পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
বাজপাখী
চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
[ লেখক
পরিচিতি : চারুচন্দ্র ১৮৭৭ ( মতান্তরে ১৮৭৬ ) সালের ১১ই অক্টোবর
জন্মগ্রহণ করেন । আদি বাসস্থান অধুনা বাংলাদেশের যশোরে হলেও
তার জন্ম মালদহের চাঁচলে । বাবা গোপালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
, মা মুক্তকেশী দেবী । ১৮৯৫ সালে বলাগড় হাই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স
,১৮৯৬ সালে জেনারেল অ্যাসেম্ব্লিজ ( বর্তমান স্কটিশ চার্চ কলেজ
) থেকে এফ.এ এবং ১৮৯৯ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এ. পাশ
করেন । ১৮৯৬ সালে দুমকা নিবাসী রাধারাণী দেবীকে বিয়ে করেন কিন্তু
মাত্র চার বছর পরেই ১৯০০ সালে রাধারাণীর মৃত্যু হলে তিনি পদ্মাবতী
দেবীর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন ।
১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপক হিসাবে
যোগদান করেন । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে যোগদানের জন্য
তিনি ১৯২৪ সালে ঢাকা চলে যান । ১৯২৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
থেকেই সাম্মানিক এম.এ উপাধি লাভ করেন । ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর
উল্লেখযোগ্য লেখকদের মধ্যে ইন্দিরা দেবী , অনুরূপা দেবী , শৈলজানন্দ
মুখোপাধ্যায় , রাজশেখর বসু এবং অন্যান্যদের সঙ্গে চারুচন্দ্রের
নামও করতে হয় । তিনি 'ভারতী' পত্রিকার সম্পাদক এবং 'প্রবাসী'র
সহ-সম্পাদক ছিলেন । তার প্রথম ছোট গল্প ‘মরমের কথা’ প্রবাসীতেই
প্রকাশিত হয় । ‘স্রোতের ফুল’ , ‘পরগাছা’ প্রভৃতি তার রচিত ২৫টি
উপন্যাসের অন্যতম । ছোটদের জন্যও তিনি লিখেছেন , বেশ কয়েকটি
গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশ করেছেন ছোটদের উপযোগী করে । তবে তিনি
সমধিক পরিচিত তার রবীন্দ্র-গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘রবি-রশ্মি’র জন্য
। বাংলা ভাষার উপর তার যথেষ্ট দখল ছিল । সেকালের বহু রচনাতেই
যেমন পরাধীন দেশে বিদেশী শাসকদের অবহেলা ও অত্যাচার থেকে উদ্ভুত
যন্ত্রণার উল্লেখ রয়েছে , বর্তমান লেখাটির উপজীব্য বিষয়ও সেটাই
। এখনকার প্রজন্মের কাছে এই রচনায় চিত্রিত পরাধীনতার তীব্র ক্ষোভ
জনিত অভিব্যক্তি এবং ভাষা কেমন লাগে সেটা পাঠকরাই বিচার করবেন
। চারুচন্দ্রের মৃত্যু হয় ১৯৩৮ সালের ১৭ই ডিসেম্বর ।
দীপক
সেনগুপ্ত]
রহিম একে গরিবের ছেলে, তায়
অনাথ - এতিম্| তাহার না আছে আশ্রয়, আর না আছে কোনো নির্দিষ্ট
কর্ম্ম| প্রকৃতির কাছে প্রশ্রয় পাইয়া তাহার মনটা হইয়াছিল
বিচিত্র ও উচ্চাকাঙ্খায় ভরা|
রহিমের চোখ দুটা দিনের রূপের দর্পণ যেন; - সন্ধ্যায়
ম্লান নিষ্প্রভ হইয়া রাত্রির অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইয়া
পড়িত, আবার ঊষার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে তাহার চোখ দুটিও
উজ্জ্বল হইতে আরম্ভ করিত; ঊষার গোলাপী আভার উপর যখন
নবারুণের লালিমা-সম্পাত হইত তখন রহিমের চোখ দুটাও গলা
সোনার মতন উজ্জ্বলতায় টলটল করিত; শরতের সোনালি রৌদ্র
যখন তাহার কালো বাবরী চুলের উপর ও তাতারী ফর্সা মুখের
উপর আসিয়া পড়িত, তখন তাহার চোখ দুটাও অগ্নিশিখার প্রসারণ-সঙ্কোচনের
মতন জ্বল জ্বল করিতে থাকিত-সে দেখিত শরতের ক্ষেত-ভরা
শস্যের উপর শিশির পড়িয়াছে, তাহার উপর ঊষার গোলাপী আলো
ও অরুণের লালিম সোনালি আভা তেরছা হইয়া পড়িয়াছে, দূরে
দিক-বলয়ের ধারে নীল বনের কোলে ধূসর কুয়াসার পাতলা জাল
ঝুলিতেছে - যেন সুন্দরীর নীল নয়নের ছানি; একটা মেটে
রঙের খরগোশ ফসল-ক্ষেতের ভিতর দিয়া গাছগুলিতে দোলা দিয়া
ঢেউ তুলিয়া শিশির ঝরাইয়া রামধনুর রং চমকাইয়া ছুটিয়া
গেল; পাখীরা ডাকাডাকি করিয়া পরস্পরকে জাগ্রত করিয়া বাসা
ছাড়িয়া উড়িতেছে আর হঠাৎ ভার-মুক্ত হইয়া পলকা ডালগুলি
দুলিতেছে|
তাহার দৃষ্টি ছিল তীক্ষ্ণ এবং ব্যগ্র, উচ্চাকাঙ্খায়
জ্বল জ্বল, - যেন খাপেরুদ্ধ শাণিত ছোরার জলুশ, বাদশাজাদারা
হাওয়া-কাপড়ের ওঢ়না-ঢাকা বাদশাজাদীর শুভ্র বুকের উপরকার
মণিহারের ধুকধুকির উপর আলোর ঠিকরিয়া পড়া! তাহার খালি-পায়ের
গতিতে ছিল ছন্দ-বাদশাজাদার আরবী ঘোড়ার দুলকি-চাল| তার
সর্ব্বাঙ্গের বলনিতে ছিল আনন্দ ও আগ্রহ - তখনও তাহা
প্রকাশ পাইত যখন সে তাহার হাতীর দাঁতের মতন গোল গোল
