পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
আমার
দেখা লোক
যোগেন্দ্রকুমার
চট্টোপাধ্যায়
[লেখক পরিচিতি : লেখকের সম্বন্ধে খুব বেশি
কিছু জানা যায় নি। ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দে হুগলী জেলার চন্দননগরে
জন্ম। পিতার নাম ইন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়। ১৮৮৭ খৃষ্টাব্দে
প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং হুগলী কলেজে পড়াশোনা করেন।
কেরাণীর চাকরী ছেড়ে ‘হিতবাদী’ পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসাবে
যোগদান করেন। ‘বঙ্গবন্ধু’ পত্রিকারও সম্পাদক ছিলেন। ‘হিতবাদী’
, ‘সাহিত্য’ ইত্যাদি বহু পত্র পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন।
জীবনে বহু খ্যাতনামা লোকের সংস্পর্শে যে তিনি এসেছেন সেটা
বর্তমান লেখাটি পড়লেই বোঝা যাবে। তার প্রকাশিত কযেকটি গ্রন্থ
: বৃদ্ধের বচন (১৯১৮) , আগন্তুক ( গল্প-১৯০৬) , শ্রীমন্ত সদাগর
, অমিয় উৎস , জামাই-জাঙ্গাল , সওদাগর। ১৯৬০ খৃষ্টাব্দে তার
মৃত্যু হয়।........ দীপক
সেনগুপ্ত ]
প্রথম
অংশ
আমরা যখন
বাল্যকালে স্কুলে পড়িতাম তখন চন্দননগর পালপাড়ায় একটি হরিসভা
ছিল। সেই হরিসভার সম্পাদক ছিলেন বাবু শরৎচন্দ্র পাল। শরৎবাবু
যতদিন চন্দননগরে ছিলেন, ততদিন সেই হরিসভাটি বেশ সুশৃঙ্খলায় চলিয়াছিল।
শরৎ বাবুর সময় কলিকাতা ও অন্যান্য স্থান হইতে বহু সাধক, ভক্ত
ও প্রেমিক সেই হরিসভাতে গিয়া বক্তৃতা ও সঙ্কীর্তন প্রভৃতি করিতেন।
একদিন আমরা স্কুল হইতে বাটি যাইবার সময় পথে শুনিলাম আজ কলিকাতা
হইতে কেশবচন্দ্র
সেন পালপাড়ায় বক্তৃতা
করিতে আসিবেন।
কেশবচন্দ্র
সেন
বাল্যকাল হইতেই কেশববাবুর
নাম শুনিয়াছিলাম, আর শুনিয়াছিলাম যে তিনি এক বড় গোছের ব্রাহ্ম।
কেশববাবু সম্বন্ধে তখন আমাদের জ্ঞান ঐ পর্যন্ত। যাহা হউক,
কেশববাবু চন্দননগরে আসিয়াছেন, বক্তৃতা করিবেন, তাঁহার বক্তৃতা
শুনিতে হইবে, এই আশাতে স্কুল হইতে বাটিতে আসিয়াই বই শ্লেট
ফেলিয়া, তাড়াতাড়ি আহার শেষ করিয়া ছুটিলাম পালপাড়াতে। আমি একা
ছিলাম না, আমরা একটা দল বাঁধিয়া বক্তৃতা শুনিতে গেলাম। পালপাড়ার
হরিসভা আমাদের বাড়ি হইতে প্রায় আধ মাইল।
পালপাড়ায়
উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, হরিসভার সম্মুখে রাস্তার উপর খুব বড় মেরাপ
বাঁধা হইয়াছে, মেরাপের উপর সামিয়ানা ঢাকা। রাস্তার উপর দরমা
পাতিয়া তাহার উপর সতরঞ্চ মাদুর প্রভৃতি পাতা। একদিকে স্ত্রীলোকদের
জন্য খানিকটা স্থান চিক দিয়া ঘেরা। আসরটি দেখিয়াই মনে হইল যেন
যাত্রার আসর। হরিসভার ফটক লতাপুষ্পপত্রর দ্বারা সাজান। ফটকের
ঠিক সম্মুখে একটা টেবিল ও একখানা চেয়ার, টেবিলের উপর একটা রূপার
গ্লাস, নিকটে একটা ছোট টুলের উপর একটা জলের কুঁজা। টেবিলের ডানদিকে
এবং বাঁ দিকে টেবিল হইতে দুই-তিন হাত দূরে দুই-তিনখানা করিয়া
বেঞ্চ পাতা; সেই বেঞ্চের উপর দশ-পনর জন প্রৌঢ় ও বৃদ্ধ লোক বসিয়া,
তিন-চারি জনের স্কন্ধে তানপুরা, কাহারও হাতে একতারা। দুই জনের
কোলে খোল ও মৃদঙ্গ। বক্তার আসন শূন্য, কেশববাবু তখনও সভাতে আসেন
নাই শুনিলাম, তিনি হরিসভার ভিতরে বসিয়া আছেন।
আমরা যখন
সভাক্ষেত্রে উপস্থিত হইলাম, তখন সভা লোকে লোকারণ্য, কোথাও আর
তিলধারণের স্থান নাই। যাহারা আসরে বসিবার স্থান পায় নাই, তাহারা
বাহিরে দাঁড়াইয়া আছে। আমরা বালক, আমাদের গতি কে রোধ করিবে ?
