প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

দেবী ও দানবী

কেদারনাথ মজুমদার

      [ লেখক পরিচিতি : ১২৭৭ বঙ্গাব্দের ২৬শে জ্যৈষ্ঠ অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমায় কাপাসাটিয়া গ্রামে মামাবাড়িতে কেদারনাথ মজুমদার জন্মগ্রহণ করেন। পৈত্রিন নিবাস ছিল কিশোরগঞ্জের গচিহাটা গ্রামে। বাবা লোকনাথ মজুমদার ও মা জয়দুর্গা দেবী। মহাভারত প্রণেতা রামেশ্বর নন্দী ছিলেন পূর্বপুরুষ।
কেদারনাথ গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক পাঠ শেষ করে মামার কাছে চলে আসেন এবং নাসিরাবাদ এন্ট্রান্স স্কুলে ভর্তি হন। সেখানকার হেডপণ্ডিত উমেশচন্দ্র বিদ্যারত্ন তার জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেন। এন্ট্রান্স স্কুল ছেড়ে সিটি স্কুলে এবং পরে ১৮৮৪ সালে ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন কেদারনাথ। স্কুলের পড়ায় অবশ্য মন ছিলনা তার। বাবার গড়ে তোলা পুস্তকালয় ছোট বেলা থেকেই তার সাহিত্যপ্রীতি জাগিয়ে তুলেছিল। মা’ও এ ব্যাপারে উৎসাহ যোগাতেন। স্কুলের পড়া সম্বন্ধে সাহিত্যপ্রেমী গৌরচন্দ্র নাথ লিখেছেন –“তখন হইতেই পিছনের বেঞ্চে বসিয়া তাঁহার প্রথম উপন্যাস ‘প্রফুল্ল’ লিখিতে আরম্ভ করেন। ‘ভরার মেয়ের’ করুণ কাহিনীই ইহার প্রতিপাদ্য বিষয়। ১৮৭৭ অব্দের আশ্বিন মাসে নোয়াখালি জেলা জলপ্লাবনে ভাসিয়া যায়। এই দুর্ঘটনা দৌলত খাঁর প্লাবন বলিয়া প্রসিদ্ধ। এই ভীষণ বন্যার অপূর্ব কাহিনী যেমন বাঙালি হৃদয়ে একটা বিরস আতঙ্কের সৃষ্টি করিয়াছিল তেমনি সহানুভূতিও জাগাইয়া তুলিয়াছিল। স্কুলের ভাবপ্রবণ ছাত্র কেদারনাথও ইহার প্রভাব হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারেন নাই। ছাত্র সাহিত্যসেবী কেদারনাথ এই হৃদয়-বিদারক কাহিনী অবলম্বন করিয়াই ১৮৮৮ সনে এই ক্ষুদ্র উপন্যাসখানি লিখিয়াছিলেন। তিনি আমাদের নিকট বলিয়াছিলেন – বঙ্কিমবাবুর ‘দেবী চৌধুরানী’র প্রফুল্লর অনুকরণেই তাঁহার উপন্যাসের নামকরণ করিয়াছিলেন ‘প্রফুল্ল’। নায়িকা বন্যার স্রোতে ভাসিয়া আসিয়াছিল বালিয়া পরে তিনি ইহাকে ‘স্রোতের ফুল’ আখ্যা দিয়াছিলেন”।

       কেদারনাথের সাহিত্য স্পৃহা এত প্রবল ছিল যে, বিদ্যালয়ের প্রথাগত বিদ্যালাভে তিনি মন দিতে পারেন নি। ১৮৮৯ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষার সঙ্গেই তার শিক্ষালাভের পর্ব শেষ হয়। অল্প বয়স থেকেই কেদারনাথের ইচ্ছা ছিল তিনি স্বাধীনভাবে সাময়িকপত্র প্রকাশ ও পরিচালনা করবেন। কলকাতার ঠাকুরবাড়ি থেকে তখন সাময়িক পত্র ‘বালক’ প্রকাশিত হত। তারই অনুকরণে ১২৯৪ বঙ্গাব্দে কেদারনাথ প্রকাশ করেন ‘কুমার’। গৌরচন্দ্র নাথ লিখেছেন –“আমরা ‘কুমারের’ ৪র্থ সংখ্যা (বৈশাখ হইতে শ্রাবণ ১২৯৫) মাত্র দেখিয়াছি। কুমারে নানাপ্রকার সুলিখিত প্রবন্ধ, কবিতা ও উপন্যাসাদি প্রকাশিত হইত”। পত্রিকাটি কতদিন চলেছিল জানা যায় নি। নানা সমস্যায় জর্জরিত কেদারনাথ কিন্তু নিরলসভাবে সাহিত্যচর্চা করে গিয়েছেন। রামপ্রাণ গুপ্ত লিখেছেন –“এই সাহিত্য সাধনাই কেদারবাবুর প্রাণস্বরূপ ছিল। সাহিত্যেই তাঁর আনন্দ ছিল। প্রথম অবস্থায় তাঁহার অর্থকৃচ্ছ ছিল, জীবনে অনেক অপত্য শোক ঘটিয়াছিল, দারূণ ব্যাধি তাঁহার হাত দুইখানি অবশ করিয়া ফেলিয়াছিল; কিন্তু তিনি কোন দশাতেই সাহিত্য সেবায় বিরত হন নাই, সর্বদা সাহিত্যের আলোচনা, সাহিত্যের অনুশীলন, সাহিত্যিক বন্ধুবর্গের সাহচর্য করিতেন। তিনি একবার কোন এক উপলক্ষে আমাকে লিখিয়াছিলেন যে, ব্যাধি তাঁহার জীবন দুর্বহ করিয়াছে, সাহিত্য লইয়াই কোন রকমে বাঁচিয়া রহিয়াছেন; সাহিত্য সেবার আনন্দই তাঁহাকে জীবনী শক্তি দিতেছে”।