ফর্সা বাহুর বলনির উপর একমাথা কালো লম্বা চুল ছড়াইয়া
সটান লম্বা হইয়া মাটিতে শুইয়া পড়িয়া শুনিতে পাইত দূরে
বাজ শিকারীদের এক বিশেষ ধরণের চীৎকার সুগম্ভীর স্তব্ধতা
- অসহন অপেক্ষার শিহরণ যেন গুম্বজের খোলের মতন গভীর
নিস্তব্ধ হইয়া বুকের উপর চাপিয়া বসিয়াছে| তারপর? তার
পর দুটি শাদা কালো দাগ জড়াজড়ি করিয়া ঘুরপাক খাইতে খাইতে
স্বচ্ছ নীল আকাশের শামিয়ানার সীমানার দিকে উঠিয়া চলিয়াছে
- ইহা দেখিয়াই রহিম হাতের কুনুই-এ ভর করিয়া কাত হইয়া
উঠিয়া পড়ে, তখন তাহার চক্ষু বিস্ফারিত, দৃষ্টি স্থির,
মুখ আগ্রহে ঈষৎ উন্মুক্ত| তার পর? তার পর যখন সেই শাদা-কালো
ফোঁটা আঁকা-বাঁকা শিথিলগতিতে, আর কালো দাগটা বরাবর তার
উপরে থাকিয়া নামিয়া আসে সোজা-বল্লমের মতন, তীরের মতন,
তখন নীল আকাশের খোল তার শিকারীদের চিৎকারের আঘাতে বড়
একটা উপুড়-করা ঘন্টার মতন বাজিতে থাকে, সওয়ারেরা ঘোড়া
ছুটাইয়া বাজের নখে বিদীর্ণবক্ষে বকের ও বিজয়ী বাজের
পতন ও অবতরণ দেখিতে যায়| আর সঙ্গে সঙ্গে বালক রহিমও
ছুটিয়া চলে| যখন প্রত্যাবৃত্ত বিজয়ী বাজের চোখ বাঁধিয়া
তাহার প্রভু হাতের উপর বসাইয়া তাহার জয়ের উল্লাসে বিকম্পিত
ও যুদ্ধে শ্রান্ত শিথিল ডানার উপর হাত বুলাইয়া দিতে
থাকে, তখন রহিম আনন্দে হাততালি দিয়া চীৎকার করিয়া উঠে|
সে প্রায়ই শিকারীদের সহিত বাজ-বাহাদুর নবাবাজাদার আস্তাবলে
ফিরিয়া গিয়া দেখিত বাজ-বরদার সোনার গামলায় গোলাপজলে
বাজের রক্তমাখা হলুদবর্ণ পা দুখানি ধোয়াইয়া নয়নসুখ রেশমী
রুমালে কেমন যত্নে সন্তর্পণে মুছাইয়া দেয়, যেন সে বাদশাজাদারই
ছেলে; তার পর বাজের গলায় হাত বুলাইয়া সুড়সুড়ি দিয়া চুমকুড়ি
দিয়া দিলসা দিতে থাকে, আর বাজ সুখাবেশে চোখ বুজিয়া বাজবরদারের
কাঁধে মাথা রাখিয়া শিকার করার সুখস্বপ্ন দেখিতে থাকে|
রহিম নিজের পরমায়ুর দশ বৎসর বা নিজের হাতের দশ আঙ্গুলের
একটার বিনিময়ে যদি একদিন অমনি করিয়া ঐ গর্ব্বগম্ভীর
বাজপাখীকে হাতে লইয়া আদর করিতে পারিত! কিন্তু ঐ বাজপাখীকে
ত তাহার ছুঁইবার জো নাই - উহারা যে বাদশাহী পাখী| নবারের
হুকুম - নবাবা বংশ ও আমীর-ওমরাহ ছাড়া আরো কারো বাজ পোষা
বা বাজের শিকার খেলা নিষেধ - বাজ বাদশাহী পাখী| তাদের
তীক্ষ্ণ নখ কিংখাবের দস্তানার খাপে ঢাকা থাকে, তাদের
চোখ কোমল রেশমী সূতার ফুলকাটা সার্টিনের পটিতে বাঁধা
থাকে, তারা তাজা মাংসের শিক-কাবাব খায় আর বিশেষজ্ঞ খিদ্মদ্গারেরা
তাদের সঙ্গে বিচিত্র শব্দ করিয়া কায়দা-দুরস্ত আলাপ করে|
রহিম যখন বাজপাখীর আলস্য-ঢুলুঢুলু বড় বড় চোখের দিকে
তাকাইয়া দেখিত তখন কেমন এক লজ্জায় তাহার মন ভরিয়া উঠিত-বিশেষতঃ
নবাবজাদার তাতারী বাজকে দেখিলে, - তাহার চোখের ঠুলি
লাল কিংখাবের, তাহার নখ-ঢাকা দস্তানা লাল কিংখাবের,
তাহার পায়ে রূপার ঘুঙুর, তাহার পায়ে বাঁধা রেশমী ডুরী,
তাহার দৃষ্টিতে গর্ব্বিত অবহেলা, আর তাহার সঙ্গে ফিরে
তাহার বীরত্বের কাহিনীর অপূর্ব্ব ছটা প্রভামণ্ডলের মতন
তাহাকে ঘিরিয়া|
বাচ্চা বাজদের ধরিয়া আনিয়া পোষ মানানো হয়-অন্ধকারে উপবাসে
রাখিয়া; তারা বন্দীদশার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে এখনো থাকিয়া
থাকিয়া রাগে ফুলে, চোখ-ঢাকা ঠুলির আবরণ-রাত্রিতে আবৃত
হইয়া তাহারা মুক্তপক্ষ বিস্তার করিয়া শিকার ধরিবার সুখস্বপ্নে
থাকিয়া থাকিয়া কম্পিত হইয়া উঠে, ডাকিবার উপক্রমে গলা
লম্বা করিয়া ফুলাইয়া ফুলাইয়া তুলে| ইহাদের সে কখনো কখনো
খাঁচা হইতে বাহির করিয়া হাতে করিয়াছে| সে ইহাদের চোখের
ঠুলি খুলিয়া আলোক দেখাইয়াছে এবং উহারা আলোকাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে
চকিত হইয়া নখ দিয়া তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়াছে; কিন্তু
পরক্ষণেই তাহাদের চোখে আলো সহিয়া চোখ সঙ্কুচিত হইয়া
আসিয়াছে, তাহারা শান্ত হইয়া পড়িয়াছে, যেমন শান্ত থাকে
যখন সে তাহাদিগকে টাটকা-কাটা গরম রক্তমাখা মাংসের টুকরা
আদর করিয়া খাওয়ায়| কিন্তু ইহাদের নাড়িয়া-চাড়িয়া তাহার
তৃপ্তি ছিল না, এদের পুষ্ট বক্ষ নয়, অমন লম্বা-চওড়া
ডানা নাই, অমন সংযত শান্ত শক্তি নাই| কিন্তু আনকোরা
বাচ্চা বাজদের শিকারে কায়দা-দুরুস্ত রকমে তালিম করিয়া
তোলা দেখিতেও কম আনন্দ সে পাইত না-ক্রমে তাহাদের স্বাধীনতার
স্মৃতি যতই মুছে আসে তাহারা ততই গম্ভীর অন্ধ হুকুমের
দাস হইয়া তাহাদের দাঁড়ে বসিয়া ঝিমায়|
প্রথমে তাহাদের