ভিড় ঠেলিয়া, ধাক্কা দিয়া এবং খাইয়া অবশেষে সেই বেঞ্চের কাছাকাছি
গিয়া পঁহুছিলাম। তখন গায়কগণ চোখ বুজিয়া গান গাহিতেছিলেন।
এস এস
করি সবে নামসঙ্কীর্ত্তন।
নামসঙ্কীর্তন প্রভুর গুণানুকীর্তন।
যে নামেতে মত্ত হয়েছিলেন সাধুগণ,
শিব শুক নারদ আদি হে,
ধ্রুব প্রহ্লাদ আদি সবে হে,
ইশা, মুসা, মহম্মদ হে,
নানক কবীর আদি সবে হে -
আমাদের
বাটিতে একখানা "ব্রহ্মসঙ্গীত" ছিল, তাহাতে ঐ গানটি
ছিল, সুতরাং গানটা আমাদের একরূপ মুখস্থই ছিল। বারংবার ঐ গানটি
গীত হইতে লাগিল। গানটি শেষ হইবার কিছু পূর্ব্বেই কেশববাবু চারিজন
ভদ্রলোকের সঙ্গে সভায় প্রবেশ করিলেন। উজ্জ্বল, গৌরবর্ণ, হাসিমুখ,
অথচ বেশ গম্ভীর, অর্দ্ধনিমীলিত চক্ষু, বেশ সুন্দর গোঁফ, দাড়ি
কামান; অতি সুন্দর মূর্ত্তি। সাদাধুতি, সাদা লংক্লথের পিরাণ,
লংক্লথের চাদর। পদে কিরূপ পাদুকা ছিল, তখন দেখিতে পাই নাই, পরে
দেখিয়াছিলাম, নাগরা জুতা। তাঁহার সঙ্গে যে চারি-পাঁচ জন লোক
সভাস্থলে আসিলেন, পরে শুনিয়াছিলাম, তাঁহাদের মধ্যে শিবনাথ শাস্ত্রী
ও নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন। নগেন্দ্রবাবুকে পরে আর কখনও
দেখি নাই, শাস্ত্রী-মহাশয়ের সহিত পরে পরিচয় হইয়াছিল, সেকথা পরে
বলিব।
কেশববাবু
সভাক্ষেত্রে প্রবেশ করিয়া উপবেশন করিলেন না, ধীর পদবিক্ষেপে
আসিয়া চেয়ারের নিকটে চক্ষুমুদিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। গান শেষ হইল,
সভা নিস্তব্ধ, সূচিপতনের শব্দ শুনিতে পাওয়া যায়। সকলেই আগ্রহপূর্ণ
দৃষ্টিতে কেশববাবুর মুখের প্রতি চাহিয়া স্থির ভাবে বসিয়া অথবা
দাঁড়াইয়া আছে। কেশববাবু নতমস্তকে হাতজোড় করিয়া - জানি না কোন
অদৃশ্য দেবতাকে প্রণাম করিলেন এবং টেবিলের উপর একটি হাত রাখিয়া
ধীরে ধীরে বক্তৃতা আরম্ভ করিলেন। তাঁহার বক্তৃতার প্রথম কথাগুলি
এখনও আমার মনে আছে। তিনি বলিলেন, " আমার পিতা পিতামহ প্রভৃতি
বৈষ্ণব ছিলেন। কিন্তু লোকে আমাকে বলে ব্রাহ্ম। " তারপর
কি বলিয়াছিলেন মনে নাই। সেদিন বক্তৃতার বিষয় ছিল " শ্রীচৈতন্যদেবের
ভক্তিমার্গ।" তের-চৌদ্দ বৎসরের কিশোর আমরা সে বক্তৃতার
মর্ম্ম কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। দেখিলাম, কেশববাবুর কণ্ঠস্বর
ক্রমশঃ উচ্চ হইতে উচ্চতর স্তরে উঠিতে লাগিল - সেই বিরাট নিস্তব্ধ
সভাক্ষেত্র সেই একটি মানুষের কণ্ঠস্বরে যেন ভরিয়া গেল। কত লোকের
চক্ষু হইতে বারিধারা ঝরিল, কেশববাবুর বক্তৃতার বিরাম নাই, যেন
ঝড় বহিয়া যাইতে লাগিল। বক্তৃতা করিতে করিতে পনর-কুড়ি মিনিট অন্তর
