প্রথম
পাতা
শহরের তথ্য
বিনোদন
খবর
আইন/প্রশাসন
বিজ্ঞান/প্রযুক্তি
শিল্প/সাহিত্য
সমাজ/সংস্কৃতি
স্বাস্থ্য
নারী
পরিবেশ
অবসর
|
পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
কণ্ঠরোধ
তৃতীয় ও শেষ অংশ
১০
ডাক্তার
এই কথা শুনিয়া মাথা তুলিয়া চেয়ারে ঠেস্ দিয়া বসিলেন; তীক্ষ্ণ
দৃষ্টিতে ধাত্রীর মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার
কথা ঠিক বুঝিতে পারিতেছি না, সকল কথা খুলিয়া বল।"
ধাত্রী পূর্ব্ববৎ বলিল, “আমার কথার কিছুমাত্র জটিলতা নাই, আমি
যাহা বলিতেছি, তাহা অত্যন্ত সহজ কথা। রতনবাইএর প্রণয়ী মাণিকজী
মুকাঞ্জি আপনার গৃহে আপনার দ্বারা চিকিৎসিত হইবার জন্য আসিয়াছেন।
আপনার অবিশ্বাস হয়, আপনি রতনবাইএর নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহার
প্রণয়ীর নাম জনিয়া আসিতে পারেন। আপনার যদি সে কথাও বিশ্বাস না
হয়, রতনবাইএর নিকট তাঁহার প্রণয়ীর যে ফটো আছে, তাহা দেখিয়া সন্দেহভঞ্জন
করিতে পারেন; আমি সে ফটো দেখিয়াছি, আপনার দ্বারা যিনি চিকিৎসা
করাইতে আসিয়াছেন - তাঁহারই সে ফটো। রতনবাইএর প্রণয়ী এখনও জীবিত।"
ডাক্তার সমস্ত কথা শুনিয়া অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত মাথায় হাত দিয়া
বসিয়া রহিলেন, যেন তিনি কি এক গভীর চিন্তায় মগ্ন। অবশেষে তিনি
বলিলেন, “তোমার গল্প আর একবার বল।"
ধাত্রী তাহার কথাগুলি পুনর্ব্বার আবৃত্তি করিল। ক্ষণকাল নিস্তব্ধ
থাকিয়া ডাক্তার উঠিলেন, গম্ভীর স্বরে বলিলেন, “ধাত্রী, তুমি
কিছুকাল এখানে অপেক্ষা কর, আমি আসিতেছি।”ধাত্রী ভীত ভাবে উঠিয়া
দাঁড়াইয়ল, বলিল, “আমি এ ঘরে আর একদণ্ড থাকিতে পারিব না, আমাকে
যাইতে দেন, রতনবাইএর সঙ্গে আমাকে আজ এইরাত্রেই দেখা করিতে হইবে।”ডাক্তার
বলিলেন, “না, এ রাত্রে তুমি কোনমতে তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে
পারিবে না। আমি যতক্ষণ এখানে ফিরিয়া না আসি, ততক্ষণ তোমাকে এখানে
অপেক্ষা করিতেই হইবে।” ডাক্তার দ্বিতীয় কথা না বলিয়া সবেগে সেই
কক্ষ পরিত্যাগ করিলেন; ডাক্তার সশব্দে দরজাবন্ধ করিয়া দরজায
চাবি লাগাইলেন, ধাত্রী মুহ্যমানভাবে একাকী সেই কক্ষে বসিয়া রহিল।
তাহার মাথা বন্ বন্ করিয়া ঘুরিতে লাগিল; উজ্জ্বল দীপালোক তাহার
সম্মুখে নীলবর্ণ ধারণ করিল, তাহার মূর্চ্ছা হইবার উপক্রম হইল।
পাঁচ মিনিট
পরে ডাক্তার সেই কক্ষে ফিরিয়া আসিলেন, সংযত স্বরে বলিলেন, “ধাত্রী,
তুমি আমাকে যাহা বলিয়াছ সমস্ত সত্য। এখন তুমি আমার একট কথা রাখিব?”
