প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

সানায়ে

[ লেখক পরিচিতি : নারায়ণচন্দ্র ভট্টাচার্য ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে হুগলি জেলার খানাকুলস্থ কৃষ্ণনগরের পোলগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম পীতাম্বর ভট্টাচার্য্য। কাব্য, ব্যাকরণ, স্মৃতি ও বেদান্ত পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি সরকার থেকে তিনবার বৃত্তি লাভ করেন। 'স্বদেশী' মাসিক পত্রিকার (১৩১৩ - ১৩১৫) সম্পাদক ও পরিচালক ছিলেন। 'বিদ্যাভূষণ' উপাধি ও যোগেন্দ্র রিসার্চ পুরস্কারও লাভ করেছেন নারায়ণচন্দ্র। তত্‍‌কালীন বহু পত্রিকাতে তিনি রচনা প্রকাশ করেছেন। তার রচিত উপন্যাস : 'কুলপুরোহিত' ; 'পরাধীন' ; 'মতিভ্রম' ; 'পরাজয়' ; 'মানরক্ষা' ; 'ডিক্রিজারী' ; 'ভবঘুরে' ; 'বিয়েবাড়ি' ; 'নিষ্কর্মা' ; 'স্বামীর ঘর' ; 'গরীবের মেয়ে' ; 'বন্ধুর মেয়ে' ; 'অপরাধী' ; 'নিষ্পত্তি' ; 'নাস্তিক' ; 'প্রেমিকা' ; 'প্রবঞ্চক' ; 'সুরমা' ; 'গিনির মালা' ; 'ঘরজামাই' ; 'একঘরে' ; 'কালোবউ' ; 'রাঁধুনী বামুন' ; 'পূজা' ; 'বন্ধন মোচন' ; 'রাঙা কাপড়ের মূল্য' ; 'সঙ্গীহারা' ; 'স্নেহের জয়' ; 'বারবেলা' ; 'প্রায়শ্চিত্ত' 'মনের বোঝা' ; 'মেয়ের বাপ' ; 'বিধবা' ; 'হিসাব নিকাশ' ; 'পরের ছেলে' ; 'পতিতা' ; 'নিরাশ প্রণয়' ; 'পরাজয়' ; প্রতিদান' ; 'গঙ্গারাম' ; 'গ্রহের ফের' ; 'সতীন পো' ; 'পূজার আমোদ' ; 'অনুরাগ' ; 'অপবাদ' ; 'অভিমান' ; 'মায়ার অধিকার' ; 'ব্রহ্মশাপ' ; 'মণির বর' ; 'দাদা মহাশয়' ; 'জেল ফেরত্‍‌' ; 'ঠাকুরের জন্য' ; 'সুখের মিলন' ; 'বৈরাগী' ; 'ত্যাজ্যপুত্র' ; 'আকালের মা' ; 'উত্তরাধিকারী' ; 'নববোধন' ; 'দুর্বাসা ঠাকুর' ; 'গুরু মহাশয়' ; 'কথাকুঞ্জ' ; 'কণ্ঠিবদল' ; 'মাণিকের মা' ; 'হিন্দু স্ত্রী-ধনাধিকার'। তিনি জৈন পুরোহিত হেমচন্দ্রের 'অভিধান চিন্তামণি' বঙ্গানুবাদ সহ প্রকাশ করেছেন। ১৯২৭ খ্রীষ্টাব্দে নারায়ণচন্দ্রের মৃত্যু ঘটে। ] দীপক সেনগুপ্ত ।

(১)

রসিক হাড়ীর সময়টা একটু অতিরিক্ত মন্দ পড়িয়াছিল। জীবনে তাহার ভাল সময় বড় একটা আসে নাই। একবার আসিয়াছিল, কিন্তু রসিক তাহাকে উপেক্ষার সহিত পরিত্যাগ করিয়াছে। তাহার পর সে কত স্তব্ধ নিশীথে আপনার নয়নের অশ্রুধারা ঢালিয়া সেই দূর অতীতকে আহ্বান করিয়াছে, সানাইয়ে বেহাগের করুণ উচ্ছ্বাস তুলিয়া তাহার চরণে হৃদয়ের অব্যক্ত বেদনা ঢালিয়া দিয়াছে, কিন্তু সে সময় আর আসে নাই; আসিবার সম্ভাবনাও নাই।
