প্রথম
পাতা
শহরের তথ্য
বিনোদন
খবর
আইন/প্রশাসন
বিজ্ঞান/প্রযুক্তি
শিল্প/সাহিত্য
সমাজ/সংস্কৃতি
স্বাস্থ্য
নারী
পরিবেশ
অবসর
|
পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
পোষ্টমাষ্টার
[
লেখক পরিচিতি : 'হিমালয়' খ্যাত জলধর সেনের পরিচিতি কিছুটা
'অবসরের' পাতায় রয়েছে। বর্তমান ধারাবাহিকের প্রথম রচনাটিতেই
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় জলধরের কিছুটা পরিচয় দিযেছেন, কিছুটা
রয়েছে 'পুরাতন রচনা ও লেখক' বিভাগটিতে। সম্পূর্ণতার প্রয়োজনে
এখানে তার জীবনের আরও কিছু ঘটনা সহ ⤗লেখক পরিচিতি⤘ তুলে
ধরা হল।
জলধর সেনের জন্ম ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দের ১৩ই মার্চ (১লা চৈত্র,
১২৬৬ বঙ্গাব্দ) কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি গ্রামে। ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দে
এটি নদীয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। পিতার নাম হলধর সেন ও মাতা
কালীকুমারী। জলধরের মাত্র তিন বছর বয়সে বসন্ত রোগে আক্রান্ত
হয়ে তার পিতা পরলোক গমন করেন। ছোটবেলায় তিনি স্থানীয় বিদ্যালয়েই
পড়াশোনা করেছেন। এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন হরিনাথ
মজুমদার ( কাঙ্গাল হরিনাথ )। পরবর্তী কালে কাঙ্গাল হরিনাথ
জলধরের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিলেন। ১৮৭১-এর ডিসেম্বরে
জলধর গোয়ালন্দ স্কুল থেকে মাইনর পরীক্ষায় উত্তের্ণ হন এবং
কৃতিত্বের দ্বীকৃতি স্বরূপ বৃত্তি লাভ করেন। ১৮৭৩-এ তার
গ্রামের কুমারখালি উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে
উত্তীর্ণ হয়ে থার্ড গ্রেড জুনিয়র স্কলারশিপ লাভ করেন। গণিত
ছিল জলধরের প্রিয় বিষয় এবং তিনি ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে মনস্থ
করেন। স্থানীয় অধিবাসী হেরম্ব চন্দ্র মৈত্রেয় ছিলেন সিটি
কলেজের অধ্যক্ষ; তিনি তখন এম.এ. পাঠরত। ইঞ্জিনীয়ারিং পড়া
ব্যয়সাপেক্ষ বলে তিনি জলধরকে জেনরেল লাইনে পড়াশোনা করতে
উপদেশ দেন এবং কলকাতায় গিয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সঙ্গে সাক্ষাত্
করতে বলেন। জলধর তখন মাসিক দশ টাকা বৃত্তি পান।
জলধর কলকাতায় এসে তার এক বন্ধুর বাড়ীতে ওঠেন এবং বিদ্যাসাগর
মহাশযের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। তার সঙ্গে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের
কথাবার্তা একটু দীর্ঘ হলেও উল্লেখযোগ্য; ব্রজেন্দ্রনাথের
রচনা থেকে সেটি তুলে দেওয়া হল। বিদ্যাসাগর বললেন -"একজামিনের
রেসাল্ট ত ডিসেম্বর মাসে বেরিয়েছে, তুই এই এপ্রিল মাস পর্য্যন্ত
কি করছিলি?' আমি তখন অল্প কথায় আমার বিলম্বের কারণ তাকে
জানালাম। বিদ্যাসাগর মহাশয় নিস্তব্ধ ভাবে আমার দিকে চেয়ে,
আমার দুঃখ কষ্টের কাহিনী শুনলেন। তার পর একটি দীর্ঘনিশ্বাস
ফেলে বললেন - 'তাইত রে, আমার কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে বোধ হয়
স্থান নেই, সব ভ'রে গিয়েছে। দাঁড়া জিজ্ঞাসা করছি।' এই বলে
সূর্য্যিবাবুকে ডাকলেন। তিনি এলে বললেন-'দেখ সূর্য্যি, এ
ছেলেটি তোমাদের দেশের, এর বাড়ী কুমারখালি। এ ফার্স্ট ইয়ারে
ভর্তি হতে চায়। ভাল ছেলে হে, স্কলারশিপ পেয়েছে।' সূর্য্যিবাবু
বললেন, 'আর ছেলে নেবার উপায় নেই, সব ভর্তি হয়ে গিযেছে।'
বিদ্যাসাগর তখন আমার দিকে চেয়ে বললেন-'শুনলি ত, এ বছর আর
কলেজে স্থান হবে না। এ বছরটা অন্য কলেজে ভর্ত্তি হ, আসছে
বছর তোকে সেকেণ্ড ইয়ারে নেবো। মাইনে টাইনে কিছু দিতে হবে
না।' তার পরই একটু চুপ করে থেকে বললেন -'দ্যাখ, তোর কথা
যা শুনলুম, তোর খরচ চলবে কি ক'রে ? এই ধর না কেন, জেনারেল
এসেম্ব্লীতে যদি ভর্ত্তি হতে পারিস, তা হলে তারা ৫ টাকা
মাইনে নেবে,-স্কলারশিপওলাদের এক টাকা রেহাই দেয়। তা হলে
আর তোর ৫ টাকা থাকলো, তাতে চলবে কি করে রে ?' এ কথার আমি
আর কি উত্তর দেবো, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। তিনি তখন বললেন
-'মনে কিছু করিস না, এ বছর তো কলেজের মাইনে আমি দেবো। তার
পর, সেকেণ্ড ইয়ারে ত এখানেই আসছিস। তাই যা, জেনারেল এসেম্ব্লীতে
খোঁজ নে গিয়ে। শুনেছি তারা ভর্ত্তি করে, তাদের বেশী ছেলে
হয় নি। আজই সেইটে ঠিক করে, কাল সকালে আবার আমার এখানে আসিস
- বুঝলি ?'
আমি তখন কেঁদে ফেলেছি । মানুষের হৃদয়ে যে এত দয়া থাকতে পারে,
এ আমি জানতাম না। আমার সেই অবস্থা দেখে ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ
উঠে এসে, আমার মাথায় হাত দিয়ে যে একটি কথা বলেছিলেন, সে
কথা এখনও আমার মনে আছে।বললেন -'ওরে পাগল, দারিদ্র্য অপরাধ
নয়। আমিও তোর মত দরিদ্র ছিলাম। যা, কাল আসিস।"
১৮৭৯ খ্রীষ্টাব্দে জেনারেল এসেম্ব্লী ইনস্টিটিউশনে প্রথম
বর্ষে ভর্ত্তি হলেও জলধর ১৮৮০-এর এল.এ. পরীক্ষায় কৃতকার্য
হতে পারলেন না। চাকরীর প্রয়োজন থাকায় তিনি তার জ্যেঠতুতো
দাদার চেষ্টায় গোয়ালন্দ স্কুলে তৃতীয শিক্ষক পদে নিযুক্ত
হন, বেতন মাসিক ২৫ টাকা। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে জলধর সুকুমারী
দেবীর সঙ্গে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন এবং কর্তৃপক্ষ দয়াপরবশ
হয়ে তার বেতন ৫ টাকা বৃদ্ধি করেন। জলধরের আনুষ্ঠানিক পড়শোনার
ফলাফল যাই হোক, ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন সাহিত্যানুরাগী।
গোয়ালন্দে অবস্থানের সময় বন্ধু অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র সঙ্গে
বৈশাখ ১২৮৯ থেকে আশ্বিন ১২৯২ পর্যন্ত কাঙ্গাল হরিনাথ পরবর্তিত
'গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা' নামক মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা
করেছিলেন। ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে জলধর চরম দুর্ভাগ্যের শিকার
হন। তার একটি কন্যাসন্তান জন্মানোর বার দিন পরে মৃত্যুমুখে
পতিত হয়, তার বার দিন পরে কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে স্ত্রীও
সন্তানের অনুগামিনী হন। স্ত্রীর মৃত্যুর সময়ে জলধর তার পাশে
ছিলেন না। তিনি তখন ফরিদপুরে একটি ইংরাজী বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা
করছেন। স্ত্রীর অসুস্থতার খবর জানিয়ে জলধরকে টেলিগ্রাম করা
হয়; কিন্তু তিনি যখন এসে পৌঁছেছেন, তার স্ত্রীর মৃতদেহ তখন
গৌরী নদীর তীরে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জলধরকে স্টেশন
থেকেই শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। এর তিন মাস পরে মা পরলোক গমন
করেন। জলধর তখন শোকে উদভ্রান্ত, নিঃসহায়, নিঃসম্বল। শান্তির
আশায় তিনি হিমালয় যাত্রা করতে মনস্থ করেন। একদিন গোলদীঘির
ধারে বন্ধু অশ্বিনীকুমার দত্তর সঙ্গে দেখা হয়। সব খবর শুনে
ব্যথিতচিত্তে তিনি জলধরকে বলেন -"জলধর, এ আনন্দের হাট
সকলের ভাগ্যে বেশীদিন টিকে না। হিমালয়ে যাচ্ছ যাও, দেখ যদি
শান্তি পাও।"
হিমালয়ের বদরিকাশ্রম যাত্রার আগে জলধর দেরাদুনে উপস্থিত
হন। কালীকান্ত সেন নামে একজন বরিশালবাসী তখন দেরাদুনে একটি
ইংরাজী স্কুল খুলেছেন। সেখানে তিনি কিছুদিন পড়িয়েছিলেন এবং
দেরাদুনে তিনি কালীকান্ত সেনের আশ্রয়েই কাটিয়েছেন। ১৮৯০
খ্রীষ্টাব্দের ৬ই মে বুধবার জলধর দেরাদুন থেকে বদরিকাশ্রম
যাত্রা করেন। বদরিকাশ্রম দর্শন করে জুন মাসের ১০ তারিখ নাগাদ
দেরাদুনে ফিরে আসেন। পদব্রজে তার এই শ্রমসাধ্য ভ্রমণ কাহিনী
তিনি তার 'হিমালয়' নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। হিমালয়
ভ্রমণ সংক্রান্ত একটি ঘটনা জানা যায় দীনেন্দ্রনাথের ⤗সে
কালের স্মৃতি'তে। তিনি জানিয়েছেন -"কিছুদিন পরে জলধর
বাবু দেশে প্রত্যাগমন করিলেন। তিনি কুমারখালী ফিরিলে শুনিতে
পাইলাম, তিনি লোটা-কম্বল সম্বল করিয়া তাপিত চিত্ত শীতল করিবার
জন্য হিমালয়ের সুশীতল ক্রোড়ে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন, অনেক
দুর্গম তীর্থ ভ্রমণ করিয়াছিলেন, অনেক সাধু-সন্ন্যাসীর আশ্রয়েও
কালযাপন করিয়াছিলেন। অবশেষে তিনি কোন মহাজ্ঞানী সাধুর শিষ্যত্ব
গ্রহণের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিলে, সেই সাধু তাহাকে বলিয়াছিলেন,
তাঁহার সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণের সময় হয নাই; তাঁহার ভাগ্যে
আছে - তাঁহাকে দীর্ঘকাল সংসারধর্ম্ম করিতে হইবে, তিনি পুরা
সংসারী হইবেন, তাঁহার সংসারধর্ম্মের সকলই বাকি। তিনি কিরূপে
সাধুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করিবেন ? সাধু তাঁহাকে স্বদেশে প্রত্যাগমন
করিতে আদেশ করিয়াছিলেন। এইজন্যই তাঁহার সন্ন্যাসী হওয়া হইল
না, তাঁহাকে লোটা-কম্বল ত্যাগ করিয়া দেশে ফিরিতে হইল।"
কর্মহীন জলধর এই সময়ে মনস্থ করিলেন শিক্ষকতা করিবার সুযোগ
ঘটলে তিনি সেই কাজেই নিজেকে যুক্ত করবেন, কারণ শিক্ষকতার
পূর্ব অভিজ্ঞতা তার ছিল। এদিকে জলধরের ঘণিষ্ঠ বন্ধু দীনেন্দ্রকুমারও
স্থির করেন তিনি মহিষাদল স্কুলে শিক্ষকতার কাজ নিয়ে এল.এ.
