পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
স্ট্যাটিস্টিক্স-রহস্য
জগদানন্দ রায়
[ লেখক
পরিচিতি : জগদানন্দ নদীয়ার কৃষ্ণনগরে ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ই
সেপ্টেম্বর জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন| পিতা অভয়ানন্দ রায়
এবং মাতা বসন্তসুন্দরী| ১৮৮৮-তে স্থানীয় বিদ্যালয় থেকেই প্রবেশিকা
এবং ১৮৯০-এ কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে এফ.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন|
বি.এ. পরীক্ষায় তার ফল সম্বন্ধে নির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায়
নি| জগদানন্দ গড়াই-এর মিশনারি স্কুলে এবং পরে কৃষ্ণনগর সেন্ট
জর্জ হাইস্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন| প্রথম থেকেই তিনি বিভিন্ন
পত্র পত্রিকায় বিজ্ঞান বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতেন| 'সাধনা' পত্রিকায়
প্রকাশিত এরকম একটি প্রবন্ধের সূত্র ধরেই পত্রিকা সম্পাদক
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে| কবির অনুরোধে তিনি প্রথম
কবির শিলাইদহের জমিদারিতে সেরেস্তার কাজ করেন এবং পরে কবির
পুত্রকন্যাদের গণিত ও বিজ্ঞান শেখানোর জন্য গৃহশিক্ষক নিযুক্ত
হন| কবির আহ্বানে ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দে তিনি শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠিত
ব্রহ্মচর্য-বিদ্যালয়ে (ব্রহ্মচর্যাশ্রম) শিক্ষক হিসাবে যোগদান
করেন| শিক্ষক হিসাবে তিনি অসামান্য খ্যাতির অধিকারী ছিলেন|
বিশ্বভারতীর গ্রন্থন বিভাগেও তিনি কাজ করেছেন| তিনি ছিলেন
শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ের প্রথম সর্বাধ্যক্ষ|
১৯২৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি 'রায় সাহেব' উপাধি লাভ করেন|
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সাধারণ
মানুষের বিজ্ঞান চেতনা গড়ে তোলার জন্য সরল বাংলায় বিজ্ঞান
বিষয়ক রচনা প্রকাশ করতে থাকেন| ১৩৩০ বঙ্গাব্দে নৈহাটিতে অনুষ্ঠিত
বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে তিনি ছিলেন বিজ্ঞান শাখার সভাপতি|
তার রচিত কিছু গ্রন্থের তালিকা দেওয়া হল :
'প্রকৃতি পরিচয়' (ঢাকা, ১৩১৮); 'আচার্য জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার'
