প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

পিতৃদেব সম্বন্ধে আমার জীবনস্মৃতি

[ লেখক পরিচিতি: মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সপ্তম সন্তান ও পঞ্চম পুত্র এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৪৯ খৃষ্টাব্দের ৪ঠা মে জোড়াসাঁকোতে। রবীন্দ্রনাথের তিনি ছিলেন ‘নতুন দাদা’। বাড়িতেই পড়াশোনা শুরু করেন। পরে সেণ্ট পল্স্, মণ্টেগুজ অ্যাকাডেমি ও হিন্দু স্কুলেও পড়াশোনা করেছেন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন কিন্তু নাটকের কাজে জড়িয়ে পড়ায় এফ. এ. পরীক্ষা আর দেওয়া হয় নি। গুণেন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি জোড়াসাঁকো নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করেন। তার নাট্যজগতে প্রবেশ ‘পুরুবিক্রম’ নাটকে সফল অভিনয়ের মাধ্যমে। অন্যান্য বিখ্যাত নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘স্বপ্নময়ী’, ‘সরোজিনী’, ‘অশ্রুমতী’ ইত্যাদি। তার কিছু নাটক মারাঠি, হিন্দি ও গুজরাটি ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে। অনেকগুলি সংস্কৃত নাটকও তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। ‘গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার’-এ তার অনেক নাটক সফলভাবে মঞ্চস্থ হয়। ‘অলীক বাবু’, ‘এমন কর্ম আর করব না’, তার উল্লেখযোগ্য প্রহসন নাটক। ‘যৎকিঞ্চিৎ জলযোগ’, ‘দায়ে প’ড়ে দার পরিগ্রহ’ ইত্যাদি প্রহসন রচনাগুলিও উপভোগ্য। দাদা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি আমেদাবাদে গিয়েছিলেন; সেখানেই ফরাসী ও মারাঠী ভাষা শিক্ষা করেন। ছাবি আঁকা এবং সেতার বাজানও তিনি শিখেছিলেন।

চিত্রাঙ্কনে তিনি ছিলেন সবিশেষ পারদর্শী। তার খাতায় নামী অনামী বহু ব্যক্তির অঙ্কিত প্রতিকৃতি সঞ্চিত আছে। যখন যার সঙ্গেই তিনি পরিচিত হতেন, তার প্রতিকৃতি তিনি খাতায় এঁকে রাখতেন। প্রখ্যাত ইংরেজ শিল্পী রদেনস্টাইনের অনুরোধে তার নিজেরই নির্বাচন করা কিছু ছবি নিয়ে একটি সঙ্কলন ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যাণ্ডে প্রকাশিত হয়। স্বর্ণকুমারী দেবী লিখেছেন – “যাঁহারই সহিত তাঁহার আলাপ হইত, তাঁহারই প্রতিকৃতি তিনি অল্পায়াসে আঁকিয়া রাখিতেন এবং যে কোনো গায়ক গোঁলক ধাঁধাযুক্ত ঘূর্ণমান তানলয়ে গাহিয়া গেলেও, তিনি সঙ্গে-সঙ্গে যন্ত্রে তাহা বাজাইয়া লইতে পারিতেন। প্রথম যখন কলকাতায় হার্মোনিয়াম আমদানি হয়, তখন আমাদের বাড়ী একটি বড় হারমোনিয়াম আনা হইয়াছিল। নূতনদাদা সেই যন্ত্রটি প্রতিদিন প্রত্যূষে বাজাইতেন। আমি যখন অতি ছোট ছিলাম, - মনে পড়ে, আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাঁহার বাজনা শুনিবার জন্য ছুটিয়া যাইতাম।”

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাহিত্য প্রতিভা ছিল বহু-বিস্তৃত। ভাষাশিক্ষা ও সাহিত্যের উন্নতিকল্পে ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘বিদ্বজ্জনসমাগম’ এবং ১৮৮২-তে ‘সারস্বত সমাজ’ নামক তিনি দুটি সংগঠন গড়ে তোলেন। মাসিক পত্রিকা ‘ভারতী’ প্রকাশনায় তিনিই ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা। ‘বীণাবাদিনী’ ও ‘সঙ্গীত প্রবেশিকা’ নামে দুটি মাসিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯০২-০৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি ছিলেন। ইতিহাস, দর্শন সম্বন্ধীয় প্রবন্ধ, গল্প, ভ্রমণ কাহিনীও তিনি রচনা করেছেন। বহু গল্প ও উপন্যাস তিনি ফরাসি ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন।

