প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

                  
নিয়তি
মানিক ভট্টাচার্য

       [ লেখক পরিচিতি : শিক্ষাব্রতী ও সাহিত্যিক মানিক ভট্টাচার্যের জন্ম ১২৯৫ বঙ্গাব্দে নদীয়ার রানাঘাটে| তার শিক্ষাগত ডিগ্রি ছিল বি.এ, বি.টি| প্রধান শিক্ষকের কাজও করেছেন তিনি, তবে তার পরিচিতি ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্প লেখক হিসাবে| তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় বাংলার বাইরে বিহারের মজঃফরপুর, ভাগলপুর ইত্যাদি স্থানে কাটিয়েছেন| তিনি যে লেখক গোষ্ঠির ঘণিষ্ঠ ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি, নিরূপমা দেবী, অনুপমা দেবী প্রভৃতির নাম| তার বহু লেখায় মধ্যবিত্ত মানুষে আবেগই ছিল প্রধান উপজীব্য| তার আদর্শ ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়| প্রভাতকুমার তার লেখার উচ্চ প্রশংসা করেছেন| মানিক ভট্টাচার্যের বহু লেখা ‘ভারতবর্ষ’, ‘বঙ্গবাণী’, ‘মানসী ও মর্ম্মবাণী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে| নিজের লেখা ছাড়াও মানিক টলস্টয়ের রচনা অনুবাদ করেছেন|

       মানিক ভট্টাচার্যের কিছু উল্লেখযোগ্য ছোট গল্প - মার্জ্জনা, নিয়তি, শাঁখারী প্রভৃতি| রচিত গ্রন্থ - চির পরাধীন (১৯২০), পাথরের দাম (১৯২৩), অপূর্ণ (১৯২৪), অশ্রুনির্ঝর (১৯২৫), প্রশান্ত (১৯২৫), প্রেমের মূল্য (১৯২৭), অদৃষ্টের কেহেলা (১৯৩০), স্বয়ম্বরা (১৯৩৩), স্মৃতির মূল্য (১৯৩৪), মিলন (১৯৩৯), বধু (১৯৪০) ইত্যাদি|

       অনেক সমালোচকের দৃষ্টিতে মানিকের রচনায় কোনো স্বাতন্ত্র ফুটে ওঠে নি| প্রাচীন মূল্যবোধের ও রক্ষণশীল মানসিকতার পৃষ্ঠপোষকতা করায় তার লেখায় কোন আধুনিকতা স্থান পায় নি| তার লেখক জীবনের পরিসর তুলনামূলক ভাবে অল্প| স্বেচ্ছায় লেখনী চালনা বন্ধ করেন তিনি| ১৩৭২ বঙ্গাব্দের ১০ই চৈত্র তার মৃত্যু হয়| ]
                                                                         দীপক সেনগুপ্ত।


     রামটহল বন্দুক স্কন্ধে করিয়া ট্রেজারির সম্মুখে পরিমিত পদক্ষেপের সহিত পাহারা দিতেছিল আর আপন অদৃষ্টের কথা ভাবিতেছিল|

      রামটহল আওরঙ্গাবাদের ট্রেজারি গার্ড| ছাপরা জেলার একটা পল্লীতে তাহার বাড়ি| কিন্তু ছয়বৎসর হইতে সে একরকম ঘর ছাড়া বলিলেই হয়| আগে সে স্ত্রীকে লইয়াই থাকিত| যেখানে গিয়াছে স্ত্রীকে লইয়াই কত হোলি দুজনে একত্রে কাটাইয়াছে, কতদেশে ঘুরিয়াছে| সরকারের চাকুরীও তো তাহার কম দিন হয় নাই| যখন ২২ বৎসরের জোয়ান সেই সময় চাকুরীতে ঢুকিয়াছে আর এখন বয়স হইতে চলিল ৫২ বৎসর| আর কয়েকটা বৎসর কাটাইতে পারিলেই পেনসন মিলিবে| কিন্তু পেনসন মিলিলেই বা কি? সে তো বাড়ি গিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিতে পারিবে না| বাড়ি গেলেই তাহার ভয় হয়| সেই ভয়ের একটু গোপন ইতিহাস আছে|

