আচার্য্য প্রবর-নিউটন-প্রচারিত
মহাকর্ষণ-সিদ্ধান্তটি বিদ্যালয়ের পণ্ডিতমহাশয়ের নির্ম্মম বেত্রভীতিতে
আমরা অতি শৈশবেই গলাধঃকরণ করিয়া রাখিয়াছি। তার পর গতিবিজ্ঞান,
পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতিঃশাস্ত্র সম্বন্ধীয় বিবিধগ্রন্থে তাহার
সহিত বিশেষ পরিচিত হইয়াছি এবং বিশাল নক্ষত্র-জগতের ধাবন হইতে
আরম্ভ করিয়া অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার ও চালচলন এই মহাকর্ষণ তত্ত্বের
সাহায্যে বুঝা ও বুঝান হইয়া থাকে, তাহা আমরা দেখিতেছি। কিন্তু
জড়পদার্থে সেই মহাকর্ষণশক্তি আসিল কোথা হইতে, তাহা আমরা দেখিতে
পাইতেছি না। ইষ্টক আকাশে নিক্ষেপ করিলে, তাহা শেষকালে পড়ে
কোথায়, তাহা মূর্খ এবং পণ্ডিত উভয়েই বলিতে পারে। মূর্খ ও বলিবে,
পৃথিবীর টানে সেটা মাটিতেই পড়িবে। পণ্ডিত ও অতি গম্ভীরভাবে
সেই কথাটাই বড় করিয়া বলেন। তার পর জিজ্ঞাসা কর,-পৃথিবীর এই
টান আসিল কোথা হইতে? তখন পণ্ডিতও যেমন, মূর্খও তেমন,-উভয়েই
নিরুত্তর।
মহাকর্ষণের ন্যায় একটা
বৃহৎ ব্যাপারের উৎপত্তির কারণ জানিবার জন্য বিজ্ঞানগ্রন্থ
খুঁজিলে, তাহাতে কেবলমাত্র দুইটি অনুমানমূলক কারণের উল্লেখ
দেখিয়া আমাদিগকে সন্তুষ্ট থাকিতে হয়। এই দুইটির মধ্যে একটি
অধ্যাপক হেলম্হোজ্ ও লর্ভ কেল্ভিন্ প্রবর্ত্তিত সেই আবর্ত্তসিদ্ধান্তের
(Vortex theory of matter) সাহায্যে আবিষ্কৃত এবং অপরটি প্রসিদ্ধ
বৈজ্ঞানিক লেসাজের (Le Sage) কতকগুলি আজগুবি যুক্তি দ্বারা
গঠিত।
অধ্যাপক লেসাজের কল্পিত
সিদ্ধান্তটির স্থূল মর্ম্ম এই যে,-অনন্ত বিশ্বটার সর্ব্বাংশে
অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণু নিয়তই এক একটি নির্দ্দিষ্ট সরল
পথে পরিভ্রমণ করিতেছে। ইহাদের গতির দিকের স্থিরতা নাই,-সকল
দিকে ইহারা প্রচণ্ডগতিতে অগ্রসর হইতেছে এবং জড়পদার্থমাত্রেই
এই বেগবান্ অণুসাগরে নিমজ্জিত থাকিয়া নিয়তই সেই সকল অণুদ্বারা
আহত হইতেছে। লেসাজ বলেন, ঐ সকল আঘাতদ্বারা জড়পদার্থে যে বেগের
উৎপত্তি হয়, তাহাকেই আমরা আকর্ষণবেগ বলি। সমগ্র জগতে যদি একটিমাত্র
জড়পিণ্ডের অস্তিত্ব থাকিত, তবে আমরা তাহাতে মহাকর্ষণের কোনই
বিকাশ দেখিতে পাইতাম না, কারণ পূর্ব্বোক্ত অণুপ্রবাহের ঘা
লাগিয়া তাহাতে যে গতি উৎপন্ন হইত, তাহার ঠিক বিপরীত পার্শ্বেও
অণুসংঘাতে ঠিক বিপরীত গতির উৎপত্তি হইত, কাজেই দুই সমান ও
বিপরীত গতিদ্বারা পদার্থে কোন বেগই উৎপন্ন হইতে পারিত না।
কিন্তু একাধিক দ্রব্যের অস্তিত্ব কল্পনা করিলে, অন্যরূপ দেখা
যায়। দুইটি দীপশিখার মাঝখানে সেই দীপদ্বয়ের সমসূত্রে যদি গোলা
