ষষ্ঠ ও শেষ অংশ
স্বদেশী যুগের আর একজন
খ্যাতনামা ব্যক্তি - ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়
মহাশয়ের সহিত আমার নানা
কারণে ঘণিষ্ঠতা হইয়াছিল। উপাধ্যায় মহাশয়ের সহিত আমার প্রথম
পরিচয় হয় - বোলপুরে শান্তিনিকেতনে ত্রিশ কি বত্রিশ বৎসর পূর্ব্বে।
যখন রবীন্দ্রবাবু শান্তিনিকেতনে আট-দশটি বালককে লইয়া "ব্রহ্মচর্যাশ্রম"
নামক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, তখন আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র ধীরেন্দ্রকুমারকে
সেই বিদ্যালয়ে পাঠাইয়া দিয়াছিলাম। সেই সময় আমি বোলপুরে গিয়া
শান্তিনিকেতনে আট-দশ দিন করিয়া বাস করিয়া আসিয়াছি। উপাধ্যায়
মহাশয় সেই সময় ব্রহ্মচর্য্যাশ্রমে শিক্ষকতা করিতেন। শুনিয়াছি
তিনি অবৈতনিক শিক্ষক ছিলেন। উপাধ্যায় মহাশয় রোমান কাথলিক সম্প্রদায়ভুক্ত
খ্রীষ্টান ছিলেন। কিন্তু গৈরিক বস্ত্র বহির্ব্বাস পরিধান করিতেন,
নিরামিষ আহার করিতেন। শান্তিনিকেতনের অদূরে শালবনে একটি তৃণাচ্ছাদিত
কুটিরে তিনি বাস করিতেন, স্বহস্তে রন্ধন করিতেন। তখন আমি জানিতাম
না যে, আমার সতীর্থ চন্দননগরের বর্ত্তমান নতের ও পণ্ডিচেরীর
ব্যবস্থাপক সভার সদস্য শ্রীযুক্ত সাধুচরণ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের
ভগিনীপতি। উপাধ্যায় মহাশয়ই একদিন আমাকে কথায় কথায় বলিলেন যে,
তাঁহার খুড়তুত ভগিনীর সহিত সাধুবাবুর বিবাহ হইয়াছে। সাধুবাবুর
শ্বশুরের সহিত আমার আলাপ ছিল। তাঁহার নাম ছিল তারিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
তিনি হুগলীতে ওকালতি করিতেন। উপাধ্যায় মহাশয় বলিলেন যে, তারিণীবাবু
তাঁহার ছোট কাকা পিতার কনিষ্ঠ সহোদর। কলিকাতার রেভারেণ্ড কালীচরণ
বন্দ্যোপাধ্যায়ও উপাধ্যায় মহাশয়ের পিতার সহোদর ছিলেন। উপাধ্যায়
মহাশয়ের পূর্ব্বনাম ভবানীচরন বন্দ্যোপাধ্যায়। কালীচরন ও ভবানীচরন
ব্যতীত তাঁহাদের বাটীর আর কেহ খ্রীষ্টধর্ম্ম গ্রহণ করেন নাই।
উপাধ্যায় মহাশয় বোলপুর হইতে আসিযা কলিকাতায় যখন "সন্ধ্যা"
নামক দৈনিক সংবাদপত্র বাহির করেন, তখন তাঁহার সহিত আমার সর্ব্বদাই
দেখা হইত। তাঁহার বিলাত যাত্রার পাঁচ-ছয় দিন পূর্ব্বে আমি
তাঁহাকে চন্দননগরে আমাদের বাটীতে লইয়া গিয়াছিলাম। সেদিন বিকালে
চন্দননগর পুস্তকাগারে তাঁহার বক্তৃতা করিবার কথা ছিল। তিনি
সকালে আমাদের বাটীতে আহার করিয়া অপরাহ্ন কালে সভাতে বক্তৃতা
করেন। বাটীর মধ্যে আহারের স্থান হাইলে আমি যখন বহির্বাটীতে
তাঁহাকে ডাকিতে গেলাম, তখন তিনি বলিলেন, " আমাকে এইখানে
