বড়দিনের ছুটিতে পকেটে ষ্টেথস্স্কোপ ও হাতে ব্যাগ লইয়া চৌভাঘায়
মামাবাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইয়াছিলাম । মামী-মাকে প্রণাম করিয়া
কেবল দাঁড়াইয়াছি , এমন সময় একটি ছেলে আসিয়া কহিল , "আপনাকে
ডাকছে ।"
মামাবাড়ীতে মাঝে মাঝে আসিতাম , দুই-এক জন বন্ধুবান্ধবও জুটিয়াছিল
, তাহাদেরই কেহ সম্ভাষণ জানাইতে আসিয়াছে ভাবিয়া তাড়াতাড়ি বাহিরে
আসিলাম । একটি বৃদ্ধ ভদ্রলোক বারান্দায় দাঁড়াইয়াছিলেন , আমাকে
দেখিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন , "আপনি ডাক্তার ?"
কহিলাম , "হ্যাঁ , কেন বলুন তো ?"
বৃদ্ধ কহিলেন , "ভালই হয়েছে । আপনাকে পাল্কী থেকে নামতে
দেখেই ছুটে এসেছি । একটু যেতে হবে । গরীব মানুষ দয়া না করলে
- " কোথায় যাইতে হইবে , কাহার অসুখ , সে কথা আর জিজ্ঞাসা
করিলাম না , ষ্টেথস্স্কোপটি পকেটে ফেলিয়া ভদ্রলোকের সঙ্গ ধরিলাম
। মিনিট পনেরো পর বাঁশের ঝোপে ঘেরা একখানি একচালা ঘরের আঙ্গিনায়
গিয়া দাঁড়াইলাম । ঘরের দরজায় একটি যুবক গামছা কোমরে জড়াইয়া
দাঁড়াইয়া ছিল , ডাকিল , " ভিতরে আসুন ।" কোমরে গামছা
জড়ান মানুষ দেখিয়াই বুঝিলাম যে , সম্ভবতঃ রোগীর আর ডাক্তার
দেখাইবার বেশি দিন প্রয়োজন হইবে না ।
ঘরে ঢুকিলাম । ঘরের কোণে বাঁশের মাচার উপরে একটি বৃদ্ধা শুইয়াছিলেন
। বুঝিলাম , ইহারই রোগ আরোগ্য করিবার জন্য আমি আসিয়াছি । রোগিণীর
পাশে বসিয়া নাড়ী পরীক্ষা করিতেছি , এমন সময় বৃদ্ধা হাত টানিয়া
লইয়া কহিলেন , " ও ছাই দেখে হবে কি ! হাত দেখতে পার ?"
বলিয়া দক্ষিণ করতল প্রসারিত করিয়া আমার হাতের উপর রাখিলেন
। আশ্চর্য্য হইয়া যুবকটির দিকে চাহিলাম । সে একটু মুচকি হাসিয়া
আমার কানের কাছে মুখ লইয়া ইংরেজীতে কয়েকটি কথা ফিস ফিস করিয়া
কহিয়া গেল ।
ব্যাপারটা কতক বুঝিলাম । মৃত্যু-পথযাত্রীর নিকট মিথ্যা কথা
কহিবার প্রবৃত্তি ছিল না , তথাপি পরিহাস করিবার চিরন্তন স্বভাবটি
পরিত্যাগ করিতে পারিলাম না ; কহিলাম , " একটু একটু পারি
বৈ কি ?"
