যখন ধর্ম্ম ও সমাজ সংস্কারকদিগের কথা লইয়া
আমার এই প্রবন্ধ আরম্ভ করিয়াছি তখন পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী
মহাশয়ের কথাও বলি |
পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী
পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে , কেশববাবুর সঙ্গে শাস্ত্রী-মহাশয়ও
পালপাড়ায় হরিসভায় গিয়াছিলেন , কিন্তু কেশববাবুর সহচরগণের মধ্যে
কে যে শিবনাথ শাস্ত্রী , তাহা তখন জানিতে পারি নাই | যখন কেশববাবুকে
দেখিয়াছিলাম , তাহার বোধ হয় তিন-চারি বৎসর পরে শাস্ত্রী-মহাশয়কে
চন্দননগরে দেখিয়াছিলাম এবং তাঁহার বক্তৃতা শ্রবণ করিয়াছিলাম
| চন্দননগরে ষ্টেশণ রোডের উপরে একটি ব্রাহ্মসমাজ আছে | এখন
"আছে" না বলিয়া "ছিল" বলাই বোধ হয় সঙ্গত
, কারণ এখন উহা না থাকার মধ্যে | কিন্তু আমাদের বাল্য ও যৌবনে
এই ব্রাহ্মসম্মজের অবস্থা বেশ ভাল ছিল | প্রতি রবিবারে অনেকগুলি
ব্রাহ্ম বা ব্রাহ্ম-মতাবলম্বী ভদ্রলোক সন্ধ্যার পর সমাজগৃহে
সমবেত হইতেন , উপাসনা , গান , সংকীর্ত্তন হইত , আমরাও মধ্যে
মধ্যে তথায় গিয়া বসিতাম এবং সকলকে চক্ষু মুদিত করিতে দেখিয়া
আমরাও চক্ষু মুদিয়া বসিয়া থাকিতাম এবং মাঝে মাঝে চাহিয়া দেখিতাম
যে , আর কেহ চাহিয়া আছেন কি না | সেই ব্রাহ্মসমাজের একবার
মাঘোৎসবের সময় শাস্ত্রী-মহাশয় বক্তৃতা করিতে গিয়াছিলেন | কেন
জানি না , - বোধ হয় স্থানাভাবের আশঙ্কায় , ব্রাহ্মসমাজের প্রাঙ্গণে
বক্তৃতার ব্যবস্থা না হইয়া প্রায় অর্দ্ধ মাইল দূরবর্ত্তী হাসপাতালের
মাঠে বক্তৃতার স্থান নির্দ্ধারিত হইয়াছিল | কিন্তু সেখানে
বক্তৃতা হওয়াও বোধ হয় বিধাতার অভিপ্রেত ছিল না , তাই সেই মাঠে
বক্তৃতা আরম্ভ হইবার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি আরম্ভ হইল | তখন অগত্যা
সকলে নিকটবর্ত্তী বাজারে আশ্রয় লইতে বাধ্য হইলেন | শাস্ত্রী-মহাশয়ও
বাজারে গিয়া আশ্রয় লইলেন | বাজারের মধ্যে অনেকগুলি বড় বড় খোলার
ঘর ছিল | সেগুলি ঠিক ঘর নহে , খোলার দ্বারা আচ্ছাদিত চল্লিশ-পঞ্চাশ
হাত লম্বা ও দশ-পনর হাত চওড়া স্থান , প্রাতঃকালে সেইখানে তরিতরকারি
বিক্রয় হইত | সেইরূপ একটা চালার মধ্যে , একটা দেবদারু কাঠের
বাক্সের উপর দাঁড়াইয়া শাত্রী-মহাশয় বক্তৃতা করিয়াছিলেন | লোক
হইয়াছিল মন্দ নহে , বোধ হয় তিন-চারি শত হইবে | তখন শাস্ত্রী-মহাশয়ের
বয়স বোধ হয় পঁয়তাল্লিশ বৎসরের অধিক হইবে না , কারণ তখন তাঁহার
কেশ ও শ্মশ্রু ঘোর কৃষ্ণবর্ণ দেখিয়াছিলাম |
ইহার অনেক বৎসর পরে , শাস্ত্রী-মহাশয়ের দেহত্যাগের
দুই-তিন বৎসর পূর্ব্বে , শাস্ত্রী-মহাশয় বোধ হয় চিকিৎসকের
পরামর্শে , বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ন্যায় চন্দননগরের গঙ্গার ধারে
