পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
মুক্তিপণ
দীনেন্দ্রকুমার
রায়
[
লেখক পরিচিতি : দীনেন্দ্রকুমারের জন্ম ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দের
২৫শে আগষ্ট বৃহস্পতিবার ( ১২৭৬ বঙ্গাব্দের ১১ই ভাদ্র ) নদীয়া
জেলার মেহেরপুর গ্রামে। বাবা ব্রজনাথ কর্মরত ছিলেন কৃষ্ণনগরের
জমিদারের সেরেস্তায়। পিতার কাছে কৃষ্ণনগরেই পড়াশোনা; কিন্তু
স্কুলের পাঠ শেষ করলেও গণিত শাস্ত্রে তার ভীতি তাকে উচ্চতর
পাঠক্রমে পড়ায় উৎসাহিত করে নি। বরং সাহিত্য তাকে আকর্ষণ
করতে থাকে। কাকা যদুনাথ ছিলেন মহিষাদল রাজ এস্টেটের ম্যানেজার
ও রাজ স্কুলের প্রেসিডেন্ট। পড়াশোনা চালিয়ে না যাওয়ায় কাকা
তার উপর সন্তুষ্ট ছিলেন না। যাই হোক, দীনেন্দ্রকুমার মহিষাদল
রাজ স্কুলের শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন। শোনা যায় কাকাকে
ধরে দীনেন্দ্রনাথ জলধর সেনকে স্কুলের তৃতীয় শিক্ষক পদে নিয়ে
আসেন। জলধর এসে ওঠেন তার পরম হিতাকাঙ্খী যদুনাথ রায়ের বাসায়;
অবসর সময়ে যদুনাথের ছেলেকে পড়াতেন তিনি। এখানেই চলত দীনেন্দ্রকুমার
ও জলধরের সাহিত্য আলোচনা। ১২৯৭-এর অগ্রহায়ণ মাসে দীনেন্দ্রকুমার
বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। শিক্ষকতার স্বল্প উপার্জ্জনে ব্যয়
নির্বাহ কঠিন হওয়ায় তিনি চলে যান রাজসাহীতে জেলা জজের অফিসে
কর্মচারী হিসাবে। রবীন্দ্র-ঘণিষ্ঠ লোকেন্দ্রনাথ পালিতের
সহায়তায় তার এই কর্মপ্রাপ্তি বলে জানা যায়। উপার্জন কিছুটা
বাড়লেও শিক্ষকতার জীবনে যে সাহিত্য চর্চার সুযোগ ছিল রাজসাহীতে
তার একান্তই অভাব। যান্ত্রিক একঘেয়েমিতে হাঁপিয়ে ওঠেন দীনেন্দ্রকুমার।
অবশ্য তার পরে এখানেই তার সঙ্গে পরিচয় হয় অক্ষয় কুমার সরকারের
সঙ্গে। ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রও 'ভারতী' পত্রিকায় লিখতেন
এবং দীনেন্দ্রকুমার ছিলেন তার খুব স্নেহের পাত্র। এ ছাড়া
রাজসাহীতে আলাপ হয় কান্ত-কবি রজনী কান্ত সেনের সঙ্গে।
এর পরের পর্যায়ে দীনেন্দ্রকুমারের আবার স্থান ও পেশা পরিবর্তন।
কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে এসে ১৮৯৩ সালে অরবিন্দ
ঘোষ বরোদা কলেজে অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ছোট বেলা থেকেই বাইরে
থাকায় বাংলা ভাষায় তিনি মোটেই স্বচ্ছন্দ ছিলেন না, অথচ বাংলা
শিখবার তার আগ্রহ ছিল প্রবল। তিনি একজন বাংলা শিক্ষকের অনুসন্ধান
করছিলেন। ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে দীনেন্দ্রকুমারের ভালই যোগাযোগ
ছিল। স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদিত 'ভারতী ও বালক' পত্রিকার
বৈশাখ সংখ্যায় দীনেন্দ্রকুমারের রচনা 'একটি কুসুমের মর্মকথা
: প্রবাদ প্রশ্ন' প্রথম প্রকাশিত হয়। সম্ভবতঃ এই সূত্র ধরে
রবীন্দ্রনাথ দীনেন্দ্রকুমারকে মনোনীত করেন অরবিন্দকে বাংলা
শেখানোর জন্য। দু'বছর তিনি বরোদায় থেকে অরবিন্দের সঙ্গে
ঘনিষ্ঠ ভাবে মেলামেশার সুযোগ পান। অরবিন্দ সম্বন্ধে তার
মূল্যায়ন ও স্মৃতি রোমন্থন ১৯২৪ সালে 'অরবিন্দ প্রসঙ্গ'
গ্রন্থে প্রকাশিত হয়।
এদিকে জলধর সেন 'বসুমতী' পত্রিকার দায়িত্ব নিয়ে প্রাক্তন
ছাত্র ও সহকর্মী দীনেন্দ্রকুমারকে আহ্বান জানান তার সঙ্গে
যোগদানের জন্য। বরোদা থেকে চলে এসে সানন্দে দীনেন্দ্রকুমার
'বসুমতী'তে যোগ দেন। এখান থেকেই তার প্রকৃত সাহিত্য জীবনের
শুরু। 'বসুমতী'-র দৈনিক ও মাসিক সংস্করণ দুইএর সঙ্গেই তিনি
ঘণিষ্ঠ ভাবে যুক্ত হয়েছিলেন। তার জীবনের শেষ রচনা 'কথাশিল্পীর
হত্যারহস্য' বৈশাখ ১৩৫০ সংখ্যা থেকে শুরু করে তার মৃত্যুর
(১২ই আষাঢ়,১৩৫০, ২৭শে জুন, ১৯৪৩) পরেও ধারাবাহিক হিসাবে
প্রকাশিত হয়েছিল।
ইংরাজিতে এড্গার অ্যালেন পো (Edger Allan Poe ) (১৮০৯ -
১৮৪৯ ) রচিত The Murders in the Rue Morgue (১৮৪১) বইটিকেই
প্রথম ডিটেক্টিভ কাহিনী বলে ধরা হয় । শোনা যায় প্রুসিয়ার
( বর্তমানে জার্মানী ) লেখক E.T.A. Hoffmann-এর একটি গল্পের
দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন । তবে অনেকে উইল্কি কলিন্সকে (Wilkie
Collins) (১৮২৪ - ১৮৮৯ ) ডিটেক্টিভ উপন্যাসের জনক বলে মনে
করেন । বিখ্যাত লেখক চার্লস ডিকেন্স রচিত Bleak House-ও
(১৮৫৩) একটি প্রাচীন গোয়েন্দা কাহিনী । শার্লক হোম্স এসেছেন
১৮৮৬ সালে। যাই হোক, বাংলায় ঠিক গোয়েন্দা কাহিনী না হলেও
১৮৮৮ খৃষ্টাব্দে দারোগা গিরিশচন্দ্র বসু রচিত ‘সেকালের দারোগার
কাহিনী’ অপরাধ ও অপরাধীদের নিয়ে সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত
গল্প । এর পর উল্লেখযোগ্য লেখক হলেন প্রিয়নাথ মুখোপাধ্য্যায়
(১৮৫৫ - ১৯১৭ ), যিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন ‘দারোগার দপ্তর’
লিখে । এই সঙ্গে হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের নামও উল্লেখযোগ্য
। এর পর স্বল্প কালের জন্য আবির্ভাব ‘তপস্বিনী’ খ্যাত নগেন্দ্রনাথ
গুপ্তর । রহস্য কাহিনীর ইতিহাস অবসর-এও আলাদাভাবে রয়েছে,
এ নিয়ে বেশী লেখা নিষ্প্রয়োজন । পরে কিছু গোয়েন্দা কাহিনী
রচিত হলেও বিখ্যাত হন তিনজন লেখক পাঁচকড়ি দে (১৮৭৩ - ১৯৪৫
) , দীনেন্দ্রকুমার রায় ( ১৮৭৩ - ১৯৪৩ ) এবং সুরেন্দ্রমোহন
ভট্টাচার্য্য । এদের সবার মধ্যে যার জনপ্রিয়তা তখনকার দিনে
প্রায় শরৎচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথকেও ছুঁতে চলেছিল তিনি হলেন
পাঁচকড়ি দে ।
ঐবসুমতী সাহিত্য মন্দির’-এর প্রতিষ্ঠাতা উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়
(১৮৬৮ - ১৯১৯) ১৩০৭ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে ‘নন্দন কানন’
নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন; এর সম্পাদক হন দীনেদ্রকুমার।
প্রথম সংখ্যা থেকেই এতে প্রকাশিত হয়েছিল তার ধারাবাহিক উপন্যাস
‘জয়সিংহের কুঠী’। অবশ্য এই ধারাবাহিকটি প্রথম বেরোতে শুরু
করে ‘দাসী’ নামক মাসিক পত্রিকায় এবং পরে তা ‘নন্দন কানন’-এ
প্রকাশিত হতে থাকে। মাসিক পত্রিকা ‘নন্দন কানন’ ক্রমশঃ ক্রাইম
পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। শুরু হয় ‘নন্দন কানন সিরিজ’ ও ‘রহস্য
লহরী সিরিজ’। এই দুই সিরিজ মিলে তার প্রকাশিত বইএর সংখ্যা
প্রায় পাঁচশ। ‘নন্দন কানন’ মাসিক পত্রিকাটি কেন বেশ কিছু
সাময়িক-পত্র গবেষকদের নজর এড়িয়ে গেছে এবং তাদের গ্রন্থপঞ্জীতে
অন্তর্ভুক্ত হয় নি তা বোঝা কঠিন। জনপ্রিয়তায দীনেদ্রকুমারের
রবার্ট ব্লেক পাঁচকড়ি দের দেবেন্দ্রবিজয়কে অতিক্রম করতে
পারে নি হয় ত; কিন্তু দীনেদ্রকুমারের লেখনী শুধু গোয়েন্দা
কাহিনীতেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে নি।
বহু লোক দীনেন্দ্রকুমারকে শুধু রবার্ট ব্লেকের স্রষ্টা এবং
গোয়েন্দা কাহিনীর রচয়িতা বলেই জানেন। কিন্তু পল্লীচিত্র
ও পল্লীসমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে তার রসস্নিগ্ধ রচনা পড়ে
বিস্মিত হতে হয়। এই রচনাগুলিতে তার চিন্তার ব্যাপ্তি, সাহিত্য
প্রতিভা ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখনী চালনার সহজাত ক্ষমতাকেই
তুলে ধরে। তার লেখনী সৃষ্ট পল্লীচিত্র, পল্লীবৈচিত্র, পল্লীকথা
প্রভৃতি গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত বিবিধ রচনা অসাধারণ বৈচিত্র
ও বর্ণময়তায় ভরপুর। ‘সাহিত্য’ সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি
স্বয়ং তার পল্লীকথা গ্রন্থের ‘প্রুফ’ সংশোধন করে দিযেছেন;
আর পল্লীজীবনকে তুলে ধরার জন্য রবীন্দ্রনাথ তাকে লিখেছেন
‘বাংলা দেশের হৃদয় হইতে আনন্দ ও শান্তি বহন করিয়া আনিয়া
আমাকে উপহার দিয়াছেন। ও অনেক পাঠক পল্লীসমাজের বিভিন্ন দিক
ও বিষয়বস্তু নিয়ে রচনাকে তার গোয়েন্দা কাহিনীর থেকে বেশি
উপভোগ্য বলে মনে করেন। পল্লীজীবনের অন্তর্নিহিত সত্তাকে
তিনি আত্মস্থ করেছিলেন। সম্ভবতঃ মুর্শিদাবাদ, মহিষাদল ও
রাজসাহীতে থাকা কালীন গ্রাম বাংলা ও পল্লী জীবনের সঙ্গে
তার একাত্মতা গড়ে ওঠে। একই সঙ্গে তার লেখনী গোয়েন্দা কাহিনীর
জটিল ঘটনা প্রবাহ ও যুক্তিজালের ঘেরাটোপে আবার পল্লীগ্রামের
সরলতা ও সজীবতার মুক্ত আঙিনায় কি করে বিচরণ করেছিল ভাবলে
আশ্চর্য্য হতে হয়। শেষ জীবনে নদীয়ার মেহেরপুরে তার বাসস্থানের