বাহিরে ভাত দিলে ভাল হইত। সন্ন্যাসীর গৃহস্থের অন্তঃপুরে গমন
করা নিষিদ্ধ।" আমি তাঁহার সে আপত্তি গ্রাহ্য করিলাম না,
তাঁহাকে বাটীর মধ্যে লইয়া গেলে তিনি মাকে প্রণাম করিয়া বলিলেন,
" মা, আমি আপনার বড় ছেলে।" মা বলিলেন, "হ্যাঁ
বাবা, তুমি সত্যিই আমার বড় ছেলে। তোমাকে দেখে আমার দেবিনের
মুখ মনে পড়ে।" দেবেন্দ্র নামে আমার এক অগ্রজ সহোদর ছিলেন,
ষোল বৎসর বয়সে তাঁহার মৃত্যু হয়। মা বলিলেন, " উপাধ্যায়
মহাশয়ের মুখ অনেকটা তোমার দাদার মত।" অপরাহ্ন কালে তাঁহাকে
সঙ্গে করিয়া পুস্তকাগারে লইয়া গেলাম। বক্তৃতার বিষয় ছিল "বর্ণাশ্রম
ধর্ম্ম", তিনি বাঙ্গালাতে বক্তৃতা করিবার ইচ্ছা করিয়াছিলেন,
কিন্তু সমবেত সকলের অনুরোধে ইংরেজীতেই বক্তৃতা করেন। আমার
মনে হয় "সন্ধ্যা" কাগজ তিনি বিলাত হইতে আসিয়া বাহির
করিয়াছিলেন। "সন্ধ্যা" গ্রাম্য ভাষাতে লিখিত হইত,
সাধু ভাষার সংশ্রব মাত্র ছিল না। "হিতবাদী'তে বিশুদ্ধ
ব্যাকরণ-সম্মত সাধুভাষা ব্যবহৃত হইত। সেইজন্য কাব্যবিশারদ
মহাশয় "সন্ধ্যা"র ভাষাকে মেছুনীর ভাষা বলিতেন। "সন্ধ্যা"তে
যে সকল লেখা বাহির হইত, তাহা আজকালকার দিনে একেবারে অচল। ভাষা
হিসাবে নহে, রাজবিদ্বেষ হিসাবে। ঐ সকল প্রবন্ধে গভর্নমেন্টের
বিরুদ্ধে যেরূপ সুতীব্র মন্তব্য প্রকাশিত হইত, এখন তাহার শত
ভাগের এক ভাগ কোন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইলে সংবাদপত্রের সম্পাদক,
প্রকাশক, মুদ্রাকর এবং স্বত্বাধিকারীর কারাদণ্ড ও ছাপাখানা
বাজেয়াপ্ত অবধারিত। "সন্ধ্যা" প্রতিদিন মধ্যাহ্নকালে
প্রকাশিত হইত ; উহা গরম গরম লেখার জন্য এক শ্রেণীর পাঠকের
বড়ই প্রিয় ছিল। রাজ বিদ্বেষের অপরাধ হইতে "সন্ধ্যা"
নিস্কৃতি পায় নাই। কয়েকটা লেখার জন্য "সন্ধ্যা'র বিরুদ্ধে
রাজবিদ্বেষের অভিযোগ হওয়াতে উপাধ্যায় মহাশয়কে গ্রেপ্তার করা
হয়। তাঁহার নামে ওয়ারেন্ট বাহির হইলে তিনি পুলিশ অপিসে গিয়া
আত্মসমর্মণ করেন। ঐ আত্মসমর্পণের দিন তিনি চেলির কাপড় পরিয়া
গিয়াছিলেন। পুলিশ আদালতে মামলা চলিবার সময় তিনি বলিয়াছিলেন
- "আমাকে আটক করিয়া রাখে এমন জেল এখনও তৈয়ারী হয় নাই।"
তাঁহার এই স্পর্ধা সত্যে পরিণত হইয়াছিল, মামলা শেষ হইবার পূর্ব্বেই
তাঁহার মৃত্যু হইয়াছিল। পূর্ব্বেই বলিয়াছি কলিকাতার
রেভারেণ্ড কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
মহাশয় ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের
পিতৃব্য ছিলেন। তিনি খ্রীষ্টান ছিলেন, কিন্তু সাহেব ছিলেন