একখানি বাটী ভাড়া লইয়া কিছুদিন বাস করিয়াছিলেন | সেই বাটীর
কিয়দংশ কয়েক বৎসর পূর্ব্বে গঙ্গার ভাঙনে ভাঙিয়া পড়িয়াছিল ,
এখনও সেই বাটীর অবশিষ্ট অংশ বিদ্যমান আছে কি গঙ্গাগর্ভে গিয়াছে
জানি না | কারণ সেই বাটীর সম্মুখস্থ পথ গঙ্গায় ভাঙ্গিয়া পড়াতে
সে-পথে আমি বহুকাল যাই নাই | বিদ্যাসাগর মহাশয় যে-বাটীতে বাস
করিতেন , শাস্ত্রী-মহাশয়ের বাটী তাহার দক্ষিণ-পূর্ব্ব কোণে
, হাটখোলা নামক পল্লীতে ছিল |
সে সময় একদিন দেখিলাম , আমার পিতার সহিত
এক শুভ্র শ্মশ্রুধারী বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমাদের বাটীতে আসিলেন
| আমার একজন বন্ধুও সেই সময় আমাদের বাটীতে ছিলেন | বাবা আমাদিগকে
ডাকিয়া সেই আগন্তুককে প্রণাম করিতে বলিলেন | আমরা উভয়ে প্রণাম
করিলে বাবা বলিলেন , "তোমরা ইঁহাকে জান না ? ইনি পণ্ডিত
শিবনাথ শাস্ত্রী |" বহুকাল পূর্ব্বে কৃষ্ণ শ্মশ্রুধারে
শাস্ত্রী-মহাশয়কে একদিন মাত্র দেখিয়াছিলাম , সুতরাং এতদিন
পরে সেই শ্বেত শ্মশ্রুধারী বৃদ্ধকে চিনিতে পারি নাই , তাহাতে
বিস্ময়ের বিষয় কিছুই নাই | বিশেষতঃ তিনি চন্দননগরে আসিয়াছেন
, বা বাবার সহিত তাঁহার আলাপ-পরিচয় হইয়াছে , তাহা আমরা জানিতম
না | পরে শুনিয়াছিলাম যে গঙ্গার তীরে বেড়াইতে গিয়া বাবার সঙ্গে
শাস্ত্রী-মহাশয়ের আলাপ হইয়াছিল | আমাদের বাটী হইতে যাইবার
সময় শাস্ত্রী-মহাশয় আমাকে এবং আমার বন্ধুকে , অবকাশ পাইলেই
তাঁহার আবাসে যাইবার জন্য আমন্ত্রণ করিয়া গেলেন | আমরা তাহার
সেই আমন্ত্রণ রক্ষায় কখনই ত্রুটি করি নাই , সময় পাইলেই তাঁহার
কাছে যাইতাম |
শাস্ত্রী-মহাশয়ের কাছে দুই-একদিন গিয়াই বুঝিতে
পারিলাম যে তাঁহার ন্যায় উন্মুক্ত হৃদয় , সরলপ্রাণ এবং সর্ব্বহিতকামী
ব্যক্তি সাধারণতঃ দেখিতে পাওয়া যায় না | তিনি আমাদের সঙ্গে
যে কত বিষয়ের কত গল্প করিতেন , তাহার ইয়ত্তা নাই | যে-দিন
যে-বিষয়ের কথা প্রথমে আরম্ভ হইত সে-দিন দুই-তিন ঘণ্টা ধরিয়া
সেই বিষয়েই গল্প চলিত | বলা বাহুল্য যে , অধিকাংশ সময়ে তিনিই
বক্তা হইতেন , আমরা শ্রোতা হইতাম | এক দিন বিদ্যানুরাগ সম্বন্ধে
কথা হইল | শাস্ত্রী-মহাশয় বলিলেন , "বিদ্যানুরাগ কাহাকে
বলে , তাহা আজকাল এ-দেশের ছেলেরা ধারণাই করিতে পারে না | আমি
বিলাতে গিয়া এক অতি দরিদ্র গৃহস্থের বাড়িতে বাসা লইয়াছিলাম
| সেই বাটিতে মাত্র চারিজন বাস করিতেন | গৃহস্বামীর বয়স বোধ
হয় আশী বৎসর , তাঁহার স্ত্রীর বয়সও পঁচাত্তর-ছিয়াত্তর বৎসর
হইবে | দুইটি কন্যা - বড়র বয়স প্রায় ষাট , ছোটর বয়সও সাতান্ন-আটান্ন
বৎসর হইবে | এই চারিজন লোক লইয়া সেই সংসার | অবস্থা অতি হীন