পরীক্ষা দেবেন। তখন শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত না থাকলে প্রাইভেটে
এল. এ. পরীক্ষা দেওয়া যেত না। দীনেন্দ্রকুমার ছিলেন গণিতে
দুর্বল পক্ষান্তরে জলধর সে বিষয়ে পারদর্শী। ঠিক সেই সময়ে
মহিষাদল স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ করা প্রয়োজন এবং দীনেন্দ্রনাথের
কাকা ছিলেন স্কুলের কর্তা। দীনেন্দ্র কুমারের সুপারিশে জলধর
মাসিক ৪০ টাকা বেতনে স্কুলে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন এবং
দীনেন্দ্রনাথের সঙ্গে একই বাড়ীতে থেকে স্কুলে শিক্ষকতার
সঙ্গে সঙ্গে দীনেন্দ্রকুমারকে গণিত শিক্ষা দিতে শুরু করেন।
একই সঙ্গে চলত সাহিত্যচর্চা। এই গণিত শিক্ষা দেবার জন্যই
দীনেন্দ্রকুমার তার লেখায় জলধরকে অনেক সময় মাস্টার-মহাশয়
হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এই সময়েই তার হিমালয় ভ্রমণ কাহিনী
'ভারতী ও বালক', 'ভারতী', 'জন্মভূমি', 'সাহিত্য' প্রভৃতি
পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। 'টপকেশ্বর ও গুচ্ছপাণি' নামে
তার প্রথম কাহিনী প্রকাশিত হয় 'ভারতী ও বালক' পত্রিকার ১২৯৯
বঙ্গাব্দের মাঘ সংখ্যায়। জলধর লিখেছেন -"যখন আমি হিমালয়ের
মধ্যে ছিলাম, সে সময়ে আমার আর কিছুই সম্বল ছিল না, শুধু
সম্বল ছিল কাঙ্গাল হরিনাথের বাউলের গানের একখানি বই। আমার
এক বন্ধু সেই বইখানির দুরবস্থা দেখিয়া যখন ভাল করিয়া বাঁধাইয়া
দেন, তখন তিনি তাহার সঙ্গে কয়েক পৃষ্ঠা সাদা কাগজ জুড়িয়া
দিয়াছিলেন। আমি সেই সাদা পৃষ্ঠাগুলিকে আমার ভ্রমণের কথা
একটু-আধটুকু লিখিয়া রাখিতাম,-ওটা একটা খেয়াল মাত্র; পরে
যে কিছু করিব, একথা ভাবিয়া লিখিতাম না; সে অভিপ্রায় থাকিলে
যথাযথভাবে অনেক কথা লিখিয়া রাখিতে পারিতাম। যখন মহিষাদলে
গেলাম, তখনও ঐ বইখানি আমার সঙ্গে ছিল, ... মহিষাদলে একদিন
দীনেন্দ্রবাবু আমার সেই গানের বইখানি দেখিতে পান এবং পেন্সিলে
লেখা সেই লেখাগুলি পড়েন। সে সময়ে তিনি 'ভারতী'তে প্রবন্ধ
লিখিতেন এবং 'ভারতী'-সম্পাদিকা মহাশয়াও তাঁহাকে বিশেষ স্নেহ
করিতেন। দীনেন্দ্রবাবু আমাকে ধরিয়া বলিলেন যে, আমার হিমালয়-ভ্রমণকথা
'ভারতী'তে লিখিতে হইবে। আমি ত কথাটা হাসিয়াই উড়াইয়া দিলাম।
শৈশবকাল হইতে যদিও একটু আধটু লেখাপড়ার চর্চ্চা করিতাম, কাগজপত্রেও
সামান্য কিছু লিখিতাম। কিন্তু বাঙ্গালা দেশ ত্যাগের পর হইতে
লেখাটা একেবারে ছাড়িয়া দিয়াছিলাম। .... কিন্তু দীনেন্দ্রবাবু
কিছুতেই ছাড়িলেন না, জোর করিয়া হিমালয়-ভ্রমণের প্রথম প্রস্তাব
লিখিয়া লইলেন এবং নিজেই বিশেষ উদ্যোগী হইয়া 'ভারতী' পত্রিকায়
প্রেরণ করিলেন। ... সম্পাদিকা মহাশয়া আমাকে জানাইলেন যে,
আমার হিমালায় ভ্রমণ পাঠকগণের ভাল লাগিয়াছে, এ সংবাদ তিনি
পাইয়াছেন। ... সে যাহাই হউক আমি 'ভারতী'তে লিখিতে লাগিলাম।
... হিমালয়ের কথা তাহার পূর্বে কেহ বাঙ্গালায় হয় ত লেখেন
নাই; তাই আমার লেখা যা তা-ই সকলে পড়িতে লাগিলেন। তখন আমার
সেই প্রবাস পল্লী হইতেই শুনিতে পাইলাম যে, 'জলধর সেন' নামে
কোন ব্যক্তি নাই, ঠাকুরবাড়ীর কেহ ছদ্মনামে হিমালয়-কাহিনী
লিখিতেছেন। ... আমি যখন 'ভারতী'তে লিখিতে আরম্ভ করি তখন
পূজনীয় রবীন্দ্রনাথ তাঁহার 'ইউরোপযাত্রীর পত্র' প্রকাশিত
করিয়াছিলেন। আমি হিমালয় লিখিবার সময় তাঁহারি অতুলনীয় লিখন-পদ্ধতি
(style ) অনুকরণের চেষ্টা করিয়াছিলাম; .... সে সময়ে হয় ত
বা সেই লিখন পদ্ধতি দেখিয়াই অনেকে সন্দেহ করিয়াছিলেন, ...
যাক সে কথা। আমি প্রায় দুই বত্সর ক্রমাগত লিখিয়া 'ভারতী'
পত্রে আমার হিমালয়-ভ্রমণের এক অংশ শেষ করিয়াছিলাম। তাহাই
একত্রে সংগ্রহ করিয়া পরে 'হিমালয়' ছাপাইয়াছিলাম।⤜
স্বজনহীন জলধরের হিমালয় ভ্রমণ প্রকৃত অর্থে কতটা বৈরাগ্য
সৃষ্টির সহায়ক হযেছিল বলা শক্ত। হয় ত সেই সন্ন্যাসীর কথাই
যথার্থ; আপাত সম্বলহীন জলধরের মন বন্ধন মুক্ত হয় নি। 'হিমালয়'
গ্রন্থে তিনি নিজেই লিখেছেন -"এখন ঘরে মা নেই, বাপ
নেই, স্ত্রী নেই, পুত্র নেই, গৃহ অরণ্যের ন্যায় নির্জন,
তবু সেই প্রাচীন স্মৃতির সমাধি মন্দিরে ফিরে যেতে মন অস্থির।"
অবশেষে একদিন জলধরকে সংসারে প্রবেশ করতেই হল। বন্ধুদের অনুরোধে
ও উদ্যোগে ডায়মণ্ডহারবারের নিকটস্থ উস্তি গ্রামের দত্ত পরিবারে
জলধর দ্বিতীয়বার দ্বার পরিগ্রহ করেন। বিয়ের পর তিনি মহিষাদলে
একটি নতুন বাড়ীতে এসে বাস করতে থাকেন। তার সাহিত্যপ্রীতি
কিন্তু তাকে ছাড়ে নি। 'সাহিত্য' পত্রিকার সম্পাদক সুরেশচন্দ্র
সমাজপতির অনুরোধে ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দে মাসিক ৩০ টাকা বেতনে
জলধর 'বঙ্গবাসী' পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে চাকরি শুরু করেন,
কিন্তু পত্রিকার মূল আদর্শের সঙ্গে বিরোধ ঘটায় মাত্র দেড়
মাস পরেই জলধর সে চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন।
'সাপ্তাহিক বসুমতী' প্রকাশিত হয় ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দের ৮ই অগাস্ট
(অন্য একটি রচনায় তারিখটি ২৫শে অগাস্ট বলে উল্লেখ করা হয়েছে)।
১৮৯৯-এর ২৭শে এপ্রিল জলধর এই পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসাবে
যোগদান করেন। এর কিছুদিন পরেই পত্রিকার স্বত্তাধিকারী উপেন্দ্রনাথ
মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পাদক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধকে
কেন্দ্র করে পাঁচকড়ি পদত্যাগ করলে জলধর সম্পাদক পদে বৃত
হন। কিন্তু সম্পাদকের গুরু দায়িত্ব কিছুটা লাঘব করার জন্য
তিনি একজন সহকারীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। উপেনবাবুর অনুমতি
নিয়ে বন্ধু দীনেন্দ্রকুমারকে চিঠি লিখে বিষয়টি জানান। দীনেন্দ্রকুমার
তখন বরোদায় শ্রীঅরবিন্দকে বাংলা ভাষা শেখাচ্ছিলেন। দু'বছর
ধরে এই কাজ করে দীনেন্দ্রকুমার নিস্কৃতি খুঁজছিলেন। জলধরের
চিঠি পেয়ে তিনি কালক্ষেপ না করে কলকাতায় এসে জলধরের সহযোগী
হিসাবে সম্পাদনার কাজ শুরু করেন। আট বছর সফলতার সঙ্গে জলধর
'বসুমতী' সম্পাদনা করেছেন। কিন্তু তার কপালে বিধাতা সুখ
লেখেন নি। ১৩১৩ বঙ্গাব্দে তার কণিষ্ঠ ভ্রাতা ও ভগিনী অকালে
পরলোক গমন করেন। এর পরেই তার কন্যা ও পত্নী কলেরায় আক্রান্ত
হন। অনেক চেষ্টা করেও কন্যাটিকে বাঁচানো যায় নি, স্ত্রী
কোনক্রমে রক্ষা পান। 'বসুমতী' ছেড়ে স্ত্রীকে নিয়ে জলধর দেশে
ফিরে আসেন। দীনেন্দ্রকুমার 'বসুমতী'র সম্পাদক হন।
'সন্ধ্যা' পত্রিকাটি ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় কর্তৃক ১৯০৪
খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত। কলকাতায় ফিরে এসে জলধর মধ্যে মধ্যে
'সন্ধ্যা'র সান্ধ্যকালীন আড্ডায় উপস্থিত হতেন। পরবর্তী কালে
'ভারতবর্ষ' পত্রিকার ১৩৪৩-এর শ্রাবণ সংখ্যায় জলধর এ সম্পর্কে
যা লিখেছেন, তা হল -"সেই সময় একদিন উপাধ্যায় মহাশয়
আমাকে বললেন -'দেখুন জলধরবাবু, আপনার ত এখন কোন কাজ নেই।
প্রত্যহ সকাল বেলা 'সন্ধ্যা' অফিসে আসুন না কেন ? মুড়ি বেগুনি
আর চা খাবেন - আর 'সন্ধ্যা' কাগজের জন্য এক কলম কি দু'কলম
যা হয় লিখবেন। বাসায় ফিরে যাবার সময় আমি আপনাকে বেশী দিতে
পারব না। 'সন্ধ্যা'র সে শক্তি নেই। নগদ দুটি করে টাকা দেব।
আমি ভাবলাম - মন্দ কি? বসেই ত আছি, যে দিন আসব চা যোগ ত
হবেই, আর 'সন্ধ্যা' কাগজের এক কলম কি দু' কলম লিখতে আধ ঘণ্টার
বেশী সময়ও লাগবে না। দক্ষিণা নগদ দুটি টাকা - যথা লাভ।"
জলধরের সঙ্গে 'সন্ধ্যা' পত্রিকার সম্পর্ক মাত্র কয়েক দিনের।
ইতিমধ্যেই সংবাদ এল, 'হিতবাদী' পত্রিকা-সম্পাদক কালীপ্রসন্ন