না। বাটীতে কাপড় পরিতেন, সভা-সমিতিতে যাইবার সময় চোগা, চাপকান
ও প্যান্টুলান পরিধান করিতেন। শুনিয়াছি তাঁহার বাটীর মহিলারা
নাকি আলতা পরিতেন এবং অন্তঃপুরবাসিনী ছিলেন। কালীচরণবাবু সিমলাতে
বাস করিতেন। আমি তাঁহার সিমলার বাসাতে তিন-চারিদিন গিয়াছিলাম,
কিন্তু একদিনও তাঁহার বাটীর কোন স্ত্রীলোককে দেখিতে পাই নাই।
চন্দননগরে একটা সভাতে বক্তৃতা করিবার জন্য তাঁহাকে বলিতে তাঁহার
আবাসে গিয়াছিলাম। এই উপলক্ষেই আমি কয়েক বার তাঁহার নিকট গিয়াছিলাম।
সভার দিন বেলা দুইটা কি তিনটার সময় আমাদের বাড়িতে তাঁহাকে
লইয়া যাই। বাটীতে আমার পিতার সহিত তাঁহার আলাপ-পরিচয় হইল,
উভয়ে বেলা চারিটা পর্যন্ত নানা প্রকার কথাবার্ত্তা হইল। সভাতে
যাইবার পূর্ব্বে বাবা তাঁহাকে একটু জলযোগ করাইয়া সঙ্গে করিয়া
সভাতে লইয়া গেলেন। তিনিও ইংরেজীতে বক্তৃতা করিয়াছিলেন। সেই
সভাতে একটা বড় মজার ব্যাপার হইয়াছিল। ঐ সভার প্রায় এক বৎসর
পূর্ব্বে, চন্দননগর গোন্দলপাড়া স্পোর্টিং ক্লাবের উদ্যোগে
এক সভা হইয়াছিল। কলিকাতার মেট্রোপলিটান ইনষ্টিটিউশনের তদানীন্তন
প্রিন্সিপ্যাল বা অধ্যক্ষ মিঃ এন ঘোষ সেই সভাতে একটা প্রবন্ধ
পাঠ করেন। চন্দননগরে বড়সাহেব বা শাসনকর্ত্তা সেই সভাতে সভাপতির
আসন গ্রহণ করিবেন, এইরূপ কথা ছিল। পাঁচটার সময় সভা আরম্ভ হইবার
কথা, চারটা বাজিয়া গেল, বড়সাহেবের দেখা নাই। প্রায় এক ঘন্টা
অপেক্ষা করিয়াও যখন বড়সাহেবের আগমনের কোন লক্ষণই লক্ষিত হইল
না, তখন তদানীন্তন মেয়র দিননাথ চন্দ্রকে সভাপতি করিয়া সভার
কার্য্য আরম্ভ হইল। প্রায় সাড়ে ছয়টার সময় বড়সাহেব আসিয়া দেখিলেন
সভার কার্য্য চলিতেছে ; দেখিয়াই তিনি বলিলেন, "আমি সভাপতি,
আমার অনুপস্থিতে সভা হইতেছে কিরূপে ?" তখন সভার সম্পাদক
বড়সাহেবকে বুঝাইয়া বলিলেন যে, বক্তাকে কলিকাতায় ফিরিয়া যাইতে
হইবে বলিয়া, পূর্ণ এক ঘন্টা বিলম্বে সভার কার্য্য আরম্ভ করা
হয়, আরও বিলম্ব হইলে তাঁহার অত্যন্ত অসুবিধা হইত। কালীচরণবাবু
যে সভাতে বক্তৃতা করিয়াছিলেন, সেই সভাতেও সেই বড় সাহেবই সভাপতিত্ব
করিয়াছিলেন। পাঁচটার সময় সভা আরম্ভ হইবার কথা, আমরা কালীবাবুকে
লইয়া সাড়ে চারিটার কিছু পরে সভাতে গিয়া দেখি, বড়সাহেব আসিয়া
সভাপতির আসন দখল করিয়া বসিয়া আছেন, পাঁচ-সাতটা বালক ব্যতীত
সভাতে আর কেহ নাই। বেলা পাঁচটার কিছু পূর্ব্বে সভার সম্পাদক
মহাশয় উপস্থিত হইলে, বড়সাহেব তাঁহাকে বলিলেন, " আমি বেলা
চারিটার সময় আসিয়া বসিয়া আছি, তোমাদের এত বিলম্ব হইল কেন ?"
