দুলের মেয়ে বিন্দী আঠার বৎসর
বয়সে বিধবা হইয়া বছরখানেক পরে যখন যোধপুরের রামু ঘোড়ুইকে সাঙ্গা
করিল, তখন সে একবারও ভাবে নাই যে, তাহাকে শেষে মাছ ধরিয়া,
মাছ বেচিয়া দিন চালাইতে হইবে| বাপ বেচু মাহার জাতিতে দুলে
হইলেও মাছ ধরা তাহার ব্যবসায় ছিল না| তাহার চাষবাস ছিল, ঘরে
সংবৎসরের খোরাকী ধান মরাই বাঁধা থাকিত| তা ছাড়া পাল্কীর সর্দ্দারীও
ছিল, সুতরাং হাড়ভাঙ্গা শীতকে উপেক্ষা করিয়া, পুকুরের জলে নামিয়া
বিন্দীকে কখনও মাছ ধরিতে হয় নাই| জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড রৌদ্রে,
শ্রাবণের অবিরল বারিধারার মধ্যে হাটে বাজারে বা পাড়ায় মাছ
বেচিবার প্রয়োজনও তাহার ছিল না| বিবাহও হইয়াছিল সমান ঘরে;
সেখানেও বিন্দীকে ভাত-কাপড়ের জন্য কখনও ভাবিতে হয় নাই| কিন্তু
বাপ-খুড়ার অমতে সাঙ্গা করিয়া, নূতন স্বামীর ঘরে আসিয়া যখন
তাহাকে এ সকলই করিতে হইল, তখন সে বুঝিতে পারিল, গুরুজনের কথা
না শুনিয়া কাজটা ভাল করে নাই|
জাতীয় সমাজে সাঙ্গা প্রচলিত থাকিলেও বাপের ইচ্ছা
ছিল না যে, মেয়ের সাঙ্গা দেয়| মায়েরও তেমন মত ছিল না| বিন্দী
কিন্তু বারুণীর মেলা দেখিতে গিয়া রামুর মুখের মিষ্ট কথায় যে
একটা ভালবাসার স্বপ্ন লইয়া ঘরে ফিরিয়াছিল, সে স্বপ্নের ঘোরটা
সে কিছুতেই কাটাইতে পারিল না| সুতরাং মা-বাপের অমতেও সে রামুকে
সাঙ্গা করিতে উদ্যত হইল| কন্যার একান্ত আগ্রহ দেখিয়া বেচু
বলিল, "যদি সাঙ্গা কত্তেই হয়, তবে গাংপুরের নিমু ঘোড়ুকেই
সাঙ্গা কর্| রেমো ছোঁড়ার চাল নাই, ওকে সাঙ্গা ক'রে শেষে কি
এক মুঠো ভাতের তরে কেঁদে বেড়াবি?"
বিন্দীর মনে কিন্তু তখন ভাত-কাপড়ের ভাবনাটা
একবারও আসিল না| সে সকলের নিষেধ অগ্রাহ্য করিয়া রামু ঘোড়ইকেই
সাঙ্গা করিল| বাপ প্রতিজ্ঞা করিল, সে আর মেয়ের মুখ দেখিবে
না| বিন্দীও আর বাপকে মুখ দেখাইল না, রামুর হাত ধরিয়া তাহার
ঘর করিতে আসিল| রামুর কুঁড়ে-ঘর, তালপাতার ছাউনী; দরজায় কবাট
নাই, ছেঁচা বাঁশের আগড়| বিন্দী সেই আগড় দেওয়া, তালপাতায় ছাওয়া
কুঁড়েটিকেই স্বর্গ বলিয়া মানিয়া লইল|
কিন্তু দিন কতক পরে বিন্দীকে যখন ছেঁড়া
কাপড়ে লজ্জা নিবারণ করিয়া, জাল ঘাড়ে পুকুরে পুকুরে ঘুরিতে
হইল এবং মাছ বেচার পয়সায় চাল কিনিয়া আনিয়া দিন চালাইতে হইল,
সেই দিন তাহার সাধের স্বর্গটা সহসা যেন কঠোর মর্ত্ত্যে পরিণত
হইয়া আসিল| প্রাণপণ চেষ্টাতেও বিন্দী সেই ভাঙ্গা কুঁড়েটুকুর
মধ্যে স্বর্গের অস্তিত্ব অনুভব করিতে পারিল না| কিন্তু তখন
আর উপায় নাই| স্বর্গই হউক বা মর্ত্ত্যই হউক, সেই ক্ষুদ্র কুঁড়েটুকুকেই
আপনার সুখের কেন্দ্র করিয়া লইয়া বিন্দী দিন কাটাইতে লাগিল|
তা রামুও যে অক্ষম ছিল, পয়সা উপায় করিতে
পারিত না, এমন নয়| সে পাল্কী বহিত, পাল্কীর ভাড়া না জুটিলে
মজুর খাটিত| কিন্তু তাহার উপার্জ্জনের একটি পয়সাও ঘরে আসিত
না| যে দিন যাহা পাইত, তাহা বাজারের সিদ্ধেশ্বর শাহার মদের
দোকানে, অথবা করিমদ্দি চাচার তাড়ির আড্ডায় দিয়া টলিতে টলিতে
ঘরে ফিরিত| ঘরে আসিয়া বিন্দীকে গালাগালি দিত, তাহার মা-বাপের
উদ্দেশে অশ্রাব্য ভাষা প্রয়োগ করিত| বিন্দী কোন দিন মুখ বুজিয়া
থাকিত, কোন দিন গালাগালির উত্তরে দুই একটা গালাগালি দিত| যে
দিন উত্তর করিত, সে দিন বিন্দী স্বামীর নিকট দুই চারি ঘা মার
খাইত| মার খাইয়া কাঁদিতে বসিত, আর রামু টলিতে টলিতে গিয়া দাবার
চাটাই পাতিয়া শুইয়া পড়িত|
তারপর বমিতে যখন চাটাই ভাসিতে থাকিত,
সংজ্ঞাহীন রামুর মুখের ভিতর মাছি ঢুকিত, তখন বিন্দী আসিয়া
সে সকল পরিষ্কার করিয়া দিত, ঘটী করিয়া জল আনিয়া রামুর চোখে
মুখে মাথায় দিয়া তাহাকে বাতাস করিতে বসিত| নেশা ছুটিয়া গেলে
রামু উঠিয়া বসিত| বিন্দী তাহার হাত ধরিয়া লইয়া গিয়া ভাতের
কাছে বসাইয়া দিত| রামু আহার শেষ করিয়া উঠিলে বিন্দী তাহাকে
আঁচাইবার জল দিয়া তামাক সাজিয়া আনিত| রামু দাবায় বসিয়া তামাক
টানিতে টনিতে গুন্ গুন্ করিয়া গাহিত-
"সে কি আমার অযতোনের ধোন|
মনো প্রাণো যারি করে করি সমোপ্পোণ|
সে কি আমার - "
বিন্দী ভাতের গ্রাস মুখের কাছে রাখিয়া
উৎকর্ণ হইয়া শুনিত, রামু গাহিতেছে-
"তবে যে অপ্রিয়ো বোলি, যখন জ্বালাতে জ্বলি,
নতুবা তারি সকোলিই, প্রমেরি কারোণ|
সে কি আমার - "
একটা অবাক্ত আনন্দের উচ্ছ্বাসে বিন্দীর
সকল নির্যাতন-সকল কষ্ট মুহূর্ত্তে মুছিয়া যাইত|
আধ ক্রোশ দূরে বাপের বাড়ী| সুতরাং বিন্দীর কষ্টের কথা মা বাপের
অগোচর ছিল না| বাপ রাগিয়া বলিত, "চুলোয় যাক্ বিন্দী|"
মা কিন্তু রাগ করিয়া থাকিতে পারিত না| সে সময়ে সময়ে আসিয়া
মেয়েকে দেখিয়া যাইত, এবং মেয়ের কষ্ট দেখিয়া কাঁদিতে থাকিত|
বলিত, "আমার ভাত কে খায় বিন্দী, আর তুই এক মুঠো ভাতের
তরে হা হ ক'রে বেড়াস্?"
