প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

জানকীনাথ ঘোষাল

[ লেখিকা পরিচিতি : হিরণ্ময়ী দেবীর জন্ম কলকাতায় ১৮৭০ সালে । মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একাদশ সন্তান স্বর্ণকুমারী দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা হিরন্ময়ী দেবী । স্বর্ণকুমারীর অপর দুই কন্যা সরলা ও ঊর্মিলা হিরন্ময়ীর দুই বোন । ডাভটন স্কুলে হিরন্ময়ীর বিদ্যাশিক্ষা শুরু এবং পরে তিনি বেথুন স্কুল থেকে মাইনর পরীক্ষা পাস করেন । প্রথাগত শিক্ষালাভ তার এখানেই শেষ । ১৩ বছর বয়সে উদ্ভিদ বিদ্যার অধ্যাপক ফণীভূষণ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয় । বিয়ের আগেই ফণীভূষণ হিরন্ময়ীদের সিমলার বাড়িতে যাতায়াত করতেন । সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করায় ফণীভূষণের সঙ্গে যশোহর, ইন্দোর প্রভৃতি বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে তাকে ঘুরতে হয় । পিতা জানকীনাথ ঘোষালের প্রভাবে হিরন্ময়ী মহিলা থিওসফিক্যাল সোসাইটির সভ্য হন । কিন্তু তার মূল লক্ষ্য ছিল সমাজ সেবা । স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রতিষ্ঠিত 'সখি সমিতিসমিতি'র তখন পড়ন্ত অবস্থা । নিজের সঞ্চিত অর্থ কাজে লাগিয়ে হিরন্ময়ী ১৯০৬ খৃষ্টাব্দে 'বিধবা শিল্পাশ্রম' গড়ে তুলে 'সখি সমিতি'কে নতুন ভাবে উজ্জীবিত করেন । পাশাপাশি ছিল তার সাহিত্য রচনায় অনলস উৎসাহ ও উদ্যম । 'সখা', 'বালক', 'ভারতী' পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন । দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত 'ভারতী' পত্রিকা সম্পাদিকা স্বর্ণকুমারী দেবীর ভগ্নস্বাস্থ্যের জন্য প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম হয, তখন হিরন্ময়ী দেবী পত্রিকাটির হাল ধরেন এবং বোন সরলা দেবীর সঙ্গে যুগ্মভাবে সম্পাদনা শুরু করেন । সরলা দেবী মহীশূরে থাকায় কার্যতঃ হিরন্ময়ী একাই সম্পাদকের কাজ করতেন । বহুদিন পর্যন্ত 'ভারতী঑ই ছিল হিরন্ময়ীর ধ্যান জ্ঞান । সরলা দেবীর কথায় "আজ যে 'ভারতী' পঞ্চাশ বছরে পদার্পণ করিতে চলিয়াছে এ আয়ুষ্মত্তার প্রধান কারণ হিরন্ময়ী দেবী । সে সময় তিনি 'ভারতী' সম্পাদনা না করিলে বাঙ্গলার সাহিত্যজগতে 'ভারতী'র নাম আজ পর্য্যন্ত প্রবাহিত থাকিত না ।"
