প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

কণ্ঠরোধ

দীনেন্দ্রকুমার রায়

[ লেখক পরিচিতি : দীনেন্দ্রকুমারের জন্ম ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দের ২৫শে আগষ্ট বৃহস্পতিবার ( ১২৭৬ বঙ্গাব্দের ১১ই ভাদ্র ) নদীয়া জেলার মেহেরপুর গ্রামে। বাবা ব্রজনাথ কর্মরত ছিলেন কৃষ্ণনগরের জমিদারের সেরেস্তায়। পিতার কাছে কৃষ্ণনগরেই পড়াশোনা; কিন্তু স্কুলের পাঠ শেষ করলেও গণিত শাস্ত্রে তার ভীতি তাকে উচ্চতর পাঠক্রমে পড়ায় উৎসাহিত করে নি। বরং সাহিত্য তাকে আকর্ষণ করতে থাকে। কাকা যদুনাথ ছিলেন মহিষাদল রাজ এস্টেটের ম্যানেজার ও রাজ স্কুলের প্রেসিডেন্ট। পড়াশোনা চালিয়ে না যাওয়ায় কাকা তার উপর সন্তুষ্ট ছিলেন না। যাই হোক, দীনেন্দ্রকুমার মহিষাদল রাজ স্কুলের শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন। শোনা যায় কাকাকে ধরে দীনেন্দ্রনাথ জলধর সেনকে স্কুলের তৃতীয় শিক্ষক পদে নিয়ে আসেন। জলধর এসে ওঠেন তার পরম হিতাকাঙ্খী যদুনাথ রায়ের বাসায়; অবসর সময়ে যদুনাথের ছেলেকে পড়াতেন তিনি। এখানেই চলত দীনেন্দ্রকুমার ও জলধরের সাহিত্য আলোচনা। ১২৯৭-এর অগ্রহায়ণ মাসে দীনেন্দ্রকুমার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। শিক্ষকতার স্বল্প উপার্জ্জনে ব্যয় নির্বাহ কঠিন হওয়ায় তিনি চলে যান রাজসাহীতে জেলা জজের অফিসে কর্মচারী হিসাবে। রবীন্দ্র-ঘণিষ্ঠ লোকেন্দ্রনাথ পালিতের সহায়তায় তার এই কর্মপ্রাপ্তি বলে জানা যায়। উপার্জন কিছুটা বাড়লেও শিক্ষকতার জীবনে যে সাহিত্য চর্চার সুযোগ ছিল রাজসাহীতে তার একান্তই অভাব। যান্ত্রিক একঘেয়েমিতে হাঁপিয়ে ওঠেন দীনেন্দ্রকুমার। অবশ্য তার পরে এখানেই তার সঙ্গে পরিচয় হয় অক্ষয় কুমার সরকারের সঙ্গে। ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রও 'ভারতী' পত্রিকায় লিখতেন এবং দীনেন্দ্রকুমার ছিলেন তার খুব স্নেহের পাত্র। এ ছাড়া রাজসাহীতে আলাপ হয় কান্ত-কবি রজনী কান্ত সেনের সঙ্গে।
এর পরের পর্যায়ে দীনেন্দ্রকুমারের আবার স্থান ও পেশা পরিবর্তন। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে এসে ১৮৯৩ সালে অরবিন্দ ঘোষ বরোদা কলেজে অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ছোট বেলা থেকেই বাইরে থাকায় বাংলা ভাষায় তিনি মোটেই স্বচ্ছন্দ ছিলেন না, অথচ বাংলা শিখবার তার আগ্রহ ছিল প্রবল। তিনি একজন বাংলা শিক্ষকের অনুসন্ধান করছিলেন। ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে দীনেন্দ্রকুমারের ভালই যোগাযোগ ছিল। স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদিত 'ভারতী ও বালক' পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় দীনেন্দ্রকুমারের রচনা 'একটি কুসুমের মর্মকথা : প্রবাদ প্রশ্ন' প্রথম প্রকাশিত হয়। সম্ভবতঃ এই সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথ দীনেন্দ্রকুমারকে মনোনীত করেন অরবিন্দকে বাংলা শেখানোর জন্য। দু'বছর তিনি বরোদায় থেকে অরবিন্দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে মেলামেশার সুযোগ পান। অরবিন্দ সম্বন্ধে তার মূল্যায়ন ও স্মৃতি রোমন্থন ১৯২৪ সালে 'অরবিন্দ প্রসঙ্গ' গ্রন্থে প্রকাশিত হয়।
এদিকে জলধর সেন 'বসুমতী' পত্রিকার দায়িত্ব নিয়ে প্রাক্তন ছাত্র ও সহকর্মী দীনেন্দ্রকুমারকে আহ্বান জানান তার সঙ্গে যোগদানের জন্য। বরোদা থেকে চলে এসে সানন্দে দীনেন্দ্রকুমার 'বসুমতী'তে যোগ দেন। এখান থেকেই তার প্রকৃত সাহিত্য জীবনের শুরু। 'বসুমতী'-র দৈনিক ও মাসিক সংস্করণ দুইএর সঙ্গেই তিনি ঘণিষ্ঠ ভাবে যুক্ত হয়েছিলেন। তার জীবনের শেষ রচনা 'কথাশিল্পীর হত্যারহস্য' বৈশাখ ১৩৫০ সংখ্যা থেকে শুরু করে তার মৃত্যুর (১২ই আষাঢ়,১৩৫০, ২৭শে জুন, ১৯৪৩) পরেও ধারাবাহিক হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল।
ইংরাজিতে এড্গার অ্যালেন পো (Edger Allan Poe ) (১৮০৯ - ১৮৪৯ ) রচিত The Murders in the Rue Morgue (১৮৪১) বইটিকেই প্রথম ডিটেক্টিভ কাহিনী বলে ধরা হয় । শোনা যায় প্রুসিয়ার ( বর্তমানে জার্মানী ) লেখক E.T.A. Hoffmann-এর একটি গল্পের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন । তবে অনেকে উইল্কি কলিন্সকে (Wilkie Collins) (১৮২৪ - ১৮৮৯ ) ডিটেক্টিভ উপন্যাসের জনক বলে মনে করেন । বিখ্যাত লেখক চার্লস ডিকেন্স রচিত Bleak House-ও (১৮৫৩) একটি প্রাচীন গোয়েন্দা কাহিনী । শার্লক হোম্স এসেছেন ১৮৮৬ সালে। যাই হোক, বাংলায় ঠিক গোয়েন্দা কাহিনী না হলেও ১৮৮৮ খৃষ্টাব্দে দারোগা গিরিশচন্দ্র বসু রচিত ‘সেকালের দারোগার কাহিনী’ অপরাধ ও অপরাধীদের নিয়ে সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত গল্প । এর পর উল্লেখযোগ্য লেখক হলেন প্রিয়নাথ মুখোপাধ্য্যায় (১৮৫৫ - ১৯১৭ ), যিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন ‘দারোগার দপ্তর’ লিখে । এই সঙ্গে হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের নামও উল্লেখযোগ্য । এর পর স্বল্প কালের জন্য আবির্ভাব ‘তপস্বিনী’ খ্যাত নগেন্দ্রনাথ গুপ্তর । রহস্য কাহিনীর ইতিহাস অবসর-এও আলাদাভাবে রয়েছে, এ নিয়ে বেশী লেখা নিষ্প্রয়োজন । পরে কিছু গোয়েন্দা কাহিনী রচিত হলেও বিখ্যাত হন তিনজন লেখক পাঁচকড়ি দে (১৮৭৩ - ১৯৪৫ ) , দীনেন্দ্রকুমার রায় ( ১৮৭৩ - ১৯৪৩ ) এবং সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্য । এদের সবার মধ্যে যার জনপ্রিয়তা তখনকার দিনে প্রায় শরৎচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথকেও ছুঁতে চলেছিল তিনি হলেন পাঁচকড়ি দে ।
