"হ্যাঁরে, বোদে, এখনো যে বড় পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস-আপিস যেতে
হবে না?"
"হবে না মনে করেই একটু গড়াচ্ছি|"
"গড়াচ্ছি! বলতে লজ্জা করে না! আমি
বু-আমি এই বয়-আমি-আমি তোর দাদা হয়ে কখনো এত বেলা অবধি গড়াই
দেখেছিস?"
"তোমার যে দাদা দিন দিন বয়স কমছে
আর আমার বাড়ছে কাজেই তুমি এখন যত ভোরে উঠতে পার আমি কি তা
পারি? তাছাড়া আজ শরীর তেমন ভাল নেই, কেমন গা মাটি মাটি করছে|"
"গা মাটি মাটি করছে| আমার যেদিন গা মাটি
মাটি করে আমি কি বেরোই না?"
"তোমার বেরলেই বা কষ্ট কি? উকীলগুলো বকে মরে তুমি বসে
ঝিমোও; তার পরে যা খুশী একটা রায় দিয়ে বিচারের শ্রাদ্ধ কর|"
"যাঃ, আর বাঁদরামী করতে হবে না;
কাজটা যদি হাতছাড়া হয়, আমি ঘরে বসিয়ে তোমার পেট ভরাতে পারব
না| যা দিন কাল পড়েছে সংসার চালানো ভার, এত যে উপায় করছি কোথায়
ধুলোর মত উড়ে যাচ্ছে চোখেও দেখতে পাই না|"
"বাস্তবিক! তার উপর আবার এই লড়ায়ের
হাঙ্গামে এসেন্স, সাবান, পাউডার, কলপ প্রভৃতি বিলাতী সৌখিন
জিনিষগুলোর এমন অসম্ভব দাম চড়ে গেছে, আমি ত ভেবেই পাই না দাদা
কি করে নিত্যি নতুন জোগাড় করছ!"
"কি বল্লি রে ছোঁড়া! কলপ? কলপ? কবে
আমাকে কলপ লাগাতে দেখেছিস্? যত বড় না মুখ তত বড় কথা! ওরে জগুয়া,
গাঁঠ গুলোয় ভাল করে তেল ডলে দেত|"
জগু| হাঁ বাবু, তাই ত দিচ্ছি| এই পুরুবিয়া হাওয়া লাগলে বুড্ঢা
লোগ্কো বদন্ হাঁত সব দুখতা| সে হামি জানে|"
"নাঃ, এরা আমাকে বাড়িছাড়া করলে দেখছি!
আমার গায়ে ব্যথা হয়েছে এ কথা তোকে কে বল্লে রে ব্যাটা? আমার
চিরকাল ভাল করে তেল মাখা অভ্যেস| যা, স্নানের ঘরে গরম জল রেখে
আয়|"
"এই গরমে গরম জল? ওহো, বুঝেছি, সেদিন
নবীন বাবু বলে গেল যে গরম জলে নাইলে গায়ের চামড়া কুঁচকে যায়
না, তাই বুঝি দাদা আজকাল গরম জলে চান কর?"
"তাই বুঝি দাদা গরম জলে চান কর!