      রামটহল স্ত্রীকে লইয়াই বরাবর থাকিত| বিবাহ হইয়াছিল তাহার বহু আগে - তখন তাহার বয়স ছিল ৯, আর তাহার স্ত্রী পার্ব্বতীর বয়স ১০/১১ না হইলেও ৯ এর নীচে তো নয়ই| তবে হাঁ, গঁওনা হইয়াছিল কিছু পরে| অন্ততঃ ৪/৫ বৎসর পরে| ২৪ বৎসর বয়সেই তাহার বাবুজী ও মা দুজনেই হঠাৎ প্লেগে মারা গেলে সে স্ত্রীকে আসিয়া লইয়া যায় এবং সেই হইতেই সঙ্গে সঙ্গে রাখে|

      সন্তান না হওয়ার জন্য তাহার মনে মনে একটা গভীর দুঃখ| দুজনেরই বয়স যখন প্রায় ৩৫ বছর তখনও পর্য্যন্ত তারা নিঃসন্তান| তাহার পর যখন সে গয়ায়, সেই সময়ে সে জানিল পার্ব্বতীর সন্তান হইবে| গয়াজী যে সারা ভারতের মধ্যে সব চেয়ে বড় তীর্থ সে বিষয়ে সেই হইতে আর কোন সন্দেহ ছিল না-আজিও নাই| সন্তানসম্ভবা শুনিবামাত্র রামটহল আনন্দে অধীর হইয়াছিল এবং সেই দিন হইতে সে স্ত্রীকে কোন প্রকার কঠিন কাজ করিতে দিত না| সহরে সহরে ঘুরিয়া এইটুকু তাহার জ্ঞান জন্মিয়াছিল যে, এরূপ অবস্থায় কাহাকেও অধিক পরিশ্রম করিতে দিতে নাই, পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়াইতে হয় ও প্রফুল্ল রাখিতে হয়| এই তিনটি করিবার জন্যই সে বিধিমত সচেষ্ট থাকিত| এমন কি পারতপক্ষে সে স্ত্রীকে রাঁধিতে পর্য্যন্ত দিত না এবং নিজে লোটা বর্ত্তন মলিত-চৌকা দিত| পার্ব্বতী প্রথমটা স্বামীর এই কাণ্ড দেখিয়া হাসিত - আদরটা কয়েকদিন ভালও লাগিয়াছিল| কিন্তু যখন শেষে দেখিল যে তাহার স্বামী তাহাকে বড়লোকের গৃহিণীর মত স্থবির করিয়া রাখিতে চায় তখন সে বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়া বসিল| দাম্পত্য কলহও ঘটিল, কিন্তু পার্ব্বতী বেশ বুঝাইয়া দিল যে, যদিও তাহার অধিক বয়সে সন্তান হইতেছে তথাপি সেজন্য তাহাকে কাঠের পুতুলের মত করিয়া রাখিবার দরকার নাই| পার্ব্বতী আরও বলিল, সে তাহার শ্বাশুড়ির মুখেও শুনিয়াছে যে, যাহা রহে ও সহে তাহাই ভাল, বেশী বাড়াবাড়ি কোন ক্ষেত্রেই ভাল কর্ত্তব্য নহে| যদিও রামটহল অনেক বুঝিয়াছিল যে, তাহার ইহাতে কি অসুবিধা - ভবিষ্যতে যখন ছেলে জন্মগ্রহণ করিবে তখন তো পার্ব্বতীর কাজ বাড়িয়া যাইবে| সেই জন্যই এ কয়দিন একটু বিশ্রাম দেওয়া দরকার| আর তাহার নিজের কাজ বাড়িবার কোন সম্ভাবনাই নাই| শুধু একটা বন্দুক ঘাড়ে করিয়া কয় হাত জায়গায় ঘুরিয়া বেড়ান তো - সে একটা শিশুও পারে| কাজেই বাকী সামর্থ্য ও সময়টা সে কি করে - একটা কাজ তো চাই তাই সে পার্ব্বতীকে সাহায্য করিতে আসে|