জল পান করিতে লাগিলেন। তিনি যত বার জল পান করিলেন, তত বারই একজন
ভদ্রলোক কুঁজা হইতে জল ঢালিয়া গ্লাস পূর্ণ করিয়া দিতে লাগিলেন।
সন্ধ্যা হইয়া গেল, আলো জ্বালা হইল। তখন এসিটিলিন গ্যাস ছিল না।
আলো জ্বালিবার জন্য পূর্ব্ব হইতেই ব্যবস্থা করা ছিল। এক বুক
উঁচু একটা বাঁশের খুঁটি, তাহার ডগাটা প্রায় একহাত চারিখানি করিয়া
চেরা। তাহার উপর একখানা সরাতে আধ সরা তেল এবং প্রত্যেক সরাতে
একটা সরিষার পুঁটুলি, সেই পুঁটুলির অগ্রভাগ - যে-অংশটা তৈলের
উপরে ছিল সেই অংশটা জ্বালিয়া দেওয়া হইল। এইরূপ দশ-বারটা আলোকে
সমস্ত সভাস্থল আলোকিত হইয়া উঠিল। বক্তার সম্মুখে টেবিলের উপর
দুইটা সেজে বাতি জ্বালিয়া দেওয়া হইল।
কেশববাবু
বোধ হয় দুই ঘণ্টা বক্তৃতা করিয়াছিলেন। বক্তৃতা শেষ হইবা মাত্র
সভাস্থল হরিধ্বনিতে বারংবার মুখরিত হইয়া উঠিল। বক্তৃতার পর নগর-সঙ্কীর্ত্তন
বাহির হইল।
মন একবার
হরি বল,
হরি হরি হরি বলে ভবসিন্ধু পারে চল।
জলে হরি স্থলে হরি, চন্দ্রে হরি সূর্য্যে হরি
অনলে অনিলে হরি, হরি, হরিময় এই ভূমণ্ডল।
এই গানটি
গাহিতে গাহিতে ভক্তের দল বাজারের দিকে গমন করিলেন। আমরা অধিক
রাত্রি হইতেছে দেখিয়া ঘরের ছেলে ঘরে ফিরিলাম।
ব্রহ্মানন্দ
কেশবচন্দ্র সেনের সাক্ষাৎ লাভের দুই বৎসর কি দেড় বৎসর পরে আর
একজন মহাপুরুষের দর্শনলাভ আমার ভাগ্যে ঘটিয়াছিল। তিনি জগদ্বিখ্যাত
-পরমহংস
রামকৃষ্ণদেব ।
পরমহংস
রামকৃষ্ণদেব
পরমহংসদেবকে একদিন চার-পাঁচ
মিনিটের জন্য চোখের দেখা দেখিয়াছিলাম মাত্র। আমার পিতার এক
মাতুল অম্বিকাচরণ মুখোপাধ্যায় শ্রীরামপুরে ওকালতি করিতেন।
আমি কি একটা প্রয়োজনে তাঁহার বাসাতে গিয়াছিলাম। তাঁহার সহিত
সাক্ষাৎ করিয়া ফিরিবার সময় একটা বাগানের নিকট দেখিলাম যে দলে
দলে লোক বাগানে যাতায়াত করিতেছে। মনে করিলাম যে ভিতরে নিশ্চয়ই
একটা কিছু দর্শনীয় ঘটনা ঘটিয়াছে, যে জন্য তথায় অত লোক সমাগম
হইয়াছে। কৌতূহলবশতঃ একজনকে সেই জনতার কারণ জিজ্ঞাসা করাতে
তিনি বলিলেন যে দক্ষিণেশ্বরের পরমহংসদেব ঐ বাগানে আসিয়াছেন,
লোকে তাঁহাকে দেখিতে যাইতেছে। আমার ইচ্ছা হইল পরমহংস কিরূপ
দেখিয়া আসি। তখন পরমহংস কাহাকে বলে, সে জ্ঞান আমার ছিল না।
আমাদের বাটীতে একটা পাতলা চটি বই ছিল, তাহার নাম " শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ
পরমহংসদেবের রচনাবলী।" সেই পরমহংসই যে এই পরমহংস তাহা
আমি জানিতাম না। যাহা হউক জনতার সঙ্গে মিশিয়া বাগানে প্রবেশ
করিলাম। তখন বোধ হয় বেলা পাঁচটা। দেখিলাম একটা গাছতলায় এক
