প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

অনাদৃতা

[ লেখক পরিচিতি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধুরীলতার জন্ম ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ২৫শে অক্টোবর জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে । মা মৃণালিনী দেবী । কবির প্রিয় ছিল বেল ফুল । তাই জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর দেওয়া নাম ছিল বেলা । কবি আদর করে ডাকতেন বেলা, বেলি বা বেলুবুড়ি নামে । মাধুরীলতা বাড়িতেই ইংরেজি ও সংস্কৃত শিখেছেন মিস্ পার্সন্স, মিস্ এলজি, মিস্ লিটেন, মিঃ লরেন্স, শিবধন বিদ্যার্ণব ও পণ্ডিত হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের কাছে । বহুবিধ বিদ্যার চর্চা করেছেন তিনি; ইংরাজি শিক্ষার সঙ্গে মনুসংহিতা ও বিষ্ণুপুরাণও বাদ যায় নি । অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে হওয় রবীন্দ্রনাথ সমর্থন করতেন না; কিন্তু নিজের মেয়েদের বেলায় সে নিয়ম তিনি মানেন নি । চোদ্দো বছর বয়সেই বেলার বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়েছিলেন তিনি । সুপাত্র খুঁজে বের করার জন্য চেষ্টা হয়েছে অনেক । অবশেষে পাওযা গেল কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর ছেলে শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীকে । দর্শন শাস্ত্রে অনার্স নিয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে বি.এ. পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেশবচন্দ্র স্বর্ণপদক লাভ করেন । মেন্টাল ও মরাল সায়েন্স নিয়ে এম.এ. তেও প্রথম । আইন নিয়ে পড়াশোনা করে মজঃফরপুরে প্র্যাকটিস করেছেন । অল্প বয়সে বিহারীলালের কাব্য প্রতিভার গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও তার মেজ বৌঠান কাদম্বরী দেবী । অতএব যথেষ্ট বরপণ দিতে হলেও রবীন্দ্রনাথ এমন পাত্রকে হাতছাড়া করতে চান নি । মাধুরীলতা ও শরৎচন্দ্রের বিবাহিত জীবন কেমন ছিল তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে ।
কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী কবিরই নির্দেশে মূল শ্লোক থেকে খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে রামায়ণ রচনার কাজে হাত দিযেছিলেন, শেষ করে যেতে পারেন নি । অসমাপ্ত কাজ শেষ করার দায়িত্ব দিযে যান মাধুরীলতার উপর, অকাল মৃত্যুতে তিনিও সেটার সমাপ্তি ঘটাতে পারেন নি; খাতাটিও আর খুঁজে পাওয়া যায় নি । তবে মহাভারত, উপনিষদ ও মনুসংহিতার কিছু শ্লোকের অনুবাদ করেছিলেন মাধুরীলতা । প্রশান্ত মহলানবীশকে একটি চিঠিতে মাধুরীলতার রচনাশক্তি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন -"ওর ক্ষমতা ছিল, - কিন্তু লিখত না ।" তার রচিত গল্প - সুরো ; মামা-ভাগ্নী ; সৎপাত্র ; দ্বীপনিবাস ; অনাদৃতা ; চোর ; চামরুর গল্প ; মাধুরীলতার গল্প । 