প্রথম
পাতা
শহরের তথ্য
বিনোদন
খবর
আইন/প্রশাসন
বিজ্ঞান/প্রযুক্তি
শিল্প/সাহিত্য
সমাজ/সংস্কৃতি
স্বাস্থ্য
নারী
পরিবেশ
অবসর
|
পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
পেনসনের
পর
কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
(দিল্লীর প্রাবাসী বঙ্গ-সম্মিলনে পঠিত)
[লেখক
পরিচিতি : কেদারনাথের জন্ম ১২৬৯ বঙ্গাব্দের ৪ঠা ফাল্গুন (১৫ই
ফেব্রুয়ারী, ১৮৬৩) রবিবার ২৪ পরগণার দক্ষিনেশ্বরে। পিতা গঙ্গানারায়ণ
বন্দ্যোপাধ্যায়। কেদারনাথেরা ছিলেন তিন ভাই। গঙ্গাপ্রসাদ ও
বিন্দুবাসিনী দেবীর মধ্যম পুত্রটি কেদারনাথ। বর্তমান 'শ্রীশ্রীসারদাদেবী
বিদ্যামন্দিরে'র উত্তর-পশ্চিমে কোণের ঘরে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন
তিনি। এজন্যই বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে স্থাপিত হয়েছে কেদারনাথের
আবক্ষ মূর্তি। দক্ষিণেশ্বর বঙ্গ-বিদ্যালয়ে ( এখনকার দক্ষিণেশ্বর
উচ্চ বিদ্যালয় ) কিছুদিন পড়াশোনা করে উত্তরপাড়া হাই ইংলিশ
স্কুলে (বর্তমান উত্তরপাড়া গভর্ণমেণ্ট স্কুল) ভর্তি হন; কিন্তু
গঙ্গা পার হয়ে যাতায়াত করতে হত বলে মায়ের আপত্তিতে দু'বছর
পর কুটিঘাটা স্কুলে চলে আসেন। দাদা মিরাটে বদলি হয়ে যাওয়ায়
সবাই মিরাটে চলে যান। মিরাটে বাঙালীদের জন্য স্কুল ছিল না;
যে সব স্কুল ছিল, সেখানে হিন্দি এবং উর্দু জানা আবশ্যিক ছিল।
শেষে কোন্নগর-নিবাসী কেদারনাথ দত্তের স্কুলে ভর্তি হলেন। দু'বছর
পরে দাদা বদলী হয়ে চলে আসেন আম্বালায়। আম্বালায় অতি কষ্টে
ইংরেজদের একটি কোচিং ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হয়েছিলেন। এভাবে ঘন
ঘন স্থান পরিবর্তনে পড়াশোনা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কেদারনাথ
লিখেছেন 'পথে পথে বিদ্যার্জন চলছিল।' কিন্তু এন্ট্রান্স পরীক্ষা
ত দিতে হবে। ভর্তি হলেন লক্ষ্ণৌ ক্যানিং কলেজিয়েট স্কুলে।
পরীক্ষার ঠিক আগে, দাদার বন্ধুর টেলিগ্রাম আসে দক্ষিণেশ্বর
থেকে, চাকরীর ব্যবস্থা হয়েছে। অফিসের ভুলে দাদা কাজ খুইয়েছেন,
তাই চাকরী না করলেই নয়। অতএব পড়াশোনার ইতি সেখানেই। দাদা অবশ্য
ছ'মাস পরে পুনর্বহাল হয়েছিলেন।
কলকাতায় কেদারনাথ প্রথমে 'হাউণ্ড এলেন
কোম্পানী'র সওদাগরি দপ্তরে এবং পরে 'কমিস্যারিয়েণ্ট অফ অ্যাকাউণ্ট্'
অফিসে কাজ করেছেন। তিনি খুব অল্প বয়সেই, ১৮৮৮
খ্রীষ্টাব্দে কলকাতায় 'সংসারদর্পণ' নামে একটি মাসিক পত্রিকা
সম্পাদনা শুরু করেন কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ায় দু'বছর পরে সে
কাজ ছেড়ে দিতে হয়। তার নিজের কথাতেই -"তখনকার দিন ছিল
লেখক-বিরল; সম্পাদকদের পত্রিকার প্রায় অর্দ্ধেক পৃষ্ঠা পূরণের
ভার নিতে হত ... ।" পিতা গঙ্গানারায়ণ ফিরোজপুরে কর্মরত
ছিলেন। তিনি পূজোআর্চা ও পড়াশোনা নিয়ে থাকতেন। কবিগান ছিল
তার খুব প্রিয়। খুব অল্প বয়সেই কেদারনাথ পিতাকে হারান। পিতার
মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তিনি কেদারনাথকে একটি খাতা দিয়ে বলেছিলেন
'এখানি যত্ন করে রেখো, এরপর দেখে খুব আনন্দ পাবে।' কিন্তু
অল্প বয়সে পাওয়া সেই খাতা কেদারনাথ বড় হয়ে আর খুঁজে পান নি।
মনের কষ্টে তিনি আড়াই বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রায়
তিন'শ কবি সঙ্গীত সংগ্রহ করে ১৩০১ বঙ্গাব্দে 'গুপ্তরত্নোদ্ধার'
নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। কবি হেমচন্দ্র গ্রন্থটির প্রশংসা
করেছেন এবং রবীন্দ্রনাথও 'সাধনা' পত্রিকার ১৩০২-এর জ্যৈষ্ঠ
সংখ্যাতে এই সঙ্কলনটির প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে একটি সুদীর্ঘ
নিবন্ধ প্রকাশ করেন। ১৩০২/০৩ বঙ্গাব্দে কেদারনাথ রচিত 'রত্নাকর'
নামে একটিম ক্ষুদ্র নাটক প্রকাশিত হয়। 'দৈনিক চন্দ্রিকা' ও
'বঙ্গবাণী' পত্রিকায় 'নন্দীশর্মার নোট' বা ডায়ারি নামে তিন
বছর ধরে হাস্যরসাত্মক 'চুটকি' প্রকাশ করেছেন কেদারনাথ। এই