বন্দী-দশায় আড়ষ্ট ডানা মেলিয়া আবার স্বচ্ছন্দে উড়িতে
শিখানো হয়, কিন্তু তখনো তাহাদের পায়ের সঙ্গে ঘুড়ির সূতার
মতন লম্বা ডুরি বাঁধা থাকে; ক্রমে তাহারা বাজবরদারদের
ডাকে বকের-ডানা লাগানো লাল কাপড়ের নকল পাখীর উপর পাক
খাইয়া ছোঁ মারিতে শিখিলে তাহাদের পায়ের দড়ির বাঁধনও
খোলা হয়| বাজবরদারদেরা যখন নকল পাখীকে দড়িতে বাঁধিয়া
শূণ্যে বিশেষ ছকের চক্রাকারে ঘুরাইয়া বজপাখীদের প্রলুব্ধ
করিতে থাকে, - সে কী চমৎকার দৃশ্য! সেই নকল পাখীর বুকে
মুরগীর বুক থেকে টাটকা-ছেঁড়া রক্তমাখা কলিজা বাঁধা থাকে-
বাজপাখী ছোঁ মারিয়া নকল পাখীর বুক ছিঁড়িয়া সেই কলিজা
পুরস্কার লয়| রক্তের লালসায় পরের হুকুমের বশ হওয়া তাহাদের
সহিয়া যায় - বন্ধন দশার রোষ তাহাদের ক্ষীণ হইয়া আসে|
ক্রমে তাহারা প্রভুর হুকুমে উড়িতে ও ফিরিয়া আসিতে এমন
অভ্যস্ত হইয়া উঠে যে বাজের পায়ের বন্ধন-ডুরিতে পলায়ন-চেষ্টার
টান আর লাগে না, মুক্ত হওয়ার বন্য আগ্রহের উজ্জ্বলতা
তাহাদের চোখে আর দেখা যায় না; তাহারা দস্তুর মত এখন
কোন শিকারের পিছু ছুটিতে হইবে সেই হুকুমের প্রতীক্ষায়
শান্তভাবে ঝিমায় এবং হুকুম পাইলে যথারীতি দস্তুরমাফিক
উড়িতে আরম্ভ করে| ধনুকের মতন বক্র পথে-যথাসময়ে শিকারের
উপর ঘুরিয়া আসিয়া অলসভাবে খেলাচ্ছলে ছোঁ মারিয়া ঝুঁকিয়া
পড়িবে বলিয়া; তাহাদের পায়ের বাঁধন খসাইয়া দিলেও তাহারা
এখন আর মুক্তির আনন্দ অনুভব করে না - স্বাধীনতার উন্মাদনায়
শিহরিয়া উঠে না|
তখন তাহাদের প্রত্যেকের
যোগ্যতা বিচার করেন তাহাদের প্রভু - কোনটা হরিয়াল শিকারে
পটু, কোনটা তিতির শিকারে দক্ষ, আর কোনটার বা চড়ুই-পাখীর
চেয়ে বড় শিকারের যোগ্যতা নাই| বড় বাজগুলিকে খরগোশ বক
চিল শিকারে নিযুক্ত করা হয় - চিল শিকারে - কাকের মতন
ঘৃণ্য পাখী, কিছুতেই পোষ মানে না, তীক্ষ্ণ নখচঞ্চুতে
দুর্দ্ধর্ষ ভয়ঙ্কর|
প্রথম প্রথম তাহাদের
হন্তব্য পাখীর আকারের নকল পাখী উড়াইয়া তাহাদের তালিম
করা হয় - সেই নকল পাখীর বুকের মধ্যে ভরিয়া দেয় তাহাদের
প্রিয় খাদ্য, তাহারা তাহা নকল পাখীর বুক ছিঁড়িয়া খুঁজিয়া
বাহির করিয়া পুরস্কার লয়| তাহার পরে তাহাদিগের সামনে
জখমী পাখী ছুড়িয়া দিয়া তাহাদের তালিম করা হয় - জখমী
পাখীর বুক ছিঁড়িয়া কলিজা উপড়াইতে সহজেই পারে, অথচ জীবন্ত
প্রাণী বধ করিবার হিংস্র আনন্দ তাহাদের উত্তেজিত করিয়া
তোলে| ক্রমে তাহারা ধরা কঠিন শিকার ধরিতে অভ্যাস করে
এবং শিকারের নেশার পরিচয়ে শিকারের প্রতীক্ষায় উন্মুখ
হইয়া থাকে| এইরূপে তাহাদের বন্য হিংস্রতা পুনর্ব্বার
পূর্ণজাগ্রত হইয়া উঠে, কিন্তু তাহা সংযমে মহিমান্বিত-তাহারা
মরণাহত শিকারের বুক চিরিয়া রক্তের নেশার মত্ততায় এক
চুমুক রক্ত পান করিয়াই তাহাকে ত্যাগ করে, - তাহাদের
শিকার যখন মাটিতে রক্তাপ্লুত হইয়া লুণ্ঠিত হয়, তখন তাহারা
বাজবরদারের হাতে বসিয়া নকসাকাটা রেকাবি হইতে মসলাদার
খুশবু কাবাব নবাবী চালে চাখিয়া চাখিয়া খাইতে থাকে -
নবাবের পাখী নবাবী কায়দায় অভ্যস্ত|
তাহাদের চক্ষু আলস্যভরা অথচ গর্ব্বিত - দিনের আলোকের
দর্পণ| তাহাদের চোখের ঠুলি যখন খোলা হয় তখন দৃষ্টি থাকে
কালো; যখন শিকারের পিছনে তাড়া করে তখন তরল সোনার মতন
জ্বলজ্বলে; আর যখন ভয়ার্ত্ত শিকারের কাতর ক্রন্দন অনুসরণ
করিয়া তাহারা ছোঁ মারে তখন তাহাদের চোখ হয় আগুনের ফুলকি!
তাহারা সকলেই রহিমের রোদপোড়া ফর্সা হাতের উপর আদরে গলিয়া
ঝুঁকিয়া পড়ে বটে, কিন্তু এরা কেউ সেই তাতারী বাজের সমকক্ষ
নয়-তাহার চক্ষে কী বাদশাহী আলস্য আর অবহেলা! রহিম ইহাদের
সকলের উপর বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছিল-তাহারা তাহার সহিত খেলা
করিতে চেষ্টা করিলে সে তাহাদের খেলায় খোলা ঠোঁট ধরিয়া
জোরে চাপিয়া বুজাইয়া দিত এবং তাচ্ছিল্যভরে তাহাদের হাত
হইতে ঝাড়িয়া ফেলিত, এবং চিলের ডাক নকল করিয়া তাহাদিগকে
অস্বস্তিতে কাঁপাইয়া তুলিত - তাহারা খাঁচা ছাড়িয়া মিথ্যা
চিলের ডাকে প্রলুব্ধ হইয়া ছুটিয়া বাহির হইত-সামনে তাহাদের
শূণ্য মাঠ ও পশ্চাতে তাহাদের গালাগালি!
নবাবজাদা রোজ আরবী ঘোড়ার সওয়ার হইয়া শিকার খেলেন-রক্তের
মতন লাল মখমলে জরির কাজ করা কিংখাবের পোষাক! রূপার ঘুঙুর
বাজাইয়া তাতারী বাজ যখন উড়ে তখন নবাবজাদার অন্তরে যেন
গান বাজে, তিনি ঘন ঘন নিশ্বাসে প্রভাতের হাল্কা বাতাস
মদের মতন পান করিয়া উত্তেজিত হইয়া উঠেন!