        আনন্দমোহন কলেজের ছাত্ররা ‘সারস্বত সাহিত্য সভা’ গঠনকালে কেদারনাথ সক্রিয় উদ্য গ্রহণ করেছিলেন; পরে তারই চেষ্টায় ‘ময়মনসিংহ সাহিত্য সভা’ স্থাপিত হয়। তিনি ছিলেন তার সম্পাদক। ১৩১৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘সৌরভ’ মাসিক পত্রিকা। কেদারনাথ ছিলেন পত্রিকার প্রাণপুরুষ। চন্দ্রকুমার দে লিখেছেন -“ ‘সৌরভ’ ছিল ময়মনসিংহের সাহিত্যিকদের বিশ্ববিদ্যালয়”। সে যুগে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অনুন্নত। উৎকৃষ্ট মানের লেখা যোগাড় করে পত্রিকা প্রকাশ ছিল রীতিমত দুঃসাধ্য ব্যাপার। ‘সৌরভে’ সম্পাদক হিসাবে তার চেষ্টা ছিল নতুন লেখক গোষ্ঠি গড়ে তোলা। অনেক সময় তিনি খ্যাতিমান লেখকদের লেখা উপেক্ষা করে নবীনদের লেখা প্রকাশ করে তাদের উৎসাহিত করেছেন”।

       ‘বাঙ্গালা সাময়িক সাহিত্য’ কেদারনাথের একটি স্মরণীয় কীর্তি। এই গ্রন্থ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন –“সাময়িক সাহিত্য অর্থে আমি – দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক প্রভৃতি পত্রিকা – যাহাতেই বেশীরভাগ সাহিত্যের আলোচনা করা হইয়াছিল – তাহা বুঝিয়াছি এবং যতদূর সংগ্রহ করিতে পারিয়াছি তাহার বিবরণ এই গ্রন্থে প্রদান করিতে চেষ্টা করিয়াছি। এতদব্যতীত এই সকল সাময়িক সাহিত্যের আলোচনা প্রসঙ্গে অন্যান্য সংবাদপত্রাদির সম্বন্ধেও যে দুই একটি কথা বলা যায়, তাহাও বলিতে চেষ্টা করিয়াছি”। কেদারনাথ ছিলেন মহারাষ্ট্র পুরাণের আবিষ্কর্তা এবং স্বভাবকবি গোবিন্দচন্দ্র দাসের অন্তরঙ্গ বন্ধু।

        কেদারনাথের প্রকাশিত গ্রন্থ – “মৈমনসিংহের ইতিহাস”, “ময়মনসিংহের বিবরণ”, “ঢাকার বিবরণ”, “সারস্বত কুঞ্জ”, “রামায়ণের সমাজ”। উপন্যাস – “শুভদৃষ্টি”, “স্রোতের ফুল”, “সমস্যা চিত্র”, “চিত্রা” প্রভৃতি।
১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ৬ই জ্যৈষ্ঠ ময়মনসিংহে কেদারনাথ পরলোক গমন করেন। ]

                                                                         দীপক সেনগুপ্ত।

 

          বঙ্গচন্দ্রের উত্তর জীবনটা রূপযৌবন সম্পন্না অঙ্কলক্ষীর প্রেম সংস্পর্শে অতি পুলকপূরিত চিত্তে অতিবাহিত হইতে লাগিলেও তাহার পরিণামে যে একটা ভীষণ দুঃখময়ফল বঙ্গচন্দ্র প্রাপ্ত হইয়াছিলেন তাহাতে তাঁহার সে কালটা বড়ই তমসাচ্ছন্ন হইয়া উঠিয়াছিল।

        বঙ্গচন্দ্র পণ্ডিত ছিলেন।পণ্ডিত হইলেও তিনি অগাধ বিদ্যার খনি বলিয়া তাঁহার মনে যে একটা অন্তর্নিহিত আস্ফালন, হিসাব করিয়া দেখিলে সর্ব্বদা অনুভব করা যাইত, সে অনুভূতির একটা দার্শনিক প্রমাণের বড়ই অসদ্ভাব ছিল। তবে তিনি যখন তিন ফিট পরিমিত সুচিক্কণ রসায়নিক অস্ত্রটী লইয়া শিশুশিক্ষার পাত উল্টাইতেন অনেকে ছেলেকেই তখন 'লিভরের' গুরুগম্ভীর ধ্বনি থামাইতে অশক্ত হইয়া অন্নপ্রাশনের অন্নজল পর্য্যন্তও ছাড়িয়া দিতে হইত।
শিক্ষকদিগের বিদ্যাবুদ্ধির লঘুত্ব গুরুত্ব লইয়া তুলনায় সমালোচনা এস্থলে নিষ্প্রয়োজন। শিক্ষক বঙ্গ রায়ের অগাধ বিদ্যা ছেলেদের বন্ধুর-পৃষ্ঠদেশের উপর লক্ষ্য করিয়াই নাহয় ঠাওরাইয়া লইলাম। যাই হউক সে সকল অবান্তর কথা ছাড়িয়া আসল কথা হউক।

