প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)


মনস্কাম

[ লেখক পরিচিতি : রবীন্দ্রনাথ মৈত্র ১৮৯৬ সালে (১৩০৩ বঙ্গাব্দে) পিতার কর্মক্ষেত্র রংপুরে ( বাংলাদেশ ) জন্মগ্রহণ করেন; তবে পৈত্রিক নিবাস ছিল ফরিদপুরের নাদুরিয়ায়। পিতার নাম প্রিয়নাথ মৈত্র। রবীন্দ্রনাথ মৈত্র অনেক গল্প, কবিতা ও নাটকের রচয়িতা। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে তার রচিত নাটক 'মানময়ী গার্ল্স স্কুল' প্রথম ষ্টার থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় ১৯৩২ সালের ২০শে ডিসেম্বর । নাটকটি তাকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। এ নাটকটি পরে বহুবার মঞ্চস্থ হয়েছে। এটি প্রথম চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে জ্যোতিষ ব্যানার্জির পরিচালনায়; মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন জহর গাঙ্গুলী ও কানন দেবী। ১৯৫৮ সালে পরিচালক হেমচন্দ্র নাটকটিকে নিয়ে দ্বিতীয়বার ছায়াছবি প্রস্তুত করেন; এবার অভিনয়ে ছিলেন উত্তমকুমার ও অরুন্ধতী দেবী। নাটকটি এতই জনপ্রিয় হযেছিল যে এটিকে নিয়ে তেলেগু ভাষায় রূপায়িত হয় ছায়াছবি ‘মিস্সাম্মা’ (Missamma) এবং তামিল ভাষায় ‘মিস্সিয়াম্মা’ (Missiyamma)। ১৯৫৭ সালে নাটকটি অবলম্বন করে তৈরী হয় হিন্দি ছবি ‘মিস মেরি’ (Miss Mary)। রবীন্দ্রনাথ মৈত্রের অন্য্যন্য রচনা : ‘সিন্ধু সরিৎ’ (কবিতা ১৯২৬); ‘মায়ার জাল’ (উপন্যাস); ‘বাস্তবিকা’ (গল্প ১৯৩২); ‘ত্রিলোচন কবিরাজ’ (গল্প ১৯৩৩); ‘দিবাকরী’, ‘উদাসীর মাঠ’ (১৯৩২); ‘মেবার কাহিনী’; ‘মডার্ন গৌরী’; ‘নিরঞ্জন’ প্রভৃতি। তিনি কিছুকাল ‘শনিবারের চিঠি’ ও সম্পাদনা করেছেন। ‘দিবাকর শর্মা’ ছদ্মনামে তিনি লিখতেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘দধিকর্দম’ তারই রচনা। ১৯৩৩ সালে (১৩৩৯ বঙ্গাব্দ) ম্যালিগন্যান্ট ম্যালিরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তিনি পরলোক গমন করেন। তার পরিবারের লোকজন তার মৃত্যুর ৭৭ বছর পরে ২০১০ সালের ২৪শে জুলাই তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি স্মরণ সভার আয়োজন করেন।       দীপক সেনগুপ্ত]


বড়দিনের ছুটিতে পকেটে ষ্টেথস্স্কোপ ও হাতে ব্যাগ লইয়া চৌভাঘায় মামাবাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইয়াছিলাম । মামী-মাকে প্রণাম করিয়া কেবল দাঁড়াইয়াছি , এমন সময় একটি ছেলে আসিয়া কহিল , "আপনাকে ডাকছে ।"
মামাবাড়ীতে মাঝে মাঝে আসিতাম , দুই-এক জন বন্ধুবান্ধবও জুটিয়াছিল , তাহাদেরই কেহ সম্ভাষণ জানাইতে আসিয়াছে ভাবিয়া তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিলাম । একটি বৃদ্ধ ভদ্রলোক বারান্দায় দাঁড়াইয়াছিলেন , আমাকে দেখিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন , "আপনি ডাক্তার ?"
কহিলাম , "হ্যাঁ , কেন বলুন তো ?"
