প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

আমার দেখা লোক
যোগেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়

[লেখক পরিচিতি : লেখকের সম্বন্ধে খুব বেশি কিছু জানা যায় নি। ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দে হুগলী জেলার চন্দননগরে জন্ম। পিতার নাম ইন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়। ১৮৮৭ খৃষ্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং হুগলী কলেজে পড়াশোনা করেন। কেরাণীর চাকরী ছেড়ে ‘হিতবাদী’ পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসাবে যোগদান করেন। ‘বঙ্গবন্ধু’ পত্রিকারও সম্পাদক ছিলেন। ‘হিতবাদী’ , ‘সাহিত্য’ ইত্যাদি বহু পত্র পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। জীবনে বহু খ্যাতনামা লোকের সংস্পর্শে যে তিনি এসেছেন সেটা বর্তমান লেখাটি পড়লেই বোঝা যাবে। তার প্রকাশিত কযেকটি গ্রন্থ : বৃদ্ধের বচন (১৯১৮) , আগন্তুক ( গল্প-১৯০৬) , শ্রীমন্ত সদাগর , অমিয় উৎস , জামাই-জাঙ্গাল , সওদাগর। ১৯৬০ খৃষ্টাব্দে তার মৃত্যু হয়।........ দীপক সেনগুপ্ত ]

দ্বিতীয় অংশ

যখন ধর্ম্ম ও সমাজ সংস্কারকদিগের কথা লইয়া আমার এই প্রবন্ধ আরম্ভ করিয়াছি তখন পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয়ের কথাও বলি |

পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী

পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে , কেশববাবুর সঙ্গে শাস্ত্রী-মহাশয়ও পালপাড়ায় হরিসভায় গিয়াছিলেন , কিন্তু কেশববাবুর সহচরগণের মধ্যে কে যে শিবনাথ শাস্ত্রী , তাহা তখন জানিতে পারি নাই | যখন কেশববাবুকে দেখিয়াছিলাম , তাহার বোধ হয় তিন-চারি বৎসর পরে শাস্ত্রী-মহাশয়কে চন্দননগরে দেখিয়াছিলাম এবং তাঁহার বক্তৃতা শ্রবণ করিয়াছিলাম | চন্দননগরে ষ্টেশণ রোডের উপরে একটি ব্রাহ্মসমাজ আছে | এখন "আছে" না বলিয়া "ছিল" বলাই বোধ হয় সঙ্গত , কারণ এখন উহা না থাকার মধ্যে | কিন্তু আমাদের বাল্য ও যৌবনে এই ব্রাহ্মসম্মজের অবস্থা বেশ ভাল ছিল | প্রতি রবিবারে অনেকগুলি ব্রাহ্ম বা ব্রাহ্ম-মতাবলম্বী ভদ্রলোক সন্ধ্যার পর সমাজগৃহে সমবেত হইতেন , উপাসনা , গান , সংকীর্ত্তন হইত , আমরাও মধ্যে মধ্যে তথায় গিয়া বসিতাম এবং সকলকে চক্ষু মুদিত করিতে দেখিয়া আমরাও চক্ষু মুদিয়া বসিয়া থাকিতাম এবং মাঝে মাঝে চাহিয়া দেখিতাম যে , আর কেহ চাহিয়া আছেন কি না | সেই ব্রাহ্মসমাজের একবার মাঘোৎসবের সময় শাস্ত্রী-মহাশয় বক্তৃতা করিতে গিয়াছিলেন | কেন জানি না , - বোধ হয় স্থানাভাবের আশঙ্কায় , ব্রাহ্মসমাজের প্রাঙ্গণে বক্তৃতার ব্যবস্থা না হইয়া প্রায় অর্দ্ধ মাইল দূরবর্ত্তী হাসপাতালের মাঠে বক্তৃতার স্থান নির্দ্ধারিত হইয়াছিল | কিন্তু সেখানে বক্তৃতা হওয়াও বোধ হয় বিধাতার অভিপ্রেত ছিল না , তাই সেই মাঠে বক্তৃতা আরম্ভ হইবার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি আরম্ভ হইল | তখন অগত্যা সকলে নিকটবর্ত্তী বাজারে আশ্রয় লইতে বাধ্য হইলেন | শাস্ত্রী-মহাশয়ও বাজারে গিয়া আশ্রয় লইলেন | বাজারের মধ্যে অনেকগুলি বড় বড় খোলার ঘর ছিল | সেগুলি ঠিক ঘর নহে , খোলার দ্বারা আচ্ছাদিত চল্লিশ-পঞ্চাশ হাত লম্বা ও দশ-পনর হাত চওড়া স্থান , প্রাতঃকালে সেইখানে তরিতরকারি বিক্রয় হইত | সেইরূপ একটা চালার মধ্যে , একটা দেবদারু কাঠের বাক্সের উপর দাঁড়াইয়া শাত্রী-মহাশয় বক্তৃতা করিয়াছিলেন | লোক হইয়াছিল মন্দ নহে , বোধ হয় তিন-চারি শত হইবে | তখন শাস্ত্রী-মহাশয়ের বয়স বোধ হয় পঁয়তাল্লিশ বৎসরের অধিক হইবে না , কারণ তখন তাঁহার কেশ ও শ্মশ্রু ঘোর কৃষ্ণবর্ণ দেখিয়াছিলাম |

