[
লেখক পরিচিতি : কামিনী রায় ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই
অক্টোবর বাখরগঞ্জের (অধুনা বাংলাদেশ) বাসণ্ডা গ্রামে
বৈদ্যবংশে জন্ম গ্রহণ করেন| পিতা চণ্ডীচরণ সেন ছিলেন
মুনসেফ| তিনি ছিলেন ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী এবং সাহিত্যানুরাগী|
কামিনী যখন সবে কথা বলতে শিখেছেন তখনই পিতামহ নিমচাঁদ
সেন তার কাছে নানা শ্লোক আবৃত্তি করতেন; সেগুলি শুনে
শুনে কামিনীর মুখস্থ হযে গিয়েছিল| তার বর্ণপরিচয় শিক্ষা
মা'র কাছে| মা অল্প অল্প লিখতে ও পড়তে জানতেন| সে
যুগে মেয়েদের লেখাপড়া করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলে
বিবেচিত হত| গ্রামের লোকদের ধারণা ছিল এতে দুর্নীতি
বৃদ্ধি পাবে এবং স্ত্রীলোকেরা গোপনে সকলের সঙ্গে পত্রালাপ
করবে| কামিনী সংগোপনে রানাঘরের মাটির দেয়ালে কাঠের
শলাকা দিয়ে অক্ষর লেখা অভ্যাস করতেন এবং শেষে মাটি
ও গোবরের প্রলেপ দিয়ে সব ঢেকে দিতেন|
স্কুলের আপার প্রাইমারী পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে
প্রথম স্থান পেয়েছিলেন| বাবার কাছে তিনি গণিত এতটাই
ভাল শিখেছিলেন যে গণিতের শিক্ষক শ্যামাচরণ বসু তাকে
লীলাবতী আখ্যা দিয়েছিলেন| চোদ্দ বছর বয়সে তিনি প্রথম
বিভাগে মাইনর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন| ছোটবেলা থেকেই
কামিনী ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির| বাবার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে
তিনি বহু সময় কাটাতেন| আট বছর বয়সে প্রথম কবিতা লেখেন
কামিনী; খুসি হয়ে বাবা তাকে কৃত্তিবাসের রামায়ণ এবং
কাশীরাম দাসের মহাভারত উপহার দিয়েছিলেন| প্রতিদিন
তিনি উপাসনার পর বাইবেল বা অন্য ধর্মগ্রন্থ থেকে অংশবিশেষ
পাঠ করতে দিতেন কামিনীকে| ইংরাজি, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল
তিনি নিজেই পড়াতেন| স্কুলে পাঠাবার সময় বাবা তাকে
বলেছিলেন মনে রাখবে "My life has a mission”|
ষোল বছর বয়সে কামিনী প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে
উত্তীর্ণ হন এবং ১৮৮৬ সালে বেথুন কলেজ থেকে সংস্কৃতে
অনার্স নিয়ে বি.এ পাশ করে সে বছরই বেথুন কলেজে শিক্ষয়িত্রীর
পদে যোগদান করেন| ভারতে তিনিই প্রথম মহিলা অনার্স
গ্র্যাজুয়েট| ১৮৯৪ সালে কামিনীর বিয়ে হয় কেদারনাথ
রায়ের সঙ্গে| কেদারনাথ ছিলেন স্ট্যাটিউটরি সিভিলিয়ান|
১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে 'আলো ও ছায়া'
কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে কবির খ্যাতি
ছড়িয়ে পড়ে| বইতে প্রথমে কবির নাম ছিল না কিন্তু পড়ে
সবাই তার পরিচয় জানতে পারে| কবিবর হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
কবিতাগুলির প্রশংসা করে লিখেছেন - "এই কবিতাগুলি
আমাকে বড়ই সুন্দর লাগিয়াছে; স্থানে স্থান এমন মধুর
ও গভীর ভাবে পূর্ণ যে, পড়িতে পড়িতে হৃদয় মুগ্ধ হইয়া
যায়| ফলতঃ বাঙ্গালা ভাষায় আমি এইরূপ কবিতা অতি অল্পই
পাঠ করিয়াছি|......." গ্রন্থটির অষ্টম সংস্করণ
অবধি প্রকাশনা থেকেই বোঝা যায় সেটি কতটা সমাদৃত হয়েছিল|
কামিনী রায় জীবনে বহু শোকে বিপর্যস্ত হয়েছেন| ১৯০০
খ্রীষ্টাব্দে তার একটি সন্তানের মৃত্যু হয়| ১৯০৮ সালে
ঘোড়ার গাড়ি দুর্ঘটনায় স্বামী প্রাণ হারান| ১৯২০ তে
মৃত্যু হয় কন্যা লীলা ও পুত্র অশোকের| এ সময় তিনি
রচনা করেন 'অশোক সঙ্গীত' - পুত্র শোকাতুরা জননীর শোকের
অভিব্যক্তি| কামিনী রায়ের কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য
হল ভাব ও ভাষার স্পষ্টতা| 'আলো ও ছায়া'র কবিতা এক
সময় বিদ্যালয়ে পাঠ্য পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল|
কবিতাটির কয়েক পংক্তি -
"পতিত মানব তরে নাহি কি গো এ সংসারে
একটি ব্যথিত প্রাণ দুটি অশ্রুধার?
পথে পড়ে অসহায়, পদে তারে দলে যায়,
দু'খানি স্নেহের কর নাহি বাড়াবার?
সত্য, দোষে আপনার চরন স্খলিত তার
তাই তোমাদের পদ উঠিবে ও শিরে?
তাই তার আর্ত রবে সকলে বধির হবে,
যে যাহার চলে যাবে - চাহিবে না ফিরে?
তোমাদেরি বাতি দিয়া, প্রদীপ জ্বালিয়া
নিয়া,
তোমাদেরি হাত ধরি হোক অগ্রসর,
পঙ্কমাঝে অন্ধকারে ফেলে যদি যাও তারে
আঁধার রজনী তার রবে নিরন্তর|"
১৮৮০ সালের
৩০শে জুন, এনট্রান্স পরীক্ষার ছ'মাস আগে, মীরজাফার্স
লেনের বাড়ীতে রচিত তার 'সুখ' কবিতাটি এক সময়ে বহু
লোকের মুখে মুখে ফিরত| তার দেহপ্রেম উদ্বেলিত হয়েছে
তার 'শুনে যা আমার আশার স্বপন' বা 'মা আমার' কবিতায়|
'মা আমার' কবিতার কয়েক পংক্তি -
"যে দিন ও চরণে ডালি দিনু এ জীবন,
হাসি অশ্রু সেইদিন করিয়াছি বিসর্জ্জন|
হাসিবার কাঁদিবার অবসর নাহি আর,
দুঃখিনী জনম ভূমি, - মা আমার
মা আমার|"
বিলাতের এক ভদ্রলোক কামিনী রায়কে বলেছিলেন -"আপনার
'মা আমার মা আমারও গানটাই আমার জীবনের মূলমন্ত্র হইয়া
আমাকে চালাইতেছে|"
কামিনী রায় তার প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ কলিকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'জগত্তারিণী স্বর্ণপদক' লাভ করেন