(ঢাকা, ১৩১৯); 'বৈজ্ঞানিকী' (এলাহাবাদ, ১৩২০); 'প্রাকৃতিকী'(১৩২১); 'জ্ঞানসোপান' (১৩২১) ; 'গ্রহনক্ষত্র' (১৩২২)
; 'বিচিত্র সন্দর্ভ' (১৩২৪); 'সাহিত্য সন্দর্ভ' (১৩২৪
) ; 'সুকুমার পাঠ' (১৩২৫ ); 'কনক পাঠ' (১৩২৫); 'চয়ন' (১৩২৬); 'পোকামাকড়' (১৩২৬); 'বিজ্ঞানের গল্প' (১৩২৭); 'গাছপালা'(১৩২৮); 'সাহিত্য সোপান' (১৩২৯); 'আদর্শ স্বাস্থ্যপাঠ'(১৩৩০); 'আদর্শ কাহিনী' (১৩৩০); 'মাছ-বেঙ-সাপ' (১৩৩০); 'বাংলার পাখী' (১৩৩১); 'শব্দ' (১৩৩১); 'পাখী'(১৩৩১); 'বিজ্ঞান-প্রবেশ' (১৩৩২); 'বিজ্ঞান-পরিচয়' (১৩৩২
) ; 'আলো' (১৩৩৩); 'গদ্য ও পদ্য'(১৩৩৩); 'সাহিত্য সৌরভ'( ১৩৩৩); 'সঞ্চয়ন' (১৩৩৩); 'বিজ্ঞান-প্রকাশ' (১৩৩৩); 'স্থির বিদ্যুৎ' (১৩৩৫); 'চুম্বক' (১৩৩৫); 'তাপ' (এলাহাবাদ, ১৩৩৫); 'চল বিদ্যুৎ' (১৩৩৬); 'পর্যবেক্ষণ শিক্ষা'(১৩৩৮); 'নক্ষত্র চেনা' (১৯৩১) ইত্যাদি| বিধুশেখর শাস্ত্রীর
সঙ্গে তিনি 'শান্তিনিকেতন পত্রিকা'ও সম্পাদনা করেছেন (১৩২৬-২৭)| ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত 'বার্ষিক শিশুসাথী' পত্রিকারও
সম্পাদক ছিলেন তিনি|
১৯৩৩ খ্রীষ্টাব্দের ২৫শে জুন শান্তিনিকেতনে জগদানন্দর দেহাবসান
হয়| ]
দীপক সেনগুপ্ত |
সোমবার|
বিলাসপুরের থানার চৌকীদারেরা হাজিরা দিতে আসিয়াছে| পুলিস-বাঙ্গলোর
সম্মুখে দুই দুই খানি ইষ্টকরচিত ক্ষুদ্র বেদী সমান্তরাল শ্রেণীতে
বিভক্ত, এবং সংখ্যায় প্রায় দেড় শত| ইহাই তাহাদের বসিবার স্থান|
পুলিসের ভাষায় ইহার নামান্তর 'বিট'| জনত্রিশেক নীল-কুর্ত্তা-পরিহিত
এবং সেই রংয়ের পাগড়ীধারী চৌকীদার নিজ নিজ নির্দ্দিষ্ট স্থান
অধিকার করিয়া বসিয়া আছে এবং জমাদারসাহেবের আগমন প্রতীক্ষায় অস্ফুটস্বরে
নিজেদের ভিতর কলহ-কচ্কচি সুরু করিয়া দিয়াছে| তাহাতে লোষ্ট্রাহত
মধুক্রমবৎ, হাটে সমাগত জনকল্লোলের দূরশ্রুত অস্পষ্টধ্বনিবৎ,
একটা অব্যক্ত কণ্ঠমর্ম্মর স্থানটাকে মুখরিত করিয়া তুলিয়াছে|
প্রত্যেক চৌকীদারের হাতের কাছে হয় ঘৃত বা দুগ্ধভাণ্ড, পাবাঁধা
দুটো একটা "মনুনিষিদ্ধ পক্ষী" অথবা তাহারই কয়টা অন্ডমাত্র
সাজান - নহিলে হাজিরা জমে না| জন কয়েক চৌকিদার থানার সংলগ্ন
দারোগা-সাহেবের ফুল ও তরকারির বাগান কোদালি-সহযোগে খনন করিতেছে,
তাহাদের গায়ের কূর্ত্তা ও মাথার পাগড়ী সম্মুখবর্ত্তী অশ্বথগাছের
শাখাপ্রশাখায় লম্বমান হইয়া "উর্দ্দি"বিরহিত চৌকিদার-জীবন
প্রত্যক্ষ করিতেছে| অদূরে নদীর ধারে জন কতক চৌকীদার উর্দ্দি
ও কূর্ত্তি পরিহিত হইয়াই খূরপী হাতে জমাদার-সাহেবের ঘোড়ার ঘাস