ইহার অনেক বৎসর পরে , শাস্ত্রী-মহাশয়ের দেহত্যাগের দুই-তিন বৎসর পূর্ব্বে , শাস্ত্রী-মহাশয় বোধ হয় চিকিৎসকের পরামর্শে , বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ন্যায় চন্দননগরের গঙ্গার ধারে একখানি বাটী ভাড়া লইয়া কিছুদিন বাস করিয়াছিলেন | সেই বাটীর কিয়দংশ কয়েক বৎসর পূর্ব্বে গঙ্গার ভাঙনে ভাঙিয়া পড়িয়াছিল , এখনও সেই বাটীর অবশিষ্ট অংশ বিদ্যমান আছে কি গঙ্গাগর্ভে গিয়াছে জানি না | কারণ সেই বাটীর সম্মুখস্থ পথ গঙ্গায় ভাঙ্গিয়া পড়াতে সে-পথে আমি বহুকাল যাই নাই | বিদ্যাসাগর মহাশয় যে-বাটীতে বাস করিতেন , শাস্ত্রী-মহাশয়ের বাটী তাহার দক্ষিণ-পূর্ব্ব কোণে , হাটখোলা নামক পল্লীতে ছিল |

সে সময় একদিন দেখিলাম , আমার পিতার সহিত এক শুভ্র শ্মশ্রুধারী বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমাদের বাটীতে আসিলেন | আমার একজন বন্ধুও সেই সময় আমাদের বাটীতে ছিলেন | বাবা আমাদিগকে ডাকিয়া সেই আগন্তুককে প্রণাম করিতে বলিলেন | আমরা উভয়ে প্রণাম করিলে বাবা বলিলেন , "তোমরা ইঁহাকে জান না ? ইনি পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী |" বহুকাল পূর্ব্বে কৃষ্ণ শ্মশ্রুধারে শাস্ত্রী-মহাশয়কে একদিন মাত্র দেখিয়াছিলাম , সুতরাং এতদিন পরে সেই শ্বেত শ্মশ্রুধারী বৃদ্ধকে চিনিতে পারি নাই , তাহাতে বিস্ময়ের বিষয় কিছুই নাই | বিশেষতঃ তিনি চন্দননগরে আসিয়াছেন , বা বাবার সহিত তাঁহার আলাপ-পরিচয় হইয়াছে , তাহা আমরা জানিতম না | পরে শুনিয়াছিলাম যে গঙ্গার তীরে বেড়াইতে গিয়া বাবার সঙ্গে শাস্ত্রী-মহাশয়ের আলাপ হইয়াছিল | আমাদের বাটী হইতে যাইবার সময় শাস্ত্রী-মহাশয় আমাকে এবং আমার বন্ধুকে , অবকাশ পাইলেই তাঁহার আবাসে যাইবার জন্য আমন্ত্রণ করিয়া গেলেন | আমরা তাহার সেই আমন্ত্রণ রক্ষায় কখনই ত্রুটি করি নাই , সময় পাইলেই তাঁহার কাছে যাইতাম |