(১৯২৯)| তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি (১৯৩২-৩৩)
এবং নারী শ্রমিক তদন্ত কমিশনের অন্যতম সদস্যা ছিলেন
(১৯২২-২৩)| ১৯৩০ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের
অভ্যর্থনা সমিতির সভানেত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি|
বৈদ্যবাটী যুবক সমিতির সভ্যবৃন্দ ১৩৩২ বঙ্গাব্দের
৭ই চৈত্র এবং সাহিত্য পরিষদের বরিশাল শাখা ১৩৩০-এর
৭ই পৌষ তাকে অভিনন্দন পত্র প্রদান করে| তার ভগিনী
ডঃ যামিনী সেন একজন প্রতিষ্ঠিত লেডি ডাক্তার ছিলেন|
তার রচিত কাব্যগ্রন্থ - 'আলো ও ছায়া' (১৮৮৯); ‘নির্মাল্য'
(১৮৯০); 'পৌরাণিকী' (১৮৯৭); 'অশোক স্মৃতি' (জীবনী,
১৯১৩); 'অশোক সঙ্গীত' (সনেট, ১৯১৪); 'গুঞ্জন' (শিশু
কবিতা, ১৩১১); 'মাল্য ও নির্মাল্য' (১৯১৩); 'অম্বা'
(১৯১৫); 'ঠাকুরমার চিঠি' (১৯২৩)| গল্পগ্রন্থ - 'ধর্ম্মপুত্র'
(১৩১৪); 'শ্রাদ্ধিকী' (১৯১৩); 'সতীমা' (নাটক, ১৯১৯);
'ডঃ যামিনী রায়ের জীবনী'; 'দীপ ও ধূপ' (১৯২৯); 'জীবনপথে'
(সম্পাদিত, ১৯৩০)| 'মহাশ্বেতা' ও 'পুণ্ডরীক' তার তার
দুটি রোমান্টিক দীর্ঘ কবিতা| তার কবিতার অপর এক বৈশিষ্ট্য
আশ্বাস ও আত্মশক্তিতে বিশ্বাস| এটি ফুটে ওঠে যখন তিনি
লেখেন -
"ওরে ক্ষুদ্র অবজ্ঞাত, ওরে শূদ্র ভাই,
দেবত্বের পথে যেতে কারো
বাধা নাই|
নিজ দোষে, পর রোষে, পাপে
কিম্বা শাপে
জন্মিয়াছ হীন কূলে - এ
হেন প্রলাপে
পাতিও না কর্ণ তব| চন্দ্র
সূর্য্য যাঁর
জ্ঞানের রচনা সেই বিশ্ব
বিধাতার -
পুত্র তুমি আছে তব উত্তরাধিকার
তার জ্ঞান ধনে, প্রেম
পুণ্যধনে আর|"
গোয়ালা বউ, গোয়ালা বউ, তোমার কাখে কি?
"কেড়ে ভরা দুধ আর ভাঁড়ে আছে ঘি|"
"কত দুধে গোয়ালিনী কতখানি জল?"
"আমার দুধ নির্জ্জলা, ঘৃত সুনির্ম্মল|"
"গোয়ালা বউ, বল না গো কার দর কি?"
"বার সের দুধ টাকায়, দশ ছটাক ঘি|"
"একটা টাকা দিলে দেবে দুধ বার সের,
গোয়ালিনী, তোমার ঘরে টাকা তবে ঢের|"
"কোথায় টাকা দিদিমণি, দুধ বেচে যা পাই,
তাই দিয়ে চাল, ডাল, নুন কিনে খাই|"
"আর কি আছে তোমার ঘরে?" "কি
থাকবে ভাই?"
দই, ঘোল, মাখন, আর গোটাকত গাই|"
(
'অন্তঃপুর' পত্রিকা, বৈশাখ ১৩০৮ )|
(এখানে মূল রচনার সঙ্গে প্রকাশিত ‘গোয়ালা বৌ’ -এর
ছবিটি সংযুক্ত হল)।
( লেখাটির শেষে সম্পাদক জানিয়েছেন -"অন্তঃপুর
যখন বাহির হয় তখন শিশুদের শিক্ষার জন্য ও আমোদের
জন্য কিছু কিছু লিখা থাকিবে, এইরূপ স্থির হয়, এবং
প্রথম বর্ষে সেইরূপ হইয়াছিল| নানা কারণে ২য় ও ৩য়
বর্ষে এই প্রকার লিখা বাহির হয় নাই| এখন হইতে আবার
সেইরূপ বাহির হইবে|” )