প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

ভাঙ্গা বাঁশী
এস. ওয়াজেদ আলি

        [ লেখক পরিচিতি : এস. ওয়াজেদ আলি ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দের ৪ঠা সেপ্টেম্বর হ্গলীর বড়তাজপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন| মাদ্রাসায় শিক্ষা শুরু হলেও ১৮৯৮ সালে তিনি শিলং-এ চলে আসেন এবং বাবা বেলায়েৎ আলীর কাছে পড়াশোনা শুরু করেন| কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এনট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং আলিগড় মেয়ো কলেজে ভর্তি হয়ে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯০৮ সালে আই.এ এবং ১৯১০-এ বি.এ ডিগ্রি লাভ করেন| অনেক বাধা সত্বেও তিনি লণ্ডনে গিয়ে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বার-এট-ল হয়ে ১৯১০ সালে এদেশে ফিরে আসেন এবং কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন| ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত তিনি প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে কাজ করেছেন|
'সবুজপত্র'-এর সম্পাদক বন্ধু প্রমথ চৌধুরীর পরামর্শে ওয়াজেদ আলি বাংলায় সাহিত্য চর্চা শুরু করেন| ইংরাজি ও বাংলা ভাষায় তার মোট ২০টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে| ১৯৩২ সালের ডিসেম্বর মাসে (অগ্রহায়ণ ১৩৩৯) তিনি 'গুলিস্তাঁ' নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন| পত্রিকাটির শীর্ষদেশে ছাপা থাকত -"প্রগতিশীল সচিত্র মাসিক মুখপত্র"| পত্রিকার চতুর্থ বার্ষিকীতে মহম্মদ সিদ্দিকি পত্রিকার আদর্শ তুলে ধরে বলেছেন -"আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হিন্দু-মুসলমানের মিলন এবং একমাত্র লক্ষ্য বৃহত্তর এক সম্মিলিত জাতির সৃষ্টি"| বহু বিশিষ্ট লেখক তাদের রচনা দিয়ে পত্রিকাটিকে সমৃদ্ধ করেছেন| চলচ্চিত্র সম্বন্ধে আলোচনা করতেন প্রখ্যাত অভিনেতা ছবি বিশ্বাস|

        ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে ওয়াজেদ আলি বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনের সাহিত্যশাখার সভাপতি হন| তার রচিত গ্রন্থ : "মহম্মদ মহসীন"; "গুলদস্তা"; "মাশুকের দরবার"; "দরবেশের দোয়া"(১৩৫১); "ভাঙ্গা বাঁশী"; " ভবিষ্যতের বাঙ্গালী" (১৯৪৩); "মুসলিম সংস্কৃতির আদর্শ"; "জীবনের শিল্প"; "খেয়ালের ফেরদৌস"; "আকবরের রাস্ট্র সাধনা" (১৯৪৯); "ইসলামের পয়গম"; "সভ্যতা ও সাহিত্যে ইসলামের অবদান"(১৩৫৫); "প্রেমের মুসাফির"; "ভারতবর্ষ"; "প্রাচ্য ও প্রতীচ্য"(১৩৫০); "পশ্চিম ভারতে"(১৩৫৫); "সুলতানের মানদীন"(নাটক); "বাদশাহী গল্প" (১৩৫১); "গল্পের মজলিশ" (১৩৫১); "ইরানের তুরানের গল্প"; "গ্রানাডার শেষ বীর" (১৩৪৭) ইত্যাদি|
       ১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই জুন ঝাউতলায় নিজের বাড়ীতে এস. ওয়াজেদ আলি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন|]

দীপক সেনগুপ্ত|


       কার্য্যান্তরে গমন হেতু আমার Bar Library যাওয়া আসা এক রকম বন্ধ হয়ে গেল, যে সব বন্ধুদের মুখ প্রত্যহ দেখতুম, তাঁরা অতীতের স্মৃতির সঙ্গে মিশিয়ে গেলেন| অনেকের কথা একরকম ভুলেই গেলাম| দুই চারিজনের ছবি স্মৃতিপটে অপেক্ষাকৃত স্পষ্টভাবে আঁকা রইল| এক মহাজন বন্ধু কিন্তু আমার মনের চিত্রাগারে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রইলেন তাঁকে রায়সাহেব বলেই পাঠকের নিকট পরিচয় দিব|

         রায়সাহেবকে স্মরণ রাখবার আমার অনেকগুলি বিশেষ কারণ ছিল| তিনি যে কেবল তাঁর সমসাময়িক ব্যারিষ্টারদের মধ্যে একজন successful লোক ছিলেন তা নয়| তা হলে এ প্রসঙ্গের অবতারণা আজ করতুম না| তাঁর মত উচ্চমনা এবং কোমলহৃদয় লোক কৃতকার্য্য ব্যাবহারজীবদের মধ্যে আর কাহাকেও দেখেছি বলে মনে হয় না| জুনিয়ারদের প্রতি তাঁর বিশেষ একটা টান ছিল, আর যখন সম্ভব হয়, তাদের সাহায্য না করে তিনি থাকতে পারতেন না| সমস্ত Bar Library-র ভিতর তিনিই আমার প্রতি একটু আন্তরিক সহানুভুতি দেখিয়েছিলেন| আমি বড় নির্জ্জনপ্রিয় ছিলুম| Library-তে আমার নিজের কোণে বসে থাকতুম, কারও সঙ্গে বড় কথা-টথা কইতুম না| আমার প্রতিও কোন প্রতিপত্তিশালী ব্যারিষ্টার বড় একটা ভ্রুক্ষেপ করতেন না| আমার একটু লেখার অভ্যাস গোড়া থেকেই ছিল| একদিন একটি ইংরাজি কাগজে আমার একটা লেখা বেরুলো| লেখাটি বোধ হয় ভালই হয়েছিল| কারণ সেটা বেরোবার দুই চারিদিন পর রায়সাহেব নিজেই এসে আমার সঙ্গে প্রবন্ধটি নিয়ে আলাপ জুড়ে দিলেন, আর উৎসাহ বাড়াবার জন্যে বেশ দুই চারিটি মিষ্ট কথা আমায় বল্লেন| আমি তাঁর মত লোকের প্রশংসা শুনে বড় আপ্যায়িত হলুম| এর পর রায়সাহেব দুই একটি ব্রিফ (Brief) ও আমায় পাঠিয়ে দেন| এইসব কারণে তাঁর প্রতি আমার আন্তরিক একটা টান ছিল|

         রায় সাহেবের করুণ এবং উদার হৃদয়ই যে কেবল লোককে তাঁর দিকে আকৃষ্ট করতো তা নয়| তাঁর মত সুপুরুষ Bar Library-তে দ্বিতীয়টি ছিল না| তাঁর চেহারা তাঁর মনের উচ্চতা সুন্দররূপে ব্যক্ত করতো| তাঁর শরীরটা ছিল অতি সুগঠন এবং বাহুল্যবর্জ্জিত| আর তাঁর মুখাকৃতির মধ্যে একটা classical সামঞ্জস্য ছিল যা আমাদের এই মেলেরিয়া-প্রপীড়িত এবং অম্লরোগ-নির্যাতিত বাঙ্গালা দেশে কচ্চিৎ দৃষ্ট হয়ে থাকে| তাঁর উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ তাঁর ক্ষোদিত প্রস্তুর মূর্ত্তির মত মুখটিকে অমন একটি আড়ম্বরশূণ্য সৌন্দর্য দিয়েছিল যা দেখে রং-এর ছটা একটা vulgar জিনিসবলে মনে হত| আর সবের উপরে তাঁর উজ্জ্বল মেধাব্যঞ্জক চক্ষু দুটির মধ্যে একটা করুণ বিষাদের ভাব ছিল যা দেখে মনে হত তাদের অন্তরালে ভাবের কোন সুন্দর এবং বিচিত্র খেলা চলেছে| তাঁর ঋজু গঠন, উন্নত গ্রীবা এবং কর্ত্তৃত্বব্যঞ্জক হাব-ভাব কিন্তু একথাও প্রকাশ করতো যে জগতে উচ্চ হবার অভিলাষ অর্থাৎ ambitionও তাঁর মধ্যে যথেষ্ট মাত্রায় বিরাজ করছে| এই ভাবটি কিন্তু তাঁর চোখ দুটির এবং মুখের কবিত্বময় ভাবের সঙ্গে ঠিক খাপ খেত না| তিনি এই জন্য কখন কখন একটি মূর্ত্তিমান প্রহেলিকার মত দেখাতেন| তাঁকে দেখে মনে হতো তাঁর অন্তরে লক্ষী-সরস্বতী মধ্যে অহরহঃ এক দ্বন্দ্ব চলেছে, আর সেই দ্বন্দ্ব তাঁর জীবনকে শান্তিশূণ্য করেছে|