বিন্দী উত্তর করিত, "কি কর্বো মা,
কপাল|"
মা অক্ষেপ করিয়া বলিত, "তোর কপাল
নয় বিন্দী, আমারই পোড়া কপাল| থাক্ তুই আমার ঘরে; পেটে ঠাঁই
দিয়েছি, হাঁড়ীতে কি ঠাঁই দিতে পার্বো না?"
মুখ নীচু করিয়া বিন্দী বলিত, "তোমার
জামাই যে রাগ কর্বে মা?"
মা রাগিয়া বলিত, "আরে মোর জামাই!
বলে-'ভাত কাপড়ের কেউ নয়, নাক কাট্বার গোঁসাই|' মুখে আগুন অমন
জামাইয়ের|"
ঈষৎ বিরক্তির সহিত বিন্দী বলিত, "ছিঃ
মা!"
মা হাত-মুখ নাড়িয়া উত্তর করিত, "আ
লো, এত দরদ! তবু যদি দু'বেলা উত্তম-মধ্যম না দিত|"
বিন্দী ধীরে ধীরে বলিত, "তা মার্লেই
বা মা, আপনার মানুষ বটে তো|"
মা গর্জ্জন করিয়া বলিত, "খ্যাঙ্রা
মারি অমন আপনার মানুষের মুখে; মার-ধর কত্তে তো আছে, কিন্তু
এই হাড়ভাঙ্গা শীতে তোকে জলে নেমে যে মাছ ধর্তে হয়, তার কি?"
মৃদু হাসিয়া বিন্দী উত্তর করিত, "তা
ধর্লেই বা মাছ, দুলের মেয়ে তো বটি|"
মা রাগে মেয়েকে কতকগুলো তিরষ্কার করিয়া
চলিয়া যাইত| কিন্তু মায়ের প্রাণ, থাকিতে পারিত না| মাঝে মাঝে
দু'সের চাল, এক সের মুড়ি, দু'পোয়া মুসুর কলায়, ক্ষেতের পাঁচটা
বেগুন, বাড়ীর সকলকে লুকাইয়া মেয়েকে দিয়া আসিত|
[ ২ ]
"বিন্দী!"
"কেনে?"
"হাঁড়ী তুল্ছিস্ যে?"
স্বামীকে ভাত দিয়া বিন্দী হাঁড়ী তুলিতেছিল|
উনানের পাশে বেদীর উপর হাঁড়ীটা রাখিয়া তাহার মুখে সরা চাপা
দিতে দিতে বিন্দী বলিল, "হাঁড়ী তুল্বো না তো প'ড়ে থাক্বে?"
রামু ভাতে নুন মাখিতে মাখিতে বলিল, "তুই
খাবি না?"
বিন্দী মৃদুস্বরে উত্তর দিল, "না|"
রা| কেনে?
বি| খিদে নেই|
রা| খিদে নেই, না ভাত নেই?
বি| রাঁধলে তো ভাত থাকবে?
রা| চাল থাক্লে তো রাঁধবি?
বিন্দী ঝঙ্কার দিয়া বলিল, "তোকে
বলেছে চাল নেই, চাল থাক্ না থাক্, রাঁধি না রাধি; সে আমার
খুশী| তোর মরদ মানুষের এত খোঁজে দরকার কি রে?"
ঈষৎ হাসিয়া রামু বলিল, "দূর মাগী,
আমি তোর খোঁজ-খবর নেব না তো নেবে কে?"
বিন্দী মুখ ফিরাইয়া ক্ষুব্ধ-কণ্ঠে উত্তর
করিল, "যম|"
রামু নীরবে কয়েক গ্রাস ভাত উদরস্থ করিয়া
বলিল, "তোর গোসা হয়েছে বিন্দি?"
বিন্দী একটু রাগতভাবে বলিল, "হাঁ,
তোকে বলেচে গোসা হয়েচে|"
স্ত্রীর মুখের দিকে চাহিয়া রামু দৃঢ়স্বরে
বলিল, "আলবোৎ গোসা হয়েচে| কৈ, তুই আমার মাথার কিরে ক'রে
বল্ দেখি?"
বিন্দী ভ্রূকুটি করিয়া ক্রোধকম্পিতকণ্ঠে
বলিল, "দেখ্ মিন্ষে, খেতে বসেছিস্, খেয়ে উঠে যা|"
রামু মুখ নীচু করিয়া ভাত মাখিতে মাখিতে
বলিল, "আমি তো খেতে বসেছি, খেয়ে উঠবো, কিন্তু তুই না
খেয়ে থাক্বি বিন্দি?"