রাখা যায়, তাহা হইলে কি হয়? গোলার যে ভাগটা দীপের দিকে, সে
ভাগটা আলোকিত ও অন্য ভাগটা অন্ধকারময় হয়; কেবল তাহাই নয়, পাশের
গোলারও গায়ে পরস্পরে ছায়া ফেলে। এই আলোককে যদি অণুস্রোত মনে
করা যায়, তবে দেখা যাইবে, দুই দিক্ হইতে বিপরীতগামী অণুস্রোত
আসিলে দুই গোলার দুই পিঠে ঘা লাগিবে, অন্য পিঠে লাগিবে না;
আলোককে প্রতিরোধ করিয়া তাহারা পরস্পরের যে পিঠে ছায়া ফেলিত,
সেই পিঠে ধাক্কাকেও আসিতে দিবে না-সুতরাং তাহারা উভয়েই এক
পিঠে ধাক্কা খাইয়া চলিতে থাকিবে-অবশেষে পরস্পরের গায়ে আসিয়া
পড়িবে। সুতরাং লেসাজের মতে, পদার্থে মহাকর্ষণশক্তির একটা পৃথক্
অস্তিত্ব নাই,-আছে কেবল সেই সর্ব্বদিক্গামী অসংখ্যক অতীন্দ্রিয়
অণুরাশি এবং তাহার অজস্র-ধাক্কা-জনিত জড়পদার্থের গতি।
লেসাজের পূর্ব্বোক্ত
সিদ্ধান্তটি কেবল অনুমান ও কল্পনা দ্বারা গঠিত। এই সিদ্ধান্ত
প্রচারের পর প্রায় এক শতাব্দীকাল অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে, কিন্তু
এ পর্য্যন্ত লেসাজ বা তাঁহার শিষ্যগণমধ্যে কেহই পূর্ব্বোক্ত
অনুমানের পোষক কোন প্রমাণই দেখাইতে পারেন নাই। এ অবস্থায় মহাকর্ষণের
উৎপত্তি প্রসঙ্গে লেসাজের উক্তি কতদূর বিশ্বাসযোগ্য, পাঠকগণ
বিবেচনা করুন।
এখন আবর্ত্তসিদ্ধান্তীদিগের
মতে মহাকর্ষণের উৎপত্তির কারণ কি, দেখা যাউক। এই কারণটা বুঝিতে
হইলে, আবর্ত্তসিদ্ধান্তটা কি, তাহা মোটামুটি জানা আবশ্যক।
উক্ত সিদ্ধান্তের প্রতিষ্ঠাতা লর্ড কেল্ভিন্ বলেন যে,-বিশ্বব্যাপী
যে ঈথরের কম্পনাদি দ্বারা তাপ, আলোক ও চৌম্বকশক্তি ইত্যাদির
বিকাশ দেখা যায়, তাহারই অবস্থাবিশেষ দ্বারা আকর্ষণাদি ধর্ম্মসহ
জড়ের উৎপত্তি হইয়াছে। চা-পূর্ণ পেয়ালার মধ্যে চামচ্ ঘুরাইলে
চায়ে যে প্রকারে আবর্ত্ত জন্মে,-সেইরূপ কোন অনির্ব্বচনীয় কারণে
ঈথরের মধ্যে ঘূর্ণা জন্মিলে, ঈথরের সেই ঘূর্ণাদশাকেই বলে জড়পদার্থ।
পদার্থের আবর্ত্তনগতির
অনেক তথ্য প্রাচীন পণ্ডিতগণের জানা ছিল, কিন্তু তৎসাহায্যে
যে মহাকর্ষণশক্তির উৎপত্তিতত্ত্বাবিষ্কার সম্ভবপর, এ কথা তাঁহাদের
মধ্যে কাহারও মনে স্থান পায় নাই। প্রায় চল্লিশ বৎসর পূর্ব্বে
আচার্য্য হেলম্হোজ্ আবর্ত্তনগতিসম্বন্ধীয় কতকগুলি জটিল ব্যাপারের
মীমাংসা জন্য কিছুদিন গবেষণায় নিযুক্ত ছিলেন। তখন সেই সকল
ব্যাপারের মীমাংসার সহিত আবর্ত্তনগতিসম্বন্ধীয়ও কয়েকটি নূতন
তথ্য তিনি প্রচার করেন। সেই সময়ে ঘূর্ণাগতির সঙ্গে মহাকর্ষণশক্তির
কোন একটা গূঢ় সম্বন্ধ আছে বলিয়া কয়েকজন পণ্ডিত অনুমান করিয়াছিলেন।
গণিতসাহায্যে হেলম্হোজ্ স্পষ্টই দেখাইয়াছিলেন,-বহিস্থ বায়ু