ঐবসুমতী সাহিত্য মন্দির’-এর প্রতিষ্ঠাতা উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৬৮ - ১৯১৯) ১৩০৭ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে ‘নন্দন কানন’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন; এর সম্পাদক হন দীনেদ্রকুমার। প্রথম সংখ্যা থেকেই এতে প্রকাশিত হয়েছিল তার ধারাবাহিক উপন্যাস ‘জয়সিংহের কুঠী’। অবশ্য এই ধারাবাহিকটি প্রথম বেরোতে শুরু করে ‘দাসী’ নামক মাসিক পত্রিকায় এবং পরে তা ‘নন্দন কানন’-এ প্রকাশিত হতে থাকে। মাসিক পত্রিকা ‘নন্দন কানন’ ক্রমশঃ ক্রাইম পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। শুরু হয় ‘নন্দন কানন সিরিজ’ ও ‘রহস্য লহরী সিরিজ’। এই দুই সিরিজ মিলে তার প্রকাশিত বইএর সংখ্যা প্রায় পাঁচশ। ‘নন্দন কানন’ মাসিক পত্রিকাটি কেন বেশ কিছু সাময়িক-পত্র গবেষকদের নজর এড়িয়ে গেছে এবং তাদের গ্রন্থপঞ্জীতে অন্তর্ভুক্ত হয় নি তা বোঝা কঠিন। জনপ্রিয়তায দীনেদ্রকুমারের রবার্ট ব্লেক পাঁচকড়ি দের দেবেন্দ্রবিজয়কে অতিক্রম করতে পারে নি হয় ত; কিন্তু দীনেদ্রকুমারের লেখনী শুধু গোয়েন্দা কাহিনীতেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে নি।
বহু লোক দীনেন্দ্রকুমারকে শুধু রবার্ট ব্লেকের স্রষ্টা এবং গোয়েন্দা কাহিনীর রচয়িতা বলেই জানেন। কিন্তু পল্লীচিত্র ও পল্লীসমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে তার রসস্নিগ্ধ রচনা পড়ে বিস্মিত হতে হয়। এই রচনাগুলিতে তার চিন্তার ব্যাপ্তি, সাহিত্য প্রতিভা ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখনী চালনার সহজাত ক্ষমতাকেই তুলে ধরে। তার লেখনী সৃষ্ট পল্লীচিত্র, পল্লীবৈচিত্র, পল্লীকথা প্রভৃতি গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত বিবিধ রচনা অসাধারণ বৈচিত্র ও বর্ণময়তায় ভরপুর। ‘সাহিত্য’ সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি স্বয়ং তার পল্লীকথা গ্রন্থের ‘প্রুফ’ সংশোধন করে দিযেছেন; আর পল্লীজীবনকে তুলে ধরার জন্য রবীন্দ্রনাথ তাকে লিখেছেন ‘বাংলা দেশের হৃদয় হইতে আনন্দ ও শান্তি বহন করিয়া আনিয়া আমাকে উপহার দিয়াছেন। ও অনেক পাঠক পল্লীসমাজের বিভিন্ন দিক ও বিষয়বস্তু নিয়ে রচনাকে তার গোয়েন্দা কাহিনীর থেকে বেশি উপভোগ্য বলে মনে করেন। পল্লীজীবনের অন্তর্নিহিত সত্তাকে তিনি আত্মস্থ করেছিলেন। সম্ভবতঃ মুর্শিদাবাদ, মহিষাদল ও রাজসাহীতে থাকা কালীন গ্রাম বাংলা ও পল্লী জীবনের সঙ্গে তার একাত্মতা গড়ে ওঠে। একই সঙ্গে তার লেখনী গোয়েন্দা কাহিনীর জটিল ঘটনা প্রবাহ ও যুক্তিজালের ঘেরাটোপে আবার পল্লীগ্রামের সরলতা ও সজীবতার মুক্ত আঙিনায় কি করে বিচরণ করেছিল ভাবলে আশ্চর্য্য হতে হয়। শেষ জীবনে নদীয়ার মেহেরপুরে তার বাসস্থানের কাছে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি ছাপাখানা; এখান থেকেই তার লেখা দ্রুত গতিতে ছাপা হয়ে বেরোত। দীনেন্দ্রকুমার ‘মুকুল’, ‘শিশুসাথী’, ‘সখা ও সাথী’, ‘মৌচাক’ প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। ছোটদের জন্যও তিনি লিখেছেন। তার রচিত ‘মজার কথা’, ‘লোহার বাক্স’, ‘তালপাতার সিপাই’ ইত্যাদি বহুবিধ রচনা কখনও মজার কখনও হাস্যরসে পূর্ণ। গোয়েন্দা কাহিনী বাদে তার রচিত কিছু গ্রন্থ : বাসন্তী (১৩০৫), হামিদা (১৮৯৯), পট(১৩০১), মজার কথা (১৯০৩), পল্লীচিত্র (১৯০৪), পল্লীবধূ (১৯২৩), তালপাতার সিপাই (১৯২৩), পল্লীকথা (১৩২৪), নায়েবমশাই (১৩৩১), অরবিন্দ প্রসঙ্গ (১৩৩০), সোনার পাহাড় (১৯২৯), নানাসাহেব (১৯২৯), নারীর প্রেম, পল্লীবৈচিত্র্য (১৩১২), কলির কালনেমি, আরব্য উপন্যাস (১৯০২), নেপোলিয়ন বোনাপার্টি (১৯০৩), মহিমময়ী, ঢেঁকির কীর্তি (১৩৩১), আরব্য রজনী (১৩৪২) ইত্যাদি। এ ছাড়া কাশিমবাজার রাজবাটি থেকে প্রকাশিত ‘তিলি পত্রিকা’ এবং সাপ্তাহিকী ‘হিন্দুরঞ্জিকা’ পরিচালনার দায়িত্ব ছিল তার উপর। তার রচনা উদ্ধার করে কিছু পুণঃপ্রকাশিত হয়েছে, আরও হয় ত হবে। জানি না ব্যস্ততা ও চাহিদায় জর্জরিত এই সময়ে ক’জন তার লেখা পড়তে আগ্রহী হবেন। ]
( লেখক পরিচিতি প্রস্তুত করতে বারিদবরণ ঘোষের রচনার সহায্য নেওয়া হয়েছে)।
বি: দ্র: দীনেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে বিভিন্ন তথ্যসূত্রে উল্লেখিত তারিখ নিয়ে এত বিভিন্ন মত সাধারণতঃ দেখা যায় না। তার জন্ম সময় বারিদবরণ ঘোষ বলেছেন ১৮৬৯ সালের ২৫শে আগষ্ট, ‘সাহিত্যসেবক-মঞ্জুষা’য় রয়েছে ১৮ই আগষ্ট, ‘বাঙালি চরিতাভিধান’ অনুসারে ১৮৭৩ সালের ২৬শে আগষ্ট। আন্যান্য কিছু সময় নিয়েও এই ধরণের বিভ্রান্তি রয়েছে।
দীপক সেনগুপ্ত।
প্রথম অংশ

