প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)


গোলাপের অপরাধ

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর

[ লেখক পরিচিতি: মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সপ্তম সন্তান ও পঞ্চম পুত্র এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৪৯ খৃষ্টাব্দের ৪ঠা মে জোড়াসাঁকোতে। রবীন্দ্রনাথের তিনি ছিলেন ‘নতুন দাদা’। বাড়িতেই পড়াশোনা শুরু করেন। পরে সেণ্ট পল্স্, মণ্টেগুজ অ্যাকাডেমি ও হিন্দু স্কুলেও পড়াশোনা করেছেন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন কিন্তু নাটকের কাজে জড়িয়ে পড়ায় এফ. এ. পরীক্ষা আর দেওয়া হয় নি। গুণেন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি জোড়াসাঁকো নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করেন। তার নাট্যজগতে প্রবেশ ‘পুরুবিক্রম’ নাটকে সফল অভিনয়ের মাধ্যমে। অন্যান্য বিখ্যাত নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘স্বপ্নময়ী’, ‘সরোজিনী’, ‘অশ্রুমতী’ ইত্যাদি। তার কিছু নাটক মারাঠি, হিন্দি ও গুজরাটি ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে। অনেকগুলি সংস্কৃত নাটকও তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। ‘গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার’-এ তার অনেক নাটক সফলভাবে মঞ্চস্থ হয়। ‘অলীক বাবু’, ‘এমন কর্ম আর করব না’, তার উল্লেখযোগ্য প্রহসন নাটক। ‘যৎকিঞ্চিৎ জলযোগ’, ‘দায়ে প’ড়ে দার পরিগ্রহ’ ইত্যাদি প্রহসন রচনাগুলিও উপভোগ্য। দাদা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি আমেদাবাদে গিয়েছিলেন; সেখানেই ফরাসী ও মারাঠী ভাষা শিক্ষা করেন। ছাবি আঁকা এবং সেতার বাজানও তিনি শিখেছিলেন।

চিত্রাঙ্কনে তিনি ছিলেন সবিশেষ পারদর্শী। তার খাতায় নামী অনামী বহু ব্যক্তির অঙ্কিত প্রতিকৃতি সঞ্চিত আছে। যখন যার সঙ্গেই তিনি পরিচিত হতেন, তার প্রতিকৃতি তিনি খাতায় এঁকে রাখতেন। প্রখ্যাত ইংরেজ শিল্পী রদেনস্টাইনের অনুরোধে তার নিজেরই নির্বাচন করা কিছু ছবি নিয়ে একটি সঙ্কলন ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যাণ্ডে প্রকাশিত হয়। স্বর্ণকুমারী দেবী লিখেছেন – “যাঁহারই সহিত তাঁহার আলাপ হইত, তাঁহারই প্রতিকৃতি তিনি অল্পায়াসে আঁকিয়া রাখিতেন এবং যে কোনো গায়ক গোঁলক ধাঁধাযুক্ত ঘূর্ণমান তানলয়ে গাহিয়া গেলেও, তিনি সঙ্গে-সঙ্গে যন্ত্রে তাহা বাজাইয়া লইতে পারিতেন। প্রথম যখন কলকাতায় হার্মোনিয়াম আমদানি হয়, তখন আমাদের বাড়ী একটি বড় হারমোনিয়াম আনা হইয়াছিল। নূতনদাদা সেই যন্ত্রটি প্রতিদিন প্রত্যূষে বাজাইতেন। আমি যখন অতি ছোট ছিলাম, - মনে পড়ে, আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাঁহার বাজনা শুনিবার জন্য ছুটিয়া যাইতাম।”

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাহিত্য প্রতিভা ছিল বহু-বিস্তৃত। ভাষাশিক্ষা ও সাহিত্যের উন্নতিকল্পে ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘বিদ্বজ্জনসমাগম’ এবং ১৮৮২-তে ‘সারস্বত সমাজ’ নামক তিনি দুটি সংগঠন গড়ে তোলেন। মাসিক পত্রিকা ‘ভারতী’ প্রকাশনায় তিনিই ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা। ‘বীণাবাদিনী’ ও ‘সঙ্গীত প্রবেশিকা’ নামে দুটি মাসিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯০২-০৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি ছিলেন। ইতিহাস, দর্শন সম্বন্ধীয় প্রবন্ধ, গল্প, ভ্রমণ কাহিনীও তিনি রচনা করেছেন। বহু গল্প ও উপন্যাস তিনি ফরাসি ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন।

তার সঙ্গীত শিক্ষা শুরু ঠাকুরবাড়ীর সঙ্গীত শিক্ষক বিষ্ণুপদ চক্রবর্তীর কাছে। ধ্রুপদ-সঙ্গীত আধারিত অনেকগুলি ব্রহ্মসঙ্গীত তিনি রচনা করেছেন। তার নিজের রচিত ‘স্বরলিপি গীতিমালা’ ও কাঙ্গালীচরণ সেন সঙ্কলিত ‘সঙ্গীত প্রবেশিকা’ নামক পুস্তকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বহু গান স্থান পেয়েছে। তিনি নিজে বহু গানের সুর দিয়েছেন। অনেক সময়ে তার গানের সুরে রবীন্দ্রনাথ কথাও বসিয়েছেন । ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে তিনি ‘ভারতীয় সঙ্গীত সমাজ’ স্থাপন করেন।

১৮৬৮ সালের ৫ই জুলাই কাদম্বরী দেবীকে তিনি বিবাহ করেন। স্ত্রীকে পড়াশোনায় উৎসাহ দেওয়া ছাড়াও সমস্ত বিরূপ সমালোচনা অগ্রাহ্য করে তাকে কলকাতার ময়দানে অশ্বচালনা শিক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক রূপে তিনি ১৮৬৯ সাল থেকে ১৯ বছর কাজ করেছেন।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্বদেশপ্রীতি ও দেশপ্রেম ছিল অসাধারণ। তার উদ্যোগে রাজনারায়ন বসুর সভাপতিত্বে ‘সঞ্জিবনী’ নামক গুপ্ত স্বদেশী সভার সূচনা হয়। এই সভার কর্মসূচী অনুসারে দেশলাই প্রস্তুত ও দেশী কাপড় বোনা শুরু হয়েছিল। স্বর্ণকুমারী দেবী লিখেছেন – ‘তাঁহার কিরূপ অপরিসীম দেশ প্রীতি ছিল, তাহারও পরিচয় তিনি নানা কাজে দেখাইয়া গিয়াছিলেন। এক সময়ে তাঁহার মনে হইয়াছিল ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় না হইলে দেশের প্রকৃত মঙ্গল সাধন হইবে না, তাই তিনি প্রথম নীলের চাষ আরম্ভ করেন। পরে, এই চাষে তাহার যাহা কিছু লাভ হইয়াছিল সমস্ত খরচ করিয়া তিনি তদানীন্তন প্রধান ইংরেজ কোম্পানির প্রতিদ্বন্দী হইয়া বরিশালে ফেরি ষ্টিমার খুলিলেন। কিন্তু দেশের লোকের সাহায্য-সহানুভূতি-সত্ত্বেও এই ব্যবসা অধিককাল স্থায়ী রাখিতে পারেন নাই। প্রভূত ক্ষতি স্বীকার করিয়া পরে সেই ষ্টিমার ইংরীজ কোম্পানিকে বিক্রয় করিয়া ফেলিতে বাধ্য হন। এই ঘটনায় তাঁহার দেশ-প্রীতি ও সৎসাহসের চূড়ান্ত পরিচয় পাওয়া যায়।"