বেশ করি ! খুব করি! তোর তাতে কি? ভাল চাস্ ত খাটিয়া ছেড়ে উঠে
যা! সারারাত এই ছাতে পড়ে থাকিস বলেই ত সকাল বেলায় গা মাটি
মাটি করে|"
"এত তাড়া কিসের? তুমি যতক্ষণে চান
করে বেরোবে আমার তার মধ্যে দশবার চান করা ভাত খাওয়া অবধি সারা
হয়ে যাবে|"
ন মরে বাল্কাকা মায় ন মরে বুঢ়উকা জোয়
গিরিজাসুন্দরীর মৃত্যুতে এই প্রবাদ বচনটি
খাটিয়া গেল; শিশু কন্যা কালীতারা ও প্রৌঢ় স্বামী হরপ্রসাদ
দুজনেই সমভাবে তার অভাব অনুভব করিল| কালীর তিন দিদিই বিবাহিতা,
তারা কেহই ছেলেপুলেভরা সংসারে তাকে স্থান দিয়া আর ঝঞ্ঝাট বাড়াইতে
রাজি হইল না| তখন হরপ্রসাদ ভাবিল বোদেটার বিবাহ দিলে সব গোল
চোকে, আমি টাকা চাই না, দেখতে শুনতে ভাল একটি গৃহস্থের মেয়ে
আনব, সে আমাদের সবাইকে টেনে করবে| টাকা চাই না, সুন্দর মেয়ের
আর অভাব কি! উপযুক্ত পাত্রীর সন্ধান পাইয়া হরপ্রসাদ কাহাকেও
কিছু না বলিয়া দেখিতে গেল; বোদের আর বিবাহ হইল না - দশম বর্ষীয়া
বালিকা সুরসুন্দরী কালীতারার জননীর পদ গ্রহণ করিল|
সুরো মেয়েটি বড় লক্ষ্মী; সে অকপট চিত্তে
ভক্তির সহিত বাপের বয়সী স্বামীর সেবা করিত| বামুন ঠাকুর ডাক
দিতে না দিতে সে পানটি ছেঁচিয়া গম্ভীর ভাবে সামনে বসিয়া পাকা
গিন্নিটির মত এটা খাও, ওটা খেলে না কেন, আজ বুঝি রান্না ভাল
হয় নাই, ঝালের মাছটায় কাঁচা হলুদের গন্ধ বেরোচ্ছে ইত্যাদি
নানাপ্রকার মন্তব্য প্রকাশ করিয়া ব্যন্ননের বাটিগুলি হাতের
কাছে সরাইয়া দিত| অপরাহ্ণে ফল ছাড়াইয়া, বেদানার রস ছাঁকিয়া,
মিষ্টান্ন সাজাইয়া ভৃত্যের হাতে স্বামীর জলযোগের জন্য পাঠাইয়া
দিত| আদালত-ফেরৎ হরপ্রসাদের ঘর্মাক্ত কাপড়গুলি বাতাসে দিয়া
কাচা কাপড়, মুখ ধুইবার জল হাতে হাতে জোগাইয়া দিত আর সন্ধ্যাবেলায়
কালীর সহিত বাজি রাখিয়া পাকা চুল তুলিত| বোতাম বসাইতে অল্পস্বল্প
মেরামতের কাজে সুরো কদাচ আলস্য করিত না| তার ছোট বুদ্ধিটিতে
যা ভাল বুঝিত খুশি মনে পালন করিত| পশ্চিমী বাঙালীর মেয়ে লজ্জা
সরমের বড় ধার ধারিত না; স্বামীকে দেখিলে বারো আনা পিঠ খুলিয়া
ষোল আনা মুখ ঢাকিবার জন্য ঘোমটা টানা কর্তব্য, সুরো সে শিক্ষা
পায় নাই| শিশু বয়সেই তার বাপ মা মরিয়াছে; বড় ভাইয়ের ঘরে সর্বদা
পরিজনহিতরতা, অক্লান্তকর্মিণী, মিষ্টভাষিণী ভাইবউকেই সে আদর্শ
বলিয়া জানিত এবং যতদূর সম্ভব তাহার উপদেশ মত চলিতে চেষ্টা
করিত|
সুরোর যৌবন বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে হরপ্রসাদেরও
এক অদ্ভুত যৌবনশ্রী ফুটিয়া উঠিল; তার কাঁচাপাকা চুলগুলি প্রথমে
কটা ক্রমে একেবারে কালো হইয়া গেল; সে দাড়ি গোঁফ ফেলিয়া দিল
এবং রাত থাকিতে উঠিয়া রোজ ক্ষৌর করিতে লাগিল; তার টোলখাওয়া
গাল দুটি দাঁতের চাড়া পাইয়া সামলাইয়া উঠিল আর তার বেশভূষার