বৃদ্ধার চোখ দুটি অকস্মাৎ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল , " তবে
দেখ তো ভাই , অদেষ্টে তীত্থ আছে কি না ?" বলিয়া কাতর
উৎসুক দৃষ্টিতে বৃদ্ধা আমার দিকে চাহিলেন । কি বলিতে হইবে
যুবকটির কথার আঁচে আমি পূর্ব্বেই বুঝিয়াছিলাম ; বৃদ্ধার করতলের
দিকে ক্ষণকাল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাহিয়া বিস্ময়ের ভাণ করিয়া কহিলাম
, " উঃ ! বিস্তর তীর্থ দেখছি !" বৃদ্ধার মুখখানি
প্রসন্ন হইয়া উঠিল , আমার ডান হাতখানি মুঠা করিয়া ধরিয়া তিনি
কহিলেন , " মিছে কথা বল্ছিস নে তো ভাই ?" অসঙ্কোচে
কহিলাম , " মোটেই না , হাতের চার দিকেই তীর্থ , তবে সব
দরজা বন্ধ বলে যেতে পারেন নি । এইবার দরজা খুলবে ।" মনে
মনে করিলাম , " দক্ষিণ দুয়ার ।" আগ্রহভরে রোগিণী
বালিশে ভর দিয়া উঠিতে চেষ্টা করিয়া পড়িয়া গেলেন । আমি কহিলাম
, "ব্যস্ত হলে তো হবে না , সেরে উঠুন আগে ।" বৃদ্ধা
চোখ না মেলিয়াই কহিলেন , " ধনে পুত্রে লক্ষীশ্বর হও ভাই
।" তারপর নীরবে তার ডান হাতখানি তুলিলেন , বুঝিলাম আশীর্ব্বাদ
করিলেন ।
পরিচর্য্যা , ও পথ্য সম্বন্ধে যুবকটিকে দুই একটি উপদেশ দিয়া
বৃদ্ধ ভদ্রলোকটির সহিত বাহির হইয়া আসিলাম ।
পথে আসিতে আসিতে আমার সঙ্গীর কাছে বৃদ্ধার জীবনের কাহিনী শুনিলাম
। বৃদ্ধার নাম দাখি ঠাকুরাণী । ভাল নাম দক্ষজা , অথবা দাক্ষায়ণী
, - যে কোনটি হইতে পারে । দাখিঠাকুরাণীর বিবাহ হইয়াছিল সাত
বৎসর বয়সে এবং বৎসর না ঘুরিতেই বিধবা হইয়াছিলেন । সে বহুদিনের
কথা । তারপর এই সত্তর বৎসর কাল দাখিঠাকুরাণী তাঁহার স্বামীর
বাস্তুভিটায় একখানা একচালা ঘর ও কাঠা দেড়েক জমির সুপারীর বাগানখানি
আশ্রয় করিয়া কাটাইয়াছেন । অনাহূত যৌবন দাখিঠাকুরাণীর দেহকেও
আক্রমণ করিয়াছিল , সেই সঙ্গে সঙ্গে কিশোর যুবক ও প্রৌঢ় নানা
বয়সের নর-সৈনিকেরাও অভিযান শুরু করিয়াছিলেন । কিন্তু একটি
শীর্ষহীন সম্মার্জ্জনীর সহায়ে দাখিঠাকুরাণী তাহাদিগকে পরাজিত
করিয়াছিলেন । সেই সঙ্গে মাথা নেড়া করিয়া ও স্বহস্তে ডালের
কাটা দিয়া মুখখানিকে ক্ষত বিক্ষত করিয়া , কাঁচা তেঁতুল খাইয়া
সমস্ত দিন পানাপুকুরে স্নান করিয়া জ্বর ডাকিয়া আনিয়া যৌবনকেও
প্রতিহত করিবার নিষ্ফল চেষ্টা করিয়াছিলেন ।
দাখিঠাকুরাণীর শেষ অবলম্বন
বৃদ্ধ অন্ধ শাশুড়ী একদিন প্রাতঃকালে সজ্ঞানে গঙ্গালাভ করিলেন
; তখনও যৌবন সগৌরবে দাখিঠাকুরাণীর দেহে রাজত্ব করিতেছিল ।
ঠাকুরাণী অত্যন্ত কাঁদিলেন এবং বুড়া ঘোষাল মহাশয়ের কাছে গিয়া
কাঁদিয়া জানাইলেন যে , তাঁহাকে তীর্থে রাখিয়া আসা হোক । একক
তীর্থবাসের বয়স হয় নাই বলিয়া মাতব্বর ঘোষাল মহাশয় তাঁহাকে
নিরস্ত করিলেন । সে আজ পঞ্চাশ বৎসর আগেকার কথা । সেই দিন হইতে
আজ পর্যন্ত প্রত্যহ দাখিঠাকুরাণী তীর্থযাত্রী , তীর্থবাস ও
তীর্থমৃত্যু কামনা করিয়া আসিতে ছিলেন । শেষে এমন অবস্থা হইযাছিল
যে গ্রামের কেহ তীর্থ করিতে গেলে তাহাকে শ্বশুরবাড়ী যাইতেছি