বৃদ্ধ কহিলেন , "ভালই হয়েছে । আপনাকে পাল্কী থেকে নামতে দেখেই ছুটে এসেছি । একটু যেতে হবে । গরীব মানুষ দয়া না করলে - " কোথায় যাইতে হইবে , কাহার অসুখ , সে কথা আর জিজ্ঞাসা করিলাম না , ষ্টেথস্স্কোপটি পকেটে ফেলিয়া ভদ্রলোকের সঙ্গ ধরিলাম । মিনিট পনেরো পর বাঁশের ঝোপে ঘেরা একখানি একচালা ঘরের আঙ্গিনায় গিয়া দাঁড়াইলাম । ঘরের দরজায় একটি যুবক গামছা কোমরে জড়াইয়া দাঁড়াইয়া ছিল , ডাকিল , " ভিতরে আসুন ।" কোমরে গামছা জড়ান মানুষ দেখিয়াই বুঝিলাম যে , সম্ভবতঃ রোগীর আর ডাক্তার দেখাইবার বেশি দিন প্রয়োজন হইবে না ।
ঘরে ঢুকিলাম । ঘরের কোণে বাঁশের মাচার উপরে একটি বৃদ্ধা শুইয়াছিলেন । বুঝিলাম , ইহারই রোগ আরোগ্য করিবার জন্য আমি আসিয়াছি । রোগিণীর পাশে বসিয়া নাড়ী পরীক্ষা করিতেছি , এমন সময় বৃদ্ধা হাত টানিয়া লইয়া কহিলেন , " ও ছাই দেখে হবে কি ! হাত দেখতে পার ?" বলিয়া দক্ষিণ করতল প্রসারিত করিয়া আমার হাতের উপর রাখিলেন । আশ্চর্য্য হইয়া যুবকটির দিকে চাহিলাম । সে একটু মুচকি হাসিয়া আমার কানের কাছে মুখ লইয়া ইংরেজীতে কয়েকটি কথা ফিস ফিস করিয়া কহিয়া গেল ।
ব্যাপারটা কতক বুঝিলাম । মৃত্যু-পথযাত্রীর নিকট মিথ্যা কথা কহিবার প্রবৃত্তি ছিল না , তথাপি পরিহাস করিবার চিরন্তন স্বভাবটি পরিত্যাগ করিতে পারিলাম না ; কহিলাম , " একটু একটু পারি বৈ কি ?"
বৃদ্ধার চোখ দুটি অকস্মাৎ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল , " তবে দেখ তো ভাই , অদেষ্টে তীত্থ আছে কি না ?" বলিয়া কাতর উৎসুক দৃষ্টিতে বৃদ্ধা আমার দিকে চাহিলেন । কি বলিতে হইবে যুবকটির কথার আঁচে আমি পূর্ব্বেই বুঝিয়াছিলাম ; বৃদ্ধার করতলের দিকে ক্ষণকাল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাহিয়া বিস্ময়ের ভাণ করিয়া কহিলাম , " উঃ ! বিস্তর তীর্থ দেখছি !" বৃদ্ধার মুখখানি প্রসন্ন হইয়া উঠিল , আমার ডান হাতখানি মুঠা করিয়া ধরিয়া তিনি কহিলেন , " মিছে কথা বল্ছিস নে তো ভাই ?" অসঙ্কোচে কহিলাম , " মোটেই না , হাতের চার দিকেই তীর্থ , তবে সব দরজা বন্ধ বলে যেতে পারেন নি । এইবার দরজা খুলবে ।" মনে মনে করিলাম , " দক্ষিণ দুয়ার ।" আগ্রহভরে রোগিণী বালিশে ভর দিয়া উঠিতে চেষ্টা করিয়া পড়িয়া গেলেন । আমি কহিলাম , "ব্যস্ত হলে তো হবে না , সেরে উঠুন আগে ।" বৃদ্ধা চোখ না মেলিয়াই কহিলেন , " ধনে পুত্রে লক্ষীশ্বর হও ভাই ।" তারপর নীরবে তার ডান হাতখানি তুলিলেন , বুঝিলাম আশীর্ব্বাদ করিলেন ।
পরিচর্য্যা , ও পথ্য সম্বন্ধে যুবকটিকে দুই একটি উপদেশ দিয়া বৃদ্ধ ভদ্রলোকটির সহিত বাহির হইয়া আসিলাম ।