সময়ে তার দুটি রচনা সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন -"ঐ সময় ঠাকুরবাড়ী
হতে 'বালক' নামে একটি পত্রিকা দেখা দেয়। এক সংখ্যায় 'লাঠি'
বলে একটি লেখা বাহির হয়। সেই সংস্রবে বোধ হয় মনীষী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ
(রবীন্দ্রনাথ) ঠাকুর 'লাঠির উপর লাঠি' চালান। আমি 'লাঠালাঠি'
লিখে [আষাঢ় ১২৯২] সেটা শেষ করে দি। পরে রবীন্দ্রনাথের "চিরঞ্জীবেষু"
বলে ইয়ং বেঙ্গলদের প্রতি ঠাকুদ্দার উপদেশ দেখা দেয়। আমি 'শ্রীচরণেষু'
বলে তার উত্তর দি [অগ্রহায়ণ ১২৯২]। বিষয়টি উভয়েই দু'তিন সংখ্যা
চালাই। তখন কে জানত যে, কার সঙ্গে এই বাচালতা করা হচ্ছে।"
এই সময়ে কেদারনাথের জনৈক বন্ধু তার দুটি
পাণ্ডুলিপি নিজের নামে প্রকাশ করলে, অত্যন্ত ব্যথিত কেদারনাথ
স্বেচ্ছায় বদলি নিয়ে জহ্বলপুর চলে যান। সেখানে তিনি সাত বছর
কাটিয়েছেন। সেনাবাহিনীতে চাকরীরত কেদারনাথের ভারতের উত্তর-পশ্চিম
সীমান্তে বার বার বদলির আদেশ এলেও মূলতঃ মায়ের আপত্তিতে তিনি
সেখানে যান নি। ইতিমধ্যে দাদা ও মা ইহলোক ত্যাগ করেছেন। কর্তৃপক্ষের
আদেশে এবার কেদারনাথ ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই মাসে চীনে চলে
যান। ১৯০৫-এ চীন থেকে ফিরে এসে কানপুরে ষ্টোর অফিসের ভার গ্রহণ
করেন এবং অনুরুদ্ধ হয়ে সেখানকার 'বঙ্গ-সাহিত্য-সমাজ' লাইব্রেরীর
সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেন। তার আগ্রহ এবং উদ্যোগে এলাহাবাদে
অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে 'বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ'-কে আমন্ত্রণ
জানান হয় - উদ্দেশ্য ছিল প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে বাংলা ভাষার
প্রতি আকর্ষণ ও শ্রদ্ধা বর্ধন। কেদারনাথের কোন পুত্র সন্তান
ছিল না। একমাত্র কন্যার বিয়ের পর তিনি চাকরি ছেড়ে দিতে মনস্থ
করেন । ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে মেডিকেল সার্টিফিকেট দিয়ে
চাকরিতে অবসর গ্রহণ করেন এবং কাশীতে বসবাস শুরু করেন।
কেদারনাথ 'চীনপ্রবাসীর পত্র' নামে 'ভারতী'
পত্রিকায় ( চৈত্র ১৩১০ ও বৈশাখ ১৩১১ ) দুটি লেখা লেখেন। লেখা
দুটিতে উল্লেখিত নারী শিক্ষা সম্বন্ধে তার নারীদের অর্থকরী
বিদ্যাশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
কাশীতে অবস্থান কালেও কেদারনাথ তার সাহিত্য চর্চা চালিয়ে গেছেন।
তিনি লিখেছেন -"অন্তরে কিন্তু সাহিত্য প্রীতির আসন পাতাই
ছিল। কোথাও না লিখলেও বাড়ীতে একখানা খসরা খাতা খোলা থাকত,
অবসর বিনোদনের উপায়ছলে। দশাশ্বমেধে সাধুসন্ত দেখে বেড়াই, সুযোগ
হলে সঙ্গও খুঁজি। তদ্ভিন্ন বিশেষ কিছু চোখে পড়লে বাসায় ফিরে
অন্তর কণ্ডুয়নবৃত্তি হিসেবে লিখে রাখি। খাতা খানি ক্রমে পুষ্ট
হতে থাকে।" এই খাতা অবলম্বন করেই 'নন্দিশর্মা' ছদ্মনামে
তার 'কাশীর-কিঞ্চিৎ' পুস্তক প্রকাশিত হয়। কাশীতে তার সঙ্গে
রসরাজ অমৃতলাল বসু ও কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রেরও সাক্ষাৎ হয়।
১৩২৭ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে কাশী থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা
'প্রবাস-জ্যোতিঃ' বছর খানেক সম্পাদনা করেছিলেন কেদারনাথ।
দাদা গোপালচন্দ্র সাহিত্য-চর্চাও করতেন।
'ইণ্ডিয়ান মিররে' তিনি নিয়মিত লিখতেন। 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকার
গ্রাহকও ছিলেন তিনি। কেদারনাথ সম্বন্ধে অমরনাথ ভট্টাচার্য
লিখেছেন- 'শাস্ত্রচর্চা-শিক্ষানুরক্তির ভাবগম্ভীর আবহে লালিত
হয়েছিল কেদারনাথের ছেলেবেলার দিনগুলি।' বঙ্গদর্শন পড়ে বঙ্কিমচন্দ্রের
অনুরক্ত হয়ে পড়েন তিনি। 'কমলাকান্ত' পড়ে তিনি অত্যন্ত মুগ্ধ
হয়েছিলেন; পরবর্তী কালে তার লেখাতেও এর ছাপ পড়েছে।
তার রচিত গ্রন্থ : 'রত্নাকর' ( অভিনয়
কাব্য, ১৮৯৩ ) ; 'গুপ্তরত্নোদ্ধার' ( প্রাচীন কবি-সঙ্গীত সংগ্রহ,