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অন্তঃকরণ ছিল অতি উদার। একবার তার এক সামান্য বাজার সরকারের বালিকা-বধূর সঙ্গীত প্রীতি তিনি জানিতে পারেন। তিনি সেই মেয়েটিকে বাড়ীর অন্য সব মহিলার সঙ্গে সমান আদরের সঙ্গে সঙ্গীত শিক্ষা দিয়েছিলেন। স্ত্রীশিক্ষা ও নারী মুক্তি আন্দোলনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৯২৫ সালের ৪ঠা মার্চ তার মৃত্যু হয়।      
দীপক সেনগুপ্ত ]


       সালমো গৃহিণীর একটা টুপির দোকান ছিল| সেই নগরে একদল দুর্গ-সৈন্যের আড্ডা ছিল বলিয়া, সামরিক দ্রব্যসামগ্রীও দোকানে রাখা হইত| লাল রংয়ের টুপি, নীল রং-এর টুপি, জরি লাগানো টুপি, পালক লাগানো টুপি-এই সব জিনিসে দোকানের শার্সি আলমারী ঝিকমিক করিত|

      তাছাড়া সালমো-দম্পতির কাজ বেশ জমিয়া উঠিয়াছিল; এখন তাহাদের বেশ স্বচ্ছল অবস্থা| তাহাদের গোড়ার কথাটা এখন আর কাহারও মনে নাই| যে সালমোর পিতা রোদে পুড়িয়া, বৃষ্টিতে ভিজিয়া, সহরের পথ দিয়া চলিতে চলিতে হাঁক দিয়া যাইত-"চাই পুরানো কোর্ত্তা, চাই পুরানো কাপড়!" - সে সময়ের কথা এখন আর কাহারও স্মরণ নাই|
কিছুকাল পরে বৃদ্ধ আর বেশী হাঁটাহাঁটি করিত পারিত না বলিয়া একটা দোকান ঘরে বসিয়া তাহার ব্যবসা চালাইত| কিন্তু তাঁহার পরে তাঁর পুত্রটি ফেরী-করা ব্যবসায়ে ক্লান্ত হইয়া, পুরানো রদ্দি মাল বিক্রয় করিয়া সেই টাকায় পারী নগরের ধরণে একটা জমকালো রকমের টুপির দোকান খুলিয়া বসিল|

      তাহার স্ত্রী দুঃখদৈন্যের সময়েই সালমোকে বিবাহ করে; এবং তখন তাহাদের যেরূপ কর্ম্মের অবস্থা ছিল, সেই অনুসারেই হিসাব করিয়া চলিত| কিন্তু এখন সে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হইয়া থাকে; বেশভুষায় বেশ সুসজ্জিত হইয়া থাকে| এখন সে রেশমি পরিচ্ছদ পরিধান করে, কাণে হীরার কাণবালা, আঙ্গুলে হীরার আংটি পরে| বেশ নিশ্চিন্তভাবে জীবন যাপন করে|

      সালমো-গৃহিণী দোকানের হিসাবপত্র রাখে, খরিদ্দারদিগকে আদর অভ্যর্থনা করে; সে যে খুব ধনী, এবং ব্যস্ত না হইয়া ধীরে সুস্থে কাজ করে - ইহাই দেখাইবার জন্য সে বাহিরের দিকে দরজার কপাটে ঠেস দিয়া অলস-ভঙ্গীতে, বাহুদ্বয় বক্ষে আড়াআড়িভাবে রাখিয়া, অনেকক্ষণ ধরিয়া বসিয়া থাকে| সম্মুখ দিকে সিধা চাহিয়া থাকে - সেই চাহনীতে একটা অস্পষ্ট ভাব লক্ষিত হয় - যেন একটা স্বপ্ন হইতে সদ্য জাগিয়া উঠিয়াছে|

        আর সালমো লোকটি বেঁটেখেটে, নাদুশ-নুদুশ, আমুদে, সুবেশী বলিয়া তাহার মনে মনে একটা অহঙ্কার আছে| নিজের ব্যবসায়ের উপযুক্ত কাপড় চোপড় ছাড়িয়া দিয়া সে ফ্যাঁশান দুরস্ত ভাল ভাল কোর্ত্তা, ভাল ভাল পেন্টুলুন-ভাল ভাল ফোতুই সর্ব্বদাই পরিয়া থাকে|

        এই টুপির দোকানদার, তার দোকানের সম্মুখে লম্বালম্বি ভাবে পায়চারি করিতে ভাল বাসিত| পকেটে হাত গোঁজা, মুখে মৃদুহাস্য, খরিদবিক্রীর কাজের উপর নজর আছে অথচ যেন নির্লিপ্ত| শেষ-জাত ছেলেটির খেলাধূলা দেখিতেছেন, আর আনন্দে আত্মহারা হইতেছেন| পল্লীগ্রামে এইরূপ ছেলেকে নাবী বর্ষার মত "নাবী" ছেলে বলে| কেননা, তার ভগিনী “গোলাপের" ১০ বৎসর পরে ওর জন্ম হয়| তাই এই ছেলেটির উপর বাপমায়ের ভালবাসা অপরিসীম|

         বাপমায়ের চোখের সামনে ছেলেটা খেলা করিত, মখমলের পাজামাটা ফুটপাথের উপর দিয়া টানিয়া চলিত| পাশ্ববর্ত্তী ময়রার দোকান হইতে নানাবিধ মিষ্টান্ন মুখে ভরিয়া কাঠবিড়ালীর মত তার সুন্দর ঠোঁট চটচটে করিয়া তুলিত; তার পর তাহার মার কাছে আসিয়া আধো আধো খোকার ভাষায় বলিত -"আমার এখনো পেত ভরে নি - তবু দিদি বলে কিনা-আল খাসনে|"