এবং শ্বশুরবাড়ী না থাকিলে কোন কল্পিত কুটুম্ববাড়ীর নাম করিয়া
বাহির হইতে হইত । নতুবা দাখিঠাকুরাণীর উপদ্রবের অন্ত থাকিত
না । তিনি আহারনিদ্রা ত্যাগ করিয়া তীর্থকামীর দরজায় ধরনা দিয়া
পড়িয়া থাকিতেন । এ জন্য দুর্ভোগও তাঁহাকে কম ভুগিতে হয় নাই
। গত বৎসর বৃন্দাবন ঠাকুর চৈত্র মাসে তীর্থে লইয়া যাইবেন আশ্বাস
দিলেন । ঠাকুরাণী ত বৈশাখ হইতে আরম্ভ করিয়া চৈত্র হইতে বৃন্দাবন
ঠাকুরের পত্নীর সেবা , গোয়াল পরিষ্কার , কাঁথা সেলাই , নারায়ণের
ভোগ পাক ইত্যাদি বিচিত্র কাজ অম্লান বদনে করিয়া গেলেন । চৈত্র
মাসের তেইশে তারিখে বৃন্দাবন ঠাকুর পাঁজি খুলিয়া চক্ষু কপালে
তুলিয়া কহিলেন , " রামঃ ! অকাল দেখছি যে , তীর্থ ত নেই
এ বছর !" সেই দিন বাড়ী আসিয়া দাখিঠাকুরাণী শয্যা লইলেন
এবং মাস খানেকের মধ্যে বিছানা ছাড়িয়া উঠিলেন না । তাহার পরেই
এই ব্যাধি । এই পর্যন্ত বলিয়াই বৃদ্ধ হাসিয়া কহিলেন , "
তীর্থ-ব্যাধি আর কি !" কেন জানি না আমি হাসিতে পারিলাম
না । পরদিন আবার ডাক আসিল । মামীমা কহিলেন , " ঐ তেত্থ-পাগল
বুড়ীর কাছে যাচ্ছিস্ আবার ! জ্বালিয়ে মারবে যে ।"
বুড়ীর প্রতি একটু মমতা জন্মিয়াছিল , মামীর কথা কানে তুলিলাম
না ।
গিয়া দেখিলাম দাখিঠাকুরাণী উঠিয়া বসিয়া বেড়ায় ঠেস দিয়া ভিজান
সাগু খাইতেছেন । আশ্চর্য্য হইলাম । এ রোগী একদিনে উঠিয়া বসিতে
পারে একথা কল্পনাও করি নাই । খুশী হইয়া কহিলাম , " যা
হোক্ । উঠে বসেছেন ।"
দাখিঠাকুরাণী হাসিয়া কহিলেন , " তীত্থে যেতে হবে তো ভাই
। শুয়ে থাকলে কে সঙ্গে নেবে , তাই প্রসারিত গঙ্গা , আমার মত
লক্ষ লক্ষ ডাক্তার আর দাখিঠাকুরাণীর মত কোটি কোটি তীর্থকামী
। এ সব কথা বলিয়া আর বুড়িকে ব্যাকুল করিবার ইচ্ছা হইল না ।
অসঙ্কোচে কহিলাম , " সে অবিশ্যি দেখব দিদিমা , তীর্থে
যাবার সময় খবর দেবেন ।"
" - তা দেব বৈকি ভাই - " বলিয়া দাখিঠাকুরাণী আমার
মাথায় হাত দিয়া কহিলেন , " আমার বুকের পাষাণ নেমে গেল
দাদা , এমন কথা আর কেউ বলেনি ।"
নীরবে প্রণাম করিয়া বিদায় লইলাম । প্রাঙ্গণে নামিয়া শুনিলাম
দাখিঠাকুরাণী কহিতেছেন, "মনস্কাম পূর্ণ কর হরিঠাকুর ।
নারায়ণ । তারকব্রহ্ম।" তারপর নারায়ণের সমস্ত নামগুলিই
আবৃত্তি করিতে আরম্ভ করিলেন , আমি শুনিয়া হাসিলাম । আমি নারায়ণ
হইলে এতক্ষণে যে দাখিঠাকুরাণীকে নিশ্চয়ই সর্ব্বতীর্থ দর্শন
করাইয়া আনিতাম তাহাতে সন্দেহ ছিল না ।
২
যাহা হোক , নারায়ণ দাখিঠাকুরাণীর প্রার্থনা শুনিলেন , বুড়ীর
মনস্কাম পূর্ণ হইল । মামীমা লিখিলেন যে , তাঁহার স্বামীর বসত
ভিটাখানি বাদে আর সমস্ত ঘর দরজা তৈজসপত্র লেপকাঁথা ইত্যাদি
সিকি মূল্যে বেচিয়া দাখিঠাকুরাণী একদল তীর্থযাত্রীর সঙ্গ লইয়াছেন
। শুনিয়া অত্যন্ত সুখি হইলাম ।
তখন প্রয়াগের কাছাকাছি একটা জায়গায় বসন্ত ও বিসূচিকা রোগের
প্রতিকারের উপায় সম্বন্ধে বড় বক্তৃতা করিয়া ফিরিতেছিলাম ।
প্রয়াগে কুম্ভ মেলা আরম্ভ হইয়াছে , মহামারীর অত্যন্ত প্রাদুর্ভাব