১৮৯৪ ) ; 'কাশীর কিঞ্চিৎ' ( রস কবিতা, ১৯১৫ ) ; 'কাশী সঙ্গীতাঞ্জলি'
( ১৯১৬ ) ; 'চীনযাত্রী' ( ভ্রমণ কাহিনী ,১৯২৫ - 'প্রবাস-জ্যোতি'
ও 'অলকা'য় প্রথম প্রকাশিত ) ; 'শেষ খেয়া' ( উপন্যাস, ১৯২৫
) ; 'আমরা কি ও কে' ( লিপিচিত্র, ১৯২৭ ) ; 'কবলুতি' ( লিপিচিত্র,
১৯২৮ ) ; 'কোষ্ঠির ফলাফল' ( উপন্যাস, ১৯২৯ ) ; 'পাথেয়' ( গল্প
সমষ্টি, ১৯৩০ ) ; 'ভাদুড়ী-মশাই' ( উপন্যাস, ১৯৩১ ) ; 'দুঃখের
দেওয়ালী' ( গল্প সমষ্টি, ১৯৩২ ) ; 'উড়ো-খৈ' ( রহস্য কবিতা,
১৯৩৪ ) ; 'আই হ্যাজ' ( উপন্যাস, ১৯৩৫ ) ; 'পাওনা' ( উপন্যাস,
১৯৩৬ ) ; 'মা ফলেষু' ( গল্প সমষ্টি, ১৯৩৬ ) ; 'সন্ধ্যাশঙ্খ'
( গল্প সমষ্টি, ১৯৪০ ) ; 'নমস্কারী' ( গল্পসমষ্টি, ১৯৪৪ )
; 'স্মৃতিকথা' ( ১৯৪৫ )। এ ছাড়া বহু লেখা 'ভারতবর্ষ', 'উত্তরা',
'শনিবারের চিঠি' প্রভৃতি সাময়িক পত্রে লেখা হয়েছে, যা গ্রন্থিত
হয় নি। সজনীকান্ত দাশের অনুরোধে তিনি নিজের জীবনের কিছু কথা
নিয়ে 'আত্মস্মৃতি' রচনা না করলে হয় ত তার সম্বন্ধে তেমন কিছুই
জানা সম্ভব হত না। কেদারনাথ সম্বন্ধে 'শণিবারের চিঠি' লিখেছে
-"বঙ্কিমচন্দ্র যেমন উচ্চবিত্ত, রবীন্দ্রনাথ যেমন বুদ্ধিজীবী
এবং শরৎচন্দ্র যেমন নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালীদের লইয়া সাহিত্য-সংসার
রচনা করিয়াছেন, কেদারনাথ তেমনই দরিদ্র বাঙালী কেরাণীদের লইয়া
এক নূতন সংসার গঠন করিয়াছেন।"
সাহিত্য সেবার স্বীকৃতি স্বরূপ মিরাট,
নাগপুর, কলকাতা, কাশী প্রভৃতি স্থানে অনুষ্ঠিত 'প্রবাসী বঙ্গ-সাহিত্য
সম্মিলন'-এর সভাপদির পদ অলঙ্কৃত করেছেন। তিনি ছিলেন 'প্রবাসী
বঙ্গ-সাহিত্য সম্মিলন'-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৩৩ খ্রীষ্টাব্দে
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি 'জগত্তারিণী পদক' লাভ করেন।
কেদারনাথ লিখেছেন -"জীবনে উল্লেখযোগ্য যদি কিছু থাকে"
তা হল -"শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, ধর্ম্ম ও কর্ম্মবীর
শ্রী বিবেকানন্দ স্বামী, শ্রী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, শ্রীযুক্ত
আচার্য কেশবচন্দ্র সেন ও বালগঙ্গাধর তিলক মহারাজের দর্শনলাভ।"
সাহিত্য-মহলে তিনি 'দাদামহাশয়' নামে পরিচিত ছিলেন। শেষ বয়সে
বিপত্নীক কেদারনাথ বিধবা কন্যা ও দৌহিত্রদের নিয়ে পুর্ণিয়াতে
বসবাস করতেন। সেখানেই ১৩৫৬ বঙ্গাব্দের ১২ই অগ্রহায়ণ ( ২৯শে
নভেম্বর ১৯৪৯ ) সোমবার শেষরাত্রে ৮৭ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন।
তিনি 'অন্তিম বাসনা' নামে একটি কবিতা লিখে গিয়েছেন। কবিতাটির
শেষ দু'টি পংক্তি -
"যা দিয়েছ
পেয়েছি তা, চলিলাম রাখি
তোমাদেরই শুভকামী
- তোমাদেরই থাকি।" ]
দীপক
সেনগুপ্ত ।
আমরা
বাঙ্গালী। বাঙ্গালী সম্বন্ধে অভিজ্ঞেরা-অর্থাৎ লেখক, বক্তারা,
একবাক্যে শেষ কথাটা বলে দিয়েছেন যে, এরা চাকুরে জাতি। চাক্রীই
যদি পেশা হল, ভালো চাক্রী খোঁজাই স্বাভাবিক। সরকারী চাক্রীই
সেরা-তাতে পেন্সন্ আছে, ভাগ্যে থাকলে খেতাবও মেলে।
আজকার এই সম্মিলনী-সভায় অনেক ভদ্রসন্তানই
থাকতে পারেন,-যদি অপরাধ না হয়তো তাঁদের অনুমতি নিয়ে বলি,-যাঁরা
সরকারী চাক্রী করেন, তাঁরা পেনসনের আশা রাখেন। কিন্তু পেন্সন্
কথাটা তাঁদের আজো শোনা জিনিষ; কাগজেকলমে জানলেও, সেটার আস্বাদ
তাঁরা পাননি। আমি কিছু কিছু পেয়েছি, তাই বোধ করি সে সম্বন্ধে
বলবার একটু দাবীও আছে।
আমাদের দেশে চাকুরেরাই বোধহয় বেশী লিখেছেন; ডেপুটিরাও চাকুরে,-অবশ্য
বড় চাকুরে। সম্ভবতঃ সেই আশাতেই সম্মিলনীর প্রধান কর্মচারী মহাশয়,
আমাদের কাছ থেকে গবেষণাপূর্ণ মৌলিক কাজের কথা প্রভৃতি চেয়েছেন।
তা তিনি নিশ্চয়ই পাবেন, তবে আমার কাছে নয়। পেনসন্ প্রাপ্তির
পরের অভিজ্ঞতাটা গবেষণাপ্রসূত বা মৌলিক না হলেও, অনেকের কাছে
নতুন, আর কাজের কথা বলে গৃহীত হতে পারে। অবশ্য এটা আমার অনুমান।
আমি সেই সম্বন্ধেই একটু বলছি। বিষয়বুদ্ধি কোনদিনই না থাকায় বিষয়