একটু শ্লেষের হাসি হাসিয়া বিন্দী বলিল,
"ভাল রে মিন্ষে, এই যে আমার ওপর দরদ দেখাতে শিখেচিস্?"
রামু গম্ভীরস্বরে বলিল, "কেনে বিন্দী,
আমি কি তোকে দরদ করি না?"
শ্লেষের তীব্রস্বরে বিন্দী বলিল, "খুব
করিস্| এই দুকুর বেলা কত দরদ দেখালি? চোখের কোলটা এখনো ফুলে
আছে|"
লজ্জিতকণ্ঠে রামু বলিল, "বড্ড লেগেচে,
না বিন্দী?"
ঈষৎ হাসিয়া বিন্দী বলিল, "না, মার্লে
কি লাগে?"
রামু নতমস্তকে কোলের ভাতগুলাকে চটকাইতে
লাগিল| বিন্দী একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, "লাগেনি তেমন,
তবে আর একটু হলেই চোখটা যেতো| তো যেতো যেতোই, তুই ব'সে রইলি
যে? খেয়ে নে|"
রামু ক্ষিপ্রহস্তে কয়েক গ্রাস ভাত মুখে তুলিয়া, বাঁ হাতে ধরিয়া
ঘটীর জলটা গলায় ঢালিয়া দিল| বিন্দী বলিল, "ও কি, ভাত
ফেলে উঠ্ছিস যে?"
রামু বলিল, "ফেলে উঠ্ছি না, খেয়েই
উঠ্ছি|"
বি| তবে ওগুলা প'ড়ে রইল কেনে?
রামু| থাক্, তুই খাবি|
রামু উঠিতে গেল| বিন্দী তাড়াতাড়ি আসিয়া
তাহার হাতটা চাপিয়া ধরিল; ব্যগ্রস্বরে বলিল, "আমার মাথা
খাস্, খেয়ে ফেল্, কা'ল আবার তোকে ভাড়া বইতে যেতে হবে|"
রামু বলিল, "আর তুই উপোস থাক্বি?"
বিন্দী বলিল, "আমার খিদে নেই, মাইরি
বল্ছি, আমার খিদে নেই|"
রামু তাহার মুখের দিকে চাহিয়া চাহিয়া
বলিল, "আমাকে ছুঁয়ে বল্ছিস্?"
বিন্দী তাহার হাতটা ছুঁড়িয়া দিয়া উঠিয়া
দাঁড়াইল' গর্জ্জন করিয়া বলিল, "খেতে হয় খা, নয় তো চুলায়
যা| আমি কেনে কথায় কথায় তোর কিরে কত্তে যাব রে মিন্ষে?"
রামু হাসিতে হাসিতে উঠিয়া গেল| বিন্দী
তাহাকে তামাক সাজিয়া দিয়া খাইতে বসিল| রামু তামাক টানিতে টানিতে
ডাকিল, "বিন্দী!"
বিন্দী মুখের ভাত চিবাইতে চিবাইতে উত্তর
দিল, "হুঁ|"
রামু জিজ্ঞাসা করিল, "সত্যি কি ঘরে
চাল ছিল না?"
বিন্দী মুখের ভাতগুলা গিলিতে গিলিতে উত্তর
করিল, "আধসেরটাক প'ড়ে আছে|"
রামু বলিল, "তবে রাঁধ্লি না কেন?"
বিন্দী ঈষৎ রুক্ষস্বরে বলিল, "আজ
রাঁধলে কা'ল কি খাবি!"
রামু রাগিয়া বলিল, "ছাই খাব| কা'ল
খাব ব'লে আজ তুই উপাস দিবি?"
দুঃখিত স্বরে বিন্দী বলিল, "কাজেই,
কা'ল আর মাছ ধর্তে যেতে পারবো না| কোমরে একটা দরদ লেগেছে|"
রামু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া হুঁকা
হাতে বসিয়া রহিল|
বিন্দী আহার শেষ করিয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা
করিল, "ব'সে ব'সে কি ভাব্ছিস্ ঘোড়ই?"
রামু মাথা না তুলিয়াই বলিল, "ভাব্চি,
মদ ছাড়্বো, না তোকে ছাড়্বো?"
বিন্দী বলিল, "মদ কি ছাড়্তে পার্বি?
ছাড়িস্ তো আমাকেই ছাড়্বি|"
রামু মুখ তুলিল; অভিমান-ক্ষুব্ধকণ্ঠে
বলিল, "তোকে ছাড়্বো বিন্দী?"
বিন্দী ঘরে গিয়া বিছানা পাতিয়া রামুকে
শুইবার জন্য ডাকিল| রামু কোন উত্তর দিল না, চুপ করিয়া বসিয়া
রহিল|
দুই তিনবার ডাকিয়া স্বামীর সাড়া না পাইয়া
বিন্দী বাহিরে আসিল, এবং বাঁহাতে কেরোসিনের ডিবা, ডান হাতে
স্বামীর হাত ধরিয়া টানিতে টানিতে বলিল, "তা আমাকে ছাড়িস্
ছাড়্বি, এখন শুবি আয়| কাল সকালে উঠেই আবার তোকে ভাড়ায় যেতে
হবে|"
রামু উঠিয়া ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকিল|
[ ৩ ]
"তোর পায়ে পড়ি
ভূতো, আজ আর খাব না|"
ভূতো ওরফে ভূতনাথ হো হো করিয়া হাসিয়া
উঠিল; হাসিতে হাসিতে বলিল, "কেনে বল্ দেখি, আজ তুই তপিস্বি
হয়েছিস্ না কি?"
রামু বলিল, "না, আমি দিলেসা করেছি|"
ভূতো বলিল, "বিন্দীর কাছে বুঝি?"
ভূতো শ্লেষের হাসি হাসিল| রামু বলিল,
"আমি নিজের মনে মনে দিলেসা করেছি, ও সব আর ছোঁব না|"
ভূ| বিন্দী বুঝি বারণ করেছে|
রা| বারণ কর্বার মেয়ে বিন্দী নয়|
ভূ| তবে?
রা| তবে আবার কি? সে পেটে না খেয়ে আমাকে
খাওয়াবে আর আমি নেশা ক'রে সব উড়িয়ে দেব!