      পার্ব্বতীর স্বামীর অদ্ভুত যুক্তি শুনিয়া-মুখে কাপড় দিয়া হাসিত| মেয়ে মানুষ হইয়া দুধের বাটিতে চুমুক দিতে সে ভয়ঙ্কর আপত্তি করিত; কিন্তু রামটহল বিজ্ঞের মত তাহাকে বুঝাইত যে, ও দুধ তো তাহার জন্য নহে গর্ভস্থ সন্তানের জন্য| সে আবার আসিয়া যথেষ্ট পরিমাণে দুধ পায় তাহার ব্যবস্থা তো করিয়া রাখিতে হইবে| তুলসীদাসের রামায়ণ হইতে পড়িয়া স্ত্রীকে শুনাইত যে, স্বয়ং রামচন্দ্রজী সীতাজীকে গর্ভবস্থায় কত আদর করিতেন|

      এবিম্বধ বাদ প্রতিবাদের মধ্যে পার্ব্বতী গয়াতেই একটি পুত্র প্রসব করিল; রামটহল পুত্র মুখ দেখিয়া আনন্দে উন্মত্তপ্রায় হইয়া উঠিল| বন্ধু বান্ধবকে বেশ করিয়া খাওয়াইল| পাড়ায় পাড়ায় প্রসাদ বিলাইল| এই সব কারণে দোকানে তাহার কয়েক টাকা ধারও হইয়া গিয়াছিল| তাহা হইলেও রামটহল দুঃখিত হইল না | গয়ায় জন্মিয়াছিল তাই রামটহল ছেলের নাম গদাধর রাখিয়াছিল| সে মাঝে মাঝে কাগজের উপর বাবু গদাধর মিশ্র লিখিয়া নিজে দেখিত ও পার্ব্বতীকে দেখাইত এবং নামটা যে কি চমৎকার কাগজের উপর মানায় তাহাও দুজনে দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছিল| ভাগ্যে অন্য কোন বাজে নাম না রাখিয়া ঠিক যে নামে তাহাকে মানাইবে সেই নামটাই রাখিয়াছিল| গদাধর হাঁটিতে শিখিবার বহু আগে সে ঠিক করিয়া রাখিয়াছিল যে, গদাধরকে যেন বন্দুক ধরিয়া পাহারা দিতে না হয় | অমন ছেলের কানে কলম যেমন মানায় কাঁধে বন্দুক হইলে তাহার সিকিও মানায় না| তাহাকে যে ইংরাজী লেখা পড়া শিখাইতে হইবে তাহা সে একেবারে ঠিক করিয়া রাখিল| গদাধর কথা বলিবার আগেই তাহার পড়িবার বই কিনিয়া আনিয়া হাজির করিল এবং পাঁচ বৎসরে পড়িতেই তাহাকে একটা শুভদিন দেখিয়া গুরু অর্থাৎ পাঠশালায় হাজির করিয়া দিল| তাহার প্রকাণ্ড গোঁফ নাড়িয়া গুরুকে বুঝাইয়া দিল যেন এই ছেলের গায়ে হাত না তোলে এবং হাত না তোলার জন্য সে মাসে মাহিয়ানাটা ডবল করিয়া দিবে|

      গদাধরের জন্মের পর হইতেই রামটহল বড় ধার্ম্মিক হইয়া পড়িয়াছিল| সাধু দেখিলেই সে সেবা করিত| অতিরিক্ত সেবা দেখিয়া পার্ব্বতী যখন খরচের কথাটা তুলিত সে বলিত এসব গদাধরের কল্যাণে - তাহার দীর্ঘজীবনের জন্য সে করিতেছে| বোতল বোতল ওষুধে যে কাজ না হয়, ভাল সাধুর পায়ের এক আধ মুঠা ধূলা পাইলেই তার চেয়ে দশগুন কাজ করে| এসব তথ্য দেশের লোক ভুলিয়া যাইতেছে তাইতো দেশের এত অকল্যাণ| যাহা হউক এই অকল্যাণ যাহাতে তাহার সংসারে প্রবেশ না করে সে বিষয়ে রামটহলের যত্নের পরিসীমা ছিল না| গদাধরের বয়স বৎসর নয় দশ হইতেই রানটহল তাহাকে ইংরাজী স্কুলে নাম লিখাইয়া দিল|