গুজরাট অঞ্চলে যাঁহাদের গতিবিধি আছে , নওসেরা নামক গ্রামটি তাঁহাদের অপরিচিত নহে ; ইহা সুরাটের সন্নিকটস্থ সমুদ্রতীরবর্তী সমৃদ্ধ নগর । নওসেরা গায়কবাড় রাজ্যের একটি প্রধান জেলা ; এখানকার জজ ম্যাজিষ্ট্রেট প্রভৃতি মারাঠা হইলেও এখানকার অধিবাসীগণ প্রধানতঃ পারসী ; শতাব্দীপূর্ব্বে স্বদেশবিতাড়িত বিপন্ন পারসী সম্প্রদায় ভারতের শ্যামলক্রোড়ে আশ্রয় গ্রহণের আশায় সর্ব্বপ্রথমে এই নগরেই তাঁহাদের জাহাজ লাগাইয়াছিলেন । পরে তাঁরা বোম্বে নগরে বাসগৃহাদি নির্ম্মাণ করেন । নওরোয় এখনও বহুসংখ্যক সম্ভ্রান্ত ও সুশিক্ষিত পারসীর বাসগৃহ আছে ; বোম্বে নগরের অনেক বিখ্যাত পারসী ধনপতি নওসেরাতেও এক একটি বিলাসগৃহ নির্ম্মাণ করিয়া রাখিয়াছেন । সমুদ্রতীরবর্তী অবাধবায়ু প্রবাহিত এই পরম স্বাস্থ্যকর নগরটির প্রতি প্রকৃতি দেবীর স্নেহানুরাগের অভাব নাই ; নগরটি দেখিলে বোধ হয় , যেন একটি চিত্রপট । গ্রীষ্মকালে গুর্জ্জরের প্রচণ্ড সৌরকরজালও এখানে অতি স্নিগ্ধভাব ধারণ করে । গুর্জ্জরের তৃণশস্যবর্জ্জিত , নেত্রজ্বালাউৎপাদক বৈচিত্রবিহীন ধূসর মরুক্ষেত্রের মধ্যে নওসেরা যেন নেত্রতৃপ্তিকর শ্যামলতৃণপুঞ্জ ও রমণীয় কুসুমকুঞ্জবিভূষিত , আনন্দকল্লোল মুখরিত , চিরবসন্ত নিসেবিত একখানি সুন্দর ওয়েসিস্ ।