তার সঙ্গীত শিক্ষা শুরু ঠাকুরবাড়ীর সঙ্গীত শিক্ষক বিষ্ণুপদ চক্রবর্তীর কাছে। ধ্রুপদ-সঙ্গীত আধারিত অনেকগুলি ব্রহ্মসঙ্গীত তিনি রচনা করেছেন। তার নিজের রচিত ‘স্বরলিপি গীতিমালা’ ও কাঙ্গালীচরণ সেন সঙ্কলিত ‘সঙ্গীত প্রবেশিকা’ নামক পুস্তকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বহু গান স্থান পেয়েছে। তিনি নিজে বহু গানের সুর দিয়েছেন। অনেক সময়ে তার গানের সুরে রবীন্দ্রনাথ কথাও বসিয়েছেন । ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে তিনি ‘ভারতীয় সঙ্গীত সমাজ’ স্থাপন করেন।

১৮৬৮ সালের ৫ই জুলাই কাদম্বরী দেবীকে তিনি বিবাহ করেন। স্ত্রীকে পড়াশোনায় উৎসাহ দেওয়া ছাড়াও সমস্ত বিরূপ সমালোচনা অগ্রাহ্য করে তাকে কলকাতার ময়দানে অশ্বচালনা শিক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক রূপে তিনি ১৮৬৯ সাল থেকে ১৯ বছর কাজ করেছেন।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্বদেশপ্রীতি ও দেশপ্রেম ছিল অসাধারণ। তার উদ্যোগে রাজনারায়ন বসুর সভাপতিত্বে ‘সঞ্জিবনী’ নামক গুপ্ত স্বদেশী সভার সূচনা হয়। এই সভার কর্মসূচী অনুসারে দেশলাই প্রস্তুত ও দেশী কাপড় বোনা শুরু হয়েছিল। স্বর্ণকুমারী দেবী লিখেছেন – ‘তাঁহার কিরূপ অপরিসীম দেশ প্রীতি ছিল, তাহারও পরিচয় তিনি নানা কাজে দেখাইয়া গিয়াছিলেন। এক সময়ে তাঁহার মনে হইয়াছিল ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় না হইলে দেশের প্রকৃত মঙ্গল সাধন হইবে না, তাই তিনি প্রথম নীলের চাষ আরম্ভ করেন। পরে, এই চাষে তাহার যাহা কিছু লাভ হইয়াছিল সমস্ত খরচ করিয়া তিনি তদানীন্তন প্রধান ইংরেজ কোম্পানির প্রতিদ্বন্দী হইয়া বরিশালে ফেরি ষ্টিমার খুলিলেন। কিন্তু দেশের লোকের সাহায্য-সহানুভূতি-সত্ত্বেও এই ব্যবসা অধিককাল স্থায়ী রাখিতে পারেন নাই। প্রভূত ক্ষতি স্বীকার করিয়া পরে সেই ষ্টিমার ইংরীজ কোম্পানিকে বিক্রয় করিয়া ফেলিতে বাধ্য হন। এই ঘটনায় তাঁহার দেশ-প্রীতি ও সৎসাহসের চূড়ান্ত পরিচয় পাওয়া যায়।"

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অন্তঃকরণ ছিল অতি উদার। একবার তার এক সামান্য বাজার সরকারের বালিকা-বধূর সঙ্গীত প্রীতি তিনি জানিতে পারেন। তিনি সেই মেয়েটিকে বাড়ীর অন্য সব মহিলার সঙ্গে সমান আদরের সঙ্গে সঙ্গীত শিক্ষা দিয়েছিলেন। স্ত্রীশিক্ষা ও নারী মুক্তি আন্দোলনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৯২৫ সালের ৪ঠা মার্চ তার মৃত্যু হয়।      
দীপক সেনগুপ্ত ]