খুঁজে পাইনি; অপরাধ ক্ষমা করবেন।
জীবমাত্রেই মুক্তি খোঁজে, বন্ধন কেউ চায়
না, সেটা এড়াতেই চায়। আমিও জীবের মধ্যে একটি, তাই "জীবমাত্রেই"
বলেছি, "মানুষমাত্রেই" বলিনি। পেন্সন্ নেবার জন্যে
ছট্ফট্ করছিলাম, দিন গুণছিলাম। আপিসের প্যাড্খানা পঞ্জিকা হয়ে
দাঁড়িয়েছিল, দেহলি পুষ্পে ভরাট।
যেদিন থার্ড্ বেল্ দিলে, তিনটে বাজতেই "আর
কারোর চাকর নই" বলে কাগজপত্র গুটিয়ে, বাসায় চলে এলুম। অনন্তশয্যা
পাতাই ছিল, এসেই সটান্ চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লুম। সর্বাঙ্গে আনন্দের
তরঙ্গ ঢেউ খেলে বেড়াতে লাগলো, গায়ে আর ধরছে না। পা'দুটো সামনে,
আর হাত দুটো মাথা ডিঙ্গিয়ে সজোরে সোজা করে দিয়ে, উপর দিকে চেয়ে
বললুম-"উঃ এতটা দিন কাটিয়ে দিয়েছি। পঁ-চি-শ বছর! আজ তুমি
এলে! সত্যি এলে"!! বল্তে বল্তে এমন লম্বা হয়ে পড়লুম, খাটের
বাইরে পা গিয়ে পড়লো, হাত দুটো মাথা পেরিয়ে যেন দু'হাত তফাতে।
আজো বুঝতে পারিনে সত্য কি মিথ্যা। মনে আছে চোখে জল গড়িয়েছিল।
আনন্দের বেগ যে এটুকু শরীরে ধরছিল না। নিজেই অবাক হয়ে ভেবেছি।
মনে হয়েছে হবে না, কেন, বন্ধনমুক্তি যে। বদ্ধ অবস্থায় কি করে
বুঝব আমি কত বড়। নীলাচলে মহাপ্রভু সমুদ্রের নীল রং দেখে, শ্রীকৃষ্ণ
ভেবে আনন্দে 'এই যে এই যে' বলে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। জেলেরা তোলবার
পর অনেকেই দেখেছিলেন-তাঁর দেহ দেড়া হয়ে গেছে; আনন্দে অঙ্গ শিথিল
হয়ে হাতপায়ের খিল খুলে গেছে।
যাক্, মুক্তির আশার আনন্দেরই এতটা প্রভাব।
প্রকাশের বেদনা উপস্থিত, কার কাছে বলি, বাসায় কেউ নেই। চাকরটাকেই
বললুম। সে নিশ্চয়ই ভেবেছিল, বাবু ভাঙ্ খেয়েছেন।
বাসা তুলে বাড়ি গেলাম। দেহমনে কোথাও আর
ভার নেই, স্বাধীন জীব। এইবার একমনে ভগবানের নাম করা, গ্রামের
স্কুল আর লাইব্রেরিটে দেখা, আর গুড়ুক খাওয়া। স্বাস্থ্যটা জোর
রাখবার জন্যে ছোট একটি বাগান করা - বাস্।
দিন দশেক বেশ গেল; কোট, জুতো, মোজা বজায়
রইল। তারপর-"বসে বসে কি করবে, বাজারটা করলেও তো সংসারের
উপকার হয়"। সত্যি তো। কোট, জুতো, মোজা খস্লো। পল্লীগ্রামের
বাজারে চার আনার বাজার করতে মোজাজুতো পরে আর কে যায়। গামছা কাঁধে
উঠলো, যে কাজের যে বেশ।
ক্রমে,-এটা আনোনি ওটা আনোনি, এটা এত কম
কেন, ওটা অত মাগ্গি কেন, ঘুশো চিংড়ি সবাই পেলে আর তুমি পাও না;
ইত্যাদি।
আগে আমি হুকম করতুম, এখন আমি হুকম শুনি,
- সারাদিন। বাবু - বাড়িতেই দিন কাটাই-ভগবানের নাম করা চাই তো।
সোনা, মাণিক, গোপাল, যাদু লেলিয়ে দিয়ে যান, বলে যান,-পুকুরে
না যায়, পড়ে না যায়, মাণিককে কোলে করে পা নাড়ালেই ঘুমুবে, ভারি
শান্ত ছেলে। কেউ নাক টানে, কেউ কান টানে, কেউ যা করে তা সভায়
বলবার নয়। কাঁদলে আমার দোষ। এই নিত্য। সব ছেলেই শান্ত। গোপাল
লাফিয়ে পড়ে দাড়িটে কাটলে, কপাল পোড়ে আমার। বউমা বলেন,-বুড়ো মিন্সে
বসে বসে ফেলে দিলে গা। কাজকর্ম নেই, ছেলেগুলোকে দেখতে শুনতেও
পারেন না ইত্যাদি। কর্তা ছিলুম-এখন আমি একাধারে ঝি চাকর দুইই।
অবশ্য তারা যা বলে আর করে, তা নাকি আমার ভালর জন্যেই।
ভগবানের নাম করবার কথা মুখে আনতে সদুপদেশ
পাই-"ছেলেরা কি ভগবান নয়, ওদের নিয়ে থাকলেই ভগবানকে নিয়ে
থাকা হয়"। ঠিক। বোধহয় পূর্বজন্মে কড়া সাধনভজন করে থাকব,
তাই ভাগ্যে এতগুলি ভগবান জুটেছেন।
সব গঙ্গাস্নানে কি নিমন্ত্রণে যান, বাড়ি
চৌকি দিতে হয়, বৎসগুলি সামলাতে হয়। এই শেষেরটিই সাংঘাতিক, যেহেতু
সবাই শান্ত। তারা আমার প্রাণান্তের পাক্ চড়িয়ে দিলে।
আর তো পারিনে। এক বছরেই বেশ বুড়িয়ে দিলে।
চুল পাক্লো, মেরুদণ্ড বাঁক্লো। এখন যা জলখাবার পাই, তা ওই পঙ্গপাল
তারাই খায়, আমি দেখি। ক্রমে সয়ে গেল। একদিন দেখতে পেয়ে বল্লেন-"কি
আনন্দ বল দিকি"! বললুম-"অত্যন্ত"।
কাতরে ভগবানকে বলি-"বন্ধনমুক্তির সাধ মিটেছে প্রভু। ত্বয়া
হৃষীকেশ, আর নিযুক্তোস্মি নয়, দয়া করে বিযুক্তোস্মি"!