প্রসিদ্ধ সানাইওয়ালা যুধিষ্ঠির হাড়ীর পুত্র ও শিষ্য রসিক হাড়ীও যে একজন নামজাদা সানাইদার, এ কথা সকলেই স্বীকার করিত। অনেকে এমনও বলিত, সে সানাইয়ে পিতাকেও ছাড়াইয়া উঠিয়াছে। রসিক কিন্তু একথা স্বীকার করিত না। সে বলিত, তাহার পিতা যেমন ভরা রাত্রে দরবারী কানাড়ার গমকের উপর গমক তুলিত-মূর্চ্ছনা ঢেউয়ের মত উঠিত, ভৈরবীর কোমল ধৈবত ও নিখাদের মধ্যে যে মূর্চ্ছনা দিয়া মধ্যমে আনিয়া মিলাইত, সেটুকু রসিক এতদিনেও আয়ত্ত করিতে পারে নাই; কখনও পারিবে কি না সন্দেহ। সুরজ্ঞ শ্রোতারা বলিত, "এটা রসিকের বিনয়।" অপরে বলিত, "হবেও বা, যুধিষ্ঠির একজন ক্ষণজন্মা সানাইদার ছিল।"
পিতার মৃত্যুর পর রসিক যখন পিতার লায়েক বাড়ীর বাঁধা সানাইদার হইল, যখন অর্থ ও সম্মান কিছুরই অভাব রহিল না, তখন পাঁচ কুটুম্বে ও ভাই ব্রাদারে অনুরোধ করিল, "রসিক, এবার একটা বিয়ে কর।" রসিকেরও ইহাতে আপত্তি ছিল না, তবে একটু বাধা ছিল।
যুধিষ্ঠির জীবিত থাকিতেই পুত্রের বিবাহের চেষ্টা করিয়াছিল। পাত্রীও স্থির হইয়াছিল। পাত্রী প্রতিবেশী সদা হাড়ীর মেয়ে বসুমতী বা বসী। এক কম তিন গণ্ডা টাকা পণও হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু বিয়ের কিছু আগে বসীর মা যখন শুনিল যে, রসিক যুধিষ্ঠিরের বিয়ালী (বিবাহিতা) স্ত্রীর সন্তান নহে, সাঙ্গালী (বিধবা বিবাহকরা) স্ত্রীর সন্তান, তখন সে রসিককে মেয়ে দিয়া আপনার কুলগৌরব নষ্ট করিতে চাহিল না। সম্বন্ধ ভাঙ্গিয়া গেল, বসীর অন্যত্র বিবাহ হইল। যুধিষ্ঠির অন্য সম্বন্ধ দেখিবার পূর্ব্বেই মহাকালের আহ্বানে আকুল হইয়া উঠিল, অনাহত সুরের ডাক শুনিতে শুনিতে কালের সুরের খেলা ভাঙিয়া কোন অজ্ঞাত দেশে চলিয়া গেল।
রসিকের মা অনেক আগেই মারা গিয়াছিল। সুতরাং পিতার মৃত্যুতে রসিক সংসারে সম্পূর্ণ একা হইয়া পড়িল। সানাইটীকেই একমাত্র সঙ্গী করিয়া রসিক নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করিতে লাগিল। সে সানাই বাজাইয়া যথেষ্ট উপার্জ্জন করিত, কিন্তু তাহাতে তাহার মনের কোন সুখই ছিল না। সর্ব্বদাই মনের ভিতর একটা বিচিত্র অভাবের তাড়না ভোগ করিত। এই তাড়নার হাত হইতে অব্যাহতি লাভের জন্য সে অর্জ্জিত অর্থ প্রায় সমস্তই তাড়ী ও মদের আড্ডায় ঢালিয়া দিত। তাহাতেও যখন স্বস্তি পাইত না, তখন সে আপনার নির্জ্জন কুটীরদ্বারে বসিয়া অন্ধকার মাঠের দিকে চাহিয়া সানাইয়ে ফুঁ দিত; সে ফুত্‍‌কারে সানাইয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে করুণ উচ্ছ্বাস স্তব্ধ নিশীথিনীর বক্ষ কম্পিত করিত, সেই উচ্ছ্বাস আরও একটি নারীহৃদয় আলোড়িত করিত-সে হৃদয়ের অধিকারিণী সদা হাড়ীর মেয়ে - জাগরণ ও সুপ্তি-বিমূঢ়া-বসী!