      এই সময়ে হঠাৎ রামটহল অদ্ভুতভাবে পরিবর্তিত হইয়া গেল| কয়েকদিন রামটহল বড়ই উন্মনা হইয়া রহিল| কাহারও সহিত বড় একটা কথা কয় না, ছেলেকে আদর করে না, পার্ব্বতীর সঙ্গে ছেলের ভবিষৎ নিয়ে পরামর্শ করে না| রামটহলের এই আকস্মিক পরিবর্তনের পার্ব্বতী কোন কারণ খুঁজিয়া পাইল না, জিজ্ঞাসা করিয়াও উত্তর মিলিল না|

      মেয়ে মানুষের মন - প্রথমটা পার্ব্বতীর সন্দেহ হইল স্বামীর মনটা আর কোথাও ধরা পড়ে নাই তো| যদি এ বয়সে বড় একটা তাহা ঘটে না - তবুও পুরুষতো, বিশ্বাস কি? পার্ব্বতী লক্ষ্য করিয়া তাহার কোন চিহ্ণ দেখিতে পাইল না| কাজ শেষ হইলে সে ঘরে আসিয়া বসিত আর বিশেষ কাজ ছাড়া বাহির হইত না| রাত্রে ডিউটি পড়িলে বাহিরে থাকিত নচেৎ সেই ছোট ঘরখানায় বসিয়া গোস্বামীজীর বইটা লইয়া বিষণ্ণমুখে মাথা দোলাইয়া পড়িয়া যইত| রামটহলের ক্ষুধা কমিয়া গেল| পার্ব্বতীর সন্দেহ তবে কি সন্ন্যাসী হইয়া যাইবে - যে সাধু সন্ন্যাসীর উপর টান! কিন্তু আপাততঃ তাহারও কোন লক্ষণ দেখিল না| পার্ব্বতীর ভরসা হইল কিন্তু প্রতিকারের কোন পথ খুঁজিয়া পাইল না| এই ভাব লক্ষ্য করিবার পরেই রামটহল ম্লানমুখে বলিল সে আরঙ্গাবাদে বদলি হইয়াছে| পরশুই যাইতে হইবে| পার্ব্বতী বলিল জিনিষপত্র সব গুছাইয়া লই| কিন্তু রামটহল তখন অদ্ভুত কথা বলিয়া বসিল; সেখানে সে একাই যাইবে| সহরের ভিতর সে একটা চালা ঘর ভাড়া করিয়াছে, সেখানে পার্ব্বতী গদাধরকে লইয়া থাকিবে; কারণ আরঙ্গাবাদে এখানকার মত বড় স্কুল নাই; ছোট স্কুল - ইংরাজীতে তাহাকে মাইনর স্কুল বলে, তার মানেই ছোট স্কুল|
কথাটা এইটুকু সত্য যে, সে সময় আরঙ্গাবাদে মাইনর স্কুলই ছিল বটে| কিন্তু মাইনর স্কুলে পড়িতে গদাধরের কোন ব্যাঘাত ঘটিত না| পার্ব্বতী কিন্তু অতশত বুঝিল না| তবু সে বলিল, না থাক ভাল স্কুল তবু তাহারা যাইবে| সেই স্কুলেই যেটুকু জ্ঞান হয়-সেই ভালো| তার ছেলে তো সত্যিকার হাকিম হইবে না| কথাটায় বড়ই মর্ম্মাহত হইল| যে ছেলেকে কত আশা করিয়া মানুষ করিতেছে তাহার সম্বন্ধে এসব কথা সে সহ্য করিতে পারিত না| সে পার্ব্বতীকে বুঝাইল মানুষ কিসের থেকে কি হয় কেহই বলিতে পারে না| না জানিয়া শুনিয়া ও রকম একটা কথা ফস করিয়া বলিয়া বসিতে নাই| তাহাতে লাভ তো হয় হয়ই না, উপরন্তু ক্ষতির আশঙ্কা থাকেই| রামটহল আরও বুঝাইল যে এখানে স্কুলের কর্ত্তাদের কৃপায় গদাধর বিনা বেতনে পড়িতে পাইতেছে| সেখানে তাহা পারিবে কি না কে বলিতে পারে| না পারিবার কথাই ধরিয়া রাখিতে হয়| তাহার পর রামটহল একটা মোটামুটি স্কুলের বেতন ধরিয়া দিল যে, ইংরাজী স্কুলে ছেলে ৭/৮ বৎসর পড়িবে তাহাতে খালি স্কুলের বেতনই অনুমান আড়াই শত টাকা লাগিবে আর সে টাকাটা এখানে থাকিলে বাঁচিয়া যাইবে| আর খরচের কথা - এখানে থাকিলে লাগিবে ওখানেও লাগিবে| তা বলিয়া ছেলের যাহাতে মঙ্গল হয় তাহা করিতে হইবে|