একদিন নবাবজাদার পরম তাতারী বাজ
একটা শ্বেতপদ্মের মতন একটা বকের বুক ছিঁড়িয়া তাহাকে
রক্তকমলে পরিণত করিল - বকটা শরবনের পাশে জলার উপর পড়িয়া
গেল, শিকারীরা গিয়া মৃত্যু যন্ত্রণায় বিলুণ্ঠিত বকের
গলা জবাই করিয়া উহাকে আনিয়াছিল, কিন্তু বাজের আর কোনো
সন্ধানই তাহারা পাইল না| সে হয় অন্য কোনো শিকারের পিছনে
উধাও হইয়া গিয়াছে, কিংবা কালো জলে নিজের ছায়া দেখিয়া
ভয় পাইয়া ভাগিয়াছে অথবা সে মনের আনন্দে বাতাসে গা ভাসাইয়া
নিরুদ্দেশ যাত্রা করিয়াছে| বৃথাই তাহারা খুঁজিল, বৃথাই
তাহারা তাহাকে বাছা! বাছা! আদরের নামে ডাকাডাকি করিল,
বৃথাই তাহারা শীশ দিয়া বাঁশী বাজাইয়া বন কাঁপাইয়া তুলিল|
নবাবজাদা সর্দ্দার বাজবরদারের মুখে ঘোড়ার কোড়া মারিয়া
তাহাকে রক্তাক্ত করিয়া দিল এবং জলা জঙ্গল না মানিয়া
সটান সোজা ঘোড়া দৌড়াইয়া বাড়ি ফিরিয়া চলিল - তাহারা ঠোঁট
জোরে চাপা ও অলস চোখের উপর চোখের পাতা ঝুঁকিয়া দৃষ্টিতে
অন্ধকার ঘনাইয়া তুলিয়াছিল| বাজপাখী তাহারা খুঁজিয়া পাইল
না|
কিন্তু রহিম তাহাকে পাইল| একটা ঝোঁপের কাঁটায় তাহার
রেশমী সূতায় গাঁথা সোনার ঘুঙুর জড়াইয়া আটকাইয়া গিয়াছিল
- সে গাছের ডাল নখে চাপিয়া ডানা তুলিয়া গলা বাড়াইয়া
চোখ পাকাইয়া ঠোঁট শানাইয়া বন্ধন-দশায় শত্রুর আক্রমণ
প্রতিহত করিবার জন্য একেবারে যুদ্ধোদ্যত হইয়াছিল-তাহার
সর্ব্বাঙ্গের ভঙ্গীতে মরীয়া ভাব-সে অনশনে মৃত্যুর অপেক্ষা
করিতেছে| ঝাঁকড়া সবুজ গাছে বড় বড় বৈঁচী পাকিয়া লাল হইয়া
আছে এবং তাহার উপর বসিয়া আছে বাদশাহী তাতারী - যেন চুনীর
মিনা করা পান্নার সিংহাসনে বাদশাহ বসিয়া যুদ্ধ ঘোষণার
হুকুম দিতেছে| রহিম তাড়াতাড়ি তাতারী বাজকে মুক্ত করিতে
গেল-কাঁটার আটক হইতে বাজের পায়ের ঘুঙুর ছড়াইতে হাত বাড়াইয়াই
আনন্দের উত্তেজনায় তাহার হাত কাঁপিতে লাগিল, বাদশাহজাদার
মোহর-খোদা সোনার ঘুঙুর তাহার আঙ্গুলের নাড়া পাইয়া বাজিয়া
উঠিল ও সেই সঙ্গে তাহার অন্তরও আনন্দে বাজিতে লাগিল,
তারপর যখন সে বাজপাখীকে মুক্ত করিয়া নিজের হাতের উপর
তুলিয়া বসাইল ও বাজ তাহার তীক্ষ্ণ নখ ফুটাইয়া রহিমের
হাত চাপিয়া ধরিল তখন সে উল্লাসে চীৎকার করিয়া উঠিল-এই
হারানো বাজ সে খুঁজিয়া পাইয়াছে, এ এখন তাহার - এই বিস্তৃতবক্ষে
দীর্ঘপক্ষ স্বর্ণচক্ষু বাদশাহী বাজ! এ যে সম্পূর্ণ তাহার
- আর কাহাকেও ত সে ইহাকে দেখাইতেও পারিবে না-এ শুধু
তাহার, একান্ত তাহার! গহন বনের বুকে ইহার জন্য একটা
খাঁচা বানাইতে হইবে, ভোর বেলা ইহার চোখের ঘুম ভাঙ্গিবার
আগেই সে চুরি করিয়া চুপি চুপি বনের মধ্যে যাইবে, তাহারা
দুজনে বিজন প্রান্তর দিয়া ভোরের গোলাপী আকাশে সন্ধানী
দৃষ্টি বুলাইতে বুলাইতে শিকার খুঁজিয়া ফিরিবে, তাহারা
পরস্পরে পরিচিত হইয়া উঠিবে-বাজপাখী তাহাকে ভালোবাসিবে,
সে ত তাহাকে ভালোবাসেই| তাহাদের মাথার উপর প্রভাতের
সোনালী আলো ঝরিয়া পড়িবে, তাহাদের দুজনের গোপন প্রভাতের
শীতল বাতাসে মিলাইয়া যাইবে, রহিম তাহার প্রাণের যত্নে
বাজপাখীর কিংখাবের দস্তানা আর মুক্তার ঝালর দেওয়া চোখের
ঠুলি আর রাজভোগের অভাব ভুলাইয়া রাখিবে|
রহিম বাজপাখীকে এক গাছে বাঁধিয়া রাখিয়া ছুটিয়া নিকটের
এক পুষ্করিণীর পাড়ে গেল| সেখানে জলে কাহার হাঁস চরিতেছিল,
এক ঢিলে একটাকে জখম করিয়া সাঁতার দিয়া গিয়া ধরিল ও তার
পর চুরি করিয়া আবার বনের মধ্যে ছুটিয়া আসিয়া লুকাইল|
বাজপাখী জখমী হাঁসের উপর ছোঁ মারিয়া পড়িয়া তাহার কলিজা
ছিঁড়িয়া গরম রক্ত পান করিল| ইহা দেখিয়া রহিমের মাথা
আনন্দের নেশায় ঝিমঝিম করিতে লাগিল, তাহা হইলে বাজপাখী
তাহাকে ঘৃণা করে নাই, বাজপাখী তবে তাহার হইতে রাজী আছে|
সে তাহার হইল| রহিম যখন ভোরের অন্ধকারে শিশির-ভেজা ঝরা
পাতা মাড়াইয়া তাহার কাছে আসে তখন সে গলা বাড়াইয়া স্থির
বিস্ফারিত চক্ষে তাহার পদধ্বনি শোনে ও তাহার আগমনের
প্রতীক্ষা করে| রহিম আসিয়া হাত বাড়াইয়া দিলেই সে তাহার
খাঁচা হইতে লাফাইয়া বাহির হইয়া তাহার হাতের উপর বসে,
উড়িবার ভঙ্গীতে ডানা উঁচায়, কিন্তু উড়ে না - তাহা শুধু
স্মরণ করাইয়া দিবার নির্বাক ইঙ্গিত, তাহার পরই তাহারা
কোমল আলোকে ক্রমশ প্রকাশমান প্রান্তরে ছুটিয়া বাহির
হইয়া পড়ে|
তাহাদের
চক্ষু গোলাপী আকাশে শিকার সন্ধানে ব্যস্ত হয়| দূরের
পাহাড় জমাট অন্ধকারের মতন, তাহার কোলে বন কাজলের পর্দ্দার
মতন-সমস্ত বৃক্ষ নিদ্রামগ্ন স্তব্ধ, তাহাদের শাখা নিদ্রাচ্ছন্ন
পাখীর ভারে আক্রান্ত| ক্রমে আকাশে জ্বলন্ত স্বর্ণ ও
