প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

প্রেরিত পত্র (১)

            বিজ্ঞবর মান্যবর শ্রীলশ্রীযুক্ত অরুণোদয় সম্পাদক মহাশয়
    মদীয় কতিপয় পংক্তি সংশোধনানন্তর তদীয় অরুণোদয় পত্রৈক পার্শ্বে স্থান দানে চিরবাধিত করিবেন|

          অনেক দিবস গত হইল তিন চারিটি বিধবা নারীর বিবাহ হওয়াতে আমরা অত্যন্ত আহ্লাদিত এবং ভরসান্বিত হইয়াছিলাম| বোধ করিয়াছিলাম এতদিনের পর বুঝি জগদীশ্বর তাহাদিগের প্রতি সানুকূল হইয়াছেন, কিন্তু কি দুঃখের বিষয় যে অদ্যাবধি বঙ্গবাসীরা ভীত হইয়া গর্হিত কর্ম্ম জানিয়াও হিত কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইতে অপারক| যখন এতদ্দেশীয় মহানুভব মহাত্মারা বিধবা বিবাহে উৎসাহান্বিত হইয়া জনসমীপে নাম স্বাক্ষর প্রাপ্ত হইবার আশয়ে স্থানে স্থানে পুস্তক প্রেরণ করিয়াছেলেন, তখন প্রায় পঞ্চ সহস্র ভদ্রসন্তান নামস্বাক্ষর করিয়াছিলেন| এবং আমরা বিশেষ জানি যেসকলেই এই সুখদ বিষয়ের হিতানুষ্ঠানে যত্নশীল হইয়াছিলেন| আহা! তখন আমরা আহ্লাদে পরিপূর্ণ হইয়া তাহাদিগকে অগণ্য ধন্যবাদ করিয়াছিলাম এবং মনে মনে ভাবিয়াছিলাম যে ইহারা সকলেই বিবাহ দিতে এবং বিবাহ করিতে উদ্যত আছেন| সম্পাদক মহাশয় বিবেচনা করুন যদি এবিষয়ে ঐ কাল্পনিক স্বাক্ষরকারিদিগের যথার্থ উৎসাহ থাকিত তবে এত দিনে তাহারা নিজ২ কন্যা ও ভগিনীপ্রভৃতির দিয়া এই আবশ্যকীয় বিষয়ের সূত্রপাত করিতেন| আমি বোধ করি যে প্রত্যেকের ভবনেই প্রায় দুঃখিনী বিধবা বালা ক্লেশ ভোগ করিতেছে; যদি সকল ভবনে না হয় তথাচ পঞ্চ সহস্র মধ্যে এক সহস্র থাকিবার সম্ভাবনা| যদি ঐ সহস্র অভাগা বালিকার এত দিনে বিবাহ হইত, তবে এই ভারতবর্ষ অদ্য কত সুখাস্পদ হইত| হে কাল্পনিক স্বাক্ষরকারি মহোদয়েরা! পূর্বোক্ত মহানুভব মহাশয়েরা কি তোমাদিগকে নাম স্বাক্ষর জন্য প্রহার করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন? ছি ছি! যদি এরূপ করিবার মানস ছিল, তবে কি কারণ স্বাক্ষর করিয়া জনসমীপে হাস্যাস্পদ হইলেন?

কস্যচিৎ জেনেরল এসেম্ব্লিনামক বিদ্যালয়ের
প্রথম শ্রেণীর ছাত্র|

( মূল বানান ও শব্দবিন্যাস অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে)
( ‘অরুণোদয়’ পাক্ষিক পত্রিকা, ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দ )