সে আজ প্রায় বিশবৎসরের কথা - এই নগরে একজন বিখ্যাত পারসীধনপতি বাস করিতেন , তাঁহার নাম আপাজি জিজি ভাই জাহাঙ্গীরজী । বোম্বে নগরে আপাজির বিস্তীর্ণ কারবার ছিল , গৃহে তাঁহার একমাত্র সপ্তদশবর্ষীয়া দুহিতা রতনবাই । রতনবাই সুশিক্ষিতা ও সুন্দরী - পিতার আদরিণী কন্যা । রতনবাই-এর বয়স যখন সাত বৎসর , সেই সময় তাঁহার মাতৃবিয়োগ হয় । আপাজী দ্বিতীয় দ্বারপরিগ্রহ করেন নাই ; সংসারে তাঁহার দুইটি মাত্র বন্ধন ছিল - প্রথম সরলা দুহিতার প্রতি পরম স্নেহ , দ্বিতীয় বাণিজ্য । এই দুইটি বন্ধনই যথেষ্ট মনে হওয়ায় তিনি আর একটি নতুন বন্ধন সম্পূর্ণ অনাবশ্যক মনে করিয়াছিলেন - বিবাহ বন্ধনের প্রতি মনোযোগ প্রদানের তাঁহার অবসর ছিল না । সুতরাং সকলেই জানিত , রতনবাই-ই তাঁহার বিপুল ঐশ্বর্য্যের একমাত্র উত্তরাধিকারিণী ।
এ পর্যন্ত আপাজি প্রাণাধিকা দুহিতাকে কোন যুবকের হস্তে সমর্পণ করেন নাই । অধিক বয়সে বিবাহ পারসী সমাজে নিষিদ্ধ নহে । কিন্তু রতনবাই একটি সম্ভ্রান্ত প্রতিবেশী যুবককে ভালবাসিয়া ফেলিয়াছিলেন , এই যুবককটির নাম মাণিকজী মুকাঞ্জি । মাণিকজী আপাজির নিকট রতনবাইএর পাণিগ্রহণের প্রার্থনা করিলে , আপাজি তাঁহাকে কিছুকাল অপেক্ষা করিতে অনুরোধ করেন ,- আপাজি তখন গোপনে যোগ্যতম পাত্রের সন্ধান করিতেছিলেন । ইতিমধ্যে মাণিকজিকে ব্যবসায় উপলক্ষে আরবদেশে যাত্রা করিতে হইল । তাঁহার আশা ছিল তিনি কিছুদিন পরে স্বদেশে প্রত্যাগমন করিয়া প্রিয়তমার পাণিগ্রহণ করিবেন । একদিন বসন্তের সায়াহ্ণে কুসুমিত তরুকুঞ্জে আসন্নবিরহশঙ্কাকুল মাণিকজী , রতনবাইএর নিকট বিদায় গ্রহণ পূর্ব্বক বোম্বে নগরে যাত্রা করিলেন । আপাজির সৌধ্যন্তরালবর্ত্তী উপবনে নিবিড় পত্র চন্দন তরুমূলে একটি কাষ্ঠাসনে বসিয়া স্তম্ভিত হৃদয়া রতনবাই শুভ্রচন্দ্রালোকবিহসিত আকাশের দিকে চাহিয়া রহিলেন । স্তব্ধসান্ধ্য প্রকৃতি তাঁহার মনে কোন সান্ত্বনাদান করিতে পারিল না ।