শাস্ত্রী-মহাশয়ের কাছে দুই-একদিন গিয়াই বুঝিতে পারিলাম যে তাঁহার ন্যায় উন্মুক্ত হৃদয় , সরলপ্রাণ এবং সর্ব্বহিতকামী ব্যক্তি সাধারণতঃ দেখিতে পাওয়া যায় না | তিনি আমাদের সঙ্গে যে কত বিষয়ের কত গল্প করিতেন , তাহার ইয়ত্তা নাই | যে-দিন যে-বিষয়ের কথা প্রথমে আরম্ভ হইত সে-দিন দুই-তিন ঘণ্টা ধরিয়া সেই বিষয়েই গল্প চলিত | বলা বাহুল্য যে , অধিকাংশ সময়ে তিনিই বক্তা হইতেন , আমরা শ্রোতা হইতাম | এক দিন বিদ্যানুরাগ সম্বন্ধে কথা হইল | শাস্ত্রী-মহাশয় বলিলেন , "বিদ্যানুরাগ কাহাকে বলে , তাহা আজকাল এ-দেশের ছেলেরা ধারণাই করিতে পারে না | আমি বিলাতে গিয়া এক অতি দরিদ্র গৃহস্থের বাড়িতে বাসা লইয়াছিলাম | সেই বাটিতে মাত্র চারিজন বাস করিতেন | গৃহস্বামীর বয়স বোধ হয় আশী বৎসর , তাঁহার স্ত্রীর বয়সও পঁচাত্তর-ছিয়াত্তর বৎসর হইবে | দুইটি কন্যা - বড়র বয়স প্রায় ষাট , ছোটর বয়সও সাতান্ন-আটান্ন বৎসর হইবে | এই চারিজন লোক লইয়া সেই সংসার | অবস্থা অতি হীন বলিয়া আমাকে বোর্ডার বা ভাড়াটিয়া রাখিয়াছিলেন | আমার সমস্ত কার্য্য সেই দুইজন প্রৌঢ়া কুমারী করিতেন | আমার ঘর পরিষ্কার করা , বিছানা করা , পোষাক পরিষ্কার করা , মায় জুতা বুরুষ পর্যন্ত তাঁহারা দুই ভগিনীতে করিতেন | আহার্য্যই তাঁহারা দিতেন | সংসারে সেই তিনজন স্ত্রীলোক - বৃদ্ধা এবং তাঁহারই কন্যারা সমস্ত দিন "লেস" বুনিতেন আর বৃদ্ধ সেই লেস ফিরি করিয়া বিক্রয় করিতেন | ইহাই ছিল তাঁহাদের উপজীবিকা | বৃদ্ধ সমস্ত দিন প্রায় বাহিরে থাকিতেন , দিনমানে বাটীতে তাঁহাকে বড় দেখিতে পাইতাম না | তিনি আসিতেন সন্ধ্যার পর | ঐ তিনটি স্ত্রীলোক গৃহকার্য্য করিয়া যে-সময় লেস বুনিতেন , সেই সময় কোলের উপর একখানি করিয়া বই খুলিয়া রাখিতেন | হাতে লেস বুনিতেছেন , আর আপন মনে