একটু ফাঁক পেলে-কোন দোকানে কি ঘাটে বসে
বাঘ মারি, অর্থাৎ আপিসের আর সাহেবের গল্প করি। আপিস ছিল মুঠোর
মধ্যে, আর সাহেব ছিলেন হাতের পুতুল। যা ছকে রেখে এসেছি, এখন
অন্ধে কাজ চালাতে পারে; তবু এই একের অভাবে তিন তিনজন রাখতে হয়েছে,
ইত্যাদি। সেই সময়টুকু কাটে ভালো।
পরম স্নেহের আর মোহের "গ্লবিউল"
গুলি ক্রমে অসামাল করে তুললে; বুড়ো বয়সে পালাবার সখ এনে দিলে।
মনে পড়লো বাল্যবন্ধু ভগবতী বাবুও পেন্সন্ নিয়েছেন, দেওঘরে আছেন;
তিনি কেমন আছেন দেখা যাক্। ভাগ্যবান লোক, ভালই থাকবেন।
অবস্থা পাকাই দাঁড়িয়েছিল, খস্তে বিলম্ব
হল না। এখন আমার পা বাড়ালেই অমৃতযোগ।
দেখে বন্ধু ভারি খুসী, বললেন-"বাঁচালে
ভাই, দুটো কথা কয়ে বাঁচব। জিজ্ঞাসা করলুম-"আগে বল তো আছ
কেমন"?
"বড়ি মজিমে হ্যায় ভায়া"।
শুনে বড় আনন্দ হ'ল, বললুম-"আমিও পেন্সন্
নিয়েছি, তোমার রুটিন্টে জানতে এলুম, অবশিষ্ট জীবনটা সেই আদর্শমত
কাটাবার চেষ্টা করব।"
"ও ভেব না, কোনো চেষ্টা করতে হবে না
যে, আপ্সে এসে যাবে। আমাকে কি কিছু করতে হয়েছে-না করতে কেউ দিচ্ছে।"
বললুম-"সব সংসার তো একরকম নয় দাদা;
না সব অদৃষ্ট।"
"সব এক ভাই-সব এক। পেন্সন্ নেবার পর সব এক; বৈচিত্র্যের
বেয়াদবী নেই দেখতেই পাবে।"
স্নাহারের পর আমাকে বিশ্রাম করতে বলে ভগবতী
বাবু ভিতরে গেলেন। বেলা তিনটের পর এসে বললেন-"কই ঘুমোও
নি তো?"
"দিনে বড় একটা ঘুমোই নে, একটু গড়িয়ে নিই বটে। বই কি খবরের
কাগজ থাকলে তাই নিয়েই থাকি।"
"ও বদ-অভ্যাসটা থেকে মা সরস্বতী কৃপা
করে আমাকে রেহাই দিয়েছেন-যথালাভ। বাংলা হরফ্গুলো ভুলে না যাই,
তাই পাঁজি একখানা থাকে। ফি বছর কিনতে হয় না,-সবই নূতন পঞ্জিকা,
মাঝে মাঝে বিজ্ঞাপনগুলো দেখি,-ভারি interesting হে! কিন্তু ঝঞ্ঝাটও
বড়, বাক্সের মধ্যে বন্ধ রাখতে হয়,-ছেলেমেয়েদের হাতে না পড়ে।"
বললাম-তুমিও তো শোওনি দেখছি।"
"আমি? হেঃ-পেন্সন্ নিয়েছি যে। দেখছো
না,-তোফা মানস সরোবরে রয়েছি, বুকেপিঠে রাজহংস রাজহংসীরা কেলি
করে, চোখ বুজতে ভয় হয়-কখন কোন্টা চোখ খুবলে নেবে।"
একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়লো, বললুম-"পড়েন
না, ঘুমোন না, তবে আহারের পর এ চার পাঁচ ঘণ্টা করেন কি?"
"করেন কি?-করেন কর্মভোগ। গ্রহ কি সূত্র
ধরে কখন্ যে দেহে প্রবেশ করে, তা বলা যায় না ভাইয়া। কৈশোরে শিল্পের
দিকে বেশ একটু ঝোঁক ঝাম্রেছিল। বেগুণী রংয়ের রেশম এনে, চাদরে
পাড় তুলে ব্যবহার করতুম। দেখে বাহবা পড়ে গেল। মামা আমাকে নিয়ে
জ্যোতিষীর বাড়ি ছুটলেন। পণ্ডিত
বললেন-"এ যে কাশ্মীরের শাল-শিল্পী বিখ্যাত কুদ্রৎ খাঁ!