ছুলিতে বসিয়া গিয়াছে| আজ তাহারা বড় আনন্দে আছে, দুই প্রহরের
পরই বাড়ী ফিরিতে পারিবে| কেন না, স্বয়ং দারোগা-সাহেব তাঁহার
অশ্বযুগল লইয়া তিনদিন হইল দেহাৎ রওনা হইয়াছেন| তিনি সহরে থাকিলে
বেচারীদের সন্ধ্যার পূর্ব্বে থানাত্যাগের হুকুম নাই|
সাধারণত জমাদারজী বেলা ৮টার পূর্ব্বে শয্যাত্যাগ করেন না, "অপ্সরের"
অনুপস্থিতিতে আজ তাঁহার আয়েসের মাত্রা আরো ঘণ্টাখানেক বর্দ্ধিত
হইয়াছিল| অতএব দক্ষিণ কর্ণের শিরোভাগে গুটিকতক খড়িকা রক্ষা করিয়া
বামহস্তধৃত আলবোলার নলটি তাম্বুলরাগরক্ত ওষ্ঠাধরে স্পর্শ করিতে
করিতে দোদুল্যমান-উদর জমাদার কিষণসহায় যখন থানার আফিস বারান্দায়
"তসরিফ্" লইয়া আসিলেন, বেলা তখন দশটা বাজিয়া গিয়াছে|
বৈশাখী সায়াহ্নের বাত্যাবর্ষাগর্ভ অকালজলদের
সঙ্গে কিষণসহায়ের স্নেহ-চিক্কণ মূর্তিখানির যাঁহারা তুলনা করিতে
চান, তাঁদের সাদৃশ্যজ্ঞান নাই, এমত বলিলে লেখক ধর্ম্মে পতিত
হইবেন| সাদৃশ্য যথেষ্ট এবং তাহার প্রমাণস্বরূপ ইহা বলিতে পারি
যে, দূর হইতে তাঁহার সে মূর্ত্তি দেখিয়া চৌকীদারের দল ইতিপূর্ব্বেই
"চমকি সম্ভ্রমে উঠি যেন" দাঁড়াইয়াছিল| জমাদারসাহেব
বারান্দায় সমাগত হইবামাত্র তাহারা একযোগে সিপাহী-ধরণে তাঁহাকে
অভিবাদন করিল| সেখানে ঢালা-বিছানা ও চেয়ার-টেবিল, দুই রকম আসনেরই
ব্যবস্থা ছিল| কিষণসহায় আরামটাই বুঝেন ভাল, অতএব অর্দ্ধনিমীলিত
নেত্রে তাকিয়া ঠেসান দিয়া বসিলেন| তখন তাঁহার সমক্ষে "ভেট
সওগাদ" উপস্থিত কারার জন্য চৌকীদার মহলে হুড়াহুড়ি পড়িয়া
গেল| কোন্ ভূম্যধিকারীর প্রতাপ ইহার সঙ্গে তুলনীয়? সরকারী খাজানা
না দিয়াও যে দারোগা এবং জমাদার কনষ্টেবলের দল এদেশে এতটা আধিপত্যসুখ
সম্ভোগ করে, ইহাতেই হয় ত জমীদারের দল ঈর্ষান্বিত; এবং সরকার
বাহাদুরের বামহস্তস্বরূপ পুলিসবিভাগের এতটা নিন্দাবাদ যে শুনা
যায়, তাহার প্রধান কারণ সম্ভবত ইহাই| যাহা হউক, জমাদারসাহেব
সেই উপহারের রাশি নিতান্ত অপ্রসন্নদৃষ্টিতে দেখিতেছিলেন না|
পক্ষিজাতীয় উপহারের দিকে কটাক্ষ করিয়া তিনি দারোগা মসুবআলীর
বাসার দিকে তর্জ্জনী নির্দ্দেশ করিলেন| গব্যরসের বেলায় অঙ্গুলিটি
স্বতই সেদিন - মহাহিন্দু তিনি - তাঁহার বাসগৃহের দিকে হেলিল|
মুহূর্ত্তে সে সওগাদস্তূপ দুই দিকে চলিয়া গেল, অথচ কিষণসাহায়কে
একটি বাক্য ব্যয় করিতে হইল না| বাক্যবলের চেয়ে বাহুবলটাই যে
শাসনপ্রণালীর পক্ষে অধিকতর উপযোগী, এই দৃষ্টান্তে তাহা প্রমাণ
হয় কি না?