নির্ব্বাণোন্মুখ দীপের ন্যায় মুখ উজ্জ্বল করিয়া ধাত্রী জিজ্ঞাসা
করিল, “কি কথা?” “রতনবাইকে এ সম্বন্ধে কোন কথা বলিও না, নির্ব্বিবাদে
বিবাহ শেষ হউক। আমি এ জন্য তোমাকে প্রচুর অর্থ পুরস্কার দিব।”
“একটি বালিকার জীবনের সুখশান্তি নষ্ট করিবার জন্য যে এমন উৎকোচে
লোভ করে, তাহার জীবনে ধিক্, আর যে এমন উৎকোচদান করিতে চাহে -
তাহার জীবনে শত ধিক্। পরের প্রণয়ীকে বিবাহ করিতে তোমার একটুও
সঙ্কোচ, কিছুমাত্র আপত্তি না?? পুরুষজাতি কি এতই অপদার্থ, আত্মসম্মনহী?”-
উত্তেজনাভরে স্থানকাল বিস্মৃত হইয়া ধাত্রী এই কথাগুলি এক নিঃশ্বাসে
বলিয়া ফেলিল।
ক্রোধে মুখ আরক্তিম করিয়া ডাক্তার বলিলেন, “কি, আমার গৃহে বসিয়া
তুমি আমারই অপমান করিতে সাহসী হইতে?” “হাঁ, যে লোভান্ধ পুরুষ
ধর্ম্মজ্ঞান বিসর্জ্জন দিয়া একটি নিরপরাধী কোমলপ্রাণা যুবতীর
সর্ব্বনাশ করিতে দ্বিধা না করে - তাহাকে আর কি সম্মান করি? সে
কি কাহারও সম্মানলাভের যোগ্য পাত্র?” ডাক্তার বলিলেন, “শোন ধাত্রী,
স্ত্রীলোকের সঙ্গে কর্ত্তব্য লইয়া তর্ক করিতে আমার প্রবৃত্তি
নাই, তুমি আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া আমাকে যে সকল অপমানজনক কথা
বলিলে, তুমি পুরুষ হইলে আমি তোমাকে পদাঘাত করিতাম। কিন্তু তুমি
নিজে যে কি ভুল করিয়া বসিয়াছ, তাহা এখনও বুঝিতে পার নাই, আমি
তোমাকে বুঝাইয়া দিতেছি। আমি জানিতাম না যে আমার প্রণযের প্রতিদ্বন্দ্বী
এখনও বাঁচিয়া আছে, জানিতাম না যে মস্তিষ্করোগে কাতর ও অকর্ম্মণ্য
হইয়া সে-ই আমার কাছে চিকিৎসার জন্য আসিয়াছে, কাল সকালে তাহার
মস্তিষ্কে অস্ত্রচালনা করিতে হইবে, অতি কঠিন অস্ত্রচিকিৎসা তাহাও
তুমি জান, আমার মন তুমি যে ভাবে বিচলিত করিয়াছ, তাহাতে ছুরিকা
যদি একটু বিচলিত হয়, কোন কারণে যদি আমার হাত ঈষৎ মাত্রায় কম্পিত
হয়, তাহা হইলে রোগীকে তৎক্ষণাৎ মরিতে হইবে, তুমি নিজের বুদ্ধির
দোষে হয় ত তাহার মৃত্যুর কারণ হইতে পার; অস্ত্রপ্রয়োগের পূর্ব্বে
তুমি কেন এ সকল কথা আমার নিকট প্রকাশ করিল? এখন যদি রোগীর মৃত্যু
হয়, তাহা হইলে তাহার অপমৃত্যুর জন্য তুমিই অপরাধী।"
ধাত্রী ডাক্তারের কথার অর্থ বুঝিতে পারিল, সে কাঁপিতে কাঁপিতে
উঠিয়া ডাক্তারের পদতলে বসিয়া পড়িল। করজোড়ে ঊর্দ্ধমুখে অত্যন্ত
কাতরভাবে ডাক্তারের মুখের দিকে চাহিয়া বিচলিত স্বরে বলিল, “দয়া
কর, হতভাগ্য যুবককে দয়া কর, তাহাকে মারিও না, পবিত্র অগ্নিদেবের
দিব্য, পরমেশ্বরের দিব্য নিরপ্রাধের প্রাণবধ করিও না।"
ডাক্তার ধীরভাবে বলিলেন, “ধাত্রী, ওঠ, নরহত্যা করিবার আমার ইচ্ছা
নাই, আমি আমার অস্ত্রচিকিৎসার দুর্নাম ঘটিতে দিব না। আমি রোগীর
মস্তিষ্কে অস্ত্র করিব, তাহার ব্যাধি আরোগ্য করিব, সে বিষয়ে
সন্দেহ মাত্র নাই; এই অস্ত্রচিকিৎসায় কৃতকার্য্য হইলে আমার সুনাম
বর্দ্ধিত হইবে, সে লোভ আমি পরিত্যাগ করিতে পারি না। আমি যাহাকে
ভালবাসি তাহাকে পাইতে চাই, কিন্তু তাহাকে পাইবার জন্য আমার যশ
কলঙ্কিত করিবার ইচ্ছা নাই। আমি অস্ত্র করিব, কিন্তু তোমার কথা
শুনিয়া আমি এইটুকু বুঝিয়াছি যে, বিবাহের পর ভিন্ন এই অস্ত্রচিকিৎসা
আমার পক্ষে সঙ্গত হইবে না। আমি মাণিকজীকে বুঝাইয়া আরো কয়েকদিন
অপেক্ষা করিতে বলিব, তুমি ইচ্ছা করিলে রতনবাইএর নিকট ফিরিয়া