       যেদিন হাইকোর্ট ছাড়লুম সেইদিন থেকে তাঁর সঙ্গে দেখাশুনাও বন্ধ হল| মধ্যে মধ্যে তাঁর বাড়িতে দেখা করবার সঙ্কল্প করতুম, কিন্তু সেটা কার্য্যে পরিণত হত না| Bar ছাড়বার দুই বৎসর পর একদিন সন্ধ্যার সময় Eden Garden এ বেড়াতে গিয়েছি| Bar Standএর নিকট পদচারণা করতে করতে হঠাৎ দেখলুম একটি বেঞ্চে রায়সাহেব একেলা বসে আছেন| নিকটে গিয়ে অভিবাদন করলুম| আমার সঙ্গে সেই অপ্রত্যাশিত সাক্ষাতে তিনি বড়ই আনন্দিত হলেন| কুশলাদি জিজ্ঞাসার পর বল্লেন, "অনেকদিন পর আজ তোমার সাথে দেখা হল; এস, একটু বেড়ান যাক|" আমি আনন্দে সম্মতি দিলুম| দুইজনে তখন Garden ছেড়ে মাঠে নামলুম| রায়সাহেব বল্লেন, "আমি Practice ছেড়ে দিয়েছি শুনেছ?" আমি আশ্চর্য্য হয়ে বল্লুম, "আপনি অমন লাভের Practice এত শীঘ্র কেন ছাড়লেন?" আরও ৭/৮ বৎসর তো অনায়াসে কাজ করে যেতে পারতেন|"

      একটা ক্ষীণ হাসি হেসে রায়সাহেব বল্লেন, "কোর্টের ভণ্ডামি আর ভাল লাগে না|" আমি বল্লুম "আইনের ব্যবসার মত বৃহৎ ব্যবসাকে আপনি ভণ্ডামি বলেন! আমাদের ব্যারিষ্টার ভাইয়েরা শুনলে বলবে কি?"
রায়সাহেব-"চুলোয় যাক তোমার ব্যারিষ্টার ভাইয়েরা| প্রত্যহ সত্যকে মিথ্যা বানাতে বানাতে, রামের ধন শ্যামকে দিতে দিতে, আরো কালোকে ধলা সাজাতে সাজাতে আমার নিজের উপর একটা বিজাতীয়া ঘৃণা জন্মে গিয়েছিল| Practice ছেড়ে তবু একটু শান্তি পেয়েছি| ভগবান কি এই অদ্ভুত ব্যাভিচারের জন্যই মানুষকে তার প্রতিভা দিয়েছেন?”

        অনুমোদনের প্রবৃত্তিটা দমন করে আমি বল্লুম "কেন, সকলেই ত অমন পাপ করে আসছে| ঐ দেখুন C সাহেব| তিনি বলেন, "আইনের বই ছাড়া অন্য বই পড়ার মত পাপ পৃথিবীতে আর নেই| আইনের বইয়েতে ধর্ম্ম, নীতি, সাহিত্য রাজনীতি সবই আছে| লোকে যে কেন আইনের অত সব মহা মহা Standard বই আর সর্ব্বজন মান্য authoriitative decisions থাকতে অন্য রকম সাহিত্যের দিকে আকৃষ্ট হয় তা আমি বুঝতে পারি না|"
সি (C) সাহেবের এই উক্তি শুনে রায় সাহেবের মুখে এমন একটা ঘৃণার ভাব প্রকটিত হয়েছিল, যা, সে সময়ে কোন Leonordo da Vanci কিম্বা Van Dyke থাকলে আর্টে অমর করে যেতে পারতেন| আর C সাহেবের প্রতি তিনি যে বিশেষণটির প্রয়োগ করলেন, সেটি ছাপাবার মানসিক কিম্বা নৈতিক সাহস আমার নাই| উত্তেজিত কণ্ঠে আমায় তিনি বল্লেন "আমাকেও কি তুমি ঐসব লোকেদের মধ্যে গণ্য কর?"

        আমি একটু কুণ্ঠিত হয়ে বল্লুম "ক্ষমা করবেন| আপনাকে আমি যে চক্ষে দেখি Bar এর আর কাকেও সে চক্ষে দেখি না| আমাদের সমব্যবসায়ীদের মতের কথা আপনাকে বলেছিলুম মাত্র; তুলনার উদ্দেশ্য আমার ছিল না|"
রায় সাহেব - "সম ব্যবসায়ীদের আর তাদের মতের কথা আমায় বলোনা| আমি তাদের যথেষ্ট দেখেছি, আর তাদের মতও যথেষ্ট শুনেছি| ওসব দুঃস্বপ্ন যত শীগগীর ভুলতে পারি ততই ভাল| আমার জন্ম হয়েছিল অন্য কাজের জন্য| কেবল লোভে পড়ে আর পৃথিবীর একজন বড় মানুষ হবার নীচ প্রবৃত্তির প্ররোচনায় আমি হৃদয়ের অঙ্গুলি সঙ্কেতকে তাচ্ছিল্য করে এই soul desturctive (আত্মঘাতী) ব্যবসায় যোগ দিয়েছিলুম| স্বকৃত এই মহাপাপের শাস্তিও আমি পেয়েছি| আমার সমস্ত জীবন একটা প্রকাণ্ড মরুভূমির মত নিষ্ফল হয়েছে|"

      আমি বল্লুম “আপনার জীবন নিষ্ফল হয় নি| আপনার দ্বারা অনেক লোক উপকৃত হয়েছে|”

      রায়সাহেব – “সেসব কি আমার ব্যারিস্টারি না করলে হত’না? আসল কথা তা নয়| আমি জন্মেছিলুম আর্টের জন্য আর সাহিত্যের জন্য| আমি যদি আর্ট কিম্বা সাহিত্য নিয়ে থাকতুম তাহলে জগৎকে স্থায়ী কিছু দিয়ে যেতে পারতুম| কিন্তু নীচ স্বার্থের পথে গিয়ে আমি আমার হৃদয়ের প্রেরণাকে তাচ্ছিল্য করেছি, আর আমার শ্রেষ্ঠ সম্পদকে হেলায় নষ্ট করেছি|”

       এই কথাগুলি বলতে বলতে ভাবাবেশে রায় সাহেবের চক্ষু দুটি জ্বলতে লাগলো| আমি কি উত্তর দিব কিছু ঠিক করতে পারলুম না| কেবল বল্লুম, "আপনাকে দেখলে আর আপনার কথা শুনলে আপনি যে একজন artist সে বিষয়ে কারও সন্দেহ থাকেনা|"