(১)

        সে অনেকদিনের কথা বলিতেছি-একটী শুভদিনে অতি অল্পায়াসেই বঙ্গচন্দ্র বালিকার পতিত্বে বরিত হইলেন।
কল্পনাপ্রিয় বঙ্গচন্দ্র পত্নীলাভের পূর্ব্বে যে রূপকটী ভারতচন্দ্র আওড়াইয়া ঠিক করিয়া ছিলেন, যখন দেখিলেন মৃণ্ময়ীর ঘোর আবলুশ রং রঞ্জিতদেহে লোকললামভূতা হিরণ্ময়ী নায়িকার রূপলাবণ্য অসম্ভব, তখন অনর্থক সে "কে বলে শারদ শশী" রূপকের অন্ধ অনুসরণ লাভ জনক বিবেচনা করিলেন না। কালোকেই কজ্জ্বল বলিয়া মনে করিয়া লইতে চেষ্টা দেখিলেন।

      বঙ্গচন্দ্র প্রেমিক, কাজেই সরল এবং রসিক।তাই নব প্রণয়িনীর ভালবাসার একটা ওজন করিতে অবসর গ্রহণ না করিয়াই একেবারে তাহাকে ষোল আনা রকমে ভালবাসিয়া ফেলিলেন। কিন্তু মৃণ্ময়ী প্রতিদানে ততটা মুক্তহস্ত হইতে অবকাশ পাইয়া উঠিল না। বঙ্গচন্দ্রের সরল হৃদয় তাই কতক পরিমাণে প্রতিহত হইল। বঙ্গচন্দ্র তখন বুঝিতে পারিলেন না যে, পুরুষের ন্যায় স্বেচ্ছাচারী উপকরণ লইয়া রমণী হৃদয় গঠিত হয় নাই। তাহাদের লাজ লজ্জার একটা নির্দ্দিষ্ট পরিমাণ আছে এবং থাকাই স্বাভাভিক [?] তাই ব্যস্তবাগীশ বঙ্গ পণ্ডিত একেবারে স্ত্রীর স্ত্রীত্বেই ঘোর সন্দিহান হইয়া উঠিলেন।

      মৃণ্ময়ীর বয়ঃক্রম তখন ত্রয়োদশ। বঙ্গচন্দ্র লক্ষ্য করিয়া দেখিলেন, মৃণ্ময়ী যদি কখন কাহারও নিকট কোন উপদেশ পাইয়া থাকে তবে তাহা কেবল শাশুড়ীর প্রতি যথোচিত সম্মান, দেবরের প্রতি অমায়িকতার আতিশয্য ও গৃহকার্য্যে নিপুণতা প্রদর্শন ব্যতীত, স্বামিনামে একটা জিনিসে র প্রতি কিরূপ ব্যবহার করিতে হইবে আদপেই তাহা শিক্ষালাভ করে নাই।

      বঙ্গচন্দ্র আর যাহা লক্ষ্য করিলেন, তাহাতে নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করিতে কোন প্রতিবন্ধক দেখিলেন না যে মৃণ্ময়ী 'বোবা'। মৃণ্ময়ীও কিন্তু সে ভ্রান্তি অপনোদনের কোন চিহ্ণ দেখাইতে চেষ্টা করিলেন না। বঙ্গচন্দ্র প্রতি নিশীথে তৈলদাহ পূর্ব্বক শয্যাগৃহে মানভঞ্জন বিচিত্র বিলাসের অভিনয় করিতে লাগিলেন। ব্রীড়াবনতা বালিক মৃণ্ময়ী নিঃশব্দে সে ভালবাসার অত্যাচার গুলি সহ্য করিতে লাগিলেন। তাহার বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল, তথাপি মুখ ফুটিল না।আমরাও জানি -
           "বদন থাকিতে না পারে বলিতে
           তেঞি যে অবলা নাম|"

       কিন্তু আমরা জানিলে কি হয়, যাহার সে বুঝিল কই?
     কোলাহল প্রিয় অল্পমতি মানব-শিশুকে দমন করিতে যাইয়া, রসায়নশাস্ত্রের গুরুতর বিশ্লেষণ সাধারণ মস্তিষ্কের যোগ্য নয়, বঙ্গচন্দের এই একটী প্রকাণ্ড রকমের অঘটন ঘটন পটীয়সী বিদ্যার বাহাদুরী কিন্তু এক্ষেত্রে বঙ্গচন্দ্র স্বীয় প্রতিভা অক্ষুণ্ণ রাখিতে পরাঙ্মুখ হইয়া মৃণ্ময়ীকে কয়েকদিনের জন্য পিত্রালয়ে পাঠাইয়া দিতে সংকল্প করিলেন। যাওয়ার দিনে নির্জ্জনগৃহে আসিয়া মৃণ্ময়ী বঙ্গচন্দের পায়ে টিপ করিয়া এক প্রণাম করিয়া চারুহাসির বিদ্যুদ্দাম কটাক্ষে বঙ্গকে ভুলাইয়া গেল। দিবসে মৃণ্ময়ীর সহিত বঙ্গের এই প্রথম সন্দর্শন। বঙ্গের যদি ক্ষমতা থাকিত, সে ক্ষমতায় যদি লজ্জার ছায়া স্পর্শ না করিত, তবে কি আর মৃণ্ময়ী সেদিন যাইতে পারে?