তিন মাসের মধ্যে মাণিকজীর কোন সংবাদ পাওয়া গেল না । রতনবাইএর দুশ্চিন্তার সীমা রহিল না ; অবশেষে একদিন বজ্রাঘাত হইল । সংবাদ আসিল , আরব সাগর প্রান্তে দুর্দ্দান্ত মুর দস্যুগণ মাণিকজীর সমস্ত পণ্যদ্রব্য লুঠিয়া লইয়াছে , এবং মাণিকজীর হাত পা বাঁধিয়া তাঁহাকে সমুদ্রগর্ভে নিক্ষেপ করিয়াছে । মাণিকজীর মৃত্যুসংবাদ শুনিয়া রতনবাই শয্যাগ্রহণ করিলেন , তাঁহার মনের সুখশান্তি সমস্ত বিনষ্ট হইল । বিস্তর চিকিৎসায় রতনবাই একটু সুস্থ হইয়া উঠিলেন বটে , কিন্তু তাঁহার বিষণ্ণভাব দূর হইল না ; মধ্যে মধ্যে হিষ্টিরিয়ায় তিনি কষ্ট পাইতে লাগিলেন । আপাজি কন্যার শুশ্রূষার জন্য বহু অর্থব্যয় করিলেন , বিচক্ষণ চিকিৎসকগণ রতনবাইএর চিকিৎসা করিতে লাগিলেন , কিন্তু দেহের চিকিৎসায় মনের ব্যাধি কিরূপে আরোগ্য হইবে ?

রতনবাইএর সেবা শুশ্রূষার জন্য আপাজি একটি ধাত্রী নিযুক্ত করিয়াছিলেন । ধাত্রীটি জাতিতে পারসী , নাম রাজাবাই । রাজাবাইের বয়স প্রায় ত্রিশ বৎসর হইবে , সে অবিবাহিতা ; রাজাবাই প্রাণপণে রতনবাইএর সেবা করিতে লাগিল । অল্পদিনেই সে রতনবাইএর সখীর স্থান অধিকার করিল । রতনবাই তাঁহার মনের সকল কথা ধাত্রীর নিকট প্রকাশ করিয়া মনের ভার লাঘব করিতেন ।
এক বৎসর পরে একদিন রতনবাই ধাত্রীর নিকট তাঁহার দুর্ভাগ্যের কথা লইয়া অলোচনা করিতেছিলেন , ধাত্রী নানা কথায় তাঁহাকে প্রবোধদানের চেষ্টা করিতেছিল । অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া রতনবাই মুখ তুলিলেন , ধাত্রীর মুখের উপর মৃদু কটাক্ষপাত করিয়া বলিলেন , " তুমি যাই বল , আমার বিশ্বাস মাণিকজী বোধ হয় বাঁচিয়া আছেন ; সমুদ্রগর্ভে পড়িয়া তিনি যে প্রাণত্যাগ করিয়াছেন , একথা আমি কোন মতে বিশ্বাস করিতে পারি না ।" ধাত্রী নিরাশভাবে মাথা নাড়িল , স্নেহের স্বরে বলিল , " রতন, ভগিনি , মিথ্যা আশা পোষণ করিও না , আরব-দস্যুদল জাহাজলুঠ করিয়া লইয়া যাঁহাকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করিয়াছে - তিনি জীবিত আছেন , আবার তিনি তোমার কাছে ফিরিয়া আসিবেন , এরূপ আশা আকাশকুসুমের মত নিষ্ফল । তাঁহাকে ভুলিয়া যাও , সুখী হইতে চেষ্টা কর , সংসারে তোমার অভাব কি , ভগিনি ?" রতনবাই অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিলেন , তাহার পর সবিষাদে বলিলেন , " হ্যাঁ , তাঁহাকে ভুলিতেই হইবে । উপায় নাই , বাবার ইচ্ছা আমি বিবাহ করিয়া সুখী হই ; সুখী না হই তাঁহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করিতে পারিব না , বিবাহ করিতেই হইবে ।"
" তোমার পিতা কি পাত্র স্থির করিয়াছেন ?"
" হ্যাঁ ।"
" কে পাত্র ? - এখানকার কোন লোক ? - যোগ্য পাত্র ত ?" - ধাত্রী এক নিশ্বাসে একত্রে তিনটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া ফেলিল ।

