পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
পাষাণের
স্মৃতি
সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর
[
লেখক পরিচিতি : সুধীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দের ১৩ই
জুলাই ( ৩০শে আষাঢ়, ১২৭৬ ) জোড়াসাঁকোতে| পিতা দ্বিজেন্দ্রনাথ
ঠাকুর, পিতামহ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এবং মাতা সর্বসুন্দরী দেবী
| দ্বিজেন্দ্রনাথের চতুর্থ পুত্র সুধীন্দ্রনাথ মেট্রোপলিটন
ইনস্টিটিউশন থেকে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ১৫ বছর ৬ মাস বয়সে ২য়
বিভাগে এন্ট্রান্স এবং ১৮৮৮-তে তৃতীয় বিভাগে এফ.এ পাশ করেন|
এরপর প্রেসিডেন্সি কলেজে থেকে বি. এ. পাশ করেন ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে
| নবকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে চারুবালার সঙ্গে তার বিয়ে হয়
| সুধীন্দ্রনাথের পুত্র-কন্যাদের নাম রমা , এণা , সৌমেন্দ্রনাথ
, স্বরীন্দ্রনাথ ও চিত্রা | গান গাওয়া , অভিনয় ইত্যাদিতে রমার
খুব উৎসাহ ছিল ; গাইতে তেমন না পারলেও এণা বাঁশি ও সেতার বাজাতে
পারতেন ; সৌমেন্দ্রনাথ জড়িয়ে পড়েছিলেন রাজনীতির সঙ্গে, একটি
রাজনৈতিক দলও গঠন করেছিলেন তিনি ; ছোট মেয়ে চিত্রা নাচ , গান
ও অভিনয়ে যথেষ্ট পারদর্শিনী ছিলেন |
রবীন্দ্রনাথ 'জীবনস্মৃতি'তে লিখেছেন "বালকদের
পাঠ্য একটি সচিত্র কাগজ বাহির করার জন্য মেজ বউঠাকুরাণী বিশেষ
আগ্রহ করিয়াছিল| তাঁহার ইচ্ছা ছিল, সুধীন্দ্র বলেন্দ্র প্রভৃতি
আমাদের বাড়ির বালকগণ এই কাগজে আপন আপন রচনা প্রকাশ করে|"
১২৯২ বঙ্গাব্দের বৈশাখে সত্যেন্দ্র-পত্নী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর
সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাহিত্য পত্রিকা 'বালক'| বৈশাখ সংখ্যায়
'স্বাধীনতা (বালকের রচনা)' নামে সুধীন্দ্রনাথ প্রথম প্রবন্ধ
প্রকাশ করেন, তখন তার বয়স মাত্র ১৬ বছর| ১২৯৮-এর অগ্রহায়ণ
মাসে মাত্র ২২ বছর বয়সে সুধীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত
হয় সাহিত্য পত্রিকা 'বালক'| ৩ বছর কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পাদনার
কাজ পরিচালনার পর এই দায়িত্ব দ্রহণ করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ|
সুধীন্দ্রনাথের রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছে 'ধর্ম্মের অভিব্যক্তি
ও ব্রাহ্মসমাজ' ; 'দোলা' (কাব্য) ; 'মঞ্জুষা' (গল্প) ; 'মায়ার
বন্ধন' (উপন্যাস) ; 'দাসী' (কবিতা) ; 'চিত্ররেখা' (ছোট গল্প)
; 'বৈতানিক' (কাব্য) ; 'করঙ্ক' (গল্প) ; 'প্রসঙ্গ' ; 'চিত্রালি'
(গল্প) ইত্যাদি| 'সাহিত্য' , 'ভারতী' , 'প্রবাসী' প্রভৃতি
মাসিক পত্রিকায় সুধীন্দ্রনাথ নিয়মিত লিখতেন | ১৯২৯ খৃষ্টাব্দের
৭ই নভেম্বর (২১শে কার্তিক ১৩৩৬) তার মৃত্যু হয়|]
দীপক
সেনগুপ্ত |
আমি পাষাণ | ভগবান কেন আমায় পাষাণ করলেন ? তার বদলে আমাকে
যদি দু'টি ছোট ছোট হাত দিয়ে পাঠাতেন তাহলে আমি তাকে জড়িয়ে ধরে'
থাকতুম , দেখতুম মৃত্যু কি করে' তা'কে আমার হাত থেকে ছিনিয়ে
নিত ! কিন্তু আজ তার চিহ্ণমাত্রও নেই , কেবল আমি আছি - কত লোকের
পায়ের ধূলোকাদা বুকে ক'রে আমি এই নদীর ধারে প'ড়ে আছি | আমি ঘাটের