          সে যাহা চাহিত, ময়রা তাহাই দিত - জানিত, যতই কিনুক না, ওর মা সব টাকা শোধ করিয়া দিবে|
সালমো-গৃহিণীর এখনও বয়স কম, দেখিতেও বেশ সুশ্রী| নিজ কন্যার সঙ্গ তার ভাল লাগিত না| গোলাপের এখনও "খুকী" ডাক নাম ঘোচে নাই, এখনও ছোট মেয়ের মত খাটো ঘাগরা পরে, কিন্তু আসলে সে এখন ষোড়শী রমণী| মেয়েটি রূপসী| ইহার রূপ প্রাচ্য ধরণের- কোন ক্ষয়ের চিহ্ণ দেখা দিলেও এই রূপের বদল হয় না| এবং বোর্ডিং-স্কুল সুলভ খাটো কাপড় পরা সত্ত্বেও সৌরকরোজ্জ্বল দেশের কন্যাদের ন্যায় ইহার গতিভঙ্গি অতি নমনীয়, অতি কমনীয়, অজ্ঞাসারে বিলাসলালসাগর্ভ| তপ্ত কাঞ্চনের মত গায়ের রং, ডালিম ফুলের চেয়েও উজ্জল ওষ্ঠযুগল; সরল নাসিকা; একটু ভারী ভারী চোখের পাতা; সেই নেত্র পল্লবে অর্দ্ধাবৃত ঘোর কৃষ্ণবর্ণ নেত্রযুগল; তমসাচ্ছন্নগগনে বিলম্বে যে সব তারার উদয় হয় সেই তারার মত, ঐ নেত্র হইতে একটা মধুর জ্যোতি নিঃসৃত হইতেছে| তাহার চুলও কালো রেশমি ধরণের, ঢেউ-খেলানো; - একটা স্থূল জালে বদ্ধ হইয়া পিঠের উপর ঝুলিয়া পড়িয়াছে| কিন্তু এইরূপ কেশ বন্ধনে তাহার ছোট মেয়ের ভাবটা ঘুচিয়া গিয়াছে| কিন্তু এই কেশ বন্ধনে তাহাকে বেশ মানাইয়াছে| ইহা ছাড়া তাহার মাথায় কতকগুলো সোনার মোহর শোভা পাইতেছে অথবা মহম্মদের দেশে রঙ্গিণীদের ন্যায় কেশের শেষ-প্রান্তটা মুক্তোর পাড় দেওয়া একটা বস্ত্রখণ্ডে আবদ্ধ|

         এইরূপে, মেয়েটি তাহার মায়ের আত্মাভিমানে যেরূপ আঘাতে করিল, সেইরূপ তাহার সতর্কবুদ্ধিকেও একটু উষকাইয়া দিল| সালমো-গৃহিণী মেয়েকে দোকানে আসিতে দিত না-এই ছুতা করিয়া আসিতে দিত না যে, তাহার দোকানের খদ্দের সবই পুরুষ-এই নিছক খদ্দেরদিগের সংস্পর্শে আসা "খুকীর" পক্ষে সুবিধাজনক নহে|
এই বিশুদ্ধ নীতির দোহাই দিয়া, বাড়ির এক তেতলা ঘর তাহার জন্য নির্দিষ্ট হইল এবং এক ইহুদি ধাত্রী পাচিকার উপর তাহার তত্ত্বাবধানের ভার ন্যস্ত হইল| এই ঘুরঘুরে পাড়া-বেড়ানো স্ত্রীলোকটা যারপরনাই নোংরা; কিন্তু গৃহিণী মনে করিতেন, সে ভাল ভাল গুনে বিভুষিত; কেননা, সে ইহুদি ধর্ম্মগ্রন্থের খুব ছোটখাটো অনুশাসনও অক্ষরে অক্ষরে পালন করিত| রন্ধনের ব্যঞ্জনাদি আদৌ উৎকৃষ্ট নহে| নিম্ন শ্রেণীর মাংস; কিন্তু উহা শাস্ত্রনির্দেশানুসারে যথানিয়মে কাটিয়া, অর্দ্ধঘন্টা বিশুদ্ধ জলে-ধুইয়া তাহার পর একঘন্টা ধরিয়া লুনে কচলানো হইত| টুকরো মাংসের খারাপ "ইষ্টু" সুরুয়া স্বাদহীন, মাখন-বর্জিত| তরকারিগুলো কি একটা ঘোলাটে তরল পদার্থের মধ্যে ভাসিত| তাহার এক সমধর্ম্মী যে বুট-জুতো বেচিত সে মিষ্টান্নও প্রস্তুত করিত| ধর্ম্মান্ধ সালমো-গৃহিণী, এই সমস্ত ব্যঞ্জন ও মিষ্টান্নে সন্তুষ্ট ছিলেন, কারণ তিনি মনে করিতেন, এই সমস্ত ঈশ্বরেরই ইচ্ছার অভিব্যক্তি|

        ধাত্রী নোয়েমী, তরকারী-রান্নার বাসনের সহিত মাংসরান্না-বাসন মিশাইত না বটে, কিন্তু কোন বাসনই ভাল করিয়া ধুইত না| সে শুক্রবারে এমন করিয়া আগুন জ্বালাইয়া রাখিত, সাত-ডেলে প্রদীপে এমন করিয়া তেল ভরিয়া রাখিত যে, ইহুদি স্যাবাথের শনিবার রাত্রি পর্য্যন্ত উহা সমানভাবে জ্বলিত| কেননা, বাইবেল গ্রন্থে আছে:- "স্যাবাথের দিনে কোন কাজ করিবে না: কি তোমার পত্নী, কি তোমার পুত্র, কি তোমার গরু, কি তোমার গাধা - কাহাকেও সে দিনে কাজে খাটাইবে না|" এই ধাত্রী, ধুলা-গর্দ্দার প্রতি কটাক্ষপাত না করিয়া উহার মনিবদিগকে এই সব পূর্ব্ব দিনের বাসী রান্না জঘন্য খাদ্য সামগ্রী অম্লানবদনে পরিবেষণ করিত|

       বোর্ডিং-স্কুল হইতে বাহির হইবার পর হইতে সাল্মো-দুহিতা "গোলাপ" এই প্রকার রমণীর সঙ্গ লাভ করিল| ধাত্রীর সঙ্গে রন্ধন কার্য্যে যোগ দেওয়াই তাহার এক প্রধান আমোদ ছিল| একটু পিয়ানো শিখিয়াছে, একটু শেলায়ের কাজ করিতে পারে, একটু রাঁধিতে পারে-আর কি চাই? গোলাপের মা ইহাতেই সন্তুষ্ট আছেন| তিনি ভয় করিতেন, পাছে কেহ মেয়ের প্রশংসা করে| যে ভদ্র-সঙ্গ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া অলস জীবন যাপন করিতেছে, ইহাতে তাঁহাত কোন ভয় হইত না|

        অক্টোবর মাসের কোন এক অতি-ধূসর অতি-বিষণ্ণ দিনে, সালমো-গৃহিণী তাঁহার দোকানে এক প্রতিবেশীনীর সহিত কথা কহিতেছিলেন| তাহার মুখের ভাব গুরুগম্ভীর, ঠোঁট চাপা,-দেখিলে মনে হয় যেন সে কি -একটা গুপ্ত কথা জানে এবং তাহা প্রকাশ করিবার জন্য তাহার প্রাণ ছটাফট করিতেছে| সালমো-গৃহিণী জিজ্ঞাসা করিলেন:-

     "তুমি কি কথাটা খুব ঠিক করে জেনেছ?"