( ২ )

কথায় বলে, "হাতের কাছ পায়ের মোছ, কপাল মুছবার নয়।" বসীর সম্বন্ধেও কথাটা ঠিক খাটিয়া গেল। বসীর মা অনেক খুঁজিয়া পাতিয়া ভাল ঘর ভাল বর দেখিয়া, বসীর বিবাহ দিল, কিন্তু ষেটারা পূজার রাত্রে বিধাতা তাহার কপালের ভিতর যে আঁচড় কাটিয়া দিয়াছিল, তাহা মুছিতে পারিল না। বিবাহের বছর না ঘুরিতেই বসী বিধবা হইল। পনর বত্‍‌সর বয়সে বিবাহ হইয়াছিল, ষোল বত্‍‌সরে ভরাগঙ্গা-বসী তরঙ্গিত যৌবনের পূর্ণ উচ্ছ্বাস লইয়া মায়ের কাছে ফিরিয়া আসিল।
লোকে বলিল, "বসীর মা, বসীর সাঙ্গা দে।"
বসীর মাও বুঝিল, তাহা ছাড়া আর উপায় নাই। তখন সে প্রত্যাখ্যাত রসিকের সঙ্গে ঘণিষ্ঠতা আরম্ভ করিল। রসিক তখন লায়েক বাড়ী হইতে মুঠা মুঠা টাকা, ঘড়া গাড়ু শাল দোশালা লইয়া আসিতেছে। বসীর মা আত্মীয়তা জানাইয়া তাহার কতক কতক ঘরে আনিতে লাগিল। রসিক ইহাতে আপত্তি দেখাইল না বটে, কিন্তু বিবাহের বিষয়ে সে একটুও আমল দিল না। বোধ হয় তাহার মন হইতে পূর্ব্ব প্রত্যাখ্যানের অপমানের ভাব তখনও যায় নাই। মায়ে ঝিয়ে দিনকয়েক আনাগোনা করিয়া, যখন রসিকের মনের ভাবটা বুঝিতে পারিল, তখন তাহারা নিরস্ত হইল।
বসী রূপবতী নয়, কিন্তু সুন্দরী। ইহার উপর যৌবনের স্নিগ্ধ মধুর নবীন রাগে তাহার সেই স্বাভাবিক সৌন্দর্যটুকু আরও একটু সমুজ্জ্বল, আরও একটু মনোহর হইয়া উঠিয়াছিল। সুতরাং রসিক ছাড়া পাড়ার অনেক অবিবাহিত যুবকই বসীদের বাড়ীর মাটি চষিয়া ফেলিল। বসীর মা কিন্তু সহজে কাহাকেও আমল দিল না। অগত্যা আঙ্গুর-টকের-খ্যাঁকশেয়ালীর দল একে একে সরিয়া পড়িল। কেবল একজন সরিল না, সে অর্জ্জুন।
অর্জ্জুনের বাপ হাড়ীপাড়ার মধ্যে একজন সম্ভ্রান্ত অধিবাসী। অর্জ্জুনও সানাইয়ে সুদক্ষ। দ্রোণের কাছে কর্ণ ও পার্থের মত যুধিষ্ঠিরের কাছে রসিক ও অর্জ্জুনের শিক্ষা। দুইজনের মধ্যে কত প্রণয়ও ছিল। এখন বসী আসিয়া সে প্রণয়ের মধ্যে দাঁড়াইয়াছে। অর্জ্জুন ও রসিক এখন প্রতিদ্বন্দী। রসিক কুমার, অর্জ্জুন বিপত্নীক। তাহার বাপ তখনও জীবিত। বাপ ছেলেকে পুনরায় সংসারী করিবার ইচ্ছায় ভাল মেয়ে ও যোগ্য কুটুম্ব খুঁজিয়া বেড়াইতেছিল। অর্জ্জুন কিন্তু বসীকে দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছিল, এবং পিতার সম্পূর্ণ মত না থাকিলেও বসীকে ও বসীর মাকে প্রসন্ন করিবার চেষ্টায় ফিরিতেছিল।
অর্জ্জুন প্রত্যহ সন্ধ্যার পর সানাই হাতে বসীর মার কুটীরে উপস্থিত হইত, এবং বসীর মার সঙ্গে কিছুক্ষণ সুখদুঃখের গল্প করিয়া বসীকে সানাই শুনাইত। সে বাছিয়া বাছিয়া ভাল সুর বাজাইত। সুরের মাঝে মাঝে ফাঁক ধরিয়া তাহাতে যত রকম কায়দা দেখান যাইতে পারে তাহা দেখাইত। তাহার ফুত্‍‌কারে ও অঙ্গুলী সঞ্চালনের কৌশলে নির্জ্জীব সানাই সজীব মানুষের মত কখন হাসিত, কখন কাঁদিয়া ভাসাইয়া দিত, কখন বা বিরহের অকুল তান তুলিয়া করুণ স্বরতরঙ্গে সমস্ত আকাশ প্লাবিত করিত। কিন্তু তাহার এই প্রাণঢালা সঙ্গীতের সব রেসটুকু যে বসীর কাণে যাইত এমন বোধ হইত না। সে আপন মনে চাটাই বুনিত, পাতা গুছাইত! শেষে রাত বেশী হইলে, হাই তুলিয়া আলস্য ভাঙ্গিয়া উঠিয়া দাঁড়াইত। অর্জ্জুন নৈরাশ্যের দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া সানাই বন্ধ করিয়া ঘরে যাইত।