পারিপাট্য দেখিয়া বোদে হাসিয়া অস্থির হইল| সুরোকে আর পান ছেঁচিতে
হয় না, দাঁতেরব্যাথা সেরে গেছে আমার লক্ষীকে আর কষ্ট করে পান
ছেঁচতে হবে না বলিয়া হরপ্রসাদ সুরোর চিবুক ধরিয়া আদর করিত|
কালী বা সুরোকে মাথায় হাত দিতে দেয় না, বলে, যেদিন মাথা ধরবে
টিপে দিও, শুধু শুধু হাতে তেল লাগিয়ে লাভ নেই| ছাতের এক কোণে
টিনে ঘেরা নূতন তৈরি স্নানের ঘর হরপ্রসাদ কয়খানা সাবান নিঃশেষ
করিয়া ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাইতে সে রহস্য ভেদ করিতে কাহারো
সাহস কুলায় নাই-বেদেরও না| পুরাতন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হইলে
সে কেমন একটা সঙ্কোচ বোধ করে, তাহারাও হরপ্রসাদকে চিনিতে পারে
না, এবং বুড়ো বয়সে নাৎনীর যোগ্য মেয়েকে বিবাহ করিলে ভীমরতি
কি ভীম আকার ধারণ করে আঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া হরপ্রসাদের দিকে
দেখাইয়া দেয়| একমাত্র নব্য উকীল মহলে ডেপুটি হরপ্রসাদের খাতির
ধরে না| নলিন চৌধুরীর কাধে হাত দিয়া সেই ছোকরার দলে পরিবেষ্টিত
হইয়া সে বুঝিতেই পারে না লোকে তাহাকে দেখিয়া হাসে কেন?
২
ছুটির
দিনটা পূর্ণ মাত্রায় রসালাপে যাপন করিবার পাছে কোন ব্যাঘাত
ঘটে সেই জন্য হরপ্রসাদ নিজের গ্রামসম্পর্কীয়া এক মাসীর খোঁজ
লইতে বোদের সহিত কালীকে প্রত্যেক রবিবারে পাঠাইয়া দিত| দুই
এক রবিবার পার হইলে ব্যাপার বুঝিতে বোদের বাকি রহিল না; দাদার
উপর তুষ্ট থাকিলে একেবারে সন্ধ্যা কাবার করিয়া ফিরিত আবার
কখনো তফাতে গাড়ী রাখিয়া আচমকা আসিয়া একতরফা প্রেমালাপে বাধা
দিয়া দাদার অভিশাপ অর্জন করিত|
সুরো ভাঁড়ার ঘরে তোলা উনানে মিষ্টান্ন
প্রস্তুত করিতে ব্যস্ত, এমন সময় মস্ত একগাছা বেলফুলের গোড়ে
মালা লইয়া হরপ্রসাদ ডাকিল, "সুরো, ও সুরো, দেখ তোমার
জন্যে কি এনেছি|"
সুরো| "কি গা?"
হর| "কি গা!' আহা, প্রাণ ঠাণ্ডা
করে দিলে! সেদিন না বল্লুম যে নলিনের বউ 'ভাই' বলে সাড়া দেয়?"
সুরো| "সে দেয় দিগ্গে| কি এনেছ দেখি!
ওঃ, ফুলের মালা! একটু জল আছড়া দিয়ে রেখে দাও না কাল অবধি গন্ধ
থাকবে|"
হর| "আচ্ছা, সুরো, তোমায় না মানা
করেছি গরমে উনুন-তাতে বসে কিছু কোরো না, তোমার কষ্ট হয় মনে
করলে ওসব আমার মুখে রোচে না, তার চেয়ে আমি বেশী খুসী হই যদি
তুমি এখন ওসব ফেলে সেদিনকার সেই ঢাকাই কাপড়খানি পরে দেখাও;
কিনে দিলুম তা একবার পরলেও না| এত অছেদ্দা কর কেন?"
সুরো| "কি মুস্কিল! ছিঁড়ে যাবে বলে
ঘরে পরি না, তার জন্যে এত রাগ? তুমি যাও না আমি এইগুলো সেরে
এই এলুম বলে|"
হর| "এলুম, এলুম, কর্তে কর্তে বোদেরাও
এসে পড়বে|"
সুরো| "তা আসুক না, বেশ ত|"
হর| "অত তর্ক না করে ওঠই না| এই
গজু! জগুয়া রে! এদিকে আয়! শীগ্গির বাম্নাকে ডেকে দে, তাকে
কি করতে রাখা হয়েছে যে মা-জীকে গরমে খাবার তৌরি করতে হবে!
