পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
স্বপ্ন
চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
[ লেখক
পরিচিতি : চারুচন্দ্র ১৮৭৭ ( মতান্তরে ১৮৭৬ ) সালের ১১ই অক্টোবর
জন্মগ্রহণ করেন । আদি বাসস্থান অধুনা বাংলাদেশের যশোরে হলেও
তার জন্ম মালদহের চাঁচলে । বাবা গোপালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
, মা মুক্তকেশী দেবী । ১৮৯৫ সালে বলাগড় হাই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স
,১৮৯৬ সালে জেনারেল অ্যাসেম্ব্লিজ ( বর্তমান স্কটিশ চার্চ
কলেজ ) থেকে এফ.এ এবং ১৮৯৯ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এ.
পাশ করেন । ১৮৯৬ সালে দুমকা নিবাসী রাধারাণী দেবীকে বিয়ে করেন
কিন্তু মাত্র চার বছর পরেই ১৯০০ সালে রাধারাণীর মৃত্যু হলে
তিনি পদ্মাবতী দেবীর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন ।
১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপক হিসাবে
যোগদান করেন । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে যোগদানের জন্য
তিনি ১৯২৪ সালে ঢাকা চলে যান । ১৯২৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
থেকেই সাম্মানিক এম.এ উপাধি লাভ করেন । ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর
উল্লেখযোগ্য লেখকদের মধ্যে ইন্দিরা দেবী , অনুরূপা দেবী ,
শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় , রাজশেখর বসু এবং অন্যান্যদের সঙ্গে
চারুচন্দ্রের নামও করতে হয় । তিনি 'ভারতী' পত্রিকার সম্পাদক
এবং 'প্রবাসী'র সহ-সম্পাদক ছিলেন । তার প্রথম ছোট গল্প ‘মরমের
কথা’ প্রবাসীতেই প্রকাশিত হয় । ‘স্রোতের ফুল’ , ‘পরগাছা’ প্রভৃতি
তার রচিত ২৫টি উপন্যাসের অন্যতম । ছোটদের জন্যও তিনি লিখেছেন
, বেশ কয়েকটি গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশ করেছেন ছোটদের উপযোগী
করে । তবে তিনি সমধিক পরিচিত তার রবীন্দ্র-গবেষণামূলক গ্রন্থ
‘রবি-রশ্মি’র জন্য । বাংলা ভাষার উপর তার যথেষ্ট দখল ছিল ।
সেকালের বহু রচনাতেই যেমন পরাধীন দেশে বিদেশী শাসকদের অবহেলা
ও অত্যাচার থেকে উদ্ভুত যন্ত্রণার উল্লেখ রয়েছে , বর্তমান
লেখাটির উপজীব্য বিষয়ও সেটাই । এখনকার প্রজন্মের কাছে এই রচনায়
চিত্রিত পরাধীনতার তীব্র ক্ষোভ জনিত অভিব্যক্তি এবং ভাষা কেমন
লাগে সেটা পাঠকরাই বিচার করবেন । চারুচন্দ্রের মৃত্যু হয় ১৯৩৮
সালের ১৭ই ডিসেম্বর ।
..
দীপক
সেনগুপ্ত]
কোনও না কোনও উৎসব
উপলক্ষ্যে বহু বঙ্গবাসী যে সাহেব সার্জ্জেনের ছড়ির আঘাত নীরবে
হজম করিয়াছেন , তাহাতে কোন সন্দেহ নাই । আমার ভাগ্যেও এক শ্বেতাঙ্গ
পুঙ্গবের সূক্ষ্ম বেত্রযষ্টির সহিত মধুর পরিচয় হইয়াছিল । সেই
পরিচয়ে , নিমজ্জমান ব্যক্তি যেমন নিমেষের মধ্যে একবার আপনার
ভূত ভবিষ্যৎ , আশা আকাঙ্খা , আত্মীয়তা বন্ধন স্মরণ করিয়া লয়
, আমারো তেমনি সকল মনে পড়িল ; মনে পড়িল এই আঘাতটি নীরবে হজম
করিলে আমার দীর্ঘজীবনের সম্ভোগসুখ বোধ হয় অবশ্যসম্ভব , এবং ইহার
প্রতিদান দিলে আমার প্লীহার আয়তন নিমেষ মধ্যে তিনগুণ বাড়িয়া