তারপর গভীর নিশীথে যখন পল্লীর অপর প্রান্ত হইতে আর একটি সানাইয়ের করুণ সুর উত্থিত হইত, তখন বসী তন্দ্রাঘোরে চমকিয়া উঠিত, এবং বংশীধ্বনিমুগ্ধ কুরঙ্গীর ন্যায় রুদ্ধশ্বাসে উত্‍‌কর্ণ হইয়া তাহা শুনিত। শুনিতে শুনিতে তাহার মনে হইত, যেন কোনা্‌ অতৃপ্তহৃদয় আবেশময়ী তৃষিত প্রাণের করুণ বেদনা এই সুরের মধ্যে ঢালিয়া দিয়া তাহারই উদ্দেশ্যে এই ক্ষুদ্র কুটীরপ্রান্তে পাঠাইয়া দিতেছে। এই আকুল কণ্ঠের করুণ প্রার্থনা শুনিতে শুনিতে, ভাবিতে ভাবিতে সে যে কখন ঘুমাইয়া পড়িত, কখন যে সে মোহন সুরের তরঙ্গ নৈশাকাশে বিলীন হইয়া যাইত, তাহা সে জানিতেও পারিত না।
কিন্তু সকালে বসী চাটাই মাথায় লইয়া হাটে যাইবার সময় যখন দেখিত, রসিক তাড়ীর নেশায় আচ্ছন্ন হইয়া কুটীরের রোয়াকে ছেঁড়া চাটাইয়ের উপর অচেতন অবস্থায় পড়িয়া আছে, বমিতে বিছানা ভিজিয়া গিয়াছে, রাস্তায় পর্য্যন্ত বমির বিশ্রী দুর্গন্ধ ছুটিয়াছে, তখন তাহার রজনীর ভ্রম ঘুচিয়া যাইত; ঘৃণার সহিত ভাবিত, "ছি ছি, এই কি সেই সানাইদার? এই কি প্রতি নিশীথে সুর-মন্দাকিনী বহায় এবং প্রতিদিনই এই বীভত্‍‌স কাণ্ড করে! এ যে বদ্ধ মাতাল! অর্জ্জুন এত মিষ্ট বাজাইতে পারে না বটে, কিন্তু সে তো এমন মাতাল নয়। ও সে মানুষ, আর এ ভূত!" তবুও বসীকে ভূতেই পাইয়াছিল; ভবিষ্যতের জন্য সে কোনও দিন মাথা ঘামায় নাই, এবং বর্ত্তমানের কুহেলিকা সে ভেদ করিতে প্রয়াস পায় নাই।
আর রসিক তাহার শূন্য কুটীরদ্বারে বসিয়া যখন দেখিত, পূর্ণ যৌবনভারাবনত দেহ লইয়া বসুমতী ধীর মন্থর পদক্ষেপে লাবণ্যের মধুর তরঙ্গ তুলিতে তুলিতে, অধীর কটাক্ষে বিদ্যুতের তীব্রশিখা বিকীরণ করিতে করিতে, স্তব্ধ মধ্যাহ্ণে, অলস সন্ধ্যায় তাহার কুটীরপার্শ্ব দিয়া চলিয়া যাইতেছে, তখন রসিকের বুকের ভিতর একটা তীব্র আকুলতা আসিয়া চাপিয়া বসিত, একটা তীব্র লাবণ্যের ছায়ায় সংসারটা যেন অন্ধকার হইয়া আসিত, সুখদুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, জীবনমৃত্যু, সকলই একটা নির্ম্মম ব্যর্থতার মধ্যে চাপা পড়িয়া যাইত। সে বসিয়া বসিয়া ভাবিত, "হায়, বসুমতীকে যদি পাইতাম!" ভাবিত বটে, কিন্তু পাইবার চেষ্টা রসিক একবারও করিত না।
বড় বড় বাড়ীতে বিবাহে, পূজায় রসিকের বায়না হইত। বাজনায় সন্তুষ্ট করিয়া সে কত টাকা, কাপড়, শাল দোশালা, ঘড়া, গাড়ু বকসিসা্‌ পাইত। রসিক কতক নিজে লইত, কতক সঙ্গীদের বিলাইয়া দিত। বিবাহবাড়ীতে যখন নবদম্পতী বাসরঘরে বসিয়া স্বপ্নলোকে বিচরণ করিত, তখন রসিক দ্বার-প্রান্তে বসিয়া, সানাইয়ে সাহানার মধুময় মিলনের উচ্ছ্বাস তুলিয়া গাহিত-"এসো এসো বধুঁ এসো বসো হে হৃদয়-মন্দিরে।" তাহার সে আকাঙ্ক্ষাভরা স্নিগ্ধমধুর সুরের মূর্চ্ছনা আসিয়া যেন নবদম্পতীকে জড়াইয়া ধরিত।
লোকে বলিত, "রসিক তুই বিয়ে কর।"
রসিক হাসিয়া বলিত, "এইবার করবো।"
তাহার সে ফুটন্ত হাসিটুকুর ভিতর যে দীর্ঘনিশ্বাস চাপা থাকিত, তাহা কেহ দেখিতে পাইত না, রসিকও বিবাহের কোন চেষ্টা করিত না।


( ৩ )

"বলি তোর জ্বালায় কি মানুষ একটু নিশ্চিন্তি হ'য়ে ঘুমুতেও পাবে না?" কথাটা বসুমতী খুব রাগিয়াই বলিল, বলিয়াই রসিকের বোধ হইল। সে মৃদু হাসিয়া উত্তর করিল, "আমি তো কাউকে ঘুমুতে বারণ করি না।"
বসুমতী পূর্ব্বের ভাবেই চোখমুখ ঘুরাইয়া বলিল, "বারণ তো করিসা্‌নে। দুপুর রেতে বসে বসে সানাই ফুঁকিসা্‌ কিসের লেগে বল তো?"