১। কোন সময়ে পিতৃদেব সাহেবগঞ্জে গঙ্গাবক্ষে বজ্রায় অবস্থিতি করিতেছিলেন। কোন বিষয়কর্ম্ম উপলক্ষে সেই সময়ে তাঁহার সহিত আমি সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলাম। বজরার মধ্যে গিয়া দেখি, টেবিলের উপর দুই চারি খানা বাঁধান ফরাসী গ্রন্থ, আর একখানি ফরাসি-ইংরাজি অভিধান রহিয়াছে। ঐ গ্রন্থগুলি Victor Cousin-র প্রসিদ্ধ গ্রন্থ "Le vrai, Le beau, le bien" - অর্থাৎ "নিত্য, সুন্দর, মঙ্গল।" উহার ইংরাজি অনুবাদ পাঠ করিয়া তাঁহার এতই ভাল লাগিয়াছিল যে ফরাসী মূল-গ্রন্থ পড়িবার জন্য তিনি উৎসুক হইয়াছিলেন। তাই তিনি কয়েক কাপি বিলাত হইতে আনাইয়াছিলেন। তন্মধ্যে এক কাপি প্রতি পৃষ্ঠার মধ্যে সাদা কাগজ গ্রথিত করিয়া বাঁধাইয়া লইয়াছিলেন। আমি যখন গেলাম, তখন তিনি ইংরাজি অনুবাদের সহিত মিলাইয়া, অভিধানের সাহায্যে ঐ গ্রন্থ অধ্যয়ন করিতেছিলেন। মধ্যে মধ্যে যে অংশ বুঝিতে পারিতেছিলেন না, আমাকে তাহার অর্থ ব্যাখ্যা করিতে বলিলেন। কারণ, তিনি জানিতেন, আমি অল্পস্বল্প ফরাসী জানি। তাঁহার বার্ধক্যে এই অধ্যবসায় দেখিয়া আমি বিস্মিত হইয়াছিলাম। ঐ গ্রন্থ পাঠ করিবার জন্য আমার ঔৎসুক্য হইলেও সেই সময়ে আমি পাঠ করিবার অবসর পাই নাই। তাঁহার মৃত্যুর পর, সেই কীটদষ্ট গ্রন্থ বোলপুরের লাইব্রেরী হইতে আনাইয়া পাঠ করি ও অনুবাদ করিতে প্রবৃত্ত হই।

২। একদিন আমাদের বাড়ির পাঠশালায় গুরু মহাশয়ের সম্মুখে বসিয়া তালপাতায় ক, খ প্রভৃতি অক্ষরে দাগা বুলাইতেছিলাম বোধ হয় আমার বয়স তখন ৫ বৎসর - সেই সময়ে পিতৃদেব আমাদের পাশ দিয়া যাইতেছিলেন। গুরুমহাশয় উঠিয়া দাঁড়াইলেন। আমি দাঁড়াইলাম না। তিনি ফিরিয়া আসিয়া, আমাকে দাঁড়াইতে বলিলেন। আদব-কায়দার প্রতি এমন তাঁহার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল।

৩। তিনি সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। আমার প্রণীত পুরুবিক্রম, সরোজিনী, অশ্রুমতী নাটক প্রকাশিত হইলে তাঁহাকে পাঠাইয়া দিয়াছিলাম। তিনি প্রত্যেকেরই সংক্ষিপ্ত সমালোচনা করিয়া আমাকে পত্র লেখেন, সেই পত্রগুলি সযত্নে রক্ষা করি নাই বলিয়া এখন দুঃখ হয়।