কাছে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি ছাপাখানা; এখান থেকেই তার
লেখা দ্রুত গতিতে ছাপা হয়ে বেরোত। দীনেন্দ্রকুমার ‘মুকুল’,
‘শিশুসাথী’, ‘সখা ও সাথী’, ‘মৌচাক’ প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিত
লিখতেন। ছোটদের জন্যও তিনি লিখেছেন। তার রচিত ‘মজার কথা’,
‘লোহার বাক্স’, ‘তালপাতার সিপাই’ ইত্যাদি বহুবিধ রচনা কখনও
মজার কখনও হাস্যরসে পূর্ণ। গোয়েন্দা কাহিনী বাদে তার রচিত
কিছু গ্রন্থ : বাসন্তী (১৩০৫), হামিদা (১৮৯৯), পট(১৩০১),
মজার কথা (১৯০৩), পল্লীচিত্র (১৯০৪), পল্লীবধূ (১৯২৩), তালপাতার
সিপাই (১৯২৩), পল্লীকথা (১৩২৪), নায়েবমশাই (১৩৩১), অরবিন্দ
প্রসঙ্গ (১৩৩০), সোনার পাহাড় (১৯২৯), নানাসাহেব (১৯২৯),
নারীর প্রেম, পল্লীবৈচিত্র্য (১৩১২), কলির কালনেমি, আরব্য
উপন্যাস (১৯০২), নেপোলিয়ন বোনাপার্টি (১৯০৩), মহিমময়ী, ঢেঁকির
কীর্তি (১৩৩১), আরব্য রজনী (১৩৪২) ইত্যাদি। এ ছাড়া কাশিমবাজার
রাজবাটি থেকে প্রকাশিত ‘তিলি পত্রিকা’ এবং সাপ্তাহিকী ‘হিন্দুরঞ্জিকা’
পরিচালনার দায়িত্ব ছিল তার উপর। তার রচনা উদ্ধার করে কিছু
পুণঃপ্রকাশিত হয়েছে, আরও হয় ত হবে। জানি না ব্যস্ততা ও চাহিদায়
জর্জরিত এই সময়ে ক’জন তার লেখা পড়তে আগ্রহী হবেন। ]
( লেখক পরিচিতি প্রস্তুত করতে বারিদবরণ ঘোষের রচনার সহায্য
নেওয়া হয়েছে)।
বি: দ্র: দীনেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে বিভিন্ন তথ্যসূত্রে উল্লেখিত
তারিখ নিয়ে এত বিভিন্ন মত সাধারণতঃ দেখা যায় না। তার জন্ম
সময় বারিদবরণ ঘোষ বলেছেন ১৮৬৯ সালের ২৫শে আগষ্ট, ‘সাহিত্যসেবক-মঞ্জুষা’য়
রয়েছে ১৮ই আগষ্ট, ‘বাঙালি চরিতাভিধান’ অনুসারে ১৮৭৩ সালের
২৬শে আগষ্ট। আন্যান্য কিছু সময় নিয়েও এই ধরণের বিভ্রান্তি
রয়েছে।
দীপক
সেনগুপ্ত।
(১)
ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে সীমান্তবাসী দুর্দ্দান্ত পাঠান
জাতির সহিত ইংরেজের দাঙ্গাহাঙ্গামা সর্ব্বদা লাগিয়াই আছে| কএক
বৎসর পূর্ব্বে আফ্রিদী জাতির সহিত ইংরেজের যে যুদ্ধ হইয়াছিল, সে
কথা পাঠকগণের স্মরণ থাকিতে পারে| সেনাপতি সার বিঙ্গন ব্লভের অধীনে
যে সকল ইংরেজ সেনানায়ক আফ্রিদীগণের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করিয়াছিলেন,
তাঁহাদের মধ্যে কর্ণেল লীর নাম উল্লেখযোগ্য| কর্ণেল লীর একমাত্র
কন্যা মিস ইসোবেল লী লড়াই দেখিবার জন্য সীমান্তে পিতার নিকট গমন
করিয়াছিলেন|
সে বৎসর শীতকালে মহাসমারোহে আফ্রিদীর-যুদ্ধ চলিতেছিল; ফ্রেব্রুয়ারী
মাসের প্রথমে ২য় সংখ্যক বেঙ্গল ল্যান্সার্শ (2, Bengal Lancers)
সৈন্যদল সুবিখ্যাত খাইবার পাশের পশ্চিমাংশে - সীমান্ত-স্তম্ভের
(Frontier post) সন্নিকটে শিবির সংস্থাপন করিয়াছিল ; কর্ণেল লী
এই সেনাদলের অধিনায়ক ছিলেন| তিনি একদিন প্রভাতে তাঁহার তাম্বুতে
বসিয়া লিখিতেছিলেন, এমন সময় তাঁহার প্রাণাধিকা কন্যা সুন্দরী ইসোবেল
হাসিতে হাসিতে তাঁহার সম্মুখে আসিয়া বলিলেন, "বাবা, কি সুন্দর
প্রভাত! পার্ব্বত্য প্রকৃতি আজ বড় চমৎকার দেখাইতেছে; আমি একটু
ঘুরিয়া আসি|"
কর্ণেল লী লিখিতে লিখিতে মুখ তুলিয়া কন্যার মুখের দিকে চাহিলেন|
ইসোবেল ঊনিশ বৎসরের মেয়ে; প্রভাত-কমলের মত সুন্দর তাঁহার মুখ,
স্বর্ণাভ কেশগুলি সূক্ষ পশমের মত সুকোমল, তাঁহার হাসি বড় মিষ্ট,
আর তাঁহার প্রকৃতি বড়ই চঞ্চল| বাপের আদরিণী মেয়ে - কর্ণেল তাঁহার
কোনও আব্দার প্রায়ই অগ্রাহ্য করিতেন না| আজও তাঁহার ইচ্ছায় বাধা
দিতে কর্ণেলের প্রবৃত্তি হইল না, কিন্তু দুর্দ্দমনীয় আফ্রিদীগণ
সেনা-নিবাসের চারিদিকে প্রচ্ছন্নভাবে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে তাহা তিনি
জানিতেন; ইসোবেল বেড়াইতে বেড়াইতে যদি দূরে গিয়া পড়েন, তাহা হইলে
বিপদের সম্ভাবনা আছে বুঝিয়া তিনি বলিলেন, "বেল, এখানে ইচ্ছমত
ভ্রমণ করা নিরাপদ নহে, যদি একান্তই বেড়াই ইচ্ছা হইয়া থাকে তবে
একটু ঘুরিয়া এস, কিন্তু সাবধান, লাইনের বাহিরে যাইও না|"
'হাতী সাহেব' Indus Transport Train এর রসদবাহী হস্তী, যেন ঐরাবতের
বংশধর, এরূপ বৃহৎ হস্তী সচরাচর দেখা যায় না| গজরাজের দেহ ১১ ফিট
৪ ইঞ্চি উচ্চ, কাল মেঘের মত তাহার রঙ, নামটিও খুব জমকাল - সায়েন-সা|
বিস্কুট ভক্ষণে সায়ন-সার বড় আনন্দ| ইংরেজ সৈন্যগণের অনেকেই আমোদ
দেখিবার জন্য স্বহস্তে তাহাকে বিস্কুট খাওয়াইত| ইসোবেলের ইচ্ছা
হইয়াছিল তাহাকে খানকত বিস্কুট খাওয়াইয়া আসেন| ইসোবেলের মা পাকা
ঘোড়সোয়ার ছিলেন, গৃহপালিত পশুপক্ষীকে তিনি বড় আদর-যন্ত করিতেন;
কএক বৎসর পূর্ব্বে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছিল| কন্যার কথা শুনিয়া পরলোকগতা
পত্নীর গুণের কথা কর্ণেলের মনে পড়িল; তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ
করিয়া একটু হাসিলেন, সে হাসি বিষাদমাখা| তাহার পর তিনি তাঁহার
কার্য্যে পুনর্ব্বার মনঃসংযোগ করিলেন| চঞ্চলা ইসোবেল কুরঙ্গিণীর
ন্যায় নাচিতে নাচিতে সেখান হইতে প্রস্থান করিলেন|
ইসোবেল অশ্বারোহণে তাম্বুর বাহিরে আসিয়া দেখিলেন, তাঁহার পিতার
একটি বন্ধু প্রাতর্ভ্রমণে বাহির হইয়াছেন| এই সাহেবটির নাম মিঃ
স্পেণসার | মিঃ স্পেণসার উত্তর পশ্চিম সীমান্ত জেলার বিধাতৃপুরুষ
- Political Officer.
মিঃ স্পেণসার ইসোবেলকে একাকিণী ভ্রমণে বাহির হইতে দেখিয়া অত্যন্ত
বিস্মিত হইলেন, বলিলেন, "অমন জায়গায় কি একাকী বেড়াইতে আছে?
গতরাত্রে একদল আফ্রিদী আমাদের কাছে দরবার করিতে অসিয়াছে, নিকটেই
তাহারা আড্ডা লইয়াছে; এ অবস্থায় তোমাকে একলা যাইতে দিতে পারি না,
চল, আমিও তোমার সঙ্গে যাই|
ইসোবেল একথা শুনিয়া ভীত হওয়া দূরের কথা বরং ভারি খুসী হইলেন, সোৎসাহে
বলিলেন, "আফ্রিদী আসিয়াছে? বটে! চলুন, তাহাদিগকে দেখিয়া আসি|
আমি বিলাতের কোনও কাগজে আফ্রিদীদের সম্বন্ধে একটা গল্প লিখিব|
তাহা পড়িয়া বিলাতের লোক খুব তারিফ করিবে| খ্যাতি লাভের এমন সহজ
উপায় আর কি আছে বলুন|"
মিঃ স্পেনসার বলিলেন, "হাঁ, ভাল করিয়া লিখিতে পারিলে বিলাতের
পাঠকগণের নিকট ইহা একটি নূতন জিনিষ হইবে বটে, লোকে রোমাঞ্চকর উপন্যাসের
মত রুদ্ধ নিঃশ্বাসে, মহা আগ্রহে তাহা পাঠ করিবে| আফ্রিদীদের সম্বন্ধে
তোমার অভিজ্ঞতা লাভের চমৎকার সুযোগ উপস্থিত| আটজন আফ্রিদীর চারিদিকে
তোমার পিতার রেজিমেন্টের ছয়শত সৈন্য সজ্জিত রহিয়াছে| এমন সুযোগ
ভিন্ন অন্য সময় আফ্রিদীদের দিকে ফিরিয়াও চাহিও না|"
ইসোবেল মিঃ স্পেনসারের সহিত সায়েন সার নিকট উপস্থিত হইলেন; আফ্রিদীরাও
তখন সেখানে আসিয়া 'হাতী সাহেব'কে দেখিতেছিল| দুগাছি অনতিদীর্ঘ
রজ্জু দ্বারা হস্তীর পশ্চাতের পদদ্বয় দুইটি খোঁটায় আবদ্ধ ছিল|
আর সে, মোটা মোটা ঘাসের আঁটি শুঁড়ে তুলিয়া মুখে পুরিতেছিল| আফ্রিদী-দূতেরা
মিঃ স্পেনসারকে দেখিয়া তাঁহার সহিত আলাপ আরম্ভ করিল| যে আফ্রিদীর্সদ্দার
এই দূতদলের দলপতি হইয়া আসিয়াছিল - সেই তাহাদের অভিযোগের কথা বলিতেছিল|
এই আফ্রিদীসর্দ্দারের নাম চামরু| সীমান্তের অধিবাসিগণ চামরুর নামে
হাড়ে কাঁপিত| পরস্বাপহরণে লুণ্ঠনে, নরহ্ত্যায় চামরুর কুণ্ঠা ছিল
না; সীমান্ত-প্রদেশবাসী কৃষকগণের ক্ষেত্রে শস্য পাকিলে, সে সদলবলে
শস্যক্ষেত্রে আপতিত হইয়া সমস্ত শস্য কাটিয়া লইয়া যাইত; গ্রামবাসীরা
বাধা দিতে আসিলে তাহাদের শোণিতে শস্যক্ষেত্রে প্লাবিত করিত| ইংরেজের
শিবির হইতে বন্দুক চুরী করিতে তাহার মত ওস্তাদ সে অঞ্চলে দ্বিতীয়
ছিল না|
চামরুর সঙ্গে আরও সাতজন মাতব্বর আফ্রিদী দৌত্য-কার্য্যে আসিয়াছিল,
তাহাদের সকলেই বলবান যুবক, প্রত্যেকেরই দেহ অসুরের মত, তন্মধ্যে
সর্ব্বাপেক্ষা যে অধিক জোয়ান, তাহার বয়স সকলের অপেক্ষা অল্পবোধ
হয় ত্রিশ বৎসরের অধিক নহে| তাহার নাম আলিবাগ; আলিবাগ চামরু সর্দ্দারের
একমাত্র পুত্র| আলিবাগ ব্যাঘ্রের ন্যায় হিংস্র, আবার তাহারই মত
শোণিতলোলুপ| ইংরেজ জাতিকে সে অত্যন্ত ঘৃণা করিত|
মিস্ ইসোবেল আফ্রিদীদের দিকে না চাহিয়া হাতীর সঙ্গে খেলা করিতে
লাগিলেন, তাঁহার বামহস্তে অশ্বের বল্গা, দক্ষিণহস্তে চিনি মাখান
'টোষ্ট' করা পাঁউরুটি; তিনি টুক্রা টুক্রা পাঁউরুটির হাতীর সম্মুখে
ধরিলে, সে তাহা তাঁহার হাত হইতে তুলিয়া মুখে নিক্ষেপ করিতে লাগিল|
পাঁউরুটিখানি ফুরাইলে, মিস ইসোবেল সহাস্যে তাঁহার শুভ্র হাতখানি
ঘুরাইয়া বলিলেন, "আর নাই! এখন কি খাইবি?"