থানায় থানায় প্রতি সোম মঙ্গলবারে চৌকীদারদের
যে হাজিরি হয়, তাহার বিবরণ হরেদরে একই-রকম| দারোগা বা জমাদার
সাহেব রেজেষ্টারি উল্টাইয়া "বিটে"র ক্রমানুসারে হাঁকিয়া
যাইতেছেন, অমনি ১০|১৫|২০ জন চৌকীদার খাড়া হইয়া উঠিয়া জন্ম, মৃত্যু,
চুরী-চামারি প্রভৃতির ছাপা প্রশ্ন পাঠশালার ছেলেদের মত মুখস্থ
উত্তরে পূর্ণ কতিতেছে, কেহ সে অবস্থায় গালি খাইতেছে, কাহাকেও
হুকুমমত আপনার কান আপনি মলিতে হইতেছে, এ দৃশ্য হিমালয় হইতে কুমারিকা
পর্য্যন্ত বোধ করি সর্ব্বত্র সুপরিচিত| কিলটা ঘুষোটা চাপড়টা
কখন বেত্রাঘাত-ইহারও অপ্রতুল নাই| জেলার বা মহকুমার হাকিম জরিমানার
কার্য্যকারিতা সম্বন্ধে আস্থাবান্, পুলিস কর্ম্মচারীদের এরূপ
ধারণা হইয়া গেলে তাহার "কোসিসে"রও অভাব হয় না| ইহার
ফলে তিনটাকার চৌকীদার তিনমাস পরে কখন কখন নগদ দেড় টাকা গৃহজাত
করিয়া থাকে, তথাপি উর্দ্দি ও কুর্ত্তির মায়া ত্যাগ করিতে পারে
না| চৌকীদারপত্নী তাহাতে খুঁৎখুঁৎ করিলে ভর্ত্তার কাছে শুনিতে
পায়- "বলিস্ কি ক্ষেপি, পুলিসের অমন ইজ্জতের চাকরী এক কথায়
ছেড়ে দেব? সময়ে অসময়ে অমন কত দেড়টাকা হাতে আস্বে!" উর্দ্দূ
ও হিন্দী প্রচলিত জেলার পাঠকমহাশয় উক্তিটুকুকে মনে মনে অনুবাদ
করিয়া লইলেই দেখিতে পাইবেন, মনুষ্যচরিত্র সর্ব্বত্র একরূপ!
তা বক্ষ্যমাণ সোমবারে বিলাসপুর থানার কথা
হইতেছিল| সরকারী কাজ গরীব চৌকীদারদের হাসি-অশ্রুতে মিশামিশি
হইয়া ঘন্টাখানেক চলিয়াছে, কর্ণশীর্ষে রক্ষিত জমাদারসাহেবের সেই
খড়িকাগুলি তাঁহার দন্তক্লেদ দূর করিতে অনেকবার ব্যবহৃত হইয়াছে,
বাটার পান প্রায় নিঃশোষিত হইয়াছে, এমন সময়ে ডাকে মহুকুমার হাকিম
'জইন্ট'সাহেবের এক পরোয়ানা আসিয়া উপস্থিত| হুকুম, তাঁহার এলাকার
ভিতর কত গর্দ্দভ, ঘোড়া এবং টাট্টু আছে, এবং সর্ব্বোচ্চ ও সর্ব্বনিম্ন
ঘোড়ার মাপ কি - তিন দিনের ভিতর রিপোর্ট করিতে হইবে| জমাদারসাহেব
হুকুমটা পড়িয়া মনে মনে খানিকটা গজ্গজ্ করিলেন| তার পর জইন্টসাহেব
ও দারোগার উদ্দেশে একচোট বিনাম অভিধানবহির্ভূত বিশেষণ প্রয়োগপূর্ব্বক
একছিলিম তামাকু চড়াইতে পার্শ্ববর্ত্তী চৌকীদারকে আদেশ করিয়া
কনষ্টেবল মেঘুসিংকে তলব করিলেন| মেঘু অনেককাল পুলিসে চাকরী করিয়া
বিস্তর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়াছিল, থানার অপ্সরেরা তার মুঠার মধ্যে
বলিলেই হয়| বাস্তবিক ও তাহাদের কোনরূপ 'মুস্কিল' উপস্থিত হইলে