যাইতে পার, আমাদের বিবাহ না হওয়া পর্য্যন্ত সেখানে থাকিতে পার
- কিন্তু তুমি যে রহস্য আবিষ্কার করিয়াছ, সে সম্বন্ধে কোন কথা
তাঁহার নিকট প্রকাশ করিতে পারিবে না।"
ধাত্রী অবিচল স্বরে বলিল, “অসম্ভব। আমি তাঁহাকে সেই কথা বলিবার
জন্যই তাঁহার নিকট ফিরিয়া যাইতে চাহিতেছি, যতক্ষণ আমার দেহে
প্রাণ আছে, ততক্ষণ যাহাতে তাঁহার অনিষ্ট হয়, আমি কিছুতেই তাহা
করিতে দিব না।"
ডাক্তার বলিলেন, “দেখ ধাত্রী, তোমাকে আমি এখানে আটক করিয়া রাখিতে
চাহি না, তুমি যাইতে পার, কিন্তু তুমি সেখানে গিয়াও যাহাতে কোন
কথা প্রকাশ করিতে না পার, তাহার উপায় করিয়া তবে তোমাকে ছাড়িয়া
দিব।”
ধাত্রী ভীতভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কি করিবেন?” “আমি তোমার
মুখ বন্ধ করিব।”“কিরূপ?” “সে কথা তোমার নিকট প্রকাশ করিতে চাহি
না। আজ রাত্রে তুমি এ স্থান ত্যাগ করিয়া যাইতে পারিবে না। যদি
তুমি আমার নিকট অঙ্গীকার কর, রতনবাইএর নিকট কোন কথা প্রকাশ করিবে
না, তাহা হইলে কাল তোমাকে ছাড়িয়া দিব, তুমি একবার অঙ্গীকারে
আবদ্ধ হইলে তাহা পালন করিবে, সে বিশ্বাস আমার আছে। যদি তুমি
অঙ্গীকার করিতে অসম্মত হও - তখন অগত্যা তোমার মুখ বন্ধ করিতে
হইবে।” ডাক্তার উঠিয়া দ্বার খুলিলেন, এবং পাশের একটি কক্ষে,
যে কক্ষটি ধাত্রীর বাসের জন্য নির্দ্দিষ্ট হইয়াছিল, তাহাকে সেই
কক্ষে গমন করিতে বলিলেন।
১২
ধাত্রী সেই কক্ষে প্রবেশ
করিল, তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ কাঁপিতেছিল, অবসাদে তাহার মন আচ্ছন্ন
হইয়াছিল। ধাত্রীএকখানি কৌচের উপর আড়ষ্টভাবে বসিয়া পড়িল, হতাশভাবে
চারিদিকে দেখিতে লাগিল, নির্জ্জন গৃহ, মিট্ মিট্ করিয়া একটা
আলো জ্বলিতেছে, বাহিরে ঘোর অন্ধকার, কোনদিকে মনুষ্যের কণ্ঠস্বর
শুনিতে পাওয়া যায় না। ধাত্রী পলায়নের একবার অভিপ্রায় করিল,
কিন্তু সাহস হইল না, যদি হঠাৎ ধরা পড়ে, মৃত্যু নিশ্চিত, বিশেষতঃ
এই গভীর রাত্রে অন্ধকারের মধ্যে সে কোথায় যাইব? ধাত্রী কৌচের
উপর পড়িয়া দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া বাস্পরুদ্ধ স্বরে বলিল, “রতনবাই,
রতনবাই, তোমার কোনই উপকার করিতে পারিলাম না, তোমার যে কি সর্ব্বনাশ
উপস্থিত তাহা তুমি বুঝিতে পারিতেছ না।” অনেকক্ষণ পরে ধাত্রী
উঠিল, তাহার পর দ্বার রুদ্ধ করিয়া শুইয়া পড়িল, একঘণ্টার মধ্যেই
অবসাদভরে তাহার চক্ষু মুদ্রিত হইয়া আসিল; সে ঘুমাইয়া পড়িল।
কিছু কাল পরে ধাত্রী হঠাৎ জাগিয়া দেখিল, উজ্জ্বল দীপালোকে
সেই কক্ষ প্লাবিত হইতেছে, ডাক্তার তাহার মাথার কাছে নতমুখে
দাঁড়াইয়া তাহার নাকের কাছে একখানি রুমাল ধরিয়াছেন, ধাত্রীর
উভয় হস্ত ডাক্তারের বাম হস্তের মধ্যে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ। ধাত্রী
সবেগে একবার উঠিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু কৃতকার্য্য হইল না,
ক্লোরোফর্ম্মের সুমিষ্ট মৃদুগন্ধে মুহূর্ত্তে মধ্যে সে অভিভূত
হইয়া পড়িল, তাহার সংজ্ঞা লোপ হইল। - একটি গুপ্তদ্বার পথে ডাক্তার
যে এই কক্ষে প্রবেশ করিতে পারেন, ধাত্রী তাহা পূর্ব্বে বুঝিতে
পারে নাই। ধাত্রী প্রভাতে জাগিয়া উঠিল, সে স্বপ্ন দেখিতেছিল,
নিদ্রিত ছিল, কিম্বা তাহার মূর্চ্ছা হইয়াছিল, তাহা প্রথমে