বাংলায় এসে জন্মেছে। কালে এ জামিয়ার বানাবে।" মামা প্রতিভার
কদর জানতেন,-ইস্কুলটা ছাড়িয়ে দিলেন। তাঁরই আশীর্বাদে এখন নিদ্রা
ত্যাগ করে জামিয়ার বানাচ্ছি। কাটতিও তেমনি!"
আমি অবাক হয়ে শুনতে লাগলুম আর ভাবতে লাগলুম-জগতে
এসে দিনগুলো বৃথাই কাটিয়েছি, দেখছি সকলেই কিছু না কিছু জানেন।
বল্লুম-
"বিজ্ঞাপন দেখিনি তো, নেবার লোক পান কোথা?"
"নেবার লোক। অভাব কি? বছরে তিন চারটে বাঁধা
খদ্দের আসেই; প্রত্যেকের অন্ততঃ এক ডজন করে চাই। পারলে তিন ডজন
করে দিন না, অধিকন্তু ন দোষায়, কেউ "চাইনে" বলবে না।
অত পেরে উঠিনে, সেজন্য সৎপরামর্শ সামলাতে রাতের ঘুমটাও যায় যায়
হয়েছে।"
বললুম "না দাদা, ছুঁচের সূক্ষ্ম কাজ
এ বয়সে রাত্রে আর কোরো না। পয়সা আছে বটে" -বন্ধু বাধা দিয়ে
বললেন-"পয়সা"? বললুম-"না হয় টাকাই হল।"
বন্ধু কথা না কয়ে চট্ করে বাড়ির মধ্যে চলে
গেলেন। একটা গাঁঠ্রি এনে সামনে ধরে দিয়ে বললেন-"খুলে দেখ
না।"
খুলতেই কতকগুলো ছোট, বড়, মাঝারি, প্রমাণ তরোবেতরো কাঁথা বেরিয়ে
পড়লো।
বললেন-"নির্ভয়ে নেড়েচেড়ে দেখো-নির্ভয়ে
নেড়েচেড়ে দেখো। ওতে এখনো আমার কৃতকর্মের পুরস্কার স্পর্শ করেননি।
প্রকৃতির প্রতিশোধ আরম্ভ হতে দেরি আছে।"
দেখেশুনে আমি তো স্তম্ভিত।
"চুপ্ করে রইলে যে"?
"না, ভাবছি আমাদের শুভানুধ্যায়ী শাস্ত্রকারেরা
অনেক ভুগেই বলে গেছেন-বাঁচতে চাও তো পঞ্চাশ পেরলেই বনে যাও।"
"কি বললে-বন? বন তুমি কাকে বলো?-বাঘভাল্লুক
থাকলেই তো বন। তার সঙ্গে চিতে, নেকড়ে, বিচ্ছু-আর কি চাও? এখানে
অভাব অনুভব করলে নাকি?"
ও কথা মাথা পেতে মেনে নিয়ে বললুম-"গৃহস্থালীর
ছুঁচের কাজটা সকল দেশেই মেয়েরা"-
বন্ধু বলে উঠলেন-"অম্বল, ভায়া অম্বল!
আহারান্তে অমনিতেই বুকে ছুঁচ ফুটতে থাকে, তার উপর আবার হাতে
ছুঁচ। বলো কি!" অপ্রতিভের মত বললুম,-"তাতো জানতুম
না, এখন কেমন আছেন?"
বললেন-"কাশীর গারাভৈরবী দিদি বড় স্নেহ
করেন, ওস্তাদও তেমনি, তাঁর ব্যবস্থাতেই বেঁচে আছেন। সিদ্ধা কিনা,
চূড়া-বাঁধা চুলে সোনার তারে গাঁথা স্ফটিকের মালা জড়ানো, হাতে
জার্মান সিলভারের high-polish ত্রিশূল; দেহ চন্দনের ক্ষেত। যেমন
সৌম্যা, তেমনি ধৌম্যা। তাঁর টোট্কাই চল্ছে: আহারান্তে ঘড়ি ধরে
তিন ঘণ্টা গড়ানো, নাহয় চিত্তবৃত্তি নিরোধের জন্য তিন ঘণ্টা তাস
খেলা; তাতেও যদি না ওঠে, সেকেন্দরী সিক্কার পাক্কা তিন পো মালাই।
শেষেরটিই ব্রহ্মাস্ত্র, পড়েছে কি সব বালাই সাফ্। সেইটিই চলছে।-হ্যাঁ
গৃহস্থালী বলছিলে না। আমার এটা ঠিক গৃহস্থালী নয় ভায়া-নিজের
গড়া 'গোলেবকালী' । এই যেমন বিশ্বামিত্রের সৃষ্টি। প্রতিভাবানদের
দস্তুরই ওই,-বানানো পথ বাদ দিয়ে চলা।"
আমিও অবাক হয়ে সেই কথাই ভাবছিলুম; শেষটা
Penguin Island-এ পৌঁছে গেলুম নাকি, ইনিই মহাপুরুষ St. Mael
নয় তো! তাড়াতাড়ি কাঁথার পুঁটলিটা বন্ধুর হাতে দিয়ে বললুম-"করেছ
কিন্তু সুন্দর, শিল্পকলা একেই বলে, বাঃ।"
বললেন-"হ্যাঁ আসল চাটিম্ কলা,-কুদ্রৎ
খাঁ যে!" বলেই হাসি মুখে নিয়ে প্রস্থান। ভাবলুম রেহাই।
তা কিন্তু হল না।
পুঁটলি রেখেই পুনঃ প্রবেশ,-হ্যাঁ, যে কথা
বলতে এসেছিলুম; আমাদের বন্ধু অমর এখানে এসেছে। আজ দেখি লোহালক্কড়ের
দোকানে দ্বিতীয় প্রহরের রোদটা মাথায় করে ছুটোছুটি করছে। আহা
তার তো পেন্সন্ নয়, এ আরাম পাবে কোথায়; কলকাতায় Hardware-এর
দোকান। তাকে বল্লুম," এত বেলায় এই রোদে করছ কি অসুখে পড়বে
যে। বিশেষ দরকারী কিছু নাকি? ছাতাটা ফেল্লে কোথায়?" অমর
হেসে বললে-"যাতে দু' পয়সা আছে, তাই দরকারী, এই দেখনা ঘণ্টা
দেড়েক ঘুরে দেড়শো টাকা ঘুরিয়ে আনলুম। ভেবনা, আমরা রোদেজলেই মানুষ,
ছাতা নেওয়ার বদ অভ্যাস নেই। অসুখ বলছ! অ-রোজগারের চেয়ে আর বসে
থাকার অসুখ আছে নাকি?" এই বলে হি হি করে হেসে 'ক্যা ভাইয়া'
বলেই একটা লোহার দোকানে ঢুকে পড়লো।
"ওর জন্যে বড় দুখ্খু হয় ভাই, পেন্সন্
পেলে আজ,-আহা ভাগ্যে! বুঝ্তো,-কি বল? তবে পয়সার প্রেম ওকে যৌবনের
বল যুগিয়ে জোয়ান করে রেখেছে। আর আমি বেটা 'চিন্তামণি' হয়ে রইলুম
হে!"