       আবিষ্টের ন্যায় রায় সাহেব বলতে লাগলেন "শুন, আবদুল্লা, আমার কথা শুন| হুগলি জিলার এক সঙ্গতিপন্ন জমিদার গৃহে আমার জন্ম| অতুল বিভবের অধিকারী না হলেও আমার বাবা বেশ একজন বিত্তবান লোক ছিলেন| তাঁর প্রকৃতি অত্যন্ত ambitiouns এবং সম্মানলোভী ছিল| সরকারের বড় বড় জমিদারদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে তিনি বড় ভাল বাসতেন আর নানাবিধ কাজে অংশ নিয়ে দেশের লোকের এবং সরকারের কাছে প্রতিপত্তি বাড়াবার চেষ্টায় সর্ব্বদা তিনি ব্যস্ত থাকতেন| শেষ জীবনে তিনি রাজসরকার থেকে রায়বাহাদুরের উপাধিও পেয়েছিলেন| আমি ছিলুম তাঁর একমাত্র সন্তান| তাঁর ভবিষৎ আশা ভরসা তিনি সব আমার উপরই ন্যস্ত করেছিলেন| আমি কবে হাইকোর্টের বেঞ্চে বসবো, কিম্বা Advocate General এর গাউন পরব, সেই সুদিনের স্বপ্নে তিনি বিভোর হয়ে থাকতেন|"

        আমার মা কিন্তু ভিন্ন প্রকৃতির লোক ছিলেন| বাঙ্গলা সাহিত্যে তাঁর বিশেষ অভিজ্ঞতা ছিল| আর তাঁর প্রাণে যথেষ্ট কবিত্ব ছিল| ভাবাপূর্ণ সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখে তিনি বন্ধু-বান্ধবদের পড়ে শুনাতেন| প্রকৃত সৌন্দর্য্যমোদীর মত তাঁর সৌন্দর্য্য জ্ঞান আমাদের বাড়ির প্রত্যেক জিনিষের মধ্যে প্রকটিত হতো| ঘরের সাজ-সজ্জা, আসবাব পত্রের বিন্যাসের ধরণ, জিনিষ পত্রের পারিপাট্য ফার্ণিচারের বাহুল্যহীন সুরুচিসম্মত গঠন আমার মার সৌন্দর্য্যানুভুতির কথা স্পষ্টাক্ষরে প্রকাশ করতো| বাবার স্থূল প্রকৃতির মধ্যে কিন্তু এসব একেবারেই স্থান পেতনা| তিনি বেশীর ভাগ সময় বাইরের ঘরে থাকতেন আর সেখানে নিজেকে আড়ম্বর, ধূমপান এবং জাঁকজমকে পরিবৃত রাখতে ভালবাসতেন| প্রকৃত taste এর তিনি বড় ধার ধারতেন না| আর কবিতা দেবীর অঙ্গনে কখনও ভুলেও পা দিতেন না| তাঁর অনিচ্ছাবশতঃই মার কবিতাগুলি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় নাই| আমার মা বিনা অনুযোগে বাবার আদেশ এবং ইচ্ছা শিরোধার্য্য করতেন| কিন্তু তাঁর মুখ দেখে তাঁর আন্তরিক দুঃখের কথা আমি স্বচ্ছন্দে বুঝতে পারতুম|

        "আমাতে আমার বাবার এবং মায়ের দুই বিভিন্ন এবং পরস্পরবিরোধী প্রকৃতির একটা সামঞ্জস্যহীন মিলন ঘটেছিল| প্রবল এক সৌন্দর্য্য পিপাসা আমার মনে ছেলেবেলা থেকে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করে এসেছে| কিন্তু তার সঙ্গে ambition এবং খ্যাতি প্রতিপত্তির আকাঙ্খাও আমার প্রাণকে বাল্যকাল থেকে চঞ্চল করে রেখেছে| কেবল অল্পদিন থেকে এই শেষোক্ত বৃত্তির তাড়না আমি অনুভব করিনি|

        "আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েই সরস্বতী নদী প্রবাহিতা| নদীর পাশে একটা বড় মাঠ আছে| ছেলেবেলায় নদীর তটে আর মাঠের মধ্যে খেলা করতে আমি বড় ভালবাসতুম| তখনকার কথা মনে হলে শরীর এখনও পুলকে শিউরে উঠে| মাঠে রাখাল বালকদের সঙ্গে হা-ডু-ডু, ঘোল ঘোল, ধাসা প্রভৃতি খেলার স্মৃতি এখনও আমার মনে জেগে আছে|

        "ক্ষীণাঙ্গিনী সরস্বতী যখন বর্ষায় জলে দুকুল ডুবিয়ে সমুদ্রের পথে ছুটতো, আমার খেয়ালও তখন তার সঙ্গে তার সুদুর অভিসারের পথে ভেসে যেতো| গাছে যখন কোকিল ডাকতো, আর বউ কথা কও পাখী যখন তার সোনার পোষাক পরে ঝোপের ভিতর থেকে অবিরাম ভাবে তার বউয়ের কাছে তার মিনতি জ্ঞাপন করতো, তখন আমার মনে হতো পৃথিবী কি সুন্দর| এখানে আছে কেবল আনন্দের সঙ্গীত, সোহাগের মিনতি আর প্রেমের আব্দার| পায়রার দল যখন ক্ষেতে বসে আহার করতো তখন তাদের পালকের বর্ণচ্ছটা, তাদের লাল ঠোঁটগুলির সুললিত গঠন, আর তাদের রাঙ্গা পায়ের তালবদ্ধ গতি কি অপূর্ব্ব আনন্দে মনকে অভিষিক্ত করে দিত|

       "আবার সন্ধ্যার সময় শ্মশানের সঙ্গীহীন তেঁতুল গাছটির মধ্যে কত ভূত প্রেতের খেলাই না আমি দেখতুম, আলেয়ার গতিশীল আকস্মিক জ্যোতি তখন কত রোমঞ্চক ভাবই না আমার মনের মধ্যে জাগিয়ে দিত|

       "মাঠের মাঝখানে দিয়ে যে পথ চলে গেছে, সেই পথে সকালে চাষীদের গিন্নি বউয়েরা চেঙ্গারী মাথায় করে হাটে বাজারে যেতো; পথিকেরা Canvas এর ব্যাগ হাতে করে ছোট ছোট নারকুলি হুকা টানতে টানতে সেই পথ দিয়ে তাদের কার্য্যক্ষেত্রে যেতো; নিষ্ঠাবান গ্রাম্য রমণীরা দলবদ্ধ হয়ে গল্প করতে করতে সেই পথ দিয়েই আবার গঙ্গাস্নানে যেতো| আমি গাছের আড়ালে বসে তাদের সব দেখতুম, আর ভাবতুম|" কোথা থেকে তারা আসে আর কোথায় তারা যায়; কাদের তারা গিন্নী, আর কাদের তারা বউ; তাদের ঘরগুলো কেমন কেমন, আর তাদের দিনগুলো কেমন করে কাটে; এই সব কথা ভাবতে ভাবতে আমি একেবারে তন্ময় হয়ে উঠতুম|

         "রাত্রে আমাদের বাড়ির উঠানে রূপকথার বৈঠক হতো| পাড়ার সব ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা সেখানে জড় হতো| বড় একটা মাদুর বিছিয়ে আমরা সব তাতে বসতুম; আর মা, দিদিমা এবং আর আর প্রাচীনাদের জিদ করে গল্প বলতে বাধ্য করতুম| ছেলেবেলায় সেইসব কথা-কাহিনী শুনে যে আনন্দ পেয়েছি এখন Hamlet আর Faust পড়ে তার শতাংশের একাংশও পাই না| সেই তীব্র অনুভুতি এখন চলে গেছে| সুখের কথা শুনে প্রাণ আনন্দে তেমন আর নাচে না; দুঃখের কাহিনী চোখ দিয়ে সেই অশ্রুর বন্যা আর বহায় না| বাল্যের সেই কোমল দরদী হৃদয় সংসারের ঘাত প্রতিঘাতে এখন পাষাণের মত কঠিন হয়ে পড়েছে|"

         আমি প্রতিবাদ না করে এখানে থাকতে পারলুম না, বল্লুম "আপনার হৃদয়ের কোমলতা এখনও যায় নি| ব্যবহারিক জীবন আপনাকে যেমন অবিকৃত রেখেছে, তেমন আর কাউকে রাখতে পারে নি|"