ব্যক্তি বসিয়া আছেন, একটু স্থূলকায়, দাড়ি-ছাঁটা, অর্দ্ধনীমিলিত
চক্ষু। তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া অনেক লোক বসিয়া আছে। সকলেই নীরব,
তিনি মাঝে মাঝে পার্শ্ববর্ত্তী লোকের সহিত দুই-একটা কথা বলিতেছেন।
অতি মৃদুস্বরে কথা হইতেছিল, আমি কিছুই শুনিতে পাইলাম না। যাঁহারা
বসিয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে অধিকাংশই বৃদ্ধ বা প্রৌঢ় ভদ্রলোক।
যুবক বালক একজনকেও দেখিলাম না। তাই সাহস করিয়া আর অগ্রসর না
হইয়া এক পার্শ্বে দাঁড়াইয়া রহিলাম। আমি আমার নিকটবর্ত্তী একজন
লোককে জিজ্ঞাসা করিলাম, "পরমহংস কোথায় ?" তিনি সেই
জনতার মধ্যে উপবিষ্ট দাড়ি ছাঁটা লোকটিকে দেখাইয়া বলিলেন, "উনিই
পরমহংসদেব।" আমার সেই বয়সে আমি পরমহংসদেবের সহিত সাধারণ
লোকের কিছুমাত্র প্রভেদ বুঝিতে পারিলাম না। চার-পাঁচ মিনিট
সেখানে দাঁড়াইয়া চলিয়া আসিলাম।
বাল্যকালে
পরমহংসদেবকে দেখিয়া তাঁহার অসাধারণত্ব কিছুমাত্র হৃদয়ঙ্গম করিতে
না পারিলেও পরে তাঁহার প্রিয়তম শিষ্য জগদ্বিখ্যাত বিবেকানন্দ
স্বামীকে দেখিয়া আমার মনে হইয়াছিল যে, একজন অসাধারণ মানুষকে
দেখিলাম।
বিবেকানন্দ
স্বামী
স্বামীজী আমেরিকা হইতে
প্রত্যাবর্ত্তন করিবার বৎসরেই হউক বা তাহার পর বৎসরেই হউক,
দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়িতে তাঁহাকে দেখিয়াছিলাম। তাঁহার দর্শনলাভের
পূর্ব্বেই শিকাগো ধর্ম্ম-মহাসম্মেলনে তিনি অপূর্ব্ব বক্তৃতা
করিয়া সমগ্র আমেরিকাকে মুগ্ধ করিয়াছিলেন, সেই বক্তৃতা একাধিকবার
পড়িয়াছিলাম। সুতরাং তাঁহার সম্বন্ধে আমার অতি উচ্চ ধারণা হইয়াছিল।
দক্ষিণেশ্বরের অপর পারে বালীতে আমার শ্বশুরালয়। একদিন শ্বশুরবাটীতে
গিয়া শুনিলাম যে, সেই দিন দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়িতে পরমহংসদেবের
আবির্ভাব বা তিরোভাব উপলক্ষে মহাসমারোহ হইবে। বিবেকানন্দ স্বামীর
তথায় আসিবার কথা আছে। স্বামীজী কালীবাড়িতে আসিবেন শুনিয়াই
আমি তথায় যাইবার জন্য উৎসুক হইলাম, আমার সমবয়স্ক পাঁচ-সাত
জন সঙ্গী জুটিয়া গেল। সকলে মিলিয়া একখানা নৌকা করিয়া কালীবাড়িতে
উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম যে সুপ্রশস্ত অঙ্গন লোকে লোকারণ্য।
বাঙালী অপেক্ষা মাড়োয়ারী ও হিন্দুস্থানীর সংখ্যাই অধিক বলিয়া
মনে হইল। শুনিলাম যে স্বামীজী তখনও আসেন নাই, তবে আসিবেন,
ইহা নিশ্চিত। আমি বন্ধু-বর্গ সহ নাট-মন্দিরে উঠিয়া একস্থানে
বসিয়া পড়িলাম। নাট-মন্দিরের মধ্যস্থলে একটা ছোট গালিচা পাতা