৪। তিনি প্রায়ই বাহিরে বাহিরে থাকিতেন। যখনই বাড়ি আসিতেন, তিনি আমাদিগকে নানা বিষয়ে শিক্ষা ও উপদেশ দিতেন। তাঁহার তেতালার বসিবার ঘরে, দিনকতক তিনি আধুনিক জ্যোতিষশাস্ত্র সম্বন্ধে আমাদিগকে ধারাবাহিকরূপে মৌখিক উপদেশ দিতে আরম্ভ করিলেন। আমাদের সঙ্গে তাঁহার দুই একজন বাহিরের শিষ্যও উপস্থিত থাকিতেন। আমার সেঝদাদা গনেশঠাকুরের কাজ করিতেন। তিনি ক্ষিপ্রহস্তে তাঁহার সমস্ত কথা টুকিয়া লইতেন। তিনি এবিষয়ে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। সেঝদাদা কাগজ পেন্সিল লইয়া সর্বদাই প্রস্তুত থাকিতেন। কি ব্রাহ্মসমাজে, কি পারিবারিক উপাসনা মণ্ডপে, যেখানেই পিতৃদেব বক্তৃতা করিতেন বা উপদেশ দিতেন, তিনি যতদূর সম্ভব তাহা অবিকল টুকিয়া লইতেন। পরে পরিষ্কার করিয়া লিখিতেন। এমন কি, পিতৃদেব ঘরে বসিয়া সহজভাবে বাক্যালাপ করিতেছেন, তাহাও তিনি টুকিতে ছাড়িতেন না। আমরা এখন পিতৃদেবের যে সকল ব্যাখ্যান দেখিতে পাই, উহার অধিকাংশই তাঁহারই পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের ফল। সেঝদাদার পূর্বে মেঝদাদাও এইরূপ পিতৃদেবের বক্তৃতাসকল টুকিয়া লইতেন। পরিষ্কার করিয়া লিখিয়া তাঁহাকে দেখাইলে, তিনি কোন কোন অংশ সংশোধন করিয়া দিতেন।

৫। আমাদের স্বাস্থ্য ও দৈহিক উন্নতির প্রতিও তাঁহার দৃষ্টি ছিল। কুস্তি শিখাইবার জন্য হীরা সিং নামক একজন শিখ্ পালোয়ানকে তিনি নিযুক্ত করিয়াছিলেন। এই হীরা সিংহের নিকট প্রসিদ্ধ পালোয়ান অম্বুগুহও শিক্ষা করিতেন। আমাদের বাড়িতে কুস্তির একটা আখ্ড়া ছিল। আমি তখন শিশু ছিলাম। আমি ইহাতে যোগ দিই নাই। ভাইদের মধ্যে আমার সেঝদাদা ( হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ) ব্যায়াম চর্চ্চায় উৎকর্ষ লাভ করিয়াছিলেন। তিনি রীতিমত পালোয়ান হইয়া উঠিয়াছিলেন। হীরা সিংহের নিকট তলোয়ার, গৎকা, লাঠি সব রকমই শিক্ষা করিয়াছিলেন। বাঙ্গালীর মধ্যে আমার সেঝদাদা ও অম্বুগুহ সেই সময়ে এই বিষয়ে খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন।
পিতৃদেব যখন বাড়ি আসিতেন, তিনি আমাদের সকলকে লইয়া আহারে বসিতেন। মধ্যাহ্ণ ভোজনের সময়, অন্ন ব্যঞ্জনের পর, শেষে চাপাটি ও সন্দেশ আসিত। বোধ হয় পিতৃদেব মনে করিতেন ভতে যথেষ্ট দৈহিক পুষ্টি হয় না। আবার দিনকতক কাশী হইতে একজন হালুইকর আনাইয়াছিলেন, সেই হালুইকর রাত্রে নানাবিধ উৎকৃষ্ট নিমকি ও মিষ্টান্ন প্রস্তুত করিত।

৬। পিতৃদেব যখন দেরাদুনে ছিলেন, আমি কোন বিষয়কর্ম্ম উপলক্ষে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলাম। তিনি সীতানাথ ঘোষের পত্র বাহির করিয়া বলিলেন, "বেচারা বড়ই কষ্টে পড়েছে"। এই বলিয়া সীতানাথকে ৭০০০ টাকা দিতে আমাকে অনুমতি করিলেন। শুনিলাম সীতানাথবাবু অত টাকা পাইবেন বলিয়া আদৌ প্রত্যাশা করেন নাই। এইরূপ আরও দুই একটি দৃষ্টান্ত আছে। পিতৃদেব যখন দান করিতেন, এইরূপেই মুক্তহস্তে দান করিতেন। এই প্রসঙ্গে সীতানাথবাবুর কিছু পরিচয় দেওয়া অবশ্যক। তিনি একজন বৈজ্ঞানিক ছিলেন। তিনি তাড়িৎ চিকিৎসার জন্য একপ্রকার নূতন যন্ত্র উদ্ভাবন করিয়াছিলেন। তিনি কিছুদিন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় সম্পাদকতাও করিয়াছিলেন। হিন্দু তাড়িৎ-জ্ঞান সম্বন্ধে গবেষণাপূর্ণ অনেকগুলি প্রবন্ধ তিনি পত্রিকায় প্রকাশ করেন।