       একে তো এই সব যুক্তি, তারপর রামটহল অনেক দিন পর স্ত্রীর সহিত এতগুলি কথা এক সঙ্গে কহিল| পার্ব্বতী যুক্তি সম্পূর্ণ না বুঝিলেও আর আপত্তি করিল না, খালি চোখের জল ফেলিয়া নিরস্ত হইল|

       তারপর যথাসময়ে পার্ব্বতী ও গদাধরকে নূতন বাসায় আনিয়া তাহাদের সব ব্যবস্থা করিয়া দিয়া ক্রন্দনরতা পত্নী ও ক্রদনোদ্যত পুত্রকে শান্ত করিবার একটু বিফল চেষ্টা করিয়া রামটহল নিজের লোটা কম্বল ও একটা কেরোসিনের বাক্স লইয়া দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া ম্লানমুখে আরঙ্গাবাদের দিকে যাত্রা করিল|

       বাহিরে আসিয়া রামটহলের চোখ দুটায় যে অশ্রু বাণ বহিয়াছিল আর বুকটার ভিতর যে তোলপাড় করিতেছিল তাহার এক কণাও যদি পার্ব্বতী দেখিত ও বুঝিতে পারিত তাহা হইলে কিছুতেই স্বামীকে একা ছাড়িয়া দিত না|
পার্ব্বতী তবু এ খবরটা জানিত না, যে স্বামী ইচ্ছা করিয়া এই বদলি করাইয়াছে; জানিলে কি করিত বলা যায় না|

       ছয় বৎসর সে আরঙ্গাবাদে আছে| তাহার স্বভাব মাধুর্য্যে ও সরলতায় সবাই তাহার উপর প্রীত, সেজন্য তাহার বদলির সময় হইলেও বদলি হয় নাই| এই কয় বৎসরের মধ্যে রামটহল বৎসরে দুইবার করিয়া বাড়ি গিয়াছে, কিন্তু ২/৪ দিনের বেশী কিছুতেই থাকে নাই| যে সময়টা থাকিত সে সময়টাও যেন একটু ভয়ে ভয়ে থাকিত| পার্ব্বতী চক্ষুতে এ ভাবটা এড়ায় নাই| কিন্তু এ ভয়টা কিসের তাহ সে বুঝিতে পারিত না| একবার ভাবিত স্বামী হয় তো কোন অন্যায় কাজ করিয়া ফেলিয়াছে| তার জন্য হয় তো ভয়ে-ভয়ে থাকে যদি দৈবাৎ ধরা পড়ে যায়| কখনও বা ভাবে স্বামীর কোন কারণে মস্তিষ্ক-বিকৃতি ঘটিতেছে| অনেক বার জিজ্ঞাসা করিয়াছে কেন সে এরূপ হইয়া গেল| সে নিজে কি কোন রমটহলের কাছে কোন দোষ করিয়াছে - যদি করিয়াই থাকে তাহা হইলেও কি মার্জনা নাই| আর মার্জনাই যদি না থাকে তাহা হইলে শাস্তি দিলেই তো মিটিয়া যায়| যদিও সে উপযুক্ত ছেলের মা হইয়াছে তথাপি যদি রামটহল এখনও তাহাকে ধরিয়া মারে তাহা হইলেও সে কিছু বলে না - রাগও করেন না| কেন না আগেরকার দিনগুলা তাহার বেশ মনে পড়ে|
বেশী করিয়া যখন গদাধর গর্ভে ছিল ও পরে সে যখন ভূমিষ্ঠ হইয়াছিল সেই সময়কার আদর যত্ন ও ভালোবাসর কথা পার্ব্বতী চিতায় যইবার আগে ভুলিতে পারিবে না| এই সব কথা ভাবিতে ও বলিতে সে কাঁদিয়া ফেলিত| রামটহলও ওকথা শুনিয়া বড়ই কাতর হইত| কিন্তু সে নিজের ব্যবহারের কথাটা বলি বলি করিয়াও বলিতে পারিত না| কিসের একটা বোঝা তাহার মনে পাথরের মত বসিয়া আছে তাহা তুলিয়া ফেলিবার ধৈর্য্য বুঝি অসম্ভব|