পথে আসিতে আসিতে আমার সঙ্গীর কাছে বৃদ্ধার জীবনের কাহিনী শুনিলাম । বৃদ্ধার নাম দাখি ঠাকুরাণী । ভাল নাম দক্ষজা , অথবা দাক্ষায়ণী , - যে কোনটি হইতে পারে । দাখিঠাকুরাণীর বিবাহ হইয়াছিল সাত বৎসর বয়সে এবং বৎসর না ঘুরিতেই বিধবা হইয়াছিলেন । সে বহুদিনের কথা । তারপর এই সত্তর বৎসর কাল দাখিঠাকুরাণী তাঁহার স্বামীর বাস্তুভিটায় একখানা একচালা ঘর ও কাঠা দেড়েক জমির সুপারীর বাগানখানি আশ্রয় করিয়া কাটাইয়াছেন । অনাহূত যৌবন দাখিঠাকুরাণীর দেহকেও আক্রমণ করিয়াছিল , সেই সঙ্গে সঙ্গে কিশোর যুবক ও প্রৌঢ় নানা বয়সের নর-সৈনিকেরাও অভিযান শুরু করিয়াছিলেন । কিন্তু একটি শীর্ষহীন সম্মার্জ্জনীর সহায়ে দাখিঠাকুরাণী তাহাদিগকে পরাজিত করিয়াছিলেন । সেই সঙ্গে মাথা নেড়া করিয়া ও স্বহস্তে ডালের কাটা দিয়া মুখখানিকে ক্ষত বিক্ষত করিয়া , কাঁচা তেঁতুল খাইয়া সমস্ত দিন পানাপুকুরে স্নান করিয়া জ্বর ডাকিয়া আনিয়া যৌবনকেও প্রতিহত করিবার নিষ্ফল চেষ্টা করিয়াছিলেন ।

দাখিঠাকুরাণীর শেষ অবলম্বন বৃদ্ধ অন্ধ শাশুড়ী একদিন প্রাতঃকালে সজ্ঞানে গঙ্গালাভ করিলেন ; তখনও যৌবন সগৌরবে দাখিঠাকুরাণীর দেহে রাজত্ব করিতেছিল । ঠাকুরাণী অত্যন্ত কাঁদিলেন এবং বুড়া ঘোষাল মহাশয়ের কাছে গিয়া কাঁদিয়া জানাইলেন যে , তাঁহাকে তীর্থে রাখিয়া আসা হোক । একক তীর্থবাসের বয়স হয় নাই বলিয়া মাতব্বর ঘোষাল মহাশয় তাঁহাকে নিরস্ত করিলেন । সে আজ পঞ্চাশ বৎসর আগেকার কথা । সেই দিন হইতে আজ পর্যন্ত প্রত্যহ দাখিঠাকুরাণী তীর্থযাত্রী , তীর্থবাস ও তীর্থমৃত্যু কামনা করিয়া আসিতে ছিলেন । শেষে এমন অবস্থা হইযাছিল যে গ্রামের কেহ তীর্থ করিতে গেলে তাহাকে শ্বশুরবাড়ী যাইতেছি এবং শ্বশুরবাড়ী না থাকিলে কোন কল্পিত কুটুম্ববাড়ীর নাম করিয়া বাহির হইতে হইত । নতুবা দাখিঠাকুরাণীর উপদ্রবের অন্ত থাকিত না । তিনি আহারনিদ্রা ত্যাগ করিয়া তীর্থকামীর দরজায় ধরনা দিয়া পড়িয়া থাকিতেন । এ জন্য দুর্ভোগও তাঁহাকে কম ভুগিতে হয় নাই । গত বৎসর বৃন্দাবন ঠাকুর চৈত্র মাসে তীর্থে লইয়া যাইবেন আশ্বাস দিলেন । ঠাকুরাণী ত বৈশাখ হইতে আরম্ভ করিয়া চৈত্র হইতে বৃন্দাবন ঠাকুরের পত্নীর সেবা , গোয়াল পরিষ্কার , কাঁথা সেলাই , নারায়ণের ভোগ পাক ইত্যাদি বিচিত্র কাজ অম্লান বদনে করিয়া গেলেন । চৈত্র মাসের তেইশে তারিখে বৃন্দাবন ঠাকুর পাঁজি খুলিয়া চক্ষু কপালে তুলিয়া কহিলেন , " রামঃ ! অকাল দেখছি যে , তীর্থ ত নেই এ বছর !" সেই দিন বাড়ী আসিয়া দাখিঠাকুরাণী শয্যা লইলেন এবং মাস খানেকের মধ্যে বিছানা ছাড়িয়া উঠিলেন না । তাহার পরেই এই ব্যাধি । এই পর্যন্ত বলিয়াই বৃদ্ধ হাসিয়া কহিলেন , " তীর্থ-ব্যাধি আর কি !" কেন জানি না আমি হাসিতে পারিলাম না । পরদিন আবার ডাক আসিল । মামীমা কহিলেন , " ঐ তেত্থ-পাগল বুড়ীর কাছে যাচ্ছিস্ আবার ! জ্বালিয়ে মারবে যে ।"