৭। কলিকাতায় আমার বড়দিদিমার একখানা বাড়ী ছিল। দিদিমার এক পালিত কন্যামাত্র ছিল। পিতৃদেব ছাড়া তাঁহার প্রকৃত উত্তরাধিকারী আর কেহই চিল না। দিদিমার মৃত্যু হইলে সেই বাড়ীর স্বত্ব আমার পিতৃদেবে আসিয়া বর্ত্তিল। সেই বাড়ী দখল করিবার কথা উঠিল। আমাদের মধ্যে কাহারও কাহারও সেই বাড়ির উপর লোলুপ দৃষ্টি ছিল। বাড়ীটি বেশ বড়। মূল্য ২০/৩০ হাজারের কম হইবে না। কিন্তু পিতৃদেব ঐ বাড়ী দিদিমার পালিত কন্যাকেই দান করিলেন। এইরূপ তাঁহার দয়া ও উদারতা ছিল।

৮। বিশুদ্ধ সঙ্গীতের প্রতি তাঁহার অনুরাগ ছিল। আদি ব্রাহ্মসমাজের গায়ক বিষ্ণু চক্রবর্তী আমাদের বাড়ীর বেতনভুক্ গায়ক ছিলেন। মধ্যে মধ্যে সন্ধ্যার পরে তিনি বিষ্ণুর গান শুনিতেন। মাসিক বেতন পাইলেও, গান শুনিবার পর, প্রত্যেক বার ২ টাকা করিয়া বিষ্ণুকে পারিতোষিক দিতেন। তিনি ভাল ভাল গায়ককে আমাদের বাড়ীতে আশ্রয় দিতেন। তন্মধ্যে, শ্রী রমাপতি বন্দ্যোপাধ্যায়, যদু ভট্ট, শান্তিপুরের প্রসিদ্ধ জমিদার মতিবাবুর ভ্রাতা রাজচন্দ্র বাবু - ইঁহাদের নাম উল্লেখযোগ্য। এই সকল ওস্তাদের হিন্দি গান ভাঙ্গিয়া আমরা অনেক ব্রহ্ম সঙ্গীত রচনা করিয়াছি। সর্ব্বপ্রথমে মেঝদাদা বড়দাদা বিষ্ণুর গান ভাঙ্গিয়া ব্রহ্ম সঙ্গীত রচনা করেন। কিছুকাল পরে বড়দাদা, সেঝদাদা ও আমি - আমরা নানা ওস্তাদের হিন্দি গান ভাঙ্গিয়া ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করিতে প্রবৃত্ত হই। যাহার যেদিন রচনা হইত, পিতৃদেব সেই রচিত গান সন্ধ্যার পর শুনিতেন। তাঁহার ভাল লাগিলে আমরা উৎসাহিত হইতাম। যখন আমি সঙ্গীত সমাজ প্রতিষ্ঠা করিবার উদ্যোগ করি, সেখানে বিশুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চ্চা হইবে শুনিয়া তিনি ১০০০ টাকা চাঁদা স্বাক্ষর করিতে আমাকে অনুমতি করেন।

৯। প্রায়ই দুই একজন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রকে আমাদের বাড়ীতে আশ্রয় দিয়া তাহার শিক্ষার ব্যয়ভার তিনি বহন করিতেন। তন্মধ্যে একজন পরীক্ষোত্তীর্ণ ছত্র - এখন ডাক্তার - আমাদের সহিত কখনও সাক্ষাৎ হইলেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিয়া থাকেন। দুই একজন বন্ধুর পুত্রকেও, কলিকাতায় থাকিয়া বিদ্যালয়ে শিক্ষা করিবার জন্য আমাদের বাড়ীতে আশ্রয় দিয়াছিলেন। তাঁহাদের জন্য উত্তম ঘর ও উত্তম আহারাদির ব্যবস্থা করিতেন।