       ভালনর-গৃহিণী যেন তাঁহার বিশ্বস্ততার সাক্ষ্য দিবার জন্য, বাহুদ্বয় উপর দিকে উত্তোলন করিয়া বলিলেন:-
এবিষয়ে আমি খুব নিশ্চিন্ত| আমি যে তাদের দেখেছি, নিজের চক্ষে দেখেছি| আমি শুধু নয়, আরও দশজনে দেখেছে,- হাত দিয়ে পরস্পরের গলা জড়িয়ে ধরে ওরা মাঠ দিয়ে চলেছে- এত কাছাকাছি হয়ে কথা কচ্চে যে মনে হয় যেন কথার সঙ্গে চুম্বনেরও বিনিময় চলচে|

       সালমো-গিন্নির মুখ ফ্যাঁকাশে হইয়া গেল-সমস্ত মুখের মধ্যে কেবল তাঁর নেত্রযুগল অগ্নিশিখার মত জ্বলিত লাগিল; তিনি বলিয়া উঠিলেন: আঃ! এ বড় বেশী রকম! এ কথা আমি বিশ্বাস করিতে পারিনে: - নিশ্চয় বাড়িয়ে বলেছে| গোলাপ ছেলে মানুষ একটা অবিবেচনার কাজ করতে পারে, কিন্তু যে রকম বলচ, সে একটা দোষ পুনঃ পুনঃ করচে, তা কখনই তার দ্বারা হতে পারে না| একজন পুরুষ মানুষ তার পিছনে পিছনে গেছে, এমন কি তার সঙ্গে কথাও কয়েছে একথা আমি স্বীকার করতে পারি; জানি এই সব খৃষ্টানরা বড় অভদ্র| গোলাপ যদি তার কথার উত্তর না দিয়ে নীরবে চলে যেত তাহলে আরও ভাল হত একথা আমি মানি কিন্তু ঐ পুরুষের হাত ধরা, রোজ রোজ তার সঙ্গে দেখা করা-না, না-কখনই হতে পারে না-এ ডাহা মিথ্যে কথা|

       এই শুভাকাঙ্খী ব্যক্তির পাতলা ঠোঁটের উপর দিয়া একটু মৃদু হাসির রেখা চলিয়া গেল| সে গোলাপের সমস্ত গুপ্ত ব্যাপার প্রকাশ করিবার জন্য বড়ই ব্যস্ত| গোলাপের মায়ের কণ্ঠস্বরে যে একটা যন্ত্রণার ভাব প্রকাশ পাইতেছিল, তাহার জন্য তাহার কিছুমাত্র দয়ার উদ্রেক হইল না- তাহার কথার সত্যতা সমর্থন করিবার জন্য আরও অনেক খুঁটিনাটির বর্ণনা করিল|

      - তোমার কি ভাই অবিশ্বাস হয়, আমি একটা মিথ্যে গল্প একটা অস্পষ্ট জনরবের কথা- বিশেষতঃ এমন একটা বিষয় সম্বন্ধে-তোমাকে আমি বলতে আসব? বরং আমার জিব কেটে ফেলব| তবু - কিন্তু এ যে ইজ্জতের কথা| এ ইজ্জতের কথা; ইজ্জতের চেয়ে বড় আর কিছুই নেই| আমার স্বর্গীয় স্বামী এই কথা বলতেন| তিনি তাঁর উপর-ওয়ালাদের সম্বন্ধে খোসামুদের কথা বলতে পারতেন না বোলে তাঁর পদিন্নতি হল না| খোশামুদি দূরে থাক, তিনি হক কথা বলে দিতেন| এই বিষয়ে আমি কতকটা তাঁর মতন এবং এই জন্যই গোলাপের কেলেঙ্কারি আমি তোমাকে জানাতে এসেছি|
খুকি এসব কিছু বোঝে না; তার এত অল্প বয়স,-নিতান্ত অবোধ, এতে যে-কোন বিপদ আছে সে তা জানে না| কিন্তু তার ধাত্রী - সেই পাকা ঘাগী - সে ত সব জানে| তার ত জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল| তাকে বিশ্বাস করটাই তোমার ভুল| পাছে প্রেমিকযুগল বাধা পায় এই জন্য সে দূরে দূরে থাকে, তারা ধরা না পড়ে এইজন্য সে চারিদিকে নজর রাখে| আর কিছু না - তাকে শুধু চাবকে দেওয়া উচিত - একটা প্রকাশ্য জায়গায় চাবকে দেওয়া উচিত| তা'হলেই তার উচিত শিক্ষা হয়|

           গোলাপ ঐ উপর-তলায় আছে বলে তুমি বেশ নিশ্চিন্ত আছ-না ভাই? কিন্তু সে কি করে তাকি জান? সামনের বাড়িতে যে ছোঁড়াটা থাকে সে চুম্বনের ইঙ্গিত করে, আর গোলাপ তার জানালার পিছনে অর্দ্ধ-প্রচ্ছন্ন থেকে খিক-খিক করে হাসে| প্রায়ই দেখতে পাবে সেই ছোঁড়াটা তার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে নড়ে না| ছোঁড়াটা ফর্সা, পাতলা, ছিপছিপে, দেখতে সুশ্রী| যদি সে গোলাপকে বিয়ে করতে রাজি হয়, তাহলে তুমি একটি সুন্দর জামাই পাবে|
চিত্তের অটল ধীরতা সত্ত্বেও, ভালনর-গিন্নি, সালমো-গিন্নির ভীষণ মুখের ভাব দেখিয়া একটু থতমত খাইয়া গেল| সালমো-গিন্নির নেত্র হইতে অনলশিখা নিঃসৃত হইতেছিল, ঠোঁটের রেখা বাঁকিয়া পড়িয়াছিল, সমস্ত শরীর থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল| মায়ের প্রাণে দুঃখের দারুণ রোষ প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিয়াছিল| যে ব্যক্তি সচরাচর শান্তপ্রকৃতি, আজ তাহার এই ভীষণ রূপান্তর দেখিয়া ভালনর-গিন্নি এই সময় 'পিট্টান' দেওয়াই সুবুদ্ধির কাজ বলিয়া মনে করিল| সে উঠিয়া বলিল:-

        "যাক যাক, তুমি ভাই এর জন্য মন খারাপ করো না - এখনও বেশীদূর গড়ায়নি - তুমি দু'কথায় পাগলী মেয়েটাকে বুঝিয়ে দিতে পারবে| শীঘ্রই আবার তোমার সঙ্গে দেখা করব| আজ আসি|"

         সেই সময় সালমো দরজায় পায়চারি করিতেছিল-কিন্তু তাকে কোন কথা না বলিয়া সালমো-গিন্নি ঝড়ের মত সিঁড়ি দিয়া অন্তর্হিত হইল|

         এই সময়ে, ক্রোধান্ধ জননী ও ভয়ভীতা দুহিতা - এই উভয়ের মধ্যে একটা তুমুল ব্যাপার চলিতে লাগিল| কান্নাকাটি, চীৎকার ও ভর্ৎসনাবাক্য শুনা যাইতে লাগিল|

         ধাত্রী নোয়েমী তাড়া খাইয়া, সিঁড়ির নীচে দাঁড়াইয়া কাঁপিতেছিল, মেয়েটার পক্ষ সমর্থন করিয়া কিছু বলিতে সাহস হইতেছিল না| ভীতিবিহ্বল হইয়া হাঁ করিয়া দন্ত বিকাশ করিয়া সে সব শুনিতেছিল; তারপর হঠাৎ দরজার পিছনে সালমো-গিন্নির পায়ের শব্দ শুনিয়া সে পলায়ন করিল| ইতিমধ্যে সালমো-গৃহিণীর আবার শান্তমূর্ত্তি ধারণ করিয়া, নীচে নামিলেন এবং টুপির বিচিত্র বর্ণের উজ্জ্বল পালোক জরি-জরাওর মধ্যে, দোকানের দফতর-ডেস্কের সম্মুখে তাঁহার সেই চিরন্তন অলস ভঙ্গীতে আসিয়া বসিলেন|