      ( বিঃ দ্রঃ : পত্রপ্রেরক তার নাম জানান নি, জানালেও তার সম্বন্ধে তথ্য যোগাড় করা সম্ভব ছিল না| সে সময়ে স্কুলের প্রথম শ্রেণী এখনকার কোন শ্রেণীর সমতুল্য ছিল এবং কোন বয়সে ভর্তি হওয়া যেত জানা নেই| যদি বর্তমানের ক্লাস ওয়ানের সমতুল্য হয় তবে সেই ছাত্রের পক্ষে এ ধরণের সমাজ সচেতনতা ও তথ্যসহ পত্র প্রকাশ বিস্ময়ের উদ্রেক করে| প্রসঙ্গতঃ বিধবা বিবাহ নিয়ে আন্দোলন ও বিদ্যাসাগরের এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালনের কথা আমরা কম বেশি সকলেই অবগত আছি| ছাত্রটির পত্র প্রকাশিত হয়েছে ১৮৫৮ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি এবং বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়ন হয়েছিল ১৮৫৬-এর ২৬শে জুলাই| প্রেরিত পত্রটি থেকে বোঝা যাচ্ছে বিধবা বিবাহ আইন পাশ হলেও সমাজের অনেকেরই ইচ্ছা সত্বেও কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণে দ্বিধা ছিল| এ প্রসঙ্গে ‘ভারতকোষ’ থেকে কিছু তথ্য দেওয়া হল -

       “দেশের বৃহত্তর দায়িত্ব থেকে অবশ্য এত শীঘ্র তিনি (বিদ্যাসাগর) অবসর লন নাই| জীবনমুক্তির ব্যাপকতর সংগ্রামে বিদ্যাসাগরের সাধনা তখনও অসমাপ্ত ছিল| শৈশবে যখন তিনি কলিকাতায় আসেন তখন সতীদাহ-প্রথা আইনতঃ নিষিদ্ধ হচ্ছে| তার পর অনেকদিন কেটে গিয়েছে, ইতিমধ্যে দেশীয় সমাজে বিধবা-বিবাহ নিয়ে বাদানুবাদের সূত্রপাত হয়েছে| কৃষ্ণনগরের রাজা শ্রীশচন্দ্র এবং কলিকাতায় কেউ কেউ তখন বিধবা-বিবাহের বিধান খুঁজছেন| অন্য দিকে সেই সময়ে হিন্দু বালিকা বিধবাদের দুর্দশা প্রসঙ্গে সর্ব্বশুভঙ্করী পত্রিকায় (১৮৫০ খ্রীঃ) এবং বিধবাদের পুনর্বিবাহের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতে (১৮৫৪-৫৫ খ্রীঃ) বিদ্যাসাগর দীর্ঘ প্রস্তাব রচনা করেছেন| এই সব প্রস্তাবে সমাজদেহ আলোড়িত হয়ে ওঠে| কিন্তু নিজস্ব বক্তব্য প্রচারে বিদ্যাসাগর কেবল সুবুদ্ধি ও মানবতার উপর নির্ভর করেন নি, সাধারণের বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য তিনি অসীম শ্রমে অনুকূল শাস্ত্রবচনও উদ্ধার করেছিলেন|

         উপরন্তু বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন যে মানবতার যুক্তি ও শাস্ত্রনির্দেশও যথেষ্ট নয়, প্রয়োজনমত সরকারি আইনের সাহায্য নিতে হবে| বিধবা-বিবাহের সমর্থনকারীরা এই উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়নের জন্য সরকারের নিকট জনস্বাক্ষরিত একাধিক আবেদনপত্র প্রেরণ করেন| ১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দের ৪ অক্টোবর বিদ্যাসাগর যে আবেদন পাঠান তাতে প্রায় সহস্রটি স্বাক্ষর ছিল| বিরোধী পক্ষ থেকেও বিপরীত আবেদন পৌঁছায়| কিন্তু বহুবিধ বিচার আলোচনার পর সরকারি কর্ত্তৃপক্ষ ব্যবস্থাপক সভায় বিধবা-বিবাহ আইন পাশ করিয়ে নেন (২৬ জুলাই, ১৮৫৬ খ্রীঃ)| শান্তিপুরের তাঁতিরা তখন কাপড়ের পাড়ে বুনে দিত 'বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে, সদরে করেছে রিপোর্ট, বিধবাদের হবে বিয়ে'| বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তিত হলে তাদের এই স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস যেন সার্থকতা লাভ করল|” )
                                                                             দীপক সেনগুপ্ত|


প্রেরিত পত্র (২)