হিরন্ময়ীর রচনা নানা পত্রিকায় ছড়িয়ে আছে ; সেগুলি একত্রিত করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার চেষ্টা কেউ করেন নি । 'ভারতী'তেই তার মোট রচনার সংখ্যা প্রায় আশি । সনেট রচনাতেও তিনি যথেষ্ট পারদর্শিতার ছাপ রেখেছেন । ১৯০৬ খৃষ্টাব্দে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে একটি প্রদর্শনী সভার ভাষণে তিনি মহিলাদের আলস্য ত্যাগ করে চরকায় সূতো কাটার পরামর্শ দেন । হিরন্ময়ী ইহজগতে ছিলেন মাত্র ৫৫ বছর । মা স্বর্ণকুমারী দেবীর মৃত্যুর (১৯৩২) আগেই ১৯২৫ খৃষ্টাব্দের ১৩ই জুলাই তিনি পরলোকে গমন করেন । বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে মায়ের পাশে তিনি থেকেছেন । কন্যার মৃত্যুতে স্বর্ণকুমারীর প্রতিক্রিয়া, - “আজ আমিই মাতৃহারা হলাম ।"বর্তমান ধারাবাহিকে এর পরেই প্রকাশিত হবে সরলা দেবীর তার দিদির সম্বন্ধে রচিত প্রবন্ধ ‘হিরন্ময়ী দেবী’ । সেই প্রবন্ধ থেকে পাঠক লেখিকা সম্বন্ধে আরও কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন । ]
.. দীপক সেনগুপ্ত।



রাগিণী ভৈরবী - তাল ঝাঁপতাল

সংসারের মাঝে , সকলের কাজে,
দেহ প্রান মন, করিয়া অর্পণ
      দিয়েছিলে তুমি ।
পর আপনার, ছিল না তোমার,
হয়ে একচিত সেবিয়াছ নিত্য
      মাতা জন্মভূমি । ।
গুণমুগ্ধ তব, বান্ধবেরা সব,
বিদায সম্মান, করিবারে দান
      এসেছে সকলে ।
পূজার তরেতে, অর্ঘ্য করতে,
অনাথ আমরা, আসিয়াছি ত্বরা
      নয়নের জলে । ।
কে লইবে তাহা শূন্য গৃহ আহা ।
তব স্মৃতি বক্ষে, কহে কক্ষে কক্ষে,
      নাই কেহ নাই ।
অন্তর সে কহে, নহে তাহা নহে,
জানি তুমি আছ, শান্তি লভিয়াছ
      অমৃতের ঠাঁই । ।

আজ আমরা যাঁর পবিত্র শ্রাদ্ধবাসরে সমবেত হইয়াছি তিনি আমাদের পিতা । আমরা সন্তান হইয়া এই শোকসভায় পিতার কথা যে বলিতে আসিয়াছি তাহা শুধু সম্পর্কের দাবীতে নহে । তিনি আমাদের পিতা - পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্মঃ পিতা হি পরমন্তপঃ - সত্য, কিন্তু তিনি শুধু একলা আমাদের ছিলেন না । শুধু নিজের পরিবার প্রতিপালন করিয়া, নিজের সন্তানদের স্নেহ করিয়াই পিতৃদেব জীবন অতিবাহিত করেন নাই । তিনি তাঁহার উদার মনঃপ্রাণ ব্যক্তিগত সম্বন্ধের উদার গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ রাখেন নাই - বন্ধুবান্ধব ও মাতৃভূমির সেবায় প্রসারিত করিয়া দিয়াছিলেন । তাই তাঁহার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন, যেদিন তাঁহার আত্মজ পুত্র শ্রীমান্ জ্যোৎস্নানাথ বহুদূরে ইংলণ্ড প্রবাসে সেদিন ভক্তবৎসলা বঙ্গজননীর প্রেরিত বহু পুত্রগণের সহায়তায় আত্মীয়গণের হৃদয়ে জ্যোৎস্নানাথের অনিবার্য্য অনুপস্থিতিজনিত সন্তাপের তীব্রতা কতটা প্রশমিত হইযাছিল ।