কাব্যবিশারদ জাপান থেকে দেশে ফিরবার পথে জাহাজেই মৃত্যুমুখে
পতিত হয়েছেন (৪ঠা জুলাই, ১৯০৭)। 'হিতবাদী'র স্বত্তাধিকারী
উপেন্দ্রনাথ সেন সখারাম গণেশ দেউস্করকে দিয়ে জলধরকে ডেকে
পাঠান। সখারাম গণেশ দেউস্করের কিছুটা পরিচয় এই ধারাবাহিকে
যোগেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায় রচিত 'আমার দেখা লোক'-এ পাওয়া
যাবে। ঠিক হল দেউস্করকে সম্পাদক নিযুক্ত করে জলধর সহকারী
সম্পাদক হিসাবে কাজ করবেন। কিন্তু একটি রাজনৈতিক মতভেদকে
কেন্দ্র করে স্বত্তাধিকারী উপেন্দ্রনাথের সঙ্গে সম্পাদক
দেউস্করের বিরোধ উপস্থিত হলে, সম্পাদক পদত্যাগ করেন এবং
জলধর সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু নরম প্রকৃতির
মানুষ জলধরের পক্ষে 'হিতবাদী'র বৈপ্লবিক চরিত্র হয় ত ধরে
রাখা সম্ভব হয় নি; তিনি সম্মালোচনার সম্মুখীন হন। এই পরিস্থিতিতে
জলধর 'হিতবাদী' ছেড়ে দেওয়াই মনস্থ করেন। 'হিতবাদী' ছেড়ে
১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে জলধর সন্তোষের ( ময়মনসিংহের টাঙ্গাইল
মহকুমায় অবস্থিত ) জমিদার ও সাহিত্যানুরাগী প্রমথনাথ রায়চৌধুরীর
ছেলেমেয়েদের শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহন করেন।
'সুলভ সমাচার' সাপ্তাহিক পত্রিকাটি কেশবচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত
'ভারত-সংস্কার সভা' থেকে প্রচার শুরু হয় ১২৭৭-এর ১লা অগ্রহায়ণ
থেকে। পত্রিকার দাম ছিল প্রতি সংখ্যা মাত্র এক পয়সা। 'সুলভ
সমাচার'-এর নবপর্যায় প্রকাশিত হয় দৈনিক হিসাবে ১৩১৮ বঙ্গাব্দের
১লা বৈশাখ নরেন্দ্রনাথ সেনের সম্পাদনায কলকাতার ক্রীক রো
থেকে। সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত এি পত্রিকাটির পঁচিশ হাজার
কপি সরকার আধ আনা মূল্যে ক্রয় করে বাংলার জনসাধারণের মধ্যে
বিনামূল্যে বিতরণ করতেন। পত্রিকা সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ সেন
বাংলা জানতেন না বলে জলধরকেই সব কাজ করতে হত। ১৯১১-এর জুলাই
মাসে নরেন্দ্রনাথের মৃত্যু হলে জলধরই সম্পাদক হন। কিন্তু
প্রস্তাবিত বঙ্গভঙ্গ স্থগিত হয়ে যাওয়ায় এবং কোন অশান্তির
আশঙ্কা না থাকায় সরকার 'সুলভ সমাচার' প্রয়োজনহীন সাব্যাস্ত
করে। এক বছর চলার পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৩১৮-এর চৈত্র
মাসের পর জলধর আবার কর্মহীন হয়ে পড়েন।
দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে, একের পর এক বহু পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট
থেকে জলধর অবশেষে কি করে তার প্রিয় 'ভারতবর্ষ' পত্রিকার
সঙ্গে যুক্ত হলেন সেটা ১৩৪৩-এর ভাদ্র সংখ্যার 'ভারতবর্ষে'
প্রকাশিত রচনায় তার ভাষাতেই শোনা যাক -" 'সুলভ সমাচার'
উঠে যাওয়ার সংবাদ পেয়েই আমার পরম হিতৈষী বন্ধু আমার পূর্ব্ব
মনিব সন্তোষের কবি-জমিদার শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ রায় চৌধুরী
মহাশয় আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং যত দিন আর কোন সুবিধা না হয়
তত দিন তাঁর প্যারাগন প্রেসের ভার নিতে বললেন। এখন যেখানে
আমাদের ভারতবর্ষ-অফিস হযেছে পূর্ব্বে সেখানে ট্রাম কোম্পানীর
আস্তাবল ছিল। সেই আস্তাবলের ঘরগুলি ভাড়া নিয়ে প্রমথবাবু
প্যারাগন প্রেস করেছিলেন। আমি সেই প্রেসের ম্যানেজার হলাম।
তখন 'ভারতবর্ষ' প্রচারের বিপুল আয়োজন চলছে। কবিবর দ্বিজেন্দ্রলাল
রায় ও পণ্ডিত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ যুগ্ম-সম্পাদক হয়েছেন।
সেই সময়ে ভারতবর্ষের স্বত্তাধিকারী শ্রীমান হরিদাস চট্টোপাধ্যায়
মহাশয় আমাকে বললেন যে তিনি প্যারগন প্রেসেই 'ভারতবর্ষ' ছাপতে
চান। আমার আর তাতে আপত্তি কি। অতবড় একখানি কাগজ ছাপবার জন্য
যা কিছু ব্যবস্থা করতে হয় আমি তাই করতে লাগলাম। হরিদাসবাবু
কিছু টাকা অগ্রিমও দিলেন। তখন 'ভারতবর্ষে'র সঙ্গে আমার ঐটুকুই
সম্বন্ধ ছিল।
আমি চার পাঁচ ফর্ম্মার মত কম্পোজ তুলে দিলাম। প্রথম ফর্ম্মায়
পেজ সাজিয়ে যেদিন দ্বিজেন্দ্রলালের বাড়ীতে পাঠিয়ে দিলাম,
সেই দিনই সেই ফর্ম্মার প্রুফ দেখতে দেখতেই অকস্মাত্ দ্বিজেন্দ্রলাল
অমরধামে চলে গেলেন।
তখন চারিদিকে হৈ হৈ পড়ে গেল। 'ভারতবর্ষে'র কর্ম্ম-কর্ত্তাগণ
কি করবেন স্থির করতে পারলেন না। অনেকের নাম প্রস্তাবিত হল।
অবশেষে হরিদাসবাবু আমাকেই দ্বিজেন্দ্রলালের শূণ্য পদে জোর
করে বসিয়ে দিলেন।"
১৩২৩ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাস থেকে জলধরের সুদক্ষ সম্পাদনায়
দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে 'ভারতবর্ষ' একটি জনপ্রিয় ও প্রথম শ্রেণীর
পত্রিকা হিসাবে সাহিত্য জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
জলধর সেনের রচিত গ্রন্থ, অন্যান্য লেখা ও সম্পাদিত পুস্তকের
তালিকা সুদীর্ঘ। এখানে কয়েটির উল্লেখ করা হচ্ছে।
'প্রবাস চিত্র' (ভ্রমণ, ১৮৯৯) ; 'চাহার দরবেশ' (উর্দু উপন্যাস
থেকে অনূদিত, ১৯০০) ; 'হিমালয়' (ভ্রমণ, ১৯০০) ; 'নৈবেদ্য'
(গল্প, ১৯০০) ; 'পথিক' (ভ্রমণ, ১৯০১) ; 'হিমাচল বক্ষে' (ভ্রমণ,
১৯০৪) ; 'ছোট কাকী ও অন্যান্য গল্প' (১৯০৪) ; 'নূতন গিন্নী
ও অন্যান্য গল্প' (১৯০৭) ; 'দুঃখিনী' (উপন্যাস, ১৯০৯) ;
'পুরাতন পঞ্জিকা' (গল্প ও ভ্রমণ, ১৯০৯) ; 'বিশুদাদা' (উপন্যাস,
১৯১১) ; 'হিমাদ্রি' (ভ্রমণ, ১৯১১) ; 'আমার বর ও অন্যান্য
গল্প' (১৯১৩) ; 'কাঙ্গাল হরিনাথ' (জীবনী, ১৮১৩) ; 'করিম
সেখ' (উপন্যাস, ১৯১৩) ; 'আলান কোয়াটারমেন' (অনূদিত উপন্যাস,
১৯১৪) ; 'পরাণ মণ্ডল ও অন্যান্য গল্প' (১৯১৪) ; 'আমার য়ুরোপ
ভ্রমণ' (১৯১৫) ; 'অভাগী' (উপন্যাস, ৩খণ্ডে, ১৯১৫, ১৯২২,
১৯৩২) ; 'আশীর্ব্বাদ' (গল্প, ১৯১৬) ; 'দশদিন' (ভ্রমণ, ১৯১৬)
; 'বড়বাড়ী' (উপন্যাস, ১৯১৬) ; 'এক পেয়ালা চা' (গল্প, ১৯১৮)
; 'হরিশ ভাণ্ডারী' (উপন্যাস, ১৯১৯) ; 'ঈশানী' (উপন্যাস,
১৯১৯) ; 'পাগল' (উপন্যাস, ১৯২০) ; 'কাঙ্গালের ঠাকুর' (গল্প,
১৯২০) ; 'চোখের জল' (উপন্যাস, ১৯২০) ; 'ষোল-আনি' (উপন্যাস,
১৯২১) ; 'মায়ের নাম' (গল্প, ১৯২১) ; 'সোনার বালা' (উপন্যাস,
১৯২২) ; 'দানপত্র' (উপন্যাস, ১৯২২) ; 'মুসাফির-মঞ্জিল' (ভ্রমণ,
১৯২৪) ; 'পরশ পাথর' (উপন্যাস, ১৯২৪) ; 'ভবিতব্য' (উপন্যাস,
১৯২৫) ; 'দক্ষিণাপথ' (ভ্রমণ, ১৯২৬) ; 'তিন পুরুষ' (উপন্যাস,
১৯২৭) ; 'বড় মানুষ' (গল্প, ১৯২৯) ; 'মধ্যভারত' (ভ্রমণ, ১৯৩০)
; 'সেকালের কথা' (কথাচিত্র, ১৯৩০) ; 'উত্স' (উপন্যাস,
১৯৩২)।
এ ছাড়া জলধর ছোটদের জন্য কিছু রচনা করেছেন; যেমন : 'সীতা
দেবী' (১৯১১) ; 'কিশোর' (গল্প-সংগ্রহ, ১৯১৫) ; 'শিব-সীমন্তিনী'
(১৯২৪) ; 'মায়ের পূজা' (গল্প সংগ্রহ, ১৯২৭) ; 'আফ্রিকায়
সিংহ শিকার' (১৯২৯) ; 'রামচন্দ্র' (১৯৩০) ইত্যাদি। তিনি
বিদ্যালয়ের কিছু পাঠ্য পুস্তকেরও প্রণেতা। জলধর জীবনে কোন
কবিতা রচনা করেন নি কিন্তু তার কাব্য বোধ ও বিশ্লেষণের গভীরতার
কোন অভাব ছিল না। তিনি সন্তোষের জমিদার কবি প্রমথনাথ রায়চৌধুরী
রচিত তিন খণ্ড কাব্য গ্রন্থ ভূমিকা সহ সম্পাদনা করেছেন।
এতে তার কাব্য-ভাবনার স্বকীয়তার পরিচয় মেলে।
জলধর বহু লোকের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তার সাহিত্য সেবার
স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি বিভিন্ন ভাবে সম্মানিত হয়েছেন। ১৩৩৯
বঙ্গাব্দের ১২ই ভাদ্র রবিবার শরত্চন্দ্রের পৌরহিত্যে কলকাতায়
রামমোহন লাইব্রেরী হলে জলধরের সম্বর্ধনার আয়োজন করা হয়।
১৩২২ বঙ্গাব্দে তিনি ছিলেন তৃতীয় বার্ষিক 'মেদিনীপুর সাহিত্য-সম্মিলনে'র
সভাপতি; 'বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষত্'-এর সহ-সভাপতি (১৩২৯-৩০,