(২)

       বিদায়কালে বঙ্গ মৃণ্ময়ীকে বলিয়াছিলেন, "যাইয়া চিঠি লিখিও|" আবক্ষলম্বিত অবগুন্ঠনের মধ্য হইতে কোন উত্তর আসিল না বটে, তথাপি বঙ্গচন্দ্র মনে করিয়াছিলেন, মৃণ্ময়ী পিত্রালয়ে গিয়াই তাহার নিকট একটা বিস্তৃত ক্ষমাপত্র লিখিয়া বিস্তর কান্নাকাটী করিবে। মৃণ্ময়ীরও যে সে ইচ্ছা না ছিল তাহা নহে, কিন্তু লজ্জা সে ক্ষেত্রে ঘোর বিরোধী হইয়া দাঁড়াইল। বিশেষ মৃণ্ময়ী ভাল করিয়া লিখিতে পড়িতেও জানিত না।

       কিছুদিন দেখিয়া বঙ্গচন্দ্র আর থাকিতে পারিলেন না। অভিমানের এক সুদীর্ঘ গদ্য-পদ্যময়ী গাথা লিখিয়া মৃণ্ময়ীর নিকট প্রেরণ করিলেন। প্রেরণ করিয়া বড়ই সুখী হইলেন। সুখের কারণ মৃণ্ময়ী তাহা পাঠ করিয়া মর্ম্মাহত হইবে। তারপর কত কাঁদিয়া কাটিয়া কতশত সহস্রবার অপরাধ স্বীকার করিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া চিঠি লিখিবে। সে চিঠি পড়িয়া বঙ্গ কত সুখী হইবেন। প্রেমিকের ইহাই রীতি। প্রেমিকা যদি প্রেমিকের হৃদয়ের ভাব বুঝিয়া একটী মাত্র অশ্রুও ত্যাগ করে, প্রেমিক অম্লানবদনে সে সুখের নিকট স্বর্গসুখও বলিদান করিতে কুণ্ঠিত নন। তাই প্রেমিকের মনে প্রেমিকার অশ্রু সুখের উৎস ছুটাইয়া দেয়, প্রেমের বন্ধন দৃঢ় করে। দুঃখের বিষয় মৃণ্ময়ীর বাল্যশিক্ষার বিদ্যা বঙ্গচন্দ্রের কাদম্বরীর মর্য্যাদা রক্ষা করিয়া উঠিতে পারিল না।

        মৃণ্ময়ী পত্র পাইয়া লজ্জায় জড়সড় হইয়া পড়িল। কেহ দেখিতে না পায় এমন একটী নির্জ্জন কুঠরীতে যাইয়া পত্র খুলিল, খোলা হইল, খোলার পরেই বস্তাবন্ধ হইল, এখন উত্তরের পালা, যথা সম্ভব বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করিয়া পত্র লেখা শেষ হইল। তারপর দুইদিন বস্তায় রহিল, চতুর্থ দিন তাহা বিছানর নীচে আসিল, পঞ্চম দিবসে বস্ত্রাঞ্চলে ঘুরিয়া ঘুরিয়াও কোন ক্রমে ডাক বাক্স প্রাপ্ত হইল না। ষষ্ঠদিনে গোপনে তাহা ডাকঘরে গমন করিল। পত্র তখন স্বাধীনভাবে বিচরণ করিয়া আসিয়া বঙ্গচন্দ্রের বৈঠকখানায় পঁহুছিল। এদিকে বঙ্গচন্দ্র উৎকণ্ঠায় সংজ্ঞা শূন্য।
কল্পনার পুঞ্জীভূত আবেগ লইয়া বঙ্গ পত্র খুলিলেন। পত্র খুলিয়া তাহার সকল আশা বর্ত্তুলাকার হইয়া গেল। ললাটে হস্ত প্রদান করিয়া বররুচিকে স্মরণ করিলেন -
             "---------------------চতুরানন
             অরসিকেষু রসস্য নিবেদনম্‌
             শিরসি মালিখ মালিখ মালিখ|"
             মৃণ্ময়ী লিখিয়াছে -
      "শ্রী শ্রী চরণ কমলেষু|
আপনা একানা পত্র পায়া বড়ৈ সুকি হৈলাম। ইরুপ সময় সময় লিখিয়া পত্র লিখি সুকি করিবেন। আমরা এখানে সবাই ভালই আছি। উত্তরে আপনাদের সকল সংবাদ লিকিয়া সুকি করিবেন। সময় সময় পত্র লিকিবেন আমরা ভাল মঙ্গল চাই         নিবেদন ইতি
         সেবিকা
         শ্রীমৃণ্ময়ী দাস্যা"

(৩)