যা, চট করে আসতে বল|"
চাকরদের সম্মুখে স্বামীর অতিরিক্ত আগ্রহ প্রকাশ হইবার ভয়ে
সুরো তাড়াতাড়ি পাচককে নিজের স্থান ছাড়িয়া দিল| অনেকদিন পর্য্যন্ত
সে মনে মনে অনুভব করিতেছে যে হরপ্রসাদ বেতনভোগী ভৃত্য হইতে
আরম্ভ করিয়া বন্ধুবান্ধব সকলকার কাছেই নিজেকে হাস্যাস্পদ করিয়া
তুলিতেছে, আর সে কাহার জন্য? তারই জন্যই ত এই বৃদ্ধটি যুবকের
বেশে সময় নাই অসময় নাই লোক-আনাগোনার রাস্তায়, যেখানে -সেখানে
তার হাত চাপিয়া ধরে, মাথার কাপড় টানিয়া খুলিয়া দেয়, গায়ে এসেন্স
ঢালিয়া দেয়- এই সেদিন ঠাকুরপো দেখিতে পাইয়া তবে না সকালে অত
ঠাট্টা করিল! কি করিয়া বুঝাইবে যে সে পুরাতন স্বামীর সেবা
করিয়া যত তৃপ্ত হইত এই নূতন স্বামীর সেবা তার মনে তেমন প্রীতি
সঞ্চার করে না! হরপ্রসাদের কথাবর্তা, আদর, ভালবাসা সবই তার
মনে হয় যেন কার কাছে ধার করা, এ সব ছিব্লামী তার স্বামীর যোগ্য
নয় এ কথা কে তাঁকে বলিবে? তার রূপের, তার নবপ্রস্ফুট যৌবনের
অর্ঘ্য লইয়া সে তাঁকে দেবতা জানিয়া পূজা দেয় তবে কেন তিনি
নিজেকে পরের কথা শুনিয়া তাহার চোখে খাটো করিতে চেষ্টা করিতেছেন?
সে পরটি যে কে তাহাও সুরো বেশ জানিত ও বড় রাগ হইলে তার মুণ্ডপাত
করিত-অবশ্য মনে মনে|
কত কথাই আজ বলিতে স্থির করিয়া সুরো আস্তে
আস্তে হরপ্রসাদের কাছে আসিয়া দ্মাড়াইল, কিন্তু সে এক গাল হাসিয়া,
মালা ছড়াটি তার গলায় পরাইয়া হাত ধরিয়া যখন কাছে টানিয়া লইল,
সুরো মাথা হেঁট করিয়া অঞ্চলের প্রান্ত খুঁটিতে লাগিল, যা বলিতে
আসিল কিছুই বলিতে পারিল না|
হর| "সুরো, প্রাণ আমার, তুমি ফুল
ভালবাস বলে আমি কত দূর থেকে নিজে গিয়ে ফুলের মালাটি আনলুম
আর তুমি আমাকে তার বদলে কিছু দিলে না ভাই?"
সুরো| "কি চাও? পাখার বাতাস দেব?
গরম হচ্ছে?"
হর| "আঃ! ঐ এক কথাতে সব মাটি করে
দিলে! এত করে মনে মনে সব জপ্তে জপ্তে এলুম ভণ্ডুল হয়ে গেল!
পাখার বাতাস কি আমি চেয়ে ছিলুম? নলিনের বউ বলে, 'প্রাণনাথ'-"
সুরো| "সে যা খুসী বলুক, ও সব আমার
ভাল লাগে না|"
হর| "কেন তোমার ভাল লাগে না ভাই?
আমার ত বেশ লাগে| কি বলছিলুম, ঐ নলিনের বউ বলে, 'প্রাণনাথ!
হৃদয়েশ্বর!'-"
সুরো| "দেখ, কাল থেকে তুমি আর নলিনের
বাড়ি যেও না, সত্যি সত্যি যদি ওর বউ ও সব ছাইভস্ম বলত তাহলে
কি ও তোমার সামনে সে কথা বলতে পারত? তোমাকে নিয়ে তামাসা করে
বোঝ না? নাও, ছাড় কে এসে পড়্বে!"