'সবুজপত্র' ছাড়া 'ভারতী' ও 'বঙ্গদর্শন (নবপর্যায়)' পত্রিকাতেও তিনি লিখেছেন । মাত্র একত্রিশ বছরের কিছু বেশি সময় বেঁচে ছিলেন মাধুরীলতা । ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই মে তার মৃত্যু হয় । ]
... দীপক সেনগুপ্ত।

দুইটি কন্যা ও তিনটি পুত্রের ভার স্বামীর হাতে সঁপিয়া দিয়া হরমণি যখন চির অবসর গ্রহণ করিল, নীলু বড় ফাঁপড়ে পড়িয়া গেল । সে বেচারা ছাপাখানায় কাজ করিত, বেতন যাহা পাইত মাসে মাসে স্ত্রীর হাতে দিয়া নিশ্চিন্ত থাকিত, সামান্য ২০ টাকায় কি করিয়া এতগুলি প্রাণীর ভরণপোষণ সম্ভব তাহা তাহাকে একদিনও ভাবিতে হয় নাই । প্রত্যহ নিয়মিত ৯ ।১০ টার সময় সে ডাক দিত, "বড় বৌ, ভাত বাড়, আমি নাইতে যাচ্ছি ।" স্নান সারিয়া যেখানে হর পাখা হাতে ভাত আগলাইয়া মাছি তাড়াইতেছে সেখানে বসিয়া গিয়া সপাসপ্ নাকে মুখে ভাত গুঁজিয়া পানটি হাতে লইয়া আপিসের দিকে চলিয়া যাইত । নীলুর খাওয়ার কোন কষ্ট ছিল না, মাছটি তরকারীটি যে সময়কার যা পাওয়া যাইত, নীলুর পাতে পড়িতই পড়িত, পরিবারের সকলেই তাহার মত রাজভোগে আছে সে বিষয়ে তাহার কোন সন্দেহ ছিল না এবং মধ্যে মধ্যে স্ত্রীলোকের যে আহার সম্বন্ধে অতিরিক্ত লোভ আছে এবং সেটা যে অত্যন্ত নিন্দনীয় সে কথা চাণক্যের শ্লোক মিশাইয়া স্ত্রীকে বুঝাইয়া দিত । হর চুপ করিয়া শুনিত; স্বামী চলিয়া গেলে ছেলেগুলিকে খাওয়াইবার সময় তাহার চোখের জল সামলান দায় হইত । খোকা দুধ হইলে আর ভাত খাইবে না; পট্লা এখন খাইবে না, মার সঙ্গে খাইবে, মা নিজের জন্য বড় মাছ লুকাইয়া রাখিয়াছে; টুলি বলে, বাবা কেন সব তরকারী খাইয়া ফেলে, আমাদের জন্যে একটুও রাখে না; কচির সবে বিবাহ হইয়াছে সে মাকে ধমকায়, না খাওয়াইতে পারিবি ত শ্বশুরবাড়ি পাঠাইয়া দিস্ না কেন? কচি জানে না তাহার গহনায় ২ ।১০ ভরি সোনা কম পড়িয়াছিল, তাহা পূরণ করিতে না পারিলে তাহর শ্বশুর বধূকে স্থান দিতে পারিবে না । "লক্ষ্মী আমার, সোনা আমার, আজকের মত খাও, কাল দিদিমার বাড়ি যাব, কত সন্দেশ আনব, সব তোমাদের দেব"; এইরূপ এক-একদিন এক-এক ছলনা করিয়া ছেলেদের ভুলাইয়া নিজে যে হর ফ্যানের জলে ভাত চটকাইয়া নুন মাখিয়া খাইত তাহাতে তাহার তিলমাত্র দুঃখ ছিল না, সে কটাও নিজে না গিলিয়া যদি ছেলেদের দিতে পারিত তবেই তাহার আপশোষের নিবারণ হইত ।