নদীয়ার জয়রামপুরের ঘোষালবংশে প্রায় ৭৩ বৎসর পূর্বে পিতৃদেবের জন্ম হয় । আমাদের পিতামহ ঁজয়চন্দ্র ঘোষালের দুই পুত্র ছিলেন, তন্মধ্যে পিতামহাশয় কনিষ্ঠ । এই ঘোষালবংশ অসাধারণ বলবীর্য্যের জন্য প্রসিদ্ধ । তাঁহাদের জয়রামপুরের পৈতৃক জমিদারী সম্বন্ধে এই প্রসিদ্ধি আছে যে, ঘোষালদিগের কোনো পূর্বপুরুষ উহা বীর্যতার পুরষ্কার স্বরূপ কৃষ্ণনগরের রাজার নিকট হইতে প্রাপ্ত হন । প্রবাদ এই যে-রাজার এলাকায এক বন্য মহিষ প্রবেশ করিয়া অত্যন্ত উৎপাত আরম্ভ করে, কেহ তাহাদিগকে দমন করিতে না পারায় রাজা ঘোষালদের দুই ভ্রাতাকে ডাকিয়া পাঠান । তাঁহারা রাজাহ্বানের কারণ অবগত হইয়া বলিলেন এই একটা বুনো মোসের জন্য দুটো লোকের কি দরকার ? একজনই যথেষ্ট । এই বলিয়া কোনো এক ভ্রাতা একখানা কাঠের মোটা চেলা লইয়া যুদ্ধার্থে যাইলেন । সঙ্গে রাজা, অনুচর, গ্রামবাসী সকলে দর্শকভাবে চলিলেন । মহিষ যেমন করিযা আক্রমণ করে, অমনি তিনি শিং ধরিয়া তাহাকে হটাইয়া দেন । এইরূপে খানিকক্ষণ যুদ্ধের পর একবার এমন জোরে তাহার মুখ মাটিতে গুঁজিয়া ধরিলেন যে তাহার উঠিবার সাধ্য রহিল না । তখন তাহার মাথা কাটিয়া রাজাকে উপহার দিলেন ও প্রতিদানে এই ব্রহ্মত্র লাভ করিলেন ।
কথিত আছে, আমাদের প্রপিতামহ একদিন ঘাটে স্নান করিতে যাইতেছেন এমন সময় সংবাদ পাইলেন যে গ্রামে একটা ব্যঘ্র প্রবেশ করিয়া অনর্থ করিতেছে । তিনি অমনি ব্যাঘ্রাভিমুখে গমন করিয়া কিছুক্ষণ ধরিয়া যুদ্ধের পর ব্যাঘ্রকে বধ করিয়া স্কন্ধে লইয়া গৃহে আগমন করেন । কিন্তু ব্যাঘ্রের প্রহারে তাঁহার শরীর এরূপ জর্জ্জরিত হইয়াছিল যে তাহাতেই তাঁহার মৃত্যু ঘটে ।
পূর্বে ডাকাতের দৌরাত্ম্য প্রবল ছিল কিন্তু শুনা যায় ঘোষালদের এমনিই ডাক নাম ছিল যে জয়রামপুরে তাহারা আসিতে সাহস করিত না । আর নিকটের গ্রামে ডাকাত পড়িলে যখনই তাঁহারা বিপন্ন পরিবারের সাহায্যার্থে পঁহুছিতেন ডাকাতেরা সভয়ে প্রস্থান করিত । এখনও দেশে প্রবাদ প্রচলিত আছে যে "ঘোষালদের ভয়ে বাঘে ছাগলে এক ঘাটে জল খায় ।"
এই প্রবাদগুলি অতিরঞ্জিত হইলেও ইহা যে, বংশবিশেষের গতি নির্দেশ করে তাহা নিঃসন্দেহ । এই বংশে জন্মিয়া পিতার বাল্য - শিক্ষাও বংশানুকূল হইয়াছিল । তাঁহাদের লাঠিখেলা বর্ষাখেলা ঘোড়ায় চড়া প্রভৃতি শিক্ষা দেওয়া হইত এবং মধ্যে মধ্যে দুই দল হইয়া কৃত্রিম যুদ্ধ চলিত । জ্যেঠামহাশয় ও পিতামহাশয় দুই বিরোধী দলের অধ্যক্ষ হইতেন - তাঁহাদের মধ্যে অসামান্য ভ্রাতৃস্নেহ ছিল কিন্তু যুদ্ধের সময় কেহ কাহাকেও ছাড়িয়া কথা কহিতেন না ।
এই শান্তিপূর্ণ সমযে ডাকাত বা ব্যাঘ্রের সহিত যুদ্ধ করিবার আবশ্যক না হইলেও পিতৃদেবের এই অসাধারণ বল ও সাহসের পরিচয় অনেক কার্য্যেই পাওয়া যাইত ।