১৩৪৩-৪৫); 'বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনে'র (রাধানগর) সাহিত্য
শাখার সভাপতি (৬-৭ই বৈশাখ, বৈশাখ, ১৩৩১)। ১৯২৯-এর ৩র জুন
জলধর 'রায় বাহাদুর' উপাধিতে ভূষিত হন। ১৩৪১ বঙ্গাব্দের ভাদ্র
মাসে অনুষ্ঠিত 'নিখিল বঙ্গ জলধর সম্বর্দ্ধনা'য় কথা-শিল্পী
শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত এবং স্বক্ষরিত মান-পত্র
প্রদান করা হয় জলধর সেনকে। এ ছাড়াও তিনি অন্যান্য বহু প্রতিষ্ঠানের
দ্বারা সম্বর্ধিত হয়েছেন।
১৩৪৫ বঙ্গাব্দের ৮ই মাঘ জলধরের একমাত্র অবলম্বন তার স্ত্রী
ইহলোক ত্যাগ করেন, এতে তিনি একেবারে ভেঙে পড়েন এবং সে বছরেররই
২৫শে চৈত্র (১৫ই মার্চ, ১৯৩৯) ৮০ বছর বয়সে জলধরের কর্মব্যস্ত
জীবনের অবসান হয়। জলধরের বর্তমান পরিচিতিটি প্রস্তুত করতে
ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত প্রবন্ধের সাহায্য নেওয়া
হয়েছে।
জলধর প্রসঙ্গে ইতি টানার আগে দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতেই
হয়। একটি হ'ল স্বামী বিবেকানন্দ প্রসঙ্গ। হিমালয় ভ্রমণ কালে
সামীজীর একবার 'প্রাণ সংশয়' উপস্থিত হয়। মৃত্যুর সব লক্ষণ
প্রায় উপস্থিত। সে সময়ে জলধর ঘটনাচক্রে সেখানে উপস্থিত ছিলেন
এবং তিনি একটি বনজ ওষধি প্রয়োগ করে স্বামীজীকে 'বাঁচিয়ে
তোলেন'। ঘটনাটির সত্যতা সম্বন্ধে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
জলধর লিখেছেন -" ... পূজ্যপাদ স্বামী বিবেকানন্দ সম্বন্ধে
বর্ণিত ব্যাপার দিবালোকের ন্যায় সম্পূর্ণ সত্য। উহার মধ্যে
কোথাও বিদুমাত্র অতিরঞ্জন নাই। তবে খুঁটিনাটির ভুল থাকতে
পারে বটে, কারণ অনেকদিনের কথা।"
কিন্তু ঘটনাটি অসত্য হতে যাবে কেন ? স্বামী বিবেকানন্দ ঘটনার
সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে ? জলধর তার সাধারণ দৃষ্টিতে যা দেখেছেন
যা বুঝেছেন তাই লিখেছেন। বিবেকানন্দ নিজেই বলেছেন ঈশ্বর
কৃপায় তিনি সে সময়ে সমাধি অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছিলেন। সমাধিস্থ
অবস্থায় মহাপুরুষদের দৈহিক লক্ষণ মৃত মানুষদের মতই হয়ে থাকে
বলে উল্লেখিত হয়েছে। খ্যাতনামা চিকিত্সক ও বিজ্ঞানী ডঃ
মহেন্দ্রলাল সরকার, যিনি রামকৃষ্ণদেবেরও চিকিত্সা করেছিলেন,
ঠাকুরের উপস্থিতিতেই তিনি সেটা পরীক্ষা করে দেখেছেন। ওষুধ
প্রয়োগ ও বাইরের কোলাহলে বিবেকানন্দের সমাধি ভঙ্গ হলে সেটাকে
'বাঁচিয়ে তোলা' বলে প্রতীয়মান হতেই পারে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি গুরুতর। জলধর সেন রচিত বহু লেখার আসল 'রচয়িতা'
না কি দীনেন্দ্রকুমার রায়। দীনেন্দ্রকুমারের সে রকমই দাবী।
অন্যের লেখা জলধর নিজের নামে ছাপিয়েছেন কোন রকম কৃতজ্ঞতা
প্রকাশ ছাড়াই। মারাত্মক অভিযোগ। 'অবসরে'র পাতায় ইতিপূর্বেই
বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। এখানে কিছু নির্দিষ্ট
তথ্য শুধু তুলে ধরা হবে। দীনেন্দ্রকুমারের বক্তব্য হল, জলধরবাবু
তার হিমালয় ভ্রমণ কালে যে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ডায়েরিতে লিখে
রেখেছিলেন, সেটাকে পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করে দীনেন্দ্রকুমার
সেটা প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন জলধরকে সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠিত
করার মহত্ সঙ্কল্প নিয়ে, অথচ জলধর তাকে সে স্বীকৃতি দেন
নি।
'সেকালের স্মৃতি'তে দীনেন্দ্রকুমার লিখেছেন -"কিছুদিন
পরে জলধরবাবুর দপ্তর ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে এক অপূর্ব্ব দ্রব্য
আবিষ্কার করিলাম। একখানি বাঁধানো খাতা,-তাহার এক দিকে ফিকিরচাঁদ
ফকিরের কয়েকখণ্ড গীতাবলী , -'কুমারখালী মথুরানাথ যন্ত্র'
হইতে প্রকাশিত; অন্য দিকে তাঁহার স্বলিখিত ভ্রমণ-বৃত্তান্ত,
-জলধরবাবুর হিমালয় ভ্রমণের সংক্ষিপ্ত বিবরণ; পেন্সিলে লেখা
- মোটা মোটা অক্ষর। .... সেই ভ্রমণ-কাহিনী আগাগোড়া পাঠ করিয়া
বুঝিতে পারিলাম, জলধরবাবু হিমালয়-পর্য্যটন উপলক্ষ্যে যথন
যেখানে গিয়াছেন, সেই স্থানের সংক্ষিপ্ত বিবরণ সংগ্রহ করিয়া
রাখিয়াছেন, কতকটা ডায়েরীর ধাঁচে লেখা। বর্ণনার পারিপাট্য
বা কৌশল আদৌ কোথাও ছিল না। তথাপি তাঁহার সেই ভ্রমণ-কাহিনীতে
নূতনত্ব থাকায় আমার বড়ই ভাল লাগিল; কিন্তু তাহা এতই সংক্ষিপ্ত
ও বাঁধুনি-বর্জ্জিত যে পাঠ করিয়া হৃদয় পরিতৃপ্ত হয় না, আগ্রহও
মেটে না। একদিন ভয়ে ভয়ে বলিলাম, 'মাষ্টার মহাশয়, আপনার এই
ভ্রমণ-বৃত্তান্ত কোনও মাসিকে প্রকাশ করিলে হয় না?' - মাষ্টার
মহাশয় চুরুটের ধোঁয়ার সঙ্গে আমার কথা হাসিয়াই উড়াইয়া দিলেন;
বলিলেন-'ও কি ভ্রমণ-বৃত্তান্ত ? অশান্ত হৃদয় লইয়া যেদিকে
দুই চোখ গিয়াছে, সেই দিকে গিয়াছি, যা চোখের সম্মুখে পড়িয়াছে,
তাই, যেমন খেয়াল হইয়াছে, সেই ভাবে লিখিয়া রাখিয়াছি। কখনও
দেশে ফিরিব, উহা ছাপার হরফে প্রকাশ করিব - এরূপ আকাঙ্ক্ষা
কোন দিন ছিল না, সে ভাবে লিখিও নাই। কেন উহা সাধারণে প্রকাশ
করিয়া আমাকে সাহিত্য-সমাজে হাস্যাস্পদ করিবেন ?"
"আমার জিদ বাড়িয়া গেল; আমি বলিলাম, উহা ভারতীতে প্রকাশ
করিব। - তিনি আমার কথা বিশ্বাস করিলেন না। আমিও বুঝিয়াছিলাম
ভ্রমাণ-কাহিনীটি যে ভাবে লিখিত হইয়াছিল, তাহা অবিকল নকল
করিয়া পাঠাইলে কোন মাসিক-সম্পাদকই সে লেখা পত্রস্থ করিবেন
না। আমি বলিলাম, 'নলচে ও খোল' বদলাইয়া উহা কথ্য ভাষায় লিখিয়া
একটা কিস্তী শ্রীমতী সরলাদেবীকে পাঠাই - দেখি, তিনি কি বলেন।
.... আমি কাপি প্রস্তুত করিয়া জলধরবাবুকে দেখিতে দিলাম,
তিনি তাহা না দেখিয়াই ফেরত দিয়া বলিলেন, 'কি ছেলেখেলা আরম্ভ
করিলেন ? হিমালয় কখনও দেখেন নাই, আমার তিন পৃষ্ঠার লেখাটুকু
ফেনাইয়া-ফুলাইয়া ষোলো পৃষ্ঠা করিলেন; আপনি আশা করিতেছেন,
উহা ভারতীতে প্রকাশিত হইবে ?' - কিন্তু আমার আশা অপূর্ণ
রহিল না; সরলা দেবী আমার হাতের লেখা কাপি পাইয়া অজ্ঞাত লেখক
জলধরবাবুর অস্তিত্ত্বে একটু সন্দিহান হইলেন বটে, কিন্তু
আমাকে তিনি বিশ্বাস করিতেন। তিনি সেই কাপিতে আমার ভাষার
প্রকাশভঙ্গি বিশেষত্ব পরিস্ফুট দেখিলেন; তথাপি আমার কথায়
নির্ভর করিয়া জলধরবাবুর নাম দিয়াই তাহা ছাপিতে আরম্ভ করিলেন।
শ্রীযুক্ত সরলা দেবীর এ সকল কথা এখনও স্মরণ থাকিতে পারে।
হয় ত এতদিন পরে আমার এই কবুল জবাব পাঠ করিয়া তিনিও মনে মনে
হাসিবেন।"
এই বিতর্ক সে সময়ে সাহিত্য-জগতে যথেষ্ট আলোড়ন তুলেছিল। প্রকৃত
তথ্য উদ্ঘাটনের উদ্দেশ্যে কবি নরেন্দ্র দেব সরলা দেবীকে
একটি চিঠি লিখে বিষয়টি জানতে চেয়েছিলেন। শ্রদ্ধেয় গবেষক
বারিদবরণ ঘোষ এই বিতর্ক নিয়ে একটি তথ্যপূর্ণ নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ
প্রকাশ করেছেন। সেখানে তিনি এই চিঠির উল্লেখ করেছেন। ১৯৩৩-এর
১২ই নভেম্বরে লেখা উত্তরে সরলাদেবী জানিয়েছেন, ".....
দীনেন্দ্র রায় তাঁর বন্ধু জলধর সেনের কুমারী লেখা (maiden)
লেখা আমাকে দেন। বলেন , তাঁর বন্ধু অতি লাজুক, তিনি অনেক
কষ্টে ডায়েরী থেকে এটি উদ্ধার করেছেন। তাঁর বন্ধুর ভরসা
নেই যে আমি জিনিসটা পছন্দ করে ভারতীতে স্থান দেব। এর পর
দীনেন্দ্রকুমার জিজ্ঞাসা করেন, আমি কি মনে করি এর ভিতর কিছু
পদার্থ আছে ? - পদার্থ ? আমি দেখিলাম এটি একটি অনুদ্ধার
খনি হইতে লব্ধ একখানি মণি .... ।" এর পর সরলা দেবী
জানিয়েছেন -"কলম্বাস যেমন আমেরিকা আবিষ্কার করিয়াছিলেন,
দীনেন্দ্র রায় তেমনি জলধরকে আবিষ্কার করিয়াছিলেন। একথা সত্য।
বেশী আর কিছু নয়।"
সরলা দেবীর এই চিঠিতে কি দীনেন্দ্রকুমারের বক্তব্যের কোন
সমর্থন মেলে ?