সিন্দুর ছড়াইয়া পড়িতে থাকে, কালো রেখা নীল হইয়া উঠে,
পেঁচা মাটি ঘেষিয়া উড়িয়া নিজের গোপন কোটরের দিকে ছুটিয়া
যায়, দিবাচর পাখীরা পাখা ঝাড়া দিয়া জাগিয়া উঠিলে প্রথমে
মৃদুস্বরে ও ক্রমে কলকাকলিতে এবং আলোক-বিভাসিত শীতল
বায়ু ভেদ করিয়া উহারা বাণের মতন বেগে বাসা ছাড়িয়া বাহির
হয়| কিন্তু রহিম ও বাজ ইহাদের পরিহার করিয়া চলিতেই থাকে-চড়ুই
বুলবুল দোয়েল-সব ছোট পাখী-তাহারা তাহাদের শিকারের যোগ্য
নয়| জলার দিক হইতে বক আর চকাচকীর টানা ডাক ও তাহাদের
ঝটপটানি শোনা যায়-ঐ ত তাহাদের যোগ্য শিকারের ক্ষেত্র|
তখন রহিম বিস্তারিত-বক্ষ বাজকে উপরে ছুড়িয়া দেয়, তাহার
পাখা অরুণালোকে জ্বলিয়া উঠে, রহিম অন্ধপ্রায় চোখে হতচেতন
বুদ্ধিতে পাখী দিকে তাকাইয়া থাকে - সে শিশির-ধোয়া নির্ম্মল
নীল আকাশের কোলে গুটিসুটি হইয়া বাণফলকে মতন উড়িয়া যায়,
তাহার পায়ের সোনার ঘুঙুর পাখীদের প্রভাত কাকলিকে উপহাস
করিয়া বাজিতে থাকে|
বকগুলা বাজের ভয়ে চাকার মতন ঘুরপাক খায়| এই জলের মধ্যে
ঝাঁপাইয়া পড়িতে যায়, তাহাদের লম্বা গলা ও বোকার মতন
ছোট্ট মাথার উপর পিঠের দিকে ঝুলানো হলদে রঙের টিকি দুলাইয়া
তাহারা অসম্ভব রকম স্থানে লুকাইবার চেষ্টা করিয়া হাস্যাস্পদ
হয়, বাজের আক্রমণ হইতে অব্যাহতি পাইবার জন্য পাকাইয়া
পাকাইয়া উপরে উঠিতে থাকে, এবং লম্বা লম্বা শাদা ডানা
মেলিয়া শত্রুর নাগালের বাহিরে গিয়া পড়িবার প্রাণপণ চেষ্টায়
তাহাদের রক্তশূণ্য ক্ষুদ্র হৃদয় প্রভাত-সমীরণে বাঁশ-পাতার
মতন থরথর করিয়া কাঁপিতে থাকে|
কিন্তু বাজপাখী বকের দল থেকে প্রথমের সবচেয়ে বড় জোরালো
ও ঠিক তাহার ঊর্দ্ধে উড্ডীন একটাকে বাছিয়া নিজের লক্ষ্য
স্থির করিয়া লয়, কারণ সে নিজের বলবিক্রমের পরিচয় দিতে
সদাই ব্যগ্র এবং সে খাড়া সোজা উপরে উঠিয়া যাইবার সময়
নিজের পাখায় প্রভাতের স্নিগ্ধ লঘু বাতাসের সংস্পর্শ
লাভের আনন্দ সর্ব্বাঙ্গ দিয়া অনুভব করিতে চায়, তাই যেন
সে রশি বাহিয়া উপরে উঠার ন্যায় একটা অরুণরশ্মী বাহিয়া
উপরে উঠিয়া যায়| শীঘ্রই সে সকল পাখীকে পরাস্ত করিয়া
সকলের উপরে উঠিয়া যায়; তাকে তখন চড়াই-পাখীর চেয়েও ছোট
দেখায়; কিন্তু তাহার ডানা বিস্তারের অবলীল ভঙ্গী, তাহার
অঙ্গের শক্তিমান সঞ্চালন দেখিলেই অনুভব করা যায় তাহার
ক্রুর হিংস্র দৃষ্টির স্বচ্ছ উজ্জ্বলতা ও তাহার চঞ্চু-নখের
প্রখরতা| হঠাৎ সে ডানা গায়ের সঙ্গে গুটাইয়া লইয়া বাণের
ভারী ফলার মতন উপর হইতে বকের ভয়ে-ফিরানো অসহায় গলার
উপর আসিয়া পড়ে এবং একসঙ্গে একখণ্ড পাথরের মতন সটান সোজা
মাটিতে আসিয়া পড়ে - এক ডানাও এদিক-ওদিক বাঁকিয়া যায়
না| তখন রহিম দৌড়াইয়া সাঁৎরাইয়া কাদা ভাঙ্গিয়া বনজঙ্গল
ঠেলিয়া পতনের আঘাতে অভিভূত ও ভয়ে জড়ীভূত বকের কাছে ছুটিয়া
যায় - যেন সে মরিয়া হইয়া হতাশার সাহসে হিংস্র হইয়া তাহার
লম্বা ঠোঁট দিয়া বাজের অঙ্গে প্রত্যাঘাত না করে| বাজ
শীঘ্রই তাহার শিকারকে মরণ-মার মারিয়া তাহার বড় বড় প্রশান্ত
চোখের উজ্জ্বল দৃষ্টি ফিরাইয়া নিজের প্রভুর দিকে দেখে,
এবং সদ্যসংহার করা শিকারের গরম কলিজা পুরস্কার পাইবার
প্রতীক্ষা করে|
ইহার পর সেদিন সে আর উড়ে না|
রহিম যখন তাহাকে বাতাসে ছুড়িয়া দিয়া তাহাকে দিলাশা দিবার
ধ্বনি করিতে করিতে তাহার আগে ছুটিয়া যায়, তখন সে ডানার
দুই ঝাপটায় রহিমের নাগাল ধরিয়া তাহার হাসিমুখের পাশে
কাঁধের উপর দিয়া দাম্ভিক গম্ভীরভাবে বসে| উহার যেন ছেলেখেলা
ভালো লাগে না এবং রহিমও বাজের দূরপ্রসারিত দৃষ্টির গম্ভীরতায়
আচ্ছন্ন হইয়া খেলা হইতে ক্ষান্ত হয়|
রহিম সেই বাজকে এমন ভালোবাসিল যেমন ভালো সে আর কাহাকেও
ও কিছুকেই বাসে নাই; সে যেন তাহার প্রাণ, তাহার বাসনা,
তাহার তৃষ্ণা - উহার ডানা কত প্রশস্ত, উহার দৃষ্টিতে
জয়ের কি নিশ্চয়তা! কিন্তু রহিমের এই গুপ্তপ্রণয়ে বেদনা
বিদ্ধ হইয়াছিল, একটা আসন্ন দুর্ভাগ্যের আশঙ্কায় কালিমা
তাহার আনন্দ আচ্ছন্ন করিয়া রখিয়াছিল| কখনো কখনো রহিমের
ভয় হইত যে, বাজপাখী হয়ত একদিন দারুণ তাচ্ছিল্যভরে তাহাকে
ছাড়িয়া উড়িয়া চলিয়া যাইবে এবং তাহার পায়ের ঘুঙুর বিদ্রুপে
বাজাইয়া দৃষ্টির বহির্ভূত হইয়া যাইবে, এবং সেই তাহার
প্রাণসদৃশ পাখীহারা শূণ্য অস্তিত্ব মৃত্যুরই সামিল হইবে|
কখনো কখনো রহিমের মনে হইত যে এই বাজপাখী যেন মূর্ত্তিমান
মহিমা - তাহা নীলের জমিতে সূর্য্যালোকে উদ্ভাসিত হইয়া
উড়িয়া বেড়ায়, অথবা তাহার কাঁধের উপর বসিয়া নূতন কীর্ত্তি
অর্জ্জন প্রতীক্ষা করে; এই সম্ভ্রমের আনন্দে রহিম নিজের