পুস্তক পড়িতেছেন , বাজে গল্প নাই , পরচর্চ্চা নাই , ঝগড়া-কলহ নাই , যেন কলের পুতুলের মত কাজ করিয়া যাইতেন | লেস বুনিতে বুনিতে মাঝে মাঝে পুস্তকের পাতা উল্টাইতেন | আমি তাঁহাদের শ্রমশীলতা , ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা দেখিয়া অবাক হইয়া চাহিয়া থাকিতাম | আমি যে-কক্ষে শয়ন করিতাম , তাহার পাশের কক্ষেই বৃদ্ধ গৃহস্বামী শয়ন করিতেন | একদিন রাত্রি প্রায় একটার সময় আমার ঘুম ভাঙিয়া গেল , দেখিলাম যে বৃদ্ধের কক্ষে আলো জ্বলিতেছে ; জানালার ফাটল দিয়া সেই আলোক আমার শয্যার উপর আসিয়া পড়িয়াছে | তত রাত্রিতে বৃদ্ধের কক্ষে আলো দেখিয়া আমার একটু ভয় হইল , ভাবিলাম হয়ত তাঁহার কোন অসুখ করিয়া থাকিবে | আমি সংবাদ লইবার জন্য তাঁহার কবাটে মৃদু করাঘাত করিতেই বৃদ্ধ ভিতর হইতে বলিলেন , -"Come in Mr. Shastri" ( শাস্ত্রী-মহাশয় ভিতরে আসুন ) | আমি দ্বার ঠেলিয়া ভিতরে গিয়া দেখিলাম বৃদ্ধ আলো জ্বালিয়া পুস্তক পাঠ করিতেছেন ! আমি ত অবাক ! অসময়ে তাঁহার কক্ষে প্রবেশ করিবার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া বলিলাম , "আপনার কক্ষে আলো জ্বলিতে দেখিয়া আমার ভয় হইয়াছিল , ভাবিলাম হয় ত আপনি অসুস্থ হইয়াছেন |" বৃদ্ধ আমাকে ধন্যবাদ করিয়া বলিলেন , " না কোন অসুখ করে নাই | সমস্ত দিন পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াই , পড়িতে সময় পাই না , তাই রাত্রিতে একটু পড়াশুনা করি |" আশী বৎসরের বৃদ্ধ ফিরিওয়ালা রাত্রি একটা-দেড়টা পর্যন্ত পড়াশুনা করিতে পারেন ইহা ত আমাদের ধারণার অতীত | আমি সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিলাম - " কি বই পড়িতেছিলেন , জানিতে কৌতূহল হইতেছে |" তিনি বলিেল্ন , "History of China" ( চীন দেশের ইতিহাস )|

