির কি
নিজেই প্রচুর ইন্ধন যোগায় নাই। তবে।- সমস্যা ক্রমেই জটিল হইয়া
উঠিল। এখন আর কোনও মতেই নিশ্চেষ্ট থাকিবার উপায় নাই। সমস্ত
ব্যবস্থা ঠিক করিয়া সুস্থির পত্রযোগে মাধুরীকে জানাইয়া রাখিল
যে, অদ্য রাত্রি দশটার সময় রাস্তায় একখানি মোটরগাড়ী আসিয়া
দাঁড়াইবে, তাহার নির্দ্দেশমত চলিলেই অবিলম্বে পুরাতন, অপ্রীতিকর
বন্ধন হইতে উদ্ধারলাভ ঘটিবে। তার পর নূতন জীবন, নূতন আলোক।
তবে শিশু পুত্রের মায়া। - যদি তাহা সহ্য করিবার ক্ষমতা না
থাকে, তবে এইখানেই পূর্ণচ্ছেদ, যবনিকাপাত হওয়া কর্তব্য।
উত্তরে সুস্থির যাহা জানিতে পারিল, তাহাতে
সে আর কালবিলম্বের প্রয়োজন মনে করিল না। রাজকুমার আজ আহারাদির
পরই কার্য্যোপলক্ষে বর্দ্ধমানে যাইবে। সে আজ আর ফিরিতে পারিবে
না। সুস্থিরও বন্ধুর সহিত এক সময়েই বাটীর বাহির হইল। সেও এখন
বরাহনগরে ভগিনীর ওখানে যাইতেছে। তাহারও আজ বন্ধুগৃহে ফিরিয়া
আসা সম্ভবপর হইবে না। ভবিষৎ ভাবিয়াই কি সুস্থির এইরূপ সাবধানতা
অবলম্বন করিয়াছিল।
রাত্রি
তমোময়ী। ঘন নভোরেণুজালে সমগ্র কলিকাতানগরী, আচ্ছ্ন্ন হইয়া
গিয়াছিল। ফাল্গুন মাসেও শীত বেশ জোরেই পড়িয়াছিল! কয়েকদিন পূর্ব্বে
প্রবল বৃষ্টিপাত হইয়াছিল, সেজন্য শীত তাহার রাজত্বের অবসানকালেও
একবার জাঁকিয়া বসিয়াছিল। দূরে কোনও ঘড়ীতে রাত্রি দশটা বাজিবার
শব্দ বাতাসে মিলাইয়া গেল। ইহার অল্পক্ষণ পরেই একখানি মোটর
রাজকুমারের বাটীর সম্মুখস্থ পার্কের অনতিদূরে আসিয়া দাঁড়াইল।
থামিবার পূর্ব্বেই মোটর বাঁশী পাঁচবার বাজিয়া উঠিয়াছিল।
এক ব্যক্তি মোটরের দ্বার খুলিয়া নামিয়া
আসিল। তাহার গায় ওভারকোট, মাথায় নাইট্ক্যাপ্। মুখ ভাল করিয়া
দেখা যাইতেছিল না। একবার সে চারিদিকে চাহিয়া দেখিল, রাজপথ
জনশুন্য। কুজ্ঝটিকার ঘনান্ধকারে দুই হাতে দূরের কোন পদার্থ
দেখাই যায় না। লোকটি দ্রুতপদে রাজপথ অতিক্রম করিয়া রাজকুমারের
নিস্তব্ধ অট্টালিকার সম্মুখে আসিল। বাটীর সম্মুখদ্বারে না
গিয়া, অন্তঃপুরচারিণীদিগের বাহিরে আসিবার জন্য সে স্বতন্ত্র
দ্বার ছিল, তাহার কাছে গিয়া দাঁড়াইল। কপাটে কয়েক বার টোকা
দেবার পরই দ্বার মুক্ত হইল। সর্ব্বাঙ্গ শালে আবৃত একটি নারীমূর্তি
মুক্ত দ্বার পথে বাহিরে আসিল। আগন্তুক নীরবে অগ্রে চলিল, নারীমূর্তি
তাহার পশ্চাদ্বর্ত্তিনী হইল। মোটরের দ্বার খুলিয়া পুরুষ রমণীকে
ভিতরে প্রবেশ করিতে ইঙ্গিত করিল। রমণী মোটরে আরোহণ করিবামাত্র
পুরুষটিও সোফারকে গাড়ী চালাইতে বলিয়া স্বয়ং বিপরীত দিকের আসনে
বসিয়া পড়িল। সেই দারুণ শীতেও পুরুষটির শরীরে স্বেদধারা দেখা
দিল। জড়ের ন্যায়ে সে কিয়ৎকাল আপনার আসনে বসিয়া রহিল। সঙ্গিনী
নারীর সহিত কোনও রূপ বাক্যালাপের সামর্থ্য বোধ হয় তাহার ছিল
না।
মোটর হুহু শব্দে ছুটিয়া চলিয়াছে। কিয়ৎকাল
পরে যেন একটু প্রকৃতিস্থ হইয়া সে ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকিল, "মাধুরী!"