যাইতে পারে , আমার হৃদয়টা চারিগুণ ভারি হইয়া উঠিতে পারে , কিংবা
ন্যায়বান শ্বেতাঙ্গ বিচারকের মতে সাহেবের সাময়িক মস্তিষ্ক-বিকৃতি
নিশ্চিত হইতে পারে । কিন্তু তথাপি অত্যাচারী সাহেব মারার সুখ
লাভ আসন্ন দেখিয়া বাঙ্গালী-স্বভাবের বিদ্রোহী হস্ত সুদৃঢ় বেত্রযষ্টির
দ্বারা সাহেবের পৃষ্ঠ মার্জ্জন করিয়া দিল । সাহেব দৌড়িয়া আসিয়া
আমায় ধরিল , আমিও যষ্টি সুদৃঢ় করিয়া ধরিলাম , আমার স্বদেশী কনষ্টেবলও
অনেকে আসিয়া আমাকে ঘিরিল , আমার স্বদেশী ভ্রাতাগণ রুদ্ধনিশ্বাসে
আমার অবসান প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন । সাহেব আসিয়া আমাকে বলিল
, 'Why did you beat me' ?" আমার চিত্ত তখন বাত্যবিতাড়িত
আটলাণ্টিক মহাসাগরের মত বড় উদ্বেল , বড় বিচলিত , আমার অস্তিত্ব
আমি তখন বিস্মৃত হইয়াছি , সমস্ত জগৎসংসার আমা হইতে অপসৃত হইয়াছে
, মহাশূন্যে শুধু সাহেব ও আমি । তথাপি আমি দৃঢ়স্বরে উত্তর করিলাম
, 'Because you beat me '. সাহেব , - 'I only touched your body,I
didn't hit you'. আমি - 'Yes, you hit me. But if not, there
was no need of touching my body with your stick'. সাহেব উত্তর
করিল , 'I only touched your body in order to make you move
on, but I didn't hit you. Did I ?' . আমি পূর্ব্ববৎ দৃঢ়স্বরে
উত্তর করিলাম , 'Yes you did'. সাহেব কি একটু চিন্তা করিয়া বলিল
, 'Get away !' আমি শ্লেষস্বরে 'Thank you very much' বলিয়া
অন্যত্র চলিয়া গেলাম , কিছুক্ষণ পরে আমি আত্মস্থ হইলাম । সমস্ত
ঘটনা স্বপ্নবৎ বোধ হইতে লাগিল । উৎসব ভাল লাগিল না , পরাধীন
জাতির এত উৎসব বড় বিসদৃশ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল । আমি সমস্ত উৎসব
হইতে আপনাকে রুদ্ধ করিবার জন্য তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরিলাম । বস্ত্র
পরিত্যাগ করিয়া আমার মেসের আলোক বিহীন এক কোণে জীর্ণ কেওড়া কাঠের
চৌকীর উপর পড়িয়া চিন্তা করিতে লাগিলাম ।
চিন্তা করিতেছিলাম , আজ
আমার ঘৃণ্য কলুষিত বাঙ্গালী জীবন ধন্য হইল , আমার স্বদেশবাসীর
শত অপমানের এককণা আমি ফিরাইয়া দিতে পারিয়াছি । আর সেই সাহেব
হিমরক্ত বাঙ্গালীর নিকট হইতে প্রতিশোধ পাইয়া , লজ্জায় কাণ পর্যন্ত
আরক্ত হইয়া উঠিতেছে । চিন্তা করিতে করিতে দেখিলাম , আজ আমার
বিবাহ । বিবাহের ঘটক আমার সেই বেত্র-যষ্টি ; তাহার কৃপায় আজ
আমি 'বর' । বিবাহ বাসর সজ্জিত হইয়াছে বর্ণে গন্ধে , আলোক সঙ্গীতে
দ্যুলোক ভূলোক পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে । নব বধূর লজ্জায় আড়ষ্ট চরণের
নূপুর ধ্বনি , তাহার বিলম্বিত পদক্ষেপ , আমার কর্ণগোচর হইতে
লাগিল ; তৎপরে তাহার লজ্জানত মধুর হাস্যদীপ্ত বদনখানি আমি একবার
দেখিলাম , আমার হস্তে তাহার করুণ কোমল পাণিস্পর্শ হইল ; পুরোহিত
মন্ত্রোচ্চারণ করিল । বিবাহ হইয়া গেল । কন্যার নাম 'নিদ্রা'
, পুরোহিতের নাম 'মশক' ।
আমার এক পুত্র জন্মিল
, তাহার নাম 'স্বপ্ন' । সে যেমনি সুন্দর , তেমনি 'বলিষ্ঠ' ,