আমরা শাস্ত্রী-মহাশয়ের কথা শুনিয়া স্তম্ভিত হইলাম | সত্য সত্যই আমরা ধারণা করিতে পারি না যে প্রকৃত বিদ্যানুরাগ কাহাকে বলে | শুনিয়াছি "টাইটানিক" স্টীমার জলমগ্ন হইবার অব্যবহিত পূর্ব্বে ঐ স্টীমারের অন্যতম আরোহী বিখ্যাত "Review of Reviews" পত্রের সম্পাদক মিঃ ষ্টেড মৃত্যু আসন্ন জানিয়া একাগ্র মনে একখানা পুস্তক পাঠ করিতে আরম্ভ করিলেন | তাহা দেখিয়া স্টীমারের কাপ্তেন তাঁহাকে সেই আসন্ন মুহূর্তে পুস্তক পাঠের কথা জিজ্ঞাসা করিলে মিঃ স্টেড বলিয়াছিলেন - "মৃত্যু ত এখনই হইবে | এই পুস্তকে কি আছে তাহা আমি পড়ি নাই , মৃত্যুর পূর্ব্বে যতটুকু পারি জ্ঞান সঞ্চয় করিয়া লই |" যে-দেশে মৃত্যুর দ্বারে উপস্থিত হইয়াও জ্ঞানসঞ্চয়ে বিরত হয় না , সেই দেশের আশী বৎসর বয়স্ক ফিরিওয়ালা যে রাত্রি একটা পর্যন্ত জাগিয়া জ্ঞানসঞ্চয়ে প্রবৃত্ত হইতে পারেন , ইহা বিস্ময়ের বিষয় নহে | শাস্ত্রী-মহাশয় সাধারণ সমাজভুক্ত ব্রাহ্ম ছিলেন | তাঁহাদের সমাজে মহিলাদের অবরোধ-প্রথা নাই | শাস্ত্রী-মহাশয় চন্দননগরে সপরিবারে বাস করিতেন , আমি তাঁহার আবাসে বহুবার গিয়াছি , কোন কোন দিন একাদিক্রমে দুই-তিন ঘণ্টাও বসিয়া তাঁহার গল্প শুনিয়াছি , কিন্তু কোনদিন তাঁহার পরিবারস্থ কোন স্ত্রীলোককে আমাদের সম্মুখে বাহির হইতে দেখি নাই | শাস্ত্রী-মহাশয় চন্দননগর ছাড়িয়া কলিকাতায় আসিলে পরও আমি তাঁহার আবাসে গিয়া দেখা করিয়া আসিয়াছি | সেই সময় তাঁহার পত্নীকে দুই-একদিন দেখিয়াছিলাম | শুনিয়াছিলাম শাস্ত্রী-মহাশয়ের দুই বিবাহ ছিল , দুই পত্নীই জীবিত ছিলেন কি না জানি না , আমি তাঁহার আবাসে একজনকেই দুই-তিন দিন দেখিয়াছিলাম |