রসিক। আমার এই স্বোভাব।
বসু। অমন স্বোভাবের মুখে ঝাড়ু মারি।
রসিক হাসিও ছাড়িল না, কোন উত্তরও করিল না। বসুমতী বলিল, "ফের যদি দুপুর রাতে জ্বালাতন করবি, তা হলে তোর ও সানাইকে লাল দীঘির জলসই করবো, তা বলে রাখছি।"
রসিক। তা সানাইখানা তোর কি করেছে রে?
বসু। সে রাত দুপুরে কাণের গোড়ায় পোঁ পোঁ করে কেন?
রসিক চটা্‌ করিয়া বলিয়া ফেলিল, "এই তোরে ভালবাসে ব'লে।"
বসুমতী রাগিয়া ঠোঁট ফুলাইয়া বলিল, " তার ভালবাসার মুখে আগুন, আর তোরও-"
কথা শেষ না করিয়াই বসী রাগে গরা্‌ গরা্‌ করিতে করিতে চলিয়া গেল। রসিক চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। সেই দিন হ'তে সে রাত্রে আর সানাই বাজাইত না।
বসী নিশ্চিন্ত হইয়া ঘুমাইবার জন্য রসিককে সানাই বাজাইতে বারণ করিয়া আসিল বটে, কিন্তু বসী আর নিশ্চিন্ত হইয়া ঘুমাইতে পারিল না। সেই চিরপরিচিতি সুরটী শুনিবার উত্‍‌কণ্ঠায়, সে সমস্ত রাত্রি উত্‍‌কর্ণ হইয়া রহিল। কই সানাই ত আর বাজে না, ঘুম আসিলে চোখ বুজিত, কিন্তু তত্‍‌ক্ষণাত্‍‌ আবার চমকিয়া জাগিয়া উঠিত, ঐ বুঝি সানাই বাজিতেছে। কিন্তু সানাই বাজিল না; দুই দিন গেল, চারিদিন গেল, সপ্তাহ কাটিল, কিন্তু সানাই আর বাজিল না। বসীর বুকের ভিতর জমাট হইয়া উঠিল।
বসুমতী গিয়া রসিককে বলিল, "তুই যে আর বড় সানাই বাজাসা্‌ নে?"
রসিক তাহার ভাব দেখিয়া প্রথমটা বিস্মিত হইল; তারপর ঈষত্‍‌ হাসিয়া বলিল, "বাজালে যে লোকের ঘুম হয় না, কষ্ট হয়।"
বসু। লোকের কষ্ট হয় তাতে তোর কি?
রসিক। লোককে কষ্ট দেওয়া কি ভাল?
বসুমতী ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিল, "ইঃ, তুই যে একেবারে ধম্মিষ্ঠ হ'য়ে পড়েছিসা্‌। ওসব বাজে কথা রাখ; আসল কথাটা কি বল দেখি?"
"আসল কথাটা-তুই যে বারণ করেছিসা্‌ বসি, তাই তো বাজাই না-কথাটা রসিকের ঠোঁটের কাছে আসিয়াছিল, কিন্তু সে তাহা চাপিয়া বলিল, "এর আর আসল নকল কি?"
বসু। আছে বৈ কি।
রসিক কি আছে?
বসু। আসল কথা, তাড়ীর ঝোঁকে এখন আর বাজাবার সময় হয় না।
রসিক। তাড়ী আমি ছেড়ে দিয়েছি।
স্বরে শ্লেষের একটু তীব্রতা আনিয়া বসুমতী বলিল, "সত্যি নাকি? কবে হ'তে ছাড়া্‌লি?"
একটা ছোট চাপা নিশ্বাস ফেলিয়া রসিক বলিল, "যেদিন হতে সানাই ছেড়েছি।"
বসী। দু'টোই ছাড়া্‌লি! কেন, কি দুঃখে?
রসিক। দুঃখে কি সুখে বলা্‌তে পারি না, তবে বলেছি তো লোকের কষ্ট হয়।
বসী। তোর মাথা হয়। তুই বাজাবি; বলছি আমি, বাজাবি।
রসিক। বাজাব।
বসুমতী একটু দাঁড়াইয়া থাকিয়া বলিল, "তা হলে তুই আমার কথাতেই সানাই ছেড়েছিলি?"