তুচ্ছতার অনুভবে কাতর হইয়া পড়িত, তখন সে ঐ মহিমামণ্ডিত
বাজপাখীর দিকে তাহার হীন দৃষ্টি তুলিয়া আর চাহিতে সাহস
পাইত না| তাহার মনে এই দুঃখ জমিয়া ছিল যে ঐ পাখী তাহার
আনন্দের দিকে দৃকপাত করে না, উহার চক্ষুর তীব্র দৃষ্টি
তাহার চোখে চোখ মিলিয়া স্নেহপ্রীতিতে গলিয়া কোমল হইয়া
আসে না| এইসব চিন্তা করিতে করিতে রহিম স্বপ্নের রাজ্যে
উড়িয়া যাইত|
রহিম খোলা মাঠের
মাঝখানে লাল-মাটির ঢিপিতে মাথা রাখিয়া চিৎ হইয়া শুইয়া
শুইয়া দেখে আকাশের বুকের উপর দিয়া মানুষের অদৃষ্টের
মতন মেঘ ভাসিয়া চলিয়াছে - কখনো মন্থর ভারাক্রান্ত, কখনো
লঘু; কোনোটা নির্দিষ্ট সীমারেখায় রূপস, কোনোটা বিচ্ছিন্ন
রূপহীন; বাতাসের অদৃশ্য হাত মেঘের ঘাড়ে ধাক্কা দিয়া
লইয়া চলিয়াছে নিরুদ্দেশ অসীমের দিকে; গাছপালার পল্কা
ডালপাতা ঝুরঝুর করিয়া বাতাসের অস্তিত্বের কথা রহিমের
কানে কানে বলে; এবং রহিম তাহার প্রাণের দোসর বাজপাখীকে
রূপকথা শোনায়|
আরব্য-উপন্যাসের বাদশা হারুণ-অল-রসিদের রহস্যপূর্ণ আমদরবারের
মহৈশ্বর্য্যের কথা| রহিমও সেকালে সেখানে ছিল - মন্ত্রী
জাফর| প্রকাণ্ড শাদা ঘোড়া তাহাকে পিঠে করিয়া গতির অবেগে
নৃত্য করিত এবং এখনকার এই নতশির তন্দ্রাতুর এই বাজপাখী
তাহার উঁচু হাতের উপর বসিয়া আনন্দোজ্জ্বল দৃষ্টিতে ইঙ্গিত
অন্বেষণ করিত এবং বীরত্বগাথার মহিমাচ্ছটা তাহাদের দুজনকে
বেস্টন করিয়া থাকিত|
মানুষের অদৃষ্টের মতন মেঘপুঞ্জ অদৃশ্য বায়ের ধাক্কা
খাইয়া রহিমের মাথার উপর জমিতেছিল যেন আরব্য-উপন্যাসের
দৈত্যপুরীর গিরিগহ্বরের খিলান| তাহার ফাঁক দিয়া পড়ন্ত
রৌদ্র বল্লমের ফলার মতন বাহির হইয়া আসিতেছিল| এবং বাজপাখী
মাথা ঝুকাইয়া ঝিমাইতে ঝিমাইতে দুঃস্ব্প্নের নিষ্ফল ক্রোধে
জাগ্রত হইয়া গা ঝাড়া দিয়া তীক্ষ্ণ চীৎকার করিয়া উঠিল|
কয়েকজন ছেলে টো টো করিয়া বেড়াইতে বেড়াইতে আসিয়া দেখিল
বাদশাহজাদার হারানো বাজ রহিমের হাতে! এর পরেই বাদশাহজাদার
পেয়াদারা যমদূতের মতন আসিয়া রহিমকে গ্রেপ্তার করিল এবং
বাজপাখী ছিনাইয়া লইল তখন বাজ যথারীতি নিরুদ্বেগ ও গর্ব্বগম্ভীর,
সে একবারও তাহার উদ্ধত গ্রীবা ফিরাইয়া তাহার উদাস অগ্রাহ্য
দৃষ্টি দিয়া রহিমকে দেখিল না - ইহাতে রহিমের হৃদয়ের
রক্ত জল হইয়া গেল|
তাহারা বাজপাখীকে তাহার প্রভুর নিকটে লইয়া গেল, কিন্তু
তিনি তাহাকে ফিরিয়া পাইয়া একটুও আনন্দ প্রকাশ করিলেন
না, তাঁহার হারানো প্রিয় পাখীকে একটা আদরের কথা বলিলেন
না - ছোটলোকের ছুত লাগিয়া তাহার আভিজাত্য- গৌরব ম্লান
হইয়াছে, তাহার জাত গিয়াছে|
বাদশাজাদা রহিমের দারিদ্রের কথা জানিতেন| তিনি রহিমের
সুস্থ শরীরের অনাবৃত পুষ্ট বক্ষের দিকে চাহিয়া তাঁহার
হাত বাড়াইয়া, যেমন করিয়া লোকে হাটে গিয়া নির্ম্মম উদাসীন
ভাবে মাছ বা ছাগলের গা টিপিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখে তেমনি
করিয়া, রহিমের বক্ষ টিপিয়া টিপিয়া দেখিলেন| তাহার পর
তিনি নদীর ওপারের নবাব সাহেবকে নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইলেন
- নবাব-সাহেব যদি তাঁহার যুগল কন্যারত্ন সঙ্গে করিয়া
বাদশাজাদার গরিব খানায় কদমদারী করেন, তাহা হইলে আজ হইতে
তিন দিন পরে একটা মজাদার শিকারের খেলা তাঁহাদের উপস্থিতিতে
অধিকতর মনোরম হইয়া উঠিবে|
কারাগারের অন্ধকারে রহিমের চক্ষু বিস্ফারিত হইয়া উঠিয়াছে;
তাহার কারাগারের কালো অন্ধকারের চেয়েও কালো চোখ স্থির
অচঞ্চল| তাহার চক্ষুতারকা কারাগারের বাহিরে দিনের আবির্ভাবে
সূর্য্যলোকের দর্পণের মতন একটু উজ্জ্বল ও সঙ্কুচিত হইয়া
পড়ে মাত্র|
বাদশাজাদা শিকারের মাঠে চলিয়াছেন, পিছনে পিছনে চলিয়াছে
জাত-খোয়ানো তাতারী বাজ - তিন দিন উপবাসের দরুণ ক্ষুধায়
হিংস্র দৃষ্টি ঠুলিতে ঢাকা উদগ্র প্রখর নখর দস্তানায়
কঠিন করিয়া বাঁধা|
তাহার পিছনে আসিতেছে শুধু এক সার রং - অগ্নিশিখার মতন
জ্বলজ্বলে| ছয়টি তাজা ঘোড়া, তাহাদের গা মাজা ঘষা মসৃণ
চকচকে, বাঁকা ঘাড় পর্য্যন্ত জরির সাজ, কিংখাবের উর্দ্দি-পরা
সহিস তাহাদের আগে আগে ছুটিতেছে; ছয় ঘোড়ায় টানিয়া আনিতেছে
রক্তবর্ণ সওয়ারী গাড়ি রূপালী সোনালি কারচুপীতে মণ্ডিত;
তাহার মধ্যে নবাব-সাহেবের যুগল কন্যার বুকের উপর সোনা-জহরতের
ছড়াছড়ি! সেই গাড়ির পিছনে মখমলের ঘেরা-টোপ ঢাকা ছয় পাল্কীতে
আসিতেছে নবাবজাদিদের ছয় বাঁদী-তাহাদের চুলে মেহেদির
পাটল রং আর চোখের কোলে কালো সুর্ম্মা! তাহাদের পিছে
নবাব-সাহেব আসিতেছেন প্রকাণ্ড দাঁতাল হাতীর পিঠে সোনার
ছত্রী দেওয়া হাতীর দাঁতের হাওদায়!