ইত্যাদির সংঘর্ষজাত বাধা না থাকিলে, যে কোন পদার্থে একবার
ঘূর্ণাগতি উৎপন্ন করিতে পারিলে, সেই আবর্ত্তিত পদার্থের তাৎকালিক
গঠন ও আবর্ত্তবেগ অনন্তকাল পর্য্যন্ত সমভাবেই থাকিয়া যাইবে।
আবর্ত্তনগতির এই অদ্ভুত বিশেষত্ব এবং ইহার আরো দুই একটি শক্তির
কথা শুনিবামাত্রই, তদ্দ্বারা হয় ত ভবিষ্যতে জড়োৎপত্তি-সমস্যার
ও মীমাংসা হইবে বলিয়া লর্ড কেল্ভিনের মনে একটা সংস্কার হইয়া
গিয়াছিল। কিন্তু পূর্ব্বোক্ত ব্যাপারের সত্যতাপ্রতিপাদক যুক্তিগুলির
মধ্যে পরীক্ষাসিদ্ধ প্রমাণের একান্ত অভাব দেখিয়া, তিনি কেবল
গণিতমূলক প্রমাণ অবলম্বন করিয়া, হঠাৎ সেই মনোগত ভাব প্রচার
করিতে সাহসী হন নাই। এদিকে হেলম্হোজের অদ্ভুত আবিষ্কারবিবরণী
দেখিয়া, অধ্যাপক টেট্ তাহার প্রত্যক্ষ-প্রমাণ-সংগ্রহের জন্য
নানা পরীক্ষায় নিযুক্ত হইয়াছিলেন; এবং বায়ুর ঘূর্ণাগতি উৎপাদনের
বহুচেষ্টায় ব্যর্থমনোরথ হইয়া শেষে বিস্কুটের ডালাখোলা বাক্সের
ন্যায় একটা ছোট বাক্সের কোন এক পার্শ্বে একটি ছিদ্র করিয়া
এবং তাহার ঠিক বিপরীত দিকে খোলা পার্শ্বে একখণ্ড স্থূল কাপড়ের
আবরণ সংলগ্ন করিয়া, তিনি বায়ুর ঘূর্ণাগতি উৎপাদনের একটি অতি
সহজ উপায় উদ্ভাবন করিয়াছিলেন। এই সামান্য যন্ত্রের বস্ত্রাচ্ছাদিত
প্রান্তটিতে ধীরে ধীরে চাপ দিলে, প্রত্যেক চাপ প্রয়োগে আবদ্ধ
বায়ুর যে অংশ সেই ক্ষুদ্র ছিদ্রপথ দিয়া বহির্গত হয়, তাহা ঘূর্ণাগতি
প্রাপ্ত হয়, অধ্যাপক টেট্ এই তথ্য সর্ব্বপ্রথমে এই সময়ে জগতে
প্রচার করেন, এবং উক্ত যন্ত্রের সাহায্যে উৎপন্ন বায়ুর অদৃশ্য
আবর্ত্তন প্রত্যক্ষ দেখিবার জন্য, যন্ত্রমধ্যস্থিত বায়ুতে
ক্লোরাইড এমনিয়া (Chloride of Ammonia) বাষ্প মিশ্রিত করিয়া
দিবার যে পদ্ধতি আছে, তাহাও অধ্যাপক টেট্ দ্বারা এই সময়ে আবিষ্কৃত
হয়।
হেলম্হোজের আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই বায়ুকে ঘূর্ণাগতিসম্পন্ন
করিবার উল্লিখিত উপায়টি উদ্ভাবিত হওয়ায় লর্ড কেল্ভিনের গবেষণার
খুব সুবিধা হইয়া গিয়াছিল। যন্ত্রের উদ্ভাবক অধ্যাপক টেটের
সহিত পরীক্ষা করিয়া, অধ্যাপক হেলম্হোজের গণনালব্ধ সকল ধর্ম্মই
আবর্ত্তিত বায়ুতে তিনি প্রত্যক্ষ দেখিয়াছিলেন এবং তদ্ব্যতীত
ইহার আরো কতকগুলি অদ্ভুত ধর্ম্ম দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছিলেন।
পূর্ব্বোক্ত প্রক্রিয়ায় পরীক্ষাগারে প্রচুর ঘূর্ণি বায়ু উৎপন্ন
করিলে,-সেই দ্রুত ঘূর্ণায়মান অঙ্গুরীয়কগুলিতে অনুদ্যম (Inertia),
আকর্ষণ ও স্থিতিস্থাপকতা প্রভৃতি জড়প্র্সিদ্ধ সকল ধর্ম্মই,