      যে ছেলের জন্মের সময় তাহার কত আনন্দ, যাহার পড়িবার ক্ষমতা হইবার কত আগে সে ছেলের জন্য বই যোগাড় করিতে গিয়া কত লোকের উপহাসাস্পদ হইয়াছে, সে ছেলে কত বই সারা করিয়া পাশ দিতে চলিল তবু স্বামীর তাহার উপর আগেকার টান ফিরিয়া আসিল না, ইহা ভাবিয়া পার্ব্বতী নীরবে চোখের জল ফেলিত, আর তাহার অদৃষ্টের দোষ দিত| অদৃষ্টের দোষ নইলে অমন স্বামীর মন ভঙিয়া যায়| কিন্তু সে কোথায় যে তাহার দোষ তাহা ভাবিয়া কিছুতেই ঠিক করিতে পারিল না| পুত্রের মুখের পানে ভাল করিয়া চাহিতে তাহার লজ্জা করিত, যদি সেও ভাবে তাহার মায়ের কোন দোষেই তাহার পিতার মন এমন বদলাইয়া গিয়াছে| এক একবার সে ভাবিত যা হইবে হউক সে ছেলের হাত ধরিয়া স্বামীর কাছে গিয়া উঠিবে| তাহার সব থাকিতে সে কেন এমন বঞ্চিত হইয়া থাকিবে| কিন্তু সাত পাঁচ ভাবিয়া সে কল্পনাকে সে কাজে পরিণত করিতে পারিত না|

      গদাধরকে কোন কথা না বলিলেও সে এটা বুঝিত, যে তাহাদের তিনজনের মধ্যে কোন খানটায় একটা গোল বাধিয়াছে| মা ও বাবা দুজনকেই সে ভালরূপে জানিত, কেহ যে ইচ্ছা করিয়া কাহারও উপরে কোন দুর্ব্যবহারে করেন নাই তাহা সে বুঝিত| কিন্তু তবু গোল যে একটা কোথাও আছে তাহাতে তো কোন সন্দেহ নাই|

      তাহার পরীক্ষা আসিল| ভাল করিয়া পরীক্ষা দিয়া পিতাকে লিখিল যে, এবার তো তাহার পরীক্ষা শেষ হইয়া গিয়াছে, এখন আর সেখানে কোন কাজ নাই| যদি তাঁহার অনুমতি হয় সে মাকে লইয়া আরঙ্গাবাদ আসে|

      ফেরৎ ডাকে জবাব আসিল - এমন কাজ যেন এখন কিছুতেই না করা হয়| আরঙ্গাবাদে প্লেগ এখন দেখা দিয়াছে - এ সময়টা কাটিয়া যাক; তাহার পর সুবিধা বুঝলেই সে নিজে গিয়া সবাইকে আনিবে ইত্যাদি|

     পার্ব্বতীর আশা করিয়াছিল যে, উপযুক্ত পুত্র যখন লিখিয়াছে তখন আর অমত হইবে না| যখন দেখিল ইহাতেও কোন ফল হইল না তখন পার্ব্বতী একেবারে মুসড়িয়া পড়িল| গদাধরের তরুণ প্রাণে বড়ই আঘাত লাগিল|
যথা সময়ে গদাধরের পাশের সংবাদ বাহির হইল| গদাধর তখন মনে মনে একটা মতলব আঁটিল| মাকেও সেকথা জানাইল না|