        কয়েক ঘণ্টা পরে যখন সালমো উপরের ঘরটায় প্রবেশ করিলেন, তখন গোলাপকে দেখিতে পাইলেন না-সে তখন অন্তর্হিত হইয়াছে|

         দম্পতিযুগল একটু ভাবিত হইয়া পড়িলেন; তাহার পর, গোলাপ প্রস্থান করিবার সময় যে সব চিহ্ণ রাখিয়া গিয়াছিল তাহা ধরিয়া ফেলিলেন| চিত্তহরণকারী কোন সুন্দর পুরুষের দৃষ্টি যাহাতে তাহার উপর পড়িতে না পারে এই জন্যই গোলাপের মা গোলাপকে একটা ছোট ঘরে বদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলেন| কিন্তু তাহাতেও কোন ফল হইল না| সে তাহাদের চোখে ধূলা দিয়া পলায়ন করিয়াছে| একটা চ্যালা-কাঠ ঘরের মেজের উপর পড়িয়াছিল সেই কাঠটা উঠাইয়া লইয়া ঘরের তালাটার উপর সজোরে আঘাত করায় তালাটা ভাঙ্গিয়া যায়| তখন ঘর হইতে বাহির হইয়া, খাবার ঘরের বাসন-আলমারির উপর একটা চাবি ঝোলানো ছিল সেই চাবিটা দিয়া প্রবেশদ্বার খুলিয়া বাহির হইয়া পড়ে; যাইবার সময় দরজার কপাটও ভেজাইয়া যায় নাই| যেন মূক দেওয়াল গুলাকে বলিতেছে এইভাবে গোলাপের বাপ নিম্নস্বরে জিজ্ঞাসা করিল:- "কোথায় সে?"

         সালমো-গৃহিণী আরও রাগিয়া, ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া বলিল:-
       ব্যাদড়া মেয়ে! খারাপ কাজ ত করেইছে-তার উপর আবার একগুঁয়েমি| বাপমায়ের শাসন মানে না-কি আস্পর্ধা! বাপ মা ত উচিত শাস্তিই দিয়েছিল| আচ্ছা, একবার ফিরে আসুক, তখন দেখা যাবে? টুপির দোকানদার বারম্বার সেই এক কথা বলিতে লাগিল|

         -"সে সব পরে হবে-এখন কোথায় সে?"

         -"আমি তার কি জানি| সেই বেহায়া মেয়েটাকে তুমি খুঁজে দেখা না, হয়ত সে তার খুড়ির ওখানে, কিংবা তার বন্ধু রাখালের ওখানে, কিংবা তার পিয়ানো-শিক্ষয়িত্রীর ওখানে গেছে| যাও যাও শীগগীর যাও, আর দেরি করো না|"
সালমো-গিন্নি তাঁর ছেলেটাকে খাওয়াইলেন, তাকে বিছানায় শুয়াইয়া দিলেন| তারপর, গজর-গজর করিতে করিতে স্বামীর অপেক্ষায় রহিলেন| তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তাঁর মেয়ে ভয়ে থতমত খাইয়া, অনুতপ্তা হইয়া ফিরিয়া আসিবে|
কিন্তু যখন তাঁর স্বামী হতবুদ্ধি হইয়া ফ্যালফ্যাল করিয়া তাকাইতে তাকাইতে একাকী ফিরিয়া আসিল, তখন গিন্নির বুকে যেন একটা শেল বিঁধিল| একটা ভীষণ সন্দেহ তাঁর হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করিতে লাগিল| তাঁর মেয়েকে কেহ হরণ করিয়াছে| নিশ্চয়ই, সেই ছোঁড়াটার কাজ| সেই হতভাগা|

            “নিশ্চয়ই সে, নিশ্চয়ই সে - ঐ সামনের বাড়ির ছোঁড়াটা - যাও দৌড়ে যাও, তাকে পাকড়াও করতে হবে|"
সালমো একেবারে হুড়মুড় করিয়া সেই বাড়িতে গিয়া পড়িল- কাকে খুঁজিতে যাইতেছে, কি বলিতে হইবে সে বিষয়ে তার স্পষ্ট কোন ধারণাই ছিল না| সে আমতা আমতা করিতে লাগিল, অসংলগ্ন কথা বলিতে লাগিল, একটি সুন্দর ছেলে সেখানে আছে কিনা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল|

          হোটেলের কর্ত্তা তাঁর প্রতিবেশীর এলোমেলো পরিচ্ছদ দেখিয়া বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন:- আপনি কার সঙ্গে কথা কইতে চান? পরিষ্কার করে বলুন না -মাথামুণ্ডু! আমি যে কিছুই বুঝতে পারচিনে|

          সালমোর সহজবুদ্ধি আবার ফিরিয়া আসিল - সালমো ভাবিল ঠিক কথাটা লুকাইতে হইবে| মুখে একটু শান্তভাব আনিবার চেষ্টা করিল|

        -আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম বলে, আমার কথাগুলা একটু খাপছাড়া রকম হচ্ছিল| তোমাদের তেতালায় যে সুন্দর ছেলেটি থাকে তার সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই - কেবল আমি তার নামটা ভুলে গিয়েছি|

       -"সেই বেলা, যে দেশ বিদেশে রেশমি কাপড় বেচে বেড়ায়?"

       -"বোধ হয় সেই, আমি জানিনে| আরে সেই সুন্দর ছোঁড়াটা যে সর্ব্বদাই তাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে|" হোটেল-কর্ত্তা একটু চাপা হাসি হাসিলেন| বেশ যাহোক, সালমো মশায় এমন একজনকে খুঁজছেন যাকে তিনি জানেন না| আপনার সেই সুন্দর ছোকরা কাল যে চলে গেছে| তার ঘোরাঘুরির কাজ শেষ হয়েছে, ৬ মাসের মধ্যে সে আর ফিরবে না|

         এই কথা শুনিয়া দুর্ভাগ্য সালমোর মনে হইল যেন তাহার মাথায় ছাদটা ভাঙ্গিয়া পড়িল| সে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল|

          চলে গেছে, কাল চলে গেছে? সে যখন হরণ করে নিয়ে যাইনি-তবে আমার মেয়ে এখন কোথায়?
চট করিয়া উঠিয়া সালমো রাস্তায় নামিয়া পড়িল এবং লম্বা লম্বা পা ফেলিয়া পাগলের মত রাস্তা দিয়া চলিতে লাগিল; তারপর এক-এক লাফে সিঁড়ি দিয়া উঠিয়া দরজায় দাঁড়াইয়া স্ত্রীকে বলিল:-

         -"সে না, সে চলে গেছে|" গোলাপের মা বলিয়া উঠিল:-

           ওমা কি হবে! আমার মেয়ে!