বুঝিতে পারিল না; দেখিল, গৃহের বাতায়নশ্রেণী উন্মুক্ত, শীতল
প্রভাতবায়ু গৃহকক্ষে হিল্লোলিত হইতেছে, পূর্ব্বদিনের বাতায়নপথে
তরুণ অরুণের লোহিতালোক কক্ষে প্রবেশ করিয়াছে, কিন্তু সে পূর্ব্বরাত্রে
যে কৌচে শয়ন সেখানে নাই, একটি মুক্ত বাতায়নের লৌহগরাদের উপর
তাহার মস্তক ন্যস্ত রহিয়াছে। তাহার মনে হইল তাহার মাথা ধরিয়াছে,
মস্তকে ভয়ানক ভার, তাহার কপাল টন্ টন্ করিতেছিল। সে এখানে
কিরূপে আসিল, তাহাই চিন্তা করিতে লাগিল, সমস্ত রাত্রির ঘটনা
একে একে তাহার মনে পড়িতে লাগিল। সে উঠিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু
সর্ব্বাঙ্গ অবসন্ন, উঠিতে পারিল না। এমন সময় খট্ খট্ করিয়া
দরজা খুলিয়া গেল, একটা গুজরাটী চাকরাণী এক বালতি গরম জল লইয়া
সেই কক্ষে প্রবেশ করিল। ধাত্রীকে দেখিয়াই দাসী বালতিটা সেখানে
ফেলিয়া ভয়ে ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া পলাইল, - সেই একরাত্রির মধ্যে
ধাত্রীর চেহারা যেরূপ হইয়াছিল তাহাতে তাহাকে মানুষ বলিয়া চিনিতে
পারা যায় না। এই ব্যাপার দেখিয়া ধাত্রী আবেগভরে কি বলিতে গেল,
কিন্তু কথা বাহির হইল না, কেবল তাহার মুখ বিবর হইতে একটা অস্ফুট
ঘড়ঘড়ি মাত্র নির্গত হইল। ধাত্রী বুঝিল, যে কারণেই হউক তাহার
কণ্ঠ রোধ হইয়াছে। ধাত্রী তখন তাহার ভূমি শয্যা হইতে উঠিবার
চেষ্টা করিল, কিন্তু তাহাতেও কৃতকার্য্য হইল না, দক্ষিণ হস্ত
দক্ষিণ পদ ও দক্ষিণাঙ্গের অনুভূতি বিলুপ্ত হইয়াছে বলিয়া তাহার
মনে হইল, দেখিল সমস্ত দক্ষিণাঙ্গই অবশ। অতি কষ্টে সে মাথা
তুলিয়া দেখিতে পাইল, জানালার গরাদের ধারে - যেখানে তাহার মস্তক
সংস্থাপিত ছিল - কয়েক বিন্দু রক্ত লাগিয়া রহিয়াছে। হঠাৎ পড়িয়া
গিয়া মাথা কাটিয়াছে কি না তাহা সে স্মরণ করিতে পারিল না। সে
যেমন ভাবে পড়িয়াছিল, তেমনই পড়িয়া রহিল।
কয়েক মিনিট পরে ডাক্তার সেই কক্ষে প্রবেশ করিলেন, তিনি তীক্ষ্ণ
দৃষ্টিতে ধাত্রীর দিকে চাহিলেন, তাহার পর সবিস্ময়ে বলিলেন,
“কি সর্ব্বনাশ।”ধাত্রীর দক্ষিণ হস্তখানি টানিয়া তুলিলেন, কিন্তু
তাহা ছাড়িয়া দিতেই নিরাশ্রয় তরু পল্লবের ন্যায় তাহা ভূমিতলে
লুটাইয়া পড়িল।
ডাক্তার কোমল স্বরে ধাত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ধাত্রী, হঠাৎ
তোমার এ কি হই?”
ধাত্রী কিন্তু উত্তরদান করিতে গেল, কিন্তু কথা বাহির হইল না।
সে একবার বিস্ফারিত নেত্রে ডাক্তারের দিকে চাহিল; যেন সে দৃষ্টি
ডাক্তারকে দগ্ধ করিতে উদ্যত, তাহার পর অশ্রুরাশিতে চক্ষু দুটি
ভরিয়া উঠিল। ডাক্তার তাঁহার দুইজন দাসীকে ধাত্রীর পরিচর্য্যার
নিযুক্ত করিয়া সেই কক্ষ পরিত্যাগ করিলেন।
আধ ঘণ্টা
পরে ডাক্তার কুঠিওয়ালা একজন সাহেব ডাক্তার লইয়া সেই কক্ষে প্রবেশ
করিলেন। উভয়ে ধাত্রীকে পরীক্ষা করিলেন। অনেকক্ষণ ধরিয়া পরীক্ষার
পর সাব ডাক্তারটি গম্ভীরভাবে বলিলেন, “There is no doubt what
is the matter. Hemorrhage from the left middle cerebral, with
hemiplegia and aphasia. Rather curious in so young a girl,
the mind is fully conscious, but all power of speech is lost."
ডাক্তার কুঠিওয়ালা ধাত্রীর মস্তকের উপর মুখ নামাইয়া করুণস্বরে
জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি তোমার ডান হাতখানি তুলিতে পার?"