          হে অরুণোদয় সম্পাদক মহাশয়| পূর্ব্বতন মৎপ্রেরিত পত্র খানি অরুণোদয়ে স্থান প্রদানে পরম আহ্লাদিত করিয়াছেন| সংপ্রতি পুনরপি কতিপয় বর্ণপংক্তি প্রকটিত এক খানি পত্র পাঠাই, করুণাবলোকন পুরঃসর সংশোধনপূর্ব্বক ভবদীয় ভুবন বিকাশ পত্রৈক পার্শ্বে স্থলদানে এ নব লেখকের উৎসাহ সম্বর্দ্ধন করিবেন|

        মনুষ্যগণ স্বস্ব কর্ম্মবশতঃ উন্নতি ও হ্রাস প্রাপ্ত হয়|
     পরাৎপর পরমেশ্বরের কি পরমাশ্চর্য্য মহিমা| এই মহীমণ্ডলস্থ সমস্ত মানবদিগের মহোপকার ও হিত সাধনার্থে করুণাময় জগদীশ্বর কি না সৃষ্টি করিয়াছেন| তিনি অসঙ্খ্য জীবগণের জীবন যাত্রা ব্যয় নির্ব্বাহ জন্য বিবিধ উপায় স্থির করিয়া রাখিয়াছেন| এবং আমাদিগের সুখ স্বচ্ছন্দে সংসার লীলা সুসম্পন্নহেতু হস্ত, পদ, চক্ষুঃ, কর্ণ এবং মনঃ, বুদ্ধি, বৃত্তি ও সুনিয়ম প্রভৃতি বহুধা কারণিক বস্তু প্রদান করিয়াছেন| এত বিচিত্র ব্যাপার প্রত্যক্ষ বিবেচনা করিয়া দেখিলে হৃদয়ে কিপর্য্যন্ত জ্ঞানোদ্রেক হয় তাহা জানিতে পারা যায়|

       পরন্তু যাঁহারা সুবোধ মনুষ্য তাঁহারা কর্ত্তব্য বোধে উল্লিখিত সমস্ত বিষয় হৃদয়ঙ্গম করিয়া ঐশ্বরিক নিয়মানুগামী হইয়া পরম প্রীতি লাভ করিয়া থাকেন| এবং নিয়ত সুনীতি শরণিতে পদার্পন করত ধরণী মধ্যে সজ্জনগণ সমাজে গণ্য হইয়া ধন্যবাদ ও প্রশংসার পাত্র হয়েন| যদি কাহার পিতা মাতা ধনবিহীন হইয়া ক্লেশে কাল হরণ করিতে থাকে, তবে তিনি তদ্দর্শনে নিতান্ত খেদান্বিতান্তঃকরণ হইয়া সাধ্যানুসারে উপায়ান্বেষণ করিতে থাকেন| ফলতঃ বাসনা ফল সফল না হইলে জন্ম বিফল জ্ঞান করত স্বয়ং তিরস্কৃত হইয়া নিরুপায় বশতঃ সতত বিনীত বেশে অপরাধ মার্জ্জনার্থে আর্য্য সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া থাকেন| তথাপি পরস্বাপহরণে সুখে কাল হরণ করিব এমত প্রার্থনা করেন না| ফলতঃ এসকল ব্যক্তির লোক কুলে নিন্দিত ও পরকালে দণ্ডিত হইতে হয় না| কেহবা জনক জননীর দুঃখোন্মোচন করণার্থে শৈশবাবস্থায় বিদ্যোপার্জ্জন করিয়া থাকেন, পরিশেষে ধনোপার্জ্জনে ক্রমশঃ শ্রীমান হইয়া মাতাপিতার সেবা শুশ্রূষা করত যন্ত্রণা জাল হইতে মুক্ত হয়েন| এবং যশঃ প্রার্থিত হওত সৎকর্ম্মনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়া দেশের মঙ্গল চিন্তা করিয়া থাকেন| পরোপকারে সযত্ন হইয়া বহুতর অর্থ ব্যয় করত যশোবশ হয়েন| সুতরাং উন্নতি প্রাপ্ত হইয়া ইহলোকে পরম সুখে মনুষ্য যাত্রা নির্ব্বাহ করেন| এবং চরমে পরম পুরুষার্থ মুক্তি পদার্থ লাভের নিমিত্ত ঈশ্বরোপাসনায় মনোভিনিবেশ করত অন্তিমে স্বর্গারোহণ করেন|