বুড়ীর প্রতি একটু মমতা জন্মিয়াছিল , মামীর কথা কানে তুলিলাম না ।
গিয়া দেখিলাম দাখিঠাকুরাণী উঠিয়া বসিয়া বেড়ায় ঠেস দিয়া ভিজান সাগু খাইতেছেন । আশ্চর্য্য হইলাম । এ রোগী একদিনে উঠিয়া বসিতে পারে একথা কল্পনাও করি নাই । খুশী হইয়া কহিলাম , " যা হোক্ । উঠে বসেছেন ।"
দাখিঠাকুরাণী হাসিয়া কহিলেন , " তীত্থে যেতে হবে তো ভাই । শুয়ে থাকলে কে সঙ্গে নেবে , তাই প্রসারিত গঙ্গা , আমার মত লক্ষ লক্ষ ডাক্তার আর দাখিঠাকুরাণীর মত কোটি কোটি তীর্থকামী । এ সব কথা বলিয়া আর বুড়িকে ব্যাকুল করিবার ইচ্ছা হইল না । অসঙ্কোচে কহিলাম , " সে অবিশ্যি দেখব দিদিমা , তীর্থে যাবার সময় খবর দেবেন ।"
" - তা দেব বৈকি ভাই - " বলিয়া দাখিঠাকুরাণী আমার মাথায় হাত দিয়া কহিলেন , " আমার বুকের পাষাণ নেমে গেল দাদা , এমন কথা আর কেউ বলেনি ।"
নীরবে প্রণাম করিয়া বিদায় লইলাম । প্রাঙ্গণে নামিয়া শুনিলাম দাখিঠাকুরাণী কহিতেছেন, "মনস্কাম পূর্ণ কর হরিঠাকুর । নারায়ণ । তারকব্রহ্ম।" তারপর নারায়ণের সমস্ত নামগুলিই আবৃত্তি করিতে আরম্ভ করিলেন , আমি শুনিয়া হাসিলাম । আমি নারায়ণ হইলে এতক্ষণে যে দাখিঠাকুরাণীকে নিশ্চয়ই সর্ব্বতীর্থ দর্শন করাইয়া আনিতাম তাহাতে সন্দেহ ছিল না ।



যাহা হোক , নারায়ণ দাখিঠাকুরাণীর প্রার্থনা শুনিলেন , বুড়ীর মনস্কাম পূর্ণ হইল । মামীমা লিখিলেন যে , তাঁহার স্বামীর বসত ভিটাখানি বাদে আর সমস্ত ঘর দরজা তৈজসপত্র লেপকাঁথা ইত্যাদি সিকি মূল্যে বেচিয়া দাখিঠাকুরাণী একদল তীর্থযাত্রীর সঙ্গ লইয়াছেন । শুনিয়া অত্যন্ত সুখি হইলাম ।
তখন প্রয়াগের কাছাকাছি একটা জায়গায় বসন্ত ও বিসূচিকা রোগের প্রতিকারের উপায় সম্বন্ধে বড় বক্তৃতা করিয়া ফিরিতেছিলাম । প্রয়াগে কুম্ভ মেলা আরম্ভ হইয়াছে , মহামারীর অত্যন্ত প্রাদুর্ভাব ; সরকার বাহাদুর অজ্ঞ জনসাধারণকে সতর্ক করিবার জন্য আমাকে পাঠাইয়াছেন । অবকাশ আদৌ ছিল না । এই সময় দশটি বিভিন্ন পোষ্টাপিসের ছাপ খাইয়া একখানি খামের চিঠি আসিয়া পৌঁছিল । পড়িলাম - দাখিঠাকুরাণী প্রয়াগে তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে লিখিয়াছেন । শেষের দিকে কোথাও মরিলে হাড় ক'খানি গঙ্গায় দিবার জন্য সেই পুরাতন অনুরোধ , তাহার পরের ছত্রগুলি ধ্যাবরাইয়া গিয়াছে - কিছু বোঝা গেল না । প্রয়াগ হাট চৌবাঘা নয় , তাহা সম্ভবত দাখিঠাকুরাণী জানিতেন না । বুঝিলাম ঠাকুরাণীর সহিত সাক্ষাত হওয়া সম্ভব নয় । তথাপি পূর্ণমনষ্কাম বৃদ্ধার উল্লাস দেখিতে বড় আগ্রহ হইল । নোন মতে যদি সন্ধান করিতে পারি ভাবিয়া প্রয়াগে চলিলাম ।