            এখন আর বিবেচনার সময় নাই, যে রকমেই হোক মেয়েকে খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে| প্রতিবেশীদের খবর দেওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই কথাটা তাহাদের মধ্যে খুব রাষ্ট্র হইয়া গেল|

             পল্লীগ্রামে এইরূপ কোন ঘটনা ঘটিলে লোকেরা খুব কৌতূহুলী ও বাচাল হইয়া উঠে; কিন্তু যারা বহুকাল হইতে পরস্পর জানে, পাশাপাশি একত্র বাস করিয়াছে, বুড়াইয়া গিয়াছে, একই রকম জীবন যাপন করিয়াছে - তাহাদের মধ্যে একটা প্রগাঢ় একাত্মভাব থাকে| ২০ জন পুরুষ বাড়ী হইতে তৎক্ষনাৎ বাহির হইয়া পড়িল - সেই সময় কেহবা খাইতে খাইতে গল্পগুজব করিতেছিল, কেহবা তাস খেলায় মাতিয়াছিল| কিন্তু এই খবর পাইবামাত্রই তাহারা সব ছাড়িয়া গোলাপকে খুঁজিতে চলিল|

              মাতৃভাবে ঘা লাগায় রমণীগন আসিয়া সালমো-গৃহিণীকে ঘিরিয়া রহিল; নানাপ্রকার সান্ত্বনা বাক্য বলিতে লাগিল; তাহাকে বুঝাইতে চেষ্টা করিল, তাহার ভয় নিতান্ত ছেলেমানুষী| প্রত্যেকেই উহারই সদৃশ ঘটনা উল্লেখ করিল, কত অভিমানী মেয়ে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল, তারপর সহরময় ঘুরে আবার ভাল মানুষের মত ঘরে ফিরে এসেছে - বেড়াল-বাচ্ছা যেমন খামখেয়ালি ভাবে বাহিরে চলে গিয়ে আবার ঘরে এসে ঢোকে - এ সেই রকম| বিশেষতঃ ভালনর গৃহিণী - যাহার মন অনুতাপে একটু বিচলিত হইয়াছিল, সে আরও বেশী রকম আশ্বাস দিল|

            কিন্তু সালমো-গৃহিণী ও সব কিছুই শুনিল না| একটু শব্দেই চমকিয়া উঠিতে লাগিল; দরজার দিকে ছুটিয়া গিয়া আবার হতাশ হইয়া ফিরিয়া আসিতে লাগিল| প্রত্যেক মিনিটেই তার দুর্ভাগ্য আরও যেন গাঢ়রূপে অনুভব করিতে লাগিল|

           অবশেষে, মনের যন্ত্রণায় অভিভুত হইয়া, সিঁড়ির তলদেশ হইতে আর নড়িল না, লোহার রেলিং-এ ঝুঁকিয়া তাহাতে ভর দিয়া রহিল-লোহার ঠাণ্ডায় তাহার জ্বালা যেন একটু উপশম হইল| সেখানে হইতে, সিঁড়ির অন্ধকারের মধ্যে, চারিদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে লাগিল, আর সেই এক কথাই বার-বার বলিতে লাগিল :- "গোলাপ! আমার খুকী!" ঐ পুরাতন বাড়ি, উহার বিষাদ-ঘন প্রতিধ্বনী করিতে লাগিল|

          অনুসন্ধানকারীরা প্রথমে ষ্টেশনের দিকে গেল, কিন্তু পলাতকের কোন সন্ধান পাইল না| সহরের মাঝে গিয়াও কোন খবর পাইল না| কিন্তু একটা বিশেষ রাস্তায় গিয়া পড়ায় একটু খোঁজখবর পাওয়া যাইতে লাগিল|

          কতকগুলি লোক যাহারা প্রায় ৫টার সময় তাহাদের দরজার দাওয়ায় দাঁড়াইয়া হাঁ করিয়া আকাশের পানে চাহিয়াছিল, তাহারা ঐ সুন্দর মেয়েটিকে দেখিতে পাইয়াছিল - খুব ফর্সা - চুল খুব কালো| কোয়াসার মধ্য দিয়া মেয়েটি মাথা নীচু করিয়া খুব দ্রুতপদে চলিতেছিল| তাহারা ভাবিয়াছিল, কোন প্রেম-মুগ্ধা বালিকা, এই কোয়াসায় সুযোগ পাইয়া কোন সংকেত-স্থানে যাইতেছে|

         আর কতকগুলি লোক বলিল, মেয়েটির রকম-সকমে আশ্চর্য হইয়া তাহার পিছু পিছু খানিক দূর গিয়াছিল| কিন্তু সে একটা রেলওয়ে সাঁকোর নীচে ঢুকিয়া পড়িল- তাহার কালো চুল ছাড়া কিছুই দেখিতে পাওয়া গেল না|
তখন রাত্রি ৭ টা| নগরের কাজকর্ম্ম সারা হইয়া গিয়াছে| এই সাঁকোর পর-পারে ফাঁকা মাঠ ধু ধু করিতেছে; কেবল একটা খাল ও একটা নদী মাঠকে খণ্ডিত করিয়াছে|

         নদীর কর্ণবধিরকর কল কল শব্দ শুনা যাইতেছে|

          কালোসাপের মত একটা খাল আকিয়া-বাঁকিয়া চলিয়াছে - যেন তাহার আর শেষ নাই| ঐ খালের ধার দিয়া গোলাপ কাঁপিতে কাঁপিতে চলিয়াছে - তাহার সর্ব্বাঙ্গ হিমে জমিয়া গিয়াছে| সে স্বপ্নচারীর মত চলিয়াছে - কোথায় যাইতেছে জানে না, কোথা হইতে আসিয়াছে ঠিক মনে করিতে পারিতেছে না-কেবল ধমকানি ও নিষ্ঠুর প্রহারের দৃশ্যটাই তার মনে ছিল - মার খাওয়া! সে যেন হল - ছোট মেয়েকে শাসনের জন্য প্রহার করা যেতেও পারে; কিন্তু অপমানিত হওয়া! ওরা ওকে পাপীয়সী মনে করেছে| গোলাপের মা ক্রোধান্ধ হইয়া, কোন ঢাকাঢাকি না করিয়া, কঠোরভাবে স্পষ্ট কথা শুনাইয়া দিয়াছে| তার মুখের এমন কতকগুলা জঘন্য কথা বলিয়াছে যার অর্থ বালিকা কিছুই বুঝিতে পারে নাই| এইটুকু মাত্র আন্দাজে বুঝিয়াছিল, তাকে কলঙ্কিনী মনে করা হইয়াছে|

         সে পাপীয়সী! সে এমন কি কাজ করিয়াছে যাহাতে ঐ নামে সে অভিহিত হইতে পারে?