তিরস্কারের পরে ভূতো বলিল, "এই রে, শালা মরেচে, ওরে মুখ্যু,
এই যে তিন তিন কোশ পাল্কী ঘাড়ে ঘুরে এলি, এক পাত্তর পেটে না
দিলে গা গতরের বেদনা যাবে কেন? বৌ আগে, না নিজের জানটা আগে?
বলে-আপনি বাঁচ্লে বাপের নাম?"
রামু ইতস্ততঃ করিতে লাগিল| ভূতো তাহার
হাত ধরিয়া টানিতে টানিতে বলিল, "বেশী না হয়, দুপাত্তর
টেনে যাবি আয়, পয়সা তোকে দিতে হবে না|"
রামু সঙ্গীর কথা ঠেলিতে পারিল না, তাহার
সহিত গিয়া সিদ্ধেশ্বর শাহার দোকানে ঢুকিল| সেখানে দুই পাত্রে
স্থলে চারি পাত্র উজাড় হইয়া গেল; তথাপি রামু উঠিল না| শুধু
একবার বলিল, "ঘরে আজ চাল নাই ভূতো, মাগীটার খাওয়া হবে
না|"
ভূতো আর একপাত্র পূর্ণ করিয়া তাহার হাতে
দিতে দিতে বলিল, "তোকে বলেছে খাওয়া হবে না| তুই দেখছি,
বিন্দীর ভাবনা ভেবে ভেবেই মারা যাবি| তুই যদি কা'ল ম'রে যাস্?'
ভীত কম্পিত কণ্ঠে রামু বলিল, "না
ভূতো, তা হ'লে মাগী আছাড়ি-বিছাড়ি ক'রে ম'রে যাবে|
ভূতো হো হো করিয়া হাসিতে হাসিতে বলিল,
ম'রে যাবে না চেয়ে থাক্বে| তুই দেখিস্, তিন দিন না যেতে যেতে
আবার একটা সাঙ্গা ক'রে বস্বে|"
রামু পাত্রটা গলায় ঢালিয়া দিয়া সক্রোধে
বলিল, "মুখ সাম্লে কথা কইবি ভূতো; বিন্দী তেমন নয়|"
ভূতো ভ্রূকুটী করিয়া বলিল, "রেখে
দে তোর বিন্দী, অমন কত ইন্দির চন্দর দেখা গেছে| নফরা মাজির
বৌটা কি কর্লে দেখলি না! তোর ছাঁচার ধারে পেলা কাহারের বৌটা
বার বার চার বার-"
ভূতো নিজের জন্য একপাত্র ঢালিতে যাইতেছিল| রামু তাহার হাত
হইতে বোতলটা কাড়িয়া লইয়া এক নিশ্বাসে সবটা গলায় ঢালিয়া দিল;
তার পর বোতলটা মেঝেয় আছড়াইয়া দিয়া জড়িত কণ্ঠে বলিল, "লেয়াও
দোসরা বোতল|"
ভূতো বলিল, "আমার ট্যাঁক খালি|"
রামু আপনার কোঁচার খুঁট হইতে টাকাটা খুলিয়া
ছুড়িয়া দিল|
[ ৪ ]
সন্ধ্যা হয় হয়, বিন্দী
উনানে ঘুঁটে দিয়া রান্নার উদ্যোগ করিতেছিল আর রামুর প্রত্যাগমন-প্রতীক্ষায়
রাস্তার দিকে চাহিতেছিল| এমন সময় রামু টলিতে টলিতে আসিয়া উনানে
দাঁড়াইল; উচ্চ স্খলিত কণ্ঠে ডাকিল, "বিন্দী!"
বিন্দী ডালের হাঁড়ীটা উনানে বসাইয়া বাঁশের
চোঙ্গা দিয়া উনানে ফুঁ দিতেছিল, চোঙ্গাটা ফেলিয়া তাড়াতাড়ি
বাহিরে আসিয়া ব্যগ্রকণ্ঠে উত্তর দিল, "এসেছিস্?"
রামু বলিল, "আলবোৎ আস্বো| তোর বাবার
ঘর যে আস্বো না?"
বিন্দী থমকাইয়া দাঁড়াইয়া ঘৃণায় নাসা কুঞ্চিত
করিয়া বলিল, "কথা শোন একবার, আজ আবার খেয়ে মরেছিস্!"
রামু চীৎকার করিয়া বলিল, "চুপ রাও,
তোর বাবার খাই!"
রামু কথা কহিতেছিল বটে, কিন্তু তাহার
পা দুইটা এক মুহুর্ত্তও স্থির থাকিতে পারিতেছিল না| বিন্দী
আসিয়া তাহার হাত ধরিয়া বলিল, "তা খেয়েছিস্ খেয়েছিস্,
এখন শুয়ে পড়্বি আয়!"
রামু হাতটা টানিতে টানিতে বলিল,"
তোর বাবার হুকুমে শোব?"
বিন্দীর পিতার উদ্দেশ্যে রামু একটা কটুক্তি
প্রয়োগ করিল| বিন্দী তাহার হাতটা দিয়া সরোষে বলিল, "তবে
এইখানে প'ড়ে মর্|"
বিন্দী চলিয়া যাইতেছিল, রামু তাহার হাতটা
চাপিয়া ধরিয়া কর্কশ-কণ্ঠে বলিল, "আমি মর্বো! আমি মলে
তুই কাকে সাঙ্গা কর্বি?"
বিন্দী রাগিয়া উত্তর করিল, "যমকে|"
রামু উচ্চকণ্ঠে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল,"কর্বি?"
বিন্দীও উচ্চকণ্ঠে উত্তর দিল, "কর্বো
না ত কি তোকে ভয় ক'রে থাক্বো?"