        মৃণ্ময়ী পিত্রালয় হইতে পরিবর্ত্তিত ও পরিবর্দ্ধিত হইয়া আসিয়া প্রকাশিত হইল। নিশীথে নিভৃতকক্ষে প্রথম সাক্ষাতেই বঙ্গচন্দ্র একটী প্রণাম পাইলেন। প্রণাম করিয়া উঠিয়া মৃণ্ময়ী দীর্ঘ অবগুণ্ঠন আরও টানিয়া ব্রীড়াবনত মস্তকে একধারে দাঁড়াইয়া রহিল। পূর্ব্বে পূর্ব্বে গৃহে আসিয়াই মৃণ্ময়ী তাহার সমস্ত ক্রোধের ভার নিরীহ প্রদীপটার উপর প্রকাশ করিত। এবার এ আংশিক পরিবর্ত্তনে বঙ্গ পণ্ডিত সুখী হইলেন সন্দেহ নাই। তিনি মৃণ্ময়ীকে কোলে টানিয়া বসাইলেন, এবং প্রীতির অপার্থিব উপহার বিনিময়ে অসঙ্কোচ হৃদয়ে সর্গীয় সুখ উপভোগ করিলেন। মৃণ্ময়ী লজ্জাবনত মুখে তাহার বক্ষ চাপিয়া রহিল। সে রাত্রে বঙ্গচন্দ্র মৃণ্ময়ীকে অনেকখানি ভালবাসা দিয়া ফেলিলেন বলিয়া মনে করিলেন; কিন্তু মৃণ্ময়ী তাহাকে ততখানি দিতে পারিয়াছিল বলিয়া মনে করিবার কোন কারণ তিনি খুঁজিয়া পাইলেন না।
প্রকাশ্যে বঙ্গচন্দ্র মৃণ্ময়ীকে তাহা বুঝাইয়া দিলেন, শুনিয়া মৃণ্ময়ীর বুক ফাটিয়া গেল, চোক ভাসিয়া গেল, মুখও খুলিল না, চোকও ফুটিল না।

(৪)

         দর্শনেন্দিয় ও শ্রবণেন্দ্রিয়ের শক্তি প্রাখর্য্যে বঙ্গচন্দ্রের বৃদ্ধা জননী যতদূর অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছেন, তাহাতে পুত্রবধূর সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ করিয়া থাকাটাই যেন বর্ত্তমানযুগে মানসম্ভ্রম বজায় রাখিয়া যাইবার একমাত্র পন্থা বলিয়া তিনি মনে করিতে পারিয়াছেন। তাই নববধূর মুখ দর্শন করিয়া যদিও তাহা হইতে ততটা অনিষ্টাশঙ্কা উপলব্ধি করিতে পারিলেন না। তথাপি বধূরকর্ণে বাক্যালাপের নিষ্প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধীয় উপদেশটা ঢালিয়া দিতে দূরদর্শিনী বৃদ্ধা ভুলিয়া ছিলেন না। মৃণ্ময়ী তাই-কাহারও সহিত আলাপ করিতেন না। হঠাৎ কাহারও চক্ষে চোখ পড়িলে, শাশুড়ীই হউন আর দেবরই হউন, স্বয়ং বঙ্গচন্দ্রই হউন আর আটপ'রে চাকরই হউক, মৃণ্ময়ী সীমন্তের কাপড় বক্ষে টানিয়া আনিতেন।
বঙ্গচন্দ্র কিন্তু এগুলি বড়ই অসুখকর দৃশ্য বলিয়া মনে করিতেন। তিনি তাহার গৃহ, মাতা, ভ্রাতা ও পত্নীর উচ্চকণ্ঠে মুখরিত হউক মনে না করিলেও এমন অসঙ্গত নিস্তব্ধতার মধ্যে জীবন অতিবাহিত করা সুখদ মনে করিতেন না।
বঙ্গ চাহিতেন, মৃণ্ময়ী তাহার সহিত প্রাণ খুলিয়া, চক্ষু চাহিয়া, মুখ তুলিয়া, অবগুণ্ঠন সরাইয়া, দিবসে নিশিথে সমভাবে প্রেমের লীলাময়ী বাক্যচাতুরীতে তাহার হৃদয়-তন্ত্রী ধ্বনিত করিয়া দিউক|

        মৃণ্ময়ী মনে মনে চাহিত, তিনি দিবসে আসিয়া প্রাঙ্গণে দাঁড়ান আড়ালে থাকিয়া দেখি। নিশীথে নয়ন মুদ্রিত করিয়া নিদ্রাযান, আর আমি বসিয়া বসিয়া প্রদীপের উজ্জ্বল আলোকে সে প্রিয়তম মুখের দিকে চাহিয়া থাকি। মৃণ্ময়ীর অভ্যন্তরস্থ রক্তসম ভালবাসার প্রতি বঙ্গচন্দ্র চাহিতেন না, তাই তিনি মৃণ্ময়ীর মুখ ফুটাইতে চেষ্টা করিতেন।