         যাহারা বিবেচনা রহিত মনুষ্য তাহারা ঈশ্বরীয় নিয়ম বহির্ভূত কার্য্যানুগত হইয়া বিবিধ অবৈধ কর্ম্মে কালাপিতাত করিয়া থাকেন| এবং আত্ম স্বার্থের নিমিত্ত সর্ব্বদা মিথ্যা ও প্রবঞ্চনা বাক্যেতেও কদাপি পরাঙ্মুখ হয়েন না| পরের অনিষ্ট চিন্তাই তাহারদিগের সংসার সামগ্রী সমগ্র মধ্যে প্রধান সারদায়িনী| বিদ্যা ও ধনোপার্জ্জনে অসমর্থ হইয়া পৈতৃক ধন যাহা থাকে তাহারি উপর নির্ভর করতসুরাপানাদি বিষয়ে নিরর্থক ব্যয় করিয়া সংসার সুখ সম্পাদনে প্রবৃত্ত হয়েন| ফলতঃ ক্রমশঃ সঞ্চিত ধনে বঞ্চিত হইতে হয়| সহজেই পরিশেষে দুঃখের আর পরিশেষ থাকে না| উদর পরিপূরণার্থ পর বৈভব হরণে মনস্থ করেন| এবং অবিদ্যা বশম্বদ হইয়া জনক জননীর প্রতি অপ্রিয় বাক্য প্রয়োগ করিয়া থাকেন| না হয়ত সংসার জ্বালায় বিরক্ত হইয়া প্রাচীন পিতা মাতা ও পরিবারদিহকে এককালে ক্লেশকূপে নিক্ষেপ করত দেশান্তরী হয়েন| এই প্রকার কুনীতি পদবীতে পদার্পণ করত পদে২ বিপদগ্রস্ত হইয়া জনপদে অপদস্থ হইয়া থাকেন| সুতরাং অন্তকালেও অনন্ত গুণাবলম্বী জগদীশ্বরের অনন্ত কোপে পতিত হওত অনন্ত কালপর্য্যন্ত নিরয়গামী হইয়া অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করিতে হয়| ফলতঃ মনুষ্যগণ স্বস্ব কর্ম্ম ফলে উন্নতি হ্রাস প্রাপ্ত হয়|                                               নবদ্বীপস্থ সংস্কৃত বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র শ্রীশশিভূষণ শর্ম্মা

( ‘অরুণোদয়’ পাক্ষিক পত্রিকা, ১লা ডিসেম্বর ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দ )

       ( বিঃ দ্রঃ প্রথম শ্রেণীর জনৈক ছাত্র প্রেরিত একটি পত্র এর আগেই ‘অবসরে’ দেওয়া হয়েছে| বর্তমান পত্রপ্রেরক শশিভূষণ শর্ম্মাও প্রথম শ্রেণীর ছাত্র| প্রথম শ্রেণীর একজন ছাত্রের পক্ষে এ ধরণের ভাষা ব্যবহার ও ভাব প্রকাশ একটু বিস্ময়কর বলেই মনে হয়| মাঝে মাঝে অনুপ্রাশের ছোঁয়া পত্রটিকে আরো মনোগ্রাহী করেছে| যদিও এখনকার অনেক পাঠকের কাছেই পত্রে ব্যবহৃত সাধুভাষা সুখপাঠ্য নাও হতে পরে, তবু সে কালের সাহিত্য, ধর্মভাব ও সমাজচিন্তা কিছুটা অন্তত ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করে এ ধরণের সংকলন|)

(লেখাটিতে মূল বানান ও শব্দবিন্যাস অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে|)             

    দীপক সেনগুপ্ত|

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।

সেকালের জনপ্রিয় লেখক ও তাঁদের লেখা

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