হর| "আসে আসুক! ভাল কথা| কি বলছিলুম,
হ্যাঁ, তুমি নলিনের উপর এত চট কেন? সে তোমার কত খবর নেয়, সেইত
বলে দিলে ফুলের মালা নিয়ে এসে তোমায় পরিয়ে দিতে; সেদিনকার
কাপড় খানা সেই ত পসন্দ করে কেনালে; তাকে দিয়েই ত তোমার তেল
এসেন্স আতর সব আনাই; আমাকে দেখ না, যেদিন থেকে ওর সঙ্গে মিশ্ছি
আমার যেন ২০ বছর-এই বলছিলুম যে আমার-আমার-বুঝলে কি না- বড়
ভাল ছেলে ও| সুরো, আমার আঁধার ঘরের আলো-"
সুরো| "ও কথাটাও কি নলিন তার বৌকে
বলে?"
হর| "আ্যঁ ! আযঁ ! তার বৌকে| কে
বল্লে তোমাকে?"
সুরো| "যেই বলুক না কেন, অন্যের
কাছে শেখা বুলি আমার উপর ঝেড়ে আর আমাকে লজ্জা দিও না|"
হর| "ছি সুরো! ভাব করতে গেলুম কেঁদে
ফেল্লে! আচ্ছা, ওটা আর বলব না-হল? লক্ষ্মী সোনা আমার-মাইরি
বলছি ভাই এ কথাটা কেউ শিখিয়ে দেয় নি-অত দূরে সরে যেয়ো না,
আমি কি বাঘ না শোর যে তোমাকে খেয়ে ফেলব!"
সুরো| "হ্যাঁ গা, সেদিন যে বল্লে
যে এবার ছুটিতে গয়া কাশী দেখিয়ে আনবে তার কি হল?"
হর| "বাপ্রে! ঐ চাঁদমুখ কি আমি দেশ
বিদেশে নিয়ে ঘুরতে পারি তাহলে দ্বিতীয় সীতা হরণ হয়ে যাবে|"
সুরো| "কেন, তুমিও দশানন বধ করে
সীতাকে ফিরিয়ে আনবে!"
হর| "আর কি ভাই, সেদিন-ওর নাম কি-আর
কি সে জোর-কি বলেছিলুম ভাল-আর কি সে যুগ আছে, এখন ঘোর কলি!
বধ করতে গেলেই নিজেও সঙ্গে সঙ্গে বধ হতে হয়| অত ব্যস্ত কেন?
নাতী পুতী হোক্ তারা তীর্থ ধর্ম্ম করাবে|"
সুরো| "ঐ বুঝি ঠাকুরপো এল! যাই কালীকে
খেতে দিগে, অনেক দেরী হল|"
হর| "আঃ! বসই না, যাবে এখন, আমার
কাছ থেকে পালাতে পারলেই বাঁচ| আঃ জ্বালালে দেখছি! বোদেটা উপরে
আসছে বুঝি!"
গলার মালা খুলিয়া সুরো সরিয়া বসিতেই বোদে
দরজার কাছে হাঁকিল, দাদা!"
হর| "দাদা! কি বল্ না ছাই!"
বোদে| "মেজাজ এত গরম কেন? আচ্ছা
দাদা, এতকাল ত আমরা কেউ জানতুমও না যে এই বিদেশে আবার এক মাসী
আছে, তুমি হঠাৎ কোত্থেকে খবর পেলে? এক কাজ কর না, আমরাই বা
গাড়ী ভাড়া করে অতদূর যাই কেন তার চেয়ে মাসীকে কাছে রাখলেই
ত তুমি সব সময় তাঁর তত্ত্বাবধান করতে পার| সেই হলেই বেশ হয়,
বৌদি কি বল?"
হর| "বৌদি কি বল! কিসে বেশ হয় আমাকে
আর শেখাতে হবে না| যা, কালীকে বল খাবারের জায়গা করতে, ক্ষিদে
পেয়েছে|"
বোদে| "মালাটা আমি নিয়ে চল্লুম|"
হর| "প্রাণ ঠাণ্ডা করে দিলে!"