কোন উত্তর নাই। শুধু পরিধেয়-বস্ত্রের একবার খস্খস্ শব্দ সে
শুনিতে পাইল। সম্ভবতঃ চাপা দীর্ঘশ্বাসের শব্দও তাহার কানে
প্রবেশ করিয়াছিল। এ দীর্ঘশ্বাস কি স্বামী-পুত্র-ত্যাগ-কাতরার
হৃদয় হইতে উত্থিত হইতেছিল। উত্তেজনার বেগ কি এত শীঘ্রই কমিয়া
আসিয়াছে। পরিণামের চিন্তা কি এখনই অনুশোচনায় পরিণত হইল। অসম্ভব
নহে। সুস্থিরও তো মানুষ, তাহার হৃদয়-নামক পদার্থটি তো আছে।
সুতরাং এখন যে সদ্য গৃহত্যাগিনী নারীকে বিরক্ত করিবার কোনরূপ
চেষ্টা করিল না। এরূপ অবস্থায় মানুষ কি করিয়া থাকে, তাহার
নানা প্রকার কাহিনী সে অনেক গ্রন্থে পড়িয়াছে; কিন্তু সেরূপ
কোন ভূমিকা অভিনয়েরই চেষ্টা সে করিল না।
প্রায় পনের মিনিট পরে, নগরীর একাংশে একটি
নাতিবৃহৎ দ্বিতল অট্টালিকার সম্মুখে মোটর সহসা থামিল। সুস্থির
অমনই দরজা খুলিয়া গাড়ী হইতে নামিল। তারপর মৃদুস্বরে বলিল,
" মাধুরি, নেমে এস।"
মোটর-চালকও তখন পথে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল।
শীতের প্রভাব হইতে আত্মরক্ষার জন্যে সেও উত্তমরূপে টুপি আঁটিয়া
ও কম্ফর্টারের দ্বারা মুখমণ্ডল ঢাকিযা রাখিয়াছিল। কুজ্ঝটিকা
তখনও সমানভাবে রাজত্ব করিতেছিল। রাজপথের অপরপার্শ্বস্থ অলোকস্তম্ভ
হইতে গ্যাসলোক-শিখা সে স্থানের অন্ধকার কিয়ৎপরিমাণে সরাইয়া
দিয়াছিল।
প্রথম আহ্বানে মাধুরী নামিয়া আসিল না।
সে কী তবে শুনিতে পায় নাই। সুস্থির কম্পিত-কণ্ঠে আবার ডাকিল,
"মাধুরী, শীঘ্র নেমে এস!"
তখন নারীমূর্ত্তি গাড়ীর বাহিরে আসিল।
সুস্থিরের সম্মুখে দাঁড়াইয়া অকস্মাৎ সে গায়ের শাল ও অবগুণ্ঠন
খুলিয়া ফেলিল।
প্রেতযোনি দেখিলে মানুষ যেমন আতঙ্কে বিবর্ণ
ও স্তম্ভিত হয়, সুস্থিরের অবস্থা ঠিক তেমনই হইল। তাহার শরীরের
শোণিত প্রবাহ সহসা যেন থামিয়া গেল।
"বড় সাধে বাজ পড়িয়াছে; কেমন নয়,
বন্ধুবর।"
সে বিদ্রপে সুস্থির আহত হইল কি না বুঝা
গেল না; কিন্তু সে যে অত্যন্ত বিচলিত হইয়া পড়িয়াছিল, তাহা
তাহার কম্পিত চরণের দিকে লক্ষ্য করিলেই বুঝা যাইবে।
শ্লেষভরে রাজকুমার বলিল, "বন্ধুর
গৃহে থাকিয়া, তাহার আতিথ্যের মর্য্যাদা চমৎকারভাবে রাখিয়াছ!