এবার 'হিমালয়' সম্বন্ধে জলধরের নিজের বক্তব্য শোনা যাক।
১৩২৩-এর 'ভারতী'র বৈশাখ সংখ্যায় ('ভারতী'র ৪০ বছর পদার্পণ
উপলক্ষ্যে 'ভারতী-স্মৃতি' রচনায়) লিখেছেন -"দীনেন্দ্রবাবু
আমাকে ধরিয়া বসিলেন যে, আমার হিমালয়-ভ্রমণ কথা ভারতীতে লিখিতে
হইবে। আমি ত কথাটা প্রথমে হাসিয়া উড়াইয়া দিলাম। ... কিন্তু
দীনেন্দ্রবাবু কিছুতেই ছাড়িলেন না, জোর করিয়া হিমালয়-ভ্রমণের
প্রস্তাব লিখিয়া লইলেন এবং নিজেই বিশেষ উদ্যোগ লইয়া 'ভারতী'
পত্রে প্রেরণ করিলেন। ... আমি কিন্তু সনির্বন্ধ অনুরোধ করিয়াছিলাম
যে, আমার নামটা যেন ছাপা না হয়; ... কিন্তু সম্পাদক মহাশয়া
বোধ হয় রহস্য দেখিবার জন্যই আমার আকার-ইকার-উকার-বর্জ্জিত
নামটা প্রবন্ধের শেষে ছাপিয়া দিলেন এবং আমাকে আরও লিখিবার
জন্য উত্সাহ প্রদান করিলেন।... সম্পাদিকা মহাশয়া আমাকে
জানাইলেন যে, আমার হিমালয়-ভ্রমণ পাঠকদের ভাল লাগিয়াছে এ
সংবাদ তিনি পাইয়াছেন ... সে যাহাই হউক আমি 'ভারতী'তে লিখিতে
লাগিলাম।
আর একবার দীনেন্দ্রকুমারের 'সেকালের স্মৃতি'তে ফিরে আসা
যাক। তিনি লিখেছেন -"এক দিন সাহিত্য-সম্পাদক বন্ধুবর
সুরেশবাবু ( সুরেশ্চন্দ্র সমাজপতি ) বলিলেন, "জলধরবাবুর
হিমালয় ত লিখিয়া দিলেন, আপনার নাম কেহ জানিল না; আপনি কি
পরিশ্রম করিলেন, তাহা কেহ বুঝিল না; কিন্তু আপনার রচনা-ভঙ্গী
লেখার বিশেষত্ত্ব, এবং ভাবপ্রকাশের মধ্যে আপনার যে individuality
জাজ্জ্বল্যমান হইয়া উঠিয়াছে, জলধরবাবু কি করিয়া তাহা নিজস্ব
বলিয়া সপ্রমাণ করিবেন ?" অন্যত্র দীনেন্দ্রকুমার লিখেছেন
-"চন্দননগরের সুবিখ্যাত সাহিত্যসেবক শ্রদ্ধাভাজন শ্রীযুক্ত
হরিহর শেঠকে এক দিন এইরূপ বিস্ময় প্রকাশ করিতে দেখিয়াছি।
এক জনের কণ্ঠ হইতে অন্যের বেসুরো কণ্ঠস্বর নিঃস্বারিত হইলে
বিস্মিত হইবারই কথা বটে।"
১৩০০ ও ১৩০১ বঙ্গাব্দের বেশ কয়েকটি সংখ্যায় 'হিমালয়' ধারাবাহিকভাবে
'ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত
হয় ১৩০৭ বঙ্গাব্দে (১৯০০ খ্রীষ্টাব্দ); বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন
জলধরের ঘণিষ্ঠ বন্ধু দীনেন্দ্রকুমার রায়। তার লিখিত ভূমিকার
কিছুটা অংশ দেখে নেওয়া যাক। তিনি লিখেছেন -
"সৌভাগ্যক্রমে আমাদের শ্রদ্ধাভাজন বন্ধু বাবু জলধর
সেন মহাশয় একবার সংসার সাগরের ঘূর্ণাবর্ত্ত ভেদ করিয়া তাঁহার
সংসার-বাসনা-বর্জিত কর্মহীন জীবন মৃত্যুর মহিমাময় তটে নিক্ষিপ্ত
করেন, সংসারের সুখের প্রলোভন ছাড়িয়া শান্তির আশায় তিনি হিমালয়ের
বিজন বক্ষে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। তাহা কতদূর পূর্ণ হইয়াছিল,
সে সংবাদ আমরা রাখিনা, কিন্তু তাঁহার সুদীর্ঘ বিরহী জীবন
আমাদের বঙ্গভাষার দীনভাণ্ডারে যে মহার্ঘ্য রত্ন দান করিয়াছে
তাহা চিরদিন বঙ্গসাহিত্য সমালঙ্কৃত করিয়া রাখিবে বলিয়া আশা
হয়। বিধাতা তাঁহার হৃদয়ের প্রিয়তম সামগ্রী হরণ করিয়া তাঁহার
হৃদয়ের যে তন্ত্রীতে আঘাত করিয়াছিলেন, তাহার করুণ ঝংকার
প্রত্যেক বঙ্গীয় পাঠকের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হইবে। বঙ্গভাষার
সৌভাগ্য তিনি হৃদয়ের গভীর আঘাত পাইয়া হিমালযের অমর কাহিনী
বঙ্গভাষায় ব্যক্ত করিয়াছেন; এ আঘাতে তাঁহার যতই ক্ষতি হউক,
বঙ্গভাষার মহোপকার হইয়াছে; পাঠকগণও একটি বিস্ময়পূর্ণ, অদৃষ্টপূর্ব্ব,
অসাধারণ দৃশ্য পরম্পরার সহিত পরিচিত হইয়াছেন। - ইংরাজীতে
একটা প্রবাদ আছে, নাইটিঙ্গেল পক্ষী কণ্টকের উপর বক্ষ স্থাপন
না করিয়া কখনও গান গাহিতে পারে না। কবিবর শেলীও বলিয়াছেন
'Our sweetest songs are those that tell of saddest thought'
- তাই বুঝি জলধরবাবুর ভ্রমণকাহিনী এত সুমধুর।" সম্পূর্ণ
ভূমিকাটি দীর্ঘ বলে দেওয়া গেল না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অংশটিই
উদ্ধৃত হয়েছে। এটা পড়ে কি কখনও সামান্যতম মনে হয়েছে দীনেন্দ্রকুমার
জলধরের 'হিমালয়' গ্রন্থটি নিজে লিখেছেন। সেটাই যদি হবে তবে
তিনি এই ভূমিকা লিখলেন কেন ?
'ভারতী' পত্রিকায় 'হিমালয়' ক্রমিক ভাবে প্রকাশিত হবার আগেই
জলধরের ভ্রমণ কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে। তার রচিত 'টপকেশ্বর
ও গুচ্ছপানি' প্রকাশিত হয় ১২৯৯-এর 'ভারতী ও বালক' পত্রিকার
মাঘ সংখ্যায়। ফাল্গুন ও চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত হয় যথাক্রমে
'সহস্রধারা' ও 'হৃষিকেশ'। যে সুরেশচন্দ্র না কি 'হিমালয়ে'র
প্রকৃত রচয়িতা বিষয়ে দীনেন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন,
তারই সম্পাদিত 'সাহিত্য' পত্রিকার ১৩০১ এবং ১৩০২-এর বিভিন্ন
সংখ্যায় 'প্রবাসচিত্রে'র অধিকাংশ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
দীনেন্দ্রনাথ আরও লিখেছেন -"কেবল হিমালয়েই শেষ নহে;
তাঁহার রচিত 'প্রবাস-চিত্র' নামক ভ্রমণ-বৃত্তান্ত খানির
বিবিধ প্রবন্ধ সাধু ভাষায় লিখিত হইয়াছিল; হিমালয়ের পর সেই
ভারও আমাকেই গ্রহণ করিতে হইয়াছিল।" 'প্রবাস চিত্র'
যে জলধর রচনা করেন নি এ তথ্য যদি সুরেশবাবু জানতেন, তবে
তিনি জলধরের নাম দিয়ে তার পত্রিকায় সেটা প্রকাশ করলেন কেন
? শুধু তাই নয়। শ্রদ্ধেয় বারিদবরণ ঘোষ জানিয়েছেন -"'প্রবাস
চিত্র' বইটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়
এণ্ড সন্স। এটা কোন উল্লেখযোগ্য তথ্য নয়। কিন্তু তাঁদেরকে
ছাপার জন্য কে বা কারা অনুরোধ করেন শুনলে দীনেন্দ্রকুমার
'হতচকিত' হবেন। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি ও তাঁর ভাই যতীশচন্দ্রের
আগ্রহেই এটি তাঁরা ছাপেন॥ শুধু তাই নয় - তাঁরা এই রকমের
সব বই ছাপতে আগ্রহী হন এবং তাতেই 'হিমালয়' গ্রন্থাকারে প্রকাশ
পায়।"
পরিশেষে একটি কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনার উল্লেখ করে 'লেখক পরিচিতি'
শেষ করব। 'হিমালয়' গ্রন্থের রচনার ভঙ্গী সম্বন্ধে জলধর 'ভারতী'-র
১৩২৩-এর বৈশাখ সংখ্যায় ('ভারতী-স্মৃতি') লিখেছেন -"আমি
যখন 'ভারতী'তে হিমালয়-ভ্রমণ লিখিতে আরম্ভ করি, তাহার কিছুদিন
পূর্ব্বে পূজনীয় রবীন্দ্রনাথ তাঁহার 'ইউরোপযাত্রীর পত্র'
প্রকাশিত করিয়াছিলেন। আমি হিমালয় লিখিবার সময় তাঁহারই অতুলনীয়
লিখন-পদ্ধতি (style) অনুসরণের চেষ্টা করিয়াছিলাম।"
এ বার দীনেন্দ্রকুমার তার 'সেকালের স্মৃতি'তে কি লিখেছেন
দেখা যাক -
"জলধরবাবু 'হিমালয়ে'র রচনাসংক্রান্ত সকল ভার আমার আগ্রহেই
আমার হাতে ছাড়িয়া দেওয়ায় উহার ভাষার নির্ব্বাচন সম্বন্ধে
তাঁহার অভিমত জিজ্ঞাসা করি নাই। তাঁহার চোখের জলে, কি আমার
বুকের রক্তে এই সৌধের গাঁথুনী হইবে - এ বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণ
উদাসীন ছিলেন। কিন্তু সেই সময়ে আমি কবিবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মহাশয়ের 'য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র' পাঠ করিতেছিলাম, আমি সেই
পুস্তকের ভাষার এবং তাঁহার রচিত কবিতাগুলির প্রতি আকৃষ্ট
হইয়া, যৌবনসুলভ উত্সাহে 'হিমালয়ে' কবিবরের 'পত্রের'র ভাষারই
অনুকরণ করিয়াছিলাম, এবং তাহাতে তাঁহার কবিতার কোন কোন অংশ
উদ্ধৃত করিয়া রচনাটি সরস করিবারও চেষ্টা করিয়াছিলাম। এ সকল
কথা ত জলধরবাবুর অজ্ঞাত নহে।"
অতএব দেখা যাচ্ছে দু'জনেই লিখেছেন তারা রবীন্দ্রনাথের 'ইউরোপ
যাত্রীর পত্রে'র ভাষা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সেই পদ্ধতিই অনুসরণ
করেছেন। বিচিত্র ব্যাপার !