১০। তিনি অত্যন্ত সময়নিষ্ঠ ছিলেন। তিনি যেখানে বসিতেন তাঁহার সম্মুখস্থ টিপায়ে একটি জেব-ঘড়ি খোলা থাকিত। তিনি ঘড়ি দেখিয়া ঠিক নির্দ্দিষ্ট সময়ে স্নান আহারাদি করিতেন। কখন তাহার ব্যতিক্রম হইত না। কেবল যখন কাহারও সঙ্গে ঈশ্বর প্রসঙ্গে কথা বার্ত্তা হইত, তখন সময়ের জ্ঞান থাকিত না। তাঁহার জীবনের ঘটনায় ঈশ্বরের করুণার কত নিদর্শন পাইয়াছেন, এক এক দিন আমাদের নিকট বর্ণনা করিতেন; বর্ণনা করিতে করিতে তিনি যেন একেবারে মাতিয়া উঠিতেন - তাঁহার মুখে উৎসাহ ও আনন্দের একটা স্বর্গীয় প্রভা ফুটিয়া উঠিত। তখন আর কিছুই হুঁস থাকিত না। যখন হুঁস হইত, তাড়াতাড়ি উঠিয়া প্রস্থান করিতেন।

১১। তাঁহার 'রাশ-ভারী' ছিল। তিনি যখন বাড়ী থাকিতেন, তখন যেন বাড়ী 'গম্গম্' করিত। পাছে কোন কর্ত্তব্যের ত্রুটি হয়, চাকর-বাকর সকলেই সর্ব্বদা সশঙ্ক থাকিত। সব কাজ ঠিক্ নিয়মে চলিত। তিনি কাহাকেও শাসন করিতেন না, অথচ সমস্ত কাজ সুশৃঙ্খলরূপে নির্ব্বাহ হইত। তিনি যখন বাড়ী হইতে চলিয়া যাইতেন তখন চাকর-বাকরদিগের মন হইতে যেন একটা পাষাণ-ভার নামিয়া যাইত। ইণ্ডিয়ান মিরারের লেখক কাপ্তেন পামার কখন কখন আমাদের বাড়ীতে আসিতেন। পিতৃদেব বিদেশে চলিয়া গেলে, পামার সাহেব বাড়ীর ভাবান্তর লক্ষ্য করিয়া একদিন বলিয়াছিলেন : - "When the cat is away the mice will play."

১২। আমাদের কাহারও কোন দোষ-ত্রুটি তাঁহার কর্ণগোচর হইলে তিনি পারিবারিক উপাসনার সময় উপাসনার মণ্ডপে সাধারণ উপদেশচ্ছলে এমন ভাবে বলিতেন যে দোষী ব্যক্তি তাহার মর্ম্ম উপলব্ধি করিয়া লজ্জিত হইত।

১৩। আমি যখন শিশু ছিলাম, পিতৃদেব তাঁহার এক বন্ধু বেণীবাবুর সহিত কখন কখন দাবা খেলিতেন। কিন্তু তাস খেলিতে কখন তাঁহাকে দেখি নাই।

১৪। পিতৃদেব স্ত্রীশিক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন। আমার শৈশবকালে দেখিতাম, একজন তিলক কাটা বৈষ্ণবী ঠাকরুণ আমাদের অন্তঃপুরে শিক্ষা দিতে আসিতেন। তারপর মিস গোমিস্ প্রভৃতি খৃষ্টান মেমেরা বাঙ্গালা শিখাইতে আসিতেন। "এইরূপে আমরা মুখ ধুই, মুখ ধুই, তা'দেখাইবার পূর্বে" ( অর্থাৎ মুখ দেখাইবার পূর্বে ) - "একবার নাহি পার পুনর্ব্বার লাগো, সাধ্যমত চেষ্টা কর পুনর্ব্বার লাগো" - এই সকল বাক্য অভ্যাস করান হইত আমার মনে পড়ে। তারপর পণ্ডিত অযোধ্যানাথ পাকড়াশী আমাদের অন্তঃপুরে শিক্ষা দিতেন। ইহাই বিশুদ্ধ শিক্ষা। যখন বেথুন স্কুল প্রথমে স্থাপিত হয়, তখন পিতৃদেব আমার জ্যেষ্ঠা ভগিনীকে ঐ স্কুলে ভর্ত্তি করিয়া দেন।