রসিক বলিল, "তাই যদি ছেড়েই থাকি, তাতে দোষ কি?"
বসুমতী মুখ ঘুরাইয়া ঝঙ্কার দিয়া বলিল, "দোষ কি? কেন ছাড়বি? আমি তোর কে?" কথা বলিতে বসুমতীর চোখের পাতা কিন্তু কেমন ভারি হইয়া আসিল।
রসিক ধীর শান্ত স্বরে বলিল, "সন্ধ্যা হইয়া এল বসি, ঘরে যা।"
বসুমতী কণ্ঠটাকে আরও একটু উচ্চে তুলিয়া বলিল, "তোর হুকুমে নাকি? তুই আমার কথা শুনিসা্‌ ব'লে মনে করেছিসা্‌ বুঝি আমিও তোর কথা শুনব? আমি এই তোর দোরে চেপে বসলুম।"
পিঁড়েখানা টানিয়া লইয়া বসুমতী বসিয়া পড়িল; আর পর রসিকের দিকে বক্র কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া বলিল, "তাড়িয়ে দিতে পারবি?"
রসিক বলিল, "তা পারব না, কিন্তু না-বসি তুই ঘরে যা।"
দৃঢ়স্বরে বসুমতী বলিল, "আমি যাব না।"
রসিক আর কিছু বলিল না। তেঁতুল গাছের পাশ দিয়া দুই চারিটী নক্ষত্র দেখা যাইতেছিল, রসিক নীরবে তাহার দিকে চাহিয়া রহিল।
কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া বসুমতী উঠিল, "আচ্ছা।"
বসুমতী বলিল, "তুই রাগ করিসা্‌নে রসিক।"
রসিক বলিল, "না। দাঁড়িয়ে আসব?"
গর্ব্বের হাসি হাসিয়া বসুমতী বলিল, "ইস, আমাকে কি বামুন কায়েতের ঘরের মেয়ে পেলি? আমার ভূতের ভয় নেই।"
"না, তুই সত্যিই হাড়ীর মেয়ে।"
বসুমতী ফিরিয়া চাহিল, দেখিল, অর্জ্জুন। বসুমতী তাহার দিকে শুধু একটা ক্রুদ্ধ কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া সগর্ব্বপাদবিক্ষেপে চলিয়া গেল। রসিক স্তব্ধ জড়ের ন্যায় যেমন বসিয়াছিল, তেমনি বসিয়া রহিল। দূরে নীলাকাশে অগণ্য তারকা দীপ্ত হীরকের মত জ্বলিতেছিল। তাহার দিকে তাকাইয়া রহিল। রসিকের বুকের ভিতর ঝড় বহিতেছিল।
বসুমতীর ক্রুদ্ধ কটাক্ষে বিদ্ধ অর্জ্জুন সহজে রসিককে ছাড়িল না, সে পাড়ায় প্রচার করিয়া দিল, 'রসিক সদা হাড়ীর মেয়েকে কুপথগামিনী করিবার চেষ্টা করিতেছে। সে স্বচক্ষে দেখিয়াছে এবং স্বকর্ণে শুনিয়াছে, রসিক সে দিন সন্ধ্যাবেলা বসীকে নিজের ঘরে ডাকিয়া নানা প্রলোভন দিতেছে'। সেই অশিক্ষিত অসভ্য হাড়ীর সমাজে ইহা লইয়া একটা গুরুতর আন্দোলন চলিল, এবং মাতব্বরেরা একযোট হইয়া সিদ্ধান্ত করিল, হয় রসিক উপযুক্ত দণ্ড দিয়া বসীকে সাঙ্গা করুক, নয় তাহার হুঁকা বন্ধ হইবে।
রসিক কিন্তু মিথ্যা অপবাদের দণ্ড স্বরূপ বসীকে সাঙ্গা করিতে রাজী হইল না। সুতরাং সমাজে তাহার হুঁকা বন্ধ হইয়া গেল, মোড়লেরা তাহার 'ডাক' বন্ধ করিয়া দিল। এই অবসরে অর্জ্জুন বসীর মাকে অর্থের প্রলোভনে বাধ্য করিয়া বসীর পাণিগ্রহণ করিল। বিবাহে অর্জ্জুন বেশ দু'পয়সা খরচ করিল। পাঁচ গ্রামের আত্মীয় কুটুম্বের খোঁজ লইল, চারি পাঁচদিন ধরিয়া ভোজ চলিল। আধ মণ তিরিশ সের ধান্যেশ্বরী আসিল, তিনটা শুকর মারা হইল। পাড়ার ছেলে বুড়া সকলেই আমোদে মাতিয়া উঠিল। মাতিল না কেবল রসিক। সে আপনার উলু খড়ে ছাওয়া কুঁড়ের ভিতর বসিয়া দিন কাটাইতে লাগিল; কেবল সন্ধ্যাকালে একবার বাহির হইয়া হাটপাড়ার বাজার হইতে দুই এক ঝাঁপি তাড়ী লইয়া আসিত।