হরমনির ভায়েদের অবস্থা নিতান্ত মন্দ ছিল না, কিন্তু সেখানে হাত পাতিয়া নিজের দৈন্য স্বীকার করিতে সে অত্যন্ত কুণ্ঠা বোধ করিত । কচির বিবাহ মামাদের সাহায্যে হইয়াছে, আবার সে একা নয়, তার অন্য দুইটি সধবা বোনেরও তাহারি সমান অবস্থা, বিধবা বোনটি মার কাছেই থাকে; মা সকলকেই মাসে ২/৫ টাকা করিয়া দেন । টানাটানির সংসারে সে টাকা-কয়টি ছেলেদের অসুখ-বিসুখে ডাক্তারের ফিতে ও পথ্যতে কোথায় তলাইয়া যাইত । হাড়ভাঙ্গা খাটুনি, দুশ্চিন্তা ও অনাহারের ফল ফলিল-দারুণ যক্ষা ধরিল, নিজে বুঝিতে পারিয়া একটি দিনের জন্যও স্বামীকে সে কথা জানায় নাই-জানাইতেও হইল না, নীলু একদিন আপিসের ফেরতা বাড়ি আসিয়া দেখিল কলেরায় স্ত্রী আক্রান্ত । পাড়ার হাতুড়ে ডাক্তারের দ্বারা সেদিন চিকিৎসা চলিল, পরদিন যখন মৃত্যু ঘনাইয়া আসিল তখন শ্বশুরবাড়ি খবর পাঠাইল; ডাক্তার সঙ্গে লইয়া যখন ভাই আসিল, তখন হরমণির ছুটি হইয়া গিয়াছে ।

চোরবাগানের ঘোষাল বাড়ির কর্ত্রী রোগ ও বৃদ্ধ বয়সে অনেক শোকের তাড়নায় ভগ্নদেহা । সংসারের সমস্ত ভার বিধবা কন্যা শঙ্করীর উপর, মাতার পরিচর্যা হইতে খুঁটিনাটি কোন কাজটি সে অন্যকে করিতে দিত না এবং তার মত সুচারুরূপে সম্পন্ন করিতে পারে এমন কর্মদক্ষ বধূও তাদের ঘরে ছিল না; যে দুটি ছিল তাহার বিবাহ অবধি সেবা পাইয়াছে বলিয়া সেবা করিতে অনভ্যস্ত ।
হরমণির মৃত্যুর পর শোকাকুলা জননীকে কথঞ্চিৎ শান্ত করিয়া শঙ্করী ভগ্নীপতির সংসার ঘাড়ে লইল । মাসীর সকল যত্ন ব্যর্থ করিয়া মাতৃদুগ্ধবঞ্চিত কোলের সন্তানটি উপযুক্ত খাদ্যাভাবে মায়ের অনুসরণ করিল । শঙ্করীরও রুগ্না মাতাকে ফেলিয়া অধিক দিন থাকিবার উপায় নাই । সে টাকার জোগাড় করিয়া অবিলম্বে কচিকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাইয়া দিল; এবং পটলা ও টুলুর তত্ত্বাবধান করিবার জন্য নীলুর এক দূরসম্পর্কীয়া গরীব আত্মীয়াকে নীলুর তরফ হইতে মাসিক ২ টাকা সাহায্য আঙ্গীকার করিয়া দেশ হইতে আনাইল । নীলু বিস্তর আপত্তি জানাইল যে সে নিজে খাইতে পায় না আবার এ এক পরের বোঝা সে কেমন করিয়া বহিবে । বরং শঙ্করী যদি টুলুকে সঙ্গে লইয়া যায়, নীলু তাহা হইলে বাড়ি বিক্রয় করিয়া পটলাকে লইয়া আপিসের কাছাকাছি মেসে গিয়া থাকে । কিন্তু এ কথায় শঙ্করী কান দিল না; এমনিইত সে পূজা আহ্ণিকেরও সময় পায় না, ভোর ৫টা হইতে রাত্রি ১১টা পর্য্যন্ত এক মুহূর্তও অবকাশ নাই, এর উপর আবার টুলিকে লইয়া গেলে ধকল ত বাড়িবেই, তাছাড়া ভ্রাতৃজায়ারাও বিশেষ সন্তুষ্ট হইবে না; ছোট মেয়ে, একটু বালসালেই মাও উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিবেন; সাত পাঁচ ভাবিয়া টুলির মুখের দিকে চাহিয়া চোখের জল সম্বরণ করিয়া শঙ্করী সেই দিনই মায়ের কাছে চলিয়া আসিল ।