"সে আবার কি ,-ভগবতী থেকে চিন্তামণি
হলে কবে?"
"ভগবতী তো বটেই, এটা ছেলেদের কাছে
প্রমোশন-পাওয়া খেতাব।"
"বুঝতে পারলুম না তো।"
খুব সোজা, ঠেকে একটু কঠিন বটে। এই পেন্সন্
নেবার পরের কথা গো, তখন দেশেই ছিলুম। গরুটা সাত মাস গাভিন, কি
করে বেরিয়ে পড়েছে, সন্ধ্যা হয়, ফেরে না। চঞ্চল হতে হল। হলে আর
হবে কি, বাতে কাত করে রেখেছে। যাহোক্, সুক্ষণে কি কুক্ষণে, কড়াইসুঁটির
কচুরী হতে দেরি হওয়ায়, বাবাজীরা আটকে গিয়েছিলেন, তখনো বাড়ী ছিলেন।
বললেন-"ভাবছেন কেন, আমরা দেখছি।" শুনে কতটা সাহস আর
আনন্দ পেলুম, বুঝতেই পারছ। ভগবানের কাছে তাদের কুশল আর দীর্ঘায়ু
প্রার্থনা করলুম। বাতের বেদনা ভুলে গেলুম, আনন্দাশ্রু বেরিয়ে
এলো। পুত্রহীনদের জন্যে পরম আপশোষ অনুভব করতে লাগলুম। আহা, তারা
কী দুর্ভাগা। মজ্জায় মজ্জায় মনে হ'ল-পুত্র plus পেন্সন্ equal
to Paradise। বললুম-
'তাহলে আর দেরি করিস্ নে বাবা, কালা-গরু সন্ধ্যে
হয়ে গেলে দেখতে পাওয়া শক্ত হবে। হিঁদূর দেশ, কোন্ ব্যাটা বেড়ো
মেরে খেঁড়ো গাইটে সাবাড় করে দেবে; বেরিয়ে পড়ো যাদুরা।'
তাদের গর্ভধারিণী আড়ানা-বাহারে বলে উঠলেন,-"বাছাদের
কি খেতেও দেবে না,-এখনো পাঁচখানাও যে পেটে পড়েনি। তোমার তাড়ায়
বসেনি পর্যন্ত, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই মুখে দিচ্ছে"।
অর্থাৎ-আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, কেশ
আর কচুরী, দুয়ের সেবাই চলছে। যাক্, চুল ফিরিয়ে পাঞ্জাবী পরে,
পম্প্ সু মেরে গরু খোঁজা বেশ সেরে, চট করে বিশ মিনিটের মধ্যেই
তারা বেরিয়ে পড়লো।
বাতের তেলের বিদ্খুটে গন্ধ সারাদিন ভোগ করবার পর, সহসা সুমধুর
সৌরভে ঘরটা ভরে যাওয়ায়, নিঃশ্বেস টেনে-আঃ। কি আরামই পেলুম। ছেলেরা
বোধহয় রুমাল টেনে মুখ মুছতে মুছতে গেল। ব্রাহ্মণীকে ডেকে বললুম-,
কচুরীগুলো সবই ফেলে গেল নাকি? রেখে দাও, এসে খাবে'খন। আমাকে
এখখানা দাওতো দেখি-কেমন বানালে।"
বল্লেন-'গোণাগুণতি করেছিলুম, তার আবার ফেলে
যাবে কি?,-সোমত্ত বয়েস', ইত্যাদি বহুৎ।
বল্লুম-"যাক, বোধহয় ভালই হয়ে থাকবে।"
বল্লেন-"মন্দ হলে ওরা মুখে করত কিনা।"
"রাম কহো, ওরা সে ছেলেই নয়।"-
পুত্রগর্বেই বোধহয় আবার বাতের বেদনা ভুলে গেলুম। চিন্তায় চুর
হয়ে কেবল কালা-গরুই ভাবছি - সাতটা বাজলো, আটটায় ঘা দিলে,-এই
আসে। গরু এল না, নটার আওয়াজ এলো। কান দুটো রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালো।
সে কী প্রতীক্ষা।
ত্দুপরি ব্রাহ্মণী তর্জনসহ বল্লেন (যেহেতু
পেন্সন্ আর তর্জন কবিতায় শ্রেষ্ঠ মিলন নাহলেও উভয়ে পরম আত্মীয়)-"ছেলেগুলো
ঘুরে ঘুরে গেল, এখন্ তারা ফিরলে যে বাঁচি। কেবল গরু, গরু আর
গরু, আর সোনার চাঁদ ছেলেরা হল ওঁর গরুর চেয়ে কম।"
"কি বল্ছ গো। এমন কথা আমি কখনো ভুলেও
যে ভাবিনি। আর যা বলো বলো এত বড় মিথ্যা অপবাদটা আমাকে দিও না
গিন্নি"।
একখানা মোটর এসে সশব্দে থামলো। এত রাত্রে
আবার কে। বোধহয় রহিম মিঞা বিজয়ার নমস্কার করতে এসেছে, মোটরে
আর কে আসবে। সে আমাদের সইস্ ছিল, এখন তার সময় ভাল। আজ দু'বছর
আসছে; শুধু হাতে আসবার লোক সে নয়।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেয়ে, ধামা চেঙ্গারি
লুকিয়ে রাখতে ব্রাহ্মণী দ্রুতপদে প্রস্থান করলেন।
সঙ্গে সঙ্গে ছেলের প্রবেশ:-
"পাঁচ টাকা দশ আনা Taxi-ভাড়াটা চট্
করে দিন তো। বেটাকে ছ'টাকা দেবে, না আরো কিছু। দিন্, আর দেরি
করবেন না, বজ্জাৎ বেটা লাভের ছ'গণ্ডা টেনে নেবে, দিন্।"
ভাঙ্গানো ছিল না, ছ'টাকাই হাতে দিতে হল।
"শ্যামলীকে কোথায় পেলি?"