বিবাহের দিন সন্ধ্যার পর হইতে সে সানাইয়ে যে তান ধরিল, সে তান সমস্ত রাত্রির মধ্যে একবারও থামিল না। সে রাত্রিতে সে তান যাহারি কানে গেল, তাহাকেই বলিতে হইল, "এমন করুণ সুর রসিকের সানাই হইতে আর কখনও বাহির হয় নাই।" ভোরের সময় যখন অবশ হস্ত হইতে সানাইটা পড়িয়া গেল, তখন রসিক পাশ হইতে তাড়ীর ভাঁড়টা টানিয়া তাহাতে চুমুক দিল।

( ৪ )

মাঘের শেষে বেড়বাড়ীর ঘোষেদের বাড়ীতে বিবাহ। সেটা অর্জ্জুনের লায়েক বাড়ী হইলেও বাবুরা রসিকের সানাইয়ের সুখ্যাতি শুনিয়া তাহাকেও বায়না করিলেন। রসিক আপনার সানাইটী লইয়া যথাসময়ে ঘোষেদের বাড়ী উপস্থিত হইল।
কিন্তু একটা বড় গোল বাধিল। কোন ঢুলীই রসিকের সঙ্গে সঙ্গত করিতে রাজী হইল না, চারি আনা রোজের কোন সানাইদারও তাহার পোঁ ধরিল না। বাবুরা হুকুম দিলেন, ধমকাইলেন; বাদকেরা হাতযোড় করিয়া বলিল, "আমরা হুজুরের চাকর, কিন্তু একঘরের সঙ্গে বাজিয়ে পরগণার কাছে দায়ী হ'তে পারব না।"
কর্তা হুকুম দিলেন, "রসিক, ভাই আজ খাওয়া-দাওয়া কর, আজ বিয়েটা চুকে যাক, কাল সকালে তোর সানাই শুনব। যদি তোর বাজনা ভাল হয়, তবে তোকেই বাহাল করব।"
রসিক দুই হাত কপালে ছোঁয়াইয়া কর্ত্তাকে অভিবাদন করিল, অর্জ্জুনের মুখ শুকাইয়া গেল।
বিবাহের পরদিন প্রভাতে বরযাত্র ও কন্যাযাত্রদিগের সম্মুখে রসিক ও অর্জ্জুনের পরীক্ষা আরম্ভ হইল। সানাই শুনিবার জন্য গ্রামের ছেলে বুড়া ছুটিয়া আসিল। দান লইবার নিমিত্ত ভিন্ন ভিন্ন গ্রাম হইতে হাড়ী বাগ্‌াদীর মেয়েরা আসিয়াছিল; তাহারাও এক পাশে চাপিয়া বসিল। তাহাদের ভিতর বসীও ছিল; সে একটু আগাইয়া বসিল।
প্রথমে অর্জ্জুন বাজাইল। একজন প্রসিদ্ধ ঢুলী তাহার সহিত সঙ্গত করিল। প্রায় এক ঘণ্টা গান চলিল। সকলেই তাহাকে বাহবা দিতে লাগিল।
তারপর রসিক উঠিল। সে দুইহাত জুড়িয়া বাবুদের অভিবাদন করিয়া করুণনেত্রে ঢুলীদের দিকে চাহিল। ঢুলীরা মুখ ফিরাইয়া লইল। তখন কর্ত্তা হুকুম দিলেন, "অমনি বাজাও।" রসিক একবার ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে হীন প্রতিহিংসাপরায়ণ দলস্থ লোকদের দিকে চাহিয়া সানাইয়ে ফুত্‍‌কার দিল। সে ফুত্‍‌কারের ধ্বনি শূন্যে না মিলাইতেই অর্জ্জুন একটা ঢোল টানিয়া লইয়া বলিল, "আমি সঙ্গত করব।" ঢুলীরা বিস্ময়ে চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া অর্জ্জুনের দিকে চাহিল।
তখন উপযুক্ত সঙ্গের সহিত উপযুক্ত গান চলিল। রসিক ক্ষুদ্র সানাইয়ের ভিতর হইতে সঙ্গীতের সুধাস্রোত বহিতে লাগিল; সুরের পর সুরের তরঙ্গ উঠিয়া আকাশ বাতাস প্লাবিত করিল। শ্রোতৃগণ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় বসিয়া এই অপূর্ব্ব সঙ্গীত-সুধা পান করিতে লাগিল। অর্জ্জুনের গানের সময় কত উল্লাসসূচক ধ্বনি উঠিয়াছিল, কত বাহবা পড়িয়াছিল; কিন্তু এখন আর একটিও বাহবা পড়িল না, কেহ ঠোঁট পর্য্যন্ত নাড়িতে সাহস করিল না। যেন একটু শব্দ করিলেই এই সুরের সূক্ষ তরঙ্গ ছিন্নভিন্ন হইয়া যাইবে। সকলেই রুদ্ধশ্বাসে রসিকের প্রেরণাস্ফীত আবেগ-রক্তিম মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। সকলেই স্তব্ধ; মন্ত্র-মুগ্ধ।