আষাঢ় মাস । যেমন বৃষ্টি তেমনি ঝড় । রাস্তা ঘাট জলে ডুবিয়া গিয়াছে । কলিকাতার জনসমাকীর্ণ পথে লোক নাই, জায়গায়-জায়গায় আরোহীপূর্ণ ট্রাম চলৎশক্তিহীন অবস্থায় দাঁড়াইয়া ভিজিতেছে; সাঁতার ছাড়া ভিন্ন গম্য স্থানে পৌঁছান অসম্ভব দেখিয়া যাত্রীরা ট্রাম কোম্পানিকে গালি দিয়া যৎকিঞ্চিত স্বস্তি বোধ করিতেছে; কেহ বা কোন বছরে কোন সময়টিতে ঠিক এমনিতর বর্ষা নাবিয়াছিল তার দিন ক্ষণ লইয়া অপর একজনের সহিত তুমুল ঝগড়া বাধাইয়া তুলিয়াছে; আর একজন সেই অতীত দিনে হাওয়ার বেগে ছিন্ন ছাতাটি হাতে লইয়া পানওয়ালার চালার নীচে আশ্রয় লইয়াছিল, বৃষ্টি কম পড়িতে খানিক দূর অগ্রসর হইয়া ট্রাম ধরিয়া টিকিট কিনিতে কোমরে হাত দিয়া দেখে পয়সার গেঁজেটি নাই, সেই করুণ কাহিনী শুনাইয়া অতীত লোকসানকে বর্তমান আসর জমাইবার কাজে লাগাইতেছে ।
প্রকৃতির এই নিষ্প্রয়োজন বাড়াবাড়িতে সকলকারি কাজে একটা না একটা বাগ্ড়া পড়িয়াছে কেবল পাড়ার ডানপিঠে ছেলেগুলোর আনন্দের সীমা নাই । ঘোষালদের কিলু একখানা জলচৌকিতে বসিয়া পরমানন্দে নৌকা বাহিতেছিল, তার ছোট ভাই পানু আরো খানিক আগে মোড়ের মাথায় তারি মত সুশান্ত গুটিকতক ছেলেকে সাঁতার শিখাইতেছিল; সে দৌড়ে আসিয়া এক সময় দাদাকে খবর দিল, "ওরে পালা, পালা, নীলু পিসে গাড়ী করে আসছে, এখুনি দিদিমাকে বলে দেবে ।" কলতলায় কাদা ধুইয়া পরিত্যক্ত ধুতি কোমরে আঁটিতে আঁটিতে দুটি ভাই উপরে হাজির হইয়া দেখিল, পিসিমা ফুলুরী ভাজিতেছেন, আর নীলু পিসের আগমনবার্তা জানান হইল না ।

ঝড়ের বেগ কমিয়া গিয়াছে, বৃষ্টি ধরে-ধরে । শঙ্করী টুলুর হাত ধরিয়া একেবারে মায়ের ঘরে উপস্থিত হইল । হাঁপাইতে হাঁপাইতে একনিঃশ্বাসে বলিয়া গেল, "দেখলে মা একবার কাণ্ডখানা! বল্লে না, কইলে না, এমন দিনে মানুষে যখন কুকুর বেড়ালটা ঘরের বার করে না, হতচ্ছাড়া কি না এই এক ফোঁটা মেয়েকে লোকেদের নাচ্দরজায় নামিয়ে চলে গেল! ভাগ্যিস আজ সকাল সকাল কাপড় কাচতে গেছলুম, দেখি কলের কাছে দাঁড়িয়ে কাঁদছে, মাথা দিয়ে যেন মা গঙ্গার স্রোত বইছে; ছুটে পানুর কাপড়খানা টেনে এনে পরিয়ে এই তোমার কাছে আনছি ।"
মা । "তাত দেখতে পাচ্ছি । আমি ঘাটের মড়া, আমাকে আর জ্বালাসনে । বৌ কর্তাদের জিজ্ঞেস করে যা ব্যবস্থা হয় কর্ । হ্যাঁরে টুলি, বাপ্ কোথায় গেল?"
টুলি । "বাবা ডিল্লি, বালিতে কালা এচেচে তাই আমাকে মাচির কাছে যেতে বল্লে ।"
শঙ্করী । "শুনেছিলুম তাদের আপিস দিল্লিতে উঠে যাবে তাই বুঝি বাড়িখানা ভাড়া দিয়ে মেয়েটাকে এখানে রেখে পটলাকে নিয়ে চলে গেল । আচ্ছা বাপ্ যাহোক! সে ফেলতে পারে, আমরা ত আর হরর পেটের মেয়ে ভাসিয়ে দিতে পারি না ।
এই ছোট্ট চার বছরের মেয়েটি ঘোষাল-বাড়ির মূর্তিমতী অশান্তিস্বরূপা হইয়া দাঁড়াইল । বসত বাড়ি ভাড়া দিয়া সেই যে নীলু ডুব মারিল তা দিল্লি গেল কি মক্কায় গেল কেহ কোন খবর পাইল না ।