ধাত্রী মাথা নাড়িল। ডাক্তার তাঁহার সহযোগিকে বলিলেন, “আপনি ঠিকই
অনুমান করিয়াছেন; কথা বুঝিতে পারিতেছে, কিন্তু উত্তর দিতে পারিতেছে
না।” সাহেব ডাক্তার কোন কোন ঔষধের ব্যবস্থা করিয়া প্রস্থান করিলেন;
ভৃত্য ঔষধ আনিতে চলিয়া গেল। সে কক্ষে কেবল ধাত্রী ও ডাক্তার
কুঠিওয়ালা রহিলেন।
ডাক্তার কুঠিওয়ালা ধীরে ধীরে ধাত্রীকে বলিলেন, “তুমি নিজের নির্বুদ্ধিতার
দোষেই এই বিপদ ডাকিয়া আনিয়াছ, গত রাত্রে যদি তুমি আমার অনুরোধেই
সম্মত হইতে, তাহা হইলে তোমাকে এরূপ ভয়ঙ্কর বিপদে পড়িতে হইত না।
আমি ত পূর্ব্বেই তোমাকে বলিয়াছিলাম, আমি তোমার মুখবন্ধ করিব।
যাহা বলিয়াছিলাম তাহাই করিয়াছি। আমি কি করিয়াছি তাহা বলি শোন
- তুমি জান মস্তিষ্কতত্ত্বে আমার বিশেষ পারদর্শিতা আছে, অস্ত্রবিদ্যাতেও
আমি অপটু নহি। যখন আমি দেখিলাম তোমার মুখবন্ধ না করিতে পারিলে
আমার কার্য্যোদ্ধারের আশা নাই, তখন অগত্যা আমাকে সেইরূপই করিতে
হইল। তুমি দ্বার বন্ধ করিয়া ঘুমাইয়া পড়িলে, আমি গুপ্তদ্বারপথে
এই কক্ষে প্রবেশ করিলাম, তখন অনেক রাত্রি। তুমি ঘুমাইতেছিলে,
যাহাতে হঠাৎ জাগিয়া আমার কার্য্যে বাধাদান করিতে না পার সেজন্য
প্রথমে তোমাকে ক্লোরোফর্ম্ম দ্বারা অজ্ঞান করিয়া ফেলিলাম; তাহার
পর তীক্ষ্ণাগ্র অস্ত্রের সাহায্যে তোমার কপালের উপর অস্থির ভিতর
একটি ছিদ্র করিলাম, এবং সেই ছিদ্রপথে অস্ত্র প্রবেশ করাইয়া মস্তিষ্কে
যে সূক্ষ্ম ধমণীর উপর কথা কহিবার শক্তি নির্ভর করে - সেই ধমণীটি
ছিন্ন করিয়া ফেলিলাম। ছিদ্র অতি ক্ষুদ্র হইয়াছিল, বাহির হইতে
তাহা বুঝিতে পারা যায় না। ক্রমে শুশ্রূষাগুণে তুমি অপেক্ষাকৃত
সুস্থ হইতে পার, কিন্তু তোমার কথা কহিবার শক্তি চিরদিনের জন্য
বিলুপ্ত হইয়াছে। তোমার দক্ষিণ অঙ্গও তাহার ফলে অবশ হইয়া গিয়াছে,
বাম হস্তের সাহায্যে তুমি কিছু লিখিয়া যে মনের ভাব প্রকাশ করিবে
তাহারও উপায় নাই, মাথা ঠিক করিয়া তুমি কিছুই লিখিতে পারিবে না।
রতনবাইএর কাছে সহস্র চেষ্টাতেও গুপ্তরহস্য ভেদ করিতে পারিবে
না। পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ দাও, যে, তোমার প্রাণনষ্ট করিবার আমার
আবশ্যক হয় নাই। অন্য কোন উপায় না থাকাতেই অগত্যা আমাকে এই উপায়
অবলম্বন করিতে হইয়াছে।”
ডাক্তার ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া পুনর্ব্বার বলিতে লাগিলেন, “যাহাতে
কেহ কোনরূপ সন্দেহ করিতে না পারে, আমি সে বিষয়ে যথেষ্ট সাবধান
হইয়াছিলাম তাহা বুঝিয়াছ, দাসদাসীরা যাহাতে বুঝিতে পারে তুমি
হঠাৎ জানালার গরাদের উপর পড়িয়া গিয়া আহত হইয়াছ এই মতলবে তোমাকে
এখানে টানিয়া আনিয়া গরাদের উপর তোমার মাথা রাখিয়াছিলাম, তোমার
মস্তিষ্কনিসৃত একটু রক্তও ঐ গরাদটাতে মাখাইয়া রাখিয়াছি।” ডাক্তার
উঠিয়া সেই কক্ষ পরিত্যাগ করিলেন। ধাত্রী শূণ্যদৃষ্টিতে বাতায়নপথে