ছয় জন শিকারী একসঙ্গে শিঙা বাজাইয়া খেলা সুরু ঘোষণা
করিল, - সেই শব্দ বাঁকা শিঙার মুখ হইতে শব্দের চাকার
মতন পাক খাইতে খাইতে মাঠের উপর দিয়া গড়াইয়া গেল| খোলা
মাঠের উঁচু নীচু বাঁকা রেখা সেই শ্ব্দে যেন নাচিতে লাগিল;
ভোরের আকাশের শরাব-রঙা আলো মেঘের কিনারায় পড়িয়া মেঘগুলি
প্রজাপতির ডানার মতন জ্বল জ্বল করিতেছিল|
সকলে আসিয়া একটা ঝোপ ঘিরিয়া ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া দাঁড়াইল
- সে খানেই শিকার বাঁধা আছে| ঘোড়ার পিঠের আস্তরণ বাতাসে
পতপত করিয়া উড়িতে লাগিল; তাহার উপর যেখানে যেখানে ছায়া
পড়িয়াছিল সেখানে সেখানে লাল রং অতৃপ্ত আকাঙ্খার মতন
গাঢ়তর দেখাইতেছিল, এবং যেখানে রৌদ্র লাগিতেছিল সেখানে
সেখানে জয়ের উল্লাসের মতন উজ্জ্বলতা উচ্ছলিত হইয়া উঠিতেছিল|
বাদশাজাদার কৌহূহলী চোখের উৎসুক দৃষ্টি গাড়ির পর্দ্দার
জালির ফুকোরে উঁকি মারিতেছিল, এবং তাহাদের শুভ্র কোমল
কণ্ঠ বেড়িয়া কাঁধের ঢালুর উপর দিয়া রেশমী ওড়না নীচে
ঝুলিয়া পড়িয়াছিল| গাড়ির পর্দ্দা সরাইয়া একটু ফাঁক করিয়া
রাখিয়াছিল একখানি হাত| যেন একটি বক-বন্দী রহিম দেখিতে
দেখিতে ভাবিতেছিল - শিঙার শব্দে ভয় পাইয়া এখনি বুঝি
সে চীৎকার করিয়া পালাইবে| নিক্ষিপ্ত পাথরের মতন শিঙা
শব্দ ছুড়িয়া দিল| সকলে নিস্তব্ধ|
শিঙার শব্দে সচকিত হাত গাড়ির পর্দ্দা অনেকখানি সরাইয়া
ফেলিল - রহিম দেখিল দুটি তন্বী তরুণী, তাহাদের ঠোঁট
দুখানি যেন খোসা-ছাড়ানো একজোড়া কাগজী বাদাম, তাহাদের
চক্ষু দুটি স্বপ্নাবেশে তন্দ্রাতুর, সেই চোখের দৃষ্টি
বহুদূরের অদৃশ্য কিছুকে দেখিতেছে, এবং তাহাদের হাতগুলি
কোলে পড়িয়া আছে কুলায়ে ঘুমন্ত শাদা পাখীর মতন, তাহাদের
জমকালো পোষাকের প্রাচুর্য্য- সব মিলিয়া তাহারা রহিমের
চোখে বেহেস্তের হুরী আর রূপকথার পরীর মতন মহিমান্বিতা
অপূর্ব্বসুন্দরীর রূপে প্রতিভাত হইল| তাহাদের সামনে
বন্ধনে বন্দী বলিয়া রহিমের অত্যন্ত ক্লেশ ও লজ্জা বোধ
হইতে লাগিল|
হঠাৎ সে তাহার দৃষ্টি দূরে প্রসারিত করিয়া দিল - সুন্দরীদের
ছাড়াইয়া, ভয়ে বিস্ময়ে স্তব্ধ হাঁ করা জনতা ছাড়াইয়া,
তাহাকে ছুটাইয়া ক্লান্ত করা ধূসর মাঠ পারাইয়া|
রহিম জানিত তাহার অদৃষ্টে কি শাস্তি অপেক্ষা করিতেছে|
কিন্তু যখন সে দেখিল তাতারী বাজকে চোখ ঢাকিয়া নখ বাঁধিয়া
লইয়া আসিতেছে, তখন সে বুঝিল ঐ পাখীর উপরই তাহাকে শাস্তি
দেবার ভার পড়িয়াছে| তখন আনন্দের হাসিতে তাহার সমস্ত
অন্তর ভরিয়া উঠিল - সে যখন ঐ পাখীর মালিক হইয়া দীর্ঘ
দিনগুলি বাতাসের গান শুনিয়া ও গাছের নাচ দেখিয়া কাটাইত
ঠিক সেইসব দিনের মতন এখনও তাহার হৃদয় গর্ব্বে ধকধক করিয়া
কম্পিত হইতে লাগিল|
চোখের ঠুলি খোলা হইলে বাজপাখী যখন তিন দিন পরে আলো দেখিতে
পইল, সে ব্যগ্র দৃষ্টি চারিদিকে ফিরাইয়া একবার দেখিয়া
লইল; সে ডানা নাড়িয়া উড়িবার শক্তি সঞ্চয় করিয়া প্রস্তুত
হইয়া বাজবরদারের হাত হইতে আকাশে নিক্ষিপ্ত হইবার অপেক্ষায়
উৎসুক হইয়া রহিল; তাহার দৃষ্টি আকাশে তাহার শিকার খুঁজিয়া
বুলাইতে লাগিল, - সে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, ক্ষুধায় হিংস্র,
আগুনের ফুলকির মত জ্বালাময়, - তাহাতে স্মরণের লেশ নাই,
মমতার ছায়া নাই, সে দৃষ্টি কাহাকেও আপনার বলিয়া চিনিল
না|
রহিম একদৃষ্টে পাখীর দিকে চাহিয়াছিল -
যদি তার সঙ্গে একবার চোখাচোখি হয়, তাহা হইলে বাজ নিশ্চয়ই
তাহাকে চিনিতে পারিবে কিন্তু বাজের দৃষ্টি তাহার সঙ্গে
মিলিল না| রহিমের চোখ জলে ভরিয়া উঠিল| রহিম বাজের চোখে
তাহার জীবনের পরম আকাঙ্খা চরম আনন্দ সুখের স্ব্প্ন প্রতিফলিত
দেখিবে আশা করিয়াছিল, কিন্তু দেখিল সেখানে শুধু শিকার
বধের ক্ষুধার্ত্ত লোলুপতা নবাবজাদার পাতলা ঠোঁটের কোণের
ঘৃণা ঔৎসুক্যের মানবীয় ভাবের মতন| রহিমের হৃদয় বাজের
তাচ্ছিল্যে যেন ছিন্ন হইয়া গেল - সে মুখ ঘুরাইয়া লইল,
তাহার চোখ বুজিয়া গেল, তাহার চিন্তা যেন একখাঁচা পাখী
খাঁচার ছোট দরজা খোলা পাইয়া নিজে আগে মুক্তি পাইবার
আগ্রহে পরস্পরে ঝটাপটি করিয়া মরিতে লাগিল|
রহিম যখন এই রকম অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল তখন নকিব ফুকারিয়া
উঠিল, - "বাদশাহী কানুন বাদশাহী খেলা খেলাপ করিলে
হয় বারো তোলা রূপা, নয় ছয় তোলা বুকের রক্ত দিতে হইবে
- এই কানুন বাদশাহী আমোদের পাহারাদার!"