রামু বিন্দীর হাতটা ছাড়িয়া দিয়া তাহাকে
লাথি মারিতে গেল; কিন্তু পাটা বিন্দীর অঙ্গ স্পর্শ করিল না,
তৎপূর্ব্বে রামু নিজেই উঠানের উপর দুম করিয়া পড়িয়া গেল| বিন্দী
তাড়াতাড়ি তাহাকে ধরিয়া তুলিল| রামু
উঠিয়া টলিতে টলিতে বিন্দীকে তাহার গৃহ পরিত্যাগ করিয়া যাইতে
আদেশ করিল| বিন্দী বলিল, আচ্ছা, কা'ল সকালে যাব|"
রামু বলিল, "না, এখুনি যেতে হবে|"
বিন্দী বলিল, 'আমি যাব না|"
রামু চীৎকার করিয়া বলিল, "তোর বাবাকে
যেতে হবে| তুই যদি না যাস্-"
রামু একটা ভয়ানক কটু কথা বলিল| উত্তরে
বিন্দী তাহাকে গালাগালি করিল| রামু তখন বিন্দীর উপর বাঘের
মত ঝাঁপাইয়া পড়িল এবং তাহাকে মাটীতে ফেলিয়া নির্দ্দয়ভাবে প্রহার
করিতে লাগিল| বিন্দীর চীৎকারে পাড়ার মেয়ে পুরুষ অনেকে ছুটিয়া
আসিল| ভূতো বহু কষ্টে রামুকে টানিয়া আনিয়া তাহাকে গালাগালি
দিতে দিতে শোয়াইয়া দিল| বিন্দী প্রহারে হতচেতন হইয়া পড়িয়াছিল;
সকলে ধরাধরি করিয়া তাহাকে ঘরে আনিয়া শোয়াইল এবং মুখে হাতে
জল দিয়া তাহার চৈতন্যসম্পাদন করিল|
বিন্দীর ছয় মাসের গর্ভ ছিল| সেই রাত্রিতে
তাহার গর্ভস্রাব হইয়া গেল| সে ঘরে পড়িয়া যাতনায় ছট্ফট্ করিতে
লাগিল| ভূতো চার পয়সার কুইনাইন কিনিয়া আনিয়া তাহাকে খাওয়াইয়া
দিল|
রামুর নেশার ঘোরটা যখন একটু কাটিয়া অসিল,
তখন সে বিন্দের যন্ত্রণাসূচক কাতর স্বর শুনিয়া জড়িতকণ্ঠে বলিল,
"কেমন, আর সাঙ্গা কর্বি?"
বিন্দী কাতরস্বরে বলিল, "ওরে-একটু
জল-একটু জল|"
গর্জ্জন করিয়া রামু বলিল, "কভি নেহি,
যাকে সাঙ্গা করা্বি, সেই জল দেবে|"
বিন্দী বলিল, "না ঘোড়ই, আর সাঙ্গা
কর্বো না, তোর পায়ে পড়ি, একটু জল দে|"
রামু উঠিতে গেল, কিন্তু পারিল না; মাথাটা
তুলিতেই তাহা ঘুরিয়া চাটায়ের উপর পড়িয়া গেল|
ভূতো ঘরে যায় নাই, কাপড় দিয়া রোয়াকের
এক পাশে পড়িয়াছিল, সে উঠিয়া জল লইয়া বিন্দীর মুখের কাছে ধরিল;
বলিল, জল খা বিন্দী|"
চমকিত হইয়া বিন্দী বলিল, "তুই?"
ভূতো বলিল, "হাঁ আমি, জল খা|"
ভূতো মুখে জল ঢালিয়া দিল| বিন্দী জল খাইয়া
একটা স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করিল|
বিন্দী ভূতোকে শত্রু বলিয়াই মনে করিত|
ভূতো যে বাস্তবিক তাহার সহিত শত্রুতা আচরণ করিত, তাহা নহে,
বরং সে বিন্দীর অনুরাগ-দৃষ্টি আকর্ষণ জন্য প্রাণপণে চেষ্টা
করিত| তাহার এই চেষ্টাটুকুই কিন্তু বিন্দীর নিকট শত্রুতা বলিয়া
বোধ হইত|
বিন্দী মাছ ধরিতে যাইত, কিন্তু অভ্যাস
না থাকায় বেশী মাছ ধরিতে পারিত না| ভূতোও মাছ ধরিত, সে বিন্দীর
অজ্ঞতা দেখিয়া হাসিত, এবং কিরূপে জাল টানিতে বা তুলিতে হয়,
তাহা শিখাইয়া দিত| বিন্দী কিন্তু উহার উপদেশ গ্রহণ করিত না,
সে যাহা করিতে বলিত, বিন্দী তাহার বিপরীত আচরণ করিত| ইহার
ফলে তিন চারি ঘণ্টা পরিশ্রমের পর বিন্দী যখন দুই গণ্ডা পয়সার
মাছও ধরিতে পারিত না, তখন ভূতো নিজের হাঁড়ী হইতে এক আঁজলা
মাছ লইয়া বিন্দীর হাঁড়ীতে ঢালিয়া দিতে যাইত| বিন্দী তাহার
এই দান লইতে চাহিত না| এক এক দিন সে হাঁড়ী হইতে ভূতোর মাছ-ভরা
আঁজলাটা ঠেলিয়া দিয়া রাগে গর-গর করিয়া চলিয়া যাইত| ভূতো হাঁ
করিয়া চাহিয়া থাকিত; তাহার হাতের মাছগুলা ঝর্ঝর্ করিয়া মাটীতে
পড়িয়া যাইত|
আজি সেই ভূতোকে নিজের রোগশয্যার পাশে
দেখিয়া বিন্দী শুধু চমকিত হইল না, বিরক্তও হইল| ভূতোকে বিন্দীকে
জল খাওয়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, "এখন কেমন আছিস্ বিন্দী?"
বিন্দী রুক্ষস্বরে উত্তর করিল, "তুই
এখানে কেন? ঘরে যাস্নি যে?"
ভূতো বলিল, "তোকে এমনতর দে'খে কি
ঘরে যেতে পারি? তোকে দেখবে কে?"
বিন্দী রাগিয়া বলিল, "যম! কেন, তুই
ছাড়া কি আর দেখবার লোক নাই?"
সহাস্যে ভূতো বলিল, "যে দেখবার,
সে তো মেরে ধ'রে বেহুঁস হয়ে প'ড়ে আছে| তুই একটু জল চাইলে কি
জবাব দিলে, তা শুন্লি তো?"
বিরক্তির সহিত বলিল, "খুব শুনেছি|
তুই এখন যাবি কি না বল্?"