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়কে কয়েকবার দেখিয়াছিলাম | আমাদের ছাত্রাবস্থায় মহর্ষি চুঁচুড়ায় হুগলী কলেজের উত্তরে এবং ভূদেববাবুর বাটীর দক্ষিণে গঙ্গার উপরেই একটা খুব বড় বাগানবাড়িতে বাস করিতেন | তাঁহার একখানি প্রকাণ্ড বজরা ছিল , তিনি প্রত্যহ সেই বজরা করিয়া বেড়াইতেন | আমরাও নৌকায় করিয়া চন্দননগর হইতে চুঁচুড়ায় কলেজে পড়িতে যাইতাম | সেই সময় আমরা অনেকদিন মহর্ষিকে কখন-বা বজরার ভিতরে কখন-বা ছাদের উপরে দেখিতে পাইতাম | সেই সময় একবার তাঁহার চুঁচুড়ার বাসাতে মাঘোৎসব হইয়াছিল , সেই উৎসবক্ষেত্রেও তাঁহাকে একদিন দেখিয়াছিলাম | তাহার পর কলেজ ছাড়িবার পর আমি যখন কলিকাতায় আসি তখন একদিন জোড়াসাঁকোর বাটীতে গিয়া তাঁহাকে দর্শন করিবার সৌভাগ্য হইয়াছিল | আমি সে-সময় ' তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা' য় মধ্যে মধ্যে প্রবন্ধ লিখিতাম এবং আমার পাণ্ডুলিপিগুলি আমি ব্রাহ্মসমাজের তদানীন্তন উপাচার্য্য এবং ' তত্ত্ববোধিনী'র সহকারী সম্পাদক পণ্ডিত হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের হাতে দিয়া আসিতাম | একবার পারসীকদিগের আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে আমার কয়েকটি ধারাবাহিক প্রবন্ধ মহর্ষির খুব ভাল লাগিয়াছে , সেই জন্য তিনি ঐ প্রবন্ধের লেখক কে , তাহা ভট্টাচার্য্য-মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন | বলা বাহুল্য যে , ঐ সংবাদ শ্রবণে আমার অত্যন্ত আনন্দ হইল | আমি মহর্ষিকে দেখিবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করাতে ভট্টাচার্য্য মহাশয় আমাকে মহর্ষির নিকট লইয়া গিয়া আমার পরিচয় দিলেন | আমি তাঁহাকে প্রণামপূর্ব্বক পদধূলি লইয়া উপবেশন করিলাম , কিন্তু মহর্ষির সহিত কোন কথাবার্ত্তা হইল না , কারণ সে-সময় তাঁহার দৃষ্টি-শক্তি ও শ্রবনশক্তি ছিল না বলিলেই হয় | ভট্টাচার্য্য-মহাশয় উচ্চৈঃস্বরে দুই-একটি কথায় তাঁহার প্রশ্নের উত্তর দিবার পর আমাকে লইয়া চলিয়া আসিলেন | সুতরাং মহর্ষিকে মাত্র " চোখের দেখা " দেখিয়াছি , তাঁহার সহিত কোন কথাবার্ত্তার সুযোগ আমি পাই নাই | এই 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা'তে প্রবন্ধ লিখিবার সময়েই কবিবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , শ্রীযুক্ত ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ ঠাকুর পরিবারের কয়েকজনের সহিত আমার প্রথম পরিচয় হয় | ইহার কিছু পরে , যখন আমি ' ভারতী ' পত্রিকায় ছোটগল্প ও প্রবন্ধাদি লিখিতাম সেই সময় আমি চন্দননগর পুস্তকাগারের জন্য পুস্তক সংগ্রহ করিবার উদ্দেশ্যে বালীগঞ্জে শ্রীমতী সরলা দেবীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলাম | সরলা দেবীর সহিত তাহার পূর্ব্বেও আমার আলাপ পরিচয় ছিল | সেদিন আমি সরলা দেবীর জননী স্বর্গীয়া স্বর্ণকুমারী দেবীর পুস্তক সংগ্রহের জন্য গিয়াছিলাম |