রতনবাই পূর্ব্ববৎ স্থিরভাবে বলিলেন , " পাত্র - ডাক্তার কুঠিওয়ালা ।"
ধাত্রী রাজাবাই স্তম্ভিতভাবে বসিয়া রহিল ।

ডাক্তার কুঠিওয়ালা সে সময় নওসেরায় একজন প্রধান ডাক্তার ছিলেন , তিনি বিলাত্ফেরত । মস্তিষ্কের চিকিৎসায় তাঁহার বিশেষ বুৎপত্তি ছিল , এমন কি , তাঁহার ন্যায় সুদক্ষ মস্তিষ্করোগচিকিৎসক সে সময় বোম্বে অঞ্চলে দেশীয় ডাক্তারদের মধ্যে আর দ্বিতীয় ছিল না । অস্ত্রচিকিৎসাতেও তাঁহার যথেষ্ট দক্ষতা ছিল । অনেক বড় বড় ইংরাজ ডাক্তার যেসকল রোগীর মস্তিষ্কের পীড়া অরোগ্য করিতে পারেন নাই , ডাক্তার কুঠিওয়ালা সে সকল রোগীকে সুস্থ করিতে সমর্থ হইয়াছেন , এরূপ দৃষ্টান্ত বিরল ছিল না । ধাত্রী রাজাবাই ডাক্তার কুঠিওয়ালাকে জানিত , অনেক সময় সে তাঁহার সঙ্গে একত্র কাজ করিয়াছিল ; শুশ্রূষাকার্য্যে ধাত্রীর যথেষ্ট প্রশংসা ছিল , সুতরাং অনেক ধণাঢ্যের গৃহে রোগীপরিচর্য্যার জন্য তাহার গতিবিধি ছিল । ডাক্তারের উপর ধাত্রীর বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল না ; এমন নীরস , আত্মম্ভরি , গম্ভীর মানুষ ধাত্রী তাহার জীবনে দ্বিতীয় দেখে নাই । ভাল চিকিৎসক বলিয়া সে ডাক্তার কুঠিওয়ালাকে যতই সম্মান করুক , মনুষ্যত্বের হিসাবে সে তাঁহাকে অশ্রদ্ধা করিত । সুতরাং ডাক্তার রতনবাইকে বিবাহ করিতে উদ্যত হইয়াছেন শুনিয়া ধাত্রী স্তম্ভিত হইল , সে দিন সে রতনবাইকে তাহার মতামত কিছুই বলিল না ।
দুই দিন পরে রতনবাই ধাত্রীর নিকট ডাক্তারের কথা তুলিল । এবার আর সে চুপ করিয়া থাকিতে পারিল না , বলিল , " তুমি ও লোকটাকে বিবাহ করিবে ? লোকটা কিন্তু ভাল নয় , ঢের বয়স হইয়াছে , মেজাজ ভয়ঙ্কর খিট্খিটে , প্রাণে একটু রস নাই ; তোমার মত নবযুবতী এমন একটা অরসিকের হাতে আত্মসমর্পণ করিবে ? তোমার অদৃষ্টে সুখ নাই দেখিতেছি ।"
রতনবাইএর সুন্দর মুখখানি প্রথমে আরক্তিম হইয়া উঠিয়াছিল , ক্রমে তাহা পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করিল । তিনি একবার চঞ্চল দৃষ্টিতে ধাত্রীর মুখের দিকে চাহিলেন , সে দৃষ্টিতে কতটা বেদনা এবং কতখানি বিরক্তি ও অভিমান প্রকাশিত হইতেছিল , তাহা ধাত্রী ঠিক বুঝিতে পারিল না , ধাত্রী বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল ।
রতনবাই বলিলেন , " তুমি যে কথা বলিতেছ তাহা আমি বিশ্বাস করি , আমি কি আর কিছুই বুঝি না ? ডাক্তারকে আমি একটুও ভালবাসিনা , ভবিষ্যতে কখনও ভালবাসিতে পারিব না তাহাও জানি - "
ধাত্রী বাধা দিয়া জিজ্ঞাসা করিল , " তথাপি বিবাহ করিতে হইবে ? "
" হ্যাঁ ।"
" কেন ?"
" বলিয়াছি ত তোমাকে , বাবার ইচ্ছা । জীবনের সুখ নষ্ট করিয়াও বাবার ইচ্ছা পূর্ণ করিব ।"
ধাত্রী ব্যথিতচিত্তে জিজ্ঞাসা করিলেন , " তোমার পিতা ত নির্দ্দয় নহেন ; হৃদয়হীনও নহেন , তুমি কি তাঁহাকে তোমার প্রকৃত মনের ভাব কোন দিন জানাইয়াছ ?"