         সর্ব্বদাই একলা থাকে, কোন কাজ নাই; সে তার প্রতিবেশী সুন্দর ছোকরাটার গুপ্ত প্রেমের হাবভাবে আমোদ পাইত এই মাত্র| ইহাতে তার মনের উপর বিন্দুমাত্র আঁচ লাগে নাই|

         পর্দ্দার আড়ালে থাকিয়া, পর্দ্দার একটু ফাঁক হইতে, সে তার রঙ্গভঙ্গ দেখিয়া, জানালার ধারে তাহার দাঁড়াইবার ভঙ্গী দেখিয়া, তার শূন্যে নিক্ষিপ্ত চুম্বনের ইঙ্গিত দেখিয়া সে ও নেওমী দু'জনেই হাসিত|

        তারপর এই রঙ্গলীলার মজাটা খানিকক্ষণ উপভোগ করিয়া সে প্রচ্ছন্ন হইয়া পড়িত| তখন পাচিকা পোড়া চামড়ার দাগে চিহ্ণিত তার মুখখানা নির্লজ্জভাবে বাহির করিত এবং নানাপ্রকার মুখভঙ্গী করিয়া প্রেমের হাবভাব প্রকাশ করিত| তখন সেই ছোকরা সেই কদাকার পাচিকার হৃদয় জয় করিয়াছে দেখিয়া একটু ভীত হইয়া পড়িত|

        গোলাপ যখন বাহিরে যাইত, সেই ছোকরা তার পিছনে দ্রুতপদে চলিত-চলিতে চলিতে হাঁপাইয়া পড়িত| কেবল একবার ঘোড়-দৌড়ের মাঠে তাহাকে কাছাকাছি পাইয়া, ইয়ারকীর ধরণে কতকগুলি কুৎসিৎ কথা বলিয়াছিল, একথা সত্য; তখন গোলাপ ভীত হইয়া তাহার ধাত্রীর হাত ধরিয়া পলায়ন করে এবং মনে মনে ভাবিয়াছিল, যখন এরূপ খারাপ পরিণাম হইয়াছে, সে আর কখন তাহার রঙ্গভঙ্গ দেখিয়া হাসিবে না|

        গোলাপের একটা ভুল হইয়াছিল, সন্দেহ নাই| তাকে কি এইজন্য প্রহার করা, অপমান করা, ইঁদুর ছুঁচোর মত, আবর্জ্জনার মত একটা নোংরা জিনিস মনে করিয়া সেইরূপ তাহার প্রতি ব্যবহার করা উচিত হইয়াছিল? তার মা তাকে ভালবাসে না, যদি ভালবাসিত তাহা হইলে ধমকাইয়া তাহার পর আবার তাকে কোলে তুলিয়া লইত - না, মা তাকে দুচক্ষে দেখতে পারে না - মা ছোট ভাইটিকে খুব ভালবাসে; মেয়েকে কখনই ক্ষমা করবে না-তাহলে এখন দূরে চলে যাওয়াই ভাল| এইরূপ ভাবিয়া সে আবার পথ চলিতে লাগিল - তার মায়ের ভীষণ রুদ্র মুখ তাহাকে যেন বরাবর অনুসরণ করিতে লাগিল|

        বালিকা চলিতে চলিতে ক্লান্ত হইয়া পড়িল, পাথরে ঠোক্কর খাইতে লাগিল, ছেঁড়া চটিজুতা পায়ে, চোট লাগিয়া পা থেথ্লিয়া গেল| সেখানকার অস্বাস্থ্যকর জোলো-বাতাসে সে ভিজিয়া গেল| গলায় কোন গলবন্ধ ছিল না, কিছুতেই গরম হইতে পারিতেছিল না|

         বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ হইতেছে - দুইধারে গাছের সারি - গাছের পাতা ঝরিয়া পড়িতেছে-ঘোর অন্ধকার, চারিদিক নিস্তব্ধ - বালিকার বড় ভয় হইল| তার দাঁতে দাঁতে লাগিতে লাগিল - মনে হইল তার মৃত্যু আসন্ন|
সমস্ত জায়গাটাই যেন মৃত্যুবৎ-তাহার মধ্যে সেই একমাত্র প্রাণী জীবন্ত| মসীর মত কালো মেঘে, কাঞ্চন-কান্তি তারাগুলা ডাকিয়া গিয়াছে, অলস চন্দ্রমা অদৃশ্য হইয়া পড়িয়াছে-আকাশ হইতে কিছুই নামিতেছে না-পথ দেখাইয়া দিবে এমন একটি রশ্মিও আসিয়া পড়িতেছে না|

         বালিকা হতাশ হইয়া পথের ধারে বসিয়া পড়িল, অশ্রুপাত করিতে লাগিল-চীৎকার করিয়া কাঁদিতে লাগিল-বলিতে লাগিল:-"ওগো তোমরা কেউ এসে আমার সঙ্গে দুটো কথা কও, আমার উপর একটু মমতা কর-আমি শীতে কাঁপছি-আমার শরীর একটু গরম করে দাও|"

        গোলাপ ভাল মেয়ে, অতি কোমল-প্রকৃতি, কোন খারাপ কাজ সে কখনই করে নাই; সে যদি সুন্দরি হয় - সে তাহার দোষ নহে - এই জন্যই তার মা তাকে দেখিতে পারে না, তার সুন্দর চোখ, সুন্দর ঠোঁট, তার বয়স ১৬ বৎসর, এই জন্যই কি সে অপরাধী? অন্য ছেলে মেয়ের মা আছে - কিন্তু তার মা নেই - তার মা বড় হিংসুটে - তাকে কেবলই কষ্ট দিচ্চে - যন্ত্রণা দিচ্চে - এত দূরে চলে যাই যাতে কেউ না আমাকে খুঁজে পয - আমাকে খুঁজে না পেলে হয়ত মায়ের একটু দুঃখ হবে|

        মরণের কথা তার মাথায় আসিল, ক্রমে তার সমস্ত মনকে দখল করিয়া বসিল; সে কল্পনা করিতে লাগিল, এইমাত্র উপায়ে তাহার মায়ের স্নেহকে সে জয় করিবে|

        এইরূপ ভাবিয়া তার মন যেন একটু ক্লান্ত হইল| কিন্তু তখনও সে কাঁদিতেছিল| সে মরে গেলে আবার হয়ত মায়ের ভালবাসা পাবে, তার কথা মনে করে আবার সবাই দুঃখ করবে-এই কথাটা তার অশ্রুর মধ্যেও একটা মাধুর্য্য আনিয়াছিল| আত্মহত্যাকে সে পাপ বলিয়া মনে করে নাই - সে মনে করিয়াছিল, সে তার মায়ের কাছে আপনাকে বলি দিতেছে|

        এ কাজটা খুব সহজ, খালটা দুই-পা দূরে, খুব মৃদু কলধ্বনি শুনা যাইতেছে; খালের বদ্ধ জল কুয়াসায় ঢাকা| গোলাপ মনে করিল, এইবার আস্তে আস্তে এই জলের ভিতর প্রবেশ করিবে|

        খুকী, একটু অপেক্ষা কর, একটু অপেক্ষা কর-তুই ঠাণ্ডায় ভয় করছিলি-রাত্রের ভয় করছিলি-কিন্তু এখন যে ভোর হয়ে এল-এইবার চারিদিক আলো হয়ে উঠবে-তোর মনটাও একটু প্রফুল্ল হবে-তবে একটু অপেক্ষা কর, একটু অপেক্ষা কর!!!