         রায় সাহেব একটু বিরক্তির স্বরে বল্লেন, "আমি যখন ছেলে মানুষ ছিলুম, তোমার তখন জন্মও হয় নি| আমার মধ্যে পরিবর্তন হয়েছে কিনা তুমি কি করে জানবে? যাক, আমার কথা শুন, তর্ক তোমার আদালতের উকিলদের জন্য তুলে রাখ|"

        "একবার আমাদের পুরাণ চাকর ধেনুর সঙ্গে মাহেশের রথ দেখতে গিয়েছিলুম| সেখান থেকে আমি বাঁশের একটি ছোট বাঁশী কিনে আনি| সেই বাঁশীটা বাজাতে আমি বড় ভালবাসতুম| কখনও গাছের ঝোপে সেই বাঁশীটার সঙ্গে আলাপ করতুম; কখনও কোন নির্জ্জনে পুকুর পাড়ে সেই বাঁশী বাজাতে বাজাতে ভাবে বিভোর হয়ে যেতুম; আবার কখনও নৈশ নিস্তব্ধতায় ছাদে বসে সেই বাঁশীর মধ্যে আমার তরুণ হৃদয়ের সমস্ত উচ্ছ্বাস ঢেলে দিতুম| আমার সুখ, আমার দুঃখ, আমার আনন্দ, আমার বিষাদ, - আমার আশা, আমার আকাঙ্খা সমস্তই সেই বাঁশীর সুরে ফুটে উঠতো| কখনও সেই বাঁশীর স্বরলহরী সমীরণে কেঁপে কেঁপে নাচতো, কখনও তার আনন্দ-গীতিতে তটিনী সৈকত মুখরিত হতো, আবার কখনও তার ব্যাথার মূর্চ্ছনায় প্রকৃতি বিষাদে ভরে যেতো| বাঁশীর মধুর সুরটি যখন নেচে, নেচে, কেঁপে কেঁপে আকাশে উঠতো আমিও তখন কোন আলোয় গড়া ariel এর মত তাতে চড়ে পরীর দেশে চলে যেতুম| খাবার কথা, শোবার কথা, পড়ার কথা তখন আমি একেবারে ভুলে যেতুম| আমার চেতনার মধ্যে তখন থাকতো কেবল সেই বাঁশীর মধুর স্বর লহরী, আর থাকতো আমার ভাবের সেই সোনার রাজ্য|

       "বাবা মাঝে মাঝে আড় চোখে আমায় দেখতেন| মনে হতো যেন আমার কথা নিয়ে তিনি একটু ভাবনাচিন্তা করছেন| এই সময় একদিন তখনকার বিখ্যাত ব্যারিষ্টার Mr. Banerjee আমাদের আতিথ্য স্বীকার করলেন| তার অভ্যর্থনার মহা ধূমধাম পড়ে গেল| নিকটস্থ গ্রাম সমূহের ভদ্রলোকেরা তাঁর দর্শনের জন্য দলে দলে আমাদের বাড়ি আসতে লাগলেন| তিনিও রাজোচিত বিনয় নম্রতার সহিত তাঁদের সঙ্গে মিষ্টালাপ করে তাঁদের আপ্যায়িত করলেন|

       আমার ভবিষৎ সম্ব্ন্ধে বাবার মনে যে দ্বন্দ্ব চলছিল সেটা এবার দূর হল| আমাকে ব্যারিষ্টারি পড়াবার জন্য তিনি স্থিরসঙ্কল্প হলেন| আমিও যে কালে Banerjee সাহেবের মত খ্যাতি প্রতিপত্তি লাভ করতে পারবো এই আশা এখন বাবার মনকে জুড়ে বসলো| Banerjee সাহেবের সামনে আমার ডাক পড়লো| আমায় তিনি পরীক্ষা নিয়ে বাবাকে বল্লেন "বেশ ছেলে, তবে পড়াশুনায় ততটা মনযোগ দেয়নি| এখন থেকে একে একটু আঁটা আঁটির মধ্যে রাখা ভাল|"

       "তখন আমার বয়স মাত্র নয় বৎসর| Banerjee সাহেবের উপদেশে বাবা আমায় কলিকাতায় রাখবার আয়োজনে ব্যস্ত হলেন| আমার মাঠে-ঘাটে ঘোরা, বিরলে বসে বাঁশী বাজান আর চাঁদনীর রাতে রূপকথা শুনা সব বন্ধ হল| এক সপ্তাহ পরে বাবা আমায় নিয়ে কলিকাতায় এলেন, আর একজন খুব কড়া শিক্ষকের হাতে তত্ত্বাবধানের ভার দিলেন| আসবার সময় বাঁশীটিও কাঁদতে কাঁদতে অন্যান্য খেলনার সঙ্গে ছেড়ে এলুম|

       "কলিকাতায় বাবা আমায় হেয়ার স্কুলে ভর্ত্তি করে দিলেন| প্রতিযোগিতার প্রবৃত্তি আর ambition বাবার কাছ থেকে উত্তারাধিকার সূত্রেই আমি পেয়েছিলুম| এখানকার আবহাওয়ায় এই প্রবৃত্তিগুলি খুব সরল হয়ে উঠলো| নিজের ambition এর তাড়নে আর বাবা এবং শিক্ষক মহাশয়ের উৎসাহে আমি খুব মনোযোগের সহিত পাঠাভ্যাস করতে লাগলুম| প্রথম পরীক্ষাতেই ক্লাসে শীর্ষস্থান অধিকার করলুম| বাবা যৎপরোনাস্তি আনন্দিত হলেন|"

        "বয়সের সঙ্গে আমার উৎসাহ, ambition এবং একাগ্রতা বাড়তে লাগলো| Entrance, F.A., B.A. তিনটি পরীক্ষাতেই ইউনিভার্সিটিতে আমি প্রথম স্থান অধিকার করলুম| বাবা তখন উপযুক্ত আয়োজন করে আমায় বিলাতে পাঠালেন| সম্মানের সহিত ব্যারিষ্টারী পাশ করে তিন বৎসর পরে আমি দেশে ফিরে এলুম আর হাইকোর্টে নাম লিখিয়ে প্র্যাকটিস আরম্ভ করলুম|"

       "এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে আমার অতীত গ্রাম্য জীবনের কথা, আমার কল্পনা-জল্পনার কথা, আমার বাঁশীটার কথা অবশ্য মধ্যে মধ্যে মনে পড়তো| কিন্তু এসবের দিকে অনুরাগ দেখলেই বাবা, আমার শিক্ষক মহাশয় এবং Banerjee সাহেব আমায় সতর্ক করে দিতেন| কর্ত্তব্য-জ্ঞান আমার মধ্যে যথেষ্ট ছিল| গুরুজনের উপদেশ অনুজ্ঞা আমি বিনা বাক্যব্যয়ে শিরোধার্য করে নিতুম| পরীক্ষার কৃতিত্বও আমায় তাঁদের উপদেশ অনুসরণে বিশেষভাবে উৎসাহিত করতো|"

        "ব্যারিষ্টারিতে আমি আশাতীত সাফল্য লাভ করলুম| অল্পদিনের মধ্যে আমার বেশ পশার প্রতিপত্তি হয়ে গেল| আমাদের ব্যবসায়ে একবার পশার হলে টাকার অভাব থাকে না| আমার বেলাতেও তাই হল| অর্থ পিপাসার কিন্তু নিবৃত্তি নাই| যত উপায় করতে থাকলুম টাকার লোভও ততই বাড়তে লাগলো| ব্যবসায়ে তখন আমি একেবারে মেতে গেলুম|"

         বাল্যের ভাব-প্রবণতা কিন্তু আমাকে একেবারে ছাড়েনি| পর্ব্বতাভ্যন্তরস্থিত অগ্নি প্রবাহের ঊর্দ্ধগমন-প্রয়াস যেমন মধ্যে মধ্যে সমস্ত পর্ব্বতকে চঞ্চল করে তুলে, আমার আত্মার ঊর্দ্ধগমন-প্রয়াসও আমাকে তেমনি মধ্যে মধ্যে চঞ্চল করে তুলতো| সে উত্তেজনা কিন্তু আমার মনকে বেশীক্ষণ চঞ্চল রাখতে পারতো না|