"যাচ্চি" বলিয়া ভূতো বাহিরে
আসিয়া দরজার আগড়টা ভেজাইয়া দিল|
সকালে ভূতোর মুখে সংবাদ পাইয়া বিন্দীর
মা কাঁদিতে কাঁদিতে ছুটিয়া আসিল| সঙ্গে বাপও আসিল| তাহারা
আসিয়া রামুকে কতকগুলা গালাগালি দিল| তারপর ভূতোর পরামর্শমতে
বিন্দীকে ডুলিতে তুলিয়া লইয়া চলিয়া গেল| রামু রোয়াকের এক পাশে
চুপ করিয়া বসিয়া রহিল| শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর কথার একটিও উত্তর
দিল না|
অনেকটা বেলা হইলে রামু উঠিয়া পুকুরে একটা
ডুব দিয়া আসিল| তার পর রান্না করিতে গিয়া দেখিল, উনানের উপর
ডালের হাঁড়ীটা বসান রহিয়াছে| পাশে সরায় কাঁচা মসূর ডাল| রামু
মসূর ডাল ভালবাসিত, এজন্য বিন্দী মাছ বেচিয়া যে দিন দুই পয়সা
বেশী পাইত, সে দিন সে মসূর ডাল কিনিয়া আনিত| মাছের চুপড়ীর
ঢাকা খুলিয়া রামু দেখিল, তাহাতে বড় বড় চারিটা চিংড়ী-মাছ নুন-হলুদ
মাখা অবস্থায় পড়িয়া আছে| চিংড়ী-মাছ রামুর বড় প্রিয়, এ জন্য
বিন্দী চিংড়ী-মাছ পাইলে প্রাণান্তেও তাহা বেচিত না, ঘরে আনিয়া
স্বামীকে ঝোল রাঁধিয়া দিত| মাছের চুপড়ীর পাশেই কর্ত্তিত আলু-বেগুন
রহিয়াছে| রামু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিল| সাম্নের কুলুঙ্গীতে
একমুটা চিড়া-মুড়কী, আর একখানা তিলে পাটালী ছিল| ইহা যে রামুর
জলযোগের জন্যই সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা বুঝিতে বিলম্ব হইল না|
রামু আর সেখানে দাঁড়াইতে পারিল না, ছুটিয়া আসিয়া ঘরে ঢুকিল|
সাম্নের দেওয়ালের কুলুঙ্গীর উপর একটা শূন্য মদের বোতল ছিল|
ত্রামু সেটাকে উঠানে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল| বোতলটা ঝন্-ঝন্ শব্দে
ভাঙ্গিয়া গেল| তখন রামু ঘরের আগড় বন্ধ করিয়া বিন্দীর পরিত্যক্ত
বিছানার উপর শুইয়া পড়িল; শুইয়াই হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল|
[ ৫ ]
বিন্দী চলিয়া যাইবার
পর তিন চার দিন কাটিয়া গেল| রামুর এই দিন কয়টা বড় কষ্টেই কাটিল|
এখনও সে মদ খাইত, বরং পূর্ব্বাপেক্ষা বেশী খাইত| মদ খাইয়া
টলিতে টলিতে আসিয়া, দাবার উপর শুইয়া পড়িত| রাত্রিটা যে কোথা
দিয়া চলিয়া যাইত, তাহা সে জানিতে পারিত না| যখন নেশার ঘোর
কাটিত, জ্ঞান হইত, তখন চোখ মেলিয়া দেখিত, সকালের রোদ আসিয়া
তাহার গায়ে লাগিয়াছে, আর সে ধূলা ও শুষ্ক বমির উপর গড়াগড়ি
দিতেছে| তখন রামুর বিন্দীকে মনে পড়িত, তাহার সেবা মনে পড়িত,
অনুতাপে-আত্মগ্লানিতে তাহার বুকটা যেন ফাটিয়া যাইত| এদিকে
উপবাসে শরীর ঝিম্ঝিম্ করিত, তৃষ্ণায় ছাতি ফাটিতে থাকিত| রামু
ঘরে ঢুকিয়া জল গড়াইয়া, খানিকটা জল ঢক্ঢক্ করিয়া গলায় ঢালিয়া
দিত|
একদিন রামু জল খাইতে গিয়া দেখিল, কলসী শুষ্ক, কা'ল জল তুলিতে
ভুল হইয়াছে| সে রাগে কলসীটা লইয়া আছাড় দিল| মাটীর কলসী শতখণ্ডে
চূর্ণ হইয়া গেল| ভাঙ্গিবার সময় কলসীটা ঝন্ঝন্ শব্দে যেন একটা
বিকট হাসি হাসিয়া তৃষ্ণার্ত্ত রামুকে কঠোর উপহাস করিতে লাগিল|
রামু দাঁতে দাঁতে চাপিয়া চূর্ণ খণ্ডগুলাকে কুড়াইয়া বাহিরে
ফেলিয়া দেল|
দুই দিন অনাহারের পর রামু রাঁধিতে গেল|
কিম্তু রাঁধিবার উপকরণ কোথায় কি আছে, তাহা সে জানিত না| বহু
কষ্টে ভাতে ভাত রাঁধিবার মত যোগাড় করিয়া লইয়া সে উনানে হাঁড়ী
চাপাইল| কিন্তু উনান জ্বালিবার কিছু পাইল না| বিন্দী এখান
সেখান হইতে ঘুঁটে কাঠ সংগ্রহ করিয়া রাঁধিত| রামু বহু কষ্টে
কয়েকখান ঘুঁটে আর আধশুক্না গাছের ডাল সংগ্রহ করিয়া উনান জ্বালিতে
গেল, উনান কিন্তু জ্বলিল না| কেরোসীনের ডিবার তেল ফুরাইয়া
গেল, ধোঁয়ায় রামুর চোখ দুইটা জবাফুলের মত লাল হইয়া উঠিল, তথাপি
উনান জ্বলিল না| রামু রাগে একটা লাঠি আনিয়া হাঁড়ীর উপর বসাইয়া
দিল| হাঁড়ী ভাঙ্গিয়া জল চালে উনান ভরিয়া উঠিল| রামু আপন মনে
গর্জ্জন করিতে করিতে ঘরে গিয়া চাটায়ের উপর শুইয়া পড়িল; শুইয়া
'বিন্দী বিন্দী' বলিয়া কাঁদিয়া উঠিল|
সন্ধ্যার সময় বাজার হইতে দুই পয়সার মুড়ি
কিনিয়া আনিয়া, রামু পিত্তরক্ষা করিল|
সেই দিন রাত্রে রামু স্বপ্ন দেখিল, যেন বিন্দী আসিয়া তাহার
মাথার শিয়রে বসিয়াছে, এবং আস্তে আস্তে তাহার মাথাটা নাড়িতে
নাড়িতে স্নেহমাখা কণ্ঠে ডাকিতেছে, "ওঠ্ না ঘোড়ুই, দুই
দিন তোর খাওয়া হয় নি, খাবি আয়|"
রামু ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল, চীৎকার করিয়া
ডাকিল, "বিন্দী, বিন্দী!"