আগে বিশ্বাস করিতাম না, বন্ধুর বুকে বন্ধু এমন ভাবে বিষের
ছুরী মারিতে পারে! তোমার বড় সুখে আজ হন্তারক হইয়াছি-কি। বড়
কষ্ট হইতেছে। কুলবধূকে ঘরের বাহিরে করিতে কি এতই আনন্দ।"
সুস্থির নির্ব্বাকভাবে তেমনই দাঁড়াইয়া রহিল।
মোটর-চালক দুই পদ অগ্রসর হইয়া সকৌতুকে
এই অভিনয় দেখিতে লাগিল।
কোন উত্তর না পাইয়া রাজকুমার উত্তেজিত-স্বরে
বলিল, "তোমার প্রথম পত্র পাইয়া আমার স্ত্রী তাহা আমাকেই
দেখাইয়াছিল।"
সুস্থির একবার চকিত হইয়া উঠিল, তারপর
যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করিল।
রাজকুমার সে দিকে লক্ষ্য না করিয়াই বলিয়া
উঠিল, "চিঠিখানা সে তাহার চরণে পিষ্ট করিয়াই ফেলিয়া দিয়াছিল,
সেই পত্রের উত্তর সে বাড়ীর দাসীর দ্বারাই দিবার ব্যবস্থা করিয়াছিল।
কিন্তু আমি তাহা করিতে দেই নাই। আমার মহা বিশ্বাস একেবারে
ভঙ্গিয়া গিয়াছিল সত্য, কিন্তু তোমার বিদ্যার দৌড় কতদূর, তাহা
পরীক্ষা করিবার প্রলোভন ত্যাগ করিতে পারি নাই। তাই আমারই নির্দ্দেশক্রমে,
আমার পত্নী তোমার সেই জঘন্য পত্রগুলির জবাব দিয়াছিল। পত্রের
ভাষা আমার, হস্তাক্ষর তাহার। এ অভিনয় অনেক আগেই শেষ করিবার
জন্য আমার স্ত্রী আমাকে পুনঃ পুনঃ অনুরোধ করিয়াছিল, কিন্তু
শেষ পর্য্যন্ত না দেখিয়া আমি নিরস্ত হইব না দেখিয়া, অগত্যা
তাহাকে আমার মতানুসারেই চলিতে হইয়াছিল। বন্ধুর অন্তঃপুরে স্থান
পইয়াও যে পাপিষ্ঠ সে বিশ্বাস রাখিতে জানে না, তাহার পাপের
দণ্ড কি, তাহা জানি না। তবে শুধু বিনা মার প্রহারে বা দ্বারবানের
গলা-ধাক্কায় যে সে অপরাধের কোনই প্রায়শ্চিত্ত হয় না, তাহা
ঠিক। একদিন যাহাকে পরমস্নেহে হৃদয়ে স্থান দিয়াছিলাম, তাহাকে
আরও কঠিন দণ্ড দেওয়া কর্ত্তব্য মনে করিয়াই এই ব্যবস্থা করিয়াছিলাম।"
সুস্থির মস্তক উন্নত করিয়া বলিল, "আমার
অপরাধের কোন কৈফিয়ৎ তোমায় দিব না। সে বিচার যিনি উপরে আছেন,
তিনিই করিবেন, কিন্তু আজ সত্যই আমি নিশ্চিন্ত। আমার মহাভ্রান্তি
আজ দূর হইয়াছে। তবে-" এই বলিয়া সে দ্রুতপদে মোটর-চালককে
টানিয়া আনিল। একটানে তাহার মাথার টুপি ও কম্ফর্টার খুলিয়া
লইয়া বলিল, "ইহাকে চিনিতে পার।"
গ্যাসলোক-শিখা মোটর-চালকের উপর পড়িয়াছিল।
রাজকুমার সবিস্ময়ে দুই পদ পিছাইয়া গেল। এ যে তাহারই সহধর্ম্মিণীর
অগ্রজ শ্রীশ।
দৃঢ়স্বরে সুস্থির বলিল, "এখন হয়
তো বুঝিতে পারিবে, তোমার স্ত্রীকে কুলত্যাগিনী করিবার অভিপ্রায়
আমার ছিল না। ভ্রান্তবিশ্বাসের বশেই ব্যাপরটা এতদূর গড়াইয়াছিল।
শেষে যখন বুঝিলাম, বাধা-বিঘ্ন না মানিয়া মন উদ্দামগতিতে ছুটিয়া
চলিতেছে, তখন তাহার ভ্রাতার সাহায্যে তাহাকে তাহারই পিত্রালয়ে