রহিম আর চোখ খুলিল না| তাহার বুক চিরিয়া রক্তপাত করা
হইল যেন রক্তের গন্ধে বাজপাখী সেখানে গিয়া ঝাঁপাইয়া
পড়িয়া তীক্ষ্ণ নখর হানিয়া বিদীর্ণ করিয়া তীক্ষ্ণ চঞ্চু
হৃদয়ে বিদ্ধ করিয়া দিতে পারে| রহিম তবু চোখ মেলিল না|
বাজপাখী যখন তাহার রক্তঝরা বুকে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া তাহার
বক্ষে চঞ্চু বিদ্ধ করিয়া দিল তখনও রহিম চোখ মেলিল না,
একটি শব্দ করিল না, কেবল একবার তাহার সর্ব্বাঙ্গ শিহরিয়া
উঠিল এবং সেই শিহরণ বাজপাখীর ক্রোধ প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল,
তাহার চোখ হইতে আগুন ঠিকরিয়া পড়িতে লাগিল, সে দুই ডানা
বিস্তারিত করিয়া দিল - যেন সে ডানার ঝাপটে রহিমকে প্রহার
করিতে উদ্যত হইয়াছে|
নবাবজাদীদের কৌতূহলী মাথা সামনের দিকে আর একটু ঝুঁকিয়া
গেল, তাহাদের স্বপ্নালস, নেশাভরা চোখের অদ্ভুত দৃষ্টিতে
কৌতুকের দীপ্তি একটু জ্বলিয়া উঠিল; কিন্তু তাহাদের শিথিল
হাত যেমন কোলে পড়িয়াছিল, তেমনি রহিল, তাহাদের জরির পোষাকের
প্রত্যেকটি ভাঁজ যেমন ছিল তেমনি রহিল| কিন্তু রক্তের
গন্ধে ঘোড়াগুলা নাকের ভিতর দিয়া ফুৎকার দিতে লাগিল ও
মাটিতে পা ঠুকিয়া অস্থির হইয়া উঠিল - তাহাদের পিঠের
রক্তবর্ণ চারজামার ঝুলের ঝালর নীল আকাশের গায়ে ঝট্পট্
করিতে লাগিল| শিকারীরা বৃথাই মুখে শিঙা লাগাইয়া মুখে
বাতাস ভরিয়া গাল ফুলাইয়া প্রস্তুত হইয়া দাঁড়াইয়াছিল
- রহিম নির্ব্বাক নিস্পন্দ পড়িয়াই রহিল|
আঘাতের প্রথম বেদনা রহিমের সহ্যশক্তিকে প্রবলবেগে অক্রমণ
করিয়াছিল, তাহার মনে হইয়াছিল তাহার হৃদয় বুঝি ছিঁড়িয়া
উপ্ড়াইয়া বাহির হইয়া পড়িবে; কিন্তু পরে সেই ব্যাথার
তীব্রতায় তাহার অনুভুতি এমন অভিভূত হইয়া পড়িল যে সেই
অনুভব প্রায় সুখের কোটায় গিয়া পৌঁছি পৌঁছি করিতে লাগিল;
এবং যখন তাহার বিদীর্ণ বক্ষ হইতে গরম তাজা রক্তের স্রোত
প্রবাহিত হওয়া সে অনুভব করিতে পারিল এবং বাজের তীক্ষ্ণ
চঞ্চু বারম্বার তাহার বিদীর্ণ বক্ষে আঘাত করিতেছে বুঝিতে
পারিল, তখন রহিম আনন্দের স্বপ্নলোকের নীলিমায় ডুবিয়া
গেল - তখন বাদশাহী বাজের চঞ্চুনখের আঘাতে মৃত্যুর গৌরবে
তাহার জীবন জ্বলিয়া উঠিল - অগ্নিবর্ণ প্রভামণ্ডল তাহার
জীবনকে বেস্টন করিয়া তাহার দৃষ্টি ধাঁধিয়া বীরত্বগাথার
তালে তালে নৃত্য করিতে লাগিল|
বাদশাজাদার যখন মনে হইল যে কানুন-মোতাবেক ছয় তোলা রক্ত
আদায় হইয়া গিয়াছে, তখন তিনি তাঁহার লোকেদের ইশারা করিলেন|
শিকারীরা শিঙার চোঙায় মুলতবী ফুঁ ছাড়িয়া দিল; তাহারা
বাজপাখীকে তুলিয়া লইল - রক্তপানে পরিতৃপ্ত হইয়া তাহার
দৃষ্টি আবার শান্ত গর্ব্বে পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে; সিপাহীরা
বাদশাহী খেলা দেখার তৃপ্তির তালে পা ফেলিয়া নবোদিত রৌদ্রে
স্বর্ণমণ্ডিত দিগ্বলয়ের দিকে মুখ ফিরাইয়া শহরে ফিরিয়া
চলিল| কিন্তু রহিমকে আর জাগ্রত করা গেল না - ভাবুক ছোকরা
আনন্দ মৃত্যুর স্বপ্নে একেবারে ডুবিয়া গিয়াছিল; তাহারা
উহাকে কেবল বন্ধনমুক্ত করিয়া সেইখানেই লাল মাটির উপর
ফেলিয়া চলিয়া গেল|
বাদশাহী তাতারী বাজ আর বাদশাজাদার চিড়িয়াখানায় স্থান
পাইল না - ছোটলোকের ছুত লাগিয়া তাহার জাত গিয়াছে!
( ‘বঙ্গবাণী’ মাসিক পত্রিকা, কার্তিক ১৩৩০ )
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।