পূজ্যপাদ মাতামহ মহর্ষি দেহেন্দ্রনাথ চুঁচুড়াতে যখন রোগশয্যায় শয়ান তখন একদিন রাত্রিকালে তাঁহার মশারিতে আগুন লাগে । পিতৃদেব তাঁহাকে একলাই কোলে করিয়া উঠাইয়া নিরাপদ স্থানে লইয়া যান । পিতামহাশয়ের বিবাহের পূর্বে দাদামহাশয় যখন একবার সপরিবারে সিঁথির বাগানে বাস করিতেছিলেন, সেই সময় পিতা একদিন তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসেন । সেজ-মাতুলমহাশয় ঁহেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি অত্যন্ত দুরন্ত ঘোড়া ছিল, কেহই তাহাতে চড়িতে সাহস করিত না । কিছুদিন পূর্বে একজন দ্বারবান সেই ঘোড়ায় চড়িয়া মৃত্যুমুখে পতিত হয় । ফিরিবার সময় স্টেশনে যাইবার জন্য ভারাটে গাড়ি না পাওয়ায় সেজমামা তাহার উল্লেখ করিয়া বলেন যাইবার একমাত্র উপায় আছে । তিনি মনে করিয়াছিলেন পিতামহাশয় তাহাতে সম্মত হইবেন না; কিন্তু তিনি তৎক্ষণাৎ তাহাতেই আরোহণ করিয়া স্টেশনে গমন করেন । ঘোড়া সওয়ার চিনিতে পারে; তাঁহার হস্তে চালিত হইয়া সুবাধ্য সন্তানের ন্যায় হৃষ্ট ও প্রফুল্লভাবে সে গমন করিল - কোন দুষ্টামির চিহ্ণও প্রকাশ করিল না ।
জোড়াসাঁকোর বাটিতে তেতলার ছাদে বাগানের দিকে ত্রিকোণচূড়া এক আলিসা আছে । একদিন মামাদের সহিত বাজী রাখিয়া তিনি ইহার উপর দিয়া দৌড়িয়া যান । সামান্য পদস্খলণ হইলেই তৎক্ষণাৎ তেতলা হইতে নীচে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিতেন । তাঁহার সাহসিকতার এরূপ দৃষ্টান্ত প্রচুর আছে কিন্তু বাহুল্য ভয়ে অধিক উল্লেখ করিলাম না ।
তাঁহার নিজ ইচ্ছামতই পিতামহাশয় তাঁহাকে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে বিদ্যাশিক্ষার্থে পাঠান । তদানীন্তন প্রিন্সিপ্যাল প্রসিদ্ধ শ্রীযুক্ত উমেশচন্দ্র দত্ত মহাশয়ের তিনি প্রিয় শিষ্য ছিলেন । এইখানেই তিনি ঁরামতনু লাহিড়ী, ঁরাধিকাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় , ঁকালীচরণ ঘোষ, ঁরায় যদুনাথ রায় বাহাদুর ( কৃষ্ণনগর রাজার দৌহিত্র ) প্রভৃতি বন্ধুগণের সংস্পর্শে আসেন । রামতনু লাহিড়ী প্রমুখ মনীষীগনের উপদেশ ও উত্তেজনায় পিতা মহাশয় ও আরও কতিপয় ছাত্র জাতিভেদে বিশ্বাসশূন্য হন, এবং জজ্ঞোপবীত ত্যাগ করেন । আমাদের পিসেমহাশয় ঁপরেশনাথ মুখোপাধ্যায়ও ইঁহাদের মধ্যে একজন । উপবীত-ত্যাগবার্তা শুনিয়া পিতামহ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহাকে ত্যাজ্যপুত্র করেন, কিন্তু শুনিতে পাই পিতামহী ইহাতে মোটেই রাগ করেন নাই; বলিয়াছিলেন ছেলের যাহা সত্য মনে হয় তাহাই করিযাছে, তা করুক । কিন্তু