আনিবার ব্যবস্থা করিলাম। আমার মনে বিশ্বাস ছিল, স্বামী ও পুত্র
ত্যাগ করিয়া কোনও স্নেহশীলা নারী-কুলধর্ম্মের বহিরে যাইতে
পারে না। পথিমধ্যে অনুতাপ আসিয়া তাহার মনের গতি ফিরাইয়া দিবে।
তবে এ কথা আজ তোমার নিকট গোপন করিব না, মাধুরীকে আমি যথার্থই
শ্রদ্ধা করি, ভালবাসি। সেই শ্রদ্ধা ও ভালবাসাই তাহাকে আমার
হস্ত হইতে রক্ষা করিয়াছে। যদি নীচ-প্রবৃত্তি, কু-অভিসন্ধি
থাকিত, তাহা হইলে রাজকুমার, যথেষ্ট সুযোগ ঘটিয়াছিল, সেই অবকাশে
তোমার উচ্চমস্তক হয় তো এতদিন অনেক নিম্নে ঝুলিয়া পড়িত। আর
একটা কথা, হৃদয় লইয়া নিষ্ঠুর খেলা কখনও করিও না। হৃদয় ও আগুন
একই শ্রেণির অন্তর্গত। আগুন লইয়া খেলিতে গেলে খুব ভাল খেলোয়াড়েরও
গায়ে আঁচ লাগে, ফোস্কাও পড়ে।"
শ্রীশ বলিল, "কথাটা বড় ঠিক। সত্য
রাজকুমার, তোমার বুদ্ধির প্রশংসা আমি করিতে পারি না। বিলাতী
সভ্যতার নকল করিতে গিয়া আমরা অনেক সময় বিপদ্ বাড়াইয়া তুলি।
কাশ্মীরের দ্রাক্ষা বাঙ্গালার সমতল ক্ষেত্রে আজ পর্য্যন্ত
চাষ করিয়া কেহ সুফল দেখাইতে পারে নাই। সুস্থির আমাকে সব চিঠি
দেখাইয়াছে, সব খুলিয়া বলিয়াছে। আমার সুশীলা ভগিনী যে তোমার
হাতে পড়িয়া এমন দুঃশীলা হইয়া পড়িয়াছে, ইহা ভাবিয়া তাহার ও
তোমার উপর আমার মর্ম্মান্তিক রাগ হইয়াছিল। এখন দেখিতেছি, তুমিই
একটা প্রকাণ্ড বানর। রাগ করিও না। সত্যকথা বলা আমার চিরদিনের
অভ্যাস। নিজের সহধর্ম্মিণীকে দিয়া কোনও ভদ্রলোক যে খেলার ছলেও
পরপুরুষের নিকট এমনভাবে পত্র লিখাইতে পারে, পূর্ব্বে সে বিশ্বাস
আমার ছিল না। এ কি সর্ব্বনেশে খেলা! যাক্, এখন চল, বাড়ীর ভিতর
যাই। মা বাবা কিছুই জানেন না। বাহিরের ঘরে রাতটুকু থাকিবে
চল। আমাকে আবার কুমার বাহাদুরের মোটরটা এখনই রাখিয়া আসিতে
হইবে।"
সুস্থির মৃদুস্বরে বলিল, "আমার অপরাধ
গুরুতর; এখন তোমার কাছে সেজন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিতে গেলে
হয়তো তুমি তাহা উপহাস বলে মনে করিতেও পার। কিন্তু সত্য রাজকুমার,
আমি যা-ই হই, অপরাধকে ব'লে স্বীকার করিবার প্রবৃত্তি এখনও
হারাই নাই। আমার দোষ, - আমার অভদ্র ব্যবহার, যদি পার, মার্জ্জনা
করিও।"
রাজকুমার এতক্ষণ নীরবে কী ভাবিতেছিল।
সহসা দুই হস্তে সুস্থিরকে নিকটে আকর্ষণ করিয়া বলিল, "সে
কথা নয়। আমি ভাবিতেছিলাম, এ ব্যাপারের জন্য দায়ী কে। দোষ কাহার।-তোমার,
না আমার।"
পার্শ্বের বাড়ীর বাহিরের রোয়াকের উপর
কোন পথচারী, গৃহহীন ভিক্ষুক রাতটুকু কাটাইয়া দিবার অভিপ্রায়ে
ছিন্ন কম্বলে সর্ব্বাঙ্গ আবৃত করিয়া বসিয়াছিল। শীতের জড়তা
দূর করিবার জন্য সে গাহিতেছিল-
"দোষ কারো নয় গো মা-
স্বখাত সলিলে ডুবে মরি!"
শ্রীশ মাথা নাড়িয়া বলিল, "ঠিক। -
এখন চল, বড় ঠাণ্ডা!"