অল্প দিনেই বড় বউ আবিষ্কার করিয়া ফেলিল যে যেদিন হইতে এই ছোটলোকের মেয়ে তাদের ঘরে আসিয়াছে সেদিন হইতে তার ছেলেময়েগুলি আর বাগ্ মনে না । পড়াশুনো করে না, দুপুর বেলায় ঐ মা খেগো মেয়েটার সঙ্গে দস্যিবৃত্তি করিয়া বেড়ায় । এরূপ অবস্থায় এ বাড়িতে থাকা অসম্ভব । ছোট বউ বলে, খুকীর খাবার যতই সাবধানে রাখে কে ঢাকা খুলিয়া যায়, ছোট বাবুর গন্ধতৈল, এসেন্সের শিশি কে রোজ ভাঙ্গিয়া রাখিয়া দেয়; ছাদে কাপড় শুকাইতে দিলে বাছিয়া বাছিয়া দেশী কাপড়গুলির খুঁট্ কে দাঁতে করিয়া ছিঁড়িয়া দেয়; এসব অত্যাচার ঠাকুরঝির জন্যই হইয়াছে, তিনি আদরে মেয়েটার মাথা খাইতেছেন, মা কি আর কারো মরে না গো, তা বলিয়া কি সে যা খুসী করিবে? শঙ্করীর আদর মানে সে সময়মত টুলিকে ডাকিয়া দুবেলা খাওয়ায়, মামীদের অনুযোগ শুনিলেই তাকে কখনো কখনো ঘরে বন্ধ করিয়া শাস্তি দেয়, কখনো বা নানাপ্রকার সদুপদেশ দিয়া বুঝাইবার চেষ্টা করে যে মামাতো ভাই বোনেদের সহিত তার আকাশ-পাতাল প্রভেদ, তারা যত খুশী দুষ্টামি করিতে পারে কিন্তু টুলিকে এই বয়স হইতেই শিশুসুলভ চঞ্চলতা দমন করিয়া, মামাদের অনুগ্রহে যে দুবেলা পেট ভরিয়া ভাত পাইতেছে সেজন্য মামীদের নিকট সর্বদাই জোড়হাতে কৃতজ্ঞতা জানাইতে হইবে । টুলু ত সবই বোঝে! সে কখনো রাগিয়া ছোট দুটি হাতে প্রাণপণে মাসীর পিঠে কিল বর্ষণ করে, কখনো, "আমাকে মায়ের কাছে রেখে আয়, আর আমি তোদের বাড়ি থাকব না" বলিয়া হাত পা ছুঁড়িয়া কাঁদিতে থাকে ।
অনেক দিন ধরিয়া বড় বউয়ের সাধ শাশুড়ী-ননদ-হীন নিষ্কণ্টক সংসারে গৃহিণীপনা করে, পূজাবকাশে স্বামী বাড়ি আসিলে সে নানা তর্কযুক্তি দেখাইয়া স্বামীর সঙ্গে তার কর্মস্থানে চলিয়া গেল । ধনীকন্যা ছোট বউও ঘন ঘন বাপের বাড়ি যাতায়াত আরম্ভ করিল । টুলুর উপর দোষ চাপাইয়া দুই বধূ নিজের নিজের মনস্কামনা সাধিবার অবসর পাইলেন; লাভের মধ্যে সে বেচারী সকলকার চক্ষুশূল হইল ।

ভগবান যাদের কষ্ট দিয়াছেন রগড়াইয়া তাদেরও দিন কাটিয়া যায় । মামারা টুলুর বিবাহ দিয়াছে । সে যেদিন শ্বশুড়বাড়ী গেল সকলেই যেন পরিত্রাণ পাইল, যেন বাড়ির অলক্ষ্মী বিদায় হইল, কেবল শঙ্করী বিছানায় শুইয়া বুকের উপর একটি ছোট কোমল হস্তস্পর্শের অভাবে চোখের জলে বালিশ ভাসাইয়া দিল । তার নারী-হৃদয়ের সুপ্ত মাতৃত্ব টুলুর স্পর্শে জাগরিত হইয়া উঠিয়াছিল । সে তার ছোট বালিশটি বুকের উপর চাপিয়া ধরিয়া চুমা খাইতে লাগিল আর ধীরে ধীরে তার উপর হাত বুলাইতে লাগিল-যেন সে টুলুর মাথায় হাত বুলাইতেছে । ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করিয়া টুলির কত মঙ্গল কামনা করিল কিন্তু দরবারে গরীব শঙ্করীর দরখাস্ত নামঞ্জুর হইল । বিবাহের অনতিবিলম্বে ক্ষতবিক্ষতদেহা টুলুকে লইয়া তার শ্বশুর দিয়া গেল ও উঠানে দাঁড়াইয়া চীৎকার করিয়া বলিয়া গেল, "এই তোমাদের মেয়ে রইল, আবার যদি ওমুখো হয় তা হলে এটুকুও রইবে না ।"