        কিন্তু বালিকা আর অপেক্ষা করিল না; সেই গভীর খালের মধ্যে ঝপ করিয়া পড়িয়া গেল-একটু যুঝাযুঝি করিল, ভয়ে ও যন্ত্রণায় চীৎকার করিয়া উঠিল-তারপর সব শেষ হইয়া গেল|

         পাশ্বর্বর্তী গ্রামের ক্ষেত্রভূমি হইতে মৃত শরীর এক্ষণে বাড়ীতে আনিতে হইবে|
       রোরুদ্যমান কতকগুলি লোকে তাহাকে আড়কোলা করিয়া লইয়া আসিল; দুই দিন পূর্ব্বে সে সিঁড়ি দিয়া দ্রুত নামিয়া আসিয়াছিল, সেই সিঁড়ি বাহিয়া আবার উপরে উঠিল| দরজার চৌ-কাঠে তাহার মা আসিয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরিল এবং চুম্বনে তাহাকে আচ্ছন্ন করিল| কিন্তু তাহার সেই সুন্দর চোক দুইটি চিরকালের মত মুদিত হইয়াছে-তাহার মুখের হাসিটি চিরকালের মত অন্তর্হিত হইয়াছে - মায়ের অজস্র আদরেও তার ওষ্টযুগল আর স্পন্দিত হইতেছে না; - সে মৃত্যুর মূল্যে আদর কিনিয়াছে - কিন্তু তার মা আর তাকে এই পৃথিবীতে ফিরিয়া আনিতে পারিবে না|

        সালমো-গৃহিণী ঘোরতর বিষাদে অভিভূত| এই আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে ১০ বৎসরের মত বুড়াইয়া গিয়াছে; মাথার চুল সাদা হইয়া গিয়াছে; তাহার চোখে কালে পড়িয়াছে, মুখ তুবড়িয়া গিয়াছে| অনুতাপে তাহার হৃদয় দগ্ধ হইতেছে; তার মেয়ের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছে, আর ক্রমাগত মাটিতে কপাল ঠুকিতেছে| সে এইরূপ বলিতে লাগিল;- "গোলাপ, আমার গোলাপ, আমার চির-আনন্দ, আমার প্রাণ-পুত্তলী, একবার আমার সঙ্গে কথা ক'| আ, তুই মরিস নি; তুই এমন করে কখনই আমাকে ছেড়ে যাসনি-বাচ্ছা আমার পেটের মেয়েকে-আমি মেরেছি-তোর নিষ্কলঙ্ক চরিত্রের উপর মিথ্যে দোষ দিয়ে তোকে আমি কলঙ্কিত করেছি-তাই তোর হতভাগিনী মাকে ছেড়ে তুই চলে গিয়েছিস| ভগবান আমাকে একটি নিষ্কল্ঙ্ক শুভ্র কপোতী দিয়েছিলেন-আমি তাকেই কি না বধ করেছি! প্রভু আমাকে যত ইচ্ছা শাস্তি দাও-আমি শাস্তিরই যোগ্য| আমার চুল কেটে ফেলব, মুখে মাথায় ছাই মাখব, যতদিন বাঁচি সন্ন্যাসিনীর মত জীবন যাপন করব-গোলাপ আমার, খুকী আমার, আদরিণী আমার-একবার চোখ খুলে আমার দিকে চা-মা আমার!-একটিবার-একটিবার-সেখানে যাহারা উপস্থিত ছিল তার মধ্যে ভালনর-গৃহিণীকে দেখিতে পাইয়া গোলাপের মা তাহার উপর ঝাঁপাইয়া পড়িল| এবং বিদ্বেষপূর্ন কর্কশস্বরে চীৎকার করিয়া বলিতে লাগিল; "আমি ওকে বধ করেছি, কিন্তু তুই-ই আমাকে কতকগুলো মিথ্যা কথা বলে আমাকে দিয়ে কাজটা করিয়েছিস-আমরা দুজনেই খুনের অপরাধী!"

         উহার হাত হইতে ভালনর-গৃহিণীকে ছিনাইয়া লইতে হইল-নচেৎ গলা টিপিয়া মারিয়া ফেলিত|

        জীবনের মধ্যে এই একবার শুধু সালমো-গৃহিণী ইহুদি পোষাক বর্জ্জন করিল| সাদা কাপড়ে তাহার মেয়েকে না ঢাকিয়া, ক'নের যে প্রকৃত পরিচ্ছদ সেই রেশমী শাড়ী তাহাকে পরাইয়া দিল, কেন না সে একবার অনন্তের সহিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইল| তাহার বক্ষদেশ, তাহার সুগোল স্কন্ধ, তাহার সুকুমার বাহুদ্বয় টাটকা গোলাপ গুচ্ছে আচ্ছাদিত হইল| তাহার কাণের মুক্তা-অলঙ্কার হইতে শুভ্র কিরণ বিচ্ছুরিত হইতেছে| তাহার রেশমী কোমল থোলো থোলো কেশগুচ্ছ যেন আদর করিয়া তাহার গলার উপর এলইয়া পড়িয়াছে| এইরূপ সাজ সজ্জায় ভূষিত হইয়া রূপসী গোলাপ-বালা তাহার কোন এক অজ্ঞাত প্রিয়তমের নিকট চলিয়া গেল|

         গোলাপকে যখন কবরস্থ করা হয় তখন আমি উপস্থিত ছিলাম| যেরূপ ক্যাথলিকদের মধ্যে সেইরূপ ইহুদীদিগের মধ্যেও আত্মহত্যা একটা মহাপাপ বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে| এইজন্য পাড়া মেয়েরা সমাধি-শকটের রজ্জু কেহই ধরিতে রাজি হইল না| তাহাদের মনে হইল যেন এই কুমারীর শবাধার হইতে জ্বলন্ত অভিসম্পাত ঊর্দ্ধে উত্থিত হইতেছে| উহারা তাহার সংস্পর্শে বিপন্ন হইবে|

         গোলাপের বোর্ডিং-স্কুলের বন্ধুরা খুব ভালো খৃষ্টান, তাহার সমস্ত বিপদ ঘাড় পাতিয়া লইল; তাহারা তাহাদের গোলাপকে কখনই একা যাইতে দিবে না, তাহারা অনুযাত্রী হইয়া শবের পিছনে পিছনে চলিল|

         ইহুদি-পুরোহিত অন্ত্যেষ্টি মন্ত্র পাঠ করিলেন| পুরোহিত গোলাপকে জন্মাইতে দেখিয়াছিল, তাহাকে খুব ভালবাসিতেন| পুরোহিত এই মর্ম্মস্পর্শী বিদায়-অভিভাষণ করিলেন:-

        -যাও গোলাপ, বসরাই গোলাপ, মৃত্যু তোমাকে চয়ন করিয়াছে| অনন্ত পুরুষ তোমার প্রতি সদয় হইবেন, তুমি স্বর্গে আবার ফুটিয়া উঠিবে, তোমার সৌরভ আর কখনো উবিয়া যাইবে না|

         তারপর পুরোহিত হিব্রু ভাষায় বড় বড় বাক্য উচ্চারণ করিয়া কি বলিলেন, আমি তার এক বর্ণও বুঝিতে পারিলাম না| কেবল দেখিলাম, সেই সজ্জন পুরোহিত অশ্রুপাত করিতেছেন এবং আমি এই আশাটুকু বহন করিয়া সঙ্গে আনিলাম যে, একজন বৃদ্ধের অশ্রুজল, গোলাপ বালার সমাধির উপর মার্জ্জনার আশ্বাসবাণীরূপে পতিত হইল|

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর


( ‘বঙ্গবণী’ পত্রিকা, কার্তিক ১৩৩০ )

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।