        "সংসারের মোহ স্ববলে সেটাকে তাড়িয়ে আমায় আবার পূর্ব্বাচরিত অর্থোপার্জ্জনের পথে টেনে নিয়ে যেতো|"
"ছয় মাস পূর্ব্বে কিন্তু এক অভূতপূর্ব দুর্ঘটনা এসে আমার সমস্ত জীবনকে উলট পালট করে দিলে| আমার জীবনসঙ্গিনী আমায় শোকে ভাসিয়ে পরলোকে অন্তর্দ্ধান করলেন| আমাদের সন্তান-সন্ততি কেহ ছিল না| আমি মূলোৎপাটিতে বৃক্ষের মত একেবারে ভূমিতে লুটিয়ে পড়লুম| সমস্ত জীবন আমাবস্যার রাত্রের মত অন্ধকার মনে হতে লাগলো| কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হয়ে কয়েক দিন কাটালুম| তারপর ভবিষ্যতের কথা ভাবতে লাগলুম| Practice করা তখন আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ছিল| একবার ভাবলুম কিছুদিনের জন্য বিলাত যাই| কিন্তু তাতে প্রবৃত্তি হলনা| সেখানে কে আছে, কার কাছে যাব? তারপর ভাবলুম Darjeeling কিম্বা শিলং হয়ে আসি| তাতেও মন উঠলোনা| কলিকাতার নির্জ্জনতাই আমাকে পীড়িত করে তুলেছিল; সেখানে গিয়ে শেষে পাগল হয়ে না ফিরি| বাল্যের সুখ-স্মৃতি জড়ান দেশের বাড়ির কথা তখন মনে পড়লো| ভাববার একটা বিষয় পেলুম|"

         "ধীরে ধীরে সেই সুদূর বাল্যজীবনের কথা আমার মনে পড়তে লাগলো| মার অসীম স্নেহের কথা মনে পড়লো| দিদিমার যত্ন আদরের কথা মনে পড়লো| মার গভীর অথচ ভ্রান্ত মঙ্গলাকাঙ্খার কথা মনে পড়লো| যে-দিন দেশ ছেড়ে কলিকাতায় এসেছিলুম সেদিনকার মার বাষ্পাকুল দৃষ্টির কথা মনে পড়লো, দিদিমার রুদ্ধ কণ্ঠের আশীর্বাদের কথা মনে পড়লো| আমার Entrance পরীক্ষার ফলের গেজেট হাতে করে বাবা যখন আমার কৃতিত্বের খবর আমায় শুনিয়েছিলেন তখনকার তাঁর সেই গর্ব্বস্ফীত চেহারার কথা আমার মনে পড়লো|"

         "কোথায় এখন আমার সেই স্বজনেরা? একে একে আমাকে ছেড়ে সকলেই অনন্তধামে চলে গিয়েছিলেন| কালের স্রোত আমার জীবনের শেষ অবলম্বনটাকেও এবার ভাসিয়ে তাঁদের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে| সংসারে এখন আমি প্রকৃতই একজন অনাথ; জীবন পথের এখন আমি প্রকৃতই একজন সঙ্গীহীন পথিক|"

        "আবার সেই জন্মভূমিতে ফিরে যাবার একট অদম্য বাসনা এসে তখন আমার মনকে জুড়ে বসলো| আমার অন্তরাত্মা বলতে লাগলো আমি সেখানেই শান্তি পাব, আর কোথাও পাবনা| আর দেরী করতে পারলুম না| সেই দিনই আবশ্যকীয় জিনিষপত্রগুলি একটি গ্ল্যাডষ্টোন ব্যাগে নিয়ে দেশে ফিরলুম|"

       "আমাদের সেই পুরাণ চাকর ধেণু অনেক দিন পূর্ব্বে মারা গিয়েছিল| তার ছেলে রাম আমায় অভ্যর্থনা করে ভিতরে নিয়ে গেল| তাকে দেখে ধেনুর কথা আমার মনে পড়লো| চেহারায়, হাবভাবে, ধরণ ধারণে সে ধেনুর একটি নিখুঁত প্রতিমূর্ত্তি| সেই ধেনুর মত মিশমিশে কাল রং, সেই ধেনুরমত খাঁদা বোঁচা নাক, সেই ধেনুর মত সরল অকপট হাসি, আর ঠিক সেই ধেনুরই মত বাৎসল্যপূর্ণ অথচ স্বসম্মান সম্ভাষণ| জীবনের কর্ম্মক্ষেত্রে মানুষ তার অসমাপ্ত কাজ তার সন্তান-সন্ততির হাতে ছেড়ে যায়| কর্ত্তব্যপরায়ণ ধেনুও তার অসমাপ্ত কাজ তার রামের হাতে ছেড়ে গেছে| আমার অসমাপ্ত কাজ আমি কার হাতে ছেড়ে যাব? "

        "ভাবতে ভাবতে আমি বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলুম| সেখানে এখন কেবল প্রাচীনা বিধবা আত্মীয়া একটি কুঠুরিতে থাকতেন আর সেই বাড়ির দেখাশুনা করতেন| তাঁকে গিয়ে প্রণাম করলুম| কুশলাদি জিজ্ঞাসার পর তিনি আমার জলযোগের আয়োজনে ব্যস্ত হলেন| আমি তখন আমার সেই বাল্যের লীলাভূমির এদিক ওদিক দেখতে লাগলুম| সেই প্রকাণ্ড অট্টালিকা যা একদিন আমাদের আনন্দের কোলহলে মুখরিত হতো, আজ সেটি আরব্য উপন্যাসের কোন উজাড় সহরের মত নিস্তব্দ পড়ে আছে| আলিসা থেকে বালি খসে পড়েছে| উঠানে আগাছার বন হয়েছে| মেজেতে শেওলা জমেছে| শ্রীহীনতার চিহ্ণ সর্ব্বত্রই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে|"

       "মরিচাধরা তালাটি খুলে মার কুঠারিতে প্রবেশ করলুম| সেই চিরপরিচিত কুঠারিটি পূর্ব্বাবস্থাতেই আছে| কেবল দেওয়ালে, ছবিগুলির উপর আর আসবাব সামগ্রীর মধ্যে মাকড়সা তার জাল বিছিয়েছে| ঝুলে আর ধূলোয় জিনিসপত্রগুলি মলিন হয়ে পড়ে আছে| মার জন্য তারা যেন তাদের শোকের বেশ পরেছে| এদিক ওদিক দেখতে দেখতে অন্যমনস্কভাবে মার আলমারির একটি Drawer খুল্লুম| Drawer এর কোণে আমার বাল্যবস্থার একখানি আলোক-চিত্র একটি রূপার ফ্রেমে পড়ে আছে দেখলুম| চিত্রটির পাশেই সার্টিনে মোড়া এক লম্বা জিনিষ আমার দৃষ্টিতে পড়লো| কৌতূহলপরবশ হয়ে সেটি তুলে আবরণটি খুল্লুম| ভিতরে দেখি কিনা আমার সেই পুরান বাঁশী! আমার স্নেহময়ী মা সেটিকে সযত্নে এই চারু আবরণে কোন মহামূল্য রত্নের মত লুকিয়ে রেখেছেন| বাঁশীটি এখন শুকিয়ে ফেটে ফেটে গিয়েছে|"

        "আমি আর থাকতে পারলুম না| বাঁশীটি হাতে করে একটি চেয়ারে বসে পড়লুম| দুই চোখ দিয়ে অশ্রুর বন্যা বইতে লাগল|"