বলিয়া আমাকে বোর্ডার বা ভাড়াটিয়া রাখিয়াছিলেন | আমার সমস্ত
কার্য্য সেই দুইজন প্রৌঢ়া কুমারী করিতেন | আমার ঘর পরিষ্কার
করা , বিছানা করা , পোষাক পরিষ্কার করা , মায় জুতা বুরুষ পর্যন্ত
তাঁহারা দুই ভগিনীতে করিতেন | আহার্য্যই তাঁহারা দিতেন | সংসারে
সেই তিনজন স্ত্রীলোক - বৃদ্ধা এবং তাঁহারই কন্যারা সমস্ত দিন
"লেস" বুনিতেন আর বৃদ্ধ সেই লেস ফিরি করিয়া বিক্রয়
করিতেন | ইহাই ছিল তাঁহাদের উপজীবিকা | বৃদ্ধ সমস্ত দিন প্রায়
বাহিরে থাকিতেন , দিনমানে বাটীতে তাঁহাকে বড় দেখিতে পাইতাম
না | তিনি আসিতেন সন্ধ্যার পর | ঐ তিনটি স্ত্রীলোক গৃহকার্য্য
করিয়া যে-সময় লেস বুনিতেন , সেই সময় কোলের উপর একখানি করিয়া
বই খুলিয়া রাখিতেন | হাতে লেস বুনিতেছেন , আর আপন মনে পুস্তক
পড়িতেছেন , বাজে গল্প নাই , পরচর্চ্চা নাই , ঝগড়া-কলহ নাই
, যেন কলের পুতুলের মত কাজ করিয়া যাইতেন | লেস বুনিতে বুনিতে
মাঝে মাঝে পুস্তকের পাতা উল্টাইতেন | আমি তাঁহাদের শ্রমশীলতা
, ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা দেখিয়া অবাক হইয়া চাহিয়া থাকিতাম |
আমি যে-কক্ষে শয়ন করিতাম , তাহার পাশের কক্ষেই বৃদ্ধ গৃহস্বামী
শয়ন করিতেন | একদিন রাত্রি প্রায় একটার সময় আমার ঘুম ভাঙিয়া
গেল , দেখিলাম যে বৃদ্ধের কক্ষে আলো জ্বলিতেছে ; জানালার ফাটল
দিয়া সেই আলোক আমার শয্যার উপর আসিয়া পড়িয়াছে | তত রাত্রিতে
বৃদ্ধের কক্ষে আলো দেখিয়া আমার একটু ভয় হইল , ভাবিলাম হয়ত
তাঁহার কোন অসুখ করিয়া থাকিবে | আমি সংবাদ লইবার জন্য তাঁহার
কবাটে মৃদু করাঘাত করিতেই বৃদ্ধ ভিতর হইতে বলিলেন , -"Come
in Mr. Shastri" ( শাস্ত্রী-মহাশয় ভিতরে আসুন ) | আমি
দ্বার ঠেলিয়া ভিতরে গিয়া দেখিলাম বৃদ্ধ আলো জ্বালিয়া পুস্তক
পাঠ করিতেছেন ! আমি ত অবাক ! অসময়ে তাঁহার কক্ষে প্রবেশ করিবার
জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া বলিলাম , "আপনার কক্ষে আলো
জ্বলিতে দেখিয়া আমার ভয় হইয়াছিল , ভাবিলাম হয় ত আপনি অসুস্থ
হইয়াছেন |" বৃদ্ধ আমাকে ধন্যবাদ করিয়া বলিলেন , "
না কোন অসুখ করে নাই | সমস্ত দিন পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াই , পড়িতে
সময় পাই না , তাই রাত্রিতে একটু পড়াশুনা করি |" আশী বৎসরের
বৃদ্ধ ফিরিওয়ালা রাত্রি একটা-দেড়টা পর্যন্ত পড়াশুনা করিতে
পারেন ইহা ত আমাদের ধারণার অতীত | আমি সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিলাম
- " কি বই পড়িতেছিলেন , জানিতে কৌতূহল হইতেছে |"
তিনি বলিেল্ন , "History of China" ( চীন দেশের
ইতিহাস )|
আমরা শাস্ত্রী-মহাশয়ের কথা শুনিয়া স্তম্ভিত
হইলাম | সত্য সত্যই আমরা ধারণা করিতে পারি না যে প্রকৃত বিদ্যানুরাগ