ছিল, বুঝিলাম যে, সেই আসন স্বামীজীর জন্য রিসার্ভড রাখা হইয়াছে।
আমি গালিচা হইতে কিছুদূরে বসিয়া রহিলাম। প্রায় দশ মিনিট পরে,
হঠাৎ একটা হৈ হৈ শব্দ উঠিল - ' পরমহংসদেব রামকৃষ্ণজী কা জয়
" "স্বামী বিবেকানন্দ মহারাজকী জয় ' ধ্বনিতে সেই
প্রাঙ্গন বারংবার প্রতিধ্বনি হইতে লাগিল, বুঝিলাম স্বামীজী
আসিতেছেন।
মনে করিয়াছিলাম,
স্বামীজী সন্ন্যাসী, হয়ত ধীরগম্ভীর ভাবে, মৃদু পদক্ষেপে নাট-মন্দিরে
আগমন করিবেন। কিন্তু আমার ঐ ধারণা সম্পূর্ণ ব্যর্থ করিয়া যিনি
নাট-মন্দিরে প্রবেশ করিলেন, তাঁহাতে ধীরতা বা গাম্ভীর্য্যের
কোন লক্ষণই দেখিতে পাইলাম না। উদ্দাম চঞ্চল বালকের মত যেন অস্থিরভাবে
তিনি নাট-মন্দিরে প্রবেশ করিলেন। আমরা বাহিরে জয়ধ্বনি শুনিয়া
উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিলাম। স্বামীজী নাট্যমন্দিরে প্রবেশ করিবামাত্র
আমরা তাঁহাকে দেখিবামাত্র মুগ্ধ হইলাম, তেমন উজ্জ্বল আয়ত-লোচন
আর কাহারও দেখি নাই। মুখে হাসি। স্বামীজীর প্রতিকৃতিতে সাধারণতঃ
যে ধরনের উষ্ণীষ ও আপাদলম্বিত আলখাল্লা-পরিহিত মূর্ত্তি অঙ্কিত
দেখিতে পাওয়া যায়, স্বামীজী ঠিক সেইরূপ পোষাকই পরিয়াছিলেন। তাঁহার
সঙ্গে আরও পাঁচ-সাতজন সন্ন্যাসী আসিয়াছিলেন, তাঁহাদের পরিচ্ছদও
স্বামীজীর পরিচ্ছদের অনুরূপ। তাঁহারাও বেশ সুশ্রী, উন্নত ললাট,
গৌরবর্ণ, দেখিলে বুঝিতে পারা যায় তাঁহারাও ধার্ম্মিক, বুদ্ধিমান,
বিদ্বান। কিন্তু স্বামীজীর চক্ষুর মত অত উজ্জ্বল চক্ষু কাহারও
দেখিলাম না। স্বামীজীর পার্শ্বে তাঁহাদিগকে যেন একটু নিষ্প্রভ
বলিয়া বোধ হইল।
নাট-মন্দিরে
প্রবেশ করিয়া স্বামীজী যাহা করিলেন, তাহা আমি দেখিয়া একেবারে
স্তম্ভিত ও মুগ্ধ হইলাম, মনে মনে একটু যে গর্ব্বও অনুভব করি
নাই তাহা নহে। স্বামীজীকে দেখিয়া সকলেই করজোড়ে ললাট স্পর্শ করিয়া
প্রণাম করিতে লাগিল, তিনি এবং তাঁহার সমভিব্যাহারী সন্ন্যাসীরাও
প্রতিনমস্কার করিতে করিতে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। এমন সময় প্রায়
আট-দশ হাত দূর হইতে তাঁহার সহিত আমার দৃষ্টি-বিনিময় হইবামাত্র
তিনি আমাকে নমস্কার করিয়াই একেবারে আমার নিকট আসিলেন। আমার বন্ধুরা
মনে করিলেন যে স্বামীজীর সহিত হয়ত আমার পূর্ব্বপরিচয় ছিল। কিন্তু
সেই একদিন ব্যতীত আমি আর কখনও তাঁহাকে দর্শন করি নাই। তবে তাঁহাকে
একবার দেখিবার জন্য আমার মনে এক এক সময় প্রবল ইচ্ছা হইত। জানি
না, আমাকে দেখিবামাত্র তিনি আমার সেই প্রবল আগ্রহের কথা বুঝিতে
পারিয়াছিলেন কি না।
তিনি উপবেশন