শূন্য গৃহে পুঞ্জীভূত অন্ধকারের ভিতর
হইতে প্রতিধ্বনি হাসিয়া উত্তর দিল, -"হি হি হি হি!"
রামু অবসন্নভাবে আবার শুইয়া পড়িল|
স্বপ্নে বিন্দীকে দেখিয়া রামুর মনটা বড়
খারাপ হইয়া গেল| সে আর ঘুমাইতে পারিল না, পড়িয়া পড়িয়া নানা
কথা ভাবিতে লাগিল| দরজার আগড়ের ফাঁক দিয়া ভোরের আলো ঘরে ঢুকিলে
রামু উঠিয়া মুখ হাত ধুইল, এবং গামছাখানা কাঁধে ফেলিয়া, খেটে
লাঠিটা লইয়া বিন্দীকে দেখিতে চলিল|
পিছন হইতে ভূতো ডাকিয়া বলিল, "এত
সকলে কোথায় চলেছিস্ রে?"
পাছু ডাকায় বিরক্ত হইয়া রামু উত্তর দিল,
"যাচ্চি|"
ভূতো বলিল, "কোথায় যাচ্চিস্? শ্বশুড়বাড়ী
নাকি?"
অপ্রসন্নভাবে রামু উত্তর করিল, "বিন্দীকে
দেখতে|"
ভূতো বলিল, "আর দেকতে গিয়ে কি হবে,
ফিরে আয়|"
অমঙ্গলাশঙ্কায় রামুর বুকটা দুড় দুড় করিয়া
উঠিল| সে উদ্বেগপূর্ণ দৃষ্টিতে ভূতোর মুখের দিকে চাহিল| ভূতো
বলিল, "বিন্দী যে তোর নামে নালিশ করেছে|"
বিস্ময়াপ্লুতস্বরে রামু বলিয়া উঠিল, "এ্যাঁ!"
ভূতো তখন মাথা নাড়িয়া গম্ভীরভাবে বলিল,
"আমি তো তোকে তখনই ব'লেছিলাম, ও সব সাঙ্গালী মাগীকে বিশ্বাস
নাই, ওরা সব কত্তে পারে|"
ভূতো চলিয়া গেল| রামু ফিরিয়া লাঠি গামছা
ফেলিয়া দাবার উপর বসিয়া পড়িল| সেই দিন মধ্যাহ্ণে রামু যখন
রন্ধনের উদ্যোগে ব্যাপৃত ছিল, তখন বিন্দীর ভাই পেয়াদা সঙ্গে
আনিয়া রামুকে শমন ধরাইয়া গেল|
[ ৬ ]
রামু গিয়া শ্বশুরের
হাতে পায়ে ধরিল, পাড়ায় পাঁচজনের কাছে গিয়া পড়িল| কিন্তু বেচারাম
কাহারও কথা রাখিল না; সে বলিল, "আমার মরায়ে তিন আড়া ধান
আছে, এই ধান বেচে বেটাকে জেলে দেব, তবে আমার নাম বেচারাম|"
গ্রামের করালী চক্রবর্ত্তী মোকদ্দমার
পরামর্শদাতা ও তদ্বিরকারক হইয়াছিলেন| রামু গিয়া তাঁহাকে ধরিল|
কিন্তু চক্রবর্ত্তী মহাশয় বলিলেন, "তাও কি হয় বাপু! আমার
কথায় নির্ভর ক'রেই বেচারী মোকদ্দমায় হাত দিয়েছে, আমি কি কথার
নড়চড় করতে পারি? এতে যে আমার অধর্ম হবে|"
রামু কিন্তু কিছুতেই ছাড়িল না; কাঁদাকাটা
করিতে লাগিল| তাহার কাতরতা দর্শনে চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের প্রাণটা
একটু নরম হইল| তিনি বলিলেন, "তা কি জান বাপু, পেটে খেলেই
পিঠে সয়! গোটা দশেক টাকা দিতে পার তো চেষ্টা দেখি| পরশু মেয়েটাকে
শশুরবাড়ী পাঠাতে হবে| এ তো আর তোমাদের ঘরের মেয়ে পাঠানো নয়,
বিস্তর খরচ, বুঝ্লে?"
রামু ইহা বুঝিল বটে, কিন্তু দশটা টাকা
যে কোথায় পাইবে, তাহাই ভাবিয়া পাইল না| কিন্তু যেরূপ হউক,
টাকাটা সংগ্রহ করিতে হইবে, নতুবা জেলে যাইতে হয়| রামুর মনে
পড়িল, বিন্দীর হাতে আটগাছা রূপার চুড়ী আছে, তাহা বেচিলে দশ
টাকা হইতে পারে| বিন্দী কি চুড়ী দিয়া তাহাকে জেল হইতে রক্ষা
করিবে না|
রামু তক্কে তক্কে থাকিয়া বিন্দীর সহিত
সাক্ষাৎ করিল| ব্যস্তভাবে বলিল, "বিন্দী, তোর চুড়ী ক
গাছা দে|"
ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বিন্দী বলিল, "কেনে
রে?"
রামু বলিল, "করালী ঠাকুরকে দিতে
হবে|"
ঈষৎ হাসিয়া বিন্দী বলিল, "ঘুষ নাকি?"
রামু বলিল, "নয় তো আমাকে জেলে যেতে
হবে|"
বিন্দী বলিল, "তুই জেলে যাবি, তা
আমি চুড়ী দিতে গেলাম কেন?"
রা| তুই যে আমার ইস্তিরী|
বি| মার্বার সময় সে কথাটা মনে থাকে না?
লজ্জিতভাবে রামু বলিল, "আর তোকে
মার্বো না বিন্দী|"
বিন্দী বলিল, "আমি তোর ঘরে গেলে
তো মার্বি?"
রামু জিজ্ঞাসা করিল, "যাবি না?"
মাথা নাড়িয়া বিন্দী বলিল, "উহু|"
রা| তবে কি আবার সাঙ্গা কর্বি?
বি| কর্বো|
রা| সত্যি|
বি| সত্যি|
রামু প্রস্থানোদ্যত হইল| বিন্দী
জিজ্ঞাসা করিল, "চল্লি যে? চুড়ী নিবি না?"