নিরেট বোকাকে লোকে হস্তীমূর্খ বলে, কিন্তু হস্তী সম্বন্ধে এ কথা
খাটে না, কারণ হাতীর মত বুদ্ধিমান জন্তু অল্পই আছে; সায়েন সার
বুদ্ধি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ছিল, সে ইসোবেলের 'চালাকী' বুঝিতে পারিল,
এবং শুঁড় বাড়াইয়া তাঁহার পকেটে খানাতল্লাসে আরম্ভ করিল! পকেটে
কএক-খানি বিস্কুট ছিল, সে তাহা বাহির করিয়া লইয়া বদনে নিক্ষেপ
করিল| ইসোবেল হাসিয়া বলিলেন, "চোর!" তাহার পর তাহার
শুঁড়ে আদর করিয়া মৃদু মুষ্ট্যাঘাত করিলেন| সায়েন সা শুঁড় তুলিয়া
ফোঁৎ করিয়া নাক ঝাড়িল, সেই শব্দে ইসোবেলের ঘোড়া ভয় পাইয়া লাফাইয়া
উঠিল| হাতীর নাকের জলে তাঁহার পোষাক ভিজিয়া গেল|
তখন মিঃ স্পেনসারের সহিত চামরুর তর্কবিতর্ক চলিতেছিল| সাহেবের
মুখে দুই একটি অপমানসূচক কথা শুনিয়া সে অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া
উঠিয়াছিল; তাহার চীৎকারে আকৃষ্ট হইয়া ইসোবেল সেইদিকে চাহিলেন;
দেখিলেন, চামরুর ভাঁটার মত গোল চক্ষু দুটি রাগে রক্তবর্ণ হইয়াছে;
তাহার বিকট মুখভঙ্গি দেখিয়া ইসোবেলের মনে আতঙ্কের সঞ্চার হইল|
ভয়ে তাঁহার মুখ শুকাইয়া গেল|
ইসোবেলকে ভীত দেখিয়া মিঃ স্পেনসার নির্ব্বাক হইলেন, এবং তাঁহাকে
লইয়া সেই স্থান ত্যাগ করিবার অভিপ্রায়ে তাঁহাকে ঘোড়ার পিঠে তুলিয়া
দিলেন| ইসোবেল স্পেনসারের করতলে পদস্থাপন করিয়া এক লম্ফে অশ্বপৃষ্ঠে
আরোহণ করিয়াছেন, এমন সময় চামরু তাহার কুর্ত্তির ভিতর হইতে একখানি
তীক্ষ্ণধার বক্র ছুরি বাহির করিল, এবং বিদ্যুতদ্বেগে ইসোবেলের
অশ্বের পশ্চাতে উপস্থিত হইয়া, তাহার পশ্চাদ্ভাগে সেই ছুরি সজোরে
বিদ্ধ করিল| ছুরির তীক্ষ্ণফলা দেহে বিদ্ধ হইবামাত্র অশ্ব যন্ত্রণায়
অধীর হইয়া ঘুরিয়া দাঁড়াইল, এবং পদাঘাতে পার্শ্বস্থিত স্পেনসারকে
ভূতলশায়ী করিয়া সবেগে ছুটিয়া চলিল| ইসোবেল পড়িতে পড়িতে কোনও প্রকারে
সামলাইয়া লইলেন' অশ্বারোহণ-বিদ্যায় অনেক পুরুষ অপেক্ষা তাঁহার
অধিক পারদর্শিতা ছিল|
সায়েন সা অদূরে দাঁড়াইয়া চাম্রুর কাজ দেখিয়াছিল, চামরু তাহার কিছু
দূরে ছিল; সায়েন সা সবেগে কএক গজ অগ্রসর হইল, তাহার পশ্চাতের উভয়
পদ যে রজ্জুতে আবদ্ধ ছিল, তাহা স্থূল হইলেও সেই আকর্ষণে জীর্ণ
সূত্রের ন্যায় ছিন্ন হইল| সায়েন সা চাম্রুর সম্মুখে আসিয়া তাহার
বিরাট শুণ্ড মস্তকের উপর উত্তোলিত করিয়া তদ্দ্বারা চাম্রুর মস্তকে
সবেগে আঘাত করিল| সেই আঘাতে চামরুর মস্তক চূর্ণ হইল; যেন লোহার
হাতুড়ীর প্রচণ্ড আঘাতে তাহার মাথার খুলি ভাঙ্গিয়া গেল| চক্ষুর
নিমিষে এই কাণ্ড ঘটিল|
দলপতিকে এইভাবে নিহত হইতে দেখিয়া তাহার পুত্র ও সহচরগণ ক্রোধে
ক্ষিপ্ত প্রায় হইয়া উঠিল; স্পেন্সারকে ধরিতে পারিলে তাহারা সেইস্থানেই
তাঁহাকে হত্যা করিত, কিন্তু স্পেন্সার পূর্ব্বেই অশ্বারোহণে ইসোবেলের
অনুসরণ করিয়াছিলেন| অগত্যা বৈর-নির্য্যাতনে অসমর্থ হইয়া অফ্রিদীরা
নিষ্ফল অক্রোশে গর্জ্জন করিতে লাগিল এবং দলপতির মৃতদেহ একটি থলিয়ায়
পুরিয়া লইয়া গিরিন্তরালে প্রস্থান করিল| তাহাদের ধারণা হইল, স্পেন্সারের
ইঙ্গিতেই হাতী তাহাদের সর্দ্দারকে হত্যা করিয়াছে| তাহারা প্রতিজ্ঞা
করিল - একদিন এই অত্যাচারের প্রতিশোধ লইবে|
(২)
মিস ইসোবেল বহু চেষ্টায় আহত অশ্বকে সংযত করিয়া নিরাপদে শিবিরে
উপস্থিত হইলেন| অল্পক্ষণ পরে সায়েন সার মাহুতের নিকট এই হত্যাকাণ্ডের
কাহিণী শ্রবণ করিয়া কর্ণেল লী অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিলেন| অতঃপর
কি কর্ত্তব্য, তাহা স্থির করিতে না পারিয়া কর্ণেল বন্ধুগণের পরামর্শ
জিজ্ঞাসা করিলেন|
২য় সংখ্যক বেঙ্গল ল্যান্সার্শ সৈন্যদলের রিসালদার মেজর সর্দার
বাহাদুর মহম্মদ খাঁ নামক পাঞ্জাবী মুসলমান সেনানী কর্ণেল লীর অধীনে
আফ্রিদী যুদ্ধে আসিয়াছিলেন, মহম্মদ খাঁ সাহসী বীরপুরুষ, তিনি অনেকবার
ঘোর সঙ্কটে কর্ণেল লীর প্রানরক্ষা করিয়াছিলেন বলিয়া লী তাঁহাকে
অত্যন্ত স্নেহ করিতেন, কঠিন সমস্যায় তাঁহার পরামর্শ গ্রহণ করিতেন|
মহম্মদ খাঁ আফ্রিদীদের ভাল রকমই চিনিতেন, তিনি বলিলেন, "হুজুর,
আফ্রিদীরা নানাভাবে আপনাকে বিপন্ন করিতে চেষ্টা করিবে; মিস সাহেবকেই
উহারা এই অনর্থের মূল মনে করিয়া তাঁহার উপর রাগিয়া আছে; উহারা
কোনও সুযোগ তাঁহার প্রতি অত্যাচার করিতে পারে| আমার বিবেচনায় মিসসস
সাহেবকে আর এখানে রাখা সঙ্গত নহে; আপনি তাঁহাকে কতকগুলি প্রহরীর
হেফাজতে শিমলায় পঠাইবার ব্যবস্থা করুন|"
মিঃ স্পেন্সার ও কর্ণেল বন্ধু কাপ্তেন রেজিলাণ্ড ওয়েন (Captain
Reginald Wayne) এই প্রস্তাবের সমর্থন করিলেন| কর্ণেল লী এই পরামর্শই
সঙ্গত মনে করিলেন|
কিন্তু ইসোবেল বাঁকিয়া বসিলেন| পিতার প্রস্তাব শুনিয়া তিনি অশ্রুপূর্ণ
নেত্রে বলিলেন, "আমি অল্পদিন হইল তোমার কাছে আসিয়াছি, এখানে
আমি বেশ আছি; পৃথিবীতে তুমি ভিন্ন আমার আপনার বলিতে আর কেউ নাই,
মা বাঁচিয়া থাকিলে তিনি আমাকে কখনও এত শীঘ্র চলিয়া যাইতে বলিতেন
না| যদি আমাকে শিমলাতেই যাইতে হয় ত, আমি এ মাসে কোন মতেই যাইব
না, আমাকে মার্চ্চ মাসের শেষে সেখানে পাঠাইও| এত সৈন্য, এত অস্ত্রশস্ত্র
লইয়া যুদ্ধ করিতে আসিয়াছে, তবু আফ্রিদীগের ভয়ে অস্থির হইয়া উঠিয়াছ!
লোকে বলিবে কি?"
কর্ণেল লী কন্যার আবদার অগ্রাহ্য করিতে পারিলেন না| তিনি তাঁহাকে
নিজের কাছেই রাখিলেন; কিন্তু খুব সতর্কভাবে বাস করিতে লাগিলেন|
এই ঘটনার পর তিনি ইসোবেলকে একাকিনী কোথাও যাইতে দিতেন না|
একমাস চলিয়া গেল| সেই দুর্গম পার্ব্বত্য প্রদেশেও শীতের প্রভাব
একটু একটু করিয়া কমিতে লাগিল| মধ্যাহ্নের রৌদ্রে পাহাড় উত্তপ্ত
হওয়ায় কুচ কাওয়াজের সময় পরিবর্ত্তিত হইল| প্রত্যুষে 'প্যারেডের'
সময় নির্দিষ্ট হইল|
মার্চ্চমাসের একদিন প্রভাতে-'প্যারেড' আরম্ভ হইবার কিছু পূর্ব্বে
ইসোবেল প্রাতভ্রমণে বাহির হইলেন; সিনিয়র সব অল্টার্ণ মনরো (Senior
Subalterna Monoroe) সাহেব ইসোবেলের দেহরক্ষীরূপে অশ্বারোহণে তাঁহার
সঙ্গে চলিলেন| উভয়ে আটক রোডের (Attock Road) দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর
হইলেন|
এই পথটি বেশ প্রশস্ত ও কতকটা সমতল| পথের দুই পাশের বৃক্ষশ্রেণী
পথের উপর ছায়া বিস্তার করে, একটি সঙ্কীর্ণকায়া স্বচ্ছসলিলা গিরিনদী
এই পথের ধারে সমান্তরালভাবে প্রবাহিত হইতেছে| মিস লী নানা জাতীয়
পার্ব্বত্য বিহঙ্গ-কলকণ্ঠ মুখরিত ছায়াচ্ছন্ন নির্জ্জন পথে প্রফুল্লচিত্তে
অশ্বপরিচালিত করিলেন| মন্রো তাঁহার পশ্চাতে| প্রভাতের সুশীতল সমীরণ
তাঁহাদের ক্লান্তি দূর করিতেছিল, এবং বনকুসুমের মধুর সৌরভ মুক্ত
বায়ুতরঙ্গে ভাসিয়া আসিতেছিল|
তাঁহারা ছাউনি হইতে প্রায় একক্রোশ দূরে আসিয়া পড়িলে নদীসন্নিহিত
একটি অনতিবৃহৎ গুল্মের অন্তরাল হইতে হঠাৎ 'দুড়ুম্' করিয়া বন্দুকের
শব্দ হইল| সঙ্গে সঙ্গে মনরোর অশ্ব গুলিবিদ্ধ হইয়া ভূতলশায়ী হইল,
মনরো অশ্বপৃষ্ঠ হইতে পথিপ্রান্তে নিক্ষিপ্ত হইলেন; ঝোঁক সামলাইতে
না পারিয়া তিনিও পড়িয়া গিয়া আহত হইলেন|
আহত হইয়াও মনরো উঠিয়া দাঁড়াইলেন' সম্মুখে চাহিয়া দেখিতে পাইলেন,
বিশ পঁচিশ হাত দূরে ছয়জন আফ্রিদী অশ্বারোহী ইসোবেলকে আক্রমণ করিয়াছে,
ইসোবেল তাহাদের কবল হইতে মুক্তিলাভের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতেছেন
এবং তাঁহার হস্তস্থিত চাবুক দ্বারা আততায়ীদের প্রহার করিতেছেন|
কিন্তু ছয়জন বলবান আফ্রিদীর বিরুদ্ধে তিনি একাকিনী, কি করিবেন-
আফ্রিদীরা চক্ষুর নিমিষে তাঁহাকে বাঁধিয়া ফেলিল, এবং তাঁহাকে তাঁহার
ঘোড়ায় তুলিয়া ঘোড়াটিকে পাহাড়ের দিকে তাড়াইয়া লইয়া চলিল|
মনরোর অশ্ব তখন মাটিতে পড়িয়া 'খাবি' খাইতেছিল; তিনি বুঝিলেন, কএক
মিনিটের মধ্যেই তাহার মৃত্যু হইবে| তাঁহারও একখানি পা জখম হইয়াছিল,
তথাপি তিনি ইসোবেলের উদ্ধারের জন্য খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে আফ্রিদীগণের
অনুসরণ করিলেন, কিন্তু খোঁড়া পা লইয়া দ্রুতগামী অশ্বারোহীগণের
সমীপস্থ হওয়া অসম্ভব| কএক মিনিটের মধ্যেই আফ্রিদীরা বন্দিনী যুবতীকে
লইয়া অরণ্যের অন্তরালে অদৃশ্য হইল| অগত্যা মনরো জীবন্মৃত অবস্থায়
শিবিরে প্রত্যাগমনপূর্ব্বক কর্ণেল লীকে এই দুঃসংবাদ জ্ঞাপন করিলেন|
এই সংবাদ গ্রহণে কর্ণেল লীর মনের অবস্থা কিরূপ হইল, তাহা সহজেই
অনুমান করা যায়| ক্রোধে ক্ষোভে তিনি ক্ষিপ্তবৎ হইয়া উঠিলেন| শিবিরে
মহাকলরব উত্থিত হইল, 'প্যারেড' বন্ধ হইয়া গেল, এবং দশবার জন অশ্বারোহী
সৈনিক ইসোবেলের উদ্ধারের জন্য পাহাড়ের দিকে অশ্ব পরিচালিত করিল;
পথপ্রদর্শকরূপে মনরো তাহাদের সঙ্গে চলিলেন|
আফ্রিদীরা ইসোবেলকে অপহরণ করিয়া যে পথে লইয়া গিয়াছিল, মনরো-পরিচালিত
অশ্বারোহী সৈনিকগণ সেইপথে কিছুদূর অগ্রসর হইয়া দেখিতে পাইল, অরণ্যের
অন্তরালস্থিত শ্যামল তৃণপূর্ণ অধিত্যকায় সাতটি ঘোড়া চরিতেছে| ইংরেজ
সৈন্যগণ দেখিবামাত্র চিনিতে পারিল-উহাদের মধ্যে কর্ণেল লীর ঘোড়াটিও
আছে|
মনরো সৈনিকগণকে বলিলেন, "মিস লী এই ঘোড়ায় চড়িয়া আমার সঙ্গে
বেড়াইতে আসিয়াছিলেন, অবশিষ্ট ঘোড়াগুলি আফ্রিদী দস্যুদের| তাহারা
এই সকল ঘোড়ায় চড়িয়া মিস লীকে চুরী করিয়া লইয়া গিয়াছে| সকল ঘোড়াই
ত দেখিতেছি এখানে চরিতেছে, কিন্তু মিস লী কোথায়? আফ্রিদীরাই বা
কোথায় গেল?"