কাহাকে বলে | শুনিয়াছি "টাইটানিক" স্টীমার জলমগ্ন
হইবার অব্যবহিত পূর্ব্বে ঐ স্টীমারের অন্যতম আরোহী বিখ্যাত
"Review of Reviews" পত্রের সম্পাদক মিঃ ষ্টেড মৃত্যু
আসন্ন জানিয়া একাগ্র মনে একখানা পুস্তক পাঠ করিতে আরম্ভ করিলেন
| তাহা দেখিয়া স্টীমারের কাপ্তেন তাঁহাকে সেই আসন্ন মুহূর্তে
পুস্তক পাঠের কথা জিজ্ঞাসা করিলে মিঃ স্টেড বলিয়াছিলেন - "মৃত্যু
ত এখনই হইবে | এই পুস্তকে কি আছে তাহা আমি পড়ি নাই , মৃত্যুর
পূর্ব্বে যতটুকু পারি জ্ঞান সঞ্চয় করিয়া লই |" যে-দেশে
মৃত্যুর দ্বারে উপস্থিত হইয়াও জ্ঞানসঞ্চয়ে বিরত হয় না , সেই
দেশের আশী বৎসর বয়স্ক ফিরিওয়ালা যে রাত্রি একটা পর্যন্ত জাগিয়া
জ্ঞানসঞ্চয়ে প্রবৃত্ত হইতে পারেন , ইহা বিস্ময়ের বিষয় নহে
| শাস্ত্রী-মহাশয় সাধারণ সমাজভুক্ত ব্রাহ্ম ছিলেন | তাঁহাদের
সমাজে মহিলাদের অবরোধ-প্রথা নাই | শাস্ত্রী-মহাশয় চন্দননগরে
সপরিবারে বাস করিতেন , আমি তাঁহার আবাসে বহুবার গিয়াছি , কোন
কোন দিন একাদিক্রমে দুই-তিন ঘণ্টাও বসিয়া তাঁহার গল্প শুনিয়াছি
, কিন্তু কোনদিন তাঁহার পরিবারস্থ কোন স্ত্রীলোককে আমাদের
সম্মুখে বাহির হইতে দেখি নাই | শাস্ত্রী-মহাশয় চন্দননগর ছাড়িয়া
কলিকাতায় আসিলে পরও আমি তাঁহার আবাসে গিয়া দেখা করিয়া আসিয়াছি
| সেই সময় তাঁহার পত্নীকে দুই-একদিন দেখিয়াছিলাম | শুনিয়াছিলাম
শাস্ত্রী-মহাশয়ের দুই বিবাহ ছিল , দুই পত্নীই জীবিত ছিলেন
কি না জানি না , আমি তাঁহার আবাসে একজনকেই দুই-তিন দিন দেখিয়াছিলাম
|
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়কে কয়েকবার
দেখিয়াছিলাম | আমাদের ছাত্রাবস্থায় মহর্ষি চুঁচুড়ায় হুগলী
কলেজের উত্তরে এবং ভূদেববাবুর বাটীর দক্ষিণে গঙ্গার উপরেই
একটা খুব বড় বাগানবাড়িতে বাস করিতেন | তাঁহার একখানি প্রকাণ্ড
বজরা ছিল , তিনি প্রত্যহ সেই বজরা করিয়া বেড়াইতেন | আমরাও
নৌকায় করিয়া চন্দননগর হইতে চুঁচুড়ায় কলেজে পড়িতে যাইতাম |
সেই সময় আমরা অনেকদিন মহর্ষিকে কখন-বা বজরার ভিতরে কখন-বা
ছাদের উপরে দেখিতে পাইতাম | সেই সময় একবার তাঁহার চুঁচুড়ার
বাসাতে মাঘোৎসব হইয়াছিল , সেই উৎসবক্ষেত্রেও তাঁহাকে একদিন
দেখিয়াছিলাম | তাহার পর কলেজ ছাড়িবার পর আমি যখন কলিকাতায়
আসি তখন একদিন জোড়াসাঁকোর বাটীতে গিয়া তাঁহাকে দর্শন করিবার
সৌভাগ্য হইয়াছিল | আমি সে-সময় ' তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা' য় মধ্যে
মধ্যে প্রবন্ধ লিখিতাম এবং আমার পাণ্ডুলিপিগুলি আমি ব্রাহ্মসমাজের
তদানীন্তন উপাচার্য্য এবং ' তত্ত্ববোধিনী'র সহকারী সম্পাদক
পণ্ডিত হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের হাতে দিয়া আসিতাম |