মুখ ফিরাইয়া রামু বলিল, "আর দরকার
নাই|"
রামু দ্রুতপদে চলিয়া গেল| বিন্দী দাঁড়াইয়া
মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল|
ভূতো জিজ্ঞাসা করিল, "কি রে রামু,
মামলার কিছু চেষ্টা বেষ্টা দেখ্লি না?"
উদাসভাবে রামু উত্তর দিল, "কি আর
দেখবো?"
ভূ| তবে জেলে যাবি?
রা| গেলুম বা|
ভূ| বলিস্ কি রে, জেল যে?
রামু হাসিয়া বলিল, "যার পাছু চাইতে
নাই, তার জেলই কি, আর ঘরই বা কি?"
ভূতো একটু চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা
করিল, "সত্যি নাকি বিন্দী আবার সাঙ্গা করবে?"
রামু বলিল, "আমিও তাই শুন্চি| তুই
চেষ্টা দেখ্ না|"
ভূতো সে কথার কোন উত্তর দিল না|
মোকদ্দমার দিন রামু প্রতিবেশীকে তাহার
কুঁড়ে দেখিবার ভার দিয়া আদালতে হাজির হইল|
[ ৭ ]
আদালতে গিয়া রামু
দেখিল, ভূতো ও পাড়ার আরও দুই একজন বিন্দীর পক্ষ হইয়া সাক্ষ্য
দিতে আসিয়াছে| বিন্দীর বাপ উকীল দিয়াছে| চক্রবর্ত্তী মহাশয়
গাছতলয় বসিয়া সাক্ষীদের তালিম দিতেছেন| বিন্দী মাথায় কাপড়
দিয়া এক পাশে চুপ করিয়া বসিয়া আছে| রামুর উকীল দিবার ইচ্ছা
ছিল না| সে একাই জেলে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছে|
অসহায়ের সহায় ভগবান| একজন নূতন উকীল স্বতঃপ্রবৃত্ত
হইয়া রামুর মোকদ্দমা গ্রহণ করিলেন|
মোকদ্দমার ডাক পড়িলে রামু গিয়া আসামীর কাঠগোড়ায় দাঁড়াইল| ফরিয়াদী
বিন্দী দাসীর ডাক পড়িল| বিন্দী মাথায় ঘোমটা দিয়া আদালতের মধ্যে
আসিল| রামুর উকীল তাহাকে জেরা করিবার জন্য প্রস্তুত হইলেন|
রামু দুই হাতে কাঠগড়া চাপিয়া ধরিয়া নতমুখে দাঁড়াইয়া রহিল|
কিন্তু আদালতের প্রশ্নের উত্তরে বিন্দী
যাহা বলিল, "তাহাতে শুধু উকীল কেন, রামু পর্য্যন্ত স্তম্ভিত
হইয়া গেল| বিন্দী বলিল, "হুজুর, আসামী আমার সোয়ামী| ও
আমাকে বড্ড ভালবাসে| ও সে দিন বেশী মদ খেয়ে এসেছিল| আমি ধ'রে
শোয়াতে যেতে ও টাল খেয়ে আমার উপর পড়ে যায়| তাতেই আমার গর্ভ
নষ্ট হ'য়ে গিয়েছে| ও কোন দিনই আমাকে একটি চড়া কথা বলেনি| আমার
বাপের সঙ্গে ওর বনিবনাও নাই, তাতেই আমার বাপ পাঁচজনের মত্লবে
নালিশ রুজু করেছে|"
রামু কাঠগড়ার ভিতর স্থির হইয়া দাঁড়াইতে
পারিল না| বিন্দীর প্রত্যেক কথায় তাহার বুকের ভিতর যেন মুগুরের
ঘা পড়িতেছিল| তাহার ইচ্ছা হইতেছিল, সে চীৎকার করিয়া বলে, "ওগো,
সব মিছে, সব মিছে কথা| আমিই বিন্দীকে মেরে তার সর্ব্বনাশ করেছি|"
হাকিম মোকদ্দমা খারিজ করিয়া দিলেন| রামু
উন্মাদের ন্যায় চীৎকার করিয়া বলিল, "হুজুর!"
পাহারাওয়ালা তাহাকে ধমক দিয়া কাঠগড়া হইতে
বাহির করিয়া দিল| বিন্দী হাত ধরিয়া তাহাকে আদালতের বাহিরে
আনিল|
বাহিরে আসিয়া রামু জিজ্ঞাসা করিল, "এখন
তুই কোথায় যাবি বিন্দী?"
বিন্দী উত্তর করিল, "চুলোয়|"
রা| সাঙ্গা কর্বি না?
বি| কর্বো বই কি|
রা| কাকে?
রামুর মুখের উপর একটা মৃদু কটাক্ষ নিক্ষেপ
করিয়া বিন্দী সহাস্যে বলিল, "আপাততঃ তোলে|"
বেচারাম হতবুদ্ধির ন্যায় হইয়া চক্রবর্ত্তী মহাশয়কে জিজ্ঞাসা
করিল, "ও ঠাকুর মশাই, একি হইলো?"
চক্রবর্ত্তী সক্ষোভে বলিলেন, "আমার
মাথা আর তোর মুণ্ডু হইল| বিন্দী বেটী সব নাট ক'রে দিলে| বেটী
ছোটলোকের মেয়ে কি না, ওর কি একটুও ধর্ম্মাধর্ম্মজ্ঞান আছে?"
ভূতো ঘাড় নাড়িয়া বলিল, "যা ব'লেছ
ঠাকুর মশাই, ভদ্দর নোক না হলে কি ধম্মকম্ম বুঝ্তে পারে?"
চক্রবর্ত্তী হাসিতে হাসিতে বলিলেন, "যাক,
বেটাকে এর ফল ভুগতেই হবে| এখন উকীলের সাড়ে সাত টাকা পাওনা
আছে, সেটা মিটিয়ে দাও হে বেচারাম|"
বেচারাম মুখখানাকে একটু বিকৃত করিয়া কাপড়ের
খুঁট হইতে টাকা বাহির করিবার জন্য গেরো খুলিতে লাগিল| ভূতো
শুনিতে পাইল, রামু তখন গলা ছাড়িয়া গাহিতে গাহিতে চলিয়াছে-
"সে কি আমার অযতোনের ধো-ও-ন্,
সে কি আমার-"