অশ্বারোহী সৈনিকেরা তন্ন তন্ন করিয়া চারিদিকে অনুসন্ধান করিল,
কিন্তু তাহারা ইসোবেল বা আততায়ীগণের চিহ্নমাত্রও দেখিতে পাইল না|
অদূরে সমুচ্চ গিরিশৃঙ্গ, গিরি পাদমূলে নিবিড় অরণ্য; সেই অরণ্য
ভেদ করিয়া পথহীন দুর্গম উপত্যকায় আরোহণ করাই কঠিন, সে দিকে অশ্ব-পরিচালন-চেষ্টা
বাতুলতা মাত্র|
মনরো হতাশহৃদয়ে অনুচরবর্গের সহিত শিবিরে প্রত্যাগমন করিলেন|
কর্ণেল লী উভয় মুখ ঢাকিয়া নিঃশব্দে রোদন করিতে লাগিলেন; কেহই তাঁহাকে
সান্ত্বনা দানের চেষ্টা করিল না| ইংরেজ শিবিরে বিষাদের ছায়া ঘনাইয়া
উঠিল| অতঃপর কি কর্ত্তব্য কেহই তাহা স্থির করিতে পারিলেন না|
(৩)
চারিদিন
পর্য্যন্ত অশ্রান্ত চেষ্টাতেও মিস লীর সন্ধান মিলিল না| কর্ণেল
লীর আহারনিদ্রা বন্ধ হইল, কাজ-কর্ম্ম মাথায় উঠিল; তিনি পাগলের
মত হইলেন| তাঁহার বিশ্বাস হইল, আফ্রিদীরা তাঁহার প্রাণাধিকা কন্যাকে
অশেষ যন্ত্রণা দিয়া হত্যা করিয়াছে; ইসোবেল জীবিত থাকিলে এতদিন
তাঁহার সন্ধান পাওয়া যাইত|
কর্ণেলের সহযোগী সামরিক কর্ম্মচারীগণ বলিলেন, আফ্রিদীগণ মিস লীকে
নিশ্চয়ই হত্যা করে নাই, তাঁহাকে হত্যা করিয়া বা উৎপীড়িত করিয়া
তাহাদের কোনও লাভ নাই; সম্ভবতঃ মুক্তিপণ আদায়ের আশায় তাহারা তাঁহাকে
চুরী করিয়াছে|
কিন্তু চারিদিনের মধ্যেও আফ্রিদীরা কোনও সংবাদ পাঠাইল না| কেন
তাহা বুঝিতে না পারিয়া কর্ণেল লী সহযোগীগণের এই অনুমানের আস্থা
স্থাপন করিতে পারিলেন না|
পঞ্চম দিন অপরাহ্নে একটি আফ্রিদী যুবক অশ্বারোহণে ইংরেজের ছাউনীতে
উপস্থিত হইল| ঘাঁটীর প্রহরীরা অবিলম্বে তাহাকে কর্ণেল লীর নিকট
লইয়া গেল|
কর্ণেল লী আফ্রিদী যুবককে ব্যাকুলভাবে কন্যার কথা জিজ্ঞাসা করিলেন|
আদ্রিদী যুবক বলিল, "মিসসাহেব ভাল আছেন| আমাদের সর্দ্দার
আলিবাগ দূতরূপে আমাকে এখানে পাঠাইয়াছেন| সরকার আমাদের দাবী গ্রাহ্য
করিলেই মিস সাহেবকে এখানে রাখিয়া যাওয়া হইবে| মিস সাহেবের কোনও
ক্ষতি করা তাঁহার উদ্দেশ্য নহে|"
কর্ণেল লী ব্যগ্রভাবে বলিলেন, "তুমি যে মিথ্যা কথা বলিতেছ
না তাহার প্রমাণ কি? বর্ব্বর আফ্রিদীরা যে যন্ত্রণা দিয়া তাহাকে
হত্যা করে নাই, এ কথা কিরূপে বিশ্বাস করিব?"
আফ্রিদী যুবক তাহার পাগড়ীর প্রান্ত হইতে একখানি পত্র খুলিয়া কর্ণেল
লীর হস্তে প্রদান করিল| পত্রে ইসোবেলের হস্তাক্ষর দেখিয়া কর্ণেল
যেন মৃতদেহে প্রাণ পাইলেন| তিনি কম্পিত হস্তে পত্রখানি খুলিয়া
রুদ্ধ নিঃশ্বাসে তাহা পড়িলেন| পত্রে এইরূপ লেখা ছিল :-
"বাবা,
এই কয় দিন আমাকে না দেখিয়া আপনার মানসিক অবস্থা কিরূপ শোচনীয় হইয়াছে,
তাহা বুঝিতে পারিয়া আমি বড়ই উৎকণ্ঠিত হইয়াছি| আপনি শান্ত হউন,
এ পর্য্যন্ত আমি নিরাপদে আছি| আফ্রিদীরা আমাকে চুরী করিয়া হিন্দুকুশের
সন্নিহিত একটি উপত্যকায় লইয়া আসিয়াছে| আমি যে স্থানে আছি, ইহা
একটি আফ্রিদীপল্লী| দূরারোহ পর্ব্বতের উপর দিয়া এখানে আসিতে হয়|
পথ অতি দুর্গম, আপনার ফৌজ এ পথের সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিবে, এরূপ
বোধ হয় না| আর পথের সন্ধান পাইলেও এখান হইতে আমাকে উদ্ধার করিয়া
লইয়া যাওয়া তাহাদের সাধ্য হইবে না; এ জন্য আফ্রিদীদের অনুগ্রহের
উপরেই আপনাকে নির্ভর করিতে হইবে|
"আফ্রিদীরা
আমাকে বন্দী করিলে আমি বিনা প্রতিবাদে তাহাদের সঙ্গে আসিতে সম্মত
হওয়ায় তাহারা আমার প্রতি কোন প্রকার অত্যাচার করে নাই| এখানে আমার
আহারাদির কিছু অসুবিধা হইতেছে বটে, কিন্তু আমি ক্ষুধাতৃষ্ণায় কষ্ট
পাইতেছি না; কেবল ভবিষৎ চিন্তায় আমি অধীর হইয়াছি| এই ভীষণ পাষাণকারা
হইতে কখনও কি উদ্ধার পাইব? এমন দুর্গম স্থানে কারারুদ্ধ করিয়াও
আফ্রিদীরা আমার উপর কড়া পাহারার ব্যবস্থা করিয়াছে| একটি গিরিগুহা
আমার কারাকক্ষ রূপে নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে; দুইটি আফ্রিদী স্ত্রীলোক
দিবারাত্রি আমার পাহারায় আছে| আফ্রিদী সর্দ্দার বলিতেছে, ইংরেজ
সরকার তাহার দাবী গ্রাহ্য করিলেই সে আমাকে আপনার নিকট পাঠাইয়া
দিবে| তাহার দাবী সঙ্গত কি না তাহা আমি জানি না; তাহা পূর্ণ করা
আপনাদের পক্ষে কতদূর সম্ভব, তাহাও বলিতে পারি না| আপনার বিপন্না
কন্যার প্রাণরক্ষার জন্য আপনি প্রাণপণে চেষ্টা করিবেন তাহা জানি,
কিন্তু ইহাদের দাবী পূর্ণ করা আপনার অসাধ্য হইলে আপনি যে আমাকে
পুনর্ব্বার দেখিতে পাইবেন, এরূপ আশা করিবেন না| এই অভাগিনী কন্যার
জন্য আপনি কি সঙ্কটেই পড়িয়াছেন! আমার মনে হইতেছে মরিলেই বুঝি বাঁচিতাম,
আপনিও দুশ্চিন্তা হইতে মুক্তি লাভ করিতেন|
আপনার অভাগিনী কন্যা বেলার|"
কন্যার
পত্র পাঠ করিয়া কর্ণেল লী অতি কষ্টে অশ্রুসংবরণ করিলেন, কিন্তু
তিনি আফ্রিদী দূতকে অন্য কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার পূর্ব্বেই পলিটিক্যাল
আফিসার মিঃ স্পেনসার তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, "তোমার সর্দ্দারের
দাবী কি? কত টাকা পাইলে সে মিস সাহেবকে এখানে রাখিয়া যাইতে পারে?"
আফ্রিদী
দূত বলিল, "তাঁহার দাবী কি, তাহা আমাকে বলিয়া দেন নাই; তিনি
সরকারকে এই মাত্র জানাইতে বলিয়াছেন, কিরূপে বন্দোবস্তে তিনি মিস
সাহেবকে মুক্তি দান করিবেন, তাহা স্থির করিবার জন্য ছয়জন অনুচর
সহ তিনি আপনাদের ছাউনীতে আসিতে চান; কিন্তু মিস সাহেবকে তিনি বন্দী
করিয়াছেন-এই অপরাধে যদি আপনারাও তাঁহাদিগকে বন্দী করেন, বা তাঁহাদিগের
প্রতি অত্যাচার করা হয়, তাহা হইলে আমাদের দলের লোক মিস সাহেবের
ছিন্ন মুণ্ডু আপনাদের উপহার পাঠাইবে| আপানাদের অভিপ্রায় কি জানিয়া
যাইবার জন্য আমি আদিষ্ট হইয়াছি|"
মিঃ স্পেনসার আফ্রিদী দূতের কথা শুনিয়া সক্রোধে বলিলেন "আলিবাগের
বড় স্পর্দ্ধা! তাহার প্রাণদণ্ড না করিয়া আমরা এ সঙ্কল্প ত্যাগ
করিব না| সে অধিক দিন জীবিত থাকিলে সীমান্ত প্রদেশের এক প্রান্ত
হইতে অন্য প্রান্ত পর্য্যন্ত আগুন জ্বালাইয়া দিবে| রাজ্যের শান্তিরক্ষার
জন্য তাহাকে ধরিয়া ফাঁসী কাঠে লটকাইতে হইবে|"
আফ্রিদী দূত একথা শুনিয়া প্রস্থানোদ্যত হইয়া বলিল, "উত্তম,
আমি ফিরিয়া গিয়া সর্দ্দারকে একথা জানাইব|"
দূতের এই প্রকার ধীরতায় মিঃ স্পেনসারের ধৈর্য্য ধারণ করা অসম্ভব
হইয়া উঠিল| তিনি সক্রোধে বলিলেন, "তুই ফিরিয়া যাইবি কোথায়?