মেঘুসিং সিপাহীজী ভিন্ন 'আসান' কেহ করিতে পারিত না| সিপাহী এইমাত্র
স্নান করিয়া আসিয়া খড়মপায়ে তাহার সুপক্ক শিখাটি ঝাড়িতেছিল, সেই
অবস্থায় হাজিরিক্ষেত্রে দেখা দিল| জমাদার সংক্ষেপে কতক বা হুকুম
পড়িয়া, কতক ইঙ্গিতে, জইণ্টসাহেবের পরোয়ানার অর্থ তাহাকে জানাইতে
না জানাইতে সে ঈষৎ হাসিয়া তাঁহার কানে কানে কি বলিল| অতএব সেদিন
চৌকীদারেরা ছাপার ফারমে লিখিত একুশটি প্রশ্নের উত্তর দিয়া সভয়ে
দেখিল, আর একটা উৎকট রকমের সওয়াল তাহাদের জবাবের প্রতীক্ষা করিতেছে|
গ্রামে মোট কয়টা ঘোড়া এবং গাধা আছে, এ খবর
একরকম করিয়া বলা যায়, কিন্তু কোন্ ঘোড়াটা কত উঁচু, সহসা বলিয়া
সরকারের দুয়ারে কে ফাঁদে পড়িবে? চৌকীদারেরা একবাক্যে আপত্তি
করিয়া বসিল, একহপ্তা সময় না পাইলে তাহারা সে কথার জবাব দিতে
অক্ষম|
জমাদারকিষণসহায়ের মতে এ বেয়াদবির মাফ্ নাই|
শিকারী বিড়াল অতর্কিতভাবে যেমন মুষিকের উপর লাফাইয়া পড়ে, সেই
ভাবে সহসা তিনি চৌকীদারমহলে পড়িলেন এবং পার্শ্বস্থিত বেত্রখণ্ড
জনকয়েক চৌকীদারের পিঠে ও হাতে এরূপ জোরে জোরে বর্ষণ করিলেন যে,
তাহাতে তাঁহার নিজের কোমল হাতখানিতে পর্য্যন্ত বেদনার সঞ্চার
হইল-এবং তিনি ও তাঁহার অগ্রগামী দোদুল্যমান উদর যুগপৎ হাঁফাইতে
হাঁফাইতে যে ভাবে সেই সুদীর্ঘ বারান্দা পরিক্রমণ করিতেছিলেন,
চিত্রকর কেহ উপস্থিত থাকিলে তাহার সৌন্দর্য্যমর্ম্ম বুঝিত!
যাহার চোটে ভূত ভাগে এবং সাপের বিষ উড়িয়া
যায়, তাহাতে যে গরিব চৌকীদারদের দ্বিধাশূন্য করিয়া দিবে, ইহা
আর বেশী কথা কি? বাস্তবিক মেঘুসিংয়ের সুপরামর্শে কিষণজী সেইদিনই
বেলা ১২টার ভিতর বিলাসপুর-থানাভুক্ত ৫৪৯ গ্রামের মধ্যে বার-আনা
মৌজার অশ্ব এবং অশ্বতরের সংবাদ সংগ্রহ করিতে সক্ষম হইলেন| যে
চারি-আনা খবর বাকী ছিল, পরদিন মঙ্গলবার প্রাতে ৮টা বাজিতে না
বাজিতে তাহারও কিনারা হইয়া গেল| কেন না, সোমবার মধ্যাহ্নে থানাপ্রাঙ্গণে
যে ঝড় বহিয়াছিল, সন্ধ্যা হইতে না হইতে ভুক্তভোগী সহযোগীদের মুখে
মুখে প্রবাহিত হইয়া তাহা গ্রাম্য-চৌকীদার-গৃহমাত্রকেই সবেগে
আন্দোলিত করিয়াছিল| কাজেই নয়টার আমলে শয্যাত্যাগ করিয়া কিষণসহায়
বাহিরে আসিলে, মেঘুসিং যখন সগর্ব্বে পক্ককেশ মাথাটি নাড়িয়া ঈষৎ
হাসিতে হাসিতে তাঁহাকে বলিল যে, তিনদিন কোন্ ছার, চারিপ্রহরের
ভিতরই এমন পরোয়ানার কিনারা হইতে পারে, তখন তিনি সকৃতজ্ঞহৃদয়ে