৩
কালীতারার
বিবাহ হইয়া সে শ্বশুরবাড়ি গিয়াছে| কলিকাতার বাইরে একখানি বাড়ি
কিনিয়া পেন্সনপ্রাপ্ত হরপ্রসাদ সপরিবারে থাকে| এইবার স্ত্রীর
নেশা ছুটিয়া তাকে বাড়ির নেশায় ধরিয়াছে; ঘরে ঘরে পাথর বসাইতে
হইবে, দক্ষিণের বারাণ্ডাটা বাড়াইতে হইবে, জানালাগুলো বড় করা
দরকার, কোথায় সস্তাদরে মর্বেল, কাঠ কাঠরা বিক্রয় হইতেছে স্নান
নাই আহার নাই রৌদ্রের তাপে সে সারা সহর হাঁটকাইয়া বেড়ায়| এখন
সে বেশ দস্তুরমত বৃদ্ধ-নলিন তার ঘাড় হইতে নামিতেই সেও অল্পে
অল্পে নিজেকে বৃদ্ধ বলিয়া জাহির করিতে আপত্তি করিল না এমন
কি আবশ্যক সময় ভিন্ন দাঁত জোড়াটির পর্য্যন্ত খবর লয় না|
এই পূর্ণমাত্রায় বৃদ্ধ স্বামীটিকে পাইয়া এতদিনে সুরো প্রাণ
খুলিয়া স্নেহ প্রস্রবণ ঢালিয়া দিতে পারিল| সন্তানহীনার সমস্ত
পুঞ্জীভূত সন্তানস্নেহ অপরিমিত ধারায় হরপ্রসাদের উপর পতিত
হইল| সে এক দণ্ড স্বামীকে চোখের আড়াল করিতে চায় না| কোনো কাজে
কোন দিন বাড়ি ফিরিতে দেরি হইলে সে বোদেকে মোড়ের কাছে দাঁড়
করাইয়া একবার ঘর একবার বারাণ্ডায় ছটফট করিয়া বেড়ায়, যতই বোদে
সন্ত্বনা দেয় যে দাদাকে ছেলেধরায় ধরে নাই নিশ্চয়ই, সে আশ্বাসবাক্য
সুরো কানেও তোলে না| হরপ্রসাদের আর বেশভূষায় দৃষ্টি নাই কিন্তু
সুরো ছাড়ে না, তাঁতিনী নিজে সুন্দর সুন্দর পাড়ের কাপড় বাছিয়া
রাখে; শীতকালের উপযুক্ত নানারঙের পশমের টুপি, মোজা, গেঞ্জি,
গলাবন্ধ বুনিয়া রাখে ও সেগুলি পরাইয়া স্বামীকে কেমন মানাইয়াছে,
বারম্বার কোন না কোন ছুতা করিয়া বাইরে গিয়া দেখিয়া আসিত| ছোট
বৌ ঠাট্টা করে যে দিদি বড় ঠাকুরের টাকের বাকি দুগাছি চুল আঁচড়ানোর
চোটে আর টিকিতে দিবে না| নিদ্রিত স্বামীর গায়ে হাত দিয়া মস্তক
আঘ্রাণ করিয়া তার সমস্ত দেহ পুলকিত হইত| অযাচিতভাবে দিনের
মধ্যে যখন-তখন হরপ্রসাদের পাশে দাঁড়াইয়া গায়ে হাত বুলাইতে
থাকে, নয় তো মাথার কোন চুলটি স্থানচ্যুত হইযাছে সেটি ঠিক করিয়া
দেয়, কোঁচা পায়ে জড়াইয়া পড়িয়া যাইবে বলিয়া তুলিয়া ধরিতে বলে|
বোদে স্ত্রীকে বলে যে দাদা আগে বৌদির পায়ের ধূলো নিত কিনা
তাই বৌদি এখন মাথায় হাত দিয়ে দাদাকে আশির্বাদ করে| যে যাই
বলে সুরো গ্রাহ্য করে না, সে তার বৃদ্ধ স্বামীটিকে শিশুর মত
চোখে চোখে রাখে| খাওয়ায়, পরায়, কখনো আবার অবাধ্যতা করিলে মৃদু
ভরৎসনাও করে| একদিন হরপ্রসাদ যুবক সাজিয়া লোকের নিকট হাস্যাস্পদ
হইয়া স্রীকে আঘাত করিয়াছিল| আজ সেই স্ত্রী দুগ্ধপোষ্য শিশুর
মত ব্যবহার করিয়া তাকে আরো কত হাস্যভাজন করিয়া তুলিতেছে এ
কথা সুরোর সম্মুখে কেহ আঁচেও বলিলে সে মহা খাপ্পা হইয়া উঠিত|
হরপ্রসাদও যে মধ্যে মধ্যে বিদ্রোহ না
করিত তা নয়| স্ত্রী যে কাজ করিতে বারণ করিত বিশেষ করিয়া সেইটেই
করিয়া সে আপনার পৌরুষাভিমান প্রচার করিত| সুরো কি তাকে কচি
খোকা পাইয়াছে! সব কথায় কি তাকে স্ত্রীর অনুমতি লইতে হইবে!