-রিসালদার মেজর! এই দস্যুর হাত পা দৃঢ়রূপে রজ্জুবদ্ধ কর| শূয়ারের
গোস্ত কুত্তা দিয়া খাওয়াইব|"
রিসালদার মেজর মহম্মদ খাঁ অদূরে দাঁড়াইয়া ছিলেন; তিনি মিঃ স্পেনসারকে
বলিলেন, "খোদাবন্দ, এই বান্দা আফ্রিদী সর্দ্দারের দূত মাত্র,
দূত অবধ্য| সাময়িক উত্তেজনার বশীভূত হইয়া দূতের প্রতি উৎপীড়ন করিলে
সরকারের দুর্ণাম হইবে|"
কর্ণেল লী অধীরভাবে বলিলেন, "অগ্রে আমার কন্যার উদ্ধারের
ব্যবথা কর| আলিবাগকে তাহার ধৃষ্টতার প্রতিফল দিতে হয়, পরে দিও|"
মিঃ স্পেনসার বলিলেন, "এই বর্ব্বরদের দুর্ব্যবহারে ধৈর্য্য
রক্ষা করা কঠিন| মিস লীর উদ্ধারের জন্য আমরা প্রাণপণে চেষ্টা করিব;
কিন্তু কৃতকার্য্য হইবার সম্ভাবনা অল্প| রাস্কেলগুলা হয় ত অসঙ্গত
দাবী করিয়া বসিবে|"
কর্ণেল বলিল, "কিন্তু আলিবাগের দাবী কি, সে কথা ত অগ্রে আবশ্যক|
নগদ টাকা ভিন্ন সে আর কি চাহিবে? আমার যাহা কিছু আছে-সর্ব্বস্ব
দিয়া আমার প্রাণাধিকা কন্যাকে ফিরাইয়া আনিব; এ জন্য যদি আমাকে
সর্ব্বস্বান্ত হইতে হয়-ঋণে ডুবিতে হয়-তাহাতেও আমি সম্মত|"
মিঃ স্পেনসার বলিলেন, "কিন্তু কেবল টাকা পাইলেই যে দুর্ব্বৃত্তেরা
মিস লীকে ছাড়িয়া দিবে, এমন বোধ হয় না| উহারা যদি রাজনীতিক ব্যাপারে
হস্তক্ষেপ করিতে চায়, তাহা হইলে কিরূপে তাহার মীমাংসা হইবে? আমাদের
ব্যক্তিগত লাভ লোকসানের জন্য গবর্ণমেণ্টের পলিসি পরিবর্ত্তিত হইবে
না| আমাদের স্বার্থের অনুরোধে গবর্ণমেণ্ট 'প্রেষ্টিজ' নষ্ট করিবেন
না|"
পোলিটিক্যাল অফিসারের কথায় কর্ণেল লী মনে বেদনা পাইলেন, তিন্নি
ক্ষুব্ধস্বরে বলিলেন, "স্পেনসার, তুমি এ প্রদেশে গবর্ণমেণ্টের
প্রতিনিধি, গবর্ণমেণ্টের 'প্রেষ্টিজ' রক্ষায় তোমার আগ্রহ আছে,
কিন্তু তোমার স্মরণ রাখা উচিত, আমাকে কর্ত্তব্যপরায়ণ বিশ্বস্ত
ভৃত্য জানিয়াই গবর্ণমেণ্ট আমাকে আফ্রিদীদমনে প্রেরণ করিয়াছেন;
গবর্ণমেণ্টের 'প্রেষ্টিজ' যাহাতে নষ্ট না হয়-সে বিষয়ে আমারও কি
লক্ষ্য নাই? তুমি যদি কন্যার পিতা হইতে, তাহা হইলে আমার হৃদয়বেদনা
বুঝিতে পারিতে|"
মিঃ স্পেনসার বলিলেন, "তুমি আমায় ভুল বুঝিয়া অনর্থক ক্ষুব্ধ
হইতেছ| মিস লীর উদ্ধারের জন্য তোমার যেরূপ আগ্রহ আমার তদপেক্ষা
অল্প নহে| যাহা হউক, আমি আলিবাগ ও তাহার সঙ্গীদের অভয় দান করিতেছি,
তাহাদের প্রতি কোনও অত্যাচার করা হইবে না; তাহারা এখানে আসিয়া
তাহাদের দাবীর কথা প্রকাশ করিতে পারে|"
অনন্তর দূতকে সে কথা বলা হইলে সে বিদায় গ্রহণ করিল|
(৪)
কর্ণেল লীর প্রাণধিকা দুহিতা ইসোবেল আফ্রিদী-হস্তে বন্দিনী হইবার
পর এক সপ্তাহ অতীত হইল| অষ্টম দিন মধ্যাহ্ণ কালে আফ্রিদী সর্দ্দার
আলিবাগ ছয় জন অনুচর সহ ইংরেজের ছাউনীতে উপস্থিত হইল| দূত মুখে
সীমান্তপ্রদেশের 'পোলিটিক্যাল অফিসার মিঃ স্পেনসারের অভয়বাণী শুনিয়া
সে নিঃশঙ্কচিত্তে অনুচর-বর্গের সহিত তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে
আসিয়াছিল| সে জানিত, তাহার অন্যায় ব্যবহারে সরকার তাহার প্রতি
যতই অসন্তুষ্ট হউন, অঙ্গীকার ভঙ্গ করিয়া তাহার প্রতি উৎপীড়ন করিবেন
না| বর্ব্বর আফ্রিদী সর্দ্দারও 'ব্রিটিশ প্রেষ্টিজের' মহিমা বুঝিত,
সুতরাং ইংরেজের ছাউনীতে আসিয়া তাহাদের আকারেঙ্গিতে ভয়ের চিহ্ণ
মাত্র ছিল না| স্বধর্ম্মী আফগান-নরপতি আমীরের অভয়বাণীতে তাহারা
আস্থা স্থাপন করিতে পারিত না, কিন্তু যতই শত্রুতা থাক, সরকারের
অঙ্গীকারে তাহাদের অবিশ্বাস ছিল না| ইহারাই নাম 'ব্রিটিশ প্রেষ্টিজ'
- ইহাতেই ব্রিটেনিশয়ার গৌরব|
সেই দিন অপরাহ্ণ তিন ঘটিকার সময় পোলিটিক্যাল আফিসারের শিবিরসন্নিহিত
মুক্ত প্রান্তরে আফ্রিদীগণকে আহ্বান করা হইল| কর্ণেল লীকে তাঁহার
বন্ধুগণ অনুরোধ করিলেন, সভাস্থলে আফ্রিদীগণের সম্মুখে কন্যার অমঙ্গল
আশঙ্কায় তিনি যেন অধীরতা প্রকাশ না করেন| কর্ণেল লী এই অনুরোধে
সম্মত হইলেন| ছাউনীতে যে কএকজন মিলিটারী কর্ম্মচারী ছিলেন, তাঁহারা
সকলেই সভায় উপস্থিত হইলেন; ভারতীয় সৈনিকগণের মধ্যে কেবল মাত্র
রিসালদার মেজর সর্দ্দার বাহাদুর মহম্মদ খাঁ সভায় উপস্থিত থাকিবার
অনুমতি পাইলেন| সর্দ্দার বাহাদুরের অসাধারণ সাহস ও শৌর্য্য বীর্য্য
কর্ত্তব্যপরায়ণতার জন্য ঊর্দ্ধতন সামরিক কর্ম্মচারীগণ হইতে রেজিমেণ্টের
সামান্য পদাতিকেরা পর্য্যন্ত সকলেই তাঁহাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করিতেন|
রিসালদার মেজর মহম্মদ খাঁ সমরকুশল নির্ভীক ও কর্ত্তব্যনিষ্ঠ বীরপুরুষ;
কতবার তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে বিপক্ষের অগ্নিশ্রাবী কামান বন্দুকের
সম্মুখে অটল সাহসে অগ্রসর হইয়াছেন; সেই জন্যই গুণগ্রাহী গবর্ণমেণ্ট
'সর্দ্দার বাহাদুর' খেতাব তাঁহাকে গৌরবান্বিত করিয়াছিলেন|
রিসালদার মেজর সর্দার বাহাদুর সভার একপ্রান্তে দণ্ডায়মান ছিলেন|
সভার কার্য্য আরম্ভ হইলে তিনি ধীরে ধীরে আলিবাগের সন্নিহিত হইলেন
এবং দুইজন আফ্রিদীর সহিত নিম্নস্বরে আলাপ করিতে লাগিলেন| শ্বেতাঙ্গ
মিলিটারী কর্ম্মচারীগণের কেহ কেহ ইহা লক্ষ্য করিয়া বিস্মিত হইলেন;
তাঁহারা বুঝিলেন চতুর মহম্মদ খাঁ মনে মনে কোনও একটা ফন্দী আঁটিয়াছেন|
মিঃ স্পেনসার গম্ভীর স্বরে আলিবাগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, "সর্দ্দার,
তুমি মিস সাহেবকে চুরী করিয়া লইয়া গিয়াছ কেন?"
আলিবাগ বলিল, "আমার পিতা চাম্রু সর্দ্দার সরকারের নিকট দরবারে
আসিয়া নিহত হইয়াছেন; তাঁহার মৃত্যুতে আফ্রিদী জাতি বিষম ক্ষতিগ্রস্ত
হইয়াছে| সরকার যাহাতে আমাদের ক্ষতিপূরণের দাবী গ্রাহ্য করেন, তাহার
পথ 'খোলসা' রাখিবার জন্য আমরা মিস সাহেবকে বন্দী করিয়া লইয়া গিয়াছি,
কিন্তু হাঁহার প্রতি কোনও প্রকার অত্যাচার করা হয় নাই| আমরা জানি
বিনা কায়দায় সরকারকে ক্ষতিপূরণে বাধ্য করিতে পারিব না|"
আলিবাগের স্পর্দ্ধায় মিঃ স্পেন্সার অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইলেন| তাঁহার
মুখমণ্ডল আরক্তিম হইয়া উঠিল| তিনি বিশেষ চেষ্টায় আত্মসংবরণ করিয়া
বলিলেন, "কাপুরুষ বর্ব্বর ভিন্ন কেহ রমণীর গায়ে হাত তোলে
না| তোমাদের স্পর্দ্ধা বড়ই বাড়িয়া গিয়াছে, শীঘ্রই তোমাদের বিষদন্ত
ভাঙ্গিবার ব্যবস্থা হইবে| যাহা হউক, এখন বল কি হইলে তোমরা মিস
সাহেবকে কোনও প্রকার কষ্ট না দিয়া এখানে রাখিয়া যাইবে|"
আলিবাগ বলিল, "আফ্রিদী প্রাণভয়ে কাতর নহে, যুদ্ধেও তাহারা
পরাঙ্মুখ নহে; কিন্তু বিনারক্তপাতে যদি কার্য্যোদ্ধার হয় আমরা
তাহারই পক্ষপাতী| যুদ্ধ করিয়া সরকারেরও কোন লাভ নাই, কেবল সৈন্যক্ষয়,
আর অর্থব্যয়! সরকারের ভাণ্ডারে টাকার অভাব নাই তাহা জানি, কিন্তু
টাকার তোড়া দরিয়ায় ফেলিয়া ফল কি? এখন শুনুন আমাদের দাবী কি, -
সরকার আমাকে আফ্রিদী জাতির প্রধান সর্দার বলিয়া স্বীকার করিবেন,
এবং আমাদের রাজ্যসীমা হইতে সিন্ধুনদের দক্ষিণ দিক পর্য্যন্ত সমস্ত
ভূভাগ আমাদিগকে ছাড়িয়া দিবেন| আর ক্ষতিপূরণ স্বরূপ আমাদিগকে নগদ
লক্ষ টাকা দিবেন| এতদ্ভিন্ন-"
আলিবাগ আরও কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু মিঃ স্পেনসার তাহার কথায়
বাধা দিয়া অসহিষ্ণুভাবে বলিলেন, "আলিবাগ, কেন অনর্থক পাগলের
মত প্রলাপ বকিতেছ? তুমি কি মনে করিয়াছ সরকার তোমার এই অসঙ্গত দাবী
গ্রাহ্য করিবেন! তোমরা কি এখনও সরকারের বল বিক্রমের পরিচয় পাও
নাই? সরকার ইচ্ছা করিলে তোমাদের রাজ্য - তোমাদের সমস্ত সম্পত্তি
সিন্ধুদের জলে ডুবাইয়া দিতে পারেন, আফ্রিদীজাতির চিহ্ণ পর্য্যন্ত
বিলুপ্ত করিতে পারেন| কিন্তু তোমাদের ধ্বংস সাধন সরকারের অভিপ্রেত
নহে| আমি তোমাদের অভয়দান করিয়াছি বলিয়াই আমাদের সম্মুখে আসিয়া
এই প্রকার বাচালতা প্রকাশে সাহসী হইয়াছ! তোমাদের মঙ্গলের জন্যই
বলিতেছি, তোমরা মিস সাহেবকে আনিয়া এখানে হাজির কর| এ পর্য্যন্ত
তোমরা যে সকল অপরাধ করিয়াছে, আমি তাহা ক্ষমা করিব; এবং ভবিষ্যতে
সরকারের শান্ত শিষ্ট রাজভক্ত প্রজার ন্যায় আচরণ করিলে সরকার তোমাদের
কোনও অনিষ্ট করিবেন না|"
আলিবাগ শুষ্কহাস্যে বলিল, স্পেনসার সাহেব! আপনি কি আমাকে বালক
মনে করেন যে, মিষ্ট কথায় ভুলাইবার চেষ্টা করিতেছেন? আমাদের মঙ্গলচিন্তায়
আপনাকে ব্যাকুল হইতে হইবে না; ইচ্ছা হয়, সরকার আমাদের পাহাড়ে হুল
ফুটাইবার চেষ্টা করিবেন| আমাদের দাবীর কথা আমি বলিয়াছি| সরকার
আমাদের দাবী অগ্রাহ্য করেন, আমরা মরিবার জন্য প্রস্তুত আছি, কিন্তু
মারিয়া মরিব|"
মিঃ স্পেনসার উত্তেজিতস্বরে বলিলেন, "কি? তুমি আমাদের ভয়
দেখাইতেছ?"
আলিবাগ বলিল, "আমার যাহা বলিবার
ছিল বলিয়াছি, ইহাতে যদি ভয় দেখান হইয়া থাকে ত হইয়াছে|"
মিঃ স্পেনসার দেখিলেন মিষ্টবাক্যে কার্য্যোদ্ধারের আশা নাই; অগত্যা
তিনি উগ্রভাব ধারণ করিলেন, সক্রোধে বলিলেন, "আলিবাগ, আমার
শেষ কথা শুনিয়া রাখ, যদি মিস সাহেবের প্রতি কোন রকম অত্যাচার কর,
তাহা হইলে আফ্রিদীজাতির মঙ্গল নাই; নিশ্চয় জানিও-তোমাদের এক প্রাণীকেও
আমি জীবিত রাখিব না| সরকার তোমাদের "আণ্ডা বাচ্চা" সকলকে
একগড় করিবেন| সরকার দয়া করিয়া এখনও তোমাদের বিধ্বস্ত করেন নাই,
কিন্তু আমাদের সহিষ্ণুতারও সীমা আছে; - তাই বলিতেছি, আর আমাদের
উত্যক্ত করিও না| অসঙ্গত দাবী পরিত্যাগ কর, সাধ করিয়া নিজের সর্ব্বনাশের
পথ পরিষ্কৃত করিও না| এখনও সাবধান হও|"
আলিবাগ সগর্ব্বে বলিল, "আপনাদের কামান বন্দুক দেখিয়া যাহারা
ভয়ে কাঁপিয়া মরে, তাহাদিগকে এ সকল উপদেশ দিবেন| আপনার উপদেশ শুনিবার
জন্যও আমরা এখানে আসি নাই| আমাদের দাবী গ্রাহ্য হইবে কিনা তাহাই
জানিতে আসিয়াছি| আমার পিতার মৃত্যুর জন্য, স্পেনসার সাহেব, আপনারাই
দায়ী; সেই দায়িত্ব হইতে আপনারা সহজে মুক্তি লাভের আশা করিবেন না|
চামরু সর্দ্দারের রক্তের পরিবর্ত্তে বহু রক্তপাত হইবে, পাহাড়ে
রক্তের নদী বহিবে|-পাঠান আফ্রিদী অত্যাচারের প্রতিফল দিতে জানে|
চামরু সর্দারের পুত্র সর্দ্দার আলিবাগ জীবন থাকিতে পিতৃহত্যা বিস্মৃত
হইবে না| যেদিন আপনারা আমার বা কোন আফ্রিদীর একগাছি কেশও স্পর্শ
করিবেন, সেই দিনই মিস সাহেবের ছিন্ন মুণ্ডু আপনাদের শিবিরে উপহার
পাঠাইবার ব্যবস্থা হইবে; স্পেনসার সাহেব, আপনিও আমার শেষ কথা শুনিয়া
রাখুন|"
আলিবাগের কথা শুনিয়া কর্ণেল লী চতুর্দ্দিক্ অন্ধকার দেখিলেন| তাঁহার
শাদা মুখ নীল হইয়া গেল| তিনি অতি কষ্টে আত্মসংবরণ করিয়া মিঃ স্পেনসরের
কানে কানে বলিলেন, "স্পেনসর, তুমি করিতেছ কি! এই গোঁয়ার পহাড়ীয়া
সর্দ্দারকে চটাইয়া লাভ কি? স্তোক-বাক্যে উহাকে ভুলাইতে পারিতেছ
না? উহাকে বল, উহার দাবী সরকারের গোচর করিবে, সে সম্বন্ধে সরকারকে
বিবেচনা করিতে অনুরোধ করিবে; উহাদিগকে আশা ভরসা দিবার তোমার কোনও
অধিকার নাই| আলিবাগ টাকা চায় - আমি টাকার যোগাড় করিব; নিজে যাহা
পারি দিব, অবশিষ্ট টাকা যেখানে হইতে পারি - যেমন করিয়া পারি ঋণ
করিয়া দিব| আমার বেলাকে বাঁচাও; সে এখনও জীবিত আছে, কিন্তু অধিক
দিন এই শয়তানের হস্তে বন্দিনী থাকিলে দুশিন্তাতেই সে মারা পড়িবে|
এই দুর্বৃত্ত বলিতেছ আবশ্যক হইলে তাহার ছিন্ন মুণ্ড আমাদের শিবিরে
পাঠাইবে| কি সর্ব্বনাশ!"