       একদিন বঙ্গচন্দ্র যখন তাঁহার বাঞ্ছিত বিষয়গুলির সংস্কারের জন্য বড়ই ধরিয়া বাঁধিয়া পড়িলেন; মৃণ্ময়ীর ওষ্ঠ বন্ধন সে দিন শিথিল হইয়া গেল। অতি ধীরে মৃণ্ময়ী স্বামীকে জানাইতে চেষ্টা করিলেন, দিবসে আসিতে ভয় হয়-পাচ্ছে কেহ কিছু বলে; চোখ মেলিয়া চাহিতে - লজ্জা করে; কথাবার্ত্তা বলেনা-কায়দা পায়না। বঙ্গচন্দ্র শুনিয়া অনেক আদর করিলেন, সাহস দিলেন এবং লজ্জাবন্ধনটার আর একটুক উনিশ বিশ করিতে উপদেশ দিতেও ত্রুটী করিলেন না।
বঙ্গ পণ্ডিত এতদিনে তাহার বিদ্যার পাকা রেওয়াজ ভ্রম বলিয়া বুঝিলেন। বুঝিলেন মৃণ্ময়ীই ঠিক। বঙ্গ ভালবাসিয়া এবং ভালবাসা দেখাইয়া সুখী মৃণ্ময়ী কেবল ভাল বাসিয়াই সুখী।

(৫)

        এইরূপে সময় চলিতে ছিল।অকস্মাৎ বঙ্গ চন্দ্র বসন্তের কঠোর আক্রমণে যমালয়াভিমুখে ধাবিত হইলেন। যমলোকে তাহার ডাক পড়িল।

      মৃণ্ময়ী দুইহাতে দ্বার চাপিয়া ধরিলেন। সতীর মহাযুদ্ধে যমরাজ পরাজয় স্বীকার করিলেন বটে, কিন্তু যাত্রা নিষ্ফল করিলেন না। চতুর্দ্দশ দিবসের মহা আহবের পর যমরাজ নিরস্ত হইলেন। এ চতুর্দ্দশ দিবস মৃণ্ময়ী স্বামীর শয্যা পার্শ্বে বসিয়া লাজভয় ত্যাগ করিয়া আনত মস্তকে তাহার ঘা গুলি পরিষ্কার করিয়াছেন, স্বামীর যাতনায় নিজ যন্ত্রণা বোধ করিয়া দিবারাত্রি অশ্রু বিসর্জ্জন করিয়াছেন।

      বঙ্গ তাহা দেখিতে অবকাশ পাইলেন না। পঞ্চদশ দিবসে বঙ্গ উঠিয়া বসিলেন; তাঁহার পরিত্যক্ত রোগ ক্লান্তি ও অবসাদ লইয়া সাধ্বী মৃণ্ময়ী স্বামীর পরিবর্ত্তে কালের পশ্চাতে অনুসরণ করিলেন।

(৬)

       বিপত্নীক বঙ্গ চন্দ্র মৃণ্ময়ীর শোকে কতকদিন বড়ই অধীর ছিলেন সত্য। কিন্তু এই পঞ্চবিংশতি বর্ষেই তাহার সব ফুরাইল; এইরূপ গোছের কোন কিছু হা-হতোস্মি তাহার পাণ্ডিত্যাভিমানী হৃদয়ে স্থান দিতে প্রস্তুত হইলেন না। ধৈর্য্যধারণ করিয়া আবার বিবাহ করিবেন স্থির করিলেন।

      এবার সাধিয়া ভজিয়া প্রেম করিতে হয়, এরূপ প্রেমশূন্য নিরেট বাঙ্গালকে পত্নীত্বে বরণ করিতে একটা তুমুল বাদ প্রতিবাদ উত্থাপন করিতে হইবে, ইহা পূর্ব্ব হইতেই অবধারিত রহিল। কারণ মৃণ্ময়ী সতী সধ্বী হইলেও প্রেম-প্রপঞ্চে তাহার নিকট অনেক অত্যাচার বঙ্গ চন্দ্রকে সহ্য করিতে হইয়াছে।

****          ****        ****

      এক অতি শুভদিনে বঙ্গচন্দ্রের শুভ বিবাহ সংঘটন হইয়া গেল। অলোক সামান্যা নববধূর রূপলাবণ্যে, বিবাহ-গৃহ আলোকিত হইয়া গেল। মাতা বধূ দেখিয়া সুখী হইলেন। বঙ্গ বাবুর আনন্দ মনে ধরে না। স্ত্রী বিরাজময়ী, সুন্দরী, বিদূষী, সুচতুরা, সুপ্রেমিকা, সুকণ্ঠী ইত্যাদি ইত্যাদি। নামের সহিত পত্নীর দোষগুণের কোন পার্থক্য না থাকিতে পারে চিন্তা করিয়া বঙ্গচন্দ্র পত্নীর পৈতৃক নামটী বাতিল করিয়া তৎস্থানে 'হিরণ্ময়ী'র সমাবেশ করিয়া সুখী হইলেন। হিরণ্ময়ী বাসরেই বঙ্গকে বলাইতে কুণ্ঠিত হইল না যে হিরণ্ময়ী ও মৃণ্ময়ী-আকাশ আর পাতাল।

      হিরণ্ময়ী বঙ্গচন্দ্রের চিত্তবিনোদনার্থে সদা সর্ব্বদাই সে অপরূপ রূপের ডালি লইয়া তাহার বিলাস কক্ষের শোভা সংবর্দ্ধনে যত্নবতী। গৃহকার্য্য কিম্বা শাশুড়ী সেবায় তাহার লক্ষ্য অতি সামান্য।