আকাশের দিকে চাহিয়া রহিল, তাহার চক্ষু হইতে অশ্রু ঝরিয়া তাহার
কপোলদেশ আর্দ্র করিতে লাগিল।
১৪
এই সপ্তাহ
পরে রতনবাই সেই হাসপাতালে ধাত্রীকে দেখিতে আসিলেন। ধাত্রীর
বিপদের কথা রতনবাই তাহার প্রণয়াকাঙ্খী ডাক্তারের মুখেই শুনিয়াছিলেন।
রতনবাই এই কয়দিনে আরও মলিন ও শীর্ণ হইয়া পড়িয়াছিলেন; তাঁহাকে
দেখিলে মনে হয় - তাঁহর মনের মধ্যে দিবারাত্রি অশান্তির ঝটিকা
বহিতেছে।
রতনবাই ধাত্রীকে দেখিয়াই কাঁদিয়া ফেলিলেন, ধাত্রীর শয্যাপ্রান্তে
আসিয়া তাহার গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন, “ভাই, হঠাৎ তোমার এমন
বিপদ ঘটিল কে? আমি যে তোমাকে চিনিতেই পারিতেছি না।” ধাত্রী
কেবল অশ্রুপাত করিল, কোন উত্তর দিতে পারিল না।
ডাক্তার কুঠিওয়ালা সেই সময় সেই কক্ষে প্রবেশ করিয়া রতনবাইকে
লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “রতনবাই, তুমি অধীর হইও না, ইহাতে ধাত্রীর
অসুখ আরও বাড়িতে পারে।"
রতনবাই উঠিয়া বসিয়া ডাক্তারের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “রাজাবাই
কি আর জীবনে কথা কহিতে পারিবে ন? একি হইল ! এ রোগের কিন কোন
চিকিৎসা না? বোম্বের যত বড় ডাক্তার আছে - আনিয়া চিকিৎসা করাও,
যত অর্থ লাগে আমি দিব।"
ডাক্তার ধীরভাবে বলিলেন, “বৃথা চেষ্টা, এ রোগের চিকিৎসা নাই,
কথা কহিবার শক্তি চিরদিনের জন্য বিলুপ্ত হইয়াছে।"
রতনবাই ধাত্রীর দিকে চাহিয়া বলিলেন, “দেখ দেখ, উহার চোখ দুটির
দিকে চাহিয়া দেখ, যেন কি বলিতে চাহিতেছে, কিন্তু প্রকাশ করিতে
পারিতেছে না, বেদনা ভরা হৃদয়ের হাহাকার বাক্যে প্রকাশ হইতেছে
না, - কি কষ্ট, কি কষ্ট!” রতনবাই দুই হস্ত নিপীড়ন করিতে লাগিলেন।
অল্পক্ষণ পরে রতনবাই বলিলেন, “আচ্ছা, ওকি লিখিয়া মনের ভাব
প্রকাশ করিতে পারে ন?"
ডাক্তার বল ইলেন, “পরীক্ষা করিয়া দেখ।”- তিনি একখানা সাদা
কাগজ ও পেন্সিল আনিয়া ধাত্রীর সম্মুখে রাখিয়া বলিলেন, “ধাত্রী,
তোমার বামহস্তে বল আছে, তোমার যাহা কিছু বলিবার থাকে বামহস্তে
তাহা এই কাগজে লিখিয়া জানাইতে পার।”
ধাত্রী পেন্সিলটি বামহস্তে ধরিয়া কাগজের উপর কি লিখিতে গেল,
কিন্তু একটি অক্ষরও লিখিতে পারিল না, কাগজে কেবল কতগুলি হিজিবিজি
দাগ পড়িল!
ডাক্তার রতনবাইএর দিকে চাহিয়া বলিলেন, “লিখিবার সাধ্য উহার
নাই, লিখিবার চেষ্টা করিয়া ক্রমে অধিক ক্লান্ত হইয়া পড়িবে,
তাহা ভিন্ন কোন ফললাভের আশা নাই।”
রতনবাই গভীর সহানুভূতিভরে ধাত্রীর হস্ত নিজের করতলের মধ্যে
গ্রহণ করিয়া স্নেহোচ্ছ্বসিত স্বরে বলিলেন, “পরমেশ্বরের নিকট
প্রার্থনা করি তুমি সারিয়া উঠ, তিনি যদি তোমাকে বাক্শক্তি
ফিরাইয়া না দেন, কি করিব? আমার বিবাহের পর আমি তোমাকে গৃহে
লইয়া যাইব, আমার সহোদরা ভগিনীর ন্যায় চিরজীবন তোমাকে যত্ন
করিব, তোমার প্রতিপালনের ভার আমি গ্রহণ করিলাম। আহা, দুর্ভাগিনী
! তুমি আমার জন্য কি না করিয়াছ !”