কর্ণেল লীর অনুরোধ শুনিয়া মিঃ স্পেনসার কিঞ্চিৎ বিরক্ত হইলেন,
তিনি ভ্রুকুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, "কর্ণেল, তোমার এই অধীরতা
সমর্থন-যোগ্য নহে| আমরা যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছি;
যুদ্ধ ঘোষিত হইয়াছে; সার বিন্দন ব্লুড অগণ্য সৈন্য লইয়া 'বাজার
ভ্যালি' (Bazar Valley) আচ্ছন্ন করিয়াছে, বৃটিশ সৈন্যগণ পঙ্গপালের
মত "পর্ব্বতের দুর্গম উপত্যকার দিকে ছুটিয়াছে, লুণ্ডিকোটালে
মহা আয়োজনে যুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছে| এই যুদ্ধ উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ টাকা
জলের মত খরচ হইতেছে| আর ব্যক্তিগত অনিষ্টের আশঙ্কায় আমরা এই বর্ব্বরদের
স্তোকবাক্যে ভুলাইয়া নিচেষ্টভাবে বসিয়া থাকিব! আমরা ইহাদের অন্যায়
আবদারে কর্ণপাত করিয়াছি একথা গোপন থাকিবে না| খাইবারপাশ হইতে বোলানপাশ
পর্য্যন্ত পর্ব্বতের ঘাটিতে ঘাটিতে এই সংবাদ প্রচারিত হইবে; সিন্ধুতীর
হইতে সুদূরবর্ত্তী হেলমণ্ডের তটভূমি পর্য্যন্ত ভূভাগের সকল লোক
শুনিতে পাইবে-আফ্রিদী সর্দ্দার আলিবাগ সরকারকে 'বেকুব' বানাইয়া
নিজের জিদ্ বজায় রাখিয়াছে| একথা লইয়া আন্দোলন উপস্থিত হইলে গবর্ণমেণ্টের
কাছেই বা কি কৈফিয়ৎ দিব? না আমরা বহুদূর অগ্রসর হইয়াছি, এখন তোমার
প্রস্তাব অচল|
অতঃপর আলিবাগকে কি জবাব দেওয়া যায়, মিঃ স্পেনসার তাহাই চিন্তা
করিতে লাগিলেন| তিনি বুঝিলেন, আলিবাগকে কোন আশা ভরসা দিয়া বিদায়
করিতে না পারিলে ইসোবেলের মৃত্যু অনিবার্য্য| আলিবাগ মিথ্যা ভয়
প্রদর্শন করে নাই; অথচ উপস্থিত ক্ষেত্রে তাহাকে আশা ভরসা দেওয়াও
অসম্ভব| মিঃ স্পেন্সার নিস্তব্ধ; সভাস্থ সকলেই চিন্তামগ্ন| আলিবাগ
শেষ জবাব শুনিবার জন্য মিঃ স্পেনসারের মুখের দিকে নিনির্মেষে নেত্রে
চাহিয়া রহিল| কর্ণেল লী কন্যার অমঙ্গল আশঙ্কায় অধীর হইয়া উঠিলেন|
(৫)
পূর্ব্বেই বলিয়াছি রিসালদার মেজার সর্দ্দার বাহাদুর মহম্মদ খাঁ
সভার একপ্রান্তে দন্ডায়মান ছিলেন| তাঁহার মস্তকে সুবৃহৎ পাগড়ী,
কোমরবন্দে কোষবদ্ধ সুদীর্ঘ তরবারি| উভয় হস্ত বক্ষস্থলে সংস্থাপিত
করিয়া তিনি উভয় পক্ষের তর্কবিতর্ক শ্রবণ করিতেছিলেন| আফ্রিদী সর্দ্দারের
ঔদ্ধত্যে তাঁহার সুগৌর বদনমণ্ডলে বিরক্তি ও অধীরতার চিহ্ণ পরিস্ফুট|
মহম্মদ খাঁ তাঁহার আজানুসমুত্থিত বুটের মসমস শব্দে সভাস্থল প্রতিধ্বনিত
করিয়া আলিবাগের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন, এবং বামহস্তে তাহার কুচকুচে
কালো দাড়ী সবেগে আকর্ষণপূর্ব্বক তাহার গালে 'বিরাশি শিক্কা ওজনের'
এক চপেটাঘাত করিলেন| তাহার পর তাহার মুখে নিষ্ঠীবন ত্যাগ করিয়া
বলিলেন, "ওরে হারামজাদ, সরকারের সঙ্গে তুই লড়াই করিতে চাস?"
মহম্মদ
খাঁর আচরণে সভায় হুলুস্থুলু উপ্স্থিত হইল| আলিবাগের সঙ্গীরা ক্রুদ্ধসিংহের
ন্যায় লাফাইয়া উঠিয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিতে উদ্যত হইল, মহম্মদ খাঁ
আত্মরক্ষার জন্য কোষবদ্ধ সুদীর্ঘ তরবারি নিষ্কাষিত করিলেন| ছয়জন
আফ্রিদীর ছয়খানি তীক্ষ্ণধার বক্র ছুরিকা একসঙ্গে মস্তকের উপর উদ্যত
হইল| কেবল আলিবাগের নিশ্চেষ্টভাবে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল; ক্রোধ
ও অপমানে তাহার ভাঁটার মত গোল গোল চক্ষুদুটি আগুনের ভাঁটার মত
জ্বলিয়া উঠিল, তাহার দেহের সমস্ত রক্ত মুখে আসিয়া জমিল| মুহূর্ত্তকাল
নীরব থাকিয়া সে ক্রোধকম্পিতস্বরে মহম্মদ খাঁর শির লইবার জন্য অনুচরগণকে
আদেশ করিল|
রিসালদার মেজরের এই প্রকার অনধিকার-চর্চ্চায় মিঃ স্পেনসার অত্যন্ত
বিরক্ত হইলেন| কর্ণেল লী ও অন্য কএকজন শ্বেতাঙ্গ সামরিক কর্ম্মচারী
বিদ্যুতবেগে অগ্র্সর হইয়া মহম্মদ খাঁকে দূরে টানিয়া লইয়া না যাইলে
সভাস্থলেই শোণিতের স্রোত প্রবাহিত হইত| - কর্ণেল লী মহম্মদ খাঁকে
কঠোর ভাষায় তিরস্কার করিলেন|
আলিবাগ ক্রোধে
কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল "স্পেনসার সাহেব, আপনাদের এ কিরূপ ব্যবহার?
আমার পিতা আপনাদের দরবারে আসিয়া নিহত হইলেন| আপনি অঙ্গীকার করিয়াছিলেন
আমাদের প্রতি কোন প্রকার অত্যাচার হইবে না, আপনার অঙ্গীকারে নির্ভর
করিয়াই আপনাদের ছাউনীতে আসিয়াছি, আপনাদের একজন তাঁবেদার আমার দাড়ী
মুখে থু থু দিল| আমি এ অপমানের প্রতিফল না দিয়া ক্ষান্ত হইব না|
আমি উহার সহিত লড়াই করিয়া উহার শির লইব|"
মিঃ স্পেনসার বলিলেন, “রিসালদার মেজর আমাদের আদেশে তোমার অপমান
করে নাই, তুমি অপমানের প্রতিফল দিতে চাও উত্তম, তাহাতে আমার আপত্তি
নাই; মহম্মদ খাঁর সাধ্য থাকে-তোমার অক্রমণে আত্মরক্ষা করিবে|"
তাহার পর তিনি মহম্মদ খাঁর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, "মহম্মদ খাঁ,
তুমি অতিথির অপমান করিয়াছ| আলিবাগ এই অপমানের প্রতিফল প্রদানে
উদ্যত হইয়াছে| তুমি তাহার সহিত যুদ্ধে প্রস্তুত আছে?"
মহম্মদ
খাঁ বলিলেন, "হাঁ সাহেব, সম্পূর্ণ প্রস্তুত| কিন্তু আজ আর
বেলা নাই; কাল প্রত্যুষে আমরা পরস্পরের শক্তি পরীক্ষা করিব!"
মিঃ
স্পেনসার আলিবাগকে বলিলেন, "কাল প্রত্যুষে সর্দ্দার মহম্মদ
খাঁর সহিত যুদ্ধ করিও| আমরাও যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থাকিয়া নিরপেক্ষভাবে
যুদ্ধ দেখিব - আর তোমার দাবীর কথা আমি সরকারকে জানাইব, কি ফল হইবে
তাহা আমার অজ্ঞাত; কিন্তু তাহার পূর্ব্বেই যদি মিস সাহেবের কোন
অনিষ্ট কর - তাহা হইলে তোমাদের মঙ্গল হইবে না একথা স্মরণ রাখিও|"
অতঃপর সভা ভঙ্গ হইল|
সভাভঙ্গের
পর কর্ণেল লী মহম্মদ খাঁকে বলিলেন, "আলিবাগের বয়স তোমার অপেক্ষা
অল্প, তাহার শরীরে অসাধারণ শক্তি; তরবারি চালনে তাহার দক্ষতা কিরূপ-জান
কি?"
মহম্মদ খাঁ
বলিলেন, "জানি| শুনিয়াছি আফ্রিদী জাতির মধ্যে তাহার ন্যায়
বলবান্ পুরুষ আর কেহই নাই| তাহার 'কব্জির' এত জোর যে, বেশ ভারি
ও ধারালো তলোয়ার পাইলে সে এক কোপে প্রাকাণ্ড ষাঁড়ের গর্দ্দান দ্বিখণ্ডিত
করিতে পারে|"
কর্ণেল লী
বলিলেন, "তোমার গর্দ্দান ষাঁড়ের গর্দ্দান অপেক্ষা অনেক সরু;
বিশেষতঃ তুমি প্রাচীন হইয়াছ; সে তোমাকে আক্রমণ করিলে কিরূপে গর্দ্দান
রাখিবে?"
মহম্মদ খাঁ
সদম্ভে বলিলেন, "আমি সেই বেইমানের গোস্ত টুকুরা টুকুরা করিয়া
কাটিব| মিস সাহেবকে চুরি করিয়া লইয়া যাইবার প্রতিফল সে হাতে হাতে
পাইবে|"
কর্ণেল বলিলেন,
"কিন্তু তাহাতে ত মিস সাহেবের উদ্ধারসাধন সম্ভব হইবে না|"
"যাহাতে সম্ভব
হয়, আমি তাহাই করিব; আপনার কোনও চিন্তা নাই| আপনাকে আমার যাহা
বলিবার আছে রাত্রে বলিব|" -এই কথা বলিয়া মহম্মদ খাঁ কিছু
ব্যস্তভাবে কর্ণেলের নিকট বিদায় গ্রহণ করিলেন|
মহম্মদ খাঁ
তাড়াতাড়ি রেজিমেন্টের ডাক্তার ফাগুর্সন সাহেবের তাম্বুতে উপস্থিত
হইয়া কুর্ণিশ করিয়া দাঁড়াইলেন|
ডাক্তার ফাগুর্সন প্রত্যভিবাদন করিয়া সম্মিতমুখে জিজ্ঞাসা করিলেন,
"কি সংবাদ সর্দ্দার বাহাদুর! - মেজাজ্ সরিফ?"
মহম্মদ খাঁ বলিলেন, "হাঁ হুজুর; আপনার নিকট একটা দাওয়াই লইতে
আসিয়াছি| এমন দাওয়াই দিবেন, যাহা খাইলে ছয়, সাতজন জোয়ান গভীর নিদ্রায়
আচ্ছন্ন হয়, সহজে তাহাদের নিদ্রা না ভাঙ্গে, অথচ দাওয়াইটা প্রাণহানিকর
বা বিস্বাদ না হয়|-এমন দাওয়াই কি নাই?"