তবে একটি ব্যাপার লক্ষণীয়। দীনেন্দ্রকুমার বা অন্য কেউ কিন্তু
জলধরের লেখা শুরুর সময়ে কোন অভিযোগ তোলেন নি; তুলেছেন যখন
জলধরের খ্যাতি মধ্য গগনে। 'হিমালয়' গ্রন্থটি অসামান্য জনপ্রিয়
হয় এবং ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দেই অর্থাত্ জলধরের জীবিত কালেই
গ্রন্থটির চতুর্দ্দশ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বলা বাহুল্য 'হিমালয়'
গ্রন্থটির আনুকূল্যে জলধর শুধু সাহিত্যিক হিসাবে খ্যাতনামা
হন নি; আর্থিক দিক দিয়েও তিনি যথেষ্ট উপকৃত হয়েছেন। এই যশ
ও অর্থ প্রাপ্তিই কি জলধরের বিপদ ডেকে এনেছে ? দীনেন্দ্রকুমার
লিখেছেন -"জলধরবাবুর হিমালয়ের এ পর্যন্ত আট দশটি সংস্করণ
হইয়াছে; পুস্তকের মূল্য দেড় টাকা, সুতরাং এ পর্যন্ত ন্যূনকল্পে
পনের হাজার টাকার হিমালয় বিক্রয় হইয়াছে।" আবার অন্যত্র
বলেছেন -" 'হিমালয়ে' ও 'প্রবাসচিত্রে' জলধর বাবু যে
বহু টাকা পাইয়াছেন, আশা করি তাহাতে আমাকে অঙ্ক শিখাইবার
দক্ষিণা পরিশোধ হইয়াছে।" এতদিন পরে এই বিতর্কের সমাধানের
কোন সম্ভাবনা নেই। সংশ্লিষ্ট কেউই আর ইহলোকে নেই; অবশ্য
যখন সবাই জীবিত ছিলেন, তখনই প্রকৃত রহস্য জানা যায় নি। তবে
জলধর যে অত্যন্ত সজ্জন এবং অজাতশত্রু ছিলেন এ কথা অনেকেই
স্বীকার করেছেন। তিনি দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে 'ভারতবর্ষ' নামক
একটি প্রথম শ্রেণীর পত্রিকা যোগ্যতা ও সুনামের সঙ্গে সম্পাদনা
করে গেছেন, কোন অনুযোগ কখনও শোনা যায় নি। অতএব রহস্য চিরকাল
রহস্যই থেকে যাবে। ]
দীপক সেনগুপ্ত।
(১)
ভাই বিনয়,
তুমি পূজার ছুটীতে যখন
বাড়ী আসিয়াছিলে, তখন আমার দুঃখের কথা সমস্তই তোমাকে বলিয়াছিলাম।
তুমি নানা কাজে সর্ব্বদা ব্যস্ত থাক, বোধ হয় সে সকল কথা তোমার
মনে নাই। আমার দুঃখ অপার; সে দুঃখকাহিনী কাহারো কাছে প্রকাশ
করিয়াও কোন ফল নাই। তুমি আমার শুভাকাঙ্কী, আমার দুঃখ কষ্ট
তুমি হৃদয় দিয়া অনুভব কর, তাই মনে হইতেছে, তোমার কাছে আমার
কষ্টের কথা কতক কতক প্রকাশ করিয়া একটু শান্তি লাভ করিব। তোমার
মত বন্ধু আমার আর কে আছে? তুমি ত ভাই জান, তোমাদের গ্রামে
পোষ্টমাষ্টারি করিয়া আমি মাসে কুড়ি টাকার বেশী বেতন পাইনা;
টিকিট বিক্রয়ের কমিশন আর কত হইবে?-দু টাকার বেশী হয় না। আয়
এই বাইশ টাকা। পরিবারে তিনটি মেয়ে একটি ছেলে আর আমরা স্ত্রীপুরুষ
, বাইশ টাকা আয়ে আজকাল এতগুলি পরিবার প্রতিপালন করা যে কি
কঠিন তা আমিই জানি। না হয়, ছেলে মেয়ে কটিকে দুমুটো খাইতে দিয়া
আমরা স্ত্রী পুরুষে এক বেলা খাইয়াই থাকিলাম; ঘরের মধ্যে কি
করি না করি তার খোঁজ কে লইবে? আর আমরা অর্দ্ধাসনে দিনপাত করিতেছি,
তাহা অন্যে জানিলেই বা কি ক্ষতি? দুবেলা যাহার আহার যোটে না,
তাহার সে চক্ষুলজ্জা নিষ্প্রয়োজন। সে যাহাই হউক, এখন ঘোর বিপদে
পড়িয়াছি তাহা হইতে কিরূপে উদ্ধার হই? বড় মেয়েটি তের বত্সর
পার হইয়া চোদ্দয় পড়িয়াছে; মেজ মেয়েটিও বার বত্সরে পা দিয়াছে;
মেয়ে যে আর ঘরে রাখিতে পারি না। তুমি ত তাই জান, আমার হাতে
একটি পয়সাও নাই, এমন আত্মীয় নাই যাহার কাছে এ দুঃসময়ে সাহায্যে
চাহিয়া কিছু পাইবার আশা করিতে পারি; স্ত্রীর গায়ে এমন একখানিও
গহনা নাই যাহা বিক্রয় করিয়া দু পয়সা সংগ্রহ করি। এখন উপায়
কি? আমার যে জাতি যায়! কলিকাতায় অনেকের সঙ্গে তোমার আলাপ পরিচয়
আছে, বিনা পয়সায় কি আমার মেয়ে দুটিকে কেহ গ্রহণ করিবে না?
তুমি একটু বিশেষ চেষ্টা দেখিও; আমি বড় কষ্টে পড়িয়াছি। এমন
কেহ আপনার লোক নাই যাহার উপর পাত্র খুঁজিবার ভার দিয়া নিশ্চিন্ত
থাকিতে পারি; কাজ ছাড়িয়া নিজেরও নড়িবার যো নাই। তুমিই আমার
একমাত্র ভরসা, তোমার উপর উষা ও নিশার বিবাহভার দিতেছি, তাহারা
তোমাকে নিজের কাকা বলিয়াই মনে করে, কাকার যাহা কর্ত্তব্য,
করিও তাই। আমরা শারীরিক ভাল আছি, তুমি কেমন আছ লিখিও।
হতভাগ্য রজনী ।
(২)
মাষ্টার মহাশয়,
আপনার পত্র পাইলাম।
কলিকাতায় নানা রকম বিষয় কার্য্যে সর্ব্বদা ব্যস্ত থাকি সত্য,
কিন্তু সে জন্য আপনার কথা ভুলি নাই; আপনার উষা ও নিশার কথা
যখন তখনই মনে হয়। আমি অনেক মেয়ে দেখিয়াছি, কিন্তু উষার মত
মেয়ে আমার চক্ষে কম পড়িয়াছে। তাহার অঙ্গ সৌষ্ঠব এবং স্বভাব
দুই অতি সুন্দর; আপনাকে কষ্ট দিবার জন্যই বুঝি ভগবানা্ এমন
কন্যারত্ন আপনার ঘরে পাঠাইয়াছেন। এমন লক্ষ্মীর মত সুন্দরী,
ধীর আর শান্ত মেয়ে কি যার তার হাতে সঁপিয়া দেওয়া যায়?
আমি যদিও আজ তিন বত্সর হইল কালেজ ছাড়িয়াছি, তথাপি আমার সমপাঠী
অনেকে আজও কালেজে পড়িতেছেন। দেশের দুঃখ দূর করিবার জন্য, বালিকা-বিবাহ
রহিত করিবার নিমিত্ত, সামাজিক কুরীতি এবং কুসংস্কার নিবারণের
জন্য যাঁহাদের সঙ্গে একত্রে সভাসমিতি করিতাম, গ্রামে গ্রামে
বক্তৃতা দিয়া বেড়াইতাম, প্রতিজ্ঞা-পত্রে স্বাক্ষর করিতাম,
তাঁহাদের অনেকেই এখন ও কালেজে পড়িতেছেন। সে দিন খুঁজিয়া খুঁজিয়া
আমাদের দেশোদ্ধার দলের চাঁই একটি বন্ধুর সহিত দেখা করিতে গিয়াছিলাম;
তিনি এমা্, এ পাশ করিয়া এখন আইন পড়িতেছেন; এখন পর্য্যন্ত
তিনি বিবাহ করেন নাই; আমাদেরই জাতি, উপাধি ঘোষ, বয়স তেইশ চব্বিশ
বত্সর উষার সঙ্গে বেশ মানায়। তাঁর সঙ্গে অনেক দিন পরে দেখা
হইল, কথায় কথায় দেশোদ্ধার, জাতীয় মহাসমিতি, ব্যবস্থাপক সভা
প্রভৃতি লইয়া অনেক আন্দোলন চলিল। তাহার পর আসল কথা পাড়িলাম।
বিবাহের কথা উঠিলে, তিনি যে রকম মেয়ে চান উষা ঠিক সেই রকম
মেয়ে, তাহা বলিলাম, এবং রূপ গুণ, লেখা পড়া প্রভৃতিতে উষা তাঁহাকে
বেশ সন্তুষ্ট করিতে পারিবে, তাহাও তাঁহাকে জ্ঞাত করিলাম। পরে
মনে হইল এই সঙ্গে আপনার পরিচয়টাও দেওয়া ভাল। কাজেই তাঁহাকে
বলিলাম আপনি কুড়ি টাকা মাহিয়ানায় পাড়াগাঁয়ে পোষ্টমাষ্টারি
করেন। শুনিয়া তিনি অনায়াসে বলিয়া বসিলেন "তাইত, তেমন
respectable লোক নন। আমার বিশেষ আপত্তি না থাকা্লেও বাবা
যে এ কাজে স্বীকার হবেন তা বোধ হয় না।" - ইচ্ছা হইল আমাদের
'ছাত্রসমিতি'তে পঠিত প্রবন্ধের তাড়া হইতে তাঁহারই লিখিত 'পাশ
করা বরের অত্যাচার' শীর্ষক প্রবন্ধটি বাহির করিয়া এখন একবার
তাঁহাকে পড়িতে দিই। আপনি সামান্য পোষ্টমাষ্টার, তাই আপনাকে
শ্বশুর বলিতে তাঁহার আপত্তি। তাঁহার পিতার কাছে এ প্রস্তাব
উপস্থিত করিলে, তিনি যে ফর্দ্দ বাহির করিতেন তাহাতে অনেক রাজা
মহারাজকে পৃষ্ঠভঙ্গ দিতে হইত, অথবা পাগলের প্রলাপ বলিয়া কথাটা
হাসিয়াই উড়াইয়া দিতেন।
যাহা হউক এই এমা্, এ পাশগ্রস্ত ভদ্রলোকটির কাছ হইতে বিদায়
লইয়া, আমি অপেক্ষাকৃত অল্প পাশওয়ালা একটি ছেলের সঙ্গে দেখা
করিলাম। এ ছেলেটি আমার বড়ই বাধ্য ছিল, গত বত্সরে এলা্ এ
পাশ করিয়া এখন মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়িতেছে, অবস্থা মন্দ
নয়। শুনিয়াছিলাম এ ছেলেটির বিবাহ করিবার ইচ্ছা আছে, একটি ভাল
মেয়ে হইলেই হয়, টাকা কড়ির দিকে দৃষ্টি নাই, তাই তাহার কাছে
গিয়াছিলাম; তাহাকেও সমস্ত কথা খুলিয়া বলিলাম। সে সম্মত হইল;
কিন্তু টাকা কড়ি কিছু পাইবার আশা নাই শুনিয়া বলিল, "আমার
কোন আপত্তি নাই বটে, কিন্তু মা বাপের অমতে ত কিছু করিতে পারি
না, আমাদের ধর্ম্ম-শাস্ত্রেই ত আছে, "পিতাস্বর্গ পিতাধর্ম্ম
পিতাহি পরমন্তপঃ", পিতার অসম্মতিতে আমার কোন কাজ করিবার
ক্ষমতা নাই।" বুঝিলাম ইনিও সেই দলের। মাষ্টার মহাশয়,
কলিকাতার ছাত্রদলের মধ্যে আপনার কন্যার বিবাহের আশা ত ছাড়িয়া
দিয়াছি; নগদ পাঁচ হাজার, অভাব পক্ষে তিন চারি হাজার টাকার
কমে কালেজের ছেলের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া অসম্ভব। আমি কি করিব
কিছুই ভাবিয়া পাইতেছি না, অথচ শীঘ্র বিবাহ দেওয়া চাই। আপনি
বড় দাদাকে এ সম্বন্ধে একটু বিশেষ করিয়া বলিবেন। মধ্যবিত্ত
গৃহস্থের মধ্যে তাঁহার অনুগত অনেক লোক আছে। তিনি যদি চেষ্টা
করেন ত কৃতকার্য্য হইবার যথেষ্ট আশা আছে। আমি ভাল আছি। আপনারা
কেমন আছেন? উষা ও নিশাকে আমার ভালবাসা জানাইবেন। ইতি।
আপনার স্নেহের বিনয়।
(৩)
ভাই বিনয়,
আমি তোমাকে পূর্ব্বেই
বলিয়াছিলাম, পাশ করা ছেলেদের দিকে যাইও না। তুমি আমাকে কতবার
বলিয়াছ, পাশ করা ছেলেরা কি এতই নিষ্ঠুর? তুমি নিজের মত সকলকেই
দেখ; তুমি বিবাহ করিয়া এক পয়সাও লও নাই, তাই মনে করিয়াছিলে,
তোমার সঙ্গে মিশিয়া যাহারা স্বার্থপরতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে
হৈচৈ করিত, সকলেই সেই রকম করিবে; তাই উষা ও নিশার জন্য পাত্র
খুঁজিতে গিয়া তোমাকে ভগ্নপ্রয়াস হইতে হইয়াছে। সংসারের বাহিরে
যেমন দেখা যায়, ভিতরটাও যদি সে রকম হইত, তবে আর দুঃখ ছিল কি?