রতনবাই ধীরে ধীরে ধাত্রীর নিকট হইতে উঠিয়া গৃহে প্রস্থান করিলেন,
যাইবার সময় অশ্রুতে তাঁহার দৃষ্টিরোধ হইল।
১৫
আরও কযেক
সপ্তাহ চলিয়া গেল, ধাত্রীর অবস্থার কোন পরিবর্ত্তন লক্ষিত
হইল না, এক ভাবেই তাহার দিন কাটিতে লাগিল। অবশেষে একদিন প্রভাতে
নিদ্রাভঙ্গে ধাত্রী কিছু সুস্থ বোধ করিল, তাহার অবশাঙ্গে একটু
লঘু বলিয়া মনে হইল, সে তাহার দক্ষিণ হস্ত অল্প একটু নাড়িতে
পারিল। তবে কি তাহার পক্ষাঘাত আরোগ্য হইতেছ? আশ্বস্তচিত্তে
ধাত্রী কথা কহিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু মুখ দিয়া কথা বাহির
হইল না, পূর্ব্ববৎ অস্ফুট ভগ্নস্বর উত্থিত হইল মাত্র। তথাপি
তাহার অবস্থা যে অনেক ভাল, তাহা সে বুঝিতে পারিল। সেই দিন
ধাত্রীর শুশ্রূষাকারিণী তাহার কক্ষে প্রবেশ করিয়া বলিল, “আজ
তোমাকে অনেক সুস্থ দেখাইতেছে।” ধাত্রী কোন কথা কহিতে পারিল
না, কৃতজ্ঞদৃষ্টিতে তাহার শুশ্রূষাকারিণীর দিকে চাহিয়া রহিল।
শুশ্রূষাকারিণী বলিল, “হাঁ, তুমি অনেক সুস্থ হইয়াছ বলিয়া বোধ
হইতেছে, তুমি মুখে সে কথা প্রকাশ করিয়া বলিতে না পার - তোমার
চক্ষু দুটি সে কথা প্রকাশ করিতেছে, মানুষের চক্ষে মনের ভাব
এ ভাবে প্রকাশিত হইতে পূর্ব্বে আর দেখি নাই, আমি ডাক্তার কুঠিওয়ালাকে
এখনই এ আনন্দের সংবাদ প্রদান করিতাম, কিন্তু আজ তাঁহার সহিত
সাক্ষাৎ হওয়া কঠিন, আজ তাঁহার বিবাহ। - ধাত্রী, ওকি তুমি ওভাবে
চাহিতেছ কে? এ বিবাহ হয় একি তোমার ইচ্ছা ন? কে? ডাক্তার কুঠিওয়ালা
ত যোগ্য পাত্র, তবে তাঁহার বয়স কিছু বেশী হইয়াছে বটে, যাহাই
হউক - তিনি সকল বিষয়েই জাহাঙ্গীর সাহেবের কন্যার - ”
সহসা দ্বারে করাঘাত হইল, শুশ্রূষাকারিণী উঠিয়া গিয়া দ্বার
খুলিয়া দিল, তাহার পরই অত্যন্ত ব্যস্ত ভরে ছুটিয়া আসিয়া বলিল,
“ধাত্রী, ব্যাপার কি, বুঝিতে পারিতেছি না, জাহাঙ্গীর সাহেবের
কন্যা রতনবাই তোমাকে দেখিতে আসিতেছেন, আজ যে তাঁহার বিবাহ।"
দেখিতে দেখিতে রতনবাই ধাত্রীর শয্যাপ্রান্তে আসিয়া উপবেশন
করিলেন। সুন্দর পরিচ্ছেদে সে দিন তাঁহার সৌন্দর্য্য অত্যন্ত
মধুর দেখাইতেছিল, যেন ঊষার আকাশের উজ্জ্বল শুকতারা, কিন্তু
সেই সৌন্দর্য্যের মধ্যেও তাঁহার মুখখানি মলিন, চক্ষু দুটি
বিষাদভাবে সমাচ্ছন্ন। তিনি ধাত্রীর নিকট উপবেশন করিলে ধাত্রী
তাঁহার শুশ্রূষাকারিণীকে সে কক্ষ ত্যাগ করিয়া যাইতে ইঙ্গিত
করিল। স্ত্রীলোকটি সে কক্ষ ত্যাগ করিল।
রতনবাই বলিলেন, “ধাত্রী, ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করি তুমি
শীঘ্র সুস্থ হও, আজ আমি তোমার নিকট আমার কুমারীজীবনের শেষ
বিদায় লইতে আসিয়াছি, আজ আমার বিবাহ, আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই
আমার বিবাহ হইয়া যাইবে, আমি ডাক্তার কুঠিওয়ালার পরিণীতা ভার্য্যা
হইব। তিনি আর ফিরিয়া আসিলেন না, আমার প্রিয়তমকে এ জীবনে আর
পাইলাম না। আমার জীবনের সুখস্বপ্নের আজ চির অবসান।”
ধাত্রী রতনবাইএর কমলদলতুল্য দক্ষিণ হস্তখানি ধরিয়া তাঁহার
মুখের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল। রতনবাই নতনেত্রে ধাত্রীর
মুখের দিকে চাহিয়া, তাহার গোপনহৃদয়তলে কি অব্যক্ত বেদনা বাক্যে
প্রকাশিত হইবার জন্য তুমুল সংগ্রাম করিতেছিল, তাহা বুঝিবার
চেষ্টা করিতে লাগিলেন। ধাত্রী মনের ভাব মুখে প্রকাশ করিতে
না পারিয়া শয্যার উপর ছট্ ফট্ করিতে লাগিল।
“ধাত্রী, তোমার মনের কষ্ট কি আমাকে বুঝাইতে পার না? একি !