একবার পারসীকদিগের আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে আমার কয়েকটি ধারাবাহিক
প্রবন্ধ মহর্ষির খুব ভাল লাগিয়াছে , সেই জন্য তিনি ঐ প্রবন্ধের
লেখক কে , তাহা ভট্টাচার্য্য-মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন |
বলা বাহুল্য যে , ঐ সংবাদ শ্রবণে আমার অত্যন্ত আনন্দ হইল |
আমি মহর্ষিকে দেখিবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করাতে ভট্টাচার্য্য
মহাশয় আমাকে মহর্ষির নিকট লইয়া গিয়া আমার পরিচয় দিলেন | আমি
তাঁহাকে প্রণামপূর্ব্বক পদধূলি লইয়া উপবেশন করিলাম , কিন্তু
মহর্ষির সহিত কোন কথাবার্ত্তা হইল না , কারণ সে-সময় তাঁহার
দৃষ্টি-শক্তি ও শ্রবনশক্তি ছিল না বলিলেই হয় | ভট্টাচার্য্য-মহাশয়
উচ্চৈঃস্বরে দুই-একটি কথায় তাঁহার প্রশ্নের উত্তর দিবার পর
আমাকে লইয়া চলিয়া আসিলেন | সুতরাং মহর্ষিকে মাত্র " চোখের
দেখা " দেখিয়াছি , তাঁহার সহিত কোন কথাবার্ত্তার সুযোগ
আমি পাই নাই | এই 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা'তে প্রবন্ধ লিখিবার
সময়েই কবিবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , শ্রীযুক্ত ক্ষিতীন্দ্রনাথ
ঠাকুর প্রমুখ ঠাকুর পরিবারের কয়েকজনের সহিত আমার প্রথম পরিচয়
হয় | ইহার কিছু পরে , যখন আমি ' ভারতী ' পত্রিকায় ছোটগল্প
ও প্রবন্ধাদি লিখিতাম সেই সময় আমি চন্দননগর পুস্তকাগারের জন্য
পুস্তক সংগ্রহ করিবার উদ্দেশ্যে বালীগঞ্জে শ্রীমতী সরলা দেবীর
সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলাম | সরলা দেবীর সহিত তাহার পূর্ব্বেও
আমার আলাপ পরিচয় ছিল | সেদিন আমি সরলা দেবীর জননী স্বর্গীয়া
স্বর্ণকুমারী দেবীর পুস্তক সংগ্রহের জন্য গিয়াছিলাম |
স্বর্ণকুমারী দেবী
আমি তখন একটা সওদাগরী অফিসে কেরাণীগিরি করিতাম
| আপিস হইতে মধ্য্যহ্ণকালে বাহির হইয়া বালীগঞ্জে গিয়াছিলাম
| আমি শ্রীমতী সরলা দেবীকে আমার আগমনের কারণ বলিলে তিনি উঠিয়া
কক্ষান্তরে গমন করিলেন এবং ক্ষণকাল পরে আসিয়া বলিলেন , "আপনি
বসুন, মা আসছেন |" সে- সময় 'ভারতী'তে সরলা দেবীর অনূদিত
ওমর খৈয়ামের কবিতা প্রকাশিত হইতেছিল | সেই সকল কবিতা সম্বন্ধে
তাঁহার সহিত আমার কথাবার্ত্তা হইতেছিল , এমন সময় স্বর্ণকুমারী
দেবী সেই কক্ষ মধ্যে প্রবেশ করিলেন | আমি তাঁহাকে দেখিবামাত্র
উঠিয়া গিয়া প্রণাম করিলে তিনি অতি মধুর কণ্ঠে হাসিমুখে বলিলেন
, 'ব'স বাবা ব'স" এই বলিয়া তিনি উপবেশন করিলেন | আমিও
উপবেশন করিলে তিনি আমার নাম, ধাম, বিষয় কার্য্য সম্বন্ধে অনেক
প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলেন | কথায় কথায় তিনি যখন জানিতে পারিলেন