লোকে মুখে যাহা বলে, কাজেও যদি তাহা করিত, তাহা হইলে কি আর
ভাবিতে হইত? কলিকাতা সহর খুঁজিয়া দেখিও, কালেজের পাশের খাতা
লইয়া বাড়ী বাড়ী অনুসন্ধান করিও; দেখিবে, ধন মানের দিকে না
চাহিয়া বিবাহ করিতে প্রস্তুত, এমন ছেলে শতকরা একটি মেলা কঠিন।
আমার মত কুড়ি টাকা বেতনের পোষ্ট মাষ্টারকে শ্বশুর বলিয়া পরিচয়
দিতে একজন এম, এ, পাশ করা বাবুর লজ্জা হওয়াই উচিত; বরং তাহা
না হওয়াই আজকালের দিনে আশ্চর্য্য। উদরান্ন জুটাইতে পারি না,
চার পাঁচ হাজার টাকা কোথায় পাইব ভাই? তোমার দাদা অনুগ্রহ করিয়া
এই বিপদে আমাকে তিন শত টাকা সাহায্য করিতে প্রতিশ্রুত হইয়াছেন,
তাহাই আমার সম্বল। তিন শত টাকায় যে রকম বর পাওয়া যায়, তাহারইই
সন্ধান করিও। তোমার দাদাও চারিদিকে অনুসন্ধান করিতেছেন। কি
বলিয়া তোমাদের আশীর্ব্বাদ করিব? ভগবানা্ তোমাদের চিরসুখী
করুন,-তোমরা বিপন্নের বান্ধব।
হতভাগ্য রজনী।
(৪)
প্রিয়তম বিনয়,
তুমি শুনিয়া সুখী হইবে,
রজনীবাবুর দুই মেয়ের বিবাহের জন্য আমি পাত্র ঠিক করিয়াছি;
মেয়ে যেমন, ছেলে দুটি তেমন হইল না; কি করিব বল, চেষ্টার ত্রুটি
করি নাই। রজনী বাবুর মেয়ে দুটি সত্য সত্যই রাজার পুত্রবধূ
হইবার যোগ্য; যদি আমার আর ছোট ভাই থাকিত, তবে উষাকে আমাদের
ঘরে আনিয়া ঘর আলো করিতাম। আমাদের হরিপুরের তহবিলদার রাজকৃষ্ণ
মিত্রকে তুমি চিনিতে। গতবত্সর তাহার মৃত্যু হওয়ায় তাহার
বড় ছেলে হরেকৃষ্ণকে আমি সেই কাজ দিয়াছি; ছেলেটি বেশ শান্ত
শিষ্ট, বেশ বুদ্ধিমানও বটে, তবে লেখাপড়া ভাল জানে না। এ এক
বত্সর কাজ কর্ম্মও বেশ করিতেছে। খুব বিশ্বাসী। আমার বিশ্বাস,
তাহার সঙ্গে বিবাহ দিলে উষা কখনও খাওয়া পরার কষ্ট পাইবে না।
হরেকৃষ্ণের ছোট ভাই মাইনর স্কুলের প্রথম শ্রেণীতে পড়িতেছে,
বয়স সতের বত্সর; মাইনরটা পাশ করিলে, আমি মনে করিতেছি, তাহাকে
কলিকাতায় রাখিয়া ক্যাম্বেলস্কুলে ডাক্তারি পড়াইব, নিশার সঙ্গে
তাহার এক রকম মানাইবে। ইহারা আমার বিশেষ বাধ্য বলিয়াই আমার
কথায় সম্মত হইয়াছে। সেদিন পোষ্টমাষ্টারকে ডাকাইয়া সকল কথা
বলিয়াছি। তিনি ছেলে দুটিকেও দেখিয়াছেন, এ বিবাহে তাঁহার অমত
নাই। খরচ পত্রের একটা ফর্দ্দ ধরিয়া দেখা গেল, মোটামুটি হিসাব
করিয়া দেখিলাম, সাড়ে ন শ টাকার কমে কিছুতেই দুই মেয়ে পার করা
যায় না। আমি তিনশ টাকা দিতে চাহিয়াছিলাম, মা বলেন স্বজাতির
ছেলে কন্যাদায়ে পড়িয়াছে, বিশেষ আমাদের বড় অনুগত লোক, আরো কিছু
বেশী সাহায্য করা উচিত, ইহা অপেক্ষা পূণ্যের কাজ আর কিছুই
নাই। মার বড় দয়া। আমি মনে করিতেছি, চার শ টাকা দেব। তুমি কি
বল? তুমি বিবাহের সময়ে বাড়ী আসিও, তাহা হইলে রজনীবাবু বড়ই
সুখী হইবে।
এইমাত্র তোমাদের বড় বৌ আসিয়া বলিলেন, যে ছোট বৌমার ইচ্ছা দানের
জিনিষগুলিও আমরা দিই; তোমাকে সে কথা লিখিতে বলিলেন। দয়াময়ী
ছোট বৌমার কথা আমি অমান্য করিতে পারিব না, তাঁহার ইচ্ছা অপূর্ণ
রাখিতে আমার ইচ্ছা নাই। আমি বলিয়া দিয়াছি দান সামগ্রী যাহা
যাহা দেওয়া প্রয়োজন তিনি তোমাকে লিখিবেন, তিনি যেমন যেমন জিনিষের
ফরমাইস দিবেন তাহাই আনিবে, আমার মতামতের অপেক্ষা করিও না।
এখানকার সব মঙ্গল; বিনোদ বিপিন, খোকা ভাল আছে। তোমার শরীর
কেমন? ইতি-
আশীর্ব্বাদক
শ্রীবিজয়কুমার মিত্র।
(৫)
ভাই বিনয়,
তোমাদের দয়ায় এবার আমি
কন্যাদায় হইতে উদ্ধার হইতে চলিলাম। শনিবারে উষা নিশার বিবাহ
সে কথা পূর্ব্বেই লিখিয়াছি। তুমি অন্ততঃ শুক্রবারে অবশ্য অবশ্য
এখানে আসিয়া পৌঁছিবে। নানা কারণে তোমার সঙ্গে একবার দেখা করা
নিতান্ত দরকার। তোমরা যাহা সাহায্য করিয়াছ, তাহা ছাড়া আর যে
তিন চারি শত টাকা লাগিবে, তাহা আমি অন্যস্থান হইতে সংগ্রহ
করিয়াছি, তোমার সঙ্গে দেখা হইলে সমস্ত বলিব, অবশ্য অবশ্য আসিও।
হতভাগ্য রজনী।
(৬)
শ্রীচরণকমলেষু,
দাদা, আজ বুধবার; শনিবারে
রজনীবাবুর মেয়েদের বিবাহ। আপনি যাইতে লিখিয়াছিলেন, রজনীবাবুও
যাইবার জন্য বিশেষ অনুরোধ করিয়া পত্র লিখিয়াছেন, বাড়ী হইতেও
পত্র পাইয়াছি, কিন্তু আমার যাওয়ার বিশেষ বিঘ্ন উপস্থিত। শনিবারে
Oriental Tea Companyর মীটিং; কোম্পানির কাজকর্ম্মের বিশৃঙ্খলতার
কথা পূর্ব্বেই লিখিয়াছি। এই মীটিংে হিসাব পত্র পরীক্ষা ও ভবিষ্যতের
কাজকর্ম্মের বন্দোবস্ত স্থির হইবে। আমার সে সভায় উপস্থিত থাকা
নিতান্ত দরকার। যদি আপনি এখানে থাকিতেন, তাহা হইলে আমি যাইতে
পারিতাম। এই পত্রপাঠ আপনি চলিয়া আসিয়া শনিবারের মীটিং এ উপস্থিত
থাকিলে চলিতে পারে বটে, কিন্তু আমি ভাবিয়া দেখিলাম আমি বাড়ী
গিয়া রজনীবাবুর মেয়ের বিবাহের কিছুই বন্দোবস্ত করিতে পারিব
না, আপনি ত জানেন, ও সকল কাজে আমার কিছুমাত্র অভিজ্ঞতা নাই,
সুতরাং আমার এখানকার কাজ লইয়াই থাকা ভাল। বিবাহে আপনি যাহা
সাহায্য করিতেছেন, তাহা বেশ হইয়াছে। বাড়ীর মেয়েরা যেন বিবাহের
দিন রজনী বাবুর বাড়ীতে যান, নতুবা তিনি মনে করিবেন, গরীব বলিয়া
উপেক্ষা করিয়া বাড়ীর বৌ ঝিরা তাঁহার বাড়ীতে গেলেন না। দানের
জিনিষ পত্রগুলি আমি নিজে দেখিয়া কিনিয়াছি, আজ রাত্রে সেগুলি
রেলোয়ে পার্শেলে রওনা করিব। ইতি-
সেবক শ্রীবিনয়কুমার মিত্র।
পুঃ-পোষ্ট মাষ্টার বাবুকে আর পৃথক পত্র লিখিলাম না, আপনিই
তাঁহাকে সকল কথা বলিবেন। আর একটা কথা-তিনি অবশিষ্ট তিন চারি
শত টাকা কোথা হইতে সংগ্রহ করিলেন?
বিনয়।
(৭)
প্রিয়তমে,
তোমার পত্র পাইলাম।
তোমার চিঠি, তাহার উপর দাদার হুকুম। এক হুকুমেই রক্ষা নেই,
তা আবার ডবল; নিজে বাজারে বাজারে ঘুরিয়া যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়া
তোমার বরাতি দানের জিনিষগুলি কিনিয়াছি, এখন তোমার পছন্দ হইলেই
সকল পরিশ্রম সফল জ্ঞান করিব। তবে কিনা তোমার মন জিনিষটি বড়ই
দুষ্প্রাপ্য; কিন্তু তাই বলিয়া ভরসা করি, এ পক্ষের সাধনার
ত্রুটি নাই।
রহস্য পরিহাসের কথা এখন থাকা্। পোষ্টমাষ্টারের পরিবারের প্রতি
তোমার দয়া দেখিয়া আমি বড়ই সুখী হইয়াছি; পোষ্ট মাষ্টারের ন্যায়
দরিদ্র পরিবার যথার্থই করুণার পাত্র। দুঃখী দরিদ্রের প্রতি
তোমার যেমন দয়া আমি যেন তাহার অনুকরণ করিতে পারি। উষা ও নিশার
জন্য কেমন সুন্দর কাপড় কিনিয়াছি দেখিও, দেখিয়া তোমার মুখ আনন্দে
ভরিয়া উঠিবে। বড় দুঃখ যে তোমার সুখের সেই ভাবখানা দেখিতে পাইলাম
না। কি করিব বল? হ্ঠাত্ এমন কাজ পড়িয়া গেল যে বিশেষ ইচ্ছা
থাকিলেও কিছুতে বাড়ী যাইবার যো নাই। মানুষের সকল ইচ্ছা পূর্ণ
হইলে আর দুঃখ ছিল কি?