      বঙ্গ এখন সাংসারিক কাজ কর্ম্মের ততটা খবর রাখেন না| হিরণ্ময়ীর খাস দরবারে তাহার আমূল হিসাব চুকাইয়া দিয়াছেন। হিরণ্ময়ীই এখন গৃহকর্ত্রী। বঙ্গচন্দ্র আতি অল্পদিনের মধ্যেই হিরণ্ময়ীকে তাহার একজন অতি সুদক্ষ মন্ত্রী বলিয়া চিনিতে পারিয়াছেন। হিরণ্ময়ীও সর্ব্বতোভাবে বঙ্গচন্দ্রের কল্যাণ কামনা ত্রুটী দর্শাইতেছে না।

      শাশুড়ী, দেবর ও জা-এর খরচ লাঘবের পক্ষে তাহার দৃষ্টি যতদূর প্রখরা, নিজ অতিরিক্ত বিলাস বাসনার সম্যক পরিতুষ্টির ব্যয় বাহুল্যের দিকে আবার ততদূর উদাসীন। এবিষয়ে সন্দেহ ভঞ্জনার্থ যদিও তরুণী-জনোচিত নাতিউচ্চ, নাতিমধ্যম নিক্কণে প্রতিবেশীদিগকে লক্ষ্য করিয়া দেবর ও জাকে শুনাইতে ছাড়িতে না যে তাহার পকেট খরচের একটা বিশেষ বরাদ্দ তাহার বাবা তাহার জন্য বাঁধিয়া দিয়াছেন, তথাপি পূর্ণচন্দ্রের সন্দিহান চিত্তে সে কৈফিয়ৎটা ততদূর কার্য্যকরী হইতে পারিল না। সেজন্য তিনি কয়েক মাস দেখিয়া শুনিয়া নিজ মোসাহারার টাকাটা বধূ ঠাকুরাণীর করকমলে আনিয়া দেওয়ার ব্যবস্থাটা উঠাইয়া দিলেন। যথাসময়ে সে নালিশ বঙ্গচন্দ্রের কাণে উঠিল। তিনি ক্ষুণ্ণ হইলেন। এইরূপ খুটিনাটী ঘটনায় কয়েক দিন চলিতে লাগিল।

(৭)

        হিরণ্ময়ীর লাজলজ্জা পরিমাণ অতিক্রম করিয়া উপযুক্ত তদ্বিরের অভাবে বহুপূর্ব্বেই নির্ব্বাসিত হইয়া ছিল। স্বামী স্কুলে চলিয়া গেলে হিরণ্ময়ী আপন লাবণ্য উচ্ছলিত শশাঙ্কলাঞ্ছিত রূপরাশি লইয়া পথিপার্শ্বস্থ উন্মুক্ত কক্ষ বাতায়নে দণ্ডায়ামান হইত এবং কৈমুদীদীপ্ত বিলোল কটাক্ষে আফিস ও কলেজগমনোন্মুখ টেরাকাটা বাবুদিগকে দেখিত এবং স্বীয় অপরূপ রূপযৌবনপুষ্পিত মাধুরীমহিমা দেখাইতে ভালবাসিত। বাবুদের যাহারা সে জ্বলন্ত অনল দেখিত হঠাৎ থামিয়া পতঙ্গের জন্মের অশেষ ধন্যবাদ দিয়া তাহা প্রাপ্ত হইবার আশুপ্রত্যাশা না দেখিয়া মনের ব্যাথা মনে লুকাইয়া আপন মনে চলিয়া যাইত। হিরণ্ময়ী তাহাতে একার্য্যে ছোটখাট রকমের মিষ্ট ঠাট্টা করিত, বালিকা জা দেখিয়া লজ্জায় সরিয়া যাইত, শাশুড়ীর চক্ষে তাহা অসহ্য হইত, কিন্তু বৃদ্ধা ভয়ে ভয়ে কিছু বলিতে সাহসী হইতেন না।

       বৃদ্ধা পুত্রবধূর এই অতিরিক্ত স্বাধীনতার কথা বড় পুত্রের নিকট না তুলিয়া ছোট পুত্র পূর্ণের নিকট তুলিতে আপত্তি দেখিলেন না। পূর্ণ আফিসের কোন বন্ধুর নিকটও এইরূপ একটুক আভাস পাইয়া ছিলেন, তাই হিরণ্ময়ীর স্বাধীনতার একটুক কড়া সমালোচনা করিয়া বড়ই শক্ত কথা শুনাইয়া দিলেন। এত শক্ত কথা হিরণ্ময়ীকে কেহ কখন বলে নাই।
যথাসময়ে ঝড় আসিল, ছানি উড়াইল, খুটী নাড়িল, ঘন গর্জ্জন অনুভুত হইল, মুষলধারে বারিপাতও হইয়া গেল। বঙ্গের বুক ফাটিল, মুখ ফুটিল না।

(৮)