; সরকার বাহাদুর অজ্ঞ জনসাধারণকে সতর্ক করিবার জন্য আমাকে
পাঠাইয়াছেন । অবকাশ আদৌ ছিল না । এই সময় দশটি বিভিন্ন পোষ্টাপিসের
ছাপ খাইয়া একখানি খামের চিঠি আসিয়া পৌঁছিল । পড়িলাম - দাখিঠাকুরাণী
প্রয়াগে তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে লিখিয়াছেন । শেষের দিকে কোথাও
মরিলে হাড় ক'খানি গঙ্গায় দিবার জন্য সেই পুরাতন অনুরোধ , তাহার
পরের ছত্রগুলি ধ্যাবরাইয়া গিয়াছে - কিছু বোঝা গেল না । প্রয়াগ
হাট চৌবাঘা নয় , তাহা সম্ভবত দাখিঠাকুরাণী জানিতেন না । বুঝিলাম
ঠাকুরাণীর সহিত সাক্ষাত হওয়া সম্ভব নয় । তথাপি পূর্ণমনষ্কাম
বৃদ্ধার উল্লাস দেখিতে বড় আগ্রহ হইল । নোন মতে যদি সন্ধান
করিতে পারি ভাবিয়া প্রয়াগে চলিলাম ।
সমস্ত দিন ঘুরিয়া নিষ্ফল হিয়া ফিরিতেছি এমন সময় চৌভাঘার সাধন
মিস্ত্রির সঙ্গে অকস্মাৎ সাক্ষাৎ হইল । আমাকে দেখিয়া সাষ্টাঙ্গে
প্রণাম করিয়া সে কহিল , " ভাল হল ডাক্তার দাদা - কয়টা
মাল খালাস করে দিতে হবে ।" সে কথয় কান না দিয়া বুড়ীর
কথা জিজ্ঞাসা করিলাম । " আজ্ঞে তেনারাইতো মাল - তিনি
তো ওলাউঠা হয়ে - " ক্ষণিকের মধ্যে দাখিঠাকুরাণী যেন চক্ষের
সম্মুখে জীবন্ত হইয়া উঠিলেন , শুনিলাম বেণুবনে প্রচ্ছন্ন একটি
কুটীরের ছিন্ন শয্যায় শয়ান এক বৃদ্ধা অশ্রু সজল উৎসুক দৃষ্টিতে
আমার দিকে চাহিয়া যেন কহিতেছে - " হাড় ক'খানা গঙ্গায়
দিস্ ভাই ।" একটু থামিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম , " কবে
মরেছেন ? সৎকার করলে কে ? "
সাধন সহজ ভাষায় কহিল , " হপ্তা খানেক !" তাহার পর
মৃত্যুর একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমাকে জানাইল । প্রয়াগে আসিয়াই
তাঁহার কলেরা হয় এবং সঙ্গের লোকজন হাসপাতালে খবর দিয়া তলপীতলপা
লইয়া প্রস্থান করে । হাস্পাতালেই বুড়ীর ঈশ্বরপ্রাপ্তি হইয়াছে
। সাধন শ্রীদাম মাঝির মুখে খবর শুনিয়া দেখিতে আসিয়াছিল ।
কথা না কহিয়া হাসপাতালে গিয়া সংবাদ লইলাম । কথা যথার্থ । কলেরা
হইয়া তিরিশে তারিখে দাখি নামে একটা বাঙালী বুড়ীর মৃত্যু হইয়াছে
। কোন্ জাতের স্ত্রীলোক না জানাতে কেহ সৎকার করিতে রাজী হয়
নাই ; এগার নম্বরের প্লটে মাটি দেওয়া হইয়াছে ।
এগার নম্বরের প্লট দেখিতে গেলাম । তখনও জন কুড়ি লোকের মাটি
দেওয়া হইতেছিল । ডোমের কাছে প্রশ্ন করিয়া বুঝিলাম যে , দাখিঠাকুরাণীকে
উদ্ধার করা অসম্ভব , যেহেতু তাহারও পরে প্রায় শ'খানেক তীর্থকামী
ঐ একই স্থানে বিশ্রাম করিতে আসিয়াছে ।
গঙ্গার দিকে চাহিলাম , বহুদূর । তবে ভরসা আছে কোন কালে মাতা
জাহ্ণবী ভাঙনের আনন্দে নৃত্য করিতে করিতে এগারো নম্বরের প্লটে
আসিয়া পৌছিবেন , সেইদিন বৃদ্ধার মনস্কাম পূর্ণ হইবে । সেই
ভাঙনের দিনের প্রতীক্ষা করিয়া দাখিঠাকুরাণীর অস্থি কয়খানি
বসিয়া থাকিবে তাহাতে আমার সন্দেহ রহিল না ।
রবীন্দ্রনাথ
মৈত্র
( ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের ‘প্রবাসী’র ভাদ্র
সংখ্যায় প্রকাশিত )