স্বর্ণকুমারী দেবী

আমি তখন একটা সওদাগরী অফিসে কেরাণীগিরি করিতাম | আপিস হইতে মধ্য্যহ্ণকালে বাহির হইয়া বালীগঞ্জে গিয়াছিলাম | আমি শ্রীমতী সরলা দেবীকে আমার আগমনের কারণ বলিলে তিনি উঠিয়া কক্ষান্তরে গমন করিলেন এবং ক্ষণকাল পরে আসিয়া বলিলেন , "আপনি বসুন, মা আসছেন |" সে- সময় 'ভারতী'তে সরলা দেবীর অনূদিত ওমর খৈয়ামের কবিতা প্রকাশিত হইতেছিল | সেই সকল কবিতা সম্বন্ধে তাঁহার সহিত আমার কথাবার্ত্তা হইতেছিল , এমন সময় স্বর্ণকুমারী দেবী সেই কক্ষ মধ্যে প্রবেশ করিলেন | আমি তাঁহাকে দেখিবামাত্র উঠিয়া গিয়া প্রণাম করিলে তিনি অতি মধুর কণ্ঠে হাসিমুখে বলিলেন , 'ব'স বাবা ব'স" এই বলিয়া তিনি উপবেশন করিলেন | আমিও উপবেশন করিলে তিনি আমার নাম, ধাম, বিষয় কার্য্য সম্বন্ধে অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলেন | কথায় কথায় তিনি যখন জানিতে পারিলেন যে , দ্বারকানাথ ঠাকুরের ভগনীপতি ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায় আমার প্রপিতামহর সহোদর , ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়ের প্রপৌত্র এটর্নী অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় আমার জ্ঞাতিভ্রাতা , তখন তিনি সস্নেহে বলিলেন , "ওঃ তুমি ত আমাদের ঘরের ছেলে |" এই বলিয়া তিনি আমাদের সাংসারিক অনেক বিষয় জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন | আমি চন্দননগর হইতে প্রত্যহ প্রাতঃকালে কখন কলিকাতায় আসি , সকাল কয়টার সময় আহার করিতে হয় , আপিসে কখন জলযোগ করি , বাটীতে প্রত্যাবর্ত্তন করিবার সময় সন্ধ্যা হয় কিনা , আমার বাটীতে কে কে আছেন প্রভৃতি অনেক কথাই জানিয়া লইলেন | আমরা যে-সময় কথাবার্ত্তা কহিতেছিলাম , সেই সময় একবার সরলা দেবী দুই তিন মিনিটের জন্য কক্ষান্তরে গমন করিয়া পুনরায় আসিয়া আমাদের বাকালাপে যোগদান করিলেন | বেলা আড়াইটার সময় একজন ভৃত্য কিছু ফল ও মিষ্টান্ন আনিয়া আমার সম্মুখস্থ টেবিলে রাখিয়া দিলে স্বর্ণকুমারী দেবী বলিলেন , "মুখ হাতে জল দিয়ে একটু খাবার খাও |" আমি প্রথমে একটু আপত্তি করিলে তিনি বলিলেন , " না বাবা , তোমার অপত্তি শুনিব না | রোজ আড়াইটার সময় তোমার জল খাওয়া অভ্যাস , না খাইলে পিত্ত পড়িয়া অসুখ হইবে |" আমি অগত্যা সে সকল ফল ও মিষ্টান্নের সদ্ব্যবহারে প্রবৃত্ত হইলাম | আমি বুঝিতে পারিলাম যে , আমি আপিসে কখন জলযোগ করি সে প্রশ্নের উত্তরে আমি বলিয়াছিলাম যে , আড়াইটার সময় , তখন সরলা দেবীকে আমার অজ্ঞাতসারে ইঙ্গিত করিয়া দিলেন এবং সরলা দেবীও আমাদের নিকট হইতে উঠিয়া গিয়া ভৃত্যকে ঠিক আড়াইটার সময় জলখাবার আনিতে আদেশ করিয়া আসিয়াছিলেন | লাইব্রেরীর জন্য পুস্তক প্রার্থনা করিলে স্বর্ণকুমারী দেবী বলিলেন , " সব বই ত আমার কাছে নাই , যে কয়খানা আছে , দিব |" আমার উঠিবার কিছু পূর্ব্বে তিনি তাঁহার রচিত ছয়-সাতখানি পুস্তক আমাকে আনিয়া দিলেন | আমি তাঁহাকে প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলাম |

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর

এই ঘটনার কয়েকমাস পরে আমি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের নিকট পুস্তক ভিক্ষা করিতে গিয়াছিলাম | তিনি তখন বালীগঞ্জে তাঁহার মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের বাটীতে থাকিতেন | আমি সেইখানে গিয়া তাঁহার সঙ্গে দেখা করি | আমার নাম শুনিয়াই তিনি বলিলেন , "আপনিই ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা' ও 'ভারতী' প্রভৃতি মাসিক কাগজে প্রবন্ধ গল্প লেখেন কি ?" আমি ঐ প্রশ্নের উত্তর দিলে তিনি বলিলেন , “আপনি বেশ লেখেন | আপনার কথা আমি সরলার মুখে শুনিয়াছি |" আমি তাঁহাকে আমার আগমনের উদ্দেশ্য বলিলে তিনি বলিলেন , "কোন পুস্তক ছাপাইতে আমার যে ব্যয় হয় , সেই পুস্তক বিক্রয় করিয়া যতদিন সে টাকাটা আদায় না-হয় , তত দিন আমি সেই পুস্তক বিনামূল্যে দিই না | সুতরাং আপনাকে আমার সমস্ত পুস্তক দিব না | কয়েকখানা পাইবেন |" এই বলিয়া তিনি আমাকে তিন-চারি খানা পুস্তক আনিয়া দিলেন এবং তাহার পর বোধ হয় এক বৎসর বা দুই বৎসর পরে দুই-এক খানা পুস্তক ডাকযোগেও পাঠাইয়া দিয়াছিলেন | সেদিন তাঁহার সঙ্গে কথাবার্ত্তার সময় দেখিলাম যে তিনি অত্যন্ত মৃদুস্বরে কথা কহেন | দুই-একটি কথার পর তিনি নিজেই আমাকে বলিলেন যে , তাঁহার হাঁপানি হইয়াছিল বলিয়া চিকিৎসকগণ তাঁহাকে উচ্চৈঃস্বরে অথবা একাদিক্রমে অনেকক্ষণ ধরিয়া কথা কহিতে নিষেধ করিয়াছেন | আমি সেদিন তাঁহার কাছে বোধ হয় পনর মিনিটের অধিক কাল ছিলাম না | আমার কোন বন্ধুর পুত্র শ্রীমান হৃদয়রঞ্জনের শ্বশুর বাল্যকালে জ্যোতিবাবুর শ্যালক-পুত্রের সহিত একক্লাসে পড়িতেন , উভয়ের মধ্যে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল | সেই সূত্রে আমার বন্ধু বৈবাহিকের সহিত ঠাকুরপরিবারের একটু ঘনিষ্ঠতা হইয়াছিল | তিনি সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নীকে পিসিমা বলিয়া সম্বোধন করিতেন | আমার বন্ধুপুত্রের সহিত তাঁহার কন্যার বিবাহ হইবার পর আমার বন্ধুপুত্র , সত্যেন্দ্রবাবুর বাটীর প্রত্যেক কার্য্যে এমন কি মধ্যে মধ্যে বিনা কার্য্যেও নিমন্ত্রিত হইতেন | সত্যেন্দ্রবাবু বা জ্যোতিবাবু যখন রাঁচিতে থাকিতেন , তখনও রাঁচি হইতে আমার বন্ধুপুত্রকে সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ করিয়া রাঁচিতে লইয়া গিয়া দশ-পনর দিন রাখিয়া দিতেন | জ্যোতিবাবুর সহিত আমার সাক্ষাতের প্রায় কুড়ি বৎসর পরে আমার বন্ধুর পুত্রের বিবাহ হইয়াছিল | কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় এই যে , কুড়ি-পঁচিশ বৎসর পরেও যখন তিনি বালীগঞ্জে বা রাঁচিতে যাইতেন , তখন জ্যোতিবাবু তাঁহার নিকট আমার সংবাদ লইতেন | হৃদয়রঞ্জনের বিবাহের পর জ্যোতিবাবু যখন শুনিলেন যে হৃদয়রঞ্জনের বাটী চন্দননগরে তখন তিনি জিজ্ঞাসা করেন , "চন্দননগরের যোগেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়কে তুমি জান ?" আমি হৃদয়রঞ্জনের পিতার বাল্য বন্ধু ও প্রতিবেশী এই কথা জ্যোতিবাবু শুনিবার পর হইতে তিনি হৃদয়রঞ্জনের নিকট সর্ব্বদাই আমার সংবাদ জিজ্ঞাসা করিতেন | ডাকযোগে আমার নিকট স্বরচিত পুস্তক প্রেরণ , এবং দীর্ঘকাল পরেও আমার সংবাদ জিজ্ঞাসা - অথচ আমার সঙ্গে তাঁহার একদিন মাত্র দশ মিনিটের জন্য আলাপ - ইহা হইতেই পাঠকগণ বুঝিতে পারিবেন যে জ্যোতিবাবু কিরূপ প্রকৃতির লোক ছিলেন |

( সম্পূর্ণ রচনাটি ১৩৪২ বঙ্গাব্দের ‘প্রবাসী’র জ্যৈষ্ঠ , শ্রাবণ ও ভাদ্র সংখ্যায় প্রকাশিত )|

( ক্রমশঃ )

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।

সেকালের জনপ্রিয় লেখক ও তাঁদের লেখা

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