করিলেন আমরাও উপবেশন করিলাম। তাঁহার সহিত বাক্যালাপ করিতে আমার
বড়ই ইচ্ছা হইতে লাগিল, কিন্তু কি কথা বলিব, খুঁজিয়া পাইলাম না।
অবশেষে জিজ্ঞাসা করিলাম, "আপনি আজ এখানে বক্তৃতা করিবেন
কি ?" তিনি বলিলেন,"এ ভীষণ ভিড়ে বক্তৃতা করা অসম্ভব।
করিলেও সকলে তাহা হয়ত শুনিতে পাইবেন না।" স্বামীজীর সহিত
আমার এই প্রথম বাক্যালাপ এবং বোধ হয় ইহাই শেষ। কারণ সেদিন তাঁহার
সহিত আর কোন কথা হইয়াছিল কি না আমার মনে নাই। স্বামীজী সেই নাট-মন্দিরে
বোধ হয় কুড়ি মিনিট বসিয়াছিলেন। এই সময়ের মধ্যে বোধ হয় দুই বার
কি তিন বার তিনি মাথার উষ্ণীষ খুলিয়া আবার বন্ধন করিয়াছিলেন।
সমস্তক্ষণ তাম্বুল চর্ব্বন করিতেছিলেন এবং চঞ্চল শিশুর মত ছট্ফট্
করিতেছিলেন। তাঁহার সেই চঞ্চল ভাব দেখিলেই মনে হইত যেন একটা
অদম্য শক্তিকে আপনার মধ্যে দমন করিয়া রাখিবার চেষ্টা করিতেছিলেন,
আর সেই শক্তি যেন বাহিরে ফুটিয়া উঠিবার চেষ্টা করিতেছিল। তাঁহার
সঙ্গী সন্ন্যাসীরা কিন্তু ধীর, স্থির ও গম্ভীর।
স্বামীজী
নাট-মন্দির হইতে বাহির হইয়া গুরুস্থান অভিমুখে অর্থাৎ পরমহংসদেবের
অধ্যুষিত কক্ষের দিকে অগ্রসর হইলেন, তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত
জনতা সেইদিকে ধাবিত হইল। আমার সঙ্গীরা আর সেই জনতার মধ্যে যাইতে
সম্মত না হওয়াতে আমরা বালী প্রত্যাবর্ত্তন করিলাম। শশুরবাড়িতে
( বালীতে ) ফিরিয়া আসিবার পর এক মজার ব্যাপার হইয়াছিল, এস্থলে
তাহার উল্লেখ করা বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হইবে না। আমার শ্বশুরমহাশয়ের
মাতামহীর ভগিনী তখন জীবিত ছিলেন। তিনি বাটীর গৃহিণী ছিলেন। রাত্রিতে
আমরা আহার করিতে বসিয়াছি, এমন সময় আমার বড় শ্যালক ( তিনিও আমার
সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে গিয়াছিলেন ) বলিলেন, "বিবেকানন্দ স্বামী
যোগিনকে দেখিয়াই উহাকে নমস্কার করিয়াছিলেন; আমরা মনে করিয়াছিলাম,
বোধ হয় যোগিনের সঙ্গে তাঁহার পূর্ব্ব পরিচয় ছিল।" সেই কথা
শুনিয়াই বৃদ্ধা সগর্ব্বে বলিয়া উঠিলেন, "নমস্কার করবে না
? হলেই বা বিবেকানন্দ। কুলিনের ছেলের মান রাখবে না ? যোগিনকে
নমস্কার করেছে একি বেশি কথা নাকি ?" বলা বাহুল্য, তিনিও
কুলীনের কন্যা, কুলীনের বধূ। সেকালের লোকের মনে কৌলীন্য গর্ব্ব
কিরূপ প্রবল ছিল তাহা তাঁহার এ-কথাতেই সকলে বুঝিতে পারিবেন।
(
সম্পূর্ণ রচনাটি ১৩৪২ বঙ্গাব্দের ‘প্রবাসী’র জ্যৈষ্ঠ , শ্রাবণ
ও ভাদ্র সংখ্যায় প্রকাশিত )|
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)