এই সভাতে সভার কার্য্য আরম্ভ হইবার প্রায় এক ঘন্টা পরে, বড়সাহেব
অন্য এক ভদ্রলোককে সভাপতির আসন প্রদান করিয়া প্রস্থান করিলেন।
গোন্দলপাড়ার সভাতে দেড় ঘন্টা বিলম্বে আসিয়াছিলেন বলিয়াই তিনি
এই সভাতে তিনি এক ঘন্টা পূর্ব্বে আসিয়া বসিয়া ছিলেন। ফরাসী
সাহেবদের punchuality-জ্ঞান এই ঘটনাতেই বুঝিতে পারা যায়। এইবার
আর একজন সেকালের খ্যাতনামা পণ্ডিত ও খ্রীষ্টানের কথা বলিয়া
এই বর্ণনা শেষ করিব। তিনি
রেভারেণ্ড
লালবিহারী দে।
আমরা তাঁহার কাছে পড়িয়াছিলাম।
১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া আমরা
হুগলী কলেজে যখন ভর্ত্তি হই, তখন লালবিহারী দে কলেজের ইংরেজী
সাহিত্যের অধ্যাপক। তিনি চন্দননগরে বাস করিতেন, নিজের গাড়ী
ছিল, প্রত্যহই সেই গাড়ী করিয়া কলেজে যাইতেন। সুতরাং আমাদের
বাল্যকাল হইতেই আমরা তাঁহাকে দেখিয়াছি, অবশেষে তাঁহার ছাত্র
হইবার সৌভাগ্যও লাভ করিয়াছিলাম, আমরা তাঁহার কাছে সাত মাস
কি আট মাস পড়িয়াছিলাম, তাহার পর তিনি পেন্সন লইলেন। তিনি খর্ব্বাকৃতি
ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ পুরুষ ছিলেন। গোঁফ-দাড়ি কামান, মাথায় চুল
লম্বা ঘাড় পর্যন্ত, কিন্তু অতি পাতলা। তিনি সাদা প্যান্টুলান
ও কাল চাপকান পরিধান করিতেন ; মাথায় brimless beer hat-এর
মত একটা কাল রঙের উঁচু টুপি, এই ছিল তাঁহার পরিচ্ছদ, তিনি
এক পারসিকের কন্যাকে বিবাহ করিয়াছিলেন। দে সাহেব স্বয়ং ঘোরতর
কৃষ্ণবর্ণ হইলেও তাঁহার পুত্রকন্যারা জননীর মত গৌরবর্ণ ছিল।
তাঁহার তৃতীয় পুত্র হর্ম্মসজী টেগোর দে আমাদের সঙ্গে এক ক্লাসে
পড়িত ; হর্ম্মসজীকে তাহার পিতামাতা বাড়ীতে "হমলু"
বলিয়া ডাকিতেন, আমরাও তাহাকে সেই নামেই ডাকিতাম। হম্লু বাঙ্গালা
বুঝিতে পারিত, কিন্তু পড়িতে বা বলিতে পারিত না। বাবুর্চি খানসামার
কাছে হিন্দী শিখিয়াছিল, তাই হিন্দী বলিতে পারিত। দে সাহেব
তাঁহার পুত্রদের নাম পারসিক ও বাঙ্গাল মিশাইয়া রাখিয়াছিলেন।
তাঁহার বড় ছেলের নাম ছিল লালু লালবিহারী দে, মধ্যম পুত্রের
নামটা আমার মনে নাই, তৃতীয় পুত্রের নাম হর্ম্মসজী টেগোর দে,
ছোট পুত্রের নাম সোরাবজী টেগোর দে। কন্যাদের নাম শুনি নাই।
লালবিহারী দের Bengal Peasant Life বা গোবিন্দ সামন্ত এবং
Folktales of Bengal সেকালের দুইখানি উৎকৃষ্ট পুস্তক ছিল।
উত্তরপাড়ার স্বনামপ্রসিদ্ধ জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় মহাশয়
একবার ঘোষণা করেন যে, বাঙ্গালী কৃষক-পরিবারের নিখুঁত বর্ণনা
কেহ বাঙ্গালা বা ইংরেজী ভাষায় লিখিতে পারিলে লেখক এক হাজার
টাকা পুরস্কার পাইবেন। পুরস্কারের আশাতে অনেকে পুস্তক লিখিয়াছিলেন,
তন্মধ্যে লালবিহারী দের গোবিন্দ সামন্তই সর্ব্বোৎকৃষ্ট বলিয়া
বিবেচিত হয়। যখন ঐ পুস্তক প্রকাশিত হয় তখন লালবিহারী দে এবং
মিঃ রো উভয়েই হুগলী কলেজে ইংরেজী সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন।