তোমার চক্ষু দেখিয়া বোধ হইতেছে তুমি কিছু বলিবার জন্য ব্যাকুল
হইয়াছ, কি বলিতে চাও, ধাত্রী? একবার ভাল করিয়া চেষ্টা করিয়া
দেখ দেখি।” ধাত্রীর বক্ষের স্পন্দন অতি দ্রুত হইয়া উঠিল। সে
মুখ নাড়িল, কিন্তু কেবল ঘড় ঘড় শব্দ উচ্চারিত হইল মাত্র। হঠাৎ
তাহার ললাটের ক্ষতস্থান দিয়া রক্ত ছুটিল; অতি ক্ষীণস্বরে ধাত্রী
বলিল, “রতনবাই!” রতনবাই এই কথা শুনিবামাত্র আনন্দে উচ্ছ্বসিত
হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “কথা ফুটিয়াছে, ধন্য পরমেশ্বর, তুমি দুঃখিনীকে
দয়া করিয়াছ। ধাত্রী বল, বল কি তোমার বলিবার আছে।” ধাত্রী বলিল,
“রতনবাই শোন, হয় ত এখনই আবার কণ্ঠরোধ হইবে। ডাক্তারকে বিবাহ
করিও না, তোমার প্রিয়তম বাঁচিয়া আছেন, তিনি এই বাড়ীতেই আছেন,
ডাক্তারকে বিবাহ করিও না।”এই কয়েকটি কথা বলিয়াই ধাত্রীর সংজ্ঞালোপ
হইল।
১৬
রতনবাই ক্ষণকাল স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন। তাহার পর খুঁজিতে খুঁজিতে
সেই গৃহেই মাণিকজীকে দেখিতে পাইলেন; দীর্ঘকাল পরে এই অপ্রত্যাশিতপূর্ব্ব
মিলনে উভয়ের মনে কি ভাবের সঞ্চার হইল, তাহা বাক্যে প্রকাশ
করা অসম্ভব। প্রায় এক ঘণ্টা পরে ডাক্তার কুঠিওয়ালা তাঁহার
হাসপাতালে ফিরিয়া আসিলেন, সে দিন তাঁহার মনে বড় আনন্দ, তাঁহার
দীর্ঘকালের আশা সে দিন সফল হইবে, তিনি কোটিপতির জামাতা হইবেন,
পারসী সমাজের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরীকে তিনি পত্নীরূপে লাভ
করিবেন, তাঁহার মনের আনন্দ অন্যে কিরূপে প্রকাশ করিবে? তিনি
হাসপাতালে প্রবেশ করিতেই রাতনবাইএর সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল;
রতনবাইকে দেখিয়া বিস্মিত ও পুলকিতচিত্তে আলিঙ্গন করিবার জন্য
উভয় বাহু প্রসারিত করিলেন, কিন্তু রতনবাই তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া
নিষ্ঠুর অবিচল দৈবের ন্যায় সংক্ষেপে সকল কথা প্রকাশ করিলেন;
ধাত্রী কথা কহিতে সমর্থা হইয়াছে, সে কথা সর্ব্বাগ্রেই বলিলেন।
ডাক্তার স্থাণুর ন্যায় একস্থানে দাঁড়াইয়া স্তম্ভিতভাবে রতনবাইএর
সকল কথা শুনিলেন। তাঁহার মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করিল, তিনি থর
থর করিয়া কাঁপিতে লাগিলেন; তাহার পর বিপুল বলে মনঃসংযম করিয়া
সেই কক্ষ হইতে প্রস্থান করিলেন; সে কক্ষে আর ফিরিলেন না, সে
গৃহেও ফিরিলেন না, নওসেরাতেও আর ফিরিলেন না। এ বিপুল বিশ্বের
কোথায় তিনি নিজের কলঙ্কলাঞ্ছিত অভিশপ্ত মস্তক লুকাইলেন, তাহা
কেহ বলিতে পারে না।
মাণিকজী সমুদ্রে ডুবিয়া মরেন নাই, আরবের উপকুলে একদল বেদুইন
দস্যু তাঁহার সর্ব্বস্ব লুণ্ঠন করিয়া, তাঁহার মস্তকে লগুড়াঘাত
করিয়াছিল, এবং তাঁহাকে সেই আঘাতে সংজ্ঞাশূণ্য দেখিয়া মৃত ভাবিয়া
প্রান্তর প্রান্তে ফেলিয়া রাখিয়া গিয়াছিল। চৈতন্যলাভ করিয়া
নানা বাধা বিঘ্ন অতিক্রম পূর্ব্বক তিনি দীর্ঘকাল পরে স্বদেশে
প্রত্যাবর্ত্তনে সমর্থ হইয়াছিলেন। ডাক্তার কুঠিওয়ালার অন্তর্ধানের
পর বোম্বের আর একজন বিচক্ষণ ডাক্তার তাঁহাকে চ্কিৎসা দ্বারা
আরোগ্য করেন।
ইহার কয়েক মাস পরে মহাসমারোহে মাণিকজীর সহিত রতনবাইএর বিবাহ
হইয়া যায়। জাহাঙ্গীর জীর মৃত্যু হইয়াছে - মাণিকজীই এখন তাঁহার
বিপুল সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী। ধাত্রী এখন রতনবাইএর
প্রিয়তমা সখী।
দীনেন্দ্রকুমার
রায়
(
সম্পূর্ণ রচনাটি প্রবাসী’র ১৩১০ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায়
প্রকাশিত ) ।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
Copyright
© 2014 Abasar.net. All rights reserved.
|
অবসর-এ প্রকাশিত
পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।
|