সময় সময় সুরোরও চেতনা হইত, ভাবিত, একি করিতেছি, আমি স্বামীর
অধীনে থাকিব তা না তাঁকে নিজের অধীনে আনিতে চাই, আবার ভাবে,
কই না, অধীনে ত আনিতে চাই না, আমি কি চাই তা ত নিজেই বুঝিতে
পারি না| বোধ হয় কিছুই চাই না, শুধু নিজের সর্ব্বস্ব দান করিয়া,
দুই হাতে তাঁর আশীর্বাদ ভরিয়া লইয়া, জন্ম জন্ম তাঁকে পতিরূপে
পাইবার জন্য ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করিতে চাই|
দেখিতে দেখিতে কয়েক বছর কাটিল| এ বছরে
বসন্তের মহামারী পাড়ায় পাড়ায় দেখা দিয়াছে| হরপ্রসাদের মনে
বসন্তের এমনি ভয় ঢুকিল যে গায়ে একজায়গায় মশাকামড়ের দাগ লাগিলে
সাতবার করিয়া সে ডাক্তার ডাকিয়া পরীক্ষা করাইত| একদিন রাত্রে
সুরোর কপালে কি একটা দাগ দেখিয়া সমস্ত রাত আলাদা বিছানায় সে
কাটাইল|
এমন সময় একদিন সর্ব্বাঙ্গে ব্যাথা করিয়া সুরোর জ্বর আসিল|
বোদে হরপ্রসাদকে লুকাইয়া তেতালায় চিলের ছাদের ঘরে সুরোর জন্যে
জায়গা করিয়া দিল| সেখানে তার সর্ব্বাঙ্গ ভরিয়া বসন্ত দেখা
দিল| বোদে হরপ্রসাদকে বলিল, পটলডাঙ্গায় তার বিধবা বোনটির বড়
অসুখ, বৌদিদি তাঁকে দেখতে গিয়েচেন, কিছুদিন দেরি হবে|
হরপ্রসাদের এমনি অবস্থা স্ত্রী নহিলে
সে এক পা নড়িতে পারে না| যতই সুরো সুরো করিয়া সে ব্যস্ত হয়,
খাবার সামনে লইয়া সুরোর অনুপস্থিতিতে যতই খুঁৎ খুঁৎ করে, কই
ছুটিয়া কেহ ত আসে না| হৃদয়ের ভিতরটা অসুখ ও বিরক্তিতে ভরিয়া
ভরিয়া উঠে| হরপ্রসাদ একবার পটলডাঙ্গায় গিয়া স্ত্রীর খোঁজ লইবে
মনে করিল কিন্তু সে পাড়ায় বসন্তের প্রকোপ বেশি শুনিয়া সাহস
হইল না|
এদিকে বোদে পুরাতন ভৃত্য জগুয়ার উপর দাদার
ভার দিয়া বৌদিদির সেবায় নিযুক্ত হইল| না ছিল তার ভয়, না ছিল
ঘৃণা| আহার নিদ্রা ছাড়িয়া সুরোর বিছানার পাশে বসিয়া কি করিয়া
তার একটু যন্ত্রণার উপশম হইবে তারই উপায় বাহির করিত| সুরো
বোদেকে নিবৃত্ত করিতে অনেক চেষ্টা করিয়াছিল কিন্তু বোদে শুনিল
না বলিয়াই সুরো প্রাণে বাঁচিল| অমন প্রাণের সঙ্গে শুশ্রূষা
করিবার লোক তার আর কেহ ছিল না|
সুরো ত বাঁচিল কিন্তু তার দিকে চাহিয়া
বোদের চোখে জল আসিল| আহা অমন লক্ষ্মীর প্রতিমা, তার এ কি পরিবর্তন!