পাষাণ , কিন্তু তাই বলে আমি কোন কথা ভুলিনি - সব আমার মনে আছে
, আমার এই কঠিন বুকের মাঝখানে সে সব কথা খোদাই করা রয়েছে | সে
সব পুরান দিনের একটা জীবনের কথা তোমরা কি কেউ শুনতে চাও ? যদি
চাও , এইখানে একটু বোস | তোমাদের কাছে সে কথা বলে' মনটা একটু
হাল্কা করি |
ফাল্গুন
মাসের শেষে বসন্তের ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে | অশোক আর শিরিষের গাছে
গাছে নতুন ফুল , নতুন পাতা | পাহাড়ের উপরকার চাঁপা আর শালফুলের
ঘনগন্ধে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে | সেদিন দোলপূর্ণিমা | ফাগের গুঁড়োয়
সমস্ত বনভূমি লালে লাল - আকাশ শুদ্ধ লাল হবার উপক্রম | সেদিন
সমস্ত লোক আনন্দ করতে চলে গেছে | উপরে আছে শুধু পূর্ণিমার চাঁদ
আর নীচে পাষাণ আমি | চারিদিকে গভীর শান্তি | কেবল বাতাস দূর
থেকে আনন্দের ক্ষীণধ্বণি ব'য়ে নিয়ে আসছিল | সে ধীরে ধীরে এসে
আমার এই বুকের কাছে বসল | অনেকক্ষণ দুই হাতের উপর মাথা রেখে
স্তির হয়ে বসে' রইল ,- তারপর আমাকে আপন মনে বলতে লাগল , "
যাক সকলে আমাকে ছেড়ে দিল , আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সবাই গেল
, এখন আমার আর কেউ নেই ,- কিছু নেই , শুধু এই তুলি আর রঙ |"
সে
ছিল চিত্রকর | বয়স তার খুবই অল্প | কাঁচা বাঁশের মত তা'তে তখনও
ঘুণ ধরেনি , তাই সে শিশুর মত সরল , শিশুরই মত কোমল তার হৃদয়
ছিল | তা'র বাপ মা কেউ ছিল না | দূর-সম্পর্কের এক মামার বাড়িতে
সে থাকত| তার চিত্রকলার উপর মামার কিছুমাত্র আস্থা ছিল না |
তিনি ও-সব পাগলামি বলে জানতেন | তাই তিনি তাকে এ-সব ছেড়ে আইন
শিখতে পরামর্শ দিলেন , - সংসারে থাকতে গেলে যে , শুধু কল্পনা
দিয়ে চলে না , পয়সারও দরকার হয় , একথা তাকে জানিয়ে দিতেও ত্রুটি
করলেন না | কিন্তু সে আজ নয় কাল নয় এই রকম করে কিছুদিন কাটিয়ে
দিল | শেষে একদিন তার মামা তাকে জোর করে বললেন -"দেখ ,
আর দেরি করা যায় না , তুমি আইন পড়তে আরম্ভ করবে কিনা বল ?"
-সে বললে , " মামা আমি তো তা পারব না ,আমার আদর্শকে কোনমতে
ছাড়তে পারব না |" রেগে উঠে মামা বললেন , তবে তুমি তোমার
আদর্শ নিয়েই থাক -"আমার বাড়িতে তোমার আর জায়গা হবে না |"
সেই দিন সে তার যা' ছিল -অল্প কিছু টাকা , আঁকবার সরঞ্জামগুলি
ও দুই একটি কাপড় নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল | এসে যে আমারই বুকের উপর এইখানে
বসেছিল |
ঐ
যে খুব কাছে পারের উপর একটা বাবলা গাছ দেখছ , ঐখানে একটা ছোট
ভাঙা কুটীর ছিল | তরুণ চিত্রকর ঐ ভাঙা ঘরটা ভাড়া নিল | ঐখানে
একলা বসে বসে সে কেবল ছবিই আঁকত |
দেখতে-দেখতে
তার হাতের সব পয়সা ফুরিয়ে এল | প্রথম প্রথম দিন কতক সে ধারধোর
করে চালাল , কিন্তু লোকে ক'দিন আর ধার দেবে বল ? শেষে তার অবস্থা
খুবই খারাপ হয়ে পড়ল | তখন সে একটি একটি করে তার ছবি বিক্রি করতে
লাগল |
হেমন্তের
শেষে সেদিন সকাল বেলায় কুটীরের সম্মুখের খোলা জায়গায় বসে চিত্রকর
একমনে ছবি আঁকছিল | এমন সময় একটি ছয় বৎসরের ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে
সেখানে এসে উপস্থিত হল | কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চিত্রকরের মুখের
উপর তার বড় বড় কালো দুটি চোখ তুলে সে বলে উঠল , " তুমি
ছবি আঁক ?"