ডাক্তার
ফাগুর্সন বলিলেন, "অবশ্যই আছে, কিন্তু কি জন্য তুমি এই দাওয়াই
চাহিতেছ, তাহা আমার জানা আবশ্যক| তোমার উদ্দেশ্য কি, জানিতে না
পারিলে তাহা তোমাকে দেওয়া হইবে না|"
মহম্মদ খাঁ
বলিলেন, "মিস সাহেবকে উদ্ধার করিতে হইবে|"
ডাক্তার
ফাগুর্সন হাসিয়া বলিলেন, "বৃটিশ ফার্ম্মাকোপিয়াতে ত দাওয়াইয়ের
এ শক্তির কথা লেখে না|"
মহম্মদ খাঁ
তাঁহার কাণে কাণে কএকটি কথা বলিলেন|-ডাক্তার আর উচ্চবাচ্য না করিয়া
খানিকটা 'মর্ফাইন' (Morphine) কাগজে মুড়িয়া মহম্মদ খাঁর হস্তে
প্রদান করিলেন| মহম্মদ খাঁ ডাক্তারকে অভিবাদন করিয়া প্রস্থান করিলেন|
আফ্রিফীগণকে
তাহাদের বাসের জন্য একটা তাম্বু দেওয়া হইয়াছিল| তাহারা তাম্বুতে
ফিরিয়া একটা ডেগ্চিতে 'খানা পাকাইয়া' তাম্বুর মধ্যে ঢাকিয়া রাখিল;
ত্যাহার পর সকলে তাম্বুর বাহিরে আসিয়া একসঙ্গে 'নমাজ' আরম্ভ করিল|
তখন শ্রান্ত তপন পশিমাকাশ ও পশ্চিম গগনভেদী ধূসর গিরিচূড়া লোহিতালোকে
সুরঞ্জিত করিয়া হিন্দুকূশ শৈলমালার অন্তরালে অস্তগমন করিতেছিলেন|
আফ্রিদীদের
তাম্বু ইংরেজের ছাউনি হইতে কিছুদূরে গিরিপাদমূলে অরণ্যের অন্তরালে
সন্নিবিষ্ট হইয়াছিল| সে দিকে লোকজনের গতিবিধি ছিল না| উপাসনা-নিরত
আফ্রিদীরা জানিতেও পারিল না, আলোকান্ধকারের সেই মিলন-ক্ষণে তাহাদের
বস্ত্রাবাসের পশ্চাদ্ববর্তী অরণ্যের অন্তরাল হইতে একজন লোক মৃত্তিকায়
লম্বমান হইয়া বুকে হাঁটিয়া অতিধীরে তাম্বুর পশ্চতে আসিল, এবং তাম্বুর
একপ্রান্ত একটু ফাঁক করিয়া তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাম্বুর ভিতরটা একবার
দেখিয়া লইল; তাহার পর তাম্বুর ভিতর প্রবেশ করিয়া দুইতিন মিনিটের
মধ্যে-যে ভাবে তাম্বুতে প্রবেশ করিয়াছিল, সেই ভাবেই বাহির হইয়া
আসিল! অল্পক্ষণ পরে সন্ধ্যার অন্ধকারে অরণ্যে তাহার দীর্ঘদেহ মিশিয়া
গেল| - আফ্রিদীরা তখনও সমস্বরে করিতেছিল, "লা-আল্লা-ইলাল্লা!"
আফ্রিদীরা
নমাজ শেষ করিয়া তাম্বুতে প্রবেশ করিল, এবং ডেগ্চির চতুষ্পার্শ্বে
চক্রাকারে বসিয়া পরম পরিতৃপ্তির সহিত ভোজন করিল; প্রকাণ্ড এক ডেগ্চি
'ওগ্রা' দেখিতে দেখিতে অদৃশ্য হইল|
সমস্ত
দিনের পথ শ্রমে তাহারা অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়াছিল; তাম্বুর মধ্যে
অগ্নিকুণ্ড প্রজ্জ্বলিত করিয়া, স্ব স্ব বন্দুক মাথার কাছে রাখিয়া
ছয়জন আফ্রিদী বীর ভূমিশয্যায় শয়ন করিল; কেবল একজন মশাল জ্বালিয়া
তাম্বুর দ্বারপ্রান্তে বসিয়া রহিল-তাহার উপর পাহারার ভার ছিল|
যাহার
শয়ন করিয়াছিল, কএক মিনিটের মধ্যেই তাহার গাঢ় নিদ্রায় আচ্ছন্ন হইল|
যে জাগিয়া পাহারা দিতেছিল, তাহারও হাই উঠিতে লাগিল, ক্রমে তাহার
চক্ষু জড়াইয়া আসিল, চক্ষু মেলিবার শক্তি রহিল না; সে বসিয়া ঢুলিতে
ঢুলিতে সেই স্থানেই 'ধূপ্' করিয়া পড়িয়া গেল; মশালটা জ্বলিয়া জ্বলিয়া
নিভিয়া গেল| সমস্ত রাত্রির মধ্যে তাহাদের কাহারও নিদ্রাভঙ্গ হইল
না|
মধ্যরাত্রে
একজন সৈনিক পুরুষ একটি 'বৈদ্যুতিক দীপ' (Electric torch) হস্তে
কর্ণেল লীর বস্ত্রাবাস হইতে বহির্গত হইয়া দ্রুতপদবিক্ষেপে আফ্রিদী
তাম্বুর অভিমুখে ধাবিত হইলেন এবং নিঃশঙ্কচিত্তে আফ্রিদী-শিবিরে
প্রবেশপূর্ব্বক বৈদ্যুতিক দীপের সাহায্যে নিদ্রাভিভূত আফ্রিদী
বীরগণের মুখ দেখিতে লাগিলেন|
তিনি রিসালদার মেজর সর্দ্দার বাহাদুর মহম্মদ
খাঁ|
(৬)
পরদিন প্রভাতে
সূর্য্যোদয়ের পূর্ব্বেই আফ্রিদী সর্দর আলিবাগের সহিত অসিযুদ্ধ
করিবার জন্য সর্দ্দার বাহাদুর মহম্মদ খাঁ হাতিয়ার বন্ধ-হইয়া নির্দ্দিষ্ট
স্থলে উপস্থিত হইলেন| পূর্ব্বদিন যাঁহারা সভায় উপস্থিত ছিলেন,
তাঁহাদের প্রায় সকলেই যুদ্ধ দেখিতে আসিলেন|
কিন্তু আফ্রিদীদের
তখনও দেখা নাই; তাহারা তাহাদের তাম্বুতে পড়িয়া তখনও নাসাগর্জ্জন
করিতেছিল; যুদ্ধক্ষেত্রে তাহাদিগকে অনুপস্থিত দেখিয়া মহম্মদ খাঁ
মৃদু হাস্য করিলেন|
কর্ণেল
লী জিজ্ঞাসা করিলেন, "হাসিতেছ যে!"
মহম্মদ
খাঁ বলিলেন,"আলিবাগ কাল আমার চড় খাইয়া মনের সুখে ঘুমাইতেছে!
ইহা চির নিদ্রার পূর্ব্বলক্ষণ| আমি কাল রাত্রে আপনাকে যে সকল কথা
বলিয়া আসিয়াছি, আলিবাগকে তাহা বলিতে ভুলিবেন না|"
কর্ণেল
লী বলিলেন,"সে কথা আমার মনে আছে|"
মিঃ স্পেনসার জিজ্ঞাসা করিলেন, "কি কথা?"
কর্ণেল লী হাসিয়া বলিলেন, "মুক্তিপণের
কথা পরে জানিতে পারিবে|"
ওয়েন
বলিলেন, "সর্দ্দার বাহাদুর, আলিবাগ তলোয়ার খেলায় ওস্তাদ খুব
কেমন নয় কি? তুমি ত ঘায়েল হইবে না?"
মহম্মদ খাঁ বিনয় প্রকাশ করিয়া বলিলেন, "সে বাঁ হাতে তলোয়ার
খেলে হুজুর! খুব চমৎকার খেলোয়াড়; যাহারা কেবল ডান হাতে ভিন্ন খেলিতে
পারে না- তাহারা তাহার সঙ্গে খেলায় কখন জিতিতে পারিবে না| কিন্তু
আমার কথা স্বতন্ত্র|
কর্ণেল লী বলিলেন,"তুমি ত ডান হাত বাঁ হাত সমান চালাইতে পার|
আজ দেখা যাইবে কেমন তোমার হাত চলে! - তুমি ফৌজের মধ্যে দুই হাতেই
অসি চালনা শিখাইতেছ; এ শিকার উপযোগিতা আছে কি না বুঝা যাইবে|"
মহম্মদ
খাঁ হাসিয়া বলিলেন, "তাহা কি আর বোঝেন না হুজুর! সহজ বুঝিতেই
ত তা বুঝিতে পারা যায়! মনে করুন তলোয়ারখান চালাইতে চালাইতে ডান
হাতখানি যখম হইয়া গেল, তখনও বাঁ হাত চালাইতে পারা যায়| কিন্তু
যাহারা বাঁ হাতে তলোয়ার ধরিতে জানে না, তাহারা তৎক্ষণাৎ পরাজয়
স্বীকারে বাধ্য হয়| দুই হাতে যে তলোয়ার বা বল্লম চালাইতে পারে-সে
একা দু'জনের কাজ করিতে পারে,-অনেক সময় দু' জনের মোহড়া লইতে পারে|"
এইরূপ কথা হইতেছে এমন সময় আলিবাগ অনুচরবর্গের সহিত যুদ্ধক্ষেত্রে
উপস্থিত হইল| তখনও তাহাদের নিদ্রালস ভাব দূর হয় নাই|
কর্ণেল লী তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, "এত বিলম্ব কেন আলিবাগ?
প্রভাতে তোমাদের লড়াইয়ের সময় নির্দ্দিষ্ট আছে, তাহা কি ভুলিয়া
গিয়াছিলে?"
আলিবাগ হাই তুলিয়া বলিল, "ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম; এমন হাড়ভাঙ্গা
ঘুম জীবনে কখনও ঘুমাই নাই| ঠাহর করিতেছি, পাহাড়ের জীনে আমাদের
যাদু করিয়াছিল|"
কর্ণেল লী বলিলেন, "তাড়াতাড়ি লড়াই শেষ করিয়া লও, আজ দেখিতেছি
আমাদের ফৌজের একজন রিসালদার মেজরের চাকরী খালি হইবে| বুড়া মহম্মদ
খাঁ কি তোমার মত খেলোয়াড়ের কাছে তলোয়ার ধরিতে পারিবে?"
মহম্মাদ খাঁ অদূরে দাঁড়াইয়া আছেন দেখিয়া আলিবাগ সদন্তে বলিল, "উহার
বড় গোস্তাকি! সমস্ত আফ্রিদী জাতি আমাকে দেখিলে মাথা নোয়াইয়া কুর্ণিশ
করে, আর সরকারের একটা সামান্য নফর কি না আমার দাড়ি ধরিয়া চড়াইয়া
দিল, আমার মুখে থুথু দিল| তোবা, আজ এই শয়তানটার গোস্ত টুক্রা টুক্রা
করিয়া কাটিব|"
কর্ণেল
বলিলেন, "ঐটি পারিবে না| তোমার মান নষ্ট করিয়াছে, তুমি লড়াই
ফতে করিয়া উহার অপমান কর| পরাজয় অপেক্ষা বীরপুরুষের পক্ষে অধিক
অপমানের বিষয় কি আছে? তোমরা লড়াই করিবে, যুদ্ধে আহত হওয়াই সম্ভব,
কিন্তু কেহ কাহাকেও হত্যা করিতে পারিবে না|"
আলিবাগ বলিল,
"আপনি স্বীকার করিয়াছেন - আমাদের লড়াইয়ের আপনারা নিরপেক্ষ
থাকিবেন, কিন্তু এখন মহম্মদ খাঁয়ের পক্ষ হইয়া কথা বলিতেছেন কেন?
আপনি বুঝিয়াছেন মহম্মদ খাঁ আমার হস্তে পরাজিত হইবে; পাছে আমার
হস্তে সে নিহত হয়, পাছে আপনার একটা বিশ্বাসী নফর জাহান্নামে যায়
- এই ভয়ে আপনি এরকম প্রস্তাব করিতেছেন, তাহা আমার বুঝিতে বাকি
নাই|"
কর্ণেল
লী সহাস্যে বলিলেন, "তুমি যেমন বীর সেইরূপ বুদ্ধিমান ! -
সুতরাং আমার কথা শুনিয়া বুঝিতে পারিবে| আমি নিরপেক্ষ বিচারকের
মতই প্রস্তাব করিয়াছি| যদি তুমি মহম্মদ খাঁর হস্তে নিহত হও, তাহা
হইলে লোকে জনরব করিবে - আমরা অভয় দান করিয়া আনিয়া কৌশলক্রমে তোমাকে
হত্যা করিয়াছি| এজন্য সরকারও কৈফিয়ৎ চাহিতে পারেন; সরকারের উপর
দেশের লোকেরও বিশ্বাস কমিবে|"
আলিবাগ নির্ব্বোধ
নহে, সেই যুক্তির সারবত্তা বুঝিতে পারিয়া কর্ণেল প্রস্তাবে সম্মত
হইল|
কর্ণেল লী
বলিলেন, "আরও কথা আছে| লড়াই করিতে করিতে যদি কেহ তরবারি ত্যাগ
করে - তখনই যুদ্ধ শেষ হইবে| তাহার পরও যে তরবারি চালাইবে তাহাকে
আমি গুলি করিব| যে পরাজিত হইবে, প্রতিদ্বন্দ্বীর হস্তে তাহাকে
বন্দী হইতে হইবে|"
আলিবাগ বলিল,
"মহম্মদ খাঁ যদি পরাজিত হয়, তাহা হইলে তাহাকে বন্দী করিয়া
লইয়া যাইতে পারিব?"