ইহারা প্রত্যক্ষ দেখিয়াছিলেন। উক্ত পরীক্ষাগুলি দ্বারা কেল্ভিনের
মনে স্থির বিশ্বাস হইয়াছিল যে, ঈথরে একবার আবর্ত্তনগতি উৎপন্ন
হইলে, ঘর্ষণাদিজনিত বাধার অভাবে সেই আবর্ত্তগুলি অনন্তকাল
ঈথরসাগরে ভাসমান থাকিয়া জগতে জড়ধর্ম্মের বিকাশ করিতে পারে।
এই বিশ্বাসের উপরেই লর্ড কেল্ভিন তাঁহার প্রসিদ্ধ সিদ্ধান্তটির
প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন, এবং তাহাই অবলম্বন করিয়া একদল বলিতেছেন,-এই
জগতে যত জড়পদার্থ দেখিতেছ, তাহাদের সকলেরই সূক্ষ্মতম অংশগুলি
সর্ব্বদেশব্যাপী ঈথরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘূর্ণন ছাড়া আর কিছুই
নহে; আর জড়পদার্থমাত্রেই মহাকর্ষণ-শক্তি ও স্থিতিস্থাপকতা
প্রভৃতি যে সকল ধর্ম্ম দেখা যায়, তাহাও সেই ঈথরীয় ঘূর্ণনের
স্বভাবসিদ্ধ স্থায়ী ধর্ম্ম। ঈথরপদার্থ সহজেই ঘর্ষণবাধার অতীত,
সুতরাং কোনকালে উক্ত আবর্ত্তনগুলির লয় নাই, কাজেই জড়পদার্থ
ও তাহার স্থায়ী ধর্ম্মগুলির ধ্বংস নাই।
প্রাচীন ও আধুনিক বৈজ্ঞানিক
সিদ্ধান্তগুলির ইতিহাস আলোচনা করিলে দেখা যায়, অধ্যাপক ইয়ঙ্
কর্ত্তৃক সেই আলোকোৎপাদক ঈথর আবিষ্কারের পর হইতেই, যেন সকল
সিদ্ধান্তগুলিরই গতি ঈথরের দিকে চালিত হইতেছে,-আধুনিক সিদ্ধান্তের
মতে বিদ্যুৎ, চৌম্বকশক্তি এবং তাপালোক প্রভৃতি প্রধান প্রধান
প্রাকৃতিক ব্যাপারমাত্রই ঈথর দ্বারা উৎপন্ন। আবার দেখা যাইতেছে,
আবর্ত্তসিদ্ধান্তের মতে জড় ও জড়ধর্ম্ম সেই ঈথরেরই অবস্থাবিশেষদ্বারা
উৎপন্ন। পরীক্ষাসিদ্ধ প্রমাণের অপেক্ষা না করিয়া কেবল কতকগুলি
সম্ভবপর যুক্তির উপর বিশ্বাস স্থাপন করিয়া, আবর্ত্তবাদিগণ
সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়াছেন কি না, তাহা আমাদের ন্যায় অক্ষম ব্যক্তির
বিচার্য্য নয়। তবে সিদ্ধান্তটি যে কতদূর আনুমানিক, তাহা স্বয়ং
আবিষ্কারক মহাশয়ের নিম্নোদ্ধৃত উক্তিটি হইতে পাঠকগণ সহজেই
বুঝিতে পারিবেন। মার্কিন বৈজ্ঞানিক ডাক্তার উইলিয়ম্ প্রসঙ্গক্রমে
লর্ড কেল্ভিনকে আবর্ত্তসিদ্ধান্তসম্বন্ধে প্রশ্ন করিলে, কেল্ভিন
স্পষ্ট বলিয়াছেলেন:-The Vortex theory is only a dream. Itself
unproven, it can prove nothing and any speculations founded
upon it are mere dreams about a dream.
কাজেই দেখা যাইতেছে,
নিউটনের মহাকর্ষণসিদ্ধান্ত আবিষ্কারের পর হইতে সহস্র অগ্নিপরীক্ষায়
তাহার ধ্রুবত্বের প্র্চুর প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে সত্য, কিন্তু
উপরোক্ত দুইটি সিদ্ধান্ত প্রচারিত হওয়া সত্ত্বেও সেই বিশ্বব্যাপিনী
মহাশক্তির উৎপত্তি আজও রহস্যাবৃত রহিয়াছে।