        "পরদিন সকালে সেই বাঁশীটি নিয়ে আমার সেই পরিচিত মাঠের দিকে গেলুম| ক্ষীণাঙ্গিনী সরস্বতী ক্ষীণতর হয়ে আগের মতই সমুদ্রের পথে চলেছে, কিন্তু আমার কল্পনার ভেলাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা সে আর করলেনা| সেই বিভীষিকাময় তেঁতুল গাছটি নদীর তীরে এখনও একেলা দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু পূর্ব্বের মত তার ডালপালা নেড়ে তার রহস্যের ভাণ্ডার খুলে আর দেখালেনা| সেই সরু গ্রাম্য পথটি জলার উপর এখনও বিছান রয়েছে আর তার উপর দিয়ে পথিকের দল আগের মতই তাদের গন্তব্য পথে চলেছে, কিন্তু আমাকে বুকে করে পরীর দেশে নিয়ে যাবার কোন চেষ্টা সে আর করলেনা| পখিগুলি গাছে বসে আগের মতই গাইছে, কিন্তু তাদের সঙ্গীতে যোগ দিতে আমায় তারা আর ডাকলেনা| গাছের ডালপালাগুলি বাতাসে আগের মতই নড়ছে, কিন্তু আমায় তারা আগের মত তাদের নাচে যোগ দিতে আর সাধলেনা| আমায় এখন তারা সব ভুলে গেছে| আমি আর তাদের অন্তরঙ্গ বন্ধু নাই!|
"ব্যাথিত মনে তখন বাঁশীটি নিয়ে বাজাবার চেষ্টা করলুম| দুই একবার সেটি পোঁ, পোঁ, ফিস, ফিস করে উঠলো, কিন্তু তার মধ্যে সেই প্রাণমাতানো স্বর-লহরীর কোন সন্ধান আমি আর পেলুম না| তার প্রাণ তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে| কেবল তার শুষ্ক দেহটি এখন পড়ে আছে|

         "সব ছেড়ে নিজের জীবনের কথা তখন ভাবতে লাগলুম| আমরও প্রকৃত প্রাণ কি আমায় ছেড়ে যায়নি? বাল্যের সেই অভ্রচুম্বী আশা, সেই অতুল ভাব-সম্পদ, সেই অফুরন্ত আনন্দ-ভাণ্ডার সেই দৈবদত্ত সৌন্দর্য্যানুভুতি-এসব কি আমার স্থূল সাংসারিক লোভের চাপে, আমার নীচ ambition এর নিষ্পেষণে বিনষ্ট হয়ে যায়নি? ভগবানের নিকট থেকে বিপুল আধ্যাত্মিক সম্পদ নিয়ে আমি জগতে এসেছিলুম, সে সম্পদের কি সদ্ব্যবহার আমি করেছি? বাঁদর যেমন মুক্তা চিনে না, আমিও তেমনি সম্পদের মুল্য বুঝিনি| সংসারের কতকগুলো রঞ্জিত কাচ খণ্ডের লোভে এই অমূল্য রত্নের হারকে আমি মাটিতে লুটিয়েছি| আমার জীবনের এই দীর্ঘ পঞ্চান্ন বৎসরের মধ্যে আমার অস্তিত্বের সমর্থনের জন্য, ভগবান যে মহামূল্য দৌলৎ আমার হাতে দিয়েছিলেন তার হিসাব তাঁকে দিবার জন্য কি আমি করেছি?"

         "হাঁ, হাঁ করেছি বইকি! লক্ষ লক্ষ টাকা উপায় করেছি; সত্যকে অগণ্যবার মিথ্যে বানিয়েছি, মিথ্যেকে সত্য বানিয়েছি| করেছি বইকি; গরীবের রক্ত শোষণে ধনীকে সাহায্য করেছি, দুর্ব্বলের দলনে সবলের অমোঘ অস্ত্র হয়ে নিজের দ্যুতিতে জগৎকে চমকে দিয়েছি| করেছি বইকি; মনুষ্য-শার্দ্দুল এটর্ণিকে, পিতৃহীন অনাথের, অভিভাবকহীন বিধবার অবাধ ভক্ষণে যথেষ্ট সাহয্য করেছি| করেছি বইকি,- কপদ্দর্কহীন খাতকের শেষ আশ্রয় তার বাস্তু ভিটাকে শেরিফের নিলামে তুলতে, শনিগ্রস্ত দেউলিয়াকে কারাগারের দুর্ভেদ্য প্রাচীরের ভিতর পুরতে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছি! কি করিনি আমি? যথেষ্ট করেছি| এটর্ণি মহাজনদের প্রাসাদোপম অট্টালিকাগুলি সগর্ব্বে মাথা তুলে অমার কৃতিত্বের সাক্ষ্য দিচ্ছে| খাতকের শুষ্ক মলিন মুখ আমার প্রতিভার অপূর্ব্ব দাহনশক্তির শরীরী প্রমান-রূপে জগতের দিকে করুণনেত্রে চেয়ে আছে| মন্দিরের ভগ্নচূড়া, মসজিদের ভগ্ন প্রাচীর-আমার অলৌকিক আইন জ্ঞানের কথা ভক্তসমীপে স্পষ্টাক্ষরে ঘোষণা করছে| অন্তর্য্যামী জানেন, আমি যা করেছি, যথেষ্ট করেছি|"

        "অনুশোচনার তীব্রজ্বালায়, আত্মঘৃণার তীব্র দংশনে আমি অধীর হয়ে পড়লুম| আমার সেই স্নেহময়ী ধাত্রী সরস্বতী সাক্ষ্য করে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলুম, আইনের ব্যবসায়ে আর ফিরবোনা| জীবনের শেষ দিনগুলি পতিতপাবন ভগবানের চিন্তায়, দুঃখী-দরিদ্রের সেবায়, আর আমার বাল্যের সেই দেবদত্ত অনুভুতির পুনরুদ্দীপনের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত করবো| প্রতিভার নির্ব্বাণোম্মুখ প্রদীপ আবার জ্বলুক আর না জ্বলুক, অন্তরে অন্ততঃ তাতে শান্তি পাব| আমার মত মূঢ়ের পক্ষে তাও যথেষ্টের চেয়ে বেশী হবে|"

        "রাত্রে সেই বাঁশীটি যত্নে বালিশের নীচেয় রেখে সেই পুরাণ পালঙ্কে শয়ন করলুম| আমর সমস্ত জীবনের ঘটনাগুলি গতিশীল চিত্রের ফিল্মের মত আমার মস্তিষ্কের মধ্যে আসতে লাগলো| ধীরে ধীরে অস্পষ্টতর হয়ে সেগুলি শেষে আমার তন্দ্রার জোয়ারে ডুবে গেল| আমি ঘুমিয়ে পড়লুম| তখন এক অপূর্ব্ব স্বপ্ন দেখলুম|"

        "আমি যেন সরস্বতীর তীরে হাতে মাথা দিয়ে পড়ে আছি| আমার বাঁশীটিও আমার সামনে ঘাসের উপর পড়ে আছে| আমি অন্যমনস্কভাবে সেটিকে দেখছি| হঠাৎ সেটি ফেঁপে বাড়তে আরম্ভ করলে| আমি চমৎকৃত হয়ে দেখতে লাগলুম| বাড়তে বাড়তে সেটি ফেটে দুভাগ হয়ে গেল আর তার ভিতর থেকে আমার বিস্ময় বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে একালোক সামান্য রূপবতী রমণী বেরিয়ে এলেন| তাঁর হাতে ছিল অপূর্ব্বদর্শন একটি সোনার বাঁশী| আমি অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলুম| আতি মধুরকণ্ঠে আমার দিকে চেয়ে সুন্দরী বল্লেন "আমায় চিনতে পারছ?"

         আমি মাথা নেড়ে বল্লুম "না, আপনি কি স্বর্গের কোন দেবী না কিন্নরী?"

         সুন্দরী বল্লেন, "আমি হচ্ছি এই বাঁশীর প্রাণ| আমার কথা ভেবেছিলে বলে তোমায় দেখা দিতে এসেছি|"
আমি অনুযোগের স্বরে বল্লুম, "আমার বাঁশীকে ছেড়ে তাহলে আপনি চলে গেলেন কেন?"