কর্ণেল লী বলিলেন, "তাহাকে বন্দী করিয়া লইয়া যাইবার অনুমতি
দিতে পারি না; সে সরকারের নফর, তাহাকে ছাড়িবার আমার অধিকার নাই|
তবে তুমি মুক্তিপণ আদায় করিয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিতে পারিবে| - তোমার
সম্বন্ধেও ঐ কথা|"
আলিবাগ এ
প্রস্তাবেও সম্মত হইল| সে ভাবিল, "মিস সাহেবের মুক্তিপণ পরে
আদায় হইবে| শুধু হাতে ঘরে ফিরিব? মহম্মদ খাঁকে পরাস্ত করিয়া হাজার
টাকার কম তাহাকে ছাড়িব না| এমন দাঁও সর্ব্বদা মেলে না|"
(৭)
বিউগিল বাজিল|
যুদ্ধ আরম্ভ হইল| মহম্মদ খাঁর তরবারিখানি ওজনে আড়াই সের, প্রায়
আড়াই হাত লম্বা, তাহার মুষ্টি বেষ্টনীহীন| এই তরবারি ক্ষুরের ন্যায়
তীক্ষ্ণধার, এমন উজ্জ্বল যে দর্পণের ন্যায় তাহাতে মুখ দেখা যাইতে|
আলিবাগের
তরবারিখানিও অতি উৎকৃষ্ট| যে তরবারির এক আঘাতে ষণ্ডের গ্রীবা দ্বিখণ্ডিত
হইতে পারে, সেই তরবারি গুণের অন্যপরিচয় দেওয়া বাহুল্য মাত্র| আলিবাগের
কব্জির জোর ও অসিচালনকৌশলেরও ইহা প্রকৃষ্ট প্রমাণ|
আলিবাগ বামহস্তে তরবারি নিষ্কোষিত করিয়া তাহা ঊর্দ্ধে উৎক্ষিপ্ত
করিল| প্রভাত-সূর্য্যরশ্মি তাহাতে প্রতিফলিত হইয়া ঝকমক করিয়া উঠিল|
- মহম্মদ খাঁও বামহস্তে তরবারি আকর্ষণ করিলেন| দেখিয়া আলিবাগ সবিস্ময়ে
থমকিয়া দাঁড়াইল| মুহূর্ত্তের জন্য তাহার মুখ ম্লান হইল|
তাহার
পর উভয় অসি পরস্পরের বিরুদ্ধে পরিচালিত হইল| উভয়েরই অসিচালনকৌশল
অপূর্ব্ব| অসিদ্বয়ের ঘাতপ্রতিঘাতে ক্রমাগত ঝঞ্ঝনা উত্থিত হইল;
সৌরকরপ্রতিফলিত উভয় অসি বিদ্যুতের ন্যায় খেলিতে লাগিল| উভয় তরবারির
ঘর্ষণে ঘন ঘন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বহির্গত হইতে লাগিল, - দর্শকগণ রুদ্ধনিঃশ্বাসে
উভয় বীরের অসিসঞ্চালন নিরীক্ষণ করিতে লাগিল|
আলিবাগ ক্রমাগত
আক্রমণেরই চেষ্টা করিতেছিল; কিন্তু মহম্মদ খাঁ আত্মরক্ষার চেষ্টা
ভিন্ন প্রতি-আক্রমণের চেষ্টা করেন নাই; তিনি ধীরভাবে অপূর্ব্ব
কৌশলের সহিত আলিবাগের প্রত্যেক আঘাত ব্যর্থ করিতে লাগিলেন| আলিবাগ
আঘাত করিতে করিতে ক্রমে তাঁহার নিকট অগ্রসর হইল| অবশেষে আলিবাগ
যখন তাঁহার অত্যন্ত নিকটে উপস্থিত হইল, তখন তিনি এমন কৌশলে তাহাকে
আঘাত করিলেন যে, আলিবাগকে বিদ্যুদ্বেগে হটিয়া আসিতে হইল| মহম্মদ
খাঁ তাহার আক্রমণের প্রতীক্ষায় তরবারি অবনত করিলেন|
এবার আলিবাগ দ্বিগুণ
উৎসাহে অগ্রসর হইবামাত্র মহম্মদ খাঁ চক্ষুর নিমিষে তরবারিখানি
বামহস্ত হইতে দক্ষিণ হস্তে গ্রহণ করিলেন; প্রতিদ্বন্দ্বীর বামহস্তে
তরবারি থাকিলে তাহাকে আঘাতের জন্য যে সকল ফাঁক খুঁজিতে হয়, আলিবাগ
সেই ফাঁক খুঁজিতে গিয়া মুহূর্ত্তের জন্য অসাবধান হইল; মহম্মদ খাঁ
সেই অবসরে আলিবাগের কব্জিতে তরবারির এমন আঘাত করিলেন যে, তাহার
হাত হইতে তরবারি খসিয়া ঝন ঝন শব্দে মাটিতে পড়িয়া গেল|
মহম্মদ খাঁ
এক লম্ফে পার্শ্বে সরিয়া গিয়া আলিবাগের তরবারির উপর দণ্ডায়মান
হইলেন, এবং তাঁহার তরবারির ধারের উল্টা দিক্ দিয়া আলিবাগের ওষ্ঠে
আঘাত করিলেন; সঙ্গে সঙ্গে বলিয়া উঠিলেন "আর কেন আলিবাগ, পরাজয়
স্বীকার কর| ভাবিয়াছিলাম তুমি সের, এখন দেখিতেছি তুমি কুত্তা|
ধোপিকা কুত্তা নহি ঘরকা"-
আলিবাগ সবেগে মহম্মদ
খাঁর নাকের ডগায় এমন এক মুষ্ট্যাঘাত করিল যে, তাহার নাক ফাটিয়া
রক্ত ঝরিতে লাগিল|
মহম্মদ খাঁ সেই
আঘাতে দুইহস্ত হটিয়া গিয়া বলিলেন, "আলিবাগ, আমি তোমাকে তরবারি
ত্যাগ করাইয়াছি, তুমি পরাজিত|"
আলিবাগের
কর্ণে সে কথা প্রবেশ করিল না, তখন সে উন্মত্তবৎ হইয়াছিল| সে কএক
পদ পিছাইয়া গিয়া জানু পাতিয়া বসিল, এবং আঙ্গরাখার ভিতর হইতে একটি
টোটাভরা ছয়নলা পিস্তল বাহির করিয়া মহম্মদ খাঁর অভিমুখে উদ্যত করিল;
তৎক্ষণাৎ ঘোড়া টিপিল|
মহম্মদ খাঁ
ভীত হইলেন না; তরবারি ফেলিয়া উভয় হস্তে মুখ ঢাকিয়া দণ্ডায়মান রহিলেন|
মুহুর্মুহু
পিস্তলের আওয়াজ হইল, পিস্তলের মুখ হইতে ধোম ও অগ্নি শিখা নির্গত
হইল; পিস্তলের শব্দে যুদ্ধ-ক্ষেত্র প্রতিধ্বনিত হইল| ইংরেজ কর্ম্মচরিগণ
ক্রোধে ও ক্ষোভে লাফাইয়া উঠিলেন| আফ্রিদীরা সোৎসাহে হর্ষধ্বনি
করিয়া উঠিল|
কর্ণেল লী
এক লম্ফে আলিবাগের উপর লাফাইয়া পড়িয়া তাহার মস্তকে এমন জোরে মুষ্ঠ্যাঘাত
করিলেন যে, আলিবাগ ঘুরিয়া পড়িয়া গেল|
কর্ণেল লীর
ব্যবহার দর্শনে আফ্রিদীরা ক্রোধে গর্জ্জন করিয়া উঠিল| কিন্তু মহম্মদ
খাঁ তাহাতে ভ্রুক্ষেপ না করিয়া ভূতলশায়ী আলিবাগের বক্ষঃস্থলে জানুস্থাপন
করিয়া তাহার উভয়া হস্ত চাপিয়া ধরিলেন; বলিলেন, "তুমি আমার
বন্দী, হাতে হাতকড়া দিব কি?"
আলিবাগ
বলিল, "তাহার আবশ্যক নাই, আমি পরাজয় স্বীকার করিলাম|"
মহম্মদ
খাঁ আলিবাগকে পরিত্যাগপূর্ব্বক দণ্ডায়মান হইলেন, এবং আলিবাগের
অনুচরগণকে বলিলেন, "তোমাদের সর্দ্দারকে আমি বন্দী করিয়াছি,
মুক্তিপণ না দিলে উহার মুক্তি নাই; আমি উহাকে কারাগারে বন্দী করিয়া
রাখিব|"
আলিবাগ গাত্রোত্থান করিয়া বলিল, "কি মুক্তিপণ চাও?"
মহম্মদ
খাঁ বলিলেন, "মিস সাহেবের স্বাধীনতা| তাঁহাকে এখানে আনিয়া
না দিলে তোমার পরিত্রাণ নাই|"
আলিবাগকে এই প্রস্তাবেই সম্মত হইতে হইল| সেই দিনই আলিবাগের তিনজন
অনুচর ইসোবেলকে আনিতে চলিল - আলিবাগ ইংরেজ শিবিরে বন্দী রহিল|
যুদ্ধাবসানে
আলিবাগের অবশিষ্ট অনুচরেরা খানা পাকাইবার আয়োজনে ব্যস্ত হইল|
(৮)
তিনদিন
পরে আলিবাগের অনুচরেরা মিস ইসোবেলকে সুস্থদেহে ইংরেজের ছাউনীতে
লইয়া আসিল| পিতার সহিত তাঁহার মিলনের আনন্দ ভাষায় ব্যক্ত হইবার
নহে| আলিবাগ মুক্তি লাভ নিরুৎসাহচিত্তে ইংরেজ-শিবির ত্যাগ করিল|
সেই দিন সায়ংকালে মহম্মদ খাঁকে বিশেষভাবে সম্মানিত করিবার জন্য
ইংরেজ-শিবিরে একটি সান্ধ্যসম্মিলনীর অনুষ্ঠান হইল| সেই সময় কাপ্তেন
ওয়েন মহম্মদ খাঁকে জিজ্ঞাসা করিলেন, "সর্দ্দার বাহাদুর, তুমি
কি যাদু জান? আলিবাগ তোমাকে লক্ষ্য করিয়া মারিবার পিস্তল ছুড়িয়া
ছিল, কিন্তু একটা গুলিও তোমার শরীরে বিধিঁল না! ব্যাপার কি?"
মহম্মদ খাঁ বলিলেন "সেদিন দরবারস্থলে আমি আলিবাগের দুইজন
অনুচরের সহিত আলাপ করিতেছিলাম, তাহা আপনারা লক্ষ্য করিয়া থাকিবেন|
তাহারা কি কি অস্ত্র লইয়া আসিয়াছে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম,
তাহাদের প্রত্যেকের নিকট অতিরিক্ত একটি পিস্তল আছে; তাহাদের আহারাদির
ব্যবস্থা কি হইবে, একথাও জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, তাহারা বলিয়াছিল,
দরবারের পর তাহারা খানা পাকাইবে এবং নমাজ শেষ হইলে আহারাদি করিবে|
"আমি দরবারের পর ডাক্তার সাহেবের নিকট ঘুমের ঔষধ সংগ্রহ করিয়া,
আফ্রিদীদের নমাজের সময় তাহাদের তাম্বুর পশ্চাদ্দিক্ দিয়া তাম্বুতে
প্রবেশ করি, এবং সেই ঘুমের ঔষধ তাহাদের খানায় মিশাইয়া রাখিয়া আসি|
খানা খাইয়া উহারা সমস্ত রাত্রি বেহুঁশ হইয়া পড়িয়া ছিল| মধ্য রাত্রে
পুনর্ব্বার আমি উহাদের তাম্বুতে প্রবেশ করিয়া আলিবাগের কুর্ত্তার
নীচে ছয়নলা পিস্তল দেখিতে পাই| আমি পিস্তলের টোটাগুলি খুলিয়া লইয়া
নূতন টোটা ভরিয়া রাখিলাম, সেই সকল টোটায় গুলি ছিল না| আমি বুঝিয়াছিলাম,
দারুণ অপমানে আলিবাগ আমার প্রতি জাতক্রোধ হইয়াছে; তরবারিযুদ্ধে
পরাজিত হইলে সে আমাকে হত্যা করিবার চেষ্টা করিবে, - গুলি করিয়া
মারিবে| সেই জন্যই তাহার পিস্তল হইতে গুলি সরাইয়াছিলাম| আর সে
জাগিয়া থাকিলে আমার কার্য্যসিদ্ধির সম্ভাবনা নাই বুঝিয়া ঘুমের
ঔষধ খাওয়াইয়া তাহাকে বেহুঁশ করিয়াছিলাম| সে যখন পিস্তলের আওয়াজ
করে তখন জ্বলন্ত বারুদে আমার মুখ ঝল্সাইয়া না যায়, এই অভিপ্রায়ে
মুখ ঢাকিয়াছিলাম|"
কাপ্তেন
ওয়েন হাসিয়া বলিলেন, "তুমি প্রথম হইতেই দাবার চাল আরম্ভ করিয়াছিলে!"
মহম্মদ খাঁ বলিলেন, "হাঁ হুজুর, যুদ্ধটা দাবা খেলা ভিন্ন
আর কিছুই নহে, বুঝিয়া চাল দিতে পারিলেই বাজীমাৎ! আলিবাগকে আমি
আড়াই চালে মাৎ করিয়াছি|"
( ‘ভারতবর্ষ’ মাসিক পত্রিকা, কার্ত্তিক ১৩২০ )।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।