যে , দ্বারকানাথ ঠাকুরের ভগনীপতি ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায় আমার
প্রপিতামহর সহোদর , ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়ের প্রপৌত্র এটর্নী
অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় আমার জ্ঞাতিভ্রাতা , তখন তিনি সস্নেহে
বলিলেন , "ওঃ তুমি ত আমাদের ঘরের ছেলে |" এই বলিয়া
তিনি আমাদের সাংসারিক অনেক বিষয় জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন |
আমি চন্দননগর হইতে প্রত্যহ প্রাতঃকালে কখন কলিকাতায় আসি ,
সকাল কয়টার সময় আহার করিতে হয় , আপিসে কখন জলযোগ করি , বাটীতে
প্রত্যাবর্ত্তন করিবার সময় সন্ধ্যা হয় কিনা , আমার বাটীতে
কে কে আছেন প্রভৃতি অনেক কথাই জানিয়া লইলেন | আমরা যে-সময়
কথাবার্ত্তা কহিতেছিলাম , সেই সময় একবার সরলা দেবী দুই তিন
মিনিটের জন্য কক্ষান্তরে গমন করিয়া পুনরায় আসিয়া আমাদের বাকালাপে
যোগদান করিলেন | বেলা আড়াইটার সময় একজন ভৃত্য কিছু ফল ও মিষ্টান্ন
আনিয়া আমার সম্মুখস্থ টেবিলে রাখিয়া দিলে স্বর্ণকুমারী দেবী
বলিলেন , "মুখ হাতে জল দিয়ে একটু খাবার খাও |" আমি
প্রথমে একটু আপত্তি করিলে তিনি বলিলেন , " না বাবা ,
তোমার অপত্তি শুনিব না | রোজ আড়াইটার সময় তোমার জল খাওয়া অভ্যাস
, না খাইলে পিত্ত পড়িয়া অসুখ হইবে |" আমি অগত্যা সে সকল
ফল ও মিষ্টান্নের সদ্ব্যবহারে প্রবৃত্ত হইলাম | আমি বুঝিতে
পারিলাম যে , আমি আপিসে কখন জলযোগ করি সে প্রশ্নের উত্তরে
আমি বলিয়াছিলাম যে , আড়াইটার সময় , তখন সরলা দেবীকে আমার অজ্ঞাতসারে
ইঙ্গিত করিয়া দিলেন এবং সরলা দেবীও আমাদের নিকট হইতে উঠিয়া
গিয়া ভৃত্যকে ঠিক আড়াইটার সময় জলখাবার আনিতে আদেশ করিয়া আসিয়াছিলেন
| লাইব্রেরীর জন্য পুস্তক প্রার্থনা করিলে স্বর্ণকুমারী দেবী
বলিলেন , " সব বই ত আমার কাছে নাই , যে কয়খানা আছে ,
দিব |" আমার উঠিবার কিছু পূর্ব্বে তিনি তাঁহার রচিত ছয়-সাতখানি
পুস্তক আমাকে আনিয়া দিলেন | আমি তাঁহাকে প্রণাম করিয়া বিদায়
গ্রহণ করিলাম |
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর
এই ঘটনার কয়েকমাস পরে আমি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ
ঠাকুর মহাশয়ের নিকট পুস্তক ভিক্ষা করিতে গিয়াছিলাম | তিনি
তখন বালীগঞ্জে তাঁহার মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের
বাটীতে থাকিতেন | আমি সেইখানে গিয়া তাঁহার সঙ্গে দেখা করি
| আমার নাম শুনিয়াই তিনি বলিলেন , "আপনিই ‘তত্ত্ববোধিনী
পত্রিকা' ও 'ভারতী' প্রভৃতি মাসিক কাগজে প্রবন্ধ গল্প লেখেন
কি ?" আমি ঐ প্রশ্নের উত্তর দিলে তিনি বলিলেন , “আপনি
বেশ লেখেন | আপনার কথা আমি সরলার মুখে শুনিয়াছি |" আমি