         সুন্দরী ঈষৎতীষ্ণ স্বরে বল্লেন, "আমায় যে তাচ্ছিল্য করে, তার কাছে থাকবার আমার কোন প্রয়োজন নাই|"

         আমি কুণ্ঠিত হয়ে চুপ করে রইলুম| কি বলবো ঠিক করতে পারলুম না| সুন্দরী তখন স্মিতমুখে বল্লেন "অনেক দিন পর আমায় স্মরণ করেছ; আজ তোমায় কিছু বাজিয়ে শুনাই|" আমি তাকে ধন্যবাদ দিতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু কিছু বলবার আগেই তার সেই বাঁশীর সুর আমার শ্রবণে প্রবেশ করে আমার মন-প্রাণকে মোহিত করে দিলে|
"নদী প্রান্তর, বৃক্ষলতা, জল স্থল সুন্দরীর বাঁশীর সেই স্বর্গীয় তালে নাচতে লাগলো| এক অপূর্ব্ব পুলকে আমার সমস্ত শরীর কন্টকিত হয়ে উঠলো| আমার বিস্ময়বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে সেই নদীতটস্থ বন থেকে অনুপম লাবণ্যবিশিষ্ট, বিচিত্র কুসুমাভরণে সজ্জিত এক যুবক যুবতীর দল বের হয়ে এল, আর মধুর অঙ্গভঙ্গীর সঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে নাচতে লাগলো|

        "সে কি অপরূপ দৃশ্য! সেই নৃত্যশীল যুবক যুবতীর কটাক্ষ থেকে মন্মথের ফুলশর অজস্র ভাবে ছুটাছুটি করতে লাগলো| তাদের প্রত্যেক ভঙ্গিমাতে প্রেমের উৎস যেন উথলে উঠতে লাগলো| আমি মন্ত্র-মুগ্ধের মত সেই স্বর্গীয় দৃশ্য দেখতে লাগলাম| ক্ষণেক পরে বাঁশী থামিয়ে সুন্দরী সঙ্কেত করলেন, আর অমনি নিমেষের মধ্যে সেই নৃত্যশীল যুবক যুবতীর দল সেই বন মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল|

       "আমি কথা বলতে যাচ্ছিলুম এমন সময় সুন্দরী এক নূতন সুর ধরলেন| সে সুরের রুদ্রতেজে জল স্থল কেঁপে উঠলো| অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে লম্ফ দিয়ে কোন অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে ধাবমান হবার একটা উৎকট প্রবৃত্তি আমার মনের মধ্যে সজাগ হয়ে উঠলো| সুন্দরীর তর্জ্জনীর সঙ্কেতে প্রকৃত্স্থ হয়ে দেখলুম বন জঙ্গল সেই নদীতট থেকে অদৃশ্য হয়েছে আর তাদের জায়গায় কোন ইউরোপীয় নগরীর প্রশস্ত রাজপথ বিস্তৃত হয়ে রয়েছে| নগরীর আকার প্রকার দেখে মনে হল আমি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস দেখতে পাচ্ছি| রাজধানীর সেই পথ দিয়ে অসংখ্য নরনারী পতাকা হাতে করে কেউ Liberty কেউ Equality কেউ Faternity বলে চীৎকার করতে করতে দলবদ্ধ হয়ে পরিমিত পদক্ষেপে বাজনা বাজিয়ে চলেছে| তাদের সেই বাজনার সঙ্গে সুন্দরীর বাঁশীতে মিলে La Maisecllee's এর উন্মাদনাময় সুরকে এক অপূর্ব্ব ঝঙ্কারে বাজিয়ে তুললে| আমি মোহাবিষ্টের মত শুনতে লাগলুম| বাদ্য বন্ধ হল| আমি চমকে দেখলুম প্যারিসের সেই রাজবর্ত্ত চলে গেছে আর তার সঙ্গে সেই বিপ্লবপন্থী জনপ্রবাহও শূণ্যে মিলিয়ে গিয়েছে|

        "সুন্দরী তখন এক নূতন সুর ধরলেন| এ সুরের প্রথম সুরের কোমল গুঞ্জন ছিল না আর দ্বিতীয় সুরের গভীর বজ্রনিনাদও ছিল না| এতে ছিল অনন্ত, অফুরন্ত আশার মৃদু গম্ভীর মর্ম্মর ধ্বনী, ভগবদ্ভক্তির আবেগময় ঝঙ্কার, আর বিশ্ব প্রেমের উচ্ছ্বাসময়, উন্মাদনাময় মধুর গভীর কল্লোল| সেই স্বরলহরী আমার মন প্রাণকে এক অপূর্ব্ব স্বর্গীয়ভাবে বিভোর করে দিলে| ভক্তির অমৃতময় উৎস আমার অন্তর থেকে উথলে উঠতে লাগলো| আমার দৃষ্টি আপনা থেকেই দিগন্তের দিকে চলে গেল|

        "সেখানে দেখলুম আকাশের গায়ে হালকা মেঘগুলি বিচিত্র বর্ণে বিচিত্র হয়ে এক অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করেছে| আর তাদের মধ্যে উজ্জ্বল স্বর্ণ-সিংহাসনে এক মহাপুরুষ বসে আছেন| তাঁর শরীর থেকে এক অপূর্ব্ব বৈদ্যুতিক আভা বের হয়ে সমস্ত জগৎটাকে আলোকিত করেছে| আর তাঁর পদতলে কোটী কোটী জন প্রাণী এবং নরনারী ভক্তিভরে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছে| স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমিও তাঁর উদ্দেশ্যে প্রণত হলুম| এক অপার্থিব আনন্দে আমার মন প্রাণ ভরে গেল|

        "হঠাৎ সুন্দরীর হস্ত-স্পর্শে আমি চমকে উঠলুম| তাঁর বাদ্য তখন থেমে গেছে, দেখলুম সেই অলৌকিক দৃশ্যও দিগন্ত থেকে অন্তর্হিত হয়েছে| আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সুন্দরীর দিকে চাইলুম| তিনি বল্লেন "এসো, এবার তোমায় অমরলোকে নিয়ে যাই| ভগবানের দরবার তোমায় দেখিয়ে আনি|"

       "সুন্দরী আমার হাত ধরে শূণ্যপথে উঠলেন| আমিও অক্লেশে তাঁর সঙ্গে বায়ুপথে চলতে লাগলুম| পৃথিবী থেকে আমার দূরত্ব ক্রমেই বাড়তে লাগলো| ঘর, বাড়ি, গাছ, বন ক্রমেই ক্ষুদ্রতর মনে হতে লাগলো| মেঘের পর মেঘ ছেড়ে আমরা উপরে উঠতে লাগলুম| ভূগোলটি ক্রমেই ক্ষুদ্রতর দেখাতে লাগলো| এর মধ্যে আমরা পৃথিবীর মত একটা নূতন জগতের সামনে এসে পড়েছিলুম| সেখানে কেবল শুষ্ক মরুভুমি আর প্রান্তরময় পর্ব্বত দেখতে লাগলুম| সুন্দরী বল্লেন এই হচ্চে চন্দ্রলোক| আমরা চন্দ্রকে ছেড়ে আরও উপরে উঠতে লাগলুম| পৃথিবী একটা জ্যোতিষ্কের মত দেখাতে লাগলো| চন্দ্রের গোলকটিও ক্রমে ক্রমে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বোধ হতে লাগলো| এইরূপে অনেক গ্রহ, অনেক উপগ্রহ অতিক্রম করে আমরা এক অন্তহীন প্রচণ্ড অগ্নিপিণ্ডের সামনে এলুম| ভয়ে আমার সমস্ত অন্তরাত্মা কাঁপতে লাগলো| সেই অগ্নির ভীষণ গর্জ্জনে আমার কাণ বধির হয়ে যেতে লাগলো| আমরা অবিরামগতিতে আরও ঊর্দ্ধে উঠতে লাগলুম|