কথাটা মানিয়া লইলেন|
মেঘুসিং লিখিতে পড়িতে জানে না, কিন্তু কিষণসহায়
হিন্দী ও ফরাসীতে 'লায়েক' ব্যক্তি, সহজেই একটা সলার অঙ্কুর মঙ্গলবার
প্রাতে আসন গ্রহণ করিতে না করিতে তাঁহার মাথায় গজাইয়া উঠিল|
জইণ্টসাহেব রিপোর্ট চাহিয়াছেন তিন দিনে, কিষণসহায় যদি আজ্ই সন্ধ্যার
ডাকে তাহা পাঠাইয়া আপন 'খয়েরখাঁই' জাহির করিতে পারে, তবে তাহার
'তরক্কির' পথ প্রশস্ত হয় কি না? বিশেষত তাহার স্বসম্পর্কীয় বলদেও-সহায়
জইণ্টসাহেবের এজলাসে কোর্টবাবু; রিপোর্ট পড়িয়া দুটো তারিফ যে
তিনি করিবেনই, ইহা ত জানা কথা| জমাদারসাহেব এমন সুযোগ উপেক্ষা
করিবার পাত্র নহেন, সন্ধ্যার ডাকে রিপোর্ট চলিয়া গেল| সেই সঙ্গে
কোর্ট সব্ ইনস্পেক্টার 'চাচাসাহেব'কে একখানি চিঠিও তিনি লিখিতে
ভুলিলেন না|
জইণ্টসাহেব বুধবার প্রাতে বাঙালী হেড্ক্লার্ক
বাবুর আনীত ডাক দেখিতেছেন ও তাঁহার বাঙ্লা পরীক্ষা দিবার সুবিধা
হইবে বলিয়া সেই ভাষায় মঝে মাঝে কথাবার্ত্তা চলিতেছে, এমন সময়
কোর্টবাবু সেখানে হাজির হইয়া ঝুঁকিয়া সেলাম করিলেন| এটা ওটা
পেসের পর কিষণসহায়ের রিপোর্ট তিনি একটি সংক্ষিপ্ত ভূমিকা সহ
সাহেববাহাদুরের নেত্রপথে এরূপ ভাবে ধরিলেন, যাহাতে বিস্ময়াবিষ্ট
'অপ্সর' স্বতই খুসী হইয়া তদীয় ভ্রাতুষ্পুত্রের 'তরক্কি'র জন্য
'কোসিস্' করিতে পারেন| জইণ্টসাহেব সম্প্রতি কায়েতি হিন্দীতে
পাস্ করিয়াছেন, রিপোর্টটা নিজেই পড়িয়া উচ্চহাস্য সংবরণ করিলেন|
কোর্টবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, রিপোর্ট ঠিক কি না এবং "বহুৎ
ঠিক হ্যায়-"উত্তর পাইয়া গর্দ্দভ, ঘোড়া ও টাট্টুর তালিকা
তাহাকে পড়িতে বলিলেন| কোর্টবাবু স্মিতমুখে পড়িলেন, "গাধা
৪২, ঘোড়া ১২০, টাট্টু ৯২|" হেড্ক্লার্কের দিকে ফিরিয়া সাহেব
গম্ভীরমুখে বাঙ্লায় বলিলেন, "গাধার নম্বর ঠিক না আছে!"
বুঝিয়া কোর্টসাহেব মৃদু প্রতিবাদের জন্য বলিতেছিলেন, "জনাব
আলি!"-জইণ্ট মাজিষ্ট্রেট উচ্চ হাসিয়া বলিলেন- "আর
ডুই নম্বর উহাটে যোগ করিয়া ডাও, যে লিষ্ট বানাইয়াছে ও যে টাহাটে
পিত্যয় করে!" হেড্ক্লার্ক বাবু ওষ্ঠে মৃদুহাস্য চাপিয়া
মুখ অবনত করিলেন| কোর্টবাবু একটু একটু বাঙ্লা বুঝিতেন, তিনিও
মাথা চুলকাইয়া দৃষ্টি নত করিলেন|
[
'বঙ্গদর্শন' (নবপর্যায়) , ১৩০৮ বঙ্গাব্দ পৌষ সংখ্যা ]
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)