সমস্ত দিন ঘুরিয়া নিষ্ফল হিয়া ফিরিতেছি এমন সময় চৌভাঘার সাধন মিস্ত্রির সঙ্গে অকস্মাৎ সাক্ষাৎ হইল । আমাকে দেখিয়া সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিয়া সে কহিল , " ভাল হল ডাক্তার দাদা - কয়টা মাল খালাস করে দিতে হবে ।" সে কথয় কান না দিয়া বুড়ীর কথা জিজ্ঞাসা করিলাম । " আজ্ঞে তেনারাইতো মাল - তিনি তো ওলাউঠা হয়ে - " ক্ষণিকের মধ্যে দাখিঠাকুরাণী যেন চক্ষের সম্মুখে জীবন্ত হইয়া উঠিলেন , শুনিলাম বেণুবনে প্রচ্ছন্ন একটি কুটীরের ছিন্ন শয্যায় শয়ান এক বৃদ্ধা অশ্রু সজল উৎসুক দৃষ্টিতে আমার দিকে চাহিয়া যেন কহিতেছে - " হাড় ক'খানা গঙ্গায় দিস্ ভাই ।" একটু থামিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম , " কবে মরেছেন ? সৎকার করলে কে ? "
সাধন সহজ ভাষায় কহিল , " হপ্তা খানেক !" তাহার পর মৃত্যুর একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমাকে জানাইল । প্রয়াগে আসিয়াই তাঁহার কলেরা হয় এবং সঙ্গের লোকজন হাসপাতালে খবর দিয়া তলপীতলপা লইয়া প্রস্থান করে । হাস্পাতালেই বুড়ীর ঈশ্বরপ্রাপ্তি হইয়াছে । সাধন শ্রীদাম মাঝির মুখে খবর শুনিয়া দেখিতে আসিয়াছিল ।
কথা না কহিয়া হাসপাতালে গিয়া সংবাদ লইলাম । কথা যথার্থ । কলেরা হইয়া তিরিশে তারিখে দাখি নামে একটা বাঙালী বুড়ীর মৃত্যু হইয়াছে । কোন্ জাতের স্ত্রীলোক না জানাতে কেহ সৎকার করিতে রাজী হয় নাই ; এগার নম্বরের প্লটে মাটি দেওয়া হইয়াছে ।
এগার নম্বরের প্লট দেখিতে গেলাম । তখনও জন কুড়ি লোকের মাটি দেওয়া হইতেছিল । ডোমের কাছে প্রশ্ন করিয়া বুঝিলাম যে , দাখিঠাকুরাণীকে উদ্ধার করা অসম্ভব , যেহেতু তাহারও পরে প্রায় শ'খানেক তীর্থকামী ঐ একই স্থানে বিশ্রাম করিতে আসিয়াছে ।
গঙ্গার দিকে চাহিলাম , বহুদূর । তবে ভরসা আছে কোন কালে মাতা জাহ্ণবী ভাঙনের আনন্দে নৃত্য করিতে করিতে এগারো নম্বরের প্লটে আসিয়া পৌছিবেন , সেইদিন বৃদ্ধার মনস্কাম পূর্ণ হইবে । সেই ভাঙনের দিনের প্রতীক্ষা করিয়া দাখিঠাকুরাণীর অস্থি কয়খানি বসিয়া থাকিবে তাহাতে আমার সন্দেহ রহিল না ।

রবীন্দ্রনাথ মৈত্র


( ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের ‘প্রবাসী’র ভাদ্র সংখ্যায় প্রকাশিত )

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।