১৫। পিতৃদেব আমাদের সকলকেই একে একে ব্রাহ্মধর্ম্মের শ্লোক পাঠ করিতে অভ্যাস করাইয়াছিলেন। হ্র স্ব দীর্ঘ রক্ষা করিয়া, বিশুদ্ধ উচ্চারণ-সহকারে টানা-সুরে আমাদের শ্লোক পাঠ করাইতেন। এত অল্প বয়সে উপনিষদের গভীর তত্ত্ব সকল বুঝিতে পারিব না বলিয়াই বোধ হয় তিনি শ্লোকের অর্থ ব্যাখ্যা করিতেন না। তবে তখন হইতে ঐ সকল শ্লোক আমাদের নিকট পরিচিত হইয়া থাকিলে, ভবিষ্যতে আমরা উহা হইতে উপকার লাভ করিতে পারিব, ইহাই বোধ হয় তাঁহার মনোগত অভিপ্রায় ছিল। আমাদের সময়ে, আমি ও আমার খুড়তুত ভ্রাতা গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর - আমরা দুইজন প্রতিদিন প্রাতে তাঁহার নিকট ব্রাহ্মধর্ম্ম পাঠ করিতাম। কিছুকাল পরে রমাপ্রসাদ রায়ের পুত্রদ্বয় তাঁহার নিকট ব্রাহ্মধর্ম্ম পাঠ শিক্ষা করিতে আসিতেন। পরে, ব্রাহ্মধর্ম্ম শিক্ষার জন্য আমাদের বাড়ীর পূজার দালানে একটি ছোটখাট পাঠশালাও খোলা হয়। এই পাঠশালায় বাহিরের চারি পাঁচ জন বিদ্যালয়ের ছাত্রও ব্রাহ্মধর্ম্ম শিক্ষা করিতে আসিত। পণ্ডিত অযোধ্যানাথ পাক্ড়াশী ব্রাহ্মধর্ম্ম পাঠ করাইতেন, শ্লোকের ব্যাখ্যাও করিতেন। রীতিমত পরীক্ষাও হইত। আমার বাল্যবন্ধু অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী ( পরে হাইকোর্টের অ্যাটর্নি, "ভারতীর" সাহিত্য-সমালোচক, সুলেখক, সুকবি ) পরীক্ষায় শ্রেষ্ঠস্থান অধিকার করায় পিতৃদেব একখানা বাঁধান ব্রাহ্মধর্ম্ম-গ্রন্থ তাঁহাকে স্বহস্তে পুরষ্কার দেন। আমার দীক্ষার কিছুদিন পূর্বে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের নিকট ব্রাহ্মধর্ম্ম শিক্ষা করিবার জন্য পিতৃদেব প্রতিদিন তাঁহার নিকট আমাকে পাঠাইয়া দিতেন। আমার উপনয়নের সময় পিতৃদেব বাড়ী ছিলেন না। আমার উপনয়ন প্রচলিত প্রথা-অনুসারেই হইয়াছিল। আমার দীক্ষা ব্রাহ্মধর্ম্মের অনুষ্ঠান-পদ্ধতি অনুসারে সম্পন্ন হয়। আমার বোধ হয়, অনুষ্ঠান পদ্ধতি অনুসারে ইহার প্রথম অনুষ্ঠান।

১৬। একবার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খুব দুর্ভিক্ষ হয়। সেই দুর্ভিক্ষ উপলক্ষে আদি ব্রাহ্মসমাজে একটা সভা হয়। সেই সভায় পিতৃদেব বেদী হইতে যেরূপ মর্ম্মস্পর্শী বক্তৃতা করেন তাহা আমি কখন ভুলিব না। তাঁহার বক্তৃতা শুনিয়া লোকেরা এমনি মুগ্ধ ও উত্তেজিত হইয়াছিল যে, যাহার কাছে যাহা কিছু ছিল, তৎক্ষণাৎ সে দুর্ভিক্ষের সাহায্যার্থে দান করিল। কেহ আঙ্গুল হইতে আংটি খুলিয়া দিল, কেহ ঘড়ি ও ঘড়ির চেন্ খুলিয়া দিল। আমার স্মরণ হয় কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁহার বহুমূল্য উত্তরীয় বস্ত্র (বোধ হয় শাল) তৎক্ষণাৎ খুলিয়া দান করিলেন।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর


(‘প্রবাসী’ ১৩১৮ বঙ্গাব্দের মাঘ সংখ্যায় প্রকাশিত)

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।