রতনবাই কিঞ্চিৎ অন্যমনস্ক হইয়া কহিলেন , " তিনি জানেন যে আমি ডাক্তারকে ভালবাসি না । ইহার বেশী তিনি আর কি জানিবেন ? জানিয়াই বা ফল কি ? যাঁহাকে আমি মনে মনে আমার হৃদয় সমর্পণ করিয়াছিলাম , তিনি আজ সমুদ্রগর্ভে ; তিনি চিরজীবনের মত আমাকে ছাড়িয়া গিয়াছেন , এখন ডাক্তারকেই বিবাহ করিতে হোক , কিম্বা আর কোন লোকের সঙ্গেই বিবাহ হোক , সমান কথা । যাহা হউক , ডাক্তার অঙ্গীকার করিয়াছেন , যদি কখন মাণিকজী ফিরিয়া আসেন ,- এমন অসম্ভব কাণ্ড যদি কখন ঘটে - তাহা হইলে ডাক্তার আমাকে বিবাহ করিবেন না , কিন্তু মরা মানুষের ফিরিয়া আসিবার আশায় তিনি দীর্ঘকাল বসিয়া থাকিতে রাজী নহেন । আচ্ছা ধাত্রী , ডাক্তার এত মেয়ে থাকিতে আমাকে বিবাহ করিবার জন্য এত ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছেন কেন , বলিতে পার ?" ধাত্রী অবিচলিত স্বরে বলিল , " পারি। এত মেয়ের বাপের এমন কুবেরের মত ঐশ্বর্য্য নাই ।" কিঞ্চিৎকাল নীরব থাকিয়া রতনবাই বলিলেন , " আর দুই মাসের মধ্যে আমার বিবাহ হইবে , শুনিয়াছি । আমি সারিয়া উঠিয়াছি বলিয়া তুমি চলিয়া যাইও না, আমার বিবাহটা শেষ হওয়া পর্য্যন্ত তুমি আমার কাছে থাকিয়া যাও ।" ধাত্রী এই প্রস্তাবে সম্মত হইল । সে রতনবাইকে সহোদরার ন্যায় ভালবাসিয়া ফেলিয়াছিল ।

এই ঘটনার কয়েকদিন পরে , ধাত্রী একটা ঘরে একাকী বসিয়া আছে , সহসা সেই কক্ষে ডাক্তার কুঠিওয়ালা উপস্থিত হইলেন । ধাত্রী তাঁহাকে দেখিয়া কিছু অস্বচ্ছন্দ হইয়া উঠিল ; ডাক্তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার চারিদিকে চাহিলেন , দেখিলেন কেহ কোথাও নাই । তিনি ধাত্রীর অদূরে একখানা চেয়ারের উপর বসিয়া পড়িয়া , ধাত্রীকে নিম্নস্বরে বলিলেন , " ধাত্রী , তোমার সঙ্গে আমার একটা বিশেষ কথা আছে ।" ধাত্রী তাহার দীপশিখার ন্যায় উজ্জ্বল চক্ষু দুটি ডাক্তারের মুখের উপর স্থাপন করিয়া দৃষ্টি অবনত করিল , ডাক্তারের মুখ দেখিয়া সে তাঁহার মনের ভাব কিছুই বুঝিতে পারিল না ; ডাক্তার বলিতে লাগিলেন , " আজ কয়েকদিন হইল আমার হাসপাতালে একটা রোগী আসিয়াছে , লোকটা ভয়ঙ্কর মস্তিষ্করোগে ভুগিতেছে , জীবনের আশা বড় অল্প । সুচিকিৎসা অপেক্ষা সুশ্রূষা তাহার এখন বেশী আবশ্যক , পরিচর্য্যায় তোমার অদ্ভুত দক্ষতা , সেই রোগীর ভার তোমাকে লইতে হইবে । যদি তুমিই লোকটাকে বাঁচাইতে পার ।" ডাক্তারের মুখে এমন সরস কথা ধাত্রী কোনদিন শুনে নাই , কিন্তু তথাপি সে চুপ করিয়া রহিল , কোন উত্তর দিতে পারিল না । ডাক্তার তাহাকে নিরুত্তর দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন , " কথা কহিতেছ না কেন ?" ধাত্রী সংযত স্বরে বলিল , " মহাশয় , আপনি আমাকে যে ভারগ্রহণ করিতে বলিতেছেন , তাহা গ্রহণের অবসর আমার নাই ; আমি এখানে চাকরী করিতেছি । রতনবাই এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হন নাই , এখনও কিছুকাল তাঁহার পরিচর্য্যা আবশ্যক । এ নগরে ধাত্রীর অভাব নই , আপনি অন্য কাহাকেও একার্য্যে নিযুক্ত করুন ।" ধাত্রীর কথা শুনিয়া ডাক্তারের মুখে একরকম হাসি ফুটিয়া উঠিল , সে হাসির সহিত পৈশাচিকতা বিজড়িত ছিল , তাহার মুখে সে হাসি দেখিয়া ধাত্রীর মনে হইল লোকটা মানুষ নহে জানোয়ার । ডাক্তার আসন ত্যাগ করিয়া উঠিলেন , বলিলেন , " যাহাই হউক , আমি তোমাকেই চাই , তুমি আমার অবাধ্য হইয়া একটা লোকের জীবন সংশয়ের হেতু হইও না ।" আগামী পরশু আমি তাহার মাথায় অস্ত্র করিব - ইহা ব্যতীত তাহাকে বাঁচাইবার অন্য উপায় দেখিতেছি না , যদিই বা বাঁচে তাহা হইলেও সে পাগল হইয়া যাইবে ; তাহা কিছুতেই হইবে না । তুমি কাল সন্ধ্যার সময় আমার হাসপাতালে যাইবে , পরশু অতি প্রত্যূষে অস্ত্র করা হইবে ।" ক্রোধে মুখ রক্তবর্ণ করিয়া ধাত্রী বলিল , " মাপ করিবেন মহাশয় , আমি এখানে চাকরী করিতেছি ।" " রতনবাইকে আমি বলিব , তিনি তোমাকে ছাড়িয়া দিবেন । তোমার নিশ্চয়ই যাওয়া চাই ।" - এই কথা বলিয়া ডাক্তার ললাটে বাম হস্তের তর্জ্জনি স্পর্শপূর্ব্বক ধাত্রীকে অভিবাদন অথবা বিদ্রূপ করিয়া প্রস্থান করিলেন ।