উষা ও নিশার বিবাহের সম্বন্ধ করিতে গিয়া যে কষ্ট পাইয়াছি তাহা
বলিবার নহে। ছেলে পাশ করিলে আর রক্ষা নাই, ছেলেরা মা বাপ অর্দ্ধ-রাজ্য
ও এক রাজকন্যা চাহিয়া বসে, ছেলে খোজ করে মেয়েটি ডানাকাটা পরী
কিনা এবং সে লেখাপড়াতে কি রকম পরিপক্ক। তোমারও ত একটি ছেলে
হইয়াছে, তাহার বিবাহের সময় যেন তুমি সোনার ঘড়া, রূপার খাট
চাহিয়া বসিও না। গরীবের ঘর হইতে উষার মত একটি পরমা সুন্দরী
ক'নে আনিয়া তোমার পুত্রবধূ করিয়া দিব, তখন যেন তত্ত্বের জন্যে
বেয়ানকে গা'ল পাড়িও না। পোষ্টমাষ্টারের অবস্থা দেখিয়া মনে
যে কষ্ট হইয়াছে, তাহা যেন মনে থাকে।
আমি যাইতে পারিলাম না, তোমাকে একটা কাজের ভার দিতেছি। তোমাকে
আমার একটিনি করিতে হইবে; পারিবে ত? আমি জানি তুমি অতি সুন্দররূপে
সকল কাজ করিতে পারিবে; কেবল আমার মত মুখে চূরট গুঁজিয়া ধোঁয়া
ছাড়িতে আর বাজে ইয়ারকি দিতে পারিবে না। যাহা হউক আসল কাজের
তাহাতে কোন ক্ষতি হইবে না। তুমি সেদিন একা দশজনের কাজ করিও,
সকলে যেন দেখিয়া অবাকা্ হইয়া যায় যে, বড় মানুষের মেয়েতেও
সংসারের সকল কাজ করিতে পারে। তাহাদের বুঝিতে দিও যে অহঙ্কার
করিয়া বসিয়া থাকা, কি নাক তুলিয়া পরের নিন্দা করা পৃথিবীর
সকল বড় মানুষের মেয়ের স্বভাব নয়। বিবাহ শেষ হইয়া গেলে আমাকে
সংবাদ লিখিও, আর তুমি কেমন কাজ কর্ম্ম করিয়াছ তাহা লিখিয়া
জানাইও। সত্য বলিতেছি, তোমার প্রশংসা শুনিতে পাইলে আমার মনে
বড় আনন্দ হয়। খোকাকে সেখানে লইয়া যাইও না, কতকগুলো মিষ্টি
খাইয়া অসুখ করিতে পারে। আমি ভাল আছি।
তোমার বিনয়।
(৮)
প্রিয়তম বিনয়,
সর্ব্বনাশ হইয়াছে। পোষ্টমাষ্টার
গলায় দড়ি দিয়া মরিয়াছে।
বেলা দুই প্রহরের সময় বর কনে বিদায় হইয়া গিয়াছে, রাত্রে এই
ঘটনা, এখনো পুলিস আসিয়া উপস্থিত হয় নাই; ব্যাপার কি আমি ত
এখনো কিছু বুঝিতে পারিতেছি না। সবিশেষ পরে লিখিতেছি। ইতি-
আশীর্ব্বাদক বিজয়।
(৯)
ভাই বিনয়,
কাল যখন তুমি এই পত্র
পাইবে তখন আর আমি এ জগতে থাকিব না; দরিদ্রের জীবন ধারণে ফল
কি ভাই?
তোমাকে অনেক কথা বলিবার ছিল, সেই জন্যই তোমাকে অবশ্য অবশ্য
আসিতে লিখিয়াছিলাম, কিন্তু আমার প্রতি বিধাতা বিমুখ, তুমি
ইচ্ছা সত্ত্বেও আসিতে পারিলে না। আমার সময় অতি অল্প, মন ঠিক
অবস্থায় নাই, যে সকল কথা বলিব মনে করিয়াছিলাম তাহা আর বলা
হইল না, সকল কথা গুছাইয়া লিখিতে পারিব সে আশাও নাই। কন্যার
বিবাহ দিতে বসিয়া যে অন্যায়, বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছি, রাজদণ্ডে
তাহার প্রায়শ্চিত্ত হইতে পারে কিনা, জানি না। কিন্তু আমি আপনাকে
ক্ষমা করিবারও যোগ্য নহি; যে মহাপাপ করিতে কৃতসংকল্প হইয়াছি,
তাহার আর ইহকাল পরকালে প্রায়শ্চিত্ত নাই। চিরজীবন দারিদ্র্য
য্ন্ত্রণা ভোগ করিয়া আসিয়াছি, পরলোকেও অনন্ত নরক যন্ত্রনার
জন্য প্রস্তুত হইয়াছি, ইহাই আমার অদৃষ্টে ছিল, ইহাই বিধিলিপি।
তোমরা আমার জন্য যাহা করিযাছ, নিতান্ত প্রিয়তম আত্মীয়েও তাহা
অপেক্ষা অধিক করিতে পারে না। তোমাদের সে ঋণ পরিশোধ করা আমার
ক্ষুদ্র ক্ষমতার অতীত; প্রত্যুপকারের আশাতেও তোমরা এ হতভাগ্যের
উপকার কর নাই। তোমাদের দেবহৃদয়, দরিদ্রের দুঃখে দয়ার্দ্র হৃদয়
বিচলিত হইয়াছিল তাই আমার জন্য এতটা করিয়াছ; আমার কন্যার বিবাহের
ব্যয় নির্ব্বাহের জন্য পাঁচ শত টাকা সাহায্য করিয়াছ, কিন্তু
নয় শত টাকার কমে এ বিবাহ-কার্য্য সমাধা হয় না। গরীব কুড়ি টাকার
কেরাণী বাকি চারিশত টাকা কোথায় পাইব, নিরুপায়। অবশেষে যে উপায়
ছিল তাহাই অবলম্বন করিলাম। আমার হাতে যে সরকারী ক্যাষ ছিল,
তাহা হইতেই চারিশত টাকা লইয়া কোন প্রকারে কাজ শেষ পারিব। আর
যাহারা রহিল, যাহাদের মাথায় বাঁধন এ অন্তিম মুহুর্ত্তেও ছিঁড়িতে
পারিতেছি না, তাহাদের ভার তোমাদের দুই ভাইয়ের হাতেই দিয়া যাইতেছি,
জানি তোমরা তাহাদের ভার গ্রহণে কাতরতা প্রকাশ করিবে না, তাই
মরিতে আমার দুঃখ নাই। তুমি হয়ত বলিবে কেন মরিতেছি? তহবিল ভাঙ্গিয়া
ত কাহাকেও চিরজীবন রাজদণ্ড ভোগ করিতে হয় না, দুই চারি বত্সর
পরে আবার ঘরে ফিরিয়া আসিতে পারিব, আবার স্ত্রী পুত্রের মুখ
দেখিয়া শান্তিলাভ করিব। কিন্তু তাই এ দীন কলঙ্কিত জীবন লইয়া
কে পৃথিবীতে বাঁচিয়া থাকিতে চায়? জীবনের প্রলোভন কি এতই বেশী?
যদি সুনাম হারাইলাম, রাজদ্বারে বিশ্বাসঘাতক, চোর বলিয়া দণ্ডিত
হইলাম, সমস্ত সাধু লোকের সহানুভূতি হইতে নির্ব্বাসিত হইলাম,
তবে আর জীবনে কাজ কি? ইহা অপেক্ষা মৃত্যু ভাল।
সেই জন্যই আজ মরিব স্থির করিয়াছি। চিরজীবন চোর বলিয়া আমাকে
ঘৃণা করিতে হয় করিও, কিন্তু ভাই, আমার অপরাধের জন্য আমার স্ত্রী
পুত্রকে পথে বসাইও না। আমি আর তোমাদের একবিন্দুও অনুগ্রহের
পাত্র নই, কিন্তু তোমাদের করুণা ভিন্ন আমার স্ত্রী পুত্র অনাহারে
মরিবে। তাহাদের তুমি যে স্নেহ করিয়া আসিতেছ, এই হতভাগ্যের
অপরাধে তাহাদিগকে সে স্থান হইতে বঞ্চিত করিও না।
ইহার পূর্ব্বে আমি একদিনও একটি পয়সা সরকারী তহবিল হইতে লইয়া
খরচ করি নাই, কতদিন পেট ভরিয়া খাইতে পাই নাই, তথাপি সরকারী
তহবিলে হাত দিই নাই, স্বামী স্ত্রীতে দারিদ্রের প্রতি উপেক্ষা
প্রকাশ করিয়া উপবাসে দিন কাটাইয়াছি; কিন্তু কন্যাদায় উদ্ধারের
আর উপায় দেখিলাম না, নিজ হস্তে নিজের বুকে ছুরি দিলাম, সরকারী
ক্যাষ ভাঙ্গিলাম। মনে মনে এই দুঃসঙ্কল্প স্থির করিয়াইত সরকারী
তহবিল ভাঙ্গিয়াছি, এ কয়দিন এই বিষ আমার হৃদয় মন জর্জ্জরিত
করিয়া ফেলিয়াছে, তথাপি আমি প্রকাশ্যভাবে হাসিয়াছি। কেহ কি
বুঝিয়াছে বুকের মধ্যে কি সমুদ্র লুকাইয়া আমি এ কয়দিন কি ভাবে
কাটাইয়াছি?
আবার বলিতেছি ভাই, রসিক বিমলা রহিল, দুঃখিনী স্ত্রী রহিল,
হায়, আমার মৃত্যুতে কি সে আর বাঁচিবে? তথাপি যে কদিন বাঁচে,
সে কয়দিন তাহাদের মুখের দিকে চাহিও, তোমার হাতেই তাহাদের সমর্পণ
করিয়া যাইতেছি। তুমি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ দেখাইয়াছ, তোমার
মা, দাদা, স্ত্রী এতদিন ধরিয়া, আমাদের প্রতি যে দয়া করিয়া
আসিয়াছেন তাহাতে আমার বিশ্বাস, আমার স্ত্রী তোমাদের দাসীবৃত্তি
করিয়া জীবন কটাইতে পারিবে। আমি চলিলাম, যে দেশে মেয়ের বিবাহ
দিতে টাকা লাগে না, সেই দেশে চলিলাম। নরক হইলেও সে স্থান এই
নরমাংস বিক্রয়ের স্থান হইতে অনেক ভাল, সেই স্থানই আমার প্রার্থনীয়।
নরক যমরাজের কাছে আমি ছেলে বিক্রয়কারীদের নামে নালিস করিব;
পৃথিবীতে গরীবের বিচার হইল না।
বিনয়, আমার আর একটা অনুরোধ; ছেলের বিবাহ দিয়া টাকা লইও না।
গরীব লোক, যে পরিবার প্রতিপালন করিতে পারে না, সে যখন বিবাহ
করিতে যাইবে, তখন তাহার হাতে ধরিয়া নিষেধ করিও। আমার পরিণাম
দেখাইও।
মা উষা, নিশা, বাবা রসিক, স্নেহের পুতলি রাণি, প্রিয়তমে জনম-দুঃখিনী,
কি বলিয়া আজ তোমাদের কাছে বিদায় লইব? একদিনও তোমাদের সুখী
করিতে পারি নাই। সে আমার দুরদৃষ্ট, এ অক্ষমের সকল অপরাধ ক্ষমা
করিও; জন্মের মত আজ চলিলাম, বিদায় দেও।
ভাই বিনয়, একটি অপদার্থ, অকিঞ্চিত্কর জীবন পৃথিবী হইতে অপসৃত
হইল; আজ বিদায়, চির বিদায়।
তোমার হতভাগ্য রজনী।
জলধর
সেন
( 'দাসী' পত্রিকা ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দের
অক্টোবর সংখ্যা )।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
Copyright
© 2014 Abasar.net. All rights reserved.
|
অবসর-এ প্রকাশিত
পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।
|