দেখিলে যেন চেনা যায় না| সুরোও প্রথম দিন আপন চেহারা দেখিয়া
মৃত্যুই শ্রেয় ভাবিয়াছিল| কিন্তু পরক্ষণেই ভাবিল মরণ হইলে
তার স্বামীর দশা কি হইবে! আহা না জানি এতদিন তিনি কত কষ্টই
পাইয়াছেন! আজ একবার ঠাকুরপোকে বলিব তাঁকে সঙ্গে করিয়া আনিতে|
একবার দেখিয়া প্রাণ ঠাণ্ডা করি!
বোদে হরপ্রসাদকে ডাকিল, দাদা, চল, তোমাকে
বৌদিদির কাছে নিয়ে যাই|
হর| কোথায়?
বোদে| উপরের ঘরে আছেন|
হর| না, যাব না|
বোদে| সে কি কথা, যাবে না কেন?
হর| আমি যাব কেন? সে কি আসতে পারে না?
বোদে| তাঁর বড় অসুখ করেছিল, এখনো কাহিল
আছেন|
হর| মিছে কথা| একদিনের জন্যে তার ত অসুখ
করতে শুনিনি|
বোদে| তোমার গা ছুঁয়ে বলচি, তাঁর অসুখ
করেছিল, তুমি ভাববে বলে বলিনি|
হর| যা, যা, আর মিছে বলতে হবে না| আমি
কি আর বুঝিনে! ইদানীং তার কি আর কাজে মন ছিল? খাওয়াতেও আসত
না, তেল মাখিয়েও দিত না-জগুর হাতে পড়ে আমার প্রাণ বেরিয়ে যাচ্চে
তবু তার মনে একটু ব্যথা লাগে না| আমি ওর সঙ্গে আর কথা বলব
না|
এই ক'দিন যে কাজের অনিয়ম হইয়াছিল হরপ্রসাদের
পীড়িত কল্পনায় তাহা সুদীর্ঘ হইয়া উঠিয়াছিল| তাহার মনে হইতেছিল
যেন নমাস ছমাস ধরিয়াই এই রকম ব্যাপারটা ঘটিতেছে|
বোদে যত অনুনয় করে হরপ্রসাদের গোঁ ততই
বাড়িতে থাকে| বোদে বৌদিদিকে আসিয়া বলিল, দাদা রাগ করিয়া আছেন|
বারান্দায় বসিয়া হরপ্রসাদ অপ্রসন্ন মনে
তামাক খাইতেছিল| অমন সময় সামনের রাস্তা দিয়া হরিবোল শব্দে
মড়া লইয়া গেল| কাল রাত্রি হইতে পাড়ায় ঘোষেদের বাড়ি হইতে কান্নার
রব উঠিতেছিল| সকাল হইতে কিছুক্ষণের জন্য থামিয়াছিল আবার জাগিয়া
উঠিল| হরপ্রসাদের সর্ব্বাঙ্গে কাঁটা দিয়া উঠিল|
এমন সময় শীর্ণ মলিন সুরো ধীরে ধীরে পাশে
আসিয়া তার কাঁধের উপর হাত রাখিল|
হরপ্রসাদ চমকিয়া তার মুখের দিকে চাহিল|
এ কে? এ যে ব্যাধি মূর্তিমতী| এ যে মৃত্যুর দূতী! বোদে, বোদে!
আমার ঘরে এ কে ঢুকল রে? সরে যা! সরে যা! সুরো! সুরো! আমার
সুরো কোথায় গেল
(
'সবুজপত্র' , আষাঢ়, ১৩২২ )