তেমনি অদ্ভুত-কর্ম্মা । সে মহিরাবণের পুত্র অহিরাবণের মত জন্মিয়াই
দিগ্বিজয়ে বাহির হইয়া পড়িল । তাহার বিজয়ী রথ ভারতবর্ষ অতিক্রম
করিয়া সুদূর শ্বেতদ্বীপে যাইয়া বিশ্রাম লাভ করিল । আজ আমার পুত্রের
বীরত্বে আমি সম্রাট , আমি অধীশ্বর ।
শ্বেতদ্বীপে বাঙ্গালীর রাজত্ব অব্যাহত অক্ষুণ্ণভাবে চলিতে লাগিল
। সেখানে বঙ্গীয় বিশ্ববিদ্যালয় সকল স্থাপিত হইয়াছে ; শ্বেতমুখ
ছাত্রগণ কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষকের নিকট হেম-রবির কবিতা , বঙ্কিম-রমেশের
নভেল , জগদীশ-প্রফুল্লের বিজ্ঞান , তর্কালঙ্কার-বেদান্তবাগীশের
বেদান্তদর্শন , ক্ষাত্রে-রবিবর্ম্মার শিল্পকলা শিক্ষা করিতেছে
। ছাত্রগণ 'তুমি' কে 'টুমি' বলিয়া কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষকের উপহাস-রসিত
কাণমলা লাভ করিতেছে । শ্বেতাঙ্গগণ কৃষ্ণাঙ্গের ধুতি চাদর পরিতে
অনির্বার ভুল করিয়া সম্মুখে কাছা ও পশ্চাতে কোঁচা করিয়া সমাজে
বিষম লাঞ্ছিত হইতেছে । হাইড পার্কের স্থানবিশেষে ধুতী-পরিধায়ী
ভিন্ন অপরের প্রবেশাধিকার বারিত হইয়াছে । কৃষ্ণাঙ্গের লাঠিতে
শ্বেতমনুষ্য হত হইলে কৃষ্ণাঙ্গ বিচারক হৃদয় ও প্লীহার আয়তন বৃদ্ধি
অনুভব করিতেছেন , আর 'বঙ-ইঙ্গ' কাগজকুল আকুল হইয়া নিষ্ফল আস্ফালন
করিতেছে । সে দেশের কল কারখানার উপর খুব কড়া কর বসান হইয়াছে
, ও পার্সী বণিক তাতা মহাশয়ের স্বদেশী মিল সে দেশের লজ্জা নিবারণ
করিতেছে ; শাশপুরের ছুরী কাঁচি শেফিল্ডের রজার্স প্রভৃতিকে ফেল
করিয়া ছাড়িয়াছে । অস্ত্র আইনের মাহাত্ম্যে শ্বেতাঙ্গের গৃহে
কাঁটা চামচ দুস্প্রাপ্য হইয়া উঠিয়াছে । মদের খোলা ভাঁটি সব বন্ধ
করা হইয়াছে । সাহেবী-বাংলার অদ্ভুত নমুনা সকল সংবাদ পত্রে পাঠ
করিয়া শ্বেতাঙ্গগণ আকর্ণ আরক্ত হইয়া উঠিতেছে । দেশের যত বড় বড়
পদ প্রকাশ্য এবং গুপ্ত 'রেজোল্যুশন' করিয়া বঙ্গবাসীর একচেটিয়া
করা হইয়াছে , উচ্ছিষ্ট , উদ্বৃত্ত যাহা পড়িয়া থাকে , তাহাই দয়া
করিয়া লালায়িত শ্বেতাঙ্গের জীবন-বৃত্তি স্বরূপ তাহাদিগকে দেওয়া
হইতেছে । শ্বেতাঙ্গগণকে পথে ঘাটে , ট্রেনে ষ্টিমারে , আফিস আদালতে
'white lepers' বলিয়া অবমানিত হইতে হইতেছে ; তাহার লাঞ্ছনার
হস্ত হইতে নিষ্কৃতি লাভের আশায় আমাদেরই ভাতের হাঁড়ির তলাচাঁছা
ভূষা কালী মাখিয়া বা মেটে রং মাখিয়া কৃষ্ণাঙ্গ হইবার স্পর্ধা
করিয়া বিশেষ উপহসিত হইতেছে ।
আমার পুত্র 'স্বপ্ন' বলিল
,'ঢের হইয়াছে , এখন ক্ষান্ত হওয়া যাক্ ।' আমি সুপুত্রের প্রতিবাদ
করিতে সাহসী না হইয়া বলিলাম , 'তথাস্তু' । আমাদের বিজয়দৃপ্ত
রথ বিদ্যুৎ গতিতে ফিরিয়া আসিল ।
মেসের ঝি ডাকিতেছে , 'বাবু
, বাবু , ভাত হইয়াছে , খাইতে চলুন ।' 'নিদ্রা' লোকসমাগম দেখিয়া
তাড়াতাড়ি ঘোমটা টানিয়া 'স্বপ্ন'কে কোলে করিয়া ঘর হইতে বাহির
হইয়া গেল । আমার এই কাহিনী একজন বন্ধুকে বলিলাম । বন্ধু গম্ভীর
ভাবে বলিল , " স্বপ্ন অলীক চিন্তা মাত্র ।" আমার মনটা
বড় দমিয়া গেল ।
( ১৩১০
বঙ্গাব্দের কার্ত্তিক সংখ্যার 'প্রবাসী'তে প্রকাশিত )।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)