তাঁহাকে আমার আগমনের উদ্দেশ্য বলিলে তিনি বলিলেন , "কোন
পুস্তক ছাপাইতে আমার যে ব্যয় হয় , সেই পুস্তক বিক্রয় করিয়া
যতদিন সে টাকাটা আদায় না-হয় , তত দিন আমি সেই পুস্তক বিনামূল্যে
দিই না | সুতরাং আপনাকে আমার সমস্ত পুস্তক দিব না | কয়েকখানা
পাইবেন |" এই বলিয়া তিনি আমাকে তিন-চারি খানা পুস্তক
আনিয়া দিলেন এবং তাহার পর বোধ হয় এক বৎসর বা দুই বৎসর পরে
দুই-এক খানা পুস্তক ডাকযোগেও পাঠাইয়া দিয়াছিলেন | সেদিন তাঁহার
সঙ্গে কথাবার্ত্তার সময় দেখিলাম যে তিনি অত্যন্ত মৃদুস্বরে
কথা কহেন | দুই-একটি কথার পর তিনি নিজেই আমাকে বলিলেন যে ,
তাঁহার হাঁপানি হইয়াছিল বলিয়া চিকিৎসকগণ তাঁহাকে উচ্চৈঃস্বরে
অথবা একাদিক্রমে অনেকক্ষণ ধরিয়া কথা কহিতে নিষেধ করিয়াছেন
| আমি সেদিন তাঁহার কাছে বোধ হয় পনর মিনিটের অধিক কাল ছিলাম
না | আমার কোন বন্ধুর পুত্র শ্রীমান হৃদয়রঞ্জনের শ্বশুর বাল্যকালে
জ্যোতিবাবুর শ্যালক-পুত্রের সহিত একক্লাসে পড়িতেন , উভয়ের
মধ্যে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল | সেই সূত্রে আমার বন্ধু বৈবাহিকের
সহিত ঠাকুরপরিবারের একটু ঘনিষ্ঠতা হইয়াছিল | তিনি সত্যেন্দ্রনাথ
ঠাকুরের পত্নীকে পিসিমা বলিয়া সম্বোধন করিতেন | আমার বন্ধুপুত্রের
সহিত তাঁহার কন্যার বিবাহ হইবার পর আমার বন্ধুপুত্র , সত্যেন্দ্রবাবুর
বাটীর প্রত্যেক কার্য্যে এমন কি মধ্যে মধ্যে বিনা কার্য্যেও
নিমন্ত্রিত হইতেন | সত্যেন্দ্রবাবু বা জ্যোতিবাবু যখন রাঁচিতে
থাকিতেন , তখনও রাঁচি হইতে আমার বন্ধুপুত্রকে সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ
করিয়া রাঁচিতে লইয়া গিয়া দশ-পনর দিন রাখিয়া দিতেন | জ্যোতিবাবুর
সহিত আমার সাক্ষাতের প্রায় কুড়ি বৎসর পরে আমার বন্ধুর পুত্রের
বিবাহ হইয়াছিল | কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় এই যে , কুড়ি-পঁচিশ
বৎসর পরেও যখন তিনি বালীগঞ্জে বা রাঁচিতে যাইতেন , তখন জ্যোতিবাবু
তাঁহার নিকট আমার সংবাদ লইতেন | হৃদয়রঞ্জনের বিবাহের পর জ্যোতিবাবু
যখন শুনিলেন যে হৃদয়রঞ্জনের বাটী চন্দননগরে তখন তিনি জিজ্ঞাসা
করেন , "চন্দননগরের যোগেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়কে তুমি
জান ?" আমি হৃদয়রঞ্জনের পিতার বাল্য বন্ধু ও প্রতিবেশী
এই কথা জ্যোতিবাবু শুনিবার পর হইতে তিনি হৃদয়রঞ্জনের নিকট
সর্ব্বদাই আমার সংবাদ জিজ্ঞাসা করিতেন | ডাকযোগে আমার নিকট
স্বরচিত পুস্তক প্রেরণ , এবং দীর্ঘকাল পরেও আমার সংবাদ জিজ্ঞাসা
- অথচ আমার সঙ্গে তাঁহার একদিন মাত্র দশ মিনিটের জন্য আলাপ
- ইহা হইতেই পাঠকগণ বুঝিতে পারিবেন যে জ্যোতিবাবু কিরূপ প্রকৃতির
লোক ছিলেন |