চিত্রকর
চমকে উঠে মেয়েটির মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ; হাতে তুলি
রেখে , দুই হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে কোলের উপর বসিয়ে বলল , "
হ্যাঁ মা , আমি ছবি আঁকি | তুমি কে? "
"আমার নাম পুষ্প | আমি মামার সঙ্গে এখানে ছোটমাসির বাড়ি
বেড়াতে এসেছি | এখানে এখন থাকব | আচ্ছা , তুমি আমার ছবি আঁকবে?"
চিত্রকর মেয়েটির মুখখানি বুকের উপর চেপে ধরে আদর
করে বলল , " হ্যাঁ মা , আমি তোমার ছবি আঁকব | রোজ এমনি
সময়ে তুমি একবার এসে | "
মেয়েটি
রোজই আসতে লাগল , চিত্রকর তার ছবি আঁকতে আরম্ভ করল|
চিত্রকর রোজই সকাল সন্ধ্যায় একবার আমার কাছে এসে
বসত ; চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কি ভাবত ,
তারপর ধীরে ধীরে আবার চলে যেত |
শীতকাল এসে পড়ল | সে রকম দুরন্ত শীত কখনও পড়ে নি
| সন্ধ্যাবেলায় দ্বাদশীর চাঁদ দু'টো আমড়াগাছের মাঝখান দিয়ে উঁকি
মারছিল| সে এসে আমার কাছে বসল | তার শরীর সেদিন বড়ই অবসন্ন |
গায়ে কোন রকম কাপড় নেই | সেই দারুণ শীত একেবারে তার বুকের হাড়ের
মধ্যে ঢুকে তাকে হিঁ হিঁ করে কাঁপিয়ে তুলছিল | খানিকক্ষণ বসে
থেকে দু'হাত বুকে চেপে ধরে সে বলে উঠল , " এল না , আর সে
এল না , ছবি নিয়ে গেল না ! -পারি নে , ওগো আর পারি নে |"
সে দিন সে আর বেশিক্ষণ বসতে পারল না , শীঘ্রই উঠে গেল |
তারপর
থেকে তাকে আর দেখতে পেতুম না | রোজ সে যে সময় আসত সে সময় চলে
গেল -তারপর আরও কতদিন চলে গেল | সে আর এল না|
সে
দিন শেষবেলার পড়ন্ত রৌদ্রে আমার বুক পুড়ে যাচ্ছিল | আমি নদীর
জলের দিকে তৃষার্তের মত হাঁ করে তাকিয়ে পড়ে ছিলুম | হঠাৎ দূরে
পায়ের শব্দ শুনলুম | আমার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল | এ কার পায়ের
শব্দ ? একি সে ? ! -না , এ যে বাড়িওয়ালা | একে আমি খুবই চিনি
, পাশের গ্রাম থেকে , মাঝে মাঝে চিত্রকরের কাছে এসে তাকে এমনি
ভৎর্সনা করে যে , তার চোখ দিয়ে জল পড়তে বাকি থাকে , তার ছ'মাসের
ভাড়া পাওনা ; -কিন্তু আজ তার একি চেহারা !
চলতে
চলতে বাড়িওয়ালা বলতে লাগল , " আর এমন করলে চলবে না -একটা
না একটা কিছু না করে আজ ফিরছি নে |"
বাড়িওয়ালা
কুটীরের দাওয়ার উপর উঠল -তখনি আবার দু'হাত পিছিয়ে এল | একটা
ছেঁড়া মাদুরের উপর জীবন্ত কঙ্কাল চিত্রকর বসে -তারই হাতে আঁকা
একটা মেয়ের ছবি | চিত্রকরের হাতের তুলি তখনও ভিজে | বাড়িওয়ালা
আস্তে আস্তে এসে ছবিখানি দুই হাতে তুলে ধরে বুকের উপর চেপে ধরল
| তার সর্ব্বাঙ্গ তখন থরথর করে কাঁপছিল | চিত্রকর চমকে উঠে তার
কালিমাখা দুই চোখ তুলে বাড়িওয়ালার মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে
রইল | বাড়িওয়ালার আকুল স্বরে বলে উঠল; , " বল, বল, কেমন
করে তুমি ' বুড়িকে ' চিনলে ? কেমন করে এ ছবি আঁকলে ? এ যে আমারই
বুকের ধন , হারিয়েছি , হারিয়েছি -ক'দিন হল আমার বুক খালি করে
চলে গেছে |" চোখের জলে ছবিখানা ভিজে গেল |
চিত্রকরের
তুলির রঙ শুকিয়ে এল | এক সন্ধ্যায় অবসন্ন দেহে আমারই বুকের উপর
এসে সে ঘুমিয়ে পড়ল , আর জেগে উঠল না |
(১৩২৫
বঙ্গাব্দের বার্ষিকি 'পার্ব্বণী' পত্রিকায় প্রকাশিত) |
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)