ধাত্রীকে যাইতে হইল । ডাক্তারের ইচ্ছা অপ্রতিহত । সন্ধ্যাকালে রতনবাই ধাত্রীর হাত ধরিয়া কাতরভাবে বলিলেন , " তুমি আমার ভগিনীর স্থান অধিকার করিয়াছিলে , তোমার সঙ্গে দুই দণ্ড কথা কহিয়াই জীবনের যাহা কিছু আরাম সুখ সবই পাইতাম , আজ তাহাও ঘুচিল ; - যাও তুমি , ডাক্তার তোমাকে চান । আমি ডাক্তারকে অনেক করিয়া বুঝাইলাম - কিন্তু তিনি বলিলেন , তুমি না থাকিলে চলিবে না ; আরও বলিলেন , আমার ব্যারাম সারিয়াছে , এ অবস্থায় ধাত্রী না থাকিলেও চলিতে পারে । - কি করিয়া দিন কাটাইব ? আমি যাঁহাকে ভালবাসি তাঁহার কথাই ঘুরিয়া ফিরিয়া শতবার করিয়া আমার মনে আসিতেছে ; কে যেন আমাকে সর্ব্বদা বলিয়া দিতেছে - তাঁহার মৃত্যুসংবাদ মিথ্যা - আবার তিনি ফিরিয়া আসিবেন , - যদি বিবাহের পর ফিরিয়া আসেন , তখন কি হইবে ভাই ?" - রতনবাই ধাত্রীর স্কন্ধাবলম্বন পূর্ব্বক অশ্রু বিসর্জ্জন করিতে লাগিলেন ।
ধাত্রী বলিল , " আরে সে আসিবে না , তাঁহার জন্য আর কাঁদিও না ; আমি নিশ্চয়ই বলিতে পারি তাহার মৃত্যু হইয়াছে । তাহাকে ভুলিয়া যও , ডাক্তারকেই ভালবাস , তোমার প্রতি ডাক্তারের অগাধ স্নেহ ।"
রতনবাই বলিলেন , " ভয়ঙ্কর অগাধ । আমার প্রতি তাঁহার এত অধিক স্নেহ না জন্মিলেই আমি বাঁচিয়া যাইতাম । তোমাকে আমি উভয়ের চেহারার তফাৎটাও দেখাইয়া দিই ; ডাক্তারের চেহারা দেখিয়াছ ত , আর মাণিকজীর ছবি তোমাকে দেখাই , - বিবাহের পর ত আর আমার সে ছবির দিকে তাকাইবারও অধিকার থাকিবে না ।"
ধাত্রী রতনবাইর ইঙ্গিত অনুসারে তাঁহার সঙ্গে তাঁহার শয়নকক্ষে প্রবেশ করিল । একটা দেরাজ খুলিয়া রতনবাই একখানি বহুমূল্য 'মোরোক্কো কেশ' বাহির করিলেন , স্প্রীং টিপিতেই তাহা খুলিয়া গেল , তিনি একখানি সুন্দর ফটো ধাত্রীর হাতে দিলেন । ধাত্রী সে ছবি দেখিয়া বুঝিল , রতনবাই অযোগ্য পাত্রে আত্মসমর্পণ করেন নাই ; এমন যাহার মুখ - সে যে এত শীঘ্র ইহলোক হইতে চলিয়া যাইতে পারে , তাহা ধাত্রীর সহসা বিশ্বাস হইল না ; কিন্তু তখনই ধাত্রীর মনে পড়িল , যম সুন্দর মুখ দেখিয়া কখনও কর্ত্তব্যে বিস্মৃত হয় না ।

 

( ক্রমশঃ )

( সম্পূর্ণ রচনাটি প্রবাসী’র ১৩১০ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায় প্রকাশিত ) ।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।