" গোবিন্দ সামন্ত " প্রকাশিত হইলে রো সাহেব নাকি
উহার সমালোচনায় বলিয়াছিলেন "written in baboo English"
অর্থাৎ বাঙ্গালীর ইংরেজী ভাষায় লিখিত। ইহার কিছুদিন পরে রো
এবং ওয়েব ইভয় শ্বেতাঙ্গ অধ্যাপক মিলিত হইয়া একখানি ইংরেজী
ব্যাকরণ প্রকাশ করেন। সেই ব্যাকরণ সাধারণতঃ 'Row's Hints'
নামে খ্যাত| ঐ পুস্তক প্রকাশিত হইলে লালবিহারী দে তাঁহার সম্পাদিত
"বেঙ্গল মিস্লেনি" নামক ইংরেজী মাসিক পত্রে ঐ ব্যাকরণের
সমালোচনায় অসংখ্য ভাষার ভুল ও ব্যাকরণের ভুল দেখাইয়াছিলেন।
সমালোচনার উপসংহারে তিনি লিখিয়াছিলেন, " যাঁহারা বাঙ্গালীর
লেখাকে 'বাবু ইংলিশ' বলিয়া বিদ্রূপ করেন, তাঁহাদের জানা উচিত
যে, বাঙ্গালীর মধ্যে এমন বিশুদ্ধ ইংরেজী লেখক আছেন, মেসার্স
রো এণ্ড ওয়েব কোম্পানী যাঁহার জুতা ফিতা খুলিবারও অযোগ্য।
এই ঘটনার পর একদিন নাকি
হুগলী কলেজে লালবিহারী দের সহিত রো সাহেবের হাতাহাতি হইবার
উপক্রম হইয়াছিল এবং রো সাহেব লালবিহারী দের সহিত এক কলেজে
অধ্যাপনা করিতে অনিচ্ছুক হইয়া কৃষ্ণনগর কলেজে চলিয়া যান। লালবিহারী
দে সুবর্ণ বণিকের পুত্র। তাঁহার বাস ছিল বর্দ্ধমান জেলার এক
পল্লীগ্রামে। আমার পিতা যখন বর্দ্ধমান কলেজের ডেপুটি ইন্স্পেক্টর
ছিলেন তখন পাঠশালা পরিদর্শন করিতে সেই গ্রামে যাইতেন। সেই
গ্রামের একজন ভদ্রলোক বাবাকে লালবিহারী দের "ভিটা"
দেখাইয়াছিলেন। আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি লালবিহারী দে দীর্ঘকাল
চন্দননগরে বাস করিয়াছিলেন। আদালতের ঠিক পশ্চিমে যে ভগ্ন অট্টালিকা
আছে, তিনি তাই ভাড়া লইয়া বাস করিতেন। আমার পিতার সঙ্গে তাঁহার
আলাপ ছিল, বাবা তাঁহাদের গ্রামে মধ্যে মধ্যে যান শুনিয়া তিনি
বাবাকে গ্রাম সম্বন্ধে কত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতেন। গ্রামের
বাহিরে সেই বকুল গাছটা আছে কি না, খোঁড়া গুরু মহাশয়ের কেহ
আছে কি না, দক্ষিণপাড়ায় নাপিতদের বাটীতে কেহ আছে কি না, সেকালের
মত ঘটা করিয়া বারোয়ারি পূজা হয় কি না প্রভৃতি সমস্ত বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে
জিজ্ঞাসা করিতেন। শৈশবের লীলাক্ষেত্র জন্মভূমির কথা ধর্ম্মান্তরগ্রাহী
পুরাদস্তুর সাহেব হইয়াও ভুলিতে পারেন নাই।
আমার এই বর্ণনা ক্রমেই
বাড়িয়া যাইতেছে, বৃদ্ধ বয়সে সূদীর্ঘ অতীত জীবনের কথা চিন্তা
করিলে একটির পর একটি কত মুখই মনে পড়ে, কত বিস্মৃতপ্রায় ঘটনার
চিত্র আমার মানসপটে পরিস্ফুট হইয়া উঠে। লিখিতে লিখিতে কত লোকের
কথা লিখিব মনে করিয়া হয় ত ভুলিয়া গিয়াছি, আবার যাঁহার কথা
দুই চারি ছত্রে সারিব মনে করি, তাঁহার কথা আর শেষ হইতে চায়
না। হয়ত এই লেখা 'প্রবাসী'তে প্রকাশিত হইবার পর এমন অনেকের
কথা মনে পড়িবে, যাহা এই প্রবন্ধে উল্লেখ করা উচিত ছিল, যাহা
উল্লেখ না করাতে এই প্রবন্ধের অঙ্গহানি হইল। কিন্তু নিরুপায়।
দুর্ব্বল স্মৃতিশক্তির উপর জুলুম চলে না।
( শেষ )|