"সে অনেক কথা-বলছি," বলেই বেরিয়ে
গেল।
যাক্, গাভিন গরুটা যে পাওয়া গেছে, সেইটেই
পরম শান্তি, দুর্ভাবনা গেল। উপরি লাভ "পাইভরের" পরিমল।
অকৃত্রিম মহামাস তেলটা খানিকক্ষণ মগজ মথন করবে না।
পাশের ঘর থেকে মাতাপুত্রের কথোপকথন শ্রবণ
জুড়িয়ে দিতে লাগলো। স্বকৃত ব'লে সে কি একটা অনির্বচনীয় আনন্দানুভূতি।
সংসারের সুখই এই সবই ভাগ্যসাপেক্ষ। দেখ না, এরা আদিতে কেউ ছিল
না, মধ্যে কোথা থেকে উড়ে এসে এই মধুচক্র রচনা করেছে, "গৌড়জন
যাহে"-বুঝেছ তো-
গুণ্ গুণ্ রবে, কেমন সুখেতে সব মধু পান করে।
নয় কি। আবার- God forbid, অন্তেও কেউ থাকবে না; অবশ্য আমার প্রাণান্তের
পর।
একেই বলে-ভগবৎলীলার শিলাবৃষ্টি। আদিতে জল,
অন্তে জল, মধ্যে মাথা সামলাও।
যাক্, আনন্দোচ্ছ্বাস কিনা, সামলাতে পারিনে।
মোদ্দাটা শুনলুম-বাবাকে চট্ করে নিশ্চিন্ত
করবার তরে বাবাজীরা মোটর নিয়ে গরু খুঁজতে রওনা হন। হোটেল, বায়স্কোপ,
কিন্নরী সেরে, ইডেন ঘুরে হয়রাণ হয়ে ফিরেছেন। বলছেন-গড়ের মাঠে
যে গরু মেলে না, সে গরুই নয়। এক গন্ধবণিক বন্ধু বলে দিয়েছেন,-"মহামাস
তেলের গন্ধেই গরু পালিয়েছে, তোমরা সাবধান। একটা ক্যনেঙ্গা ওয়াটার
কিনে নিয়ে যাও।" দেড় টাকা দিয়ে কিনতেই হল। সে গরু আর ফিরছে
না। বাবার দোষেই তো এইটি হল। ও তেল আর মাখতে দিচ্ছিনে, বাথ্গেট্
থেকে দু'বোতল নিয়ে তবে ফিরেছি। মাথায় মাখাই তাঁর দরকার, সোজা
কথাগুলিও আর ওঁর মাথায় আসছে না। রোজ এক টাকায় দুধ কিনলেই হয়,-তা
বুঝবেন না।
বামাস্বর শোনা গেল-"আগে তো এমন ছিল
না, কাছারী যাওয়া ঘুচিয়ে এসেই বুদ্ধিশুদ্ধি বিগড়ে গেল। এক হাবাতে
দিনরাত বসে আছেন, বেরতে বললেই বেদনা বাড়ে। শুধু কেনবার কথা পাড়লেই
বলে বসে আছেন - টাকা আসবে কোথা থেকে।"
বাবাজী বলে উঠলেন-"সে তুমি ভেব না
মা,-যে খায় চিনি, তাকে যোগান চিন্তামণি।"
শুনলে ভায়া। গরু গেল, গরু-খোঁজার মোটরভাড়া
গেল, উপরন্তু সাত সেলামী। এখন "চিন্তামণি" বানিয়ে
রেখেছে। যা চাই যোগাতেই হবে। নান্য পন্থা-বেঁচে থাকতে-বিদ্যতেহয়নায়।
কি বল?
বলব আর কি, শুনে স্তম্ভিত হলুম, একটু হাল্কা বোধও করলুম।
বন্ধু আর দাঁড়ালেন না। যাবার সময় যে হাসিটে মুখে করে নিয়ে গেলেন,
সেটা আমাকে বেদনাই দিলে।
তাঁর রুটিনের রপট্ শুনে শিউরে উঠেছিলুম।
এখন উপায়?
ভাবলুম,-পেন্সনারের-পিঁজ্রাপোলে যাওয়াই
ভাল। কাশী রওনা হয়ে পড়লুম।
ওঁ শান্তিঃ।
কাশীধাম।
২৭ ডিসেম্বর, ১৯২৬
('সবুজপত্র'
মাঘ, ১৩৩৩। রচনাটি দিল্লীর প্রবাসী বঙ্গ সম্মিলনে পঠিত।)
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright
© 2014 Abasar.net. All rights reserved.
|
অবসর-এ প্রকাশিত
পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।
|