বাজাইতে বাজাইতে রসিক এক একবার অদূরে উপবিষ্টা বসীর দিকে চাহিতেছিল, আর সানাইয়ের প্রতি রন্ধ্র হইতে মধুর হইতে মধুরতর স্বরবৃষ্টি করিতেছিল। সহসা রসিকের ভাবান্তর হইল। সে দেখিল, বসীর মুখখানা ক্রমেই ম্লান হইয়া আসিতেছে, সে মুখে একটা ভারী আশঙ্কার ছায়া যেন গাঢ় হইতে গাঢ়তর হইয়া আসিতেছে। রসিকের তাল কাটিয়া গেল, ঢুলী তাহা সংশোধন করিয়া যাইল। আবার তাল কাটিল, আবার ঢুলী তাহা সংশোধন করিল। এবার একটা মস্ত তাল কাটিয়া গেল। সাবধান করিয়া দিবার জন্য অর্জ্জুন অন্যের অশ্রাব্য স্বরে ডাকিল, "রসিক!"
রসিক একবার অর্জ্জুনের মুখের দিকে চাহিল, বারবার বসীর প্রফুল্ল মুখখানার দিকে চাহিল। তার পর সানাইটা হাত হইতে ফেলিয়া দিয়া সেইখানে বসিয়া পড়িল।
অর্জ্জুন হাত ধরিয়া তাহাকে তুলিল; ভূনিক্ষিপ্ত সানাইটা তাহার হাতে তুলিয়া দিয়া বলিল, "বাজা।"
রসিক কিন্তু বাজাইল না। সে একবার আকুল দৃষ্টিতে চারিদিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিল; দেখিল, সকলেরই উত্‍‌সুক নেত্র তাহার মুখের উপর নিহিত। রসিকের বুকের ভিতরটা উদ্বেলিত হইয়া উঠিল। কোমলকণ্ঠে অর্জ্জুন ডাকিল, "রসিক! ভাই! কি হয়েছে তোর?"
রসিক করুণদৃষ্টিতে অর্জ্জুনের মুখের দিকে চাহিল। অর্জ্জুন ভত্‍‌র্সনার স্বরে বলিল, "মনিবের সামনে কি করিসা্‌? বাজা, তোরই জিত হইবে।"
রসিক হাতের সানাইটাকে সজোরে মাটির উপর আছড়াইয়া দিল; সানাইটা দুই খণ্ড হইয়া গেল। সেই ভগ্ন খণ্ডদ্বয়কে কুড়াইয়া লইয়া রসিক ছুটিয়া সভাস্থল হইতে পলায়ন করিল। লোকে হৈ-হৈ করিয়া উঠিল। কেহ বলিল, "বাজাতে বাজাতে পাগল হয়ে গেছে।" কেহ বলিল, "বেজায় মদ খেয়েছে।" একজন হাড়ীর মেয়ে বলিল, "উপদেবতার দিষ্টি লেগেছে।"
বিবাহ বাড়ী হইতে বিদায় লইয়া অর্জ্জুন রসিকের অনুসন্ধানে তাহার কুটীরে গেল। গিয়া দেখিল, রসিক তাহার ভগ্ন কুটীরখানির ভিতর মাটির উপর পড়িয়া আছে। তাহার পাশে মদের বোতল, তাড়ীর ভাঁড়; আর বুকের উপর সেই ভাঙ্গা সানাইয়ের খণ্ডগুলি।
অর্জ্জুন ডাকিল, "রসিক! ভাই!"
কিম্তু রসিক উত্তর দিল না। বসুমতীও স্বামীর পশ্চাত্‍‌ পশ্চাত্‍‌ আসিয়াছিল। সেও তখন উন্মাদিনী; বলিল, "ওমা, মরে গেছে যে! কে খুন করলে বলা্‌! বলা্‌ কে? তুই।"
অর্জ্জুন তীব্র দৃষ্টিতে বাষ্পাক্রান্ত কণ্ঠে বলিল, "থামা্‌ হারামজাদী, তোর জন্যে আজ আমার দাদা গেল।"

নারায়ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্য

( ⤗নারায়ণ⤘ পত্রিকা ১৩২৩ বঙ্গাব্দ অগ্রহায়ণ সংখ্যা )।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।