        বালাই গিয়াছে, এখন আর হিরণ্ময়ীর উপরে কে? শাশুড়ীর মৃত্যুর পর হিরণ্ময়ী নিশ্চিন্ত মনে ১১টা হইতে ৩টা পর্য্যন্ত পাড়া বেড়াইতে বাহির হইত। কে কি বলিবে? বঙ্গচন্দ্র তাহা জানিতে পারিতেন না। সে অতিরিক্ত কার্য্যের জন্য তাহাকে কোন অসুবিধা ভোগ করিতে হইত না। দিন এমন ভাবেই চলিতে লাগিল।
একদিন হঠাৎ একটা চিঠির গোলমালে হিরণ্ময়ীর প্রতি পূর্ণচন্দ্র সন্দিহান হইলেন, স্বীয় স্ত্রীর নিকট হইতেও তাহার অজ্ঞাত বাসের অনেকটা অনুসন্ধান লইলেন। তারপর বঙ্গকে প্রকারান্তরে জানাইতে কুণ্ঠিত হইলেন না যে "হিরণ্ময়ীর উচ্ছৃঙ্খলতাদির জন্য একটু বিশেষ দৃষ্টি সম্প্রতি আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে"। পূর্ণের এ ধৃষ্টতা জানিতে হিরণ্ময়ীর ৫ মিনিটের বেশী সময় লাগিল না।

       হিরণ্ময়ী কাঁদিয়া কাটিয়া নিজ ক্যাসবাক্স হইতে ৫০০ টাকার নোট খুলিয়া বঙ্গচন্দ্রের পদতলে রাখিল এবং সকরুণ স্বরে বলিল "এই নেও তোমাদের বেসাত - আমার কলঙ্ক, ভাইকে ভাগ করে দিয়ে সুখে থাক। আমাকে কলঙ্কিণী বলিতে হয় বল। দশ বছর তোমার সংসার নাড়িয়া যাহা করিয়া ছিলাম, তাহা লইয়া যাও। এরজন্য এত কথা!" হিরণ্ময়ীর সে সকরুণ মিষ্টস্বরে বঙ্গ পণ্ডিত মুগ্ধ হইলেন, পূর্ণের ধৃষ্টতা স্মরণ করিয়া মধুর সম্মোহন অস্ত্রগুলির অপেক্ষিক গুরুত্বের ব্যবহার করিয়া ফেলিলেন। তাহার পর যাহা হইবার হইয়া গেল।

(৯)

        অনেক চেষ্টা করিয়াও যে ব্যধি বঙ্গের দেহ-মন্দির ধ্বংস করিতে মায়া করিতেছিলো; সেই বহু মূত্রের মাত্রা হঠাৎ এত বৃদ্ধি হইয়া গেল যে বঙ্গ চন্দ্র একেবারে শয্যাশায়ী হইয়া পড়িলেন। হিরণ্ময়ীর সৌহৃদ্যে তাহার প্রবল বিশ্বাস; তাই রোগশয্যায়ও কতকটা সুখ অনুভব করিতে লাগিলেন। কিন্তু সে সুখও নিবিয়া গেল।

       রোগ যখন প্রবল হইযা উঠিল, হঠাৎ একদিন হিরণ্ময়ী শয্যা শায়িনী হইলেন। রোগ আমাশয়, "হাতে ঘটী" অবস্থাতেই থাকেন। রাত্রেই অধিক। তাতেও বিরাম নাই, দিবসে বঙ্গের অনেকটা তত্ত্ব খবর করিয়া থাকেন। রাত্রিতেও যতক্ষণ পারেন অকুণ্ঠিত চিত্তে সেবা শুশ্রূষা করিতে ছাড়েন না। হঠাৎ নিজের পীড়া পাইলে ঘটী হাতে বাহির হন। কোন দিবস ঘরে আসেন কোন দিবস বা আসিতেও পারেন না। দেখিবে কে?

      একদিন হঠাৎ হিরণ্ময়ীর চিত্ত-চাঞ্চল্য লক্ষিত হইল। চতুর্দ্দশীর সূচীভেদ্য অন্ধকার ভেদ করিয়া হিরণ্ময়ী ঘটী হস্তে বাহির হইলেন। বঙ্গচন্দ্র অনেক কষ্ট অনুভব করিলেন। উৎসুক দৃষ্টিতে দরজার প্রতি চাহিয়া রহিলেন। ভয় নাই! তাহার অভয় বাণীতে তিনি নিজেই আশ্বস্ত হইলেন। ধীরে ধীরে নিদ্রা আসিয়া তাহাকে গাঢ় আলিঙ্গন করিল।
পরদিন সকলে জানিল হিরণ্ময়ী প্রাচীর সংলগ্ন গৃহের নীরোদ বাবুর সহিত অদৃশ্য হইয়াছে। বঙ্গচন্দ্রের শয্যা পার্শ্বে যখন একথা পহুছিল, বঙ্গ চীৎকার করিয়া অজ্ঞান হইয়া পড়িলেন। তারপর যখন সংজ্ঞা হইল, বিংশতি বৎসরের বিগত স্মৃতি যেন তাহার মনে জাগরিত হইয়া উঠিল। তিনি দেখিলেন যেন সেই শঙ্কিত, সলজ্জ অবগুণ্ঠণবতী-দেবী তাহার পদতলে বসিয়া ক্লান্তির অবসাদগুলি ঢাকিয়া দিতে চেষ্টা করিতেছে। পার্শ্বে বসিয়া পূর্ণচন্দ্র অশ্রুসিক্ত নয়নে বলিল- "দাদা আমরা থাকিতে তোমার ভয় কি?"

('আরতি' মাসিক পত্রিকা, ভাদ্র ১৩০৭)

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।