       "ক্রমে অসংখ্য জগৎ, অসংখ্য সূর্য্য, অসংখ্য গ্রহমালা অতিক্রম করে আমরা এক অপূর্ব্ব অবর্ণনীয়, অচিন্তনীয় দেশে এসে উপস্থিত হলুম| সেখানকার স্বাভাবিক সৌন্দর্যের বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়| সেই অনুপমেয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের মধ্যে চলতে চলতের আমরা অনতিবিলম্বে এক অতি সুন্দর নগরে প্রবেশ করলুম| দেখলুম আমাদের সামনে এক অতিপ্রশস্ত রৌপ্যনির্ম্মিত রাজপথ বিস্তৃত রয়েছে| সেই পথ দিয়ে আমরা চলতে লাগলুম| পথের দুই পার্শ্বে সুরম্য উদ্যান সমূহের মধ্যে সুবর্ণনির্ম্মিত এবং বিচিত্র মণিমাণিক্যে খচিত প্রাসাদগুলি এক অপূর্ব্ব শোভা বিকীর্ণ করছিল| অনুপম সৌন্দর্যবিশিষ্ট, চিরযৌবনসম্পন্ন নরনারীগণ বিচিত্র ভূষণে ভূষিত হয়ে সেই পথ দিয়ে ইতস্ততঃ চলাফেরা করছিলেন| তাঁদের সঙ্গে কথা বলবার জন্য আমার মন ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল, কিন্তু সুন্দরী আমাকে তার কোন অবসর না দিয়ে দ্রুত পথ অতিক্রম করে চললেন| আমিও অগত্যা তাঁর অনুসরণ করলুম|

         "অনেকক্ষণ চলবার পর আমরা অতি মনোরম রম্য কাননের মধ্যে অবস্থিত এক কল্পনাতীত সৌন্দর্য্যময় প্রাসাদের সামনে উপস্থিত হলুম| প্রাসাদটি যে কি উপকরণ দিয়ে প্রস্তুত বুঝতে পারলুম না| একটি বৃহৎ জ্যোতিষ্কের মত সেটি জ্বলছিল| প্রাসাদের অগণ্য সোপানবলী অতিক্রম করে, এক অপূর্ব্ব কারুকার্য্যময় দালান পার হয়ে আমরা এক প্রকাণ্ড হলের মধ্যে প্রবেশ করলুম| হলের গম্বুজগুলি আকাশ স্পর্শ করছে বলে মনে হয়|

        "হলের প্রান্তভাগে এক প্রকাণ্ড বেদীর উপর এক উজ্জ্বল সিংহাসনে এক মহাপুরুষ বসেছিলেন| তাঁকে সেই মেঘের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত মহাপুরুষের কথা আমার মনে পড়লো| তাঁর শরীরের উজ্জ্বল জ্যোতিতে আমার পার্থিব চক্ষু দুটি যেন ঝলসে যেতে লাগলো|

       "হলে প্রবেশ করেই সুন্দরী একান্ত ভক্তির সাথে সেই মহাপুরুষের উদ্দেশ্যে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত কল্লেন| আমি বিনা বাক্যব্যয়ে তাঁর অনুসরণ করলুম| সুন্দরী আমায় মৃদুকণ্ঠে বল্লেন, "আমাকে মনে করেছিলে বলে ভগবানের দরবার আজ তোমায় দেখিয়ে দিলুম| চারিদিকে দেখে তোমার জন্ম সার্থক কর|"

       "আমি চক্ষু ফিরিয়ে দেখলুম ভগবানের সিংহাসনের তলে অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট সিংহাসনে অপূর্ব্ব জ্যোতিবিশিষ্ট মহাপুরুষেরা বসে আছেন| তাঁদের মুখাবয়ব দেখে পৃথিবীর কথা স্মরণ হল| দুই একজনকে তাঁদের মধ্যে আমি চিনতে পারলুম| সুন্দরী আমায় তাঁদের পরিচয় দিতে লাগলেন| বল্লেন "ইনি হচ্চেন বল্মীকি," "ইনি হচ্ছেন হোমার", "ইনি হচ্চেন দান্তে|" এইরূপে মহাজনদের আমায় দেখিয়ে দিলেন| আমাদের যুগের Darwin, Dickens, Victor Hugo প্রভৃতি মহাত্মাদেরও সেখানে দেখতে পেলুম| তাঁদের সমস্ত শরীরের মধ্যে এক অলৌকিক জ্যোতি, এক অবর্ণনীয় লাবণ্য এসেছে| তাঁদের মুখমণ্ডলে এক স্বর্গীয় শান্তির ভাব প্রকাশ পাচ্ছে|

         "ক্ষণেক পরে সুন্দরী বল্লেন "এখানে তিষ্ঠিবার তোমার অধিকার নাই| এস আবার তোমায় পৃথিবীতে রেখে আসি|" একান্ত ভক্তির সঙ্গে আবার সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে আমরা দুইজনে বাইরে এলুম| সুন্দরীকে তখন জিজ্ঞাসা করলুম "এই মহাপুরুষেরা এমন কল্পনাতীত সৌভাগ্য কি করে পেলেন?" সুন্দরী বল্লেন "আমার বরেই পেয়েছেন|" আমি চমৎকৃত হয়ে বল্লুম "আপনার এত ক্ষমতা?" সুন্দরী মৃদু হেসে বল্লে "আমি কেবল তোমার বাঁশীর প্রাণ নই| আমি শিল্পেরও প্রাণ, সাহিত্যেরও প্রাণ| আমিই হচ্চি সৌন্দর্য্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী| আমার বরেই লোক কবি হয়, শিল্পী হয়, গায়ক হয়, বাদক হয়| আমিই তাদের সাধনা সার্থক করি| আমিই তাদের ভগবানের জ্যোতির্ম্ময় দরবারে নিয়ে আসি|"

         "বিস্ফয়বিস্ফারিতলোচনে সুন্দরীর দিকে চেয়ে অতি করুণ কণ্ঠে আমি বল্লুম "আমাকেও তাহলে বর দিন| আমিও এই অমর পুরীতে আসতে চাই|"

        সুন্দরী স্নেহের কোমল স্বরে বল্লেন "বাছা তোমাকে বর দিবার ক্ষমতা আমার নাই| দেবী হলে কি হবে, তোমারই মত আমিও অধীন| তোমার সুযোগ একদিন এসেছিল কিন্তু তুমি তাকে উপেক্ষা করে পৃথিবীর সম্পদকেই কাম্য বলে গ্রহণ করেছ| তুমি যা চেয়েছিলে ভগবান তোমাকে তা দিয়েছেন| এখন অন্যায় আব্দার করলে চলবে কেন! এস তোমায় রেখে আসি|" সুন্দরী আমার হাত ধরলেন| আমরা শূণ্য পথে নামতে আরম্ভ করলুম| শোঁ শোঁ করে আমরা নেমে আসছি এমন সময় দরজায় হঠাৎ খট খট করে শব্দ শুনে আমার ঘুম ভেঙে গেল|

        "উঠে দেখি সকাল হয়ে গেছে| প্রভাত সূর্য্যের আলো আমার কামরায় প্রবেশ করেছে| দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আমার বিধবা আত্মীয়াটি বলছেন, "উঠ বাবা, বেলা হয়ে গেছে, চা খাবে এস|"

         রায় সাহেব হঠাৎ স্তব্ধ হলেন| আমি নিবিষ্টমনে তাঁর কথা শুনছিলুম| চমকে উঠে বল্লুম "কি চমৎকার স্বপ্ন!" আমরা এর মধ্যে motor stand এর কাছে এসে পড়েছিলুম| তিনি তাঁর মোটরে উঠলেন| আমিও বিদায় অভিবাদন করলুম| মোটর stand থেকে বের হতে লাগলো, রায়সাহেব আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বল্লেন "বুড়োকে একেবারে ভুলোনা মাঝে মাঝে দেখা কোরো|"

       "নিশ্চয়" বলে আমিও বাড়ির পথ নিলুম|

( ‘বঙ্গবাণী’ মাসিক পত্রিকা, মাঘ ১৩৩২ )

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।

সেকালের জনপ্রিয় লেখক ও তাঁদের লেখা

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