শঙ্করী কিছু সুধাইল না । রক্তমাখা অচেতনপ্রায় বালিকাকে কোলে তুলিয়া বিছানায় শোয়াইয়া ক্ষতস্থানের রক্ত ধুইয়া জলপটি বাঁধিয়া দিল, মায়ের ঘর হইতে ওডিকলন আনিয়া মাথায় দিয়া বাতাস করিতে লাগিল । একবার কেবল মাসীর দিকে চাহিয়া টুলি বলিল, "উঃ, মাসি, বড় ব্যথা!" বলিয়াই আবার চোখ বন্ধ করিল । রাত্রে জ্বরের ঘোরে সে ভুল বকিতে লাগিল । টুলুর সৎ-শাশুড়ীকে পাড়ার সকলে ভয় করিত ও বধূ আসিলে তার পরিণাম কল্পনা করিয়া অনেক সহৃদয়ার গায়ে কাঁটা দিত । কর্তাকে গিন্নী নাকে দড়ি দিয়া ঘুরাইত, লোকে বলিত পাড়াগেঁয়ে মাগী কি ঔষধ করিয়া অত বড় ষণ্ডামর্কা পুরুষটাকে বশ করিয়াছে । বিবাহের পর টুলু বুঝিল কি খাইয়া শ্বশুর বশ্যতা স্বীকার করিয়াছে-গালি হইতে ঝাঁটা পর্য্যন্ত অভাগার কিছুই বাদ যাইত না । টুলু তার অংশ হইতে কিছু পাইলে তার ভাগ হালকা বলিয়া বৃদ্ধের কিছু আশা হইয়াছিল-কিন্তু দানে ন ক্ষয়ং যাতি, ভাগ করিয়াও বেগ কমিল না । বধূ আসার সঙ্গে সঙ্গে ঠিকে ঝি ও বাম্নীর অনাবশ্যকতা বুঝিয়া গিন্নী তাদের বিদায় দিল । রানা, বাসন-মাজা,ঘর-লেপা, জল-তোলা এইসকল সামান্য কাজ যদি বধূর দ্বারা না হইবে ত লোকে ছেলের বিবাহ দেয় কেন?-টুলুকে দম দিবার সময় শাশুড়ী জিজ্ঞাসা করিতে ভুলিত না ।
সেদিন উপরের কলে জল নাই, প্রকাণ্ড এক মাটির কলসী করিয়া জল ভরিয়া আনিতে শাশুড়ী টুলিকে হুকুম করিল এবং বিলম্ব হইতেছে বলিয়া বারাণ্ডায় দাঁড়াইয়া তার পিতার নানাপ্রকার সদগতি কামনা করিয়া যেই তাকেও যমালয়ে যাইবার পথনির্দেশ করিবে অমনি হোঁচোট খাইয়া কলসী সমেত টুলু পড়িয়া গেল । কলসী ভাঙ্গিল দেখিয়া গিন্নী ছুটিয়া আসিয়া বারকতক চুলের মুঠি ধরিয়া টুলুর মাথা সিড়িঁতে ঠুকিয়া দিল এবং লাথির উপর লাথি মারিয়া তাকে একতলা অবধি গড়াইয়া দিল । টুলুর চীৎকারে শ্বশুর আসিলে তাকে মামার বাড়ি রাখিয়া আসিতে হুকুম করিল । হুকুম তামিল করিতে সে বিলম্ব করিল না ।
আজ সকলে ভুলিয়া গেল যে টুলি তাদের কত অপ্রিয় ছিল । ছোটবাবু স্বয়ং সর্বোৎকৃষ্ট ডাক্তার লইয়া আসিল ও নিজের হাতে ঔষধ পান করাইতে লাগিল । ছোট বৌ খুকীকে ঘুম পাড়াইয়া শঙ্করীর হাতের পাখা কাড়িয়া লইয়া বাতাস দিতে লাগিল, টুলুর শয্যাপার্শ্বে মাদুর বিছাইয়া শঙ্করীকে শুইতে কত অনুরোধ করিল কিন্তু শঙ্করী টুলুর হাতখানি চাপিয়া ধরিয়া পাষাণ-মূর্তির মত তার দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল ।
তবু এবারও বিধাতার দয়া হইল না-টুলু বাঁচিয়া উঠিল । সংসারে যার স্থান এত সঙ্কীর্ণ যে পাশ ফিরিবারও জায়গা হয় না, তারই সেই অতি দুঃখের জায়গাটুকু খালি হইতে চায় না ।

মাধুরীলতা দেবী

 


( ‘সবুজপত্র’ শ্রাবণ ১৩২২ )

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।