      চৈত্রের শেষ| বিহারের বায়ু এ সময় বাংলার মত সুধু উতলা নয একেবারে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠে| সমস্ত দুপুরটা ঝড় বহিয়া গিয়াছে| সন্ধ্যার পরও মনে হইতেছে যেন মাটির নীচ হইতে এমন গরম শ্বাস বাহির হইতেছে| সমস্ত মাটি যেন অন্ধকার মুড়ি দিয়া অসহ্য গ্রীষ্মে স্তব্ধ হইয়া আছে| রামটহল একা আঃ বা উঃ কোন প্রকার শব্দ না করিয়া শুধু নিয়মমত বন্দুক হাতে পদচারণা করিতেছে|

     রাত্রি ১০টা বাজে| রামটহলের হঠাৎ মনে হইল পাশের দিকে যেন কাহার পদশব্দ হইল| গুলি করিবার জন্য সে কান পাতিয়া রহিল| হাঁ পায়ের আওয়াজ বটে তো| সে সত্য সত্যই হাঁকিল-হুকুমদার অর্থাৎ Who comes there (কে আসে?)

      কোন উত্তর নাই| দ্বিতীয় বার তীব্রস্বরে সে হাঁকিল - হুকুমদার| মূর্ত্তি বেশ স্থির - একটু খানি সময় দাঁড়াইল কিন্তু কোন উত্তর আসিল না|

     তৃতীয়বার সে হাঁকিল - হুকুমদার, উত্তর না আসিতে সঙ্গে সঙ্গে সম্মুখস্থ লোকের পদ লক্ষ্য করিয়া সে বন্দুক ছুড়িল| মূর্ত্তি যেন ঠিক সেই মুহুর্ত্তেই একটু আগে জানু পাতিয়া যাইতে ছিল| তখন সে বন্দুক ছুটিয়া গিয়াছে|

     বন্দুক সশব্দে ছুটিল| সঙ্গে সঙ্গে একটা ভারী দ্রব্য পতনের শব্দ হইল|

     আলো লইয়া রামটহল ছুটিয়া আসিল| যাহা দেখিল তাহাতে তাহার চক্ষু স্থির হইয়া গেল| এ সে কি করিয়াছে| চোর ভাবিয়া কাহাকে সে মারিয়াছে| এ যে তাঁহরই একমাত্র পুত্র গদাধর|

     বন্দুক ফেলিয়া দিয়া একটা আর্তনাদ করিয়া সে মৃতপুত্রের বুকে লুটাইয়া পড়িল|

      সরকার হইতে তাহার কর্ত্তব্যপ্রিয়তার জন্য পুরস্কার ঘোষণা হইয়া গেল| পুত্রের রক্তে হস্ত কলঙ্কিত করিয়া সেই হস্তে কি আর বন্দুক ধরা যায়?

       চাকুরী ছাড়িয়া দিয়া সে নত নেত্রে অপরাধীর মত পার্ব্বতীর সম্মুখে দাঁড়াইল| কাঁদিতে কাঁদিতে সব কথা তাহাকে বলিল| ইহাও বলিল যে এত করিয়াও সে নিয়তির লেখা খণ্ডন করিতে পারিল না| এক সাধু তাহাকে বলিয়াছিলেন তাহার পুত্র তাহার নিজের হাতে মরিবে| সেই আশঙ্কায় সে এত কাল এত কষ্ট সহ্য করিয়াও পুত্রকে ও পত্নীকে দূরে রাখিয়া আপনি একা দূরে পড়িয়া ছিল; পাছে ঘটনাচক্রে রাগের ঝোঁকে বা ভুলের বশে কি ঘটিয়া যায়|
কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না| সেই মানুষ করা একমাত্র পুত্র - এত গুণের পুত্র - পিতার হাতেই প্রাণ দিল|
নিয়তি এমনই কঠিন|

( ‘বঙ্গবাণী’ মাসিক পত্রিকা, জ্যৈষ্ঠ ১৩৩২ )।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।