ঠাকুরদাদা অনেকদিন পর্যন্ত ত্মাহাকে ক্ষমা করিতে পারেন নাই । এমন কি জ্যেঠামহাশয়ের মৃত্যু হইলে পিতাকে বঞ্চিত করিবার জন্য অনেক বিষয় সম্পত্তি তিনি বিক্রয় করিয়া ফেলেন; তথাপি পিতৃদেব স্বার্থের জন্য নিজের মত ও বিশ্বাস ত্যাগ করেন নাই; পিতার ক্রোধবজ্র মাথায় লইয়া এই সময় তিনি নানা সমাজসংস্কার কার্য্যে ব্রতী ছিলেন, এবং নিজ ব্যয় নির্বাহ্যার্থে পুলিসে কর্ম গ্রহণ করেন, কিন্তু তাঁহার ন্যায় লোকের পুলিসের সব কার্য্য অনুমোদন করিয়া সদ্ভাবে চলা অধিক দিন সম্ভব নহে তাহা বলাই বাহুল্য ।

এই সময় মাতামহ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কৃষ্ণনগরে যান ও এই সুদর্শন উৎসাহী সমাজসংস্কার যুবককে দেখিয়া প্রীত ও আকৃষ্ট হয়েন এবং কয়েক বৎসর পরে মাতৃদেবীর সহিত তাঁহার বিবাহ স্থির হয় । আশ্চর্য্যের বিষয় এই, পিতা বিবাহ করিতেছেন শুনিয়া ঠাকুরদাদা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েন এবং এই সময় হইতে আবার তাঁহার প্রতি প্রসন্ন হইয়া অন্তরের সহিত তাঁহাকে পুনর্গ্রহণ করেন । তিনি কলিকাতায় আসিয়া মূল্যবান অলঙ্কার দ্বারা বধূর মুখ-দর্শন করেন এবং তখন হইতে মধ্যে মধ্যে কলিকাতায় আমাদের বাটিতে আসিয়া বাস করিতেন ও আমাদের লইয়া আহারাদি করিতেন । সেকালের হিসাবে তাঁহার প্রকৃতিও উদার ছিলে । ব্রাহ্মণত্বের চিহ্ণ পর্য্যন্ত পরিত্যাগ করায় তাঁহার মনে আঘাত লাগিয়াছিল কিন্তু অনেকগুলি ছোটখাট কুসংস্কার তিনি নিজেই মানিতেন না ।
বিবাহকালে পিতৃদেব মাতামহ-পরিবারের ২টি রীতি গ্রহণ করেন নাই : ১ । ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষাগ্রহণ, ২ । ঘরজামাই থাকা । এই সময় তিনি ডেপুটি কলেক্টর ছিলেন । মাতৃদেবীর যখন বিবাহ হয়, তখন তাঁহার বয়স ১২ বৎসর মাত্র । মাতামহ কন্যার যে শিক্ষাপত্তন করেন স্বামীর যত্নে তাহা পরিস্ফুট হইয়া উঠে । পিতা তাঁহার কন্যাদ্বয়কেও পুত্রনির্বিশেষে শিক্ষা দিয়া আসিয়াছেন; ইহা সকলেই জানেন । মাতৃদেবী ও আমরা যে কোনও সৎকার্য্যের বা দেশ হিতকর কার্য্যের প্রয়াস পাইয়াছি তাহার তিনি প্রধান সহায় ও উদ্যোগী ছিলে । পূজনীয় মাতুল সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমাজ-সংস্কার-প্রযত্নে তিনিই সর্বপ্রধান সহায় ছিলেন । তাঁহার বন্ধু-বাৎসল্য যে কি গভীর ছিল তাহা প্রত্যক্ষ ফললাভদ্বারা অনেক বন্ধুই বিশেষভাবে অবগত আছেন । কৃষ্ণনগর কলেজে পড়িবার সময় তাঁহার একজন বন্ধু ছিলেন, তিনি এখন অতি বৃদ্ধ, তথাপি পিতার অসুস্থতার সংবাদ পাইয়া দেখিতে আসিবার সমস্ত ঠিক করিয়াছিলেন, আমাদের বিশেষ নিষেধে ক্ষান্ত হন । তাঁহার একজন সহপাঠী বন্ধুকে তিনি একবার কয়েক সহস্র টাকা ধার দেন । বন্ধু তাহার কিয়দংশ শোধ করিয়া একদিন বলিলেন "বাকি হাজার কতক আর আমি দিতে পারছিনে, আমায় মাপ করে দেও ।" পিতৃদেব হাস্যমুখে বন্ধুর এ আবদার মানিয়া লইলেন ।
বিবাহের পরেই পিতার বিলাত যাইবার প্রস্তাব হওয়ায় তিনি ডেপুটি কালেক্টরীর পদ ত্যাগ করেন । কিন্তু নানা অভাবিত কারণে সেই সময় বিলাত যাবার বাধা পড়ায় তিনি স্বাধীন জীবিকার জন্য ব্যবসা বাণিজ্য আরম্ভ করেন । সেই সূত্রে বেরিণী কোম্পানের হোমিওপ্যাথিক দোকান তিনি ক্রয় করেন । তাহা খুব লাভজনক ছিল । বিক্রয় করিবার অল্পদিন পরে - তাহার মালিক তাহা পুনর্লাভে ইচ্ছুক হইয়া বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শরণাপন্ন হন । বিদ্যাসাগর মহাশয় পিতৃদেবের একজন বিশেষ বন্ধু ছিলেন । বিদ্যাসাগরের অনুরোধে পিতা গভীর স্বার্থত্যাগ করিয়া দোকান ফিরাইয়া দিলেন ।
তাঁহার ত্যাগস্বীকার ও দয়া প্রভৃতি কিরূপ প্রবল ছিল, তাহার আর একটি উদাহরণ দিতেছি । লাটের নিলামে অল্প মূল্যে তিনি অনেকগুলি বিষয় খরিদ করেন; তাহা রাখিলে তিনি লক্ষাধিপতি হইতে পারিতেন । কিন্তু যখন পূর্ব মালিকগণ গললগ্নবাসে আসিয়া জমি ফিরাইয়া দিবার অনুরোধ করেন, তখন তাহার অধিকাংশই তিনি প্রত্যর্পন করিয়াছিলেন ।
রোগীর সেবা তাঁহার একটি প্রধান ব্রত ছিল । পরিবারের সকলেই এ বিষযে সাক্ষ্য দিতে পারিবেন । দেশে বিদেশে সর্বত্র তিনি মাতামহ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের যতদূর সেবা করিযাছেন, আর কেহই তাহা করিতে পারেন নাই । দাসদাসীর রোগেও তিনি সেবা করিতেন । পূর্বে জোড়াসাঁকোর নবাবী প্রথায় চাকর দাসীদের অসুখের সময় তাহাদের জন্য স্বতন্ত্র গৃহ ও বৈদ্যের ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু পিতা তাহাতে সন্তুষ্ট থাকিতে পারিতেন না; অসুখের সময় নিজে পুনঃ পুনঃ তাহাদের খোঁজ খবর লইতেন; আবশ্যক হইলে নিজেও সেবা করিতেন । সময সময় তাঁহাকে এজন্য উপহাসাস্পদ হইতে হইত । গরীব দুঃখীর সেবার জন্য তিনি ঘরে বসিযা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শিক্ষা করিযা বিনা পয়সায় ডাক্তারী করিতেন । কাশিয়াবাগান বাগান-বাড়িতে আমরা যখন ছিলাম - তখন দেখিয়াছি, রোজ সকালে পাড়ার আর্ত্ত লোকে বাড়ি ভরিয়া যাইত । ভোর হইতে রোগী দেখিয়া ওষুধ বিতরণ করিতে করিতে বেলা দশটা এগারোটা বাজিয়া যাইত । তাহার পর তিনি স্নান আহার করিতেন ।

কাহারও বিপদ বা কষ্ট দেখিলে তিনি প্রাণপণ সাহায্য না করিয়া থাকিতে পারিতেন না । মাতামহমহাশয় এক সময়ে তাঁহার ভ্রাতৃজায়া প্রভৃতির সহিত বৈষয়িক মকদ্দমায় জড়িত হয়েন । তখন পিতা আইনের সূক্ষ্ম জাল ভেদ করিয়া যে নীতি বাহির করেন তাহার দ্বারাই তাঁহার বিষয় রক্ষার বিশেষ সহায়তা হয় । সেই সময় আইনে তাঁহার বিশেষরূপে প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দেখিয়া তাঁহার বন্ধুগণ তাঁহাকে বিলাত যাইয়া ব্যারিষ্টার হইবার পরামর্শ দেন এবং তিনি আমাদের মাতুলালয়ে রাখিয়া বিলাত যাত্রা করেন । সেখানে অধিকাংশ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হযেন কিন্তু শেষ পরীক্ষার পূর্বেই ছয় বৎসর বয়স্কা কনিষ্ঠা কন্যার মৃত্যু সংবাদে তাঁহাকে দেশে ফিরিতে হয় । ইচ্ছা ছিল আবার যাইয়া শেষ পরীক্ষা দিবেন এবং তজ্জন্য বরাবর ফি দিয়া নাম বজায় রাখিয়াছিলেন, কিন্তু ঘটনাচক্রে আর যাওযা হয় নাই ।
তিনি পরের কষ্টে এতদূর ব্যস্ত থাকিতেন যে নিজের বৈষয়িক কার্য্য অসম্পূর্ন হইয়া থাকিত । সান্ত্বনা-পত্রে সকলেই তাঁহার মধুর নম্রতা ও বিনয়ের উল্লেখ করিয়াছেন । যখন তিনি মৃত্যুশয্যায়, তখনও তিনি সমাগত বন্ধুবান্ধবকে যথারীতি অভিবাদন করিয়াছেন, নিজে যাইয়া গাড়িতে পৌঁছাইতে না পারায় দুঃখ জানাইয়াছেন ।

কলিকাতার প্রায় সব সাধারণ হিতকর কার্য্যেই তাঁহার যোগ ছিল । অনেক বৎসর তিনি মিউনিসিপ্যাল কমিশনার ছিলেন । ম্যেকেঞ্জি বিলের প্রতিবাদে যে ২৮ জন কমিশনার পদত্যাগ করেন, তন্মধ্যে তিনি একজন । শিয়ালদহ ও লালবাজার দুই কোর্টেই তিনি অনারারী ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন । বৎসরাবধি তাঁহার শরীর অসুস্থ ছিল, মধ্যে মধ্যে এক একবার শয্যাগত থাকিতেন, কিন্তু একটু সুস্থ বোধ করিলেই কোর্টে ও অন্যান্য কার্য্যে যাইতেন । আমাদের নিষেধ মানিতেন না । এরূপ কর্তব্যনিষ্ঠা বিরল ।
ইঁহার সঙ্কলিত Celebrated Trials in India নামক পুস্তক সাধারনের একটি বিশেষ অভাব দূর করিয়াছে ।
পাবলিক কার্য্যের মধ্যে তাঁহার সব চেয়ে প্রিয় কার্য্য ছিল - ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস । হিউমের উদ্বোধনে এটি জানকীনাথের স্বহস্তে রোপা, স্বহস্তে জল সেচন করা ও স্বহস্তে বাড়ান জাতীয় মহীরুহ । কংগ্রেসের জীবন আজ ২৮ বৎসর; আজ অনেকেই ইঁহার বন্ধু সহায় ও মুরুব্বি, কিন্তু যতদিন এ নাবালক ছিল, ততদিন জানকীনাথই এর প্রধান অভিভাবক ছিলেন ।
যে সময় অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন মাদাম ব্লাভাট্স্কি ভারতবর্ষে আসিয়া থিয়সফি প্রচার করেন সে সময় জানকীনাথ থিয়সফিষ্ট সম্প্রদায়ভিুক্ত হন । সেকালে বৎসরান্তে মাদ্রাজে একটি থিয়সফিক্যাল কন্ফারেন্স হইত; ভারতবর্ষের সকল অংশ হইতে থিয়সফিষ্টগণ সেখানে আসিয়া সম্মিলিত হইতেন । এইরূপ সম্মিলনী হইতেই হিউম সাহেবের মনে একটি ভাবের স্ফুরণ হইল যে, সমগ্র ভারতবাসের এইরূপ একটি পলিটিক্যাল সম্মিলনী গড়িয়া তুলিতে পারিলে ভারতবাসীর অশেষ মঙ্গল হইবে । এই ভাব হইতেই কংগ্রেসের উৎপত্তি এবং সেই ভাবটিকে কাজে পরিণত করার মূলে ছিলেন জানকীনাথ ঘোষাল । তিনি তখন কিছুকালের জন্য এলাহাবাদে থাকিয়া "Indian Union" নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রের সম্পাদনা ভার গ্রহন করেন । কংগ্রেসের আরম্ভ হইতে তিনি যে কিরূপ ভাবে ইহার জন্য কার্য্য করিয়াছেন, ধন প্রাণ মান দিয়া সকলের তিরস্কার সহ্য করিয়া অম্লান চিত্তে কার্য্য করিয়া গিয়াছেন তাহা সর্বজনবিদিত । মৃত্যুশয্যায় যখন তাঁহার মস্তিষ্কবিকৃতি আরম্ভ হয়, তখন কংগ্রেসে যাইবার উদ্যোগ কতদূর অগ্রসর হইল ক্রমাগত তাহার খোঁজ লইতেন । কংগ্রেস সঙ্গী-ভৃত্য গোপালকে পুনঃ পুনঃ শীঘ্র প্যাক্ করিতে আদেশ করিতেন । জষ্টিস আশুতোষ চৌধুরী মহাশয় আসিলে তাগিদ দিতেন ।
পূজনীয় শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় তাঁহার সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, তন্মধ্যে দুই একটি কথা উদ্ধার করিয়া এখন শেষ করিব । "দুঃখীর দুঃখ নিবারণ, বিপন্নের বিপদ উদ্ধার, স্বদেশে শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তার প্রভৃতি যে দিকে যে কোন কার্য্যে তাঁহার সহায়তার প্রয়োজন হইত, সর্বদাই তিনি তাহাতে আপনার শক্তি ও সামর্থ্য নিয়োগ করিতেন । কোন ভাল কাজের প্রস্তাব লইযা তাঁহার কাছে আসিলে কাহাকেও কখনও নিরাশ হইতে হয় নাই । সেই সকল প্রসঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলিয়া যাইত, তাঁহার যেন আহার নিদ্রা মনে থাকিত না, কতই যুক্তি আঁটিতেছেন, কতই উপায় উদ্ভাবন করিতেছেন, কতই সাহায্যের পথ আবিষ্কার করিতেছেন । সে সময়ে তাঁহার কাছে বসিয়া থাকাও একটি আনন্দ ।"
আজ ভ্রাতা শ্রীমান জ্যোৎস্নানাথ সুদূর প্রবাসে । তাঁহার অনুপস্থিতিবশতঃ যে পুণ্য কর্ত্তব্য সম্পাদনের ভার আমাদের উপর পড়িয়াছে তাহার ত্রুটি ভক্তির দ্বারা পূর্ণ হইবে এই আশা । এই কর্ত্তব্য-সম্পাদনে যাঁহারা আমাদের সাহায্য করিয়াছেন আর যাঁদের স্নেহ ও সহানুভূতি মাতৃদেবীর শোকার্ত হৃদয়ে সান্ত্বনাবারি বর্ষণ করিয়াছে তাঁহারা আমাদের অন্তরের কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ গ্রহণ করুন ।

হিরণ্ময়ী দেবী


( 'ভারতী' ১৩২০ বঙ্গাব